জলজ মানুষ
ইস্পাতের তৈরি চকচকে বিরাট গোলকটার সামনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন লেফট্যানেন্ট। তার সঙ্গে রয়েছে স্টিভেনস। এ ধরনের অদ্ভুত জিনিস ওরা আগে কখনও দেখেননি। লেফট্যানেন্ট বললেন, যন্ত্রটা দেখে তোমার কাছে কী মনে হচ্ছে স্টিভেন্স? সমুদ্রের তলায় পানির প্রবল চাপে এটা আবার খুঁড়িয়ে যাবে না তো?
স্টিভেন্স একটু ঘুরে বললেন, আমার ধারণা এলাস্টেড সবদিক চিন্তা-ভাবনা করেই এই গোলকটা বানিয়েছে ।
তুমি ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝতে পারছ না। সমুদ্রের নিচে পাঁচ মাইল নেমে যাওয়াটা কী ভয়ানক ব্যাপার। সমুদ্রের উপরতলে এক ইঞ্চির উপর পানির চাপ হলো চৌদ্দ পাউন্ড । ত্রিশ ফুট নিচে এই চাপ পড়ে আঠাশ পাউন্ড । এভাবে বাড়তে বাড়তে এক মাইল নিচে গিয়ে চাপ পড়ে যায় প্রায় দেড় টনের মতো। তাহলে পাঁচ মাইল নিচে সমুদ্রের মাটিতে কত চাপ পড়বে আমি তা চিন্তা করতে পারছি না।
এ কথা শুনে স্টিভেন্স যেন একটু চিন্তিত হলেন।
যা বললেন তা শুনে সত্যিই বেশ ভয় লাগছে। কিন্তু ইস্পাতের আবরণটা তো খুব পুরু।
লেফট্যানেন্ট আর কিছু বললেন না। তারা ভাবছে ইস্পাতের সেই বিরাট গোলকটি নিয়ে। এর বাইরের ব্যাস প্রায় নয় ফুটের মতো। এর গায়ে একদিকে দুটো গোল মোটা কাঁচের জানালা। একটির গায়ে স্কু দিয়ে একটি গোলাকার দরজা আটকানো। সেটা এখন আধখোলা অবস্থায় রয়েছে। তার ফাঁক দিয়ে গোলকটির ভেতরের অংশ দেখা যাচ্ছে। সেখানে বাতাসের গদি দিয়ে দেয়াল আর মেঝে মোড়া। বাইরের কোনোরকমের আঘাতেও ভেতরের মানুষটির বা যন্ত্রপাতির কোনোকম ক্ষতি হবে না। লেফট্যানেন্ট তখনও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না । তিনি আবার বললেন, দেখো, ওই জানালা দুটো সমুদ্রের তলার পানির চাপ একেবার সহ্য করতে পারবে না। প্রথমে বেঁকে ফুলে উঠবে। তারপর খুঁড়িয়ে যাবে। তখন সমুদ্রের পানি প্রচণ্ড বেগে গোলকের মধ্যে ঢুকতে থাকবে। সেই পানি বন্দুকের গুলির মতো ছুটে গিয়ে এলাস্টেডের মাথায়, বুকে বিঁধে তাকে একদম ঝাঁঝরা করে ফেলবে। যন্ত্র তখন থাকবে সমুদ্রের তলায় মাটিতে। আর তার মধ্যে এলাস্টেড মাখনমাখা নরম পাউরুটির টুকরোর মতো মেঝের উপর থেতলে পড়ে থাকবে।
ওই সময় সেখানে এলাস্টেড এসে উপস্থিত হলো। শাদা পোশাক পরনে ছিমছাম এক যুবক। বড় টুপির নিচে তার চোখ দুটো কী এক আনন্দে চকচক করছে। তাদের কথাবার্তার শেষটুকু সে শুনেছে। প্রসন্নভাবে বলে উঠল, দেখেছ, আজকের দিনটা কী সুন্দর! চমক্কার আবহাওয়া। আকাশ ঝকঝকে নীল। সমুদ্রও শান্ত। খানিক পরই গোলকটাকে সমুদ্রে নামাতে হবে। আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি ওটাতে চড়ে সমুদ্রের অতলে পাড়ি দেব।
এ কথা বলে এলাস্টেড জাহাজের রেলিঙের কিনারে গিয়ে ঝুঁকে নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। জাহাজের ডেকের এক প্রান্তে বিরাট একটা ক্রেন। তার সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে গোলকটাকে। এলাস্টেড এগিয়ে যায়।
