০৪. ঝগড়ু রুমুর পা টিপে দিল

ঝগড়ু অনেকক্ষণ ধরে রুমুর পা টিপে দিল। পা টিপতে টিপতে মাঞ্জার কথাটা বলল, আমরা যখন ছোটো ছিলাম বোগিদাদা, ওই মাঞ্জা সুতোয় লাগিয়ে একদিন ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম। সারা দিন লেগেছিল সুতোয় মাঞ্জা দিতে। লম্বা করে দুটো শিশু গাছে বেড় দিয়ে সুতো শুকোনো হল। ঘুড়ি উড়োতে সেই বিকেল হয়ে গেল।

আমি আর আমার ভাই ঝমরু, না খেয়ে না দেয়ে সুতো তৈরি করে আকাশে তো ঘুড়ি ছেড়ে দিলাম। ছাড়তেই মনে হল জ্যান্ত পাখি ছেড়ে দিলাম। ঘুড়ি কাত হল না, গোত্তা খেল না, শোঁ শো করে একেবারে সটান মাঝ আকাশে উড়ে গেল।

যতই সুতো ছাড়ি ততই ঘুড়ি উপরে উঠে যায়। ঝমরু বলল, দাদা ঘুড়ির কেন ওজন নেই, টান নেই? বাস্তবিকই তাই, এদিকে লাটাইয়ের সুতোও প্রায় শেষ। আমি বললুম, সারাদিন মাঞ্জা দিলাম, সব কটি সুতো যাবে শেষে, থাক, তুই টেনে নামা।

কী বলব, বোগিদাদা, সে ঘুড়ি নামতে চায় না, জোর করে। ততক্ষণে সূয্যি ডুবেছে, গাঁয়ের লোক আর যারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল সবাই চলে গেছে, তখন ঘুড়ি এসে চোখের সামনে দেখা দিল। দেখা দিল কিন্তু মাটিতে পড়ল না। ঝমরু আর আমি দেখলাম, ঘুড়ির কলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আশ্চর্য একটা হলদে পাখি! তার পা নেই, মাটি থেকে এক হাত উপরে খালি খালি ফড়ফড় করে উড়ে বেড়াচ্ছে। গলায় স্বর নেই, ডাকছে না, কিন্তু লাল চুনির মতো দুটি চোখ দিয়ে পাগলের মতো ইদিকে-উদিকে তাকাচ্ছে।

বোগি জিজ্ঞেস করল, তবে-না বলেছিলে কেউ ও পাখি চোখে দেখেনি?

মিথ্যা কথা বলেছিলাম, বোগিদাদা। আর কেউ কখনো দেখেনি, শুধু ঝমরু আর আমি দেখেছিলাম। ঝমরু তাকে খপ করে ধরে ফেলল, অমনি সে চোখ বুজে নিঝুম হয়ে গেল, খালি ওর বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। কিন্তু যেই-না আমি তাকে ধরেছি আর ঝমরু তার গলা থেকে সুতোর ফঁস খুলে দিল, অমনি সে ডানা ঝাঁপটা দিয়ে আমার হাত থেকে ফসকে গিয়ে, তিরের মতো আকাশে উড়ে দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল।

তারপর কী হল, ঝগড়ু?

তারপর আর কী হবে? ঝমরু আর আমার আর দেশে থাকা হল না। ওই পাখির ডানার ঝাঁপটা যার গায়ে লেগেছে সে কি আর ঘরে তিধুতে পারে, বোগিদাদা? আজ তুমি ঘুমোও বোগিদাদা, দেখো রুমুর চোখ কখন বুজে গেছে।

তার পরদিনও ভুলো এল না, তার পরদিনও না, তার পরদিনও না।

তার পরদিন রুমু বলল, ঝগড়ু, যে শেয়ালরা কুকুররা হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়ে যায়, তারা আর জানোয়ার হয় না?

ঝগডু বলল, একবার মানুষ হলে তারা আর কি জানোয়ার হতে চাইবে, দিদি? তবে শুনেছি নিদুলি মন্ত্র দিয়ে সব হয়।

তুমি জান সেই নিদুলি মন্ত্র?

জানি আমি সবই। আমাদের দুমকায় ছেলেছোকরারাও নিদুলি মন্ত্রের কথা শুনেছে। কিন্তু করা বড়ো শক্ত!

কেন শক্ত, ঝগড়ু?

