অধ্যায় ৪ : জিন মেশিন
সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্রগুলো তাদের যাত্রা শুরু করে জিনদের ধারণ করার জন্য একটি অক্রিয় আধার হিসাবে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে রাসায়নিক যুদ্ধ এবং দূর্ঘটনাজনিত আণবিক গোলাবর্ষণের ঘাত প্রতিঘাতের ধ্বংসলীলা থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য চারপাশে একটি দেয়ালের ব্যবস্থা করা ছাড়া শুরুর সেই টিকে থাকার যন্ত্রগুলো বেশী কিছু করেনি। শুরুর সেই দিনগুলোতে তারা আদিম সুপে সহজলভ্য নানা জৈব অণুগুলোকে খাদ্য হিসাবে গ্রহন করেছে। এই সহজ জীবন একসময় শেষ হয় যখন আদিম সুপে থাকা জৈব খাদ্য, যা খুব ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল বহু শতাব্দীর সূর্যের আলোর শক্তির প্রভাবে, সবই ব্যবহৃত হয়ে গিয়েছিল। টিকে থাকার যন্ত্রগুলোর একটি প্রধান শাখা, যাদের আমরা উদ্ভিদ বলি, তারা নিজেরাই সাধারণ সরল অণু থেকে জটিল অণু সৃষ্টি করার জন্যে সরাসরি সূর্যের আলো ব্যবহার করতে শুরু করেছিল, সেই প্রাচীন সুপের সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াটির পুনমঞ্চস্থ করে, তবে এবার সেই প্রক্রিয়াটি বহু দ্রুতগতিতে ঘটে। আরেকটি শাখা, যারা প্রাণী হিসাবে এখন পরিচিত, তারা ‘আবিষ্কার করেছিল কিভাবে উদ্ভিদদের এই রাসায়নিক শ্রমটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়, হয় তাদের খাদ্য হিসাবে গ্রহন করে অথবা অন্য প্রাণীদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে। টিকে থাকার যন্ত্রগুলোর প্রধান দুটি শাখার প্রতিটিতে বিচিত্র জীবনাচরণে তাদের দক্ষতা বাড়াতে ক্রমবর্ধমান হারে আরো বেশী উদ্ভাবনী কৌশল বিবর্তিত হয়েছিল এবং সেই সাথেই জীবন যাপনের নতুন উপায়গুলো নিরন্তরভাবেই সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছিল। উপশাখা এবং উপ-উপ-শাখারা বিবর্তিত হয়েছে। জীবনধারণের জন্য প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট বিশেষায়িত উপায়ে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে: সাগরে, মাটিতে, বাতাসে, মাটির নীচে, গাছে এবং অন্যান্য জীবিত শরীরের অভ্যন্তরে। এই উপ-শাখা-প্রশাখাগুলো জন্ম দিয়েছে সুবিশাল এই জীববৈচিত্র্য, আমাদের আজ যা বিসিত আর মুগ্ধ করে।
বহু কোষী শরীরের জীব হিসাবে প্রাণী এবং উদ্ভিদরা বিবর্তিত হয়েছে, প্রতিটি কোষে জিনদের সম্পূর্ণ কপি বন্টন করা হয়েছে। আমাদের জানা নেই কখন, কেন অথবা স্বতন্ত্রভাবে কত বার এটি ঘটেছে। কিছু গবেষক ‘কলোনির’ (উপনিবেশ) রুপক ব্যবহার করেন, তারা শরীরকে অগণিত কোষের একটি কলোনি হিসাবে বর্ণনা করেন। শরীরকে আমি কোষ নয় বরং “জিনদের’ কলোনি হিসাবে এবং কোষগুলোকে, জিনদের রাসায়নিক কারখানার সুবিধাজনক কার্যকরী ইউনিট হিসাবে ভাবতে পছন্দ করি।
তারা হয়তো জিনদের কলোনি হতে পারে কিন্তু এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, তাদের আচরণে, শরীরগুলো নিজস্ব একটি স্বতন্ত্রতা অর্জন করে। একটি প্রাণী তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে সমন্বিত সম্পূর্ণ, অসংখ্য কোষের সমন্বিত উদ্যোগে সৃষ্ট একক একটি ইউনিট হিসাবে।আত্মগতভাবে আমি নিজেকে অসংখ্য কোষের সমন্বয়ে সৃষ্ট কোনো কলোণী হিসাবে নয়, বরং একক একটি ইউনিট হিসাবে অনুভব করি। আর এটাই প্রত্যাশিত। নির্বাচন সেই সব জিনদের সাহায্য করেছে যারা পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যতাপূর্ণ সমন্বয় রক্ষা করে। সীমিত সম্পদের জন্যে সুতীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, অন্যান্য টিকে থাকার যন্ত্রদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করার অবিরাম সংগ্রাম ও নিজেকে অন্য কারো খাদ্য হওয়া থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টায়, বিচ্ছিন্ন কোষের একত্রে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার সমন্বয়হীনতা অপেক্ষা একক ইউনিট হিসাবে শরীরে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত হবার অবশ্যই কোন বিশেষ সুবিধা আর উপযোগিতা আছে। বর্তমানে জিনদের অনিবর্তনীয়ভাবেই জটিল পারস্পরিক সহ-বিবর্তন এমন একটি পর্যায় অবধি অগ্রসর হয়েছে যে কোনো একটি একক সারভাইভাল মেশিনের সমাজবদ্ধ হিসাবে বসবাস করার রুপটি আসলেই শনাক্ত করা সম্ভব না। সত্যিই বহু জীববিজ্ঞানীরাও এটি এভাবে শনাক্ত করেন না এবং আমার সাথে তারা দ্বিমত পোষণ করবেন।
সৌভাগ্যক্রমে, এই বইটির বাকী অংশের জন্যে সাংবাদিকরা যে বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্যতা বলে থাকেন, এই মতানৈক্য মূলত অ্যাকাডেমিক বা তাত্ত্বিক। ঠিক যেমনভাবে ‘কোয়ান্টা বা মৌলিক কণা সম্বন্ধে কথা বলা সুবিধাজনক নয় যখন আমরা গাড়ি কিভাবে কাজ করে সেটি নিয়ে আলোচনা করি, তেমনি যখন আমরা টিকে থাকার যন্ত্রগুলোর আচরণ নিয়ে আলোচনা করবো, তখন জিনদের আলোচনায় বার বার টেনে আনা অনেক সময়ই খুব ক্লান্তিকর আর অপ্রয়োজনীয় অনুভূত হতে পারে। সুতরাং বাস্তব ক্ষেত্রে একটি নিকটবর্তিতার আশ্রয় নেয়া সাধারণত সুবিধাজনক, এমন কিছু যা পুরোপুরি এক না হলেও তাদের সদৃশ্য অর্থে খুব নিকটবর্তী। সেই অর্থে আমরা কোনো একক সদস্যর শরীরকে গন্য করতে পারি একটি ‘এজেন্ট হিসাবে, যারা ভবিষ্যতে প্রজন্মের শরীরে এর সবগুলো জিনের সংখ্যা বাড়ানোর ‘চেষ্টা করে। সুবিধাজনক ভাষাই আমি ব্যবহার করবো। যদি না আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়, ‘পরার্থবাদী আচরণ” এবং “স্বার্থপর আচরণের অর্থ হবে, একটি জীব শরীরের প্রতি অন্য একটি জীব শরীরের আচরণ।
এই অধ্যায়টি ‘আচরণ সংক্রান্ত, দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন কৌশল, যা মূলত ব্যবহার করে টিকে থাকার যন্ত্রগুলোর প্রাণী শাখাঁটি। কোনো প্রাণী হয়ে ওঠে সক্রিয় উদ্দেশ্য সাধনের তীব্র আকাঙ্খসহ একটি জিন বহনকারী: ‘জিন যন্ত্র। এই আচরণের বৈশিষ্ট্য, যেমন করে জীববিজ্ঞানীরা এই শব্দটিকে ব্যবহার করেন, খুব দ্রুত একটি প্রক্রিয়া। উদ্ভিদরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে, কিন্তু খুবই ধীরে। খুব দ্রুতগতিতে চালানো ফিল্মে যখন দেখা হয়, আরোহী উদ্ভিদকে দেখে মনে হতে পারে যেন কোনো সক্রিয় প্রাণী। কিন্তু বেশীর ভাগ উদ্ভিদের স্থান পরিবর্তন আসলে অপ্রতিবর্তনযোগ্য বৃদ্ধি। প্রাণীরা, আবার অন্যদিকে শত সহস্র গুণ দ্রুততার সাথে নড়াচড়া করার কৌশল বিবর্তিত করেছে। উপরন্তু, যে নড়াচড়া তারা করে সেটি প্রতিবর্তনযোগ্য বা চূড়ান্ত নয় এবং যা অসীম সংখ্যকবার পুনরাবৃত্তযোগ্য।
এই দ্রুততার সাথে স্থান পরিবর্তন করার জন্য যে যন্ত্রটি প্রাণীরা বিবর্তিত করেছে, সেটি হচ্ছে মাংসপেশী। মাংসপেশীরা হচ্ছে ইঞ্জিন, যেটি বাষ্পীয় ইঞ্জিন এবং ইন্টারনাল কম্বাশন বা অন্তর্দহন ইঞ্জিনের মতই, যান্ত্রিক গতি অর্জনের জন্যে যা রাসায়নিক জ্বালানীতে সঞ্চিত শক্তি ব্যবহার করে। পার্থক্যটি হচ্ছে গ্যাসীয় চাপের বিপরীত, যা আমরা দেখি বাষ্পীয় বা ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে, এখানে তাৎক্ষণিক যান্ত্রিক শক্তি কোনো মাংসপেশীতে টেনশন বা চাপ রুপে সৃষ্টি হয়। কিন্তু মাংসপেশী আসলেই ইঞ্জিনের মত সেই অর্থে, তারা প্রায়শই তাদের শক্তি প্রয়োগ করে তন্তু, আর হিঞ্জ বা কবজাসহ লিভার বা ভারোত্তলন-দণ্ডের মাধ্যমে। আমাদের শরীরে এই লিভারগুলো পরিচিত অস্থি বা হাড় হিসাবে, আর কর্ড বা তন্তু হচ্ছে টেনডন এবং হিঞ্জ হচ্ছে সন্ধি বা জোড়া। সঠিক সেই আণবিক প্রক্রিয়াটি সম্বন্ধে এখন অনেক কিছু আমাদের জানা, যা ব্যবহার করে মাংসপেশী এর কর্ম সম্পাদন করে, কিন্তু আমার কাছে মাংসপেশীর সংকোচনের সময় কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হয়, সেই বিষয়টি আরো বেশী কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়।
আপনি কি কখনো কিছুটা জটিলতাসহ কোনো কৃত্রিম যন্ত্রকে দেখেছেন, উল-বোনা বা সেলাইমেশিন, কোনো তাঁত, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বোতলজাত করার যন্ত্র কিংবা মাঠের খড়কে কুণ্ডলী পাকানোর ‘হে বেলার’ মেশিন? মোটিভ পাওয়ার বা উদ্দেশ্যমূলক শক্তি আসে কোনো একটি জায়গা থেকে, ধরুন, একটি ইলেকট্রিক মটর বা একটি ট্রাক্টর। কিন্তু আরো বেশী ধাঁধার ব্যপারটা হচ্ছে সেই কাজগুলো করার জন্য এর অত্যন্ত সূক্ষ্ম ধারাবাহিকতা। সঠিক ধারাবাহিক নিয়ম মেনে ভালভগুলো খোলে আর বন্ধ হয়, ইস্পাতের আঙ্গুল দক্ষভাবে একটি খড়ের গাঁটির চারপাশে দড়ির গিট বাধে, এবং ঠিক সঠিক সময় একটি ছুরি বের হয়ে এসে সুতাটি কেটে দেয়। অনেক কৃত্রিম মেশিনের এই সময়-সমন্বয় অর্জিত হয়েছে একটি অসাধারণ আবিষ্কার ‘ক্যাম’ এর মাধ্যমে। এটি খুব সাধারণ ঘূর্ণ্যমান গতিকে একটি জটিল ছন্দময় নানা অপারেশনের প্যাটার্নে অনূদিত করে অদ্ভুত অথবা বিশেষ আকারের একটি চাকা ব্যবহার করে। মিউজিক বক্সের মূলনীতিও একই রকম। অন্যান্য মেশিন, যেমন, স্টিম অর্গান এবং পিয়ানোলা কাগজের রোল বা কার্ড ব্যবহার করে, যাদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সজ্জা ছিদ্র করা থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ যান্ত্রিক টাইমারের ব্যবহারের বদলে ইলেক্ট্রনিক টাইমার ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। ডিজিটাল কম্পিউটার হচ্ছে অনেক বড় আর বহুমুখী কর্ম সম্পাদনের জন্যে নির্মিত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের একটি উদাহরণ, যা জটিল সময় সমন্বয়কৃত নানা গতির প্যাটার্ন তৈরী করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আধুনিক ইলেক্ট্রনিক মেশিন, যেমন, কম্পিউটারের মৌলিক একটি উপাদান হচ্ছে, সেমিকন্ডাক্টর, যাদের সবচেয়ে পরিচিত রুপটি হচ্ছে, ট্রানজিস্টর।
টিকে থাকার যন্ত্রগুলো মনে হয় “ক্যাম’ আর ‘পাঞ্চড কার্ডের’ প্রযুক্তি পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়েছিল। যে যন্ত্রাংশটি তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য ব্যবহার করে সেটির বেশ মিল আছে একটি ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের সাথে। যদিও মূল পরিচালনার স্তরে এটি খুব কঠোরভাবে পৃথক। জৈববৈজ্ঞানিক কম্পিউটারের মূল একক হচ্ছে স্নায়ু কোষ বা নিউরন, তারা অভ্যন্তরীণ স্তরে যেভাবে কাজ করে সেটির সাথে ট্রানজিসটরের কাজ করার প্রক্রিয়ার সাথে কোনো মিল নেই। অবশ্যই নিউরনগুলো পারস্পরিক সংযোগে যে সংকেত ব্যবহার করে করে, সেটি খানিকটা ডিজিটাল কম্পিউটারের পালস কোডের মত মনে হতে পারে, কিন্তু প্রতিটি নিউরন এককভাবে ট্রানজিস্টরের তুলনায় অনেক বেশী জটিল আর সূক্ষ্ম উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণে দক্ষ একটি ইউনিট। অন্যান্য অংশের সাথে মাত্র তিনটি সংযোগের বদলে একটি একক নিউরনের বহু হাজার সংখ্যক সংযোগ থাকতে পারে। ট্রানজিস্টরের তুলনা নিউরন ধীরে কাজ করে। কিন্তু ক্ষুদ্রাকৃতিকরণের ক্ষেত্রে এটি আরো অনেক অগ্রসর। গত দুই দশক ধরে ইলেকট্রনিক শিল্পে এর আকারে ছোট হয়ে আসবার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টিকে প্রকাশ করা যেতে পারে এভাবে, মানুষের মস্তিষ্কে দশ হাজার মিলিয়ন নিউরন আছে, এবং আপনি আপনার মাথার খুলির মধ্যে মাত্র কয়েকশত ট্রানজিস্টরের জায়গা দিতে পারবেন।
উদ্ভিদদের কোনো নিউরনের প্রয়োজন নেই, কারণ তারা তাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে পারে জায়গা পরিবর্তন না করে। কিন্তু বহু সংখ্যক প্রাণীদের গ্রুপে আমরা নিউরন দেখি। এটি হয়তো প্রাণীদের বিবর্তনের শুরুর দিকে উদ্ভাবিত হয়েছে এবং সব গ্রুপই উত্তরাধিকার সূত্রে এটি পেয়েছে। অথবা এটি বেশ কয়েকবার উদ্ভব হয়েছে স্বতন্ত্রভাবে।
নিউরন মৌলিকভাবে শুধুমাত্র কোষ, অন্য যেকোনো কোষের মত যার নিউক্লিয়াস আর ক্রোমোজোম আছে। কিন্তু তাদের কোষ পর্দাগুলো সজ্জিত সরু, তারের মত নানা শাখা-প্রশাখা সহ বিস্তৃত। প্রায়শই নিউরনের নির্দিষ্টভাবেই একটি বিশেষ লম্বা ‘তারের মত উপাঙ্গ থাকে, যাকে বলা হয় ‘অ্যাক্সন’। যদিও অ্যাক্সনের প্রশস্ততা আণুবীক্ষণীক, তবে এর দৈর্ঘ্য হতে পারে কয়েক ফুট। জিরাফের ঘাড়ে একক অ্যাক্সনগুলো পুরো ঘাড়ের দৈর্ঘ্য জুড়ে থাকে। অ্যাক্সনরা সাধারণত একসাথে গাঁটবাঁধা থাকে মোটা বহু তার বিশিষ্ট কোনো কেবলের মত, যাদের বলা হয় নার্ভ বা স্নায়ুতন্তু। শরীরের এক প্রান্ত থেকে এরা অন্য প্রান্তে বার্তা বহন করে নিয়ে যায়, ট্রাঙ্ক টেলিফোন কেবলের মত। অন্য নিউরনগুলোর অপেক্ষাকৃত কম লম্বা অ্যাক্সন থাকে। এবং তারা একগুচ্ছ স্নায়ু কোষের ঘন একটি উপাঙ্গ তৈরী করে, যাদের আমরা বলি গ্যাঙলিয়া অথবা যখন সেই স্নায়ুকোষগুচ্ছ আকারে অনেক বড় হয়, সেটি ব্রেইন বা মস্তিস্ক তৈরী করে। কাজের দিক থেকে মস্তিস্ককে আমরা কম্পিউটারের মত মনে করতে পারি (১)। তারা সমরুপ এই অর্থে যে উভয় যন্ত্রই, নানা ধরনের জটিল প্যাটার্নের উপাত্ত ইনপুট বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষিত তথ্যভাণ্ডারে প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র যাচাই করার পর জটিল আউটপুট তৈরী করে।
