জোবেদা খানম কোরান শরীফ পড়ছিলেন। তার কোলে অনি। তিনি মাথা দুলিয়েদুলিয়ে পড়ছেন, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনিও মাথা দোলাচ্ছে। রিমি ঘরে ঢাকায় অনির মাথা দোলানো আরো বেড়ে গেল সে মার দিকে তাকিয়ে হাসল।
রিমি হাসল না। অনির এই অতিরিক্ত দাদীঘেঁষা স্বভাব তার পছন্দ না। সারাক্ষণ দাদীর সঙ্গে আছে। কোরান শরীফ পড়ছেন; তখনো কোলে বসা। রিমি বলল, কোল থেকে নাম অনি।
অনি হাসিমুখে বলল, না।
জোবেদা খানম কোরান শরীফ পড়া বন্ধ করলেন। রিমির ধারণা হল তিনি কঠিন কোন ঝগড়ার সূত্রপাত করবেন। প্রতিদিন সকালেই তা করা হয়। তা ছাড়া ঝগড়ার উপলক্ষও তৈরি হয়েছে অনিকে কোল থেকে নামতে বলা হয়েছে। কাল রাতে তাঁকে খাবার দেয়া হয় নি। এই ভুল তথ্যও তিনি টেনে আনতে পারেন।
রিমিকে আশ্চর্য করে জোবেদা খানম তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। অস্বাভাবিক নরম গলায় বললেন, আজ এত দেরিতে ঘুম ভাঙল যে বৌমা।
ঘুমুতে দেরি হয়েছিল।
ঠিক আছে, সবদিন কি আর সবকিছু নিয়মমতে চলে? মাঝে-মাঝে অনিয়ম হয়। আমাকেই দেখ না প্রত্যেকদিন ভাবি কোরান মজিদ পড়ব। পড়া আর হয় না। কতদিন পর আজ বসলাম। এক পারা পড়া হয়ে গেছে।
রিমি তাকিয়ে রইল। তার শাশুড়ির আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ সে ধরতে পারছে না।
বৌমা, একটু বস, কথা বলি।
রিমি বসল না। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল। জোবেদা খানম চোখ থেকে চশমা খুলতে-খুলতে বললেন, আমি কাপড়চোপড় কী নিব তাই তো বুঝতে পারছি না। ঐখানে এখন শীত না গরম?
কোথায় শীত না গরম?
কক্সবাজার।
কক্সবাজার?
অনি বলল, আমরা সবাই যাচ্ছি।
এই কাজটা মা খুব ভালো করেছ। এই জীবনে তো কিছু দেখলাম না। সমুদ্রটা দেখি। তোমার শ্বশুর সাহেব একবার ঠিক করল আমাদের সবাইকে নিয়ে যাবে, তখন খরচপাতির কথা চিন্তা করে আমি বললাম–বাদ দাও। যাওয়া হল না। ঐ বেচারাও দেখল না। আমি দেখলেও কাজের কাজ হয়। মরার পর তোমার শশুর সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে বলতে পারব দেখে আসলাম।
রিমি খাটে এসে বসল। তার মুখ থমথম করছে। সে কঠিন-কঠিন কিছু কথা এখন তার শাশুড়িকে শোনাবে। কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। জোবেদা খানম বললেন, তোমার শ্বশুর সাহেবের এইসব বাতিক খুব ছিল। এখানে যাবে, ঐখানে যাবে। অবশ্য কোথাও শেষ পর্যন্ত যেতে পারে নি। যাবে কীভাবে? টাকাপয়সা কই? ছেলে-মেয়ে মানুষ করতে গিয়ে জিহ্বা লম্বা হয়ে গেল। যাক এখন আর পুরানো কথা বলে লাভ কি। তা বৌমা আমরা রওনা হচ্ছি কবে?
আপনি তোমা যাচ্ছেন না।
আমি যাচ্ছি না?