তার জিনিসই পাওয়া যায় না, দিদি; পাঁচ-ঠেঙো মাকড়সা চাই, সোনা-রুপোর মাদুলি চাই– এখন আমি বাজারে যাচ্ছি, দিদি, পরে সব বলব।

বাজারে যাচ্ছ, ভালোই হল, ঝগড়ু, একটু দেখো তো।

কী দেখব, দিদি?

সেই– সেই সোনা রুপোর মাদুলি যদি পাও।

সে কি অত সহজে মেলে, দিদি?

তাহলে সেদিন সেই একচোখো লোকটাকে তাড়িয়ে দিলে কেন? ওর কাছে হয়তো ছিল। বলল, রক্ত বন্ধকরা মাদুলি আছে, স্বপ্ন দেখা মাদুলি আছে। দেখলে না কেন, ঝগড়ু?

আচ্ছা, এবার দেখলে তাকে ডেকে আনবখন। কিন্তু কী করবে তুমি ওই মাদুলি দিয়ে? বিকেলে হিরে খুঁজতে যাবে তো?

হ্যাঁ, যাব। হিরে খুঁজব, আর সেই যে তুমি বলেছিলে সাপের মাথার ফুল, যে ফুল কখনো শুকোয়, সেই খুঁজব। খোয়াইয়ের মধ্যেই সব পাওয়া যাবে তো?

পাওয়া যাবে কি না জানি না, দিদি। তবে খোয়াইয়ের মধ্যেই ওসব খুঁজতে হয়। পেলেই তো মজা ফুরিয়ে গেল।

বিকেলে যেতে হয় খোয়াইয়ে। বর্ষার জলে মাটি খেয়ে খেয়ে লাল কাঁকরের পাঁজরা বেরিয়ে থাকে। ধারে ধারে মনসা গাছ মাথা উঁচিয়ে কাঁটা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। আলো কমে এলেই রুমুর কেমন মনে হয় মনসারা আগের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে নেই, মাথা ঘুরিয়ে ইদিক-উদিক দেখছে। খোয়াইয়ের মধ্যে কতরকম আশ্চর্য সাদা লাল পাথর পড়ে থাকে।

ঝগড়ু বলল, কিছুই বিশ্বাস কর না বোগিদাদা, বইয়ে না লেখা থাকলে কিছুই মানতে চাও না। আরে বইয়ে কতটুকুরই-বা জায়গা হয়, বলো? আমাদের দুমকাতে একরকম গাছ আছে তারা চলে বেড়ায়।

ফের বাজে বকছু, ঝগড়ু?

আরে না না, নিজের চোখে দেখা। ছোটোবেলায় ঝমরু আর আমি পাহাড়ে যেতাম ছাগল চরাতে। আমাদের দেশের জন্তুজানোয়ারদের বড়ো কষ্ট, রমুদিদি, এমনি খরা যে ঘাসগুলো সব জ্বলে-পুড়ে যায়। তবে পাহাড়ের উপরে বড়ো বড়ো পাথরের ছায়ায় লম্বা লম্বা ঘাস থাকে, ছাগলরা তাই খেতে বড়ো ভালোবাসে।

ছাগলরা চরে বেড়ায়, আর ঝমরু আর আমি সারাটা দিনমান এ পাথর থেকেও পাথরে লাফিয়ে বেড়াই, বাঁশি বাজাই, আর পাথরের আড়ালে ঘুমুই। ঝমরু একটু রাগী ছিল, দিদি, একটুতেই মেরে ধরে একাকার করত।

কোথায় সে এখন?

বোগি একটু কাছে এসে বলল, মরে গেছে নিশ্চয়।

ঝগড়ু রাগ করল। মরবে কেন বোগিদাদা, তোমার যেমন কথা!ঝমরু এখন বদ্যিনাথে পুলিশে চাকরি করে, তার পাঁচটা ছেলে পাঁচটা মেয়ে; কেউ মরেনি।

আচ্ছা, আচ্ছা, তারপর বলল, ঝমরু ভারি রাগী ছিল, তারপর?

একদিন একটা ছাগল কিছুতেই পাহাড়ে উঠবে না। আমি যতই তাকে ফুসলোই, সে উলটে গুঁতোতে আসে।তখন ঝমরু রেগেমেগে দিয়েছেতাকে এক লাথি কষিয়ে। ছাগলটা অমনি তরতর করে পাহাড়ে উঠে গেল বটে, কিন্তু পাশেই একটা মস্ত মস্ত শাঁসালো পাতাওয়ালা কাঁটাগাছ ছিল, ঝমরুর পায়ে তার একটা এই বড়ো কাটা গেল বিধে। অমনি চুনির মতো গোল গোল রক্তের ফোঁটা টপটপ করে পড়তে লাগল, আর ঝমরুর সে কী চেঁচামেচি! রেগে গাছটার গোটা ডালটাই ছিঁড়ে ফেলে দিল, আর তার গা থেকেও একরকম সাদা রস পড়তে লাগল।

তারপর ব্যথা কমলে আমরাও পাহাড়ে চড়লাম। ঝমরু কী করে, পায়ে ব্যথা, সেদিন আর দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না। তখন সে করল কী, মাঝারি পাথরগুলোকে উলটে উলটে ফেলতে লাগল। কখনো পাথর উলটেছ, রমুদিদি?

না তো। কেন, কী হয়?

পাথরের তলাকার ছোটো-বড়ো পোকারা ঊর্ধ্বশ্বাসে যে যেদিকে পারে পালায়। সে ভারি মজা লাগে দেখতে, কিন্তু ওদের ভারি কষ্ট হয়।

কেন কষ্ট হয়?

আরে, ওরা অন্ধকারের পোকা, আলো সইতে পারে না। তা ছাড়া পাথরের তলাটাই ওদের বাড়ি, বাচ্চাটাচ্চা ডিম-টিম নিয়ে সেখানে ওরা থাকে। পাথর উলটে ফেলে দিলে বাচ্চারা মরে যায়, ডিমগুলো ভেঙে যায়।

ইস। ঝমরু তো ভারি দুষ্টু ছেলে।

না, দুষ্টু মোটেই নয়, রমুদিদি, আমাদের দুমকার ছেলেরা আর যাই হোক, কখনো দুষ্টু হয় না। তবে অতটা ভেবে দেখিনি।

আচ্ছা, তারপর বলো।

তারপর আট-দশটা পাথর ওইরকম উলটে ফেলবার পর, ঝমরুর সে কী চিৎকার! আমি ভাবলাম নিশ্চয় পোকায় কামড়েছে! ছুটে গিয়ে দেখি, ওর পায়ে আবার সেইরকম একটা কাঁটা ফুটে রয়েছে।

তাকিয়ে দেখি পাশে ঠিক সেইরকম একটা গাছও রয়েছে। শুধু তাই নয়, গাছটার একটা ডালও ভাঙা, আর সেখানে ফেঁটা ফেঁটা সাদা রস জমে রয়েছে।

কী করে হতে পারে ঝগড়ু? তুমি কি বলতে চাও সেই গাছটাই পাহাড়ে চড়েছিল?

দেখ, বোগিদাদা, তোমাদের সঙ্গে আমাদের এই তফাত যে আমরা যা দেখি তাই মেনে নিই, অত কী করে হল জানতে চাই না। কিছুই মানতে চাও না, এই হল মুশকিল। আমি একবার খোয়াইয়ের মধ্যে ঘোড়ার কঙ্কাল পেয়েছিলাম, তাও বোধ হয় বিশ্বাস করবে না?

বোগি বলল, তা কেন বিশ্বাস করব না? একটা সত্যি ঘোড়াই হয়তো বুড়ো হয়ে খোয়াইয়ের মধ্যে মরে গেছিল, কিংবা হয়তো কিছুতে মেরে ফেলেছিল, কিংবা পথ হারিয়ে না খেতে পেয়ে মরে গেছিল–ও কী, ফের কাঁদছিস, রুমু?

রুমু ফ্রকের কোনা তুলে চোখ মুছে বলল, ঘোড়া মরে গেলেও কাঁদতে পাবনা? না খেতে পেয়ে একলা একলা অন্ধকারে খোয়াইয়ের মধ্যে ঘুরে বেড়ালেও কাঁদতে পাব না?

বোগি বিরক্ত হয়ে বলল, ফ্রক নামাও রুমু, তোমার পেট দেখা যাচ্ছে!

ঝগড়ু ব্যস্ত হয়ে উঠল। আহা, কান্নাটা থামিয়ে আসল কথাটাই শোনোনা, দিদি। ঘোড়াটার ওরকম কিছুই হয়নি।

কী করে জানলে?

শোনোই না, বলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *