ক.
পরের দিন। ডকের মধ্যে আসামি দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেই এক ভঙ্গিতে। বয়স অনুমান করা যায়: না, তবে পরিণত যৌবনের সবল স্বাস্থ্যের চিহ্ন সর্বদেহে। শুধু আহারের পুষ্টিতে নধর কোমল দেহ নয়, উপযুক্ত আহার এবং পরিশ্রমে প্রতিটি পেশির সুদৃঢ় ছন্দে ছন্দে গড়ে উঠেছে দেহখানি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে মনে হয়, জন্মকাল থেকেই দেহের উপাদানের সচ্ছলতা এবং দৃঢসংকল্পে পরিশ্রমের অভ্যাস নিয়ে জন্মেছে। মাথায় একটু খাটো। তাম্রাভ রঙ। মুখখানা দেখে মুখের ঠিক আসল গড়ন বোঝা যায় না, দীর্ঘদিন বিচারাধীন থাকার জন্য মাথার চুল বড় হয়েছে, মুখে দাড়িগোঁফ জন্মেছে। অবশ্য আগের কালের মত রুক্ষতা নেই চুলে, আজকাল তেল পায় জেলখানার অধিবাসীরা। তবুও দাড়ি-গোঁফ-চুল বিশৃঙ্খল; হতভাগ্যের বিভ্রান্ত মনের আভাস যেন ফুটে রয়েছে ওর মধ্যে; অঙ্গারগর্ভ মাটির উপরের রুক্ষতার মত। নাকটা স্কুল; চোখ দুটি বড়, দৃষ্টি যেন উগ্ৰ। উদ্ধত কি নিষ্ঠুর ঠিক বুঝতে পারছেন না জ্ঞানেন্দ্রনাথ। পরনে সাদা মোটা কাপড়ের বহির্বাস, গলায় তুলসীর মালা, কপালে তিলক।
খ.
—ইয়োর অনার, এই আসামি নগেনের বাল্যজীবনের প্রকৃতি এবং প্রবৃত্তির কথা আমি বর্ণনা করেছি। উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের দ্বারা সত্যের উপর তা সুপ্রতিষ্ঠিত। তারপর এই নগেন গৃহত্যাগ করে চলে যায়। অনুতাপবশেই হোক আর ক্ষোভে অভিমানেই হোক নিরুদ্দেশ হয়ে চলে যায়। এবং দীর্ঘকাল পর সন্ন্যাসী বৈরাগীবেশে ফিরে আসে।
পাবলিক প্রসিকিউটার অবিনাশবাবু তার গতকালকার বক্তব্যের মূল সূত্রটি ধরে অগ্রসর হলেন। হাতের চশমাটি চোখে লাগিয়ে কাগজপত্র দেখে একখানি কাগজ বেছে নিয়ে আবার আরম্ভ করলেন
ইয়োর অনার, আমার বক্তব্যে অগ্রসর হবার পূর্বে আপনাকে আর একবার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের দিকে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করব।
অবিনাশবাবু জুরীদের দিকে তাকিয়ে বললেন– রিপোর্টে আছে জলমগ্ন হয়ে মৃত্যু হলে মানুষের পাকস্থলীতে যে-পরিমাণ জল পাওয়া যায়, এই মৃতের পাকস্থলীতে জল পাওয়া গেলেও তার পরিমাণ তার চেয়ে আশ্চর্য রকমের কম। অর্থাৎ জলমগ্ন হওয়ার কারণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু এক্ষেত্রে হয় নি। অথচ মৃত্যু ঘটেছে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। এবং শবদেহেও সেই লক্ষণগুলি সুপরিস্ফুট। তা হলে হতভাগ্য মরল কী করে? তার প্রমাণ রয়েছে মৃতের কণ্ঠনালীতে সুস্পষ্ট পাঁচটি নখতের চিহ্নের মধ্যে লুকানো। বাঁদিকে একটি, ডানদিকে চারটি। মানুষের হাতের লক্ষণ। আসামি নগেন থানায় এবং নিম্ন আদালতে স্বীকার করেছে, খগেন জলমগ্ন