প্রধান যে উপায়ে মস্তিস্ক আসলে টিকে থাকার যন্ত্রগুলোর সফলতার প্রতি অবদান রাখে, সেটি হচ্ছে মাংসপেশীর সংকোচন নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করা। আর সেটি করতে তাদের দরকার মাংসপেশী পর্যন্ত দীর্ঘ ‘কেবল’ সংযোগ, যাদের বলা হয় মটর নার্ভ, মটর স্নায়ু। কিন্তু এটি দক্ষভাবে জিনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে শুধুমাত্র যদি পেশী সংকোচনের সময় যদি বাইরের পৃথিবীতে ঘটা নানা ঘটনার সময়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। চোয়ালের মাংসপেশী সংকোচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ শুধু যখন এমন কোনো কিছুর সংস্পর্শে আসে যা কামড় দেয়া যায় এবং পায়ের মাংস দৌড়ানোর ভঙ্গীতে সংকোচনের দরকার, যখন কোনো কিছু থেকে দৌড়ে পালানো বা দৌড়ে কাছে যাবার দরকার আছে। আর এ কারণে প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই প্রাণীদের প্রতি আনুকুল্য প্রদর্শন করে যারা অনুভব করার ইন্দ্রিয় দিয়ে সজ্জিত, যে অঙ্গগুলো বাইরের পৃথিবীর নানা ভৌত ঘটনার প্যাটার্ন নিউরনের জন্যে স্পন্দনশীল সংকেতে অনূদিত করে। চোখ, কান, স্বাদ নিরূপক কোষগ্রন্থি এই সব ইন্দ্রিয়গুলোর সাথে মস্তিষ্ক যুক্ত থাকে স্নায়ুরজ্জ্ব বা কেবলের মাধ্যমে, যাদের বলা হয় সেন্সরী বা সংবেদী স্নায়ু। সংবেদী এই তন্ত্রের কাজ বিশেষভাবেই ধাঁধার মত। কারণ প্যাটার্ন চেনার প্রক্রিয়ায় তারা আরো অনেক বেশী অসাধারণ কাজ করতে পারে, যা মানুষের বানানো সবচেয়ে দামী আর সেরা যন্ত্রগুলোকেও হার মানায়। যদি সেরকম না হতো এটি, তাহলে সব টাইপিষ্টই অপ্রয়োজনীয় বাহুল্য হিসাবে চিহ্নিত হতেন, তাদের জায়গা দখল করে নিত মানুষের গলার আওয়াজ শনাক্তকারী বা। হাতের লেখা পড়তে জানা কোনো যন্ত্র। মানব টাইপিষ্টদেরএখনও বহু দশক প্রয়োজন আছে।
হয়তো এমন কোনো সময় ছিল যখন সংবেদী অঙ্গগুলো কম বেশী সরাসরি মাংসপেশীর সাথে সংযুক্ত হতো। আসলেই সী অ্যানিমোনরা এই অবস্থা থেকে আজও খুব দূরে নয়, কারণ তাদের জীবনাচরণে দক্ষতার সাথে এটি কাজ করে। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে ঘটা কোনো ঘটনার সময় আর মাংসপেশীর সংকোচনের ‘সময়ের মধ্যে আরো জটিল আর পরোক্ষ সম্পর্ক অর্জন করতে, যোগাযোগের মধ্যস্থ হিসাবে কোনো এক ধরনের মস্তিস্কের আবশ্যিকতা আছে। একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে বিবর্তনের স্মৃতি আবিষ্কার। এই কৌশলটি ব্যবহার করে, শুধুমাত্র নিকটবর্তী অতীতের কোনো ঘটনার দ্বারাই নয়, বরং আরো দূর অতীতের ঘটনার দ্বারাও মাংসপেশী সংকোচনের সময়কে প্রভাবিত করা যায়। স্মৃতি বা স্টোর বা ভাণ্ডার, ডিজিটাল কম্পিউটারের জন্যেও একটি অপরিহার্য অংশ। কম্পিউটার স্মৃতি মানুষের স্মৃতির চেয়ে অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য, কিন্তু তাদের ধারণ ক্ষমতা কম, আর তাদের তথ্য-পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়াটিও অনেক বেশী পরিমানে অপরিশীলিত।
সারভাইভাল যন্ত্রদের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি আচরণ হচ্ছে এর আপাতগ্রাহ্য একটি উদ্দেশ্যময়তা। এবং এর অর্থ হিসাবে আমি শুধু বোঝাতে চাইছি না যে, কোনো সারভাইভাল যন্ত্রকে মনে হতে পারে প্রাণীদের জিনগুলোকে টিকে থাকতে সাহায্য করার লক্ষ্যে খুব হিসাব করেই সৃষ্টি করা হয়েছে, যদিও অবশ্যই এটি তা করছে। আমি বলতে চাইছি মানুষের উদ্দেশ্য প্রণোদিত কোনো ব্যবহারের কাছাকাছি একটি সদৃশ উদাহরণ হিসাবে। আমরা যখন কোনো প্রাণীকে খাদ্য বা কোনো প্রজনন সঙ্গী বা হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ‘খুঁজতে’ দেখি, সেখানে এই ধরনের কোনো অনুসন্ধানে আমরা নিজেরা যা অনুভব করি, সেই অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট কিছু আত্মগত অনুভূতি যুক্ত না করে থাকাটা আমাদের জন্য খুব কঠিন। এগুলো হতে পারে কোনো কিছুর জন্য ‘আকাঙ্খ”, বা কোনো কাঙ্খিত বস্তুর একটি মানসিক চিত্র’, একটি লক্ষ্য’ বা ‘উদ্দেশ্য। আমাদের আত্মগত নিজস্ব ভাবনার প্রমাণ থেকে আমরা প্রত্যেকেই জানি কমপক্ষে একটি আধুনিক সারভাইভাল যন্ত্রে এই উদ্দেশ্যময়তা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে বিবর্তিত হয়েছে যাকে আমরা বলি ‘কনশাসনেস’ বা সচেতনতা। এর অর্থ কি সেই বিষয়ে আলোচনা করার জন্যে আমি দার্শনিক হিসাবে যথেষ্ট নই। সৌভাগ্যজনকভাবে আমাদের বর্তমান লক্ষ্যের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ মেশিনদের নিয়ে কথা বলা খুব সহজ, যারা এমনভাবে আচরণ করে ‘যেন মনে হয় কোনো একটি উদ্দেশ্য পূরণে এটি কোনো কাজ করতে প্রণোদনা পাচ্ছে এবং এটি আরো বেশ উন্মুক্ত করে দেয়, তারা কি আসলেই সচেতন কিনা সেই প্রশ্নটিকে। এই মেশিনগুলো মূলত খুবই সরল, এবং অসচেতন উদ্দেশ্যপূর্ণ আচরণ প্রকৌশল বিজ্ঞানে খুব সাধারণ একটি ঘটনা। সবচেয়ে ধ্রুপদী উদাহরণ হচ্ছে ‘ওয়াট স্টিম গভর্নর।
যে মৌলিক মূলনীতিটি এখানে জড়িত তাকে বলা হয় ‘নেগেটিভ ফিডব্যাক’, যার বেশ কিছু ভিন্ন রুপ আছে। সাধারণভাবে যা ঘটে সেটি হচ্ছে: কোনো একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ মেশিন’, অর্থাৎ যে মেশিনটি বা কোনো কিছু এমনভাবে আচরণ করে যেন এর একটি সচেতন উদ্দেশ্য আছে, সাধারণত এ ধরনের মেশিনে পরিমাপ করার একটি যন্ত্রাংশ আছে, বর্তমান পরিস্থিতি এবং ‘কাঙ্খিত পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য যা সারাক্ষণ পরিমাপ করে। এটি এমনভাবে তৈরী যে, পার্থক্যটি যত বড় হবে, যন্ত্রটি তত পরিশ্রম করে কাজ করবে, এবং এভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিনটি এই দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্যটি সব সময় কমানো চেষ্টা করবে– একারণে এটিকে বলা হয় ‘নেগেটিভ ফিডব্যাক’ এবং এভাবেই আসলেই যন্ত্রটি বিশ্রামে পর্যায়ে প্রবেশ করতে পারে যখন কাঙ্খিত পরিস্থিতিটি অর্জিত হয়। ওয়াট গভর্নরে এক জোড়া বল থাকে, যেটি স্টিম ইঞ্জিনের চাপে ঘুরতে থাকে, প্রতিটি বলই কজাসহ একটি বাহুর শেষ প্রান্তে লাগানো থাকে। যত দ্রুত বলগুলো ঘুরতে থাকে ততই কেন্দ্রমুখী বল তাদের ধরে রাখা বাহুটাকে আনুভূমিক অবস্থায় নিয়ে যেতে থাকে, আর এই প্রবণতাকে বাধা দিতে থাকে মাধ্যাকর্ষণ। আর একটি ভালভ বা কপাটিকার সাথে বাহুগুলো আটকে থাকে, যার মাধ্যমে ইঞ্জিনে বাষ্প প্রবেশ করে এমনভাবে যে বাষ্প প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, যখনই বলসহ বাহুটি সমান্তরাল একটি অবস্থানে পৌঁছায়। এভাবেই যদি ইঞ্জিনটি বেশী জোরে চলতে থাকে, তাহলে সেখানে প্রবেশ করা বাষ্পের প্রবাহ কিছুটা কমে যাবে, এবং আবার যখন এটি বেশী ধীরে চলতে শুরু করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভালভ দিয়ে আরো বেশী বাষ্প ভিতরে প্রবেশ করবে এবং এটি আবার দ্রুত চলতে থাকবে। এধরনের ‘পারপাস’ মেশিনগুলো প্রায়ই ওভারশুটিং বা যতটুকু এর সীমা সেটি অতিক্রম করা এবং টাইম-ল্যাগ বা সময়ের ব্যবধান বা বিরতি, যখন এটি আবার কাঙ্খিত পরিস্থিতিতে ফিরে আসে, এভাবে দ্বিমুখী দুটি পরিস্থিতির মধ্যে আন্দোলিত হয় এবং প্রকৌশলীদের শিল্পের একটি অংশ হচ্ছে এই আন্দোলিত হওয়াকে বাড়তি কোনো যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা।
ওয়াট গভর্নরের ‘কাঙ্খিত পরিস্থিতি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট গতিতে ঘোরা। অবশ্যই এটি সচেতনভাবে সেটি কামনা করছে না। কোনো একটি মেশিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র সেই অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করা, যে অবস্থায় এটি ফিরে আসতে চায়। আধুনিক পারপাস মেশিনগুলো আরো জটিল ‘জীবন-সদৃশ’ কোনো আচরণ অর্জন করার জন্য ‘নেগেটিভ ফিডব্যাকের’ মত মূলনীতিগুলোর একটি সম্প্রসারিত রুপ ব্যবহার করে। গাইডেড মিসাইলদের, যেমন আমরা দেখি তারা সক্রিয়ভাবে তাদের লক্ষ্য খুঁজে বের করছে এবং যখনই তারা তাদের লক্ষ্যবস্তুকে তাদের সীমানায় নিয়ে আসে, মনে হয় ক্ষেপণাস্ত্রটি যেন সেই লক্ষ্যবস্তুটিকে সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করছে, এর সব পালাবার ভঙ্গি, বাক নেয়া সবই খেয়াল করছে এবং কখনো কখনো আগে থেকে ধারণা করছে বা লক্ষ্যবস্তুটি কি করতে পারে, সেটি সম্বন্ধে ‘পূর্বধারণা করছে। এবং এটি কিভাবে করছে সেই বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেবার প্রয়োজন নেই। তবে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে বহু ধরনের নেগেটিভ ফিডব্যাক’, ‘ফিড ফরোয়ার্ড এবং আরো অন্যান্য কিছু নীতিমালা আছে, যা প্রকৌশলীরা খুব ভালো করে বোঝেন এবং এখন আমরা জানি, জীবন্ত শরীরের নানা কাজের সাথেও এটি সংশ্লিষ্ট। কোনোভাবেই এখানে সচেতনতার মত কোনো কিছু কাজ করছে এমন ভাবার দরকার নেই, যদিও কোনো অদক্ষ মানুষ এর আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্যমূলক এবং পুর্বপরিকল্পিত আচরণ দেখে, হয়তো সমস্যায় পড়বেন বিশ্বাস করতে যে, এই ক্ষেপণাস্ত্রটি আসলেই কোনো মানব পাইলটের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেই।
খুবই সাধারণ একটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে যে, যেহেতু একটি মেশিন যেমন, গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মূলত পরিকল্পনা এবং তৈরী করেছে সচেতনতাসহ মানুষরা, সুতরাং অবশই এটি সত্যিকারভাবে সচেতনতাসহ মানুষের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন। এই ভ্রান্ত যুক্তিটির আরেকটি রুপ হচ্ছে যে, কম্পিউটার আসলে দাবা খেলে না, কারণ তারা সেই কাজটি করতে পারে যখনই কোনো মানব অপারেটর সেটি করতে তাদের নির্দেশ দেয়। বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ বোঝা যে কেন এটি ভুল একটি যুক্তি। কারণ এটি আমাদের সেই সত্যটি বোঝার ক্ষমতার উপর এর প্রভাব ফেলে, যখন আমরা বলছি যে, জিনদের বলা যেতে পারে তারা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য কম্পিউটারের দাবা খেলা খুব ভালো একটি উদাহরণ হতে পারে। সুতরাং সংক্ষেপে বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করবো।
কম্পিউটার এখনও মানব গ্রান্ড মাষ্টারদের মত দাবা খেলতে পারেনা, তবে তারা এমন একটি মানদণ্ডে পৌঁছেছে যা কোনো দক্ষ সখের খেলোয়াড়ের সমতুল্য। আরো কঠোর অর্থে বলতে গেলে, “প্রোগ্রামগুলো’ দক্ষ শখের খেলোয়াড়দের স্তরে পৌঁছাতে পেরেছে, কারণ একটি দাবা খেলার প্রোগ্রাম কোন কম্পিউটারের শরীরের মধ্যে বসে এর দক্ষতা দেখাচ্ছে সেটা নিয়ে সে আদৌ খুঁত খুঁতে নয়। তাহলে এখানে মানব প্রোগ্রামারদের ভূমিকাটি কি? প্রথমত, সে অবশ্যই প্রতিটি মূহুর্তে কম্পিউটারকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, পুতুল নিয়ে খেলা দেখানো শিল্পীর হাতের বাধা পুতুলদের মত। কারণ সেটি পুরোপুরিভাবে প্রতারণা হবে। তার কাজ হচ্ছে প্রোগ্রামটি লেখা, এবং সেই প্রোগ্রামটি কম্পিউটারে স্থাপন করা এবং তারপর কম্পিউটার নিজের মত করে একা একাই কাজ করবে: আর কোনো মানবীয় হস্তক্ষেপ নেই, শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় তার দান কি হবে সেটি কি বোর্ডের মাধ্যমে প্রবেশ করানো ছাড়া। প্রোগ্রামার কি তাহলে সম্ভাব্য সব দাবার দান আগে থেকে অনুমান করে রেখেছেন এবং কম্পিউটারকে সেই ভালো দানগুলোর একটি দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেছেন, যেকোনো সম্ভাব্য পরিস্থিতির জন্য একটি? অবশ্যই না, কারণ দাবা বোর্ডে সম্ভাব্য অবস্থানের সংখ্যা এতই বিশাল যে, পুরো পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে সেই তালিকা সম্পূর্ণ করার আগে। আর একই কারণে সম্ভাব্য সব দান ব্যবহার করে সম্ভবত কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম করা সম্ভব নয়, যা কিনা এটি ‘কল্পনা’ করতে পারে, এবং প্রতিটি দানের পরবর্তী পাল্টা দানগুলো, যতক্ষণ না এটি খেলাটি জিতবার একটি কৌশল খুঁজে পায়। দাবার বোর্ডে সারা গ্যালাক্সীতে যত পরমাণু আছে তারচেয়ে বেশী সংখ্যক সম্ভাব্য দান আছে। কম্পিউটারকে দাবা খেলার জন্য প্রোগ্রামিং করার এগুলো হচ্ছে অসমাধানযোগ্য কিছু সমস্যা। আসলেই এটি অতিমাত্রায় একটি কঠিন সমস্যা এবং এজন্য খুব একটা বিস্ময়কর না ব্যপারটা যে, সবচেয়ে সেরা প্রোগ্রামগুলো এখনও গ্রান্ড মাস্টারের মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি।
একজন প্রোগ্রামারের আসল দ্বায়িত্ব হচ্ছে বরং অনেকটা বাবার মত, যিনি তার ছেলেকে দাবা খেলা শেখাচ্ছে। তিনি কম্পিউটারকে খেলার মূল দানগুলো সম্বন্ধে নির্দেশ দেন, আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি সম্ভাব্য শুরুর দান থেকে না, বরং বলা যায় অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত আরো সাধারণ কিছু নিয়ম ব্যবহার করে। তিনি হয়তো আক্ষরিক অর্থে পরিষ্কার ইংরেজীতে বলবেন না যে, ‘বিশপ বা গজ কৌণিক পথে চলে’ বরং এর গাণিতিক সমতুল্য কোনো নির্দেশ, যেমন যদিও সংক্ষিপ্তভাবে: ‘বিশপের নতুন কোঅর্ডিনেট পাওয়া যাবে তার পুরোনো কোঅর্ডিনেট থেকে, একই ধ্রুব পরিমান সংখ্যা যোগ করে– যদিও একই চিহ্ন হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই–পুরোনো x আর y উভয় কোঅর্ডিনেটের সাথে। তারপর তিনি হয়তো কিছু উপদেশ’ সেখানে প্রোগ্রাম করতে পারেন, যা লেখা হয় কোনো এক ধরনের গাণিতিক লজিক্যাল ভাষায়, যা মানুষের ভাষায় একই ধরনের ইঙ্গিতের মত, যেমন ‘রাজাকে কখনোই অরক্ষিত রাখা যাবে না বা কিছু উপযোগী কৌশল যেমন, নাইট বা ঘোড়া ব্যবহার করে ফর্কিং করা। বিস্তারিত বিষয়গুলো কোন সন্দেহ নেই দারুন আগ্রহ উদ্দীপক, কিন্তু সে বিষয়ে আলোচনা আমাদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক হবে। প্রধান বিষয়টি হচ্ছে এটি; যখন আসলেই এটি খেলবে, কম্পিউটার একা একাই খেলবে, এবং তখন সে তার মাষ্টার বা প্রোগ্রামারের কাছ থেকে কোনো প্রত্যক্ষ সাহায্য আশা করতে পারেনা। প্রোগ্রামাররা সম্ভাব্য সেরা সব কৌশল প্রোগ্রাম করে আগে থেকে কম্পিউটারকে প্রস্তুত করে রাখতে পারেন, বিশেষ কিছু দক্ষতার তালিকার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করে নানা ধরনের কৌশল আর দান সম্বন্ধে ইঙ্গিত দিয়ে রাখতে।