প্রথমে আমি কাচের জানালার ভেতর দিয়ে গোলকটার মধ্যে প্রবেশ করব। এরপর তোমরা স্কু দিয়ে ভালো করে জানালাটার পাল্লা বন্ধ করে দিও। আমি ভেতরে ঠিকমতো বসে কেবিনের ইলেকট্রিক বাতিটা তিন বার জ্বালাব আর নিভাব। এই সঙ্কেত পেয়ে তোমরা গোলকটাকে ক্রেনে করে পানিতে নামিয়ে দিও। কতগুলো বড় বড় সীসের ভার আটকানো আছে গোলকটার নিচে। যন্ত্রের মাথার উপরেও কতগুলো সীসের ভার কয়েক ফ্যাদম লম্বা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। যখন জাহাজটার সঙ্গে বাঁধা মোটা দড়িটা তোমরা কেটে দেবে তখন গোলকটা জোরাল ভাবে পানির নিচে নামতে থাকবে। ওর নিচে বাঁধা সীসের ভারগুলোর মধ্যে একটা লোহার রড পরানো আছে। ওই রডের সঙ্গে লাগানো আছে ঘড়ির মতো একটা যন্ত্র। সমুদ্রের তলায় মাটিতে যন্ত্রটা বসে পড়লেই ওই লোহার রড ঘড়ির মতো যন্ত্রটাকে চালিয়ে দেবে। আর এ মোটা দড়িটা রডের গায়ে জড়িয়ে যেতে থাকবে। কেবিনের আলো সারাক্ষণ জ্বলতে থাকবে। একটা সার্চ লাইটও থাকবে। তাই দিয়ে আমি পানির নিচে চারদিকটা ভালো করে দেখব। আধঘণ্টা যাওয়ার পর ঘড়ির মতো যন্ত্রটা থেকে একটা ছুরি বেরিয়ে দড়িটাকে কেটে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে গোলকটা ভারমুক্ত হয়ে উপরে উঠতে থাকবে। তখন কামানের গোলার মতো তীব্র গতিবেগ হবে আমার গোলকের। ভেসে উঠলেই কেবিনের মাথায় আলোর নিশানা জ্বলে উঠবে । তা দেখলেই তোমরা বুঝতে পারবে আমি কোথায় ভেসে উঠেছি। এটাই হলো আমার মহাসাগরের অতলে আসা যাওয়ার পরিকল্পনা।
সেদিন দুপুর এগারোটায় গোলকটাকে সমুদ্রে নামানো হলো। এলাস্টেড ওর কেবিনের বাতি তিন বার জ্বালাল আর নিভাল। একজন নাবিক যে দড়িটি দিয়ে গোলকটি বাঁধা ছিল সেটা কেটে দিল। দুলতে দুলতে গোলকটা পানির নিচে ডুবে গেল। ডেকের ওপর যখন ছিল তখন গোলকটাকে বেশ বড় দেখাচ্ছিল। এখন পানির নিচে সেটাকে ছোট দেখাচ্ছে। গোলকটার কাচের জানালা দুটো বুঝি উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন বিদায় জানাচ্ছে বাইরের পৃথিবীকে। অনেকেই রুমাল নাড়াল। একটু উৎসাহধ্বনি দিল।
খুব তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছে গোলকটা। তিন গোনার আগেই ওটা পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। জাহাজটাকে সরিয়ে নিয়ে একটু দূরে দাঁড় করানো হলো। যদি উপরে ওঠার সময় গোলোকটা জাহাজের নিচে ধাক্কা মারে তাই এই সাবধানতা।
আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল। সবার মুখে এক কথা। কেমন আছে। এলাস্টেড? কী দেখছে, কী করছে? ওর কি খুব শীত করছে? প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট হলো। এখনও দেখা নেই এলাস্টেডের। ধীরে ধীরে সবার মনে দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে । মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে। গোলকটা আর ভেসে উঠছে না। সকল নাবিক অধীর আগ্রহে রেলিং ধরে ঝুঁকে রয়েছে। সবার দৃষ্টি তখন সমুদ্রের দিকে। এলাস্টেডের বন্ধুরা তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। কখন উঠবে আলোর নিশানা।
সারারাত কেটে গেল চাপা উত্তেজনায় । তবু গোলকের দেখা নেই। আলো ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের বুকে। এলাস্টেডের ফিরে আসার সম্ভাবনা বুঝি ক্ষীণ হয়ে আসছে। কেউ বলছে কাঁচের জানালা দুটো গুঁড়ো হয়ে গেছে। কেউ বা আবার বলছে ঘড়ির মতো যন্ত্রটা ঠিকমতো দড়িটা গোটাতে পারেনি। তাই গোলকটা আর ভেসে উঠতে পারল না। এমনি সব অশুভ চিন্তার আলোচনায় সময় কেটে যাচ্ছে।
এমন সময় আকাশের গায়ে একটা আলোর ছটা ঝলসে উঠল। এক প্রান্ত থেকে অন্য এক প্রান্ত পর্যন্ত তীব্র আলোর রেখার সঙ্কেত পাঠাল। এলাস্টেডের বন্ধু ওয়েব্রিজ খুশিতে দু হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, ওই যে আলোর সঙ্কেত। নিশ্চয়ই সে কোথাও ভেসে উঠেছে। এখনই ঢেউ-এর ওপর গোলকটাকে দেখা যাবে। সবাই মিলে চারদিকে ভালো করে নজর রাখো।
অনেকক্ষণ খোঁজার পর তারা গোলকটাকে ভাসতে দেখল। তখনই ক্রেনে করে সেটাকে তোলা হল জাহাজের ডেকে। কাচের জানালাটা খুলে দেখা গেল ভেতরটা একেবারে অন্ধকার। বাইরের সার্চ লাইটটাও নেভানো। মেঝের ওপর এলাস্টেড অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়ে আছে। ভেতরটা ভীষণ গরম। কাচের জানালার ধারে রবারের যে প্লেটটা লাগানো ছিল সেটাও নরম হয়ে গেছে। জাহাজের চিকিৎসক এলাস্টেডের অচেতন দেহটাকে কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে টেনে বের করে আনলেন। এলাস্টেডকে নিয়ে যাওয়া হলো ওর নিজের কেবিনে। সারা দিন রাত পড়েই রইল আচ্ছন্নের মতো। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এলো তার। কথা বলতে পারল কয়েক দিন পর। এক রোমাঞ্চকর কাহিনি তখন তাদের শোনাল এলাস্টেড।
তোমরা ভেবেছিলেন সমুদ্রের নিচে আমি কেবলমাত্র কাদামাটি দেখতে পাব। তার পরিবর্তে সেখানে আমি নতুন এক বিচিত্র জগৎ আবিষ্কার করেছি। সেটা এত অবিশ্বাস্য যে শুনলে আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে হয়তো সন্দেহ করবে। তখন তোমরা ক্রেনের সঙ্গে লাগানো দড়িটা কেটে দিলে তখন গোলকটা পানির মধ্যে ডুবে গিয়ে ওলটাপালট খেতে লাগল। আমার অবস্থাটা একবার ভাব। একটি ফুটবলের মধ্যে ছোট ব্যাঙ-এর মতো। আমার পা দুটো যেন নিজের বশে ছিল না। মেঝের গদির ওপর পড়ে গেলাম একটা ডিগবাজি খেয়ে। হঠাৎ করে সেই দুলুনিটা বন্ধ হয়ে গেল। গোলকটা তখন সোজা হয়ে নিচে নামতে লাগল। আমি তখন কেবিনে কাচের জানালা দিয়ে বাইরের বিচিত্র সব দৃশ্য দেখতে লাগলাম। চারদিকের পানি সব সবুজ নীল। গোলক যত নিচে নামতে লাগল অন্ধকার তত গভীর হতে লাগল। উপরের পানি তারার আলোয় আলোকিত আকাশের মতো অস্পষ্ট অন্ধকার। আর নিচের পানি গভীর অন্ধকার। ছোট ছোট স্বচ্ছ প্রাণী গোলকের পাশ দিয়ে সবুজ ঝিলিক তুলে ছুটে যাচ্ছে। গতির তীব্র ঘর্ষণে গোলকটা গরম হয়ে উঠল। আমার শরীর ঘামে জবজব। জানালার কাচও গরম হয়ে উঠেছে । হঠাৎ পায়ের নিচে হিশহিশ করে একটা শব্দ ক্রমে বাড়তে লাগল। আর কেবিনের গা থেকে বুদবুদ ঝাঁক বেঁধে উপরে উঠল। এগুলো কি বাষ্পবিন্দু, নিশ্চয়ই গরম গোলকের স্পর্শে এসে সমুদ্রের পানি কিছুটা বাষ্পে পরিণত হয়েছে। আমার ভয় করতে লাগল। জানালার কাচ বোধ হয় এই উত্তাপে ফেটে যাবে। কিছুক্ষণ পর সব থেমে গেল। বুদবুদগুলোও মিলিয়ে গেল আস্তে আস্তে। জানাল কাচ ভাঙল না। এবারের মতো বুঝি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলাম। কেবিনের আলোয় দেখলাম আমি অনেকক্ষণ ধরে পানিতে নেমেছি। আর কয়েক মিনিট পরে আমি সমুদ্রের মাটি স্পর্শ করব। তোমরা তখন পাঁচ মাইল উপরে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই আমার কথা ভাবছিলে। গোলক তখন মাটির তলা স্পর্শ করেছে। ভারি জিনিসটা বসার জন্যে চারদিকে কাদামাটির একটা আস্তরণ নিচ থেকে উপরে ছড়িয়ে গেল। সেই থিকথিকে অন্ধকার ভেদ করে সার্চ লাইটের আলো ঘুরতে লাগল। দেখলাম সমুদ্রের মাটিতে কাদার ঢিবির আশেপাশে লিলি ফুলের গাছ পাতা মেলে রয়েছে। সুন্দর সুন্দর বিরাট স্পঞ্জ ঘুরে বেড়াচ্ছে দলে দলে। এদিক-ওদিকে ছড়ানো লাল আর কালো ঘাসের ঝোপ। তার ফাঁকে ফাঁকে খেলা করছে বিচিত্র রঙের সব মাছ। তাদের গায়ে নীলচে আভা।
এতটুকু বলে এলাস্টেড কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কী এক বিস্ময়কর জিনিসের কথা যেন ভাবছে।
সেই আলোমাখা প্রাণীর ঝাক গোলকের মাথার উপর দিয়ে ভেস চলে গেল। আর তাদের পেছনে পেছনে ভেসে এলো অদ্ভুত আকৃতির কতগুলো মূর্তি। দেখে যেন মনে হলো কতগুলো বিচিত্র মানুষ হেঁটে আসছে। সার্চ লাইটের তীব্র আলোয় তাদের চোখ বন্ধ। আমি স্পষ্ট দেখলাম তারা মেরুদণ্ডি প্রাণী। তাদের প্রায় গোলাকার দেহগুলো লম্বা লম্বা দুটো পা আর মোটা শক্ত লেজের উপর বসানো। পাগুলো ঠিক ব্যাঙের পায়ের মতো। দেহের সামনে ব্যাঙের হাতের মতো হাতও লাগানো রয়েছে। মাথা তাদের কালো সামনের দিকের কপালটা বেশ উঁচু। মুখটাতে মানুষের মুখের মতো একটা আদল রয়েছে। বড় বড় দুটো চোখ সরীসৃপের চোখের মতো কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ঠোট দুটোও সরীসৃপের ঠোটের মতো। হালকা নীল রঙ। এদের লম্বা লম্বা হাত মাথা তামা দিয়ে বাঁধানো। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে এসব দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ আলোর চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থেকে তারা চোখ খুলল। তারপর তাদের ভেতর থেকে একজন বীভৎসভাবে চিৎকার করে উঠল। সেই ভয়ঙ্কর শব্দ কেবিনের ভেতরে থেকেও শুনতে পেলাম। চারদিকে যেন তার প্রতিধ্বনি হতে লাগল। আমি তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে নরম কোনো জিনিস গোলকটাকে ধাক্কা দিতে লাগল। নড়ে উঠল গোলকটা। কারা এমন করে ধাক্কা দিচ্ছে? খুব দুলছে গোলকটা। আবছা অন্ধকারে দেখলাম আরও কয়েকটি ওই রকম বিচিত্র আকারের মানুষ এসে জুটেছে। সবার গায়ে ফসফরাসের নীলচে আলো এর ফলে অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। ঘড়ির মতো যন্ত্রটাকে তারা শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করছে। ভীষণভাবে নড়ছে গোলকটা। আমার তখন যে কী অসহায় অবস্থা। যদি ওই যন্ত্রটা নষ্ট হয়ে যায় তবে গোলকটা আর কখনও ভেসে উঠতে পারবে না উপরে । আমি তখন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সার্চ লাইট জ্বেলে দিলাম। সেই তীব্র আলোর ঝলকানিতে দিশেহারা হয়ে ওরা সব মিলিয়ে গেল। আমি কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কারা গোকটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে আমি নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এমন সময় দেখি দূরে অনেকটা জায়গা অল্প আলোয় আললাকিত। সেদিকেই গোলকটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যত এগিয়ে যাচ্ছি ততই কিছু কিছু জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঘরবাড়িগুলোর কাছে কতগুলো ভাঙা জাহাজের অংশ পড়ে আছে। তার পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একদল ওই অদ্ভুত জলজ মানুষ। তারা অবাক বিস্ময়ে দেখছে গোলকটাকে। আমাকে