অবস্থায় তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যে সেও ড়ুবে যাচ্ছিল, তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। সে তার থেকে উদ্ধার পাবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করেছিল। সেই অবস্থায় কোনোক্রমে তার ডান হাতটা সে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয় এবং সেই হাত পড়ে খগেনের কণ্ঠনালীতে। সে কণ্ঠনালী টিপে ধরে। খগেন ছেড়ে দেয় বা সর্বদেহের সঙ্গে তার হাত শিথিল হয়ে এলিয়ে যায়। তখন সে ভেসে ওঠে। সে একথা অস্বীকার করে না। এখন দুটি সিদ্ধান্ত হতে পারে। এক, কণ্ঠনালী টিপে ধরার ফলে খগেনের মৃত্যু হওয়ায় সে ছেড়ে দেয় বা এলিয়ে পড়ে, বা মৃত্যুর কিছু পূর্বে মৃতকল্প অচেতন অবস্থায় সে এলিয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, মৃত্যু এই কারণে আসামির দ্বারাই ঘটেছে।
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েও দুটি বিষয়ের বিচার আছে। জটিল, অত্যন্ত জটিল। দুটি বিষয়ের একটি হল, আসামি আত্মরক্ষার জন্য অর্থাৎ মৃত্যু-যন্ত্রণার মধ্যে মানবিক সকল চৈতন্য এবং চেতনা হারিয়ে, এমন ক্ষেত্রে অবশিষ্ট জান্তব চেতনার পক্ষে অতি স্বাভাবিক প্রেরণায় মৃত খগেনের গলা টিপে ধরেছিল, অথবা তার পূর্বেই তার মানসিক কূটবুদ্ধি, লোভ-হিংসাসঞ্জাত ক্রতা ও জীবনের অভ্যস্ত পাপপরায়ণতা এই সুযোগে চকিতে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। যেমন জাগ্রত হয়ে ওঠে নির্জনে অসহায় অবস্থায় নারী দেখলে ব্যভিচারীর পাশব প্রবৃত্তি, আবার। জাগ্রত হয় লুটেরার লুণ্ঠন প্রবৃত্তি, তেমনিভাবে কাল ও পাত্রের সমাবেশে সৃষ্ট সুবর্ণ সুযোগের মত পরিবেশের সুযোগ দেখে জেগে উঠেছিল। ইয়োর অনার, সৎ এবং অসতের দ্বন্দ্বের মধ্যে এই সংসারে কতক্ষত্রে যে বিশ্বাসপরায়ণ অসহায় বন্ধুকে বন্ধু হত্যা করে তার সংখ্যা অনেক! গোপন প্রবৃত্তি সুযোগ দেখে অকস্মাৎ জেগে ওঠে দানবের মত। চিরন্তন পশু জাগে; অসহায় মানুষ দেখে বাঘ যেমন গোপন স্থান থেকে লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক তেমনিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
গোপন মনের পাশব প্রবৃত্তির অস্তিত্বই মানুষের সভ্যতার শৃঙ্খলার ভয়ঙ্করতম শত্ৰু। নানা ছদ্মবেশ পরে নানা ছলনায় মানুষের সর্বনাশ করে সে। আমি সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছি। বলেই বিশ্বাস করি যে, সেই প্রবৃত্তিই সজাগ ছিল আসামির মনের মধ্যে। এখন বিচার্য বিষয় সেইটুকু; ওই জলমগ্ন অবস্থায় আসামির মনের স্বরূপ নির্ণয়! এ নির্ণয় অত্যন্ত কঠিন; অতি জটিল; এর কোনো সাক্ষী নাই। আসামি বলে, সে জানে না। এবং এও বলে যে, সে যদি হত্যা করে থাকে তবে সে মৃত্যু-শাস্তিই চায়। আসামি বৈষ্ণব, এই বিচারাধীন