যাবেন কীভাবে বলুন। আপনি কি নিজের বয়সটার কথা ভাবেন না? এই বয়সে এত বড় জানি।
বয়স হয়েছে তা কী হয়েছে? আমি কি প্যারালিসিস হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি? চলাফেরা করছি না? কাজকর্ম করছি না? গত বছরও পুরা তিরিশ রোজা করলাম। অসুবিধা হয়েছে কোনো? তুমি নিজে তো তিরিশ রোজা করতে পার নি।
আজেবাজে কথা বলে তো লাভ নেই মা। আপনাকে নিয়ে যাব না।
অনি গম্ভীর মুখে বলল, দাদীকে নিতে হবে।
তুমি চুপ কর তো অনি।
তুমি চুপ কর মা।
রিমি কঠিন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। অনি সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, দাদীকে নিতে হবে। দাদী না গেলে আমি যাব না।
জোবেদা খানমের মুখের হাসি বিস্তৃত হল। রিমি চলে এল রান্নাঘরে। সকালের নাশূতার কোনো আয়োজন এখনো হয় নি। সে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছে আর পুরো সংসার আটকে গেছে। জিতু মিয়াও নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। সাড়ে আটটার মতো বাজে। নটার মধ্যে তৌহিদকে স্কুলে রওনা হতে হবে।ভাগ্যিস স্কুল খুব দূরে না। দূরে হলে দুপুরে খেতে আসতে পারত না। খাবার দিয়ে দিতে হত। সে আরেক যন্ত্ৰণা।
জোবেদা খানম ধরেই নিলেন তাকে সঙ্গে নেয়া হবে। স্বামীর সংসারে তার কথার ওপর কেউ কথা বলে নি। পুত্রদের সংসারে এসেও তাই হয়েছে। রিমির সঙ্গে তাঁর প্রায়ই লেগে যাচ্ছে তা ঠিক, তবুও শেষ পর্যন্ত তাঁর কথাটি বহাল থাকছে। গত ঈদে তিনি বললেন, অনিকে শাড়ি কিনে দিতে হবে। রিমি শুনেই রেগে উঠল, চার বছর বয়েসী মেয়ের আবার শাড়ি কি? তিনি বললেন, ছোট মেয়েদের শাড়ি পাওয়া যায়, শাড়িই দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত শাড়ি, জামা দুটাই হল। অনি ঈদের দিন জামা পরল না, সে শাড়ি পরেই থাকবে। জোবেদা খানম মনে-মনে বললেন, এখন ভালো হয়েছে। ভোঁতা মুখ থোতা হয়েছে। যেমন ব্যবহার তেমন ফল।
তিনি খুব ভালো করেই জানেন, তাকে ছাড়া ওরা কোথাও যেতে পারবে না। অনি বেঁকে বসবে। কাজেই জিনিসপত্র এখন থেকেই গোছানো শুরু করা দরকার। নিজের বিছানা-বালিশ ছাড়া তার ঘুম হয় না। বিছানা-বালিশ সঙ্গে নিতে হবে। মশারিটা ময়লা হয়ে আছে। মশারি ধুয়ে দিতে হবে।জিতুকে বললে সে কি ধুতে পারবে? মনে হয় না। বড়ছেলের বাসায় মশারি পাঠিয়ে দিলে হয়। ওর বাসায় বড়-বড় কাজের মানুষ আছে, ওরা ধুয়ে ইস্ত্ৰি করে দেবে। এক জোড়া ভালো স্যান্ডেল দরকার। জোবেদা খানম অনিকে পাঠিয়ে রিমিকে ডেকে আনলেন।
ও বৌমা আমার মশারিটা ইরিসের বাসায় পাঠাবার ব্যবস্থা কর।
কেন?