জিনরাও তাদের টিকে থাকার যন্ত্রগুলোর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা যেটা করতে পারে সেটি হলো সব কিছু আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখে, এরপর সারভাইভাল মেশিনকে একাই তার সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং জিনরা অক্রিয় হিসাবে তাদের ভিতর বসে থাকে, সরাসরি তাদের আঙ্গুলগুলো পুতুলদের নিয়ন্ত্রণ করার সুতায় ধরা থাকে না, বরং তারা কাজ করে পরোক্ষভাবে, কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের মত। কেন তারা এত অক্রিয়? মাঝে মাঝে কেন তারা সরাসরি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নেয় না? এর উত্তরটা হচ্ছে তারা সেটা করতে পারেনা কারণ সময়ের ব্যাবধান বা টাইম ল্যাগ সমস্যা। ভালো করে এটা বোঝা সম্ভব হতে পারে আরেকটি সদৃশ উদাহরণ ব্যবহার করলে, এটির উৎস বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী; ফ্রেড হয়েল ও জন এলিয়টের লেখা A for Andromeda, একটি আকর্ষণীয় কল্পকাহিনী। এবং যেকোনো ভালো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত কাহিনীর অন্তরালে এরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনা আছে। বিস্ময়কর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে বইতে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, পুরোটাই ছেড়ে দেয়া হয়েছে পাঠকের কল্পনার উপর। আমি আশা করছি লেখকদ্বয় কিছু মনে করবেন না যদি বিষয়টি আমি এখানে স্পষ্ট করি।
আমাদের থেকে ২০০ আলোক বর্ষ দূরে, অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জে (২) একটি সভ্যতার অস্তিত্ব আছে, এবং তারা তাদের সভ্যতা আর সংস্কৃতিকে দূরবর্তী জগতগুলোতে প্রচার করে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছুক। কিভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে সেই কাজটি করা যেতে পারে? সরাসরি সেখানে ভ্রমণ করার তো প্রশ্নই আসে না। আলোর গতি তাত্ত্বিকভাবে উপরে একটি সীমা বেধে দিয়েছে এই মহাবিশ্বে কি গতিতে আপনি একটি জায়গা থেকে অন্য একটি জায়গায় যেতে পারবেন, আর যান্ত্রিক বিবেচনা এই গতিকে আরো নীচে নামিয়ে এসেছে, যা কিনা প্রায়োগিক স্তরে সম্ভব হতে পারে। এছাড়াও মহাবিশ্বে হয়তো বাসযোগ্য এমন কোনো জগৎ নাও থাকতে পারে, যেখানে যাবার জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে। আর এছাড়া আপনি কিভাবেই বা জানবেন কোন দিক বরাবর যেতে হবে? রেডিও বরং মহাবিশ্বের বাকী অংশের সাথে যোগাযোগ করার ভালো কোনো উপায়। কারণ, যদি আপনার যথেষ্ট ক্ষমতা থাকে কোনো একটি নির্দিষ্ট দিক বরাবর সংকেত না পাঠিয়ে আপনার সংকেতকে সব দিক বরাবর সম্প্রচার করতে পারলে, আপনি হয়তো অনেক বেশী সংখ্যক জগতের কাছে পৌঁছাতে পারবেন ( এই সংখ্যা বৃদ্ধি পায় যে পরিমান দূরত্ব সংকেতটি অতিক্রম করে তার বর্গফল অনুযায়ী); বেতার তরঙ্গ আলোর গতিতে ভ্রমণ করে, তার মানে হলো সেই সংকেতটি অ্যান্ড্রোমিডা থেকে পৃথিবীতে আসতে লাগবে ২০০ বছর। এই ধরনের দুরত্বের সমস্যাটি হচ্ছে এই দূরত্বে আপনি কখনোই কোনো কথোপকথন অগ্রসর করতে পারবেন না। এমনকি যদি আপনি সেই বাস্তব সত্যটিও বাদ দেন যে, প্রতিটি ধারাবাহিকভাবে আসা বার্তা পৃথিবীতে সম্প্রচার করবে এমন মানুষরা যারা প্রায় বারটি প্রজন্ম দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন, এত দূরে বসে কথপোকথন অব্যাহত রাখা স্পষ্টতই সময়ের অপচয়।
সত্যিকারভাবে আমাদের জন্য এই সমস্যাটি শীঘ্রই উদ্ভব হবে: পৃথিবী আর মঙ্গল গ্রহ থেকে বেতার তরঙ্গ আসা যাওয়া করতে সময় নেয় প্রায় চার মিনিট। কোনো সন্দেহ নেই যে নভোচারীদের একটার পর একটা পাল্টা বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে কথা বলার আচরণটি বদলাতে হবে এবং তার বদলে তাদের ব্যবহার করতে হবে দীর্ঘ মনোলোগ বা সলিলিকুই, অনেকটা চিঠির মত, বাক্য বিনিময়ের মত নয়। যেমন, আরেকটি উদাহরণ, রজার পেইন আমাদের দেখিয়েছেন, সমুদ্রে শব্দের গুণাবলী বা অ্যাকুষ্টিকে কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে, যার অর্থ খুব বেশী মাত্রায় জোরে উচ্চারিত তিমির কোনো গান তাত্ত্বিকভাবে সারা পৃথিবীর জুড়ে শোনা যাবে, শর্ত একটাই, তিমিরা যদি একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় সাঁতার কাটে। আসলেই তারা এভাবে নিজেদের সাথে খুব বেশী দুরত্বে যোগাযোগ করে কিনা তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু তারা যদি সেটা করে থাকে, তাদেরও সেই মঙ্গল গ্রহে বাস করা কোনো নভোচারীর মত একই সমস্যা হবে। পানিতে শব্দের গতি এমন যে, কোনো গানের আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিতে এবং একইভাবে তার উত্তর পেতে দুই ঘন্টা সময় লাগবে। আমি প্রস্তাব করছি এটিকে সেই বাস্তব সত্যটির একটা ব্যাখ্যা হিসাবে, কেন কিছু তিমি দীর্ঘ ধারাবাহিক সলিলোকুই বা স্বগতোক্তির মত শব্দ তৈরী করে, কোনো পুনরাবৃত্তি করা ছাড়াই, পুরো আট মিনিট ধরে। তারপর আবার তারা গানের শুরুতে ফিরে যায় এবং পুরো গানটি আবার পুনরাবৃত্তি করে। এভাবে বহুবার সেটি চলতে থাকে, প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ চক্রের স্থায়িত্ব প্রায় আট মিনিট।
গল্পের সেই অ্যান্ড্রোমিডাবাসীরাও ঠিক একই কাজটি করছিল। যেহেতু উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করার কোনো অর্থ হয়না, তারা যা কিছু বলতে চায় সবকিছু একসাথে গুছিয়ে একটি বিশাল অখণ্ড বার্তা হিসাবে তারা মহাশূন্যে সম্প্রচার করেছিল, বার বার, কয়েক মাস ব্যাপী একটি সময়ের চক্রাকারে। তাদের সেই বার্তার সাথে তিমির বার্তার যদিও মিল নেই। তাদের বার্তায় একটি বিশাল কম্পিউটার বানানোর জন্য সাংকেতিক নির্দেশাবলী ছিল। অবশ্যই সেই নির্দেশাবলী সেখানে মানুষের ভাষায় লেখা ছিল না, কিন্তু কোনো দক্ষ ক্রিপ্টোগ্রাফারের পক্ষে যেকোনো সাংকেতিক ভাষার মর্মোদ্ধার করার সম্ভব, বিশেষ করে যদি সেই কোডটি যিনি তৈরী করেছেন তিনি যদি চান, সহজে কেউ সেটির পাঠোদ্ধার করুক। জরডেল ব্যাঙ্ক রেডিও টেলিস্কোপে সেই বার্তাটি ধরা পড়ে এবং অবশেষে বার্তাটির অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়, এবং সেই প্রোগ্রামটি চালানোর জন্য একটি কম্পিউটার তৈরী করা হয়। যার ফলাফল মানবজাতির জন্য প্রায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের হয়েছিল, কারণ অ্যান্ড্রোমিডাবাসীদের উদ্দেশ্য সর্বজনীনভাবে খুব পরোপকারী মানসিকতাপূর্ণ ছিল না, এবং তাদের নকশা অনুযায়ী বানানো কম্পিউটারটি সারা পৃথিবীব্যাপী একনায়কতন্ত্র স্থাপন প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল, তবে গল্পের নায়ক একটি কুড়াল দিয়ে সেটি ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল অবশেষে।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সবচেয়ে মজার প্রশ্নটি হচ্ছে, কি অর্থে বলা যেতে পারে যে অ্যান্ড্রোমিডাবাসীরা পৃথিবীর নানা ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করেছিল। প্রতিটি মুহূর্তে কম্পিউটার কি করবে তার উপর তাদের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, আসলেই আদৌ কম্পিউটারটি তৈরী করা হয়েছিল কিনা সেটা তো তাদের জানারই কোনো উপায় ছিলনা। কারণ সেই খবরটি তাদের কাছে পৌঁছাতে ২০০ বছর লাগবে। কম্পিউটারের সব সিদ্ধান্ত আর কাজ পুরোপুরি তার নিজের। কোন ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে এটির এমনকি তার পরিকল্পক মাষ্টারদের কাছেও পরামর্শ নেবারও কোনো সুযোগ নেই। অনতিক্রম্য ২০০ বছরের প্রতিবন্ধকতার কারণে, তার সব নির্দেশগুলো আগে থেকে এর ভিতর তৈরী করে দেয়া হয়েছিল। নীতিগতভাবে, অবশ্যই আগে থেকে প্রোগ্রাম করতে হবে, অনেকটাই দাবা খেলার কম্পিউটারের মত, কিন্তু আরো বেশী নমনীয় ও ক্ষমতাধর স্থানীয় তথ্য ধারণ করার জন্য। আর এর কারণ সেই প্রোগ্রামটি পরিকল্পনা করতে হয়েছিল এমনভাবে যেন তা শুধু পৃথিবীতেই কাজ করে তাই না, বরং যেকোনো গ্রহে, যেখানে অগ্রসর সভ্যতার উপস্থিতি আছে, যেকোনো সেই একগুচ্ছ গ্রহ, যেখানকার বিস্তারিত পরিবেশ পরিস্থিতি সম্বন্ধে অ্যান্ড্রোমিডাবাসীদের আগে থেকে জানার কোনো উপায় ছিলনা।
ঠিক যেমন অ্যান্ড্রোমিডাবাসীদের দরকার ছিল একটি কম্পিউটার, যা পৃথিবীতে থাকবে তাদের হয়ে দৈনন্দিন সিদ্ধান্তগুলো দেবার জন্য, আমাদের জিনগুলো সেভাবে মস্তিষ্ক তৈরী করেছে। কিন্তু জিনরা শুধুমাত্র অ্যান্ডোমিডাবাসীরা না, যারা সাংকেতিক বার্তা পাঠিয়েছে; তারা নিজেরাও নির্দেশাবলী ধারণ করে। আর যে কারণে তারা আমাদের সুতোয় বাধা কোনো পুতুলের মত সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা সেটিও সেখানে একই: টাইম ল্যাগ বা কোনো কারণ ও তার ফলাফলের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান। জিন কাজ করে প্রোটিন সংশ্লেষণ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার এটি একটি শক্তিশালী উপায় কিন্তু এটি খুব মন্থর একটি প্রক্রিয়া। ধৈর্য সহকারে প্রোটিন সুতো নিয়ন্ত্রণ করে ভ্রণ তৈরী করার জন্য বহু মাসের পরিশ্রম প্রয়োজন। কিন্তু অন্য দিকে, আচরণ সংক্রান্ত বিষয়টির মূল হচ্ছে এটি অত্যন্ত দ্রুত একটি প্রক্রিয়া। এটি যে সময়ের পরিমাপে কাজে করে সেটি মাস না বরং সেকেন্ড বা সেকেন্ড এর ভগ্নাংশ সময়ের মাত্রায়। কিছু ঘটলো আশে পাশে, মাথার উপর একটি পেঁচা বসে আছে। লম্বা ঘাসের নাড়াচাড়া শিকারে উপস্থিতি জানিয়ে দেয় এবং মাত্র কয়েক মিলি সেকেন্ডে পুরো স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় হয়ে ওঠে, মাংসপেশী লাফ দিয়ে ওঠে, কারো জীবন বাঁচে বা হারায়। জিনরা এধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া করার সময় পায় না। অ্যানড্রোমিডাবাসীদের মত জিনরা শুধু পারে তাদের কাজ চালানোর জন্য খুব ভালোভাবে আগে থেকেই একটি দ্রুত সিদ্ধান্ত ও কাজ করার কম্পিউটার তৈরী করে নিতে এবং আগে থেকে নানা ধরনের নিয়ম আর উপদেশ সেখানে প্রোগ্রাম করে দেয়া যা সাহায্য করে যতটা ঘটনা ঘটবে বলে সে আশা করে, সেই সব পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য। কিন্তু জীবন, দাবা খেলার মত সেখানে অনেক বেশী ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাবনার ঘটনাবলী আছে, যাদের সব কিছু আগে থেকে ধারণা করা সম্ভব না। এবং দাবার প্রোগ্রামারদের মত, জিনদেরকে সারভাইভাল মেশিনদের নির্দেশ দিতে হয় সব কিছু সুনির্দিষ্টভাবে না বরং সাধারণ কৌশল ও উপায় সংক্রান্ত বিষয়ে যা জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় (৩)।
যেমন, জে. জেড. ইয়ং বলেছিলেন, জিনদের এমন কিছু কাজ করতে। হয় যা ভবিষ্যদ্বাণী সদৃশ। যখন একটি ভ্রণ সারভাইভাল মেশিন তৈরী হচ্ছে, এর জীবনের বিপদ ও সমস্যাগুলো থাকে ভবিষ্যতে। কে বলতে পারে কোনো মাংসাশী প্রাণি ঝোঁপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে আসে বা দ্রুত দৌড়াতে পারে এমন কোনো শিকার দ্রুত তার সামনে দিয়ে ছুটে যাবে এবং আঁকাবাঁকা হয়ে দৌড়াবে? কোনো মানব ঈশ্বর প্রেরিত দূত যেমন পারবে না, তেমনই পারবে না কোন জিন। কিন্তু বেশ কিছু সাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে। পোলার ভালুকদের জিনরা যেমন বেশ নিরাপদের সাথে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, এখনও জন্ম হয়নি তাদের সারভাইভাল মেশিনের জন্য আগামী ভবিষ্যৎ খুবই শীতল হবে। তারা এটিকে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে করে না, তারা কোনো কিছুই চিন্তাই করে নাঃ তারা শুধু মোটা পুরুত্বের চুলের একটি আস্তরণ তৈরী করে, কারণ তারা ঠিক সেই কাজটি করেছে আগে তাদের অতীত শরীরগুলোয় এবং সেকারণে এটি এখনও টিকে আছে তাদের জিনপুলে। তারা আরো ভবিষ্যদ্বাণী করে যে মাটিতে বরফ থাকবে এবং তাদের ভবিষ্যদ্বাণী রুপ নেয় শরীরের চুলের রং সাদা করার জন্য, যা সাদা বরফের সাথে সহজেই মিশে ক্যামোফ্ল্যাজ বা লুকিয়ে থাকার বেশ তৈরী করবে। যদি উত্তর মেরুর জলবায়ু দ্রুত বদলে যায় কোনো কারণে যে কোনো শিশু মেরু ভালুক নিজেকে জন্ম নিতে দেখবে ক্রান্তীয় কোনো মরুভূমিতে, তাহলে জিনদের ভবিষ্যদ্বাণী হবে ভুল এবং এর জন্য তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। শিশু সেই ভালুকটি মারা যাবে, যার ভিতরে সেই জিনগুলোর বাস।
কোনো একটি জটিল পৃথিবীতে ভবিষদ্বাণী খুব ভাগ্য নির্ভর একটি কাজ। প্রতিটি সিদ্ধান্ত যা কোনো একটি সারভাইভাল মেশিনকে নিতে হয় সেটি জুয়া খেলার মত এবং জিনদের কাজ হচ্ছে মস্তিষ্ককে আগে থেকেই প্রোগ্রাম করে রাখা যেন গড়পড়তা তারা সেখানে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি যেন তাদের উপকারে আসে। বিবর্তনের ক্যাসিনোতে যে বিনিময় মূল্যটি ব্যবহৃত হয় সেটি হচ্ছে ‘টিকে থাকা’, খুব কঠোর অর্থে ‘জিনদের’ টিকে থাকা, কিন্তু বহু উদ্দেশ্যে বলা যেতে পারে একক সদস্যদের টিকে থাকাটা খুব নিকটবর্তী অর্থে একটি যুক্তিসঙ্গত বিনিময় মূল্য হতে পারে। যদি আপনি কোনো পানির উৎসের কাছে পানি খেতে যান, কোনো শিকারী প্রাণীর খাদ্য হবার সম্ভাবনায় আপনি নিজের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন, যারা তাদের জীবন ধারণ করে পানির মধ্যে শিকার ধরার জন্যে লুকিয়ে থেকে। কিন্তু সেই ভয়ে আপনি যদি পানি খেতে না যান, তাহলে একসময় আপনি তৃষ্ণার্ত হয়ে মারা যাবেন। আপনি যে পথই বেছে নেন না কেন, ঝুঁকি থাকবেই এবং কিভাবে আপনার জিনগুলোর দীর্ঘায়ু হবার সম্ভাবনাকে বাড়ানো যায় আপনাকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হয়তো সবচেয়ে ভালো নীতিটি হবে, যতক্ষণ না আপনার তৃষ্ণা পাচ্ছে ততক্ষণ পানির কাছে গিয়ে পানি খাওয়াটা স্থগিত রাখতে, তারপর সময় হলে সেখানে গিয়ে বেশ ভালো পরিমান পানি পান করে আসা, যেন আপনি অনেকক্ষণ সময় পানি ছাড়া থাকতে পারেন। বিকল্পভাবে সবচেয়ে বড় বাজটি হবে অল্প করে মাঝে মাঝে পানি পান করা, পানির কোনো উৎসের পাশ দিয়ে দৌড়াবার সময় দ্রুত এক ঢোঁক পানি গিলে ফেলা। তবে কোনটি বাজীর সবচেয়ে ভালো দান, সেটি নির্ভর করে নানা ধরনের জটিল বিষয়গুলোর উপর, শুধুমাত্র শিকারী প্রাণীদের শিকার করার অভ্যাসই ন্যুনতম শর্ত না, কারণ সেটিও বিবর্তিত হয়েছে শিকারী প্রাণীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, সবচেয়ে দক্ষ কৌশল হিসাবে। সুতরাং এখানে বিপক্ষের বেশ কিছু শর্তকে গুরুত্বের সাথে বিবচেনা করতে হবে, কিন্তু অবশ্যই প্রাণীদের সম্বন্ধে আমাদের এমনভাবে ভাবতে হবে না যে, তারা এই হিসাব নিকাশগুলো খুব সচেতনভাবে করে থাকে। আমাদের শুধু বিশ্বাস করতে হবে যে সেই সব একক সদস্যদের জিন তাদের মগজকে এমনভাবে তৈরী করেছে যে তারা এই সবক্ষেত্রে সঠিক বাজিটা খেলে, যার প্রত্যক্ষ ফলাফল হচ্ছে সেই সব সদস্যদের টিকে থাকা এবং সেভাবেই তারা তাদের সেই একই জিন ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে বিস্তারে সাহায্য করবে।
আমরা বাজী ধরার এই রুপকটাকে আরো খানিকটা সামনে বাড়াতে পারি। কোনো জুয়াড়ী অবশ্যই ভাববে তিনটি প্রধান পরিমাপ– স্টেক, অড এবং প্রাইজ, বা প্রথমে তাকে কতটুকু বিনিয়োগ করতে হবে, সেই বিনিয়োগটি তার জন্য সুফল আনবার ক্ষেত্রে কতটুকু সফল হবার সম্ভাবনা আছে এবং অবশেষে কি পুরষ্কার সে পাবে। যদি পুরষ্কার অনেক বড় হয়, খেলা জেতার জন্য একজন জুয়াড়ী অনেক বেশী পরিমান কিছু বাজী রাখে। কোনো জুয়াড়ী যদি তার সবকিছু একটি জুয়ার দানের উপর বাজী রাখে তার যেমন অনেককিছু জেতার সম্ভাবনা থাকে, আবার একই ভাবে তার অনেক কিছু হারানোরও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কোনো গড়পড়তা বড় দান দেয়া কোনো জুয়াড়ী অন্য সেই সব জুয়াড়ীদের চেয়ে ভালো বা খারাপ কোনো অবস্থাতেই থাকে না, যারা অল্প পরিমান পুরষ্কার পাবার আশায় অল্প পরিমান বাজী রাখে। একটি সদৃশ্যমূলক তুলনা হচ্ছে, স্টক মার্কেটে স্পেকুলেটিভ বা অনুমাননির্ভর আর সেফ বা নিরাপদ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পার্থক্যগুলো। বেশ কিছু উপায়ে একটি স্টমার্কেট ক্যাসিনোর চেয়ে ভালো সদৃশ উদাহরণ হতে পারে। কারণ ক্যাসিনোগুলো পরিকল্পিতভাবে এমন করে সাজানো যে এটি ব্যাঙ্কের পক্ষে কাজ করে (এর অর্থ হচ্ছে কঠোরভাবে, যারা বড় দানের জুয়াড়ী, তারা গড় পড়তায় বেশী টাকা হারায় কম দানের জুয়াড়ীদের তুলনায়, আর কম দানের জুয়াড়ীরা আরো বেশী টাকা হারায়, যারা আদৌ জুয়া খেলে না তাদের তুলনায়, কিন্তু এর কারণ অবশ্যই আমাদের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয়।) এটিকে উপেক্ষা করলে, বড় আর ছোট দুই দানের জুয়া খেলা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। এমন কি কোনো প্রাণী জুয়াড়ী আছে যারা অনেক বড় দানের জুয়া খেলে এবং অন্যরা যারা সংযত তাদের জুয়ার দানে? অধ্যায় ৯ এ আমরা দেখবো প্রায়শই সম্ভব হবে পুরুষদের এমনভাবে দেখা, যে তারা আসলে বড় দান ও বড় ঝুঁকি নিয়ে বাজী খেলছে এবং নারীরা নিরাপদ বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে বহুগামী প্রজাতির ক্ষেত্রে যেখানে পুরুষরা নারীদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। প্রকৃতিবিদ যারা এই বইটি পড়ছেন তারা এমন কোনো প্রজাতির কথা হয়তো ভেবে দেখতে পারেন, যাদের বলা যেতে পারে, বড় দানে বড় ঝুঁকি জুয়াড়ী এবং অন্য কোনো প্রজাতি যারা তাদের জুয়া খেলায় অনেক রক্ষণশীল। আমি এখন সেই আলোচনায় ফিরে যাবো, যে আলোচনার সাধারণ মূলভাবটি হচ্ছে কিভাবে জিন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
মোটামুটি অনিশ্চয়তাপূর্ণ পরিবেশে ভবিষ্যদ্বাণী করার সমস্যা মোকাবেলায় জিনদের একটি উপায় হচ্ছে কোনো কিছু শেখার ক্ষমতা বা দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। যেমন, এখানে প্রোগ্রামটি হয়তো সারভাইভাল মেশিনকে দেয়া নিম্নোক্ত নির্দেশাবলীর রুপ ধারণ করতে পারে। এখানে একটি তালিকা দেয়া হলো যাদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে সুখকর বা পুরষ্কার হিসাবে: মুখে মিষ্টি স্বাদ, যৌনতৃপ্তি, হালকা তাপমাত্রা, শিশুর হাসিমুখ। আর এই হলো খারাপ জিনিসগুলোর তালিকা: নানা ধরনের যন্ত্রণা, বমনেচ্ছা, চিৎকাররত কোনো শিশু। আপনি যদি এমন কিছু করতে থাকেন, যার পরিণতিতে এই সব খারাপ জিনিসের তালিকা থেকে কিছু যদি আপনার সাথে ঘটে, কাজগুলো পুনরাবৃত্তি করবেন না, কিন্তু অন্যদিকে পুনরাবৃত্তি করুন, যদি সেই কাজের ফলাফল সুখকর ভালো জিনিসের তালিকার কিছু হয়ে থাকে। এই ধরনের প্রোগ্রামের সুবিধা হচ্ছে এটি আরো অনেক বিস্তারিত নিয়মকানুন অসংখ্য সূত্র সংক্ষিপ্ত করে, না হলে এই সব জটিল নিয়মগুলো মল প্রোগ্রামগুলো লিখতে হতো। এবং এটি একই সাথে সক্ষম পরিবেশের নানা পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে, যে পরিবেশ সম্বন্ধে আগে থেকে পূর্বধারণা করা যায় না বা অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা অনেক বেশী। আবার অন্যদিকে, কিছু ভবিষ্যদ্বাণী তারপরও করার ঝুঁকি নিতে হয়। আমাদের উদাহরণে জিনগুলো পুর্বধারণা করছে যে মুখে যদি মিষ্ট স্বাদ লাগে, যৌনতৃপ্তি, ভালো কিছু অবশ্যই হবে, এই অর্থে যে, শর্করা খাওয়া আর যৌন প্রজনন করাটি জিনের টিকে থাকার জন্য উপকারী। সেখানে পুষ্টিশক্তিহীন স্যাকারিন আর স্বমেহনের সম্ভাবনার বিষয়টি আগে থেকে ভাবা সম্ভব হয়নি, যেমন হয়নি, বেশী মাত্রায় শর্করা খাওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো কথাও, বিশেষ করে আমরা যে পরিবেশে বাস করি যেখানে এর উপস্থিতি অস্বাভাবিক মাত্রায় বেশী।
শেখার কৌশলগুলো কিছু কিছু দাবা খেলার কম্পিউটার প্রোগ্রামেও ব্যবহার করা হয়েছে। এইসব প্রোগ্রামগুলা আসলে আরো ভালো হয় যখন তারা মানব বিরোধীপক্ষ বা অন্য কম্পিউটারের সাথে খেলার সুযোগ পায়। যদি তারা নিজেরা বেশ কিছু নিয়ম আর কৌশল আগে থেকেই ধারণ করে, তারপরও তাদের সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ায় ছোটখাট র্যানডোম কিছু প্রবণতা আগে থেকেই নির্মিত থাকে। তারা অতীতের নেয়া সিদ্ধান্তগুলো রেকর্ড করে এবং যখনই তারা কোনো খেলা জেতে তারা সেই জয়ের পুর্বে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষিত করে। সুতরাং পরবর্তী সময়ে তাদের সম্ভাবনা আছে একই কৌশলগুলো থেকে আবারো বাছাই করার।
ভবিষ্যত সংক্রান্ত কোনো ভবিষ্যদ্বাণী জানার একটি কৌতূহলোদ্দীপক পদ্ধতি হচ্ছে সিমুলেশন, সম্ভাব্য বাস্তব পরিস্থিতির একটি কাল্পনিক মডেল তৈরী। যদি কোনো সেনানায়ক একটি নির্দিষ্ট সামরিক পরিকল্পনা এর বিকল্প থেকে উত্তম হবে কিনা সেটি জানতে চান, তখনই তাকে ভবিষ্যদ্বাণী করার সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সেখানে আবহাওয়া ও তার সৈন্যদের মনোবলের অবস্থা সংক্রান্ত ও শত্রু পক্ষের প্রতি-আক্রমণ সংক্রান্ত উপাত্তগুলো অজানা। তার পরিকল্পনা ভালো কিনা সেটি আবিষ্কার করার একটি উপায় হচ্ছে চেষ্টা করে দেখা। কিন্তু অবশ্যই সব অনুমানিক পরিকল্পনা কাম্য নয়, যা কিনা ভাবা সম্ভব সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা, যদি শুধুমাত্র একটি কারণও যদি হয় অল্প বয়সী তরুণদের সরবরাহ, যারা কিনা তাদের দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত’ অফুরন্ত নয় এবং যখন পরিকল্পনারও কোনো অভাব নেই। সেকারণেই উত্তম নানা ধরনের পরিকল্পনা সত্যি সত্যি না করে কাল্পনিক কোন পরিস্থিতি তৈরী করা। এটি হতে পারে যেমন পুরো মাত্রার কোনো অনুশীলন, যেখানে নর্থল্যান্ড এবং সাউথল্যান্ড উভয় পক্ষই ফাঁকা গোলবারুদ ব্যবহার করবে এমনকি এমন কিছু করাও সময় ও ব্যায়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। অনেক কম অপচয় করার মাধ্যমে ওয়ার গেমস খেলা যেতে পারে, টিনের সেনা ও ছোট খেলনা ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে বিশাল মানচিত্রের উপর জায়গা পরিবর্তন করে।
সম্প্রতি সিমুলেশনের বড় একটি অংশ পরিচালনা করার দ্বায়িত্ব নিয়েছে কম্পিউটার, শুধু সামরিক কৌশলই না, সব ক্ষেত্রেই, অনাগত কাল সম্বন্ধে যেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করার দরকার। অর্থনীতি, পরিবেশবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান ও আরো অনেক ক্ষেত্রেই এটি ব্যবহার হচ্ছে এখন। এই প্রক্রিয়া কাজ করে এভাবে। কম্পিউটারে পৃথিবী সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের মডেল আগে থেকেই তৈরী করা হয়। এর মানে এই না যে, আপনি যদি ঢাকনী সরিয়ে ⇒ খুলে দেখেন আপনি সেখানে ক্ষুদ্রকার অনুরুপ কোনো মডেল বা ডামি দেখতে পাবেন এর ভিতরে যে বিষয়টিকে সিমুলেট করা হচ্ছে সেই বিষয়টির আকার অনুসারে। দাবা খেলতে পারা কম্পিউটারে ভিতরে কোনো ‘মানসিক ছবি’ নেই তার স্মৃতির ব্যাঙ্কের ভিতর, যা কিনা দেখে মনে করা যেতে পারে দাবার গুটি সাজিয়ে রাখা কোনো দাবা খেলার বোর্ড দাবার বোর্ড ও তার বর্তমান অবস্থানকে প্রতিনিধিত্ব করবে ইলেকট্রনিক সাংকেতিক কিছু সংখ্যা। আমাদের কাছে কোনো একটি মানচিত্র হচ্ছে ক্ষুদ্রতর স্কেলে বা মাত্রায় বানানো পৃথিবীর কোনো একটি অংশের মডেল, যাকে দ্বিমাত্রিক একটি রুপে উপস্থাপন করা হয়েছে সব উপাত্ত জড়ো করার মাধ্যমে। কোনো একটি কম্পিউটারে একটি মানচিত্রকে বিকল্পভাবে প্রতিনিধিত্ব করা যেতে পারে শহরের তালিকা ও অন্যান্য কিছু স্পটের তালিকা হিসাবে। যাদের প্রত্যেকের দুটো সংখ্যা মান থাকবে, অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ। কিন্তু কিছু যায় আসে না কম্পিউটার আসলে কিভাবে মডেলটি ধারণ করে এর মাথায়, শুধুমাত্র বিবেচ্য বিষয় এটি এমন একটি রুপে ধারণ করবে, যার উপর সে কাজ করতে পারে, নিয়ন্ত্রণ ও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারে এবং মানুষ অপারেটরের কাছে সে রিপোর্টগুলো পাঠাতে পারে এমন একটি রুপে যা মানুষ অপারেটররা বুঝতে পারেন। সিমুলেশনের এই কৌশল ব্যবহার করে, মডেল যুদ্ধ জেতা ও হারা যেতে পারে, কাল্পনিক বিমান ওড়ে অথবা ধ্বংস হয়,অর্থনৈতিক নীতি উন্নতির বা ধ্বংসের কারণ হয়; প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে একটি কম্পিউটারের মধ্যে, বাস্তব জীবনের এমন কিছু করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের সামান্য খণ্ডাংশ ব্যবহার করে। অবশ্যই পৃথিবীর জন্য ভালো মডেল আছে আবার খারাপ মডেল আছে, এমনকি সবচেয়ে ভালোটাই প্রকৃত পরিস্থিতির নিকটবর্তী একটি রুপ মাত্র। কোনো পরিমান কাল্পনিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবো না বাস্তবে আসলেই কি ঘটবে। কিন্তু কোনো ভালো সিমুলেশন অবশ্যই অনেক বেশী ভালো কোনো ধরনের অন্ধ প্রচেষ্টা আর ভুল করার প্রক্রিয়ার চেয়ে। সিমুলেশনকে বলা যেতে পারে ট্রায়াল ও এরর’ প্রক্রিয়ার প্রতিনিধিক ট্রায়াল অ্যান্ড এরর, যে নামটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহু আগেই করায়ত্ত করেছেন ইঁদুর মনোবিজ্ঞানীরা।
যদি সিম্যুলেশন এতটাই উত্তম ধারণা হয়ে থাকে, আমরা হয়তো আশা করতে পারি সারভাইভাল মেশিনও হয়তো এটি প্রথম আবিষ্কারও করেছিল। মোটকথা তারা বহু আগে মানব প্রকৌশলীদের অনুকরণ করা বহু কৌশল উদ্ভাবন করেছিল, আমাদের যখন কারোরই অস্তিত্ব ছিলনা সেই সময়ে :যেমন ফোকাস করার লেন্স, প্যারাবলিক রিফ্লেকটর, শব্দ তরঙ্গর ফ্রিকোয়েন্সি অ্যানালাইসিস, সার্ভো-কন্ট্রোল, সোনার, আগত তথ্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাফার এবং দীর্ঘ-নামসহ অসংখ্য কৌশল, যাদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখানে অপ্রয়োজনীয়। তাহলে সিমুলেশনের ব্যপারটি কি? বেশ, যখন আপনি নিজে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে ভবিষ্যত সংক্রান্ত কিছু অজানা উপাত্ত বিদ্যমান, আপনাকে সেখানে একধরনের সিমুলেশনের সাহায্য নিতে হয়। আপনি কল্পনা করেন কি কি হতে পারে আপনি যদি আপনার সামনে থাকা প্রতিটি বিকল্প পরীক্ষা করে দেখেন। আপনি আপনার মস্তিষ্কে একটি মডেল তৈরী করে নেন, পৃথিবীর সব কিছু নিয়ে নয় বরং কিছু সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় বা নিয়ামকের সেট, যাদের আপনি ভাবছেন সেই বিশেষ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য প্রাসঙ্গিক। আপনি হয়তো স্পষ্টভাবে আপনার মানসচক্ষতে পুরো বিষয়টি দেখতে পারেন অথবা সেই সব বিষয়গুলোর কোনো রুপকে আপনার মনের সিমুলেশন আপনি দেখতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যেকোনো ক্ষেত্রেই খুবই কম সম্ভাবনা আছে যে আপনার মস্তিষ্কের কোথাও আসলেই একটি জায়গায় আপনি যা কল্পনা করছেন সেটির সত্যিকারের একটি স্থান দখলকারী মডেল আছে। কিন্তু, ঠিক কম্পিউটারের মতই, কিভাবে আপনার মস্তিষ্ক এর মডেলটি ব্যবহার করছে তার বিস্তারিত প্রক্রিয়াটি, এটি যে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কোনো ঘটনা পূর্বধারণা করতে সক্ষম তার থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সারভাইভাল মেশিনগুলো যারা কিনা ভবিষ্যতের কিছু কাল্পনিকভাবে সিমুলেট করতে পারে তারা অন্য সেই সব সারভাইভাল মেশিন থেকে বহু ধাপ এগিয়ে যায়, যারা শুধুমাত্র কিছু করা ও ভুল করার মাধ্যমে শেখে। সুস্পষ্টভাবে ট্রায়ালের সমস্যা হচ্ছে যে, এটি সময় আর শ্রমসাপেক্ষ একটি ব্যাপার। আর সুস্পষ্টভাবে ভুল হচ্ছে প্রায়শই প্রাণঘাতি। সিমুলেশন এ-কারণেই নিরাপদ আর দ্রুততর।
সিমুলেশন করার দক্ষতার বিবর্তন খুব সম্ভবত তার চূড়ান্ত রুপ পেয়েছিল আত্মগত সচেতনার উদ্ভব হবার মাধ্যমে। আর কেন এমনটাই ঘটার কথা, আমার মতে আধুনিক জীববিজ্ঞানে এটাই সবচেয়ে গভীরতম রহস্য। কোনো কারণ নেই মনে করার যে, ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার সচেতন যখন তারা কোন কিছু সিমুলেট করে, যদিও আমাদের স্বীকার করতে হবে ভবিষ্যতে তারা হয়ত সেটাই হতে পারে। হয়তো সচেতনার উদ্ভব হয়েছিল যখন মস্তিষ্কের পৃথিবীকে সিমুলেশন করার ক্ষমতা এতটাই সম্পূর্ণ হয়েছিল যে, এটি অবশ্যই তার নিজের একটি মডেলও সংযুক্ত করেছিল (৪)। কোন সারভাইভাল মেশিনের শরীর ও হাত-পা অবশ্যই কল্পনার পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরী করে। অনুমান করা যায় একই ধরনের কোনো কারণে, সিমুলেশনটাকেই মনে করা যেতে পারে পৃথিবীর কোনো একটি অংশের মত, যাকে সিমুলেশন করা হবে। আসলেই এর জন্য আরেকটি শব্দ হতে পারে ‘আত্ম-সচেতনতা। কিন্তু আমি এটাকে সচেতনতা বিবর্তনের পুরোপুরিভাবে সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা হিসাবে মনে করিনা। আর এর কারণ আংশিকভাবে শুধুমাত্র এর সাথে নিরন্তর পশ্চাৎমুখী যুক্তি বা রিগ্রেসের আশ্রয় নিতে হয়– যদি কোনো একটি মডেলের মডেল থাকে, তাহলে কেনই বা মডেলের মডেলের মডেলের মডেল .. হবে না?
সচেতনতা যে দার্শনিক সমস্যাই সৃষ্টি করুক না কেন, এই কাহিনীর উদ্দেশ্যে এটিকে ভাবা যেতে পারে তাদের মূল নিয়ন্ত্রক মনিব, ‘জিনদের নিয়ন্ত্রণ থেকে সারভাইভাল মেশিনদের নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহনকারী হিসাবে মুক্তি লাভ করা একটি প্রক্রিয়া হিসাবে। শুধুমাত্র দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক হিসাবে তারা সারভাইভালে মেশিনের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডই পরিচালনা করে না, তারা একই সাথে সেই যোগ্যতাও অর্জন করে, যে যোগ্যতার বলে তারা ভবিষ্যত সম্বন্ধে পূর্বধারণাও করতে পারে এবং সেই অনযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমনকি তাদের সেই জিনের নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার ক্ষমতাও আছে, যেমন তাদের যতটা সন্তান নেবার ক্ষমতা আছে ততটা সন্তান নিতে অস্বীকার করা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে মানুষ অবশ্যই বিশেষ একটি উদাহরণ, আমরা পরে সেটাই দেখতে পাবো।
কিন্তু পার্থবাদীতা আর স্বার্থপরতার কি সম্পর্ক? আমি চেষ্টা করছি। সেই ধারণাটি গড়ে তুলতে যে, কোনো জীবের আচরণ, স্বার্থপরতার অথবা পরার্থবাদীতা– জিনদের নিয়ন্ত্রণাধীন, তবে শুধুমাত্র পরোক্ষভাবে, কিন্তু তাসত্ত্বেও খুব শক্তিশালী অর্থে। কিভাবে সারভাইভাল মেশিন ও তার স্নায়ুতন্ত্র তৈরী হবে সেই বিষয়টির নির্দেশনা দেবার মাধ্যমে জিনরা আচরণের উপর তাদের চূড়ান্ত ক্ষমতার প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তের সিদ্ধান্তগুলো, যেমন এরপর কি করতে হবে, এমন সিদ্ধান্ত নেয় স্নায়ুতন্ত্র। জিনরাই প্রাথমিক নীতিনির্ধারক, আর মস্তিষ্ক হচ্ছে তাদের নীতি বাস্তবায়নকারী। যখন মস্তিস্ক আরো বেশী উচ্চ পর্যায়ের সংগঠন আর উন্নত হতে থাকে, তারা ক্রমান্বয়ে আরো বেশী পরিমান সত্যিকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো নিতে থাকে, নানা ধরনের কৌশল, যেমন কোনো কিছু শেখার মাধ্যমে বা সেটা করার কোনো কাল্পনিক পরিস্থিতির মডেল বা সিমুলেশন সৃষ্টি করে। আর এই প্রবণতার যৌক্তিক উপসংহার হচ্ছে, এখনো কোনো প্রজাতি যা অর্জন করতে পারেনি, সেটি হবে জিনদের জন্য তাদের সারভাইভাল মেশিনকে একটি মাত্র সার্বিক কোনো নীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করা: সেটাই করো যা কিছু তোমার মনে হয় ভালো আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
কম্পিউটার আর মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়াটির সদৃশ্যতার বিষয় সব ঠিকই আছে, কিন্তু এখন অবশ্যই আমাদের বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে এবং মনে রাখতে হবে যে বিবর্তন আসলেই ঘটে ধাপে ধাপে ক্রমান্বয়ে, জিনপুলে জিনদের বৈষম্যমূলকভাবে টিকে থাকার মাধ্যমে। সুতরাং, কোনো একটি আচরণের প্যাটার্ন, সেটি স্বার্থপরতা আর পরার্থবাদী যাই হোক না– তার বিবর্তন হবার জন্যে প্রয়োজন যে সেই আচরণের জন্য দায়ী জিনের জিন পুলে বেশী সফলভাবে বাঁচা, তার অন্য কোন প্রতিদ্বন্দ্বী জিনে বা অ্যালিলের তুলনায়, যারা ভিন্ন কোনো আচরণের জন্য দায়ী। পার্থবাদী আচরণের জন্য জিনের অর্থ হচ্ছে এমন কোনো জিন যা স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশের উপর এমন ভাবে তাদের প্রভাব বিস্তার করে, যা তাদের পরার্থবাদী আচরণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় (৫)। পরার্থবাদী আচরণের জিনগত উত্তরাধিকার সংক্রান্ত পরীক্ষামূলক কি কোনো প্রমাণ আছে? না, কিন্তু সেটি নিয়ে বিস্মিত হবার কারণ প্রায় নেই বললেই চলে, কারণ কোনো আচরণের জিনতত্ত্ব নিয়ে খুব কম কাজই হয়েছে। বরং আমি আপনাদের একটি গবেষণা নিয়ে কিছু বলি। যে গবেষণাটি করা হয়েছিল আচরণের প্যাটার্নের উপর, যা দেখতে খুব স্পষ্টভাবে পরার্থবাদী আচরণ হিসাবে মনে হয় না। কিন্তু জটিল কৌতূহল মেটানোর জন্য সেটি যথেষ্ট, এটি একটি মডেল হিসাবে কাজ করতে পারে, কিভাবে পরার্থবাদী আচরণ উত্তরধিকার সূত্রে অর্জন করা সম্ভব হতে পারে।
মৌমাছিরা একটি সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়, যার নাম ‘ফাউল ব্রুড’। মৌচাকের কোষের মধ্যেই থাকা অবস্থায় লার্ভা বা গ্রাবদের আক্রমণ করে। গৃহপালিত মৌমাছিদের যে জাত মৌচাষীরা ব্যবহার করে থাকেন, তাদের কোনো কোনোটি ফাউল ব্রুডে আক্রান্ত হবার জন্য বেশী ঝুঁকিপূর্ণ এবং দেখা গেছে যে এই জাতগুলোর মধ্যে পার্থক্য অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধু আচরণগত। যেমন, তাদের স্ট্রেইনটি যাকে বলা হয় “হাইজেনিক’ স্ট্রেইন, তারা খুব সহজে এই রোগের মহামারী থেকে বাঁচতে পারে আক্রান্ত লার্ভাটিতে শনাক্ত করার মাধ্যমে, তারা কোষ থেকে সেটি বের করে আনে ও মৌচাকের বাইরে ফেলে দেয়। নাজুক ঝুঁকিপুর্ণ স্ট্রেইনটি এই ‘হাইজেনিক’ শিশুহত্যার মত কোনো আচরণ করে না। এখানে যে আচরণটি সংশ্লিষ্ট সেটি আসলেই জটিল। কর্মী মৌমাছিরা সেই কোষ খুঁজে বের করে, যেখানে আক্রান্ত লার্ভাটি থাকে, কোষের মুখে মোমের ঢাকনীটি সরিয়ে ফেলে, লার্ভাটিকে সেখান থেকে বের করে, তারা তাদের মৌমাচের ঢোকার মুখের দরজার কাছে টেনে নিয়ে এসে বাইরে ময়লার স্তূপে ছুঁড়ে ফেলে।
মৌমাছির উপর কোনো জিনতাত্ত্বিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা বেশ জটিল একটি বিষয় বেশ কয়েকটি কারণে। কর্মী মৌমাছিরা নিজেরা সাধারণত প্রজনন করে না সুতরাং আপনাকে একটি জাতের রানির সাথে অন্য একটি জাতের ড্রোন (পুরুষ) এর আন্তঃপ্রজনন করাতে হবে। তারপর ভালোভাবে কন্যা শ্রমিকদের আচরণ লক্ষ করতে হবে। এটাই করেছিলেন,ডাবলিউ জি রথেনবুহলার। প্রথম প্রজন্মের সব হাইব্রিড বা সংকর কন্যাদের মৌচাকগুলো ‘নন–হাইজিনিক’ প্রকারের: তাদের ‘হাইজেনিক’ পিতামাতার আচরণ হারিয়ে গেছে বলেই মনে হয়। দেখা গেছে হাইজিনিক জিন সেখানে এখনও আছে কিন্তু তারা সেখানে রিসেসিভ, যেমন, মানুষের নীল চোখের রিসেসিভ জিন। যখন রোথেনবুহলার আবার ব্যাক ক্রস বা আন্তঃপ্রজনন ঘটান প্রথম প্রজন্মের সংকরদের সাথে বিশুদ্ধ হাইজেনিক জাতের (আবারো অবশ্যই রাণী ও ড্রোন ব্যবহার করে), তিনি এবার বিস্ময়কর কিছু ফলাফল দেখতে পান। কন্যাদের মৌচাক মোট তিন প্রকারের হয়, একটি গ্রুপ সঠিক হাইজিনিক আচরণ করে, দ্বিতীয়টি কোনো হাইজিনিক ব্যবহার দেখায় না আদৌ। আর তৃতীয়টি আংশিক হাইজিনিক হয়। শেষ গ্রুপটি মৌচাকের আক্রান্ত লার্ভাসহ কোষের মুখে মোমের আবরণটি সরায় ঠিকই, তারা আর বাকী কাজটা করে না, অর্থাৎ আক্রান্ত লার্ভাদের বাইরে নিয়ে এসে ফেলে দেয়ার কাজটি তারা করেনা। রোথেনবুহলার বিষয়টির ব্যাখ্যা করেন এভাবে, আসলে সেখানে দটি ভিন্ন জিন আছে, একটি জিন মোমের আবরণ খোলার জন্য আর একটি জিন আক্রান্ত লার্ভাদের বাইরে ফেলে দিয়ে আসার জন্য। সাধারণ হাইজেনিক জাতদের দুটো জিনই থাকে, আর যারা হাইজিনিক না তাদের থাকে এর বদলে তাদের অ্যালিল বা প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি জিন। আর সংকর স্ট্রেইনটি যারা এর অর্ধেক কাজ করে তাদের ধারণা করা হয় তারা কেবল হয়তো মোমের আবরণ খোলা বা ‘আনকাপিং’ জিনটি পায় (দ্বিগুণ মাত্রায়) কিন্তু লার্ভাদের বাইরে বের করে এনে ফেলে দেবার বা ‘থ্রোইং আউট’ জিনটি না। রোথেলবুহলার অনুমান করেছিলেন তার পরীক্ষাধীন গ্রুপের পুরোপুরি নন হাইজিনিক মৌমাছিরা হয়তো একটি সাবগ্রুপকে লুকিয়ে রাখে যারা গ্রোয়িং আউট জিন ধারণ করে কিন্তু সেটি দেখাতে পারেনা কারণ তাদের আনক্যাপিং জিনটি থাকে না। তিনি এটি নিশ্চিৎ করেন চমৎকার একটি পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেই মোমের ঢাকনীগুলো সরিয়ে রেখে, দেখা যায় আসলেই আপাতদৃষ্টিতে নন হাইজিনিক মৌমাছিদের অর্ধেক মৌমাছি পুরোপুরি ভাবে বিশুদ্ধ ‘গ্লোয়িং আউট’ আচরণটি প্রদর্শন করে(৬)।
এই কাহিনীটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ব্যাখ্যা করে যা আগের অধ্যায়ে আলোচনায় এসেছিল। এটি প্রদর্শন করছে যে খুব সঠিকভাবে বলা যেতে পারে, এই জিনটি এই আচরণের জন্য এমনকি যদিও আমাদের ন্যূনতম কোনো ধারণা নেই সেই ভ্রূণতাত্ত্বিক কারণের রাসায়নিক ধারাবাহিকতার শৃঙ্খল যা জিন থেকে কোনো একটি আচরণের দিকে নির্দেশিত হতে পারে। শঙ্খলের কার্যকারণ এমন কি হতে পারে কোনো কিছু শেখার সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন, হতে পারে যে আনক্যাপিং বা মৌচাকের কোষের ঢাকনীটি খোলার জিনটি প্রভাব খাটায় মৌমাছিদের আক্রান্ত মোমের স্বাদ নেবার ক্ষমতা দিয়ে। তার মানে তারা আক্রান্ত কোষের মোমের ঢাকনী খাওয়ার ব্যাপারটা সুখকর বা এক ধরনের পুরষ্কারের মত মনে করে এবং সেই কারণে এর পুনরাবৃত্তি করার তাদের একটি প্রবণতা থাকে। এমনকি যদি এভাবে জিন কাজ করে থাকে, তারপরও আসলেই এটি একটি সত্যিকারের জিন যা আনক্যাপিং এর জন্য চিহ্নিত, তবে শর্ত হচ্ছে যে, অন্য সব কিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে, মৌমাছিরা যারা এই জিনটি বহন করে তারা আনক্যাপিং এর কাজটি করে এবং যে মৌমাছিদের এই জিনটি নেই তারা কোন অ্যানক্যাপিং প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়না।
দ্বিতীয়ত, এটি আরো একটি বাস্তব সত্যকে ব্যাখ্যা করে, সেটি হচ্ছে। তাদের সমাজবদ্ধ সারভাইভাল মেশিনের আচরণের উপর কোন প্রভাব ফেলার জন্য জিনরা পারস্পরিক সহযোগিতা করে। গ্লোয়িং আউট জিনটি কোনো কাজে আসে না যদি না তার সাথে আনক্যাপিং জিনও উপস্থিত না থাকে, একইভাবে থ্রোয়িং আউট জিন ছাড়া আনক্যাপিং জিনও কোনো কাজ করে না। তারপর জিনগত এই পরীক্ষা দেখিয়েছে, একই সাথে স্পষ্টভাবে নীতিগতভাবে দুটি জিন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাদের সেই যাত্রায় সহজেই বিচ্ছিন্নযোগ্য। তাদের উপযোগী কাজটি নিয়ে নিয়ে যদি ভাবেন, আপনি তাদের একটি পারস্পরিক সহযোগিতাময় ইউনিট হিসাবে ভাবতে পারেন, কিন্তু অনুলিপনকারী জিন হিসাবে তারা দুটি মুক্ত এবং স্বতন্ত্র এজেন্ট।
এই তর্কের উদ্দেশ্যে আমাদের প্রয়োজন হবে সেই সব জিনগুলো সম্বন্ধে অনুমান করার জন্য, যারা সব ধরনের অসম্ভাব্য কাজের ‘জন্য দায়ী। আমি যদি কথা বলি, যেমন– এমন কোনো হাইপোথেটিকাল জিনকে নিয়ে, যা তাদের সঙ্গীকে বাঁচায় পানিতে ডুবে মারা যাওয়া থেকে এবং আপনি হয়তো এমন কোনো ধারণাকে অবিশ্বাস্য মনে করতে পারেন, তখন হাইজিনিক মৌমাছিদের গল্পটা স্মরণ করবেন। মনে করে দেখবেন, আমরা জিনকে নিয়ে এমন ভাবে কোনো কথা বলছি না, যেখানে তারা একক ভাবে পূর্বকারণ হবে সব জটিল মাংসপেশী সংকোচন, সংবেদনশীল উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ এবং এমনকি কোন সচেতনভাবে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো, যেগুলো সব জড়িত কাউকে পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচানেরা জন্যে। আমরা সেই প্রশ্নটি নিয়ে এখনও কিছু বলছি না, অর্থাৎ কোনো আচরণের গড়ে ওঠান প্রক্রিয়ায় কিছু শেখা,অভিজ্ঞতা বা পরিবেশের প্রভাব কতটুকু ভূমিকা পালন করে। আপনার শুধু মানতে হবে, এটা সম্ভব যেকোনো একটি একক জিনের জন্য, যদি আর সব কিছু অপরিবর্তিত থাকে এবং আরো অনেক জিনের সেখানে উপস্থিতি ও পরিবেশ জণিত শর্ত নিশ্চিৎ হয়, তাহলে এর বিকল্প অ্যালিলের তুলনায় সে এমন কোনো শরীর তৈরী করবে যার ডুবন্ত কাউকে বাঁচানোর সম্ভাবনা থাকবে বেশী। দুটি জিনের পার্থক্যে হয়তো দেখা যেতে পারে সামান্য কিছু পরিমানবাচক পার্থক্য। ভ্রূণগত বিকাশের বিস্তারিত প্রক্রিয়া, যতই কৌতূহলোদ্দীপক তারা হোক না কেন, এখানে তারা অপ্রাসঙ্গিক বিবর্তনীয় বিবেচনায়। কনরাড লরেনজ বিষয়টি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
জিনরা হচ্ছে মাষ্টার প্রোগ্রামার,আর তারা প্রোগ্রামিং করছে তাদের জীবন বাঁচাতে। তাদের বিচার করা হয় তাদের প্রোগ্রামের সফলতার উপর নির্ভর করে, কতটা সফলভাবে তারা খাপ খাইয়ে নেই জীবনের সব ঝুঁকি থেকে যা তাদের সারভাইভাল মেশিনকে মোকাবেলা করতে হয়। আর এর বিচারক হচ্ছে নিষ্ঠুর বিচারক, টিকে থাকার আদালতে। আমরা পরে সেই পথে আসবো যেখানে জিনের টিকে থাকাটা প্রতিপালিত আর সংরক্ষিত হয় এমন কিছু দিয়ে যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পরার্থবাদী বা পরোপকারী আচরণ। কিন্তু স্পষ্টতই প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে, সেই সারভাইভাল মেশিনের এবং সেই মস্তিষ্কটির, যা এর হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়-একক সদস্যটির টিকে থাকা ও প্রজনন সাফল্য। কলনিতে বাস করা সব জিন একমত হয়ে এই অগ্রধাধিকারের ব্যপারটিতে। প্রাণীরা সেকারণেই অনেক জটিল আর বিস্তারিতভাবে পরিকল্পনায় কালক্ষেপণ করে খাদ্য খোঁজা ও সংগ্রহে, নিজেদের কারো খাদ্য হওয়া থেকে বাঁচাতে, কোনো অসুখ বা দুর্ঘটনা থেকে থেকে বাঁচিয়ে রাখতে, নিজেদের কোনো বৈরী প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা করতে, বিপরীত লিঙ্গের সদস্যদের খুঁজে বের করতে এবং তাদের প্রজনন করার জন্য রাজী করাতে, তাদের সন্তানদের জন্য সেই সুযোগ সুবিধাগুলো ব্যবস্থা করতে, তারা নিজেরা যা ভোগ করেছে। আমি কোনো উদাহরণ দেবো না– যদি আপনি কোনো উদাহরণ চান, শুধুমাত্র খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করুন কোনো বণ্য প্রাণী যার সাথে আপনার দেখা হতে পারে এরপর কোনো এক সময়ে। কিন্তু আমি একটি বিশেষ ধরনের কারণের কথা উল্লেখ করতে চাই কারণ আমাদের সেই আচরনের প্রতি তথ্যসূত্রের ইঙ্গিত দিতে হবে যখন আমরা পরার্থবাদীতা ও স্বার্থপরতা নিয়ে কথা বলবো। এই আচরণটিকে ব্যাপকার্থে কমিউনিকেশন বা সংযোগ হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে (৭)।
বলা যেতে পারে একটি সারভাইভাল মেশিন আরেকটি সারভাইভাল মেশিনের সাথে যোগাযোগ করছে যখন সে এটির আচরণ বা এর। স্নায়ুতন্ত্রের কোনো অবস্থাকে প্রভাবিত করছে। এটি এমন কোনো সংজ্ঞা নয়, যা খুব দীর্ঘ সময় ধরে আমার সমর্থন করতে পছন্দ করা উচিৎ। ‘প্রভাব’ শব্দটি দিয়ে আমি বোঝাতে চাইছি সরাসরি কারণ সংক্রান্ত প্রভাব। সংযোগ বা কমিউনিকেশনের উদাহরণ অগণিত পাখিদের গান, ঝিঁঝি পোকার গান, কুকুদের লেজ নাড়ানো বা এর ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে দাঁড়ানো, শিম্পাঞ্জিদের দাঁত বের করা হাসি, মানুষের অঙ্গভঙ্গী ও ভাষা। সারভাইভাল মেশিনদের বহু সংখ্যক কাজই পরোক্ষভাবে তাদের জিনদের কল্যাণ নিশ্চিৎ করে অন্যান্য সারভাইভাল মেশিনদের আচরণ প্রভাবিত করার মাধ্যমে। সংযোগ যেন কার্যকরী হয় সেটা নিশ্চিৎ করতে প্রতিটি জীবই অনেক পরিশ্রম করে। পাখিদের গান বহু প্রজন্মের মানুষকে মুগ্ধ করে এসেছে, আন্দোলিত করেছে এর রহস্যময়তায়। আমি ইতিমধ্যে হাম্পব্যাক তিমিদের আরো বেশী বিস্তারিত আর রহস্যময় সঙ্গীতের কথা বলেছি, এর বিস্ময়কর ব্যপ্তি এবং এর শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করার ক্ষমতা মানুষের শ্রাব্যক্ষমতা তো বটেই, এছাড়াও সাবসনিক (শ্রাব্যতার সীমার নীচে) গোঙ্গানী থেকে আন্ট্রাসনিক (শ্রাব্যতার সীমার উপরে) চিৎকারও অন্তর্ভুক্ত। মোল-ক্রিকেটরা তাদের গানের তীব্রতা বাড়াতে পারে অনেক উচ্চ শব্দে, যখন মাটির নীচের গর্তে তারা গান গায়, খুব সতর্কতার সাথে যারা গর্ত খোড়ে দ্বিগুণ হারে বাড়ানো শিঙ্গা বা মেগাফোনের আকৃতি সৃষ্টি করে। অন্ধকারে মৌমাছিরা নাচে অন্য মৌমাছিদের কোথায় খাদ্য আছে তার দুরত্ব আর নির্দেশনা বোঝাতে, এই ধরণের যোগাযোগের শ্রেষ্ঠত্বের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে শুধু মানুষের ভাষা।
প্রাণীদের আচরণ নিয়ে কাজ করেন এমন বিজ্ঞানী বা ইথোলজিষ্টদের চিরাচরিত কাহিনীর একটি হচ্ছে যোগাযোগের সংকেত বিবর্তিত হয় যে সংকেত প্রেরণকারী আর গ্রহীতা, উভয়ের পারস্পরিক কল্যাণে স্বার্থে। যেমন, ধরুন পাখির বাচ্চারা তাদের মায়ের ব্যবহারকে প্রভাবিত করে খুব তীব্র স্বরে আওয়াজ করে যখন তারা হারিয়ে যায় বা ঠাণ্ডায় কাতর হয়। এই আচরণের প্রত্যক্ষ ফলাফল হচ্ছে ঘটনাস্থলে মায়ের উপস্থিত হওয়া, যে হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে নিরাপদ আশ্রয়ে অন্যান্য বাচ্চাদের সংস্পর্শে ফিরিয়ে আনে। এই আচরণকে বলাই যেতে পারে পারস্পরিক সুবিধার জন্য বিবর্তিত হয়েছে, এই অর্থে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই সব বাচ্চাদের আনুকুল্য প্রদর্শন করে যারা এভাবে ডাকে যখন তারা হারিয়ে যায় এবং এধরনের ডাক শোনার পর সঠিক প্রত্যুত্তর দেবার জন্য মায়েদেরকেও সুবিধা দেয়।
যদি আমরা চাই (যদিও আসলেই সেটা আবশ্যিক নয়), আমরা এই সব সংকেত বা চিপ কল’ কে নিয়ে ভাবতে পানি তাদের একটি অর্থ আছে বা তারা কোনো তথ্য বহন করছে: এই ক্ষেত্রে ‘আমি হারিয়ে গেছি। ছোট পাখিদের দেয়া কোনো সতর্কবাণী, যা আমি প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি, বলা যায় এমন কোনো তথ্য বহন করে, ‘বাজ-পাখি আছে নিকটে’; কোনো প্রাণী যে এই তথ্যটি পাবে এর উপর ভিত্তি করে সে তার আচরণ করবে ও এর ফলে সে উপকৃত হবে; সুতরাং বলা যায় এই তথ্যটি সত্যি। কিন্তু প্রাণীরা কি কখনো মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে, তারা কি কখনো মিথ্যা বলে?
কোনো প্রাণী মিথ্যা কথা বলছে এই ধারণাটিকে খুব সহজে ভুল। বোঝার সম্ভাবনা থাকে, সুতরাং আমি আগে থেকেই সেই ভ্রান্ত ধারণাটিকে ঠেকাতে চেষ্টা করবো। আমার মনে পড়ছে বিয়েত্রিস ও অ্যালেন গার্ডনারের দেয়া একটি লেকচারে আমি উপস্থিত ছিলাম, যেখানে তারা কথা বলতে পারা বিখ্যাত শিম্পাঞ্জি ওয়াশো (তিনি আমেরিকার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করেছিলেন এবং তার গবেষণা ও অর্জন আসলেই ভাষার শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়) সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য আদান প্রদান করছিলেন। দর্শকের সারিতে বেশ কিছু দার্শনিকও ছিলেন এবং লেকচার পরবর্তী আলোচনায় তারা বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা বিতর্কও করছিলেন, ওয়াশো কি মিথ্যা বলতে পারে কিনা। আমার সন্দেহ যে গার্ডনাররা ভেবেছিলেন এর চেয়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে সেখানে আলোচনা করার এবং আমি তাদের সাথে একমত এ ব্যাপারে। এই বইতে আমি প্রতারণা বা ছলনা আর মিথ্যার মত শব্দগুলো উচ্চারণ করছি আরো সরাসরি কোনো অর্থে, সেই দার্শনিকদের প্রস্তাবিত অর্থে না। তারা ছলনা বা প্রতারণা করার ‘সচেতন’ উদ্দেশ্য নিয়ে আগ্রহী। আমি শুধুমাত্র কথা বলছি কোনো একটি প্রভাবের কথা, যা কার্যকরীভাবে ছলনা বা প্রতারণার সমতুল্য হতে পারে। যদি কোনো পাখি “বাজ পাখি কাছে কাছে এমন কোনো সংকেত ব্যবহার করে যখন কিনা সেখানে কোনো বাজ পাখি সেখানে নেই, যার মাধ্যমে তার সহকর্মী পাখিরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে যায়, আর সে একা তাদের সবার খাবার খাওয়ার সুযোগ পায়, তখন আমরা হয়তো বলতে পারি এই পাখিটি মিথ্যা কথা বলেছে।, সে পরিকল্পিত উপায়ে সচেতনভাবে ছলনা করতে চেয়েছে কিনা, আমরা এমন কোনো অর্থ করছি না। যে বিষয়টি আমাদের অর্থ বোঝাচ্ছে সেটি হলো, এখানে মিথ্যাবাদী অন্য পাখিদের বঞ্চিত করে তাদের খাদ্য খাবার সুযোগ পেলো। এবং যে কারণে অন্য পাখিরা সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল তাহলে তারা মিথ্যাবাদী পাখির ডাকে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল এমন ভাবে যা কোন বাজ পাখির উপস্থিতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল।
বহু খাওয়ার উপযোগী কীটপতঙ্গ, যেমন আগের অধ্যায়ের প্রজাপতিরা, তাদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে বাজে স্বাদের বা কামড় দেয় এমন পোকামাকড়ের বাইরের রুপটি মিমিক বা অনুকরণ করে। আমরা নিজেরাই কোনো হলুদ কালো ডোরা কাটা হোভার-ফ্লাইকে ভয়ঙ্কর বোলতা ভেবেপ্রায়ই বোকা বনে যাই। মৌমাছিদের অনুকরণ করা কিছু মাছিরা আরো বেশী নিখুঁত তাদের ছলনাময় ছদ্মরুপে। শিকারী প্রাণীরা মিথ্যা কথা বলে। অ্যাঙলার মাছ। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে সাগরের তলদেশে, চারপাশের পরিবেশের সাথে শনাক্ত করা সম্ভব না এমনভাবে, তাদের একটি মাত্র চোখে পড়ার মত অঙ্গ হচ্ছে কেঁচোর মত আকাবাকা একটুকরো মাংস যা লেগে থাকে একটা দীর্ঘ ‘মাছ ধরার ছিপের মত মাথা থেকে সামনের দিকে বেরিয়ে আসা একটি বর্ধিত অংশে। যখনই কোনো ছোট মাছ নিকটে আসে, অ্যাঙলার তার কেঁচোর মত টোপটাকে নাড়ায় তার সামনে এবং এটিকে লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসে তাদের লুকিয়ে রাখা মুখের কাছে, হঠাৎ করে এটি তার মুখ হা করে, এবং সেখানে টেনে নেয় মাছটাকে তার খাদ্য হিসাবে। এখানে অ্যাঙলার যেন মিথ্যা কথা বলেছে, সে ব্যবহার করছে কেঁচোর মত মোচড়ানোর ভঙ্গি করা কোন বস্তুর প্রতি মাছদের আকর্ষিত হবার প্রবণতাকে : সে এখানে বলছে, “দেখো এই যে একটা কেঁচো এবং যেকোনো ছোট মাছ যে এই মিথ্যাকে বিশ্বাস করে, দ্রুত সে প্রাণ হারায় অ্যাঙলার মাছের খাদ্য হিসাবে।
কিছু সারভাইভাল মেশিন অন্যদের যৌন কামনাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে। ‘বি’ অর্কিড মৌমাছিদের তাদের ফুলের সাথে সঙ্গম করতে প্ররোচিত করে, কারণ তাদের ফুলগুলো স্ত্রী মৌমাছিদের মত দেখতে। এখানে ছলনার আশ্রয় নিয়ে অর্কিডের লাভ হচ্ছে পরাগায়ন, কারণ কোনো মৌমাছি দুটি অর্কিড ফুলের দ্বারা বোকা বনে গেলেও ঘটনাচক্রে সে একটি থেকে অন্য ফুলে পরাগরেণু বহন করে নিয়ে যায়। জোনাকীরা (যারা মূলত বীটল) তাদের সঙ্গীদের আকর্ষণ করে আলো জ্বলিয়ে নিভিয়ে তাদের দিকে নির্দেশ করে। প্রতিটি প্রজাতির নিজস্ব এই আলো জ্বালানো নিভানোর নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা মোর্স কোডের ডট-ড্যাশের মত প্যাটার্ন আছে, যা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে যে কোনো ধরনের সংশয় দূর করে, যা ক্ষতিকর সংকর তৈরী হওয়া থেকে প্রজাতিকে সুরক্ষা করে। ঠিক যেভাবে নাবিকরা কোনো নির্দিষ্ট বাতিঘরের আলো জ্বলা আর নেভার প্যাটার্নের প্রতি লক্ষ রাখে, তেমনি জোনাকীরাও তাদের নিজেদের প্রজাতির সদস্যদের সেই আলোর সাংকেতিক বার্তা খুঁজে বের করে। ফোটুরিস (Photuris) গণর স্ত্রী সদস্যরা ‘আবিষ্কার করেছে যে তারা ফোটিনাস (Photinus) গণর পুরুষ সদস্যদের আকর্ষণ করতে পারে, যদি তারা ফোটুরিস গণর কোনো স্ত্রী সদস্যর আলো জ্বলা-নেভার সাংকেতিক কোডটি অনুকরণ করতে পারে। এবং তারা সেটি করে, এবং যখন কোনো একটি ফোটিনাস পুরুষ সেই সংকেতের ডাকে বোকা বনে গিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়, তাকে দ্রুত খাদ্য হিসাবে খেয়ে ফেয়ে ফোটুরিস স্ত্রী সদস্যরা। সাইরেন বা লোরেলেইদের কথা মনে পড়ে যেতে পারে এর সদৃশ্য কোনো একটি উদাহরণ হিসাবে। কিন্তু কর্নিশ কেউ (ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী) পছন্দ করবেন সেই প্রাচীন যুগের ‘রেকারদের কথা ভাবতে, যারা লন্ঠন বাতি ব্যবহার করে জাহাজদের পাথুরে উপকুলের দিকে প্রলোভিত করে নিয়ে যেত, তারপর লুট করতে পাথরের আঘাতে ভেঙ্গে পড়া জাহাজের সব মালামাল।
যখনই যোগাযোগের কোনো পদ্ধতি বিবর্তিত হয়, তখন সবসময়ই বিপদের আশঙ্কা থাকে কেউ হয়তো নিজেদের স্বার্থে এই পদ্ধতিটিকে ব্যবহার করতে পারে। প্রজাতির জন্য মঙ্গল’, বিবর্তনের এমন একটি ধারণা নিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠার কারণে স্বাভাবিকভাবে আমরা প্রথমে মিথ্যাবাদী আর প্রতারকদের ভিন্ন। কোনো প্রজাতির সদস্য হিসাবেই ভাবি: শিকারী প্রাণী, শিকার, পরজীবি এরকম আরো অনেক। তবে আমাদের অবশ্যই মিথ্যা আর ছলনা এবং যোগাযোগ পদ্ধতির স্বার্থপর অপব্যবহার প্রত্যাশা করতে হবে, যার উদ্ভব হয় যখনই ভিন্ন ভিন্ন একক সদস্যদের জিনগত স্বার্থগুলো আলাদা হয়। আর এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত একই প্রজাতির সদস্যরাও। আমরা পরে দেখবো, অবশ্যই আমরা এমনকি আশা করতে পারি যে শিশুরা তাদের পিতামাতার সাথে ছলনা করবে, স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের সাথে প্রতারণা করবে এবং ভাই ভাইকে মিথ্যা বলবে।
এমনকি সেই বিশ্বাসটিও, প্রাণীদের যোগাযোগের সংকেত মূলত বিবর্তিত হয়েছে পারস্পরিক সুবিধা আদান প্রদানের বিষয়টি লালন করার জন্য এবং তারপর সেটি অপব্যবহৃত হয়ে খারাপ উদ্দেশ্যপূর্ণ কিছু সদস্যদের দারা, আসলেই খুব বেশী সরল একটি ধারণা হতে পারে যে সব প্রাণীদের যোগাযোগের মধ্যে ছলনার কোনো উপাদান শুরু থেকেই থাকে, কারণ সব প্রাণীদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অন্ততপক্ষে কিছু না কিছু স্বার্থের সংঘাত আছে। পরের অধ্যায়টি স্বার্থের সংঘাতকে বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভাবার একটি শক্তিশালী উপায় উপস্থাপন করবে।
নোটস (অধ্যায় ৪)
(১) এই ধরনের কোনো বক্তব্য, আক্ষরিক অর্থ নিয়ে ভাবেন এমন সমালোচকদের প্রায়শই উৎকণ্ঠিত করে। তারা অবশ্য সঠিক, কারণ মস্তিস্ক কম্পিউটার থেকে অবশ্যই অনেকভাবেই ভিন্ন। তাদের অভ্যন্তরীণ কাজ করার প্রক্রিয়া, যেমন, খুবই আলাদা কোনো বিশেষ ধরনের কম্পিউটারদের চেয়ে, যা আমাদের প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে। কিন্তু তাদের কাজের সাথে সদৃশ্যতার বিষয়ে সেটি আমার বক্তব্যটির সত্যতাকে কোনোভাবে হ্রাস করেনা। কাজের দিক থেকে, মস্তিস্ক ঠিক অন বোর্ড কম্পিউটারের মত কাজ করে– উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ, প্যাটার্ন রিকগনিশন, স্বল্প মেয়াদী বা দীর্ঘ মেয়াদী উপাত্ত সংরক্ষণ, নানা কাজের সমন্বয় সাধন ইত্যাদি বহু কাজ।
যখন আমরা কম্পিউটার নিয়ে কথা বলছি, তাদের সম্পর্কে আমার মন্তব্য তৃপ্তিদায়ক বা ভীতিকরভাবে নির্ভর করবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর সময় নির্ভর। আমি লিখেছিলাম যে, (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ৬২) মাথার খুলির মধ্যে আপনি শুধু কয়েকশ টানজিস্টরের জায়গা দিতে পারবেন। আধুনিক যুগের টানজিস্টররা এখন ইনটিগ্রেটেড সার্কিটের সাথে যুক্ত। আজ টানজিস্টরে সমতূল্য কিছু যা আপনার মাথার খুলির মত জায়গায় রাখতে পারেন, তার সংখ্যা বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। আমি আরো বলেছিলাম (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ৬৬), যে কম্পিউটাররা যারা দাবা খেলে তারা একজন ভালো শখের খেলোয়াড়ের দক্ষতা ছুঁতে পরেছে। তবে আজ দাবার প্রোগ্রামগুলো যা খুব ভালো পেশাজীবি খেলোয়াড়দেরও হারাচ্ছে, সেগুলো এখন খুব সহজে আমরা বাসার কম্পিউটারেও দেখতে পাই। আর পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা প্রোগ্রামটা এখন দাবার গ্রান্ড মাষ্টারদের জন্যেও জোরালো চ্যালেঞ্জ। এখানে যেমন, স্পেক্টেটর পত্রিকার দাবা বিষয়ক সংবাদদাতা রেমন্ড কিনি, ১৯৮৮ সালে ৭ অক্টোবর এর সংখ্যায় লিখেছিলেন:
‘এখনও এটি বেশ চমক সৃষ্টি করে যখন শিরোপাধারী কোনো খেলোয়ারকে হারিয়ে দেয় কোনো কম্পিউটার, কিন্তু না, হয়তো এই চমক বেশী দিন থাকবে না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধাতব দানব যে কিনা মানুষের মস্তিস্ককে চ্যালেঞ্জ করেছে, অদ্ভুতভাবে তার নামও রাখা হয়েছে ‘ডিপ থট’, সন্দেহ নেই ডগলাস অ্যাডামসে প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। ‘ডিপ থটের সবচেয়ে সাম্প্রতিকমত কর্মকাণ্ডটি হচ্ছে, গত আগষ্টে বোস্টনে ইউএস ওপেন দাবা চ্যাম্পিয়নশীপে মানব বিপক্ষকে সন্ত্রস্ত করে রাখা। আমার কাছে ডিপ থটের খেলার সার্বিক রেটিং নেই, তবে ওপেন সুইস সিস্টেম কম্পিটিশনে এবার তার অগ্নিপরীক্ষা হবে, কিন্তু আমি দেখেছি একটি আকর্ষণীয় জয় শক্তিশালী কানাডীয় খেলোয়াড় ইগর ইভানভের বিরুদ্ধে যিনি কোনো একসময় কারপভকে পরাজিত করেছিলেন! খুব ভালো করে নজর রাখুন, এটি হতে পারে দাবার ভবিষ্যত’।
এরপর ‘ডিপ থটের প্রতিটি পৃথক পৃথক দানের বিবরণ। এটি হচ্ছে ‘ডিপ থটের’ ২২ তম দানের প্রতি তার প্রতিক্রিয়া:
‘অত্যন্ত চমৎকার একটি দান, মূল ধারণাটি হচ্ছে রাণিকে কেন্দ্রের দিকে টেনে নিয়ে আসা, আর এই ধারণাটি বিস্ময়কর রকম দ্রুতগতির সাফল্যের কারণ। বিস্ময়কর এর ফলাফল .. কালোর রাণির দুই পাশে এখন পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে সাদা রাণির প্রবেশে।
এর প্রত্যুত্তরে ইভানভের চালের বিবরণ দেয়া হয়েছে এভাবে:
‘একটি বেপরোয়া মরিয়া চাল, যা কম্পিউটার কোনো হৃক্ষেপ ছাড়াই অনায়াসে মোকাবেলা করে। চূড়ান্ত অবমাননা। “ডিপ থট’ গ্রাহ্যই করেনা রাণির পুনরায় বন্দী হওয়ার বিষয়টি, এর চেয়ে বরং সে এগিয়ে যায় দ্রুত বাজিমাতের চালে, কালো হার স্বীকার করে নেয়।
‘ডিপ থট’ যে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন দাবা খেলোয়াড়, সেটাই শুধু নয়। আমার কাছে যা বিস্ময়কর মনে হয় সেটি হচ্ছে মানব ‘সচেতনতার ভাষা’, যা সাংবাদিক ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ডিপ থট ‘অবজ্ঞা সহকারে অগ্রাহ্য করলো, ইভানভের ‘মরিয়া চাল’। ডিপ থটকে বর্ণনা করা হয়েছে আক্রমণাত্মক বিপক্ষ হিসাবে, কিনি ইভানভ সম্বন্ধে বলেছেন, তিনি আশা করছেন কোনো ফলাফলের, কিন্তু তার ভাষা দেখাচ্ছে, তিনি একই রকম ভাবে খুশী হন ডিপ থটের জন্য ‘আশা’ র মতো কোনো শব্দ ব্যবহার করতে পারলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশা করছি এমন কোনো একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ জিতবে। কিভাবে নম্র হতে হয় মানবতার সেটা শেখার দরকার আছে।
(২) A for Andromeda এবং তার সিকুয়েল Andromeda Breakthrough বইতে কিছু তথ্যবিভ্রাট লক্ষ করা যায়, ভীনগ্রহবাসীদের সেই সভ্যতা কি বহু দূরের অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সী অথবা কাছের কোনো নক্ষত্র, অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ যেমনটি আমি বলেছি। প্রথম উপন্যাসটিতে গ্রহটি ২০০ আলোকবর্ষ দূরে, আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সীর খুব কাছে অবস্থিত ছিল। কিন্তু এর পরের খণ্ডে সেই একই ভীনগ্রহবাসীদের সভ্যতাকে দেখানো হয়েছে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সীতে অবস্থিত, যা ২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আমার (মূল বইয়ের পষ্ঠা ৬৮ র পাঠকরা হয়তো ২০০ কে ২ মিলিয়ন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে পারেন তাদের অভিরুচি অনুযায়ী। আমার আলোচনার উদ্দেশ্যে অবশ্য কাহিনীটির প্রাসঙ্গিকতা অক্ষুণ্ণ থাকে। ফ্রেড হয়েল, যিনি এই উপন্যাসের লেখকদ্বয়ের মধ্যে উর্ধতন, একজন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং আমার সবচেয়ে প্রিয় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী The Black Cloud এর লেখক। অসাধারণ বৈজ্ঞানিক যে অন্তর্দৃষ্টিটি তিনি তার উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন, সেটি একটি বেদনাদায়ক বৈষম্যকে চিহ্নিত করেছে তার আরো সাম্প্রতিক কিছু বইতে, যা তিনি যৌথভাবে লিখেছিলেন, সি. বিক্রমাসিংহের সাথে। ডারউইনবাদকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা (একটি শুধুমাত্র বিশুদ্ধ চান্স বা সুযোগ নির্ভর কোনো তত্ত্ব হিসাবে) এবং স্বয়ং ডারউইনের উপর তাদের বোলতাসদৃশ আক্রমণ কোনভাবেই তাদের সাহায্য করেনি অন্যথায় কৌতূহলোদ্দীপক ‘আন্তঃনক্ষত্রীয় জীবনের উৎপত্তি (যদিও অসম্ভব) সংক্রান্ত ধারণাটিকে। প্রকাশকদের নিজেদের সেই ভ্রান্ত ধারণাটি সংশোধন করা উচিৎ, যা দাবী করে কোনো একজন বিশেষঞ্জের একটি ক্ষেত্রে পারদর্শিতা মানে অন্য আরেকটি ক্ষেত্রে দক্ষতা নয়। এবং যতদিন এই ভ্রান্ত ধারণাটি থাকবে, বিখ্যাত বিশেষজ্ঞরা এটির অপব্যবহার করার প্রলোভনটি সহজে উপেক্ষা করতে পারবে না।
(৩) কোনো একটি প্রাণী বা উদ্ভিদ বা কোনো জিন সম্বন্ধে এইভাবে কৌশলগতভাবে কথা বলা, যেন তারা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিভাবে তাদের সাফল্যটি বৃদ্ধি করা যায়, যেমন, ‘পুরষরা বড় দানের বড় ঝুঁকির জুয়াড়ী এবং স্ত্রীদের নিরাপদ বিনিয়োগকারী’ (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ৭৩), গবেষণারত জীববিজ্ঞানীদের কাছে এটি খুব স্বাভাবিক একটি ব্যপার। এটি সুবিধাজনক একটি ভাষা, যা ক্ষতি করেনা যদি না ঘটনাক্রমে এটি এমন কারো হাতে পড়ে যারা এটি বোঝার জন্য যে যথেষ্ট দক্ষ নয় এটি ভুল বোঝার জন্য বেশী মাত্রায় দক্ষ? যেমন আমি আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিনা এই প্রবন্ধটির অর্থ বুঝতে যা The Selfish Gene কে সমালোচনা করে লেখা হয়েছে Philosophy শীর্ষক একটি জার্নালে। এর লেখকের নাম মেরি মিজলে, এর প্রথম পংক্তিটাই বৈশিষ্ট্যসূচক: ‘জিনরা স্বার্থপর বা অস্বার্থপর হতে পারে না, যেমন করে কোনো পরমাণুরা হিংসুটে হতে পারে না, হাতিরা ভাবতে পারে না বা বিস্কুট কোনো পূর্বকারণবাদের কারণও নয়। আমার নিজের In Defence of Selfish Genes প্রবন্ধটি এর পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি প্রাসঙ্গিকভাবে এই অত্যন্ত অসংযত আর আক্রমণাত্মক পেপারটির পূর্ণাঙ্গ উত্তর ছিল। মনে হতে পারে কিছু মানুষ, যারা শিক্ষাগতভাবে অতিমাত্রায় যোগ্য হয়েছে দর্শনের নানা কৌশল ব্যবহার করার মাধ্যমে, এবং তাদের বিদ্বান যন্ত্রটি নিয়ে তারা খোঁচা দেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেন না যেখানে সেটা অপ্রাসঙ্গিক। পি. বি. মেডোয়ারের, ‘দর্শন-কাহিনীর; প্রতি আকর্ষণ সংক্রান্ত সেই মন্তব্যের কথা মনে, যা একটি বিশাল সংখ্যক মানুষের আছে, যারা প্রায়শই সাহিত্য অন্যান্য বিদ্বান রুচির দ্বার আশীর্বাদপুষ্ট, যারা তাদের ধারণ ক্ষমতার বাইরে এমনভাবে শিক্ষিত হয়েছেন যে, তারা আর কোনো বিশ্লেষণী চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেননা।
(৪) আমি মস্তিস্কের পৃথিবী ‘সিমুলেশন’ করার ধারণাটি আলোচনা করেছিলাম ১৯৮৮ সালে আমার গিফোর্ড লেকচারে, Worlds in Microcosm শিরোনামে। আমি এখনও স্পষ্ট না, সচেতনতা সংক্রান্ত গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার জন্য আসলেই এটি আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারে কিনা। কিন্তু আমি স্বীকার করছি আমার বেশ তৃপ্তি হয়েছিলো যখন এই ধারণাগুলো স্যার কার্ল পপারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তার ডারউইন লেকচারে। দার্শনিক ড্যান ডেনেটও সচেতনতার একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেছেন, যা কম্পিউটার সিমুলেশনের রুপকে আরো বিস্তারিত করেছে তার আলোচনায়। তার সেই তত্ত্বটি বুঝতে হলে, আমাদের দুটো কারিগরী ধারণা বুঝতে হবে কম্পিউটারের জগত থেকে, সেটি হচ্ছে: ভার্চুয়াল মেশিনের ধারণাটি, এবং সিরিয়াল ও প্যারালেল প্রসেসরের মধ্যে পার্থক্য। আমি এইসব বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা প্রথমেই দিয়ে নিতে চাই।
কোনো একটি কম্পিউটার হচ্ছে আসল মেশিন, বাক্সবন্দী একটি হার্ডওয়্যার। কিন্তু যেকোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে এটি একটি প্রোগ্রাম চালায় যা এটিকে অন্য একটি মেশিনের মত অনুভুত করায়, একটি ভার্চুয়াল মেশিন। সব কম্পিউটারের জন্য এটি বহুদিন ধরেই সত্যি, কিন্তু আধুনিক ব্যবহারকারী-বান্ধব’ কম্পিউটারগুলো এই ধারণাটিকে খুব সহজে বুঝতে সাহায্য করে। যখন আমি এটি লিখেছিলাম, ‘ব্যবহারকারী-বান্ধব হিসাবে বাজারে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল অ্যাপল মাকিনটশ কম্পিউটার। এর সফলতার কারণ ছিল, এর ভিতরের একগুচ্ছ প্রোগ্রাম, যা সত্যিকারের হার্ডওয়ার মেশিনটিকে যার মেকানিজমটি, যেকোনো কম্পিউটারের মত, অসম্ভব জটিল এবং মানুষের সহজাত ধারণাবোধের সাথে খুব বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ না, ভিন্ন ধরনের একটি মেশিনের মত দেখতে লাগে: ভার্চুয়াল মেশিন, বিশেষ করে সেটি মানুষের মস্তিস্ক আর হাতের সাথে যেন দারুনভাবে মিশে যায় সেভাবেই পরিকল্পিত থাকে। Macintosh User Interface হিসাবে পরিচিত ভার্চুয়াল মেশিনটি শনাক্তযোগ্যভাবে একটি মেশিন। এর বেশ কিছু বোম থাকে যা টেপা যায় এবং নানা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যেমন, হাই-ফাই মেশিনের মত কোনো স্লাইড কন্ট্রোল। কিন্তু এটি হচ্ছে “ভার্চুয়াল মেশিন’। বোতাম বা স্লাইডার সেখানে ধাতব বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরী নয়। তারা পর্দায় থাকা ছবি এবং আর আপনি তাদের চাপ দেন বা স্লাইড করেন পর্দায় আপনাদের ভার্চুয়াল আঙ্গুল ব্যবহার করে। মানুষ হিসাবে আপনি অনুভব করেন আপনি নিয়ন্ত্রণে আছেন, কারণ আপনার আঙ্গুল ব্যবহার করে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে আপনি অভ্যস্ত। আমি নিজেই বহু ধরনের ডিজিটাল কম্পিউটারের একজন অত্যন্ত জটিল স্তরের প্রোগ্রামকারী ও ব্যবহারকারী ছিলাম এবং আমি সাক্ষ্য দিতে পারি যে ম্যাকিনটশ (ও তাদের অনুকরণকারী যে কোনো কম্পিউটার) গুণগতভাবে এর আগের অন্য কোনো ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা থেকে একেবারে ভিন্ন একটি অভিজ্ঞতা। একটি প্ররিশ্রমহীন, প্রাকৃতিক একটি অনভূতি আছে এর ব্যবহারে, যেন ভার্চুয়াল মেশিনটি কারো নিজের শরীরেরই একটি সম্প্রসারিত অংশ। বিস্ময়কর পরিমান মাত্রায় কোনো ভার্চুয়াল মেশিন কোনো ম্যানুয়াল ব্যবহার করে আপনাকে আপনার সহজাত অনুভূতিকে ব্যবহার করার অনুমতি দেয়।
আমি এখন অন্যান্য কিছু প্রাসঙ্গিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করবো, যা আমাদের কম্পিউটার বিজ্ঞান থেকে আমদানী করতে হবে, সিরিয়াল এবং প্যারালেল প্রসেসরের ধারণা।আজকের ডিজিটাল কম্পিউটারগুলো মূলত সব সিরিয়াল প্রসেসর। তাদের একটি কেন্দ্রীয় ক্যালকুলেটিং ‘মিল আছে, একটি একক ইলেকট্রনিক বটলনেক, প্রক্রিয়াকরণ হতে যার মধ্য দিয়ে সব উপাত্তকে অতিক্রম করতে হয়। তারা একই সাথে বহু কাজ করছে বলে একটি বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে, কারণ তারা খুবই দ্রুতকাজগুলো করছে। একটি সিরিয়াল কম্পিউটার হচ্ছে একটি দাবার মাস্টারের মত যে ‘একই সাথে বিশ জনের বিপক্ষে খেলছে কিন্তু আসলে সে একে পর একজনের কাছে যাচ্ছে, রোটেশন করে। আসল কোনো দাবার মাস্টারের সাথে পার্থক্য হচ্ছে, কম্পিউটার এত দ্রুত তাদের অবস্থান পরিবর্তন এবং এত শান্তভাবে এর কাজগুলো সম্পাদন করে যে, প্রতিটি মানব ব্যবহারকারীর একটি বিভ্রম হয় যে, সে একাই কম্পিউটারের একচ্ছত্র মনোযোগ পাচ্ছে। মৌলিকভাবে যদিও, কম্পিউটার ধারাবাহিকভাবে এর ব্যবহারকারীদের সময় দিচ্ছে।
সম্প্রতি আরো বেশী দক্ষ কম্পিউটার, আরো বেশী দ্রুতগতির সৃষ্টি করার প্রচেষ্টায় প্রকৌশলীরা আসলেই সত্যিকারভাবে প্যারালাল প্রসেসিং মেশিন সৃষ্টি করেছে। এরকম একটি হচ্ছে এডিনবরা সুপারকম্পিউটার, যা সম্প্রতি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। এটি মূলত সমান্তরালভাবে সাজানো কয়েকশ ‘ট্রান্সপিউটার’, যাদের প্রত্যেকেই তাদের ক্ষমতায় সমসাময়িক ডেক্সটপ কম্পিউটারের সমতুল্য। সুপারকম্পিউটার কাজ করে সমস্যাটি নিয়ে এটিকে খণ্ড খণ্ড করে ভাগ করে নিয়ে, যা স্বতন্ত্রভাবে সমাধান করা হয়, যে কাজটি করে ট্রান্সপিউটারদের একটি দল। ট্রান্সপিউটার আংশিক সমস্যা নেয়, সমাধান করে এর উত্তর দেবার পর নতুন কাজের জন্য আবার প্রস্তুত হয়। সেই সময় আরো একগুচ্ছ ট্রান্সপিউটার তাদের সমাধান প্রস্তুত করে, এভাবে পুরো কম্পিউটারটি তাদের সর্বশেষ উত্তরটি পায় সাধারণ সিরিয়াল কম্পিউটার যত দ্রুত পারে তারচেয়ে বহুগুণ দ্রুত।
আমি বলেছিলাম যে, সাধারণ সিরিয়াল কম্পিউটার প্যারালেল প্রসেসর হবার একটি বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে, যদি এর মনোযোগ যথেষ্ট পরিমান দ্রুত সে বেশ কিছু কাজের উপর রোটেট করতে পারে। আমরা বলতে পারি যে একটি ভার্চুয়াল প্যারালেল প্রসেসর সিরিয়াল হার্ডওয়ার উপর বসে আছে। দার্শনিক ডেনেটর ধারণা হচ্ছে, মানুষের মস্তিস্ক ঠিক একই কাজ করে তবে এর বিপরীত ক্রমে। আমাদের মস্তিস্কে হার্ডওয়্যার মৌলিকভাবে প্যারালাল, এডিনবরা মেশিনের মত। এবং এটি এমন সফটওয়্যার চালায় যার পরিকল্পনা করা হয়েছে সিরিয়াল প্রসেসিং মত একটি বিভ্রম সৃষ্টি করতে: কোনো সিরিয়ালভাবে প্রক্রিয়াজাত করা ভার্চুয়াল মেশিন যা প্যারালাল গঠনের উপর অবস্থান করে। গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যা আমরা সাবজেকটিভ বা আত্মগত অভিজ্ঞতা, যেমন চিন্তা করার প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করতে পারি, সেটি ডেনেটের মতে, ধারাবাহিক একটা-পর অন্যটা, অনেকটা জয়েসিয়ান চেতনার প্রবাহ। তিনি বিশ্বাস করেন বেশীর ভাগ প্রাণী এই ধারাবাহিক অভিজ্ঞতাটা অনুভব করতে পারেনা এবং তারা তাদের মস্তিষ্কটা ব্যবহার করে এর আদি, প্যারালেল প্রসেসিং এর মোডে। সন্দেহ নেই যে মানুষের ব্রেইনও, এর প্যারালাল আর্কিটেকচার সরাসরি ব্যবহার করে এর বহু নৈমিত্তিক কাজের জন্য যা জটিল সারভাইভাল মেশিনকে চালাতে সাহায্য করে। কিন্তু এছাড়াও, মানুষের মস্তিস্ক একটি ভার্চুয়াল মেশিনের সফটওয়্যার তৈরী করেছে যা সিরিয়াল প্রসেসরের বিভ্রম সষ্টি করে। মন, এর ধারাবাহিক চেতনার প্রবাহসহ হচ্ছে একটি মেশিন, মস্তিষ্কের অভিজ্ঞতাকে অনুভব করার জন্য একটি উপায়, ঠিক যেমন Macintosh User Interface যন্ত্র কম্পিউটারকে ধূসর বাক্সের মধ্যে অভিজ্ঞতায় অনুভব করানোর ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী-বান্ধব’ একটি উপায়।
খুব স্পষ্ট নয় কেন আমাদের মানুষদের কোনো সিরিয়াল ভার্চুয়াল মেশিনের প্রয়োজন, যখন অন্য প্রজাতিরা ভালোই আছে তাদের অনাড়ম্বর প্যারালাল মেশিনসহ। হয়তো বন্য মানুষকে যে কঠিন কাজগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেই কাজগুলো মূলত সিরিয়াল। অথবা হয়তো ডেনেট হয়তো ভুল করেছেন শুধুমাত্র আমাদের আলাদা করে। তার আরো বিশ্বাস হলো এই সিরিয়াল সফটওয়্যার বিকাশ মূলত সাংস্কৃতিক একটি প্রপঞ্চ এবং আমার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট নয় কেন ঠিক এটাই হতে হবে। কিন্তু আমার এখানে যোগ করা উচিৎ, আমার লেখার সময়, ডেনেটের পেপারটি প্রকাশ হয়নি এবং আমার এই ব্যাখ্যাটি মূলত তার ১৯৮৮ সালে লন্ডনে জ্যাকোবসেন লেকচারের স্মৃতির উপর নির্ভর করে প্রস্তাবিত। আমার নিঃসন্দেহে কিছুটা ক্রটিপূর্ণ আর স্মৃতি-নির্ভর ধারণা, এমনকি খানিকটা অলঙ্কৃত কোনো ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করার চেয়ে, পাঠকদের আমি উপদেশ দিচ্ছি ডেনেটের নিজস্ব ব্যাখ্যাটা পড়তে, যখন তা প্রকাশ হবে।
মনোবিজ্ঞানী নিকোলাস হামফ্রে একটি চমৎকার হাইপোথিসিস প্রস্তাব দিয়েছেন, কিভাবে কোনো কিছু সিমুলেট করার ক্ষমতার বিবর্তনের ফলাফল হিসাবে সচতেনতার উদ্ভব হয়েছে। তার The Inner Eye বইটিতে হামফ্রে বিশ্বাসযোগ্য একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন, খুব বেশী মাত্রায় সামাজিক প্রাণী, যেমন, আমরা আর শিম্পাঞ্জিদের অবশ্যই বিশেষজ্ঞ স্তরের মনোবিজ্ঞানী হতে হবে। মস্তিস্কগুলো পৃথিবীর বহু বিষয়কে একই সাথে মোকাবেলা করতে হয় বা সিমুলেট করতে হয়। কোনো সামাজিক প্রাণী আরেকজনের পথিবীতে বসবাস করে, যে পথিবী সম্ভাব্য প্রজনন সঙ্গীদের, প্রতিদ্বন্দ্বীদের, সহযোগী এবং শত্রুদের। এমন কোনো জগতে টিকে থাকা ও উন্নতি করতে এই সব অন্য সদস্যরা কি ভাবছে সেটা বুঝতে আপনাকে খুব দক্ষ হতে হবে, পূর্বধারণা করতে হবে তারা এর পরে কি করতে যাচ্ছে। সামাজিক বিশ্বেকি হতে যাচ্ছে এমন কোনো কিছু পূর্বধারণা করার তুলনায় কোনো প্রাণহীন জগতে কি হতে যাচ্ছে এমন ভবিষ্যদ্বাণী অনেক সহজ। প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞানীরা, বৈজ্ঞানিকভাবে কাজ করার মাধ্যমে, মানুষের আচরণ পূর্বধারণা করতে তারা আসলে খুব বেশী দক্ষ না। সামাজিক সঙ্গীরা, মুখের মাংসপেশীর সামান্য নড়াচড়া ও আরো সূক্ষ্ম কোনো ইঙ্গিত দেখে মনোভাব এবং কোন আচরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝার ক্ষেত্রে প্রায়শই বিস্ময়করভাবে দক্ষ। হামফ্রে বিশ্বাস করেন যে, এই স্বভাবজাত প্রাকৃতিক মনোবৈজ্ঞানিক দক্ষতা সামাজিক প্রাণীদের মধ্যে অত্যন্ত অগ্রসরভাবেই বিবর্তিত হয়েছে, অনেকটা একটা বাড়তি চোখ বা অন্য কোনো জটিল অঙ্গ বিবর্তনের মতই। এই ‘ইনার আই’ হচ্ছে বিবর্তিত সামাজিক ও মনোজাগতিক অঙ্গ, ঠিক যেমন করে বাইরের চোখ একটি দেখার অঙ্গ।
এ-পর্যন্ত হামফ্রের যুক্তি আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। তিনি আরো যুক্তি দেন, এই ‘ইনার আই’ কাজ করে আত্ম-সমীক্ষার উপর নির্ভর করে। প্রতিটি প্রাণী নিজের ভিতরে তাকায় তার নিজেদের অনুভূতি আর আবেগের প্রতি, অন্যদের অনুভূতি আর আবেগকে বোঝার জন্য। মনোজাগতিক অঙ্গ কাজ করে আত্ম সমীক্ষার মাধ্যমে। আমি নিশ্চিৎ না বিষয়টিতে একমত কিনা যে এটি আমাদের সচেতনাকে বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু হামফ্রে খুবই চমৎকার লেখক, এবং তার বই জোরালো আবেদন রেখেছে সেটি বোঝাতে।
(৫) মাঝে মাঝে অনেকেই খুবই বিচলিত হয়ে ওঠেন পরার্থবাদীতার ‘জন্য’ জিনদের বিষয়ে বা আপতদৃষ্টিতে তাদের জটিল আচরণ নিয়ে। তারা (ভুল ভাবে) ভাবেন কিছু ক্ষেত্রে আচরণের এই জটিলতা অবশ্যই নিহিত আছে একটি জিনের ভিতরে। কিভাবে পরার্থবাদীতার জন্য একটি একক জিন থাকতে পারে, তারা জানতে চান, যখন কোনো জিনের কাজ শুধু একটি প্রোটিন অনু তৈরীর সংকেত বহন করা? কিন্তু কোনো কিছুর জন্যে’ জিন এইভাবে কোন কথা বলা যা বোঝায়, তা হলো জিনটিতে কোনো ‘পরিবর্তন অন্য কোথাও কোনো পরিবর্তনের কারণ হবে। একটি জিনগত ‘পার্থক্য, কোষের অণুদের কোনো বিশেষ কিছু পরিবর্তন করার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই জটিল জণবিকাশ প্রক্রিয়ায় কোনো পার্থক্যের সৃষ্টি করে এবং সেভাবেই, বলা যায়, আচরণের পরিবর্তন করে।
যেমন, পাখিদের মধ্যে ভাতৃসূলভ পরার্থবাদীতার জন্য একটি পরিবর্তিত জিন অবশ্যই নিঃসন্দেহে এককভাবে একটি সম্পূর্ণ নতুন জটিল আচরণে জন্য দায়ী হবে না। বরং এটি ইতিমধ্যে অস্তিত্ব আছে সম্ভবত জটিল এমন কোনো আচরণের প্যাটার্ন পরিবর্তন করবে। এই ক্ষেত্রে সম্ভাব্য পূর্বসূরি কারণ হচ্ছে পিতামাতার আচরণ। পাখিদের নিয়মিতভাবে জটিল স্নায়বিক অঙ্গাণুর দরকার হয় তাদের নিজেদের সন্তানের প্রতিপালন ও খাদ্য সরবরাহের জন্যে। এটি, আবার, বহু প্রজন্ম ধরে ধীর ধাপে ধাপে তৈরী হয় পূর্বসূরি থেকে তার নিজের স্নায়ুতন্ত্র অবধি। (ঘটনাচক্রে ভাতৃসূলভ পরার্থবাদী জিনদের নিয়ে সন্দেহবাদীরা প্রায়শই তাদের মনস্থির করতে পারেন না। কেন তারা আগে একই রকম সংশয় প্রকাশ করেনা পিতামাতার প্রতিপালনের সমপরিমান জটিল আচরণটির ক্ষেত্রে?)। আগে থেকে বিদ্যমান আচরণের প্যাটার্ন– এই ক্ষেত্রে বাবা-মার সন্তান প্রতিপালন– মধ্যস্ততা করবে একটি সুবিধাজনক গড়পড়তা নিয়ম রা রুল অব থাম্ব। যেমন, নীড়ের মধ্যে সব জোরে জোরে চিৎকার করা আর মুখ হা করে থাকা জিনিসগুলো খাওয়াতে হবে। ছোট ভাইবোনদের খাওয়ানোর জন্য জিনটিও কাজ করতে পারে, তারপর, বয়স তরান্বিত করা, যে বয়সে এই গড়পড়তা নিয়মটি পুরোপুরি পূর্ণতা পায়। কোনো পাখির ছানা যে ভাতৃপ্রতিম জিনটা বহন করে একটি নতুন মিউটেশন হিসাবে, সেটি শুধুমাত্র পিতামাতার সেই গড়পড়তা নিয়মটাকেই অন্যান্য পাখিদের তুলনা একটু আগে সক্রিয় করে তোলে। এটিও তারা বাবা-মার নীড়ে ‘চিৎকার করা, মুখ হা করে থাকা সদস্যদের’– তার ছোট ভাই ও বোনরা –যেমন, তারা যেন তার নিজের নীড়ে হা করে খেতে চাওয়া জিনিসগুলো– তার নিজের সন্তান। নতুন হওয়া তো অনেক দুরের কথা, জটিল আচরণগত কিছু নতুনত্ব, ভাতৃপ্রতিম আচরণ উদ্ভব হবে একটুখানি ভিন্ন ইতিমধ্যে বিদ্যমান আচরণ বিকশিত হবার একটি সামান্য প্রকরণ হিসাবে। প্রায়ই যা ঘটে, ফ্যালাসি বা ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয় যখন আমরা অত্যাবশ্যকীয় ধীর গতিতে ধাপে ধাপে বিবর্তন হবার কথাটি ভুলে যাই। বাস্তব সত্যটি যে অভিযোজনীয় বিবর্তন অগ্রসর হয় ক্ষুদ্র, ধাপে ধাপে আগে থেকেই বিদ্যমান কোনো গঠন বা আচরণকে পরিবর্তন করার মাধ্যমে।
(৬) যদি মূল বইটির কোনো পাদটীকা থাকতো, তাদের একটি নিবেদিত হতো ব্যাখ্যা করতে যেমন রোথেনবুহলার নিজেই খানিকটা সতর্কতার সাথে করেছিলেন, মৌমাছিদের নিয়ে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়। অনেক কলোনির মধ্যে যাদের, এই তত্ত্বানুযায়ী, ‘হাইজিনিক’ আচরণ দেখানোর কথা ছিল না, তাসত্ত্বেও তাদের একটি সেই আচরণটি প্রদর্শন করেছিল। রোথেনবুহলারের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, “আমাদের এই ফলাফলটি অস্বীকার করা উচিৎ নয়, কিন্তু আমরা আমাদের জেনেটিক হাইপোথিসিসের ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করেছি অন্য উপাত্ত। অ্যানোলোমাস বা স্বাভাবিক নয় এমন কোনো কলোনি কোনো একটি মিউটেশন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে, যদিও এর সম্ভাবনা খুব কম।
(৭) প্রাণীদের কমিউকেশন বা সংযোগের বিষয়টি এমনভাবে আলোচনা করার জন্য আমি এখন অসন্তুষ্ট বোধ করছি। জন ক্রেবস এবং আমি দুটি প্রবন্ধে এই বিষয়ে যুক্তি দিয়েছিলাম যে বেশীর ভাগ প্রাণীদের সংকেত যেমন কোনো তথ্য সমৃদ্ধ ভাবা ঠিক না তেমনি তাদের ছলনাপূর্ণ হিসাবে না দেখাটাই উত্তম, বরং দেখা উচিৎ ম্যানিপুলেটিভ বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হিসাবে। কোনো একটি সংকেত হচ্ছে এমন কোনো উপায় যার মাধ্যমে একটি প্রাণী অন্য আরেকটি প্রাণীর মাংসপেশীর শক্তি ও ক্ষমতা ব্যবহার করে। কোনো একটি নাইটিঙ্গলের গান তথ্যপূর্ণ নয়, এমনকি কোনো ছলনাপুর্ণ তথ্য নয়, এটি প্ররোচনা দিতে পারে, মন্ত্রমুগ্ধ করে, হতবাক করে দেবার মত স্বর তৈরী করার ক্ষমতা দিয়ে। এই ধরনের যুক্তি এর যুক্তিসঙ্গত উপসংহার অবধি আলোচিত হয়েছে The Extended Phenotype বইটিতে, যার কিছুটা অংশ আমি সংক্ষিপ্ত আকারে সংযুক্ত করেছি এই বইয়ের ১৩ তম অধ্যায়ে। ক্রেবস ও আমি যুক্তি দিয়েছিলাম যে, সংকেত বিবর্তিত হয় আমরা যাকে বলি মানসিকতা পড়া এবং সেটি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা, এই দুটি প্রক্রিয়ার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। প্রাণীদের সংকেত বা যোগাযোগের পুরো বিষয় নিয়ে একটি বিস্ময়কর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে। জীববিজ্ঞানী আমেজ জাহাভীর দৃষ্টিভঙ্গি। অধ্যায় ৯ এর একটি নোটে আমি জাহাভীর দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করেছি আরো সহানুভূতির সাথে, এই বই এর প্রথম সংস্করণে আমি যেভাবে করেছিলাম, তার চেয়ে বেশী।