সকাল এগারোটা। চিকেন ফেদার-এর হেড অফিসে হঠাৎ করেই তুমুল ব্যস্ততা। এমডি সাহেব এসেছেন। তাঁর ঘরের তালা খুলে দেওয়া হয়েছে! ইলেকট্রিসিটি নেই বলে এসি চালু করা যাচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে জেনারেটার দিয়ে এমডি সাহেবের এসি চালু করা হয়েছে।
চিকেন ফেদারের জেনারেল ম্যানেজার আহসান টেবিলের স্মাওনে দাঁড়িয়ে আছেন। এমডি সাহেবের অনুমতি ছাড়াই তিনি বসবেন কি বসবেন না। এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে।
শুভ্ৰ বলল, বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
আহসান বসলেন।
শুভ্র বলল, মনে হয় আজ সন্ধ্যায় বাবার জাপান থেকে ফেরার কথা।
আহসান বিস্মিত হয়ে বললেন, উনি তো গতকাল ফিরেছেন! স্যার আপনি জানেন না?
শুভ্ৰ বলল, আমি বাড়িতে ছিলাম না। আমার এক বোনের সঙ্গে ছিলাম। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। যাই হোক, আমার কিছু টাকা দরকার। কীভাবে পাব?
টাকার পরিমাণ কত স্যার?
দুলাখ হলেই চলবে।
আহসান বললেন, একটা ক্লিপ দিয়ে ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারেন। কিংবা চেক কাটতে পারেন। আপনার ড্রয়ারে চেক বই আছে। চেক কাটলে একটু সময় লাগবে।
শুভ্ৰ স্লিপ লিখে টাকা নিল।
আহসান বললেন, চা খাবেন স্যার?
শুভ্ৰ বলল, চা খাব। চা দিতে বলুন। আমি দুটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। একটা যাবে আমার মার কাছে। আরেকটা যাবে একটা মেয়ের কাছে। তার ঠিকানা জানি না, তবে বাসা চিনি। আমার গাড়ির ড্রাইভার তার বাসা চেনে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।
আহসান বলল, অবশ্যই নিয়ে যাব। স্যার, আপনার বোনের বাসা কোথায়?
ও বস্তিতে থাকে। ঠিক বস্তিও বলা যাবে না। পাইপের ভেতর সংসার। জায়গাটা কটাবনের আশেপাশে। রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের গুদামঘরের বাউন্ডারির ভেতর।
আহসান বলল, স্যার, আমি খুবই কনফিউজড বোধ করছি।
শুভ্র বলল, কনফিউজড় হবার কিছু নেই। অনেকেই এ ধরনের বাড়িতে থাকে। ফুটপাতে থাকার চেয়ে ভালো।
স্