দেখতে পেয়ে তারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। আমি আবার চট করে আলো। নিভিয়ে দিলাম। তখন ওদের চোখে আমি অদৃশ্য। ঘড়িতে দেখি অনেকটা সময় কেটে গেছে। জ্বলজ্বল করছে ঘড়ির ডায়ালটা। আমার সঙ্গে আর মাত্র চার ঘন্টা চলার মতো অক্সিজেন রয়েছে। তখনই আমার সমুদ্রের উপরে ভেসে ওঠা দরকার। এবার দড়িটা কেটে দিতে হবে। নইলে গোলক ভাসতে পারবে না। ঘড়ির মতো যন্ত্রটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সেটা থেকে ছুরিটা বেরিয়ে দড়ি কাটতে পারবে না। আমি তখন নিরুপায়। কেবিনের আলো জ্বেলে হাত মুখ নেড়ে ওদের সেই কথাটা বোঝাতে চাইলাম। ওরা কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না।
ভেতরে ভেতরে আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটু পর গোলকটা জ্বলে ওঠে তীব্র গতিতে উপরে উঠতে লাগল। তাকিয়ে দেখি দড়িটা কাটা অবস্থায় বাইরে ঝুলছে। টানাটানির সময় হয়তো হঠাৎ টান পড়েছে ওটাতে। দড়ির নিচের সীসের ভারগুলো কখন যে খসে পড়ে গেছে। এর ফলে খুব গরম হয়ে উঠেছে গোলকটা। চারদিকের শীতল পানির সংস্পর্শে এসে গরম গোলকের গা থেকে বাস্পের অজস্র বুদবুদ ভেসে উঠছে। এ রকমটা নিচে নামার সময়ও হয়েছিল। এমন সময় মনে হলো একটা প্রকাণ্ড চাকা আমার মাথার উপর খুলে পড়ল। জ্ঞান হারিয়ে আমি তখন লুটিয়ে পড়লাম। এরপর জ্ঞান ফিরে পেয়ে। দেখি আমি শুয়ে আছি আমার কেবিনে। আর তোমরা রয়েছে আমার চারপাশে। প্রায় বারো ঘণ্টা আমি ছিলাম সেই অতলের রাজত্বে। তোমরা হয়তো ভাবছ এসব আমার উদ্ভট কল্পনা। না, তা নয়। এগুলো আমার কোনো কল্পনা নয়। আজগুবি গল্প নয়। জ্যাকিংস এডামের মতো প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানীরা এরকম জলজ মানুষের কথা বলে গেছেন। সমুদ্রের তলায় প্রচণ্ড চাপ এরা সহ্য করতে পারে। আর পানির মধ্যে নিশ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার মতো ক্ষমতা রয়েছে এই প্রাণীদের। এরা আমাদের মতো নতুন লাল বালু পাথরের যুগের সৃষ্টি। আমরা যেমন আকাশে ধূমকেতু দেখে বা উল্কাপাত দেখে বিস্মিত হই ওরাও তেমনি পানির নিচে ওদের জগতে যখন বাইরের কোনো কিছুকে নেমে আসতে দেখে তখন আবার অবাক হয়। পৃথিবীর গভীর জঙ্গলে সভ্য জগতের বাইরে যে বুনো আদিম আদিবাসীরা বাস করে তারা যখন দেখে বিমান থেকে অভিনব পোশাক পরা মানুষ তাদের মাঝখানে নেমে আসছে। তখন তারা বিচিত্র ভঙ্গিতে পূজা করে। এই জলজ মানুষেরাও তেমনি। যখন দেখল গোলকের মধ্যে অদ্ভুত পোশাক পরে আমি রয়েছি তখন তারা ভয় পেয়ে এক সময় আমাকে পুজো করছিল। আমি আবার যাব ওদের কাছে। ওদের জীবন রহস্য আরও ভালো করে জানার জন্যে। তারপর আমার এই বিচিত্র আবিষ্কারের কথা জানাব বিশ্ব জগতকে।
এতগুলো কথা বলে চুপ করল এলাস্টেড। এরপর সে নিজের মনের মতো করে গোলকটাতে যন্ত্রপাতি লাগিয়েছিল। তারপর ১৮৯৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রের তলায় পাড়ি দিয়েছিল সে। তার বন্ধুরা তের দিন ধরে সমুদ্রের নানা অংশে তাকে খুঁজে বেরিয়েছে। এখনও খুঁজছে। কিন্তু এলাস্ট্রেড এখনও ফেরেনি। সমুদ্রের তলায় বিচিত্র জলজ মানুষের জীবন রহস্য জানার চেষ্টায় সে সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গেল।
এইচ জি. ওয়েলস-এর ছায়া অবলম্বনে।