ট্রেন এসে চাটগাঁয়ে থামল ভোর পাঁচটায়। চারদিক অন্ধকার। ভোরের কোনো আভাস দেখা যাচ্ছে না। প্লাটফর্মের আলো কামরায় ঢুকছে। এই আলোটুকুই। ভরসা, কারণ, ট্রেন প্লাটফর্মে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনের সব বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।
রানার হাতে একটা পেনসিল-টর্চ। প্রয়োজনের সময় কোনো জিনিসই কাজ করে না। রানার পেনসিল-টর্চও কাজ করছে না। বোতাম টিপে টিপে তার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। অথচ এই পেনসিল-টর্চ রওনা হবার আগের দিন কেনা হয়েছে। রানা উঁচু গলায় বলল, কেউ ট্রেন থেকে নামবে না, আনটিল ফার্দার অর্ডার। যে যেখানে আছ সেখানেই থাকো। মালের দিকে লক্ষ রাখো। নো মুভমেন্ট।
আনুশকা বলল, খামাখা চিৎকার কোরো না তো। শুধু শুধু হৈচৈ করছ কেন?
শুধু শুধু হৈচৈ করছি? বাতি নেই কিছু নেই, এর মধ্যে একটা-কিছু যদি হয়?
কী হবে?
অনেক কিছুই হতে পারে। জরী কোথায়? জরীকে তো দেখছি না।
রানা, তোমার আলগা মাতব্বরি অসহ্য লাগছে।
অসহ্য লাগলেও কিছু করার নেই। সহ্য করে নিতে হবে। জরী কোথায়?
শুভ্র বলল, জরী অন্য কামরায় ঘুমুচ্ছে। তার শরীর ভালো না।
রানা রাগী গলায় বলল, অন্য কামরায় ঘুমুচ্ছে মানে? কে ডিসিশান দিল? আমি কিছুই জানি না, আর দলের একজন মেম্বার অন্য কামরায় চলে গেল!
আনুশকা বলল, চিৎকার বন্ধ করো তো রানা। যথেষ্ট চিৎকার হয়েছে। তুমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানো। ইতোমধ্যে ভোর হবে। আমরা নামব।
দলের ভালোমন্দ আমি দেখব না?
তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। অনেক দেখেছ।
রানা রাগ করে ট্রেন থেকে নেমে গেল। নামার সময় নইমার পা মাড়িয়ে দিয়ে গেল। ব্যাপারটা অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু নইমার ধারণা, রানা এই কাজটা ইচ্ছা করেই করেছে। নইমা অল্পতেই কাতর হয়। পায়ের ব্যথায় সে কাতরাচ্ছে। নীরা বলল, তুই এমনভাবে চিৎকার করছিস, তাতে মনে হচ্ছে হাঁটুর নিচ থেকে তোর পা খুলে পড়ে গেছে।
ব্যথা পেলে চিৎকার করব না?
এমন কিছু ব্যথা পাস নি যে ট্রেনের সব মানুষকে সেটা জানাতে হবে।
খামাখা ঝগড়া করছিস কেন? পায়ের চামড়া খুলে গেছে—আর…
তোর এত নরম চামড়ার পা তুই ফেলে ছড়িয়ে বসে আছিস কেন? কোলে নিয়ে বসে থাকলেই হতো।
নইমা কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। পায়ে স্যান্ডেল পরল। আনুশকা বলল, যাচ্ছিস কোথায়? নইমা বলল, দ্যাটস নান অব ইয়োর বিজনেস।
নইমা ট্রেন থেকে নেমে গেল। সে হাঁটতে শুরু করেছে ওভারব্রিজের দিকে।
জরীর খুব ভালো ঘুম হয়েছে। এসি দেয়া স্লিপিং বার্থের ব্যবস্থা ভালো। শুধু কামরাটা বেশি ঠাণ্ডা। কামরার অ্যাটেনডেন্ট বালিশ এবং কম্বল দিয়েছে। একা একটা কামরার দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর আলাদা আনন্দ আছে। জরী অনেক দিন পর খুব আরাম করে ঘুমুল। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখল—সেইসব স্বপ্নও আনন্দময় স্বপ্ন। ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন নয়।
এখন ট্রেন থেমে আছে। চিটাগাং এসে গেছে এটা সে বুঝতে পারছে। তার পরেও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। জীবনের আনন্দময় সময়ের একটি হচ্ছে ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে শুয়ে থাকা।
দুবার টোকা পড়ল দরজায়। জরী বলল, কে?
আমি। আমি শুভ্ৰ। আমরা এসে গেছি।
জরী পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ও, আচ্ছা।
শুভ্র বলল, এখন আমরা নামব।
জরী হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি আরো খানিকক্ষণ শুয়ে থাকতে চাই শুভ্ৰ। এই ধরো, পাঁচ মিনিট।
তোমার গায়ে কি জ্বর আছে?
বুঝতে পারছি না। মনে হয় আছে। শুভ্ৰ, তুমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে না। তুমি নেমে যাও। আমি নিজে নিজেই নামব।
আচ্ছা। রাতে তোমার কি ভালো ঘুম হয়েছে?
খুব ভালো ঘুম হয়েছে।
রানার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। মাথায় রক্ত ওঠার মতো অনেকগুলি কারণের একটি হচ্ছে নইম ট্রেন থেকে নেমে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ওভারব্রিজে উঠে গেছে। রানার একবার ইচ্ছা করছিল, ডেকে জিজ্ঞেস করে—যাচ্ছ কোথায়? শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে নি। কী দরকার? যাক যেখানে ইচ্ছা। তার দায়িত্ব কী? সে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেলে সবাই রেগে যায়। কী দরকার সবাইকে রাগিয়ে? হু কেয়ারস? গো টু হেল।
রানা খানিকক্ষণ নির্বিকার থাকতে চেষ্টা করেছে। শেষটায় রওনা হয়েছে খোঁজ নিতে। ওদের ভালো লাগুক বা না লাগুক, খোঁজ তো রাখতেই হবে। রানা পুরো স্টেশন খুঁজে এলো। নইমা নেই। কোনো মানে হয়? জলজ্যান্ত একটা মেয়ে তো। হারিয়ে যেতে পারে না বা বাতাসেও মিলিয়ে যেতে পারে না। হয়েছেটা কী? আনুশকাকে ঘটনাটা জানানো দরকার। সে শুনে হয়তো এমন কিছু বলবে, যাতে আবার মাথায় রক্ত উঠে যাবে।
কিছু বলবে?
নইমা কোথায়?
প্ল্যাটফর্মে নেমেছে।
আমি তো কোথাও দেখলাম না।
আনুশকা হাই তুলতে, আছে কোথাও। ব্যস্ত হবার কিছু নেই।
একটা মেয়ের কোনো ট্রেস নেই আর আমি ব্যস্ত হব না?
ট্রেস থাকবে না কেন? ট্রেস ঠিকই আছে। তুমি খুঁজে পাচ্ছ না।
রানা রাগ সামলাতে একটু দূরে সরে গেল। সিগারেট ধরাল। আর তখন দুজন পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখল। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকের একজন। সেও যে পুলিশের তা বোঝা যাচ্ছে। তারা থমকে দাঁড়াল। সাদা পোশাক পরা লোকটি এগিয়ে এলো।
আপনি কি ঢাকা থেকে আসছেন?
জি।
কয়েকজনের একটা পিকনিক পার্টি?
জি।
চারটি মেয়ে আছে আপনাদের দলে?
ওদের একজনের নাম জরী?
জি।
আপনাদের সবাইকে থানায় যেতে হবে।
কী বললেন?
আপনাদের থানায় যেতে হবে।
কেন?
ঢাকা থেকে ম্যাসেজ এসেছে, আপনারা মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রীকে জোর করে ধরে নিয়ে চলে এসেছেন।
কী বলছেন এসব!
আমাদের কাছে ইনফরমেশন যা আছে তাই বলছি।
রানার হাতের সিগারেট নিভে গেছে। সে নেভা সিগারেটই টানছে। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। এ কী সমস্যা! এই সমস্যায় উদ্ধারের পথ কী? পুলিশের সঙ্গে প্রতিটি কথা মেপে বলতে হয়। বিচার-বিবেচনা করে বলতে হয়। মাথায় কোনো বুদ্ধি, কোনো বিচার-বিবেচনা আসছে না। বরং হঠাৎ করে প্রচণ্ড বাথরুম পেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে বাথরুমে ছুটে না গেলে সমস্যা হয়ে যাবে। প্যান্ট ভিজে কেলেঙ্কারি হবে। রানা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, স্যার, আপনারা ঠিক বলছেন?
সাদা পােশাকের ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, আমরা ঠিক বলছি না ভুল বলছি তার বিবেচনায় আপনাকে যেতে হবে না। আমরা যে খবর পেয়েছি সেই হিসাবে কাজ করছি। আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। একজনের বিবাহিতা স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে চলে এসেছেন।
খবরটা সত্য না স্যার। বিয়ে হয় নি।
আপনাদের খবরের উপর আমরা নির্ভর করি না। আমরা খবর পেয়েছি অনেক উপরের লেভেল থেকে।
ও, আচ্ছা।
মিসেস মনিরুজ্জামান কি আপনাদের সঙ্গে আছেন?
জি স্যার।
মিসেস মনিরুজ্জামান যে আপনাদের সঙ্গে আছেন তা তো আপনারা একবাক্যেই স্বীকার করলেন। তার পরেও বলছেন ভুল বলছি?
স্যার, আপনারা এখানে দাঁড়ান, আমি জরীকে নিয়ে আসছি।
শুধু তাকে আনলে হবে না। আপনাদের সবাইকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আপনারা যে কত বড় যন্ত্রণায় পড়েছেন সে সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারণা নেই। আপনার সিগারেট নেভা। আপনি নেভা সিগারেট টানছেন।
রানা বলল, স্যার, সিগারেট খাবেন?
না, সিগারেট খাব না।
আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। ট্রেনের লোক সবাই প্ৰায় নেমে এসেছে। রানা কাপা পায়ে কামরায় উঠল। আনুশকার সঙ্গে কথা বলা দরকার। তারও আগে বাথরুমে যাওয়া দরকার। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ বাথরুম পেয়ে গেছে। একেই বলে শিকারের সময় কুত্তার ল্যাট্রিন।
আনুশকা, একটু নিচে নেমে আসো। খুব জরুরি কথা আছে। এক্সট্রিম ইমার্জেন্সি।
নইমাকে এখনো পাওয়া যায় নি?
নইমা-টাইমা বাদ। অন্য ব্যাপার। সর্বনাশ হয়ে গেছে।
অল্পতে অস্থির হয়ো না তো রানা। তোমার কি ব্লাডপ্রেশারের কোনো সমস্যা আছে? হাত কাঁপছে কেন?
কঠিন কিছু কথা রানার মুখে এসেছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে সহজ ভঙ্গিতেই ব্যাপারটা আনুশকাকে বলল। নিচু গলায় বলল, অন্যদের শোনার এখন কিছু নেই। আনুশকার কোনো ভাবান্তর হলো না। সে সহজ ভঙ্গিতেই এগিয়ে গেল। সাদা পোশাকের পুলিশ বলল, আপনি কি মিসেস মনিরুজ্জামান?
আমার নাম আনুশকা। মিসেস মনিরুজ্জামানকে আমি চিনি না।
আপনাদের আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।
কোনো ওয়ারেন্ট আছে?
পুলিশ যদি থানায় যেতে বলে তাহলে যেতে হয়। পুলিশের কাজে বাধা দিলে অ্যারেক্ট করা কোনো ব্যাপার না।
আনুশকা সহজ গলায় বলল, আপনাদের পেছনে কি কোনো বড় কর্তাব্যক্তি আছে?
হ্যাঁ, আছে?
আপনার হাতে কি ওয়াকিটকি?
হ্যাঁ।
আমার পরিচয় কি আপনি জানেন?
অকারণ কথা বলে আপনি আমাদের সময় নষ্ট করছেন।
আমার পরিচয় জানতে পারলে আপনার হাত থেকে ওয়াকিটকি মাটিতে পড়ে যাবে। কাজেই আমি অকারণ কথা বলছি না। বাঘের উপর যে থাকে তার নাম টাগ। তিমির উপর তিমিঙ্গল। আপনি কিছু জানেন না বলেই এমন কড়া গলায় আমার সঙ্গে কথা বলার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন।
পুলিশ অফিসার হকচাকিয়ে গেল। সমস্যা এদিক দিয়ে আসবে ভাবা যায় নি। এ দেখি আরেক যন্ত্রণায় পড়া গেল! আনুশকা বলল, আপনি কি অতি দ্রুত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন?
অবশ্যই পারব।
তাহলে দয়া করে আমার হয়ে একটা ইনফরমেশন ঢাকায় পাঠাবায় ব্যবস্থা করুন। পুলিশের আইজিকে খবর পাঠাতে হবে। আনুশকা নামের একটা মেয়েকে পুলিশ বিরক্ত করছে। নুরুদিন সাহেব আমার ছোট মামা?
ও, আচ্ছা?
আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না?
বিশ্বাস না হবার কী আছে? মানে আপা, সমস্যাটা হলো…
কোনো সমস্যা হয় নি। বরং আমাদের একটা সমস্যা হয়েছে। আমাদের এক বান্ধবী-নইমা তার নাম। নইমাকে পাচ্ছি না। প্ল্যাটফরমেই আছে। ওকে দয়া করে একটু খুঁজে বের করে দিন।
পুলিশের দলটা খানিকক্ষণ কোনো কথা বলল না। আনুশকা বলল, রানা, এসো তো, জিনিসপত্র নামাতে হবে। চা খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। সকালবেলা চা না খেলে আমার মাথা ধরে যায়। রানা ফিসফিস করে বলল, আইজি নুরুদ্দিন সাহেব তোমার মামা?
আনুশকা দূর। পুলিশে আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। কিছুক্ষণের জন্য ওদের পিলে চমকে দিয়েছি। এরা খোঁজখবর করবে। এই ফাঁকে আমরা কেটে পড়ব।
আমার কিন্তু মোটেই ভালো লাগছে না।
আমার লাগছে। অ্যাডভেঞ্চার-অ্যাডভেঞ্চার ভাব হচ্ছে।
আনুশকা খিলখিল করে হেসে ফেলল।
হাসছ কেন? হোয়াই লাফিং?
তুমি বড় বিরক্ত করছ রানা। পুলিশের চেয়েও বেশি বিরক্ত করছ। শান্ত হও—শান্ত।
শান্ত হব?
আনুশকা আবারো শব্দ করে হাসল। রানা চাপ নিঃশ্বাস ফেলল। পৃথিবীতে মেয়ে জাতটার সৃষ্টি কেন হলো, সে ভেবে পাচ্ছে না।