ওরা মশারি ধুয়ে দিবে। এ রকম ময়লা মশারি নিয়ে তো বিদেশ যাওয়া যায় না। দশ জনে দেখবে।
রিমি বিরক্তি গলায় বলল, আপনি সারাজীবন ঝামেলা করেছেন। আর করবেন না। আপনি কোথাও যাচ্ছেন না।
তোমার মুখের কথায় তো মা দুনিয়া চলে না। দুনিয়া চলে আল্লাহ পাকের হুকুমে। আল্লাহ পাকের যদি হুকুম হয় আমাকে না নিয়ে তোমার উপায় নেই।
রিমি কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল।
জোবেদা খানম ভাবলেশহীন গলায় বললেন, এরকম তাকিয়ে থাকলেও কিছু হবে না মা। তুমি মশারি আর আমার হলুদ কাঁথাটা ইরিসের বাসায় পাঠাও। আর ইরিসকে বল সে যেন আমাকে কিছু হাত-খরচ দেয় আর এক জোড়া নরম স্যান্ডেল কিনে দেয়।
এই বৃদ্ধার কথা দাঁড়িয়ে শোনা অর্থহীন। রিমি শুকনো মুখে ঘর ছেড়ে চলে এল। শাশুড়ির কথায় তার অবশ্যি লাভ হয়েছে। কাপড় ধোয়ার কথাটা মনে হয়েছে। অনেক কাপড় ধুতে হবে। অনির জুতা আছে, স্যান্ডেল নেই। অনির জন্যে স্যান্ডেল কিনতে হবে। বালিতে জুতা পরে হাঁটা যায় না। স্যান্ডেল থাকলে খুলে হাতে নেওয়া যায়। রিমি নানান কাজের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে রইল তবে তার কান পড়ে রইল বসার ঘরের দরজায়। সে নিশ্চিত ছিল ফরহাদ আজ আসবে। ঝড়-বৃষ্টির জন্যে কাল আসতে না পারায় লজ্জা প্রকাশ করবে। রিমি ঠিক করে রেখেছিল এগারটা সাড়ে এগারটার দিকে এলে সে তাকে দুপুরে খেয়ে যেতে বলবে। নতুন কিছু করতে হবে না। এগুলো গরম করে দিলেই হবে। বাড়িওয়ালার বাড়ি থেকে আনা জগটা এই কারণেই ফেরত দেওয়া হয় নি।
আশ্চর্যের ব্যাপার, ফরহাদ এল না। তার পরের দিনও না। তার পরের দিনও না।
রিমির মনে হল ভালোই হয়েছে। না আসাই ভালো। পুরানো কথা কে মনে করতে চায়? তার এত কী দায় পড়েছে পুরানো কথা ভাববার? আর সে কেনইবা ভাববে? অল্প বয়সে সে একটা ভুল করেছিল, সেই ভুল এতদিন পর মনে করার কোনো প্রয়োজন নেই। সে মনে করতে চায় না। এম্নিতেই তার অনেক যন্ত্ৰণা। আর যন্ত্রণা বাড়ানোর দরকার কি? ঐদিন উনাকে নিষেধ করে দিলেই সবচে ভালো হত। বললেই হত-না, আপনার আসার দরকার নেই। কেন সে এই সহজ কথাটা বলতে পারল না? এমন তো না সে কথা বলতে পারে না। সে কথা ভালোই বলতে পারে। বাড়ি ছেড়ে পালানোর কথাই ধরা যাক। ট্রেনে ওঠার পর সে ক্রমাগত কথা বলতে লাগল। এক পর্যায়ে ফরহাদ ভাই বললেন, তুমি এত কথা বলছ কেন? সে রাগ করে বলল, বেশ করছি বলছি। আপনার শুনতে ইচ্ছা না হলে ঐ পাশের সিটে গিয়ে বসুন। আমার পাশে থাকলে আমি কথা বলব।
ফরহাদ ভাই নিচু গলায় বললেন, লোকজন কী মনে করছে।
যার যা ইচ্ছা মনে করুক। আমি কি কাউকে ভয় পাই?