অবস্থাতেও সে তিলকফোঁটা কাটে দেখতে পাচ্ছি। সে এক সময় গৃহত্যাগ করেছিল বৈরাগ্যবশে, জীবহত্যা করে কুলধৰ্ম লঙ্নের জন্য অনুতাপবশে। বার বৎসর পর ফিরে এসে এই সভাইকে বুকে তুলে। নিয়েছিল সুগভীর স্নেহের বশে। সেই ভাইকে সে-ই কুড়ি বৎসরের যুবাতে পরিণত করে তুলেছিল। এই দিক দিয়ে দেখলে অবশ্যই মনে হবে এবং এই সিদ্ধান্তেই আমরা উপনীত হব যে, আসামি যখন ভাইয়ের গলা টিপে ধরেছিল, তখন তার মধ্যে জীবনের মৌলিক আত্মরক্ষার জান্তব চেতনা ছাড়া মানবিক জ্ঞান বা চৈতন্য সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে যে অপরাধ। সে করেছে, সে-অপরাধ অনেক লঘু, এমনকি তাকে নিরপরাধও বলা যায়।
বিচারক জ্ঞানেন্দ্রনাথ আবার তাকালেন আসামির দিকে। মাটির পুতুলের মত সে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তার নিজের মতই ভাবলেশহীন মুখ। তিনি জানেন, এসময় তার মুখের একটি। রেখাও পরিবর্তন হয় না; নিরাসক্তের মত শুনে যান। একটু তফাত রয়েছে। আসামির দৃষ্টিতে বিস্ময়ের আভাস রয়েছে। বিশ্লেষণের ধারা তাকে বিস্মিত করে তুলেছে। বিহ্বলতার মধ্যেও ওই। বিস্ময় তাকে সচেতন করে রেখেছে।
অবিনাশবাবু বলছিলেন কিন্তু যদি এই ব্যক্তি আকস্মিক সুযোগ, লোভ এবং হিংসার বশবর্তী হয়ে নিজের হাতে মানুষ-করা ভাইকে হত্যা করে থাকে তবে সে নৃশংসতম ব্যক্তি এবং চতুরতম নৃশংস ব্যক্তি। এবং সে তাই বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আপাতদৃষ্টিতে একথা অসম্ভব বলে মনে হবে। মনে হবে, এবং হওয়াই উচিত, যে লোক ছাগল মারার অনুতাপে লজ্জায়। সন্ন্যাসী হয়েছিল, যে ভাইকে বুকে করে মানুষ করেছে, যার কপালে তিলক-ফোঁটা, গলায় কণ্ঠী, যে ব্যক্তি ও-অঞ্চলে খ্যাতনামা বৈষ্ণব, সে কি এ-কাজ করতে পারে? কিন্তু পারে। আমি বলি পারে। এক্ষেত্রে আমার দুই কথা। প্রথম কথা, মানুষের শৈশব-বাল্যের অভ্যাস, তার জন্মগত প্ৰকৃতি অবচেতনের মধ্যে স্থায়ী অধিকারে অবস্থান করে। সে মরে না, চাপা থাকে। এবং মানব-জীবন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে অহরহ পরিবর্তনশীল। নিত্য অহরহ পরিবর্তনের মধ্যেই তার জীবনের প্রকাশ এবং সেই প্রকাশের মধ্যে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনও অনেকবার হতে পারে। যে-পথে সে চলে হঠাৎ তার বিপরীত ধরে চলতে শুরু করে। ইয়োর অনার, গৃহধৰ্ম মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। হঠাৎ দেখা যায় মানুষ সন্ন্যাসী হয়ে গেল, আবার দেখা যায়। সেই সন্ন্যাসীই গৈরিক ছেড়ে গৃহধর্ম করছে, মামলা মোকদ্দমা বিষয় নিয়ে বিবাদ সাধারণ সংসারীর চেয়ে শতগুণ আসক্তি এবং কুটিলতার সঙ্গে করছে। যেমানুষ পত্নীবিয়োগে বিরহের মহাকাব্য লেখে, সেই মানুষ কয়েক বৎসর পর বিবাহ করে নূতন প্রেমের কবিতা লেখে।
গ.
জ্ঞানেন্দ্রবাবু বললেন–সংক্ষেপ করুন অবিনাশবাবু। বি ব্রিফ প্লিজ!
—ইয়েস ইয়োর অনার, আমার আর সামান্য বক্তব্যই আছে। সেটুকু হল এই। এই আসামি নগেনের আবার একটি পরিবর্তন হয়েছিল। আমরা তার পরিচয় বা প্রমাণ পাই। সে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পৃথক হবার ব্যবস্থা করছিল এই ঘটনার সময়। কিন্তু এটা বাহ্য। অভ্যন্তরে ছিল দি ইটারন্যাল ট্রায়ঙ্গল্–
—হোয়াট? ভ্রূ কুঞ্চিত করে সজাগ হয়ে ফিরে তাকালেন বিচারক।
–সেই সনাতন ত্রয়ীর বিরোধ, ইয়োর অনার—
–দুটি নারী একটি পুরুষ–?
–এক্ষেত্রে দুটি পুরুষ একটি নারী, ইয়োর অনার—
–ইয়েস।
অবিনাশবাবু বললেন– নারীটি একটি লীলাময়ী।
–লীলাময়ী? ইউ মিন এ মডার্ন গার্ল?
—না, ইয়োর অনার, মেয়েটি লাস্যময়ী। তারও চেয়ে বেশি, স্বৈরিণী। এ হার্লট। ওই গ্রামেরই একটি দরিদ্র শ্রমজীবীর কন্যা। নগেন এবং খগেনের বাপের আমল থেকে ওই মেয়েটির বাপমায়ের সঙ্গে নানা কর্মসূত্রে হৃদ্যতা ছিল। চাষের সময় মেয়েটির মা-বাপ ওদের চাষে খাটত। শেষের দিকে কয়েক বৎসর যখন নগেন-খগেনের বাপ শেষশয্যায় দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিল, তখন স্থায়ীভাবে কৃষাণের কাজও করেছিল। ওদের বাড়িতে মেয়েটির মায়ের নিত্য যাওয়া-আসা ছিল; বাড়ি ঝট দেওয়ার কাজ করত, ওদের বাড়ির ধান সেদ্ধ ও ধান ভানার কাজ করত নিয়মিতভাবে, মাইনে-করা ঝিয়ের কাজ করত। তখন থেকেই ওই মেয়েটিও, চাপা, মায়ের সঙ্গে নিত্য দুবেলাই এদের বাড়ি আসত। এবং বয়সে সে ছিল খগেনেরই সমবয়সী, দুএক বছরের বড়; খগেনের সঙ্গে সে খেলা করত, পরে চাঁপার বিবাহ হয়, সে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। তখন সে বালিকা। আমাদের দেশের নিম্নশ্রেণীর মধ্যে সাত-আট বছর বয়সে বিবাহের কথা সর্বজনবিদিত। তারপর এই ঘটনার দু বছর আগে বিধবা হয়ে সে যখন ফিরে আসে। তখন সে যুবতী এবং স্বভাবে পূর্ণমাত্রায় স্বৈরিণী। সে তার স্বামীর বাড়িতেই এই স্বৈরিণী—স্বভাব অর্জন করেছিল, এবং যতদূর মনে হয়, জন্মগতভাবেই সে ওই প্রকৃতির ছিল। কারণ। ওই শ্বশুরবাড়িতে থাকতেই এই স্বভাবহেতু বহু অপবাদ তার হয়েছিল। দুটি-একটি ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এই চাপা ফিরে এসে স্বাভাবিকভাবেই এবং অতি সহজেই ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী এই প্রিয়দর্শন তরুণ খগেন ছেলেটিকে আকর্ষণ করেছিল। তারপর। আকৃষ্ট হল বড় ভাই। এই চাঁপা মেয়েটিই মামলায় প্রধান সাক্ষী। আসামি নগেন প্রথমটা এই তরুণ-তরুণীর মধ্যে সংস্কারকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। ভাইকে সে চাপার মোহ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করবার জন্যই চেষ্টা করেছিল। মেয়েটিকেও অনুরোধ করেছিল প্রতিনিবৃত্ত হতে।
হেসে অবিনাশবাবু বললেন– সাধুজনোচিত অনেক অনেক ধর্মোপদেশ সে দিত তখন। তার পর–।
আবার হাসলেন অবিনাশবাবু। বললেন–সাধুর খোেলস তার জীবন থেকে খসে পড়ে গেল। সে তার দিকে আকৃষ্ট হল এবং উন্মত্ত হয়ে উঠল। চাপার কাছে সে বিবাহ-প্রস্তাব পর্যন্ত করেছিল। সাময়িকভাবে চাপাও তার দিকে আকৃষ্ট হয়। ছোট ভাই মৃত খগেন তখন বড় ভাইকে। বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে। কারণ সন্ন্যাসী হয়ে বড় ভাই যখন গৃহত্যাগ করেছিল, এবং বাপের মৃত্যুশয্যায় স্বমুখে বলেছিল যে, গৃহধর্ম সে করবে না, ছোট ভাইকে মানুষ করে দিয়েই সে আবার চলে যাবে, তখন পৈতৃক বিষয়-আশয়ের ওপর তার কোনো অধিকার নাই। সমস্তর। মালিক সে একা। কিন্তু আসামি নগেন তখন সে-কথা অস্বীকার করলে। বললে, সে মুখের কথার মূল্য কী? প্রকাতেই সে বলেছিল তার সে-মন আর নাই। বলেছিল, তোর জন্যেই আমাকে থাকতে হয়েছে সংসারে; সেই সংসার আজ আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। তার জন্যেই আমাকে চাপার সংসবে আসতে হয়েছে। তুই-ই আমাকে চাপার মোহে ঠেলে ফেলে দিয়েছি। আজ আমি চাপাকে বক্টোম করে নিয়ে মালাচন্দন করে আখড়া করব। সম্পত্তির ভাগ আজ আমাকে পেতে হবে, আমি নেব।
বিরোধের একটি জটের সঙ্গে আর-একটি জট যুক্ত হয়ে রূঢ়তর এবং কঠিনতর হয়ে উঠল। তার পরিণতিতে এই ঘটনা। বিষয় নিয়ে বিরোধের শেষ পর্যন্ত গ্রামের পঞ্চজনের মীমাংসায় স্থির হয় যে, নগেন বাপের কাছে যা-ই মুখে বলে থাক, তার যখন কোনো লিখিত পঠিত কিছু নাই এবং বাপ যখন নিজে একথা বলে নি বা উইল করে যায় নি যে, তার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী একমাত্র খগেন হবে, তখন নগেন অবশ্যই সম্পত্তির অংশ পাবে। প্রায় সকল জমিই ভাগ হয়ে বাকি ছিল শুধু একখানি জমি। পঞ্চজনে বলেছিল দুজনে মাপ করে জমিটার মাঝখানে আল দিয়ে নিতে। সেই জমিখানি মাপ করে ভাগ করবার জন্যই দুই ভাই। ঘটনার দিন নদীর অপর পারে গিয়েছিল। এখানে একটা কথা বলার প্রয়োজন আছে। একটি বন্ধুর সঙ্গে মিলে ভাগে খগেনের একটি পান-বিড়ির দোকান ছিল। সে সেই দোকানেই থাকত। সেদিন কথা ছিল নগেন এসে খগেনকে ডাকবে এবং দুই ভাই ওপারে যাবে। কিন্তু নগেন আসে না, দেরি হয়। তখন খগেনই এসে নগেনকে ডাকে। নগেনের মনের মধ্যে তখন এই প্রবৃত্তি ঊকি মেরেছে বলেই আমার বিশ্বাস। একটা দ্বন্দ্ব তখন শুরু হয়েছে। এই সুযোগে যদি কাটা সরাতে পারি তবে মন্দ কী? আবার ভয়-মায়া-মমতা, তারাও স্বাভাবিকভাবে বাধা দিয়ে চলেছিল প্রাণপণ শক্তিতে। স্নেহ, দয়া প্রভৃতি মানসিক প্রবৃত্তিগুলি তখন শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। ওই নদীতে ভাইকে একলা পাওয়ার সুযোগ এলেই অন্তরের গুহায় প্রতীক্ষমাণ হিংসা যে হুঙ্কার। দিয়ে লাফ দিয়ে পড়বে সে তা বুঝতে পারছিল। সেই কারণেই নগেন বাড়ি থেকে বের হয় নি। তারই ডাকবার কথা ছিল খগেনকে। এর প্রমাণ পাই আমরা খগেনের দোকানের অংশীদার বন্ধুর কাছ থেকে। খগেনের সেই অংশীদার বন্ধু বলে, চাপা এবং নগেনের ব্যবহারে খগেন তখন। ক্ষোভে অভিমানে প্রায় পাগল। অভিমানে রাগে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এ-গ্রামেই সে আর থাকবে। না। বিষয় ভাগ করে নিয়ে, সব বেচে দিয়ে, সে যত শিগগির হয় চলে যাবে অন্যত্র। দোকানের অংশ খগেন সেইদিন সকালে বন্ধুকে বিক্রি করেছিল এবং বলেছিল নদীর ওপারের এই জমিটা ভাগ হলেই সে এ-গ্রাম ছেড়ে প্রথম যাবে নদীর ওপারের গ্রামে। সেখান থেকে জমিজমা নগেনের কোনো শত্রুকে বিক্রি করে চলে যাবে দেশ ছেড়ে। সেই কারণেই সে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল নগেনের। কিন্তু নগেন এল না দেখে বিরক্ত হয়ে বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে নগেনকে ডেকে আনে। নদীর ঘাটের পথেই এই দোকানখানি। খগেনের এই বন্ধু বলে–ওপারে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে দোকান পর্যন্ত এসেও নগেন বলেছিল, খগেন, আজ থাক। আমার শরীরটা আজ ভাল নাই। এবং এও বলেছিল, বিকেলটা আজ ভাল নয়, বৃহস্পতির বারবেলা; তার উপর কেমন গুমট রয়েছে। চৈত্রের শেষ। বাতাসটাতাস উঠলে তোকে নিয়ে মুশকিল হবে।
খগেন ভাল সাঁতার জানত না। জলকে সে ভয় করত। কিন্তু সেদিন সে বলেছিল, না। আর তোমার সঙ্গে সম্পর্ক আমি রাখব না। ওই জমিটায় আল দিতে পারলেই সাতখানা দড়ির শেষখানা কেটে যাবে। আজ শেষ করতেই হবে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নগেন বলেছিল, তবে চল।
এর মধ্যে ইঙ্গিতটি যেন স্পষ্ট। তার বর্বর-প্রকৃতির কাছে সে তখন অসহায়। দীর্ঘনিশ্বাসটি তারই চিহ্ন! এবং পরবর্তী ঘটনা, যা এর পূর্বে আমি বিশদভাবে বর্ণনা করেছি, তাই ঘটেছে। জলমগ্ন অবস্থার সুযোগে বর্বর প্রবৃত্তির তাড়নায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সমাধা করেছে সে।
অবিনাশবাবু থামলেন। ওদিকে বাইরে পেটা ঘড়িতে একটা বাজল। কোর্টের ঘড়িটা ও থেকে দু মিনিট স্লো।
জ্ঞানেন্দ্রবাবু উঠে পড়লেন।