না সেদিন রিমির একটুও ভয় লাগছিল না। বাসা থেকে পালিয়ে আসার জন্যে মন খারাপ লাগছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, এত আনন্দ পৃথিবীতে! যা দেখছে তাই ভালো লাগছে। টেলিগ্রাফের তারে ফিঙে পাখি বসে আছে। কী সুন্দর লাগছে পাখিটাকে! ট্রেনের কামরায় যাত্রীদেরও ভালো লাগছে। পা ভাঙা এক লোক নিম টুথ পাউডার বিক্রি করছে। তার বক্তৃতাও শুনতে ভালো লাগছে। ইচ্ছা করছে এই গরিব বেচারার সব কটা কৌটা সে কিনে ফেলে। তার এত ভালো লাগছে অথচ তার পাশে বসে থাকা মানুষটা ভয়ে-দুশ্চিন্তায় এতটুকু হয়ে গেছে। এত কিসের দুশ্চিন্তা? সবকিছু তো ঠিকঠাক করাই আছে। তারা যাবে ভৈরব। ভৈরবে ফরহাদ ভাইয়ের মেজো মামা থাকেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর। উনি ফরহাদ ভাইকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। ফরহাদ ভাই অর কাছে কেঁদে পড়বেন এবং বলবেন এই একটা কাজ ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছি। সেই পুলিশ ইন্সপেক্টর মামা তখন একটা ব্যবস্থা করবেন। মৌলানা ডাকিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেবেন। সব তো ঠিক করাই আছে, তবু ফরহাদ ভাই এত ভয় পাচ্ছে কেন? রিমি এক সময় বলল, আপনার মুখটা ভয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। এত ভয় পাচ্ছেন কেন?
ফরহাদ ভাই বিড়বিড় করে বললেন, ধর মামাকে যদি বাসায় গিয়ে না পাই?
পাবেন না কেন?
উনি প্রায়ই ট্যুরে যান।
মামা না থাকলে কী–মামী তো থাকবেন।
মামী আমাকে দেখতে পারেন না। তোমাকে সঙ্গে করে ঐ বাড়িতে উঠলে মামী ঘাড় ধরে বের করে দেবেন।
দিলে দিবে। আমরা কোনো একটা হোটেলে গিয়ে উঠব। আমার খুব হোটলে থাকার শখ। আচ্ছা ভৈরবে হোটেল আছে তো?
ফরহাদ ভাই সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিষণ্ণ মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর বিষণ্ণ মুখ দেখে মায়ার বদলে রিমির খুব মজা লাগতে লাগল।
গৌরীপুর স্টেশনে ট্রেন-বদল করতে হয়। রিমিকে রুমে বসিয়ে ফরহাদ গেল চা আনতে। তার মিনিট দুএকের মধ্যে রিমির মেজো চাচা এসে বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই এখানে কোথায় যাচ্ছিস…কার সঙ্গে যাচ্ছিস…
রিমি কোনো জবাব দিতে পারল না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেজো চাচা আবার বললেন, কি রে, তোর বাবা-মা কোথায়? কার সঙ্গে এসেছিস?
রিমির চিন্তাসূত্র কেটে গেল। জিতু মিয়া এসে বলল, একজন ভদ্রলোক এসেছে।
রিমির বুক ধক করে উঠল। হকচকানো গলায় বলল, কে, কে এসেছে রে?
চিনি না আফা।
চোখে চশমা আছে?
হুঁ।
রিমি ভেবে পেল না সে এই অবস্থাতেই যাবে না কাপড় বদলাবে। সে বালতিতে। কাপড় ভিজিয়েছিল। সাবানপানিতে তার শাড়ি মাখামাখি। চুল বাঁধা নেই। এইভাবে কারো সামনে যাওয়া যায়? কাপড় বদলাতে কতক্ষণ লাগবে? রিমি অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাপড় বদলাল না। যেমন ছিল তেমনি বের হয়ে এসে দেখে ফরহাদ ভাই নন। অপরিচিত একজন মানুষ। মেয়ের জন্যে প্রাইভেট টিউটর চান। সেই বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন।
রিমি কঠিন গলায় বলল, ও বাসায় গিয়ে কাউকে পড়ায় না। আপনি অন্য কারো কাছে যান। ভদ্রলোক অবাক হয়ে রিমির দিকে তাকালেন—এমন চমৎকার মেয়ের কাছে এমন কঠিন স্বরে কোনো উত্তর তিনি হয়ত আশা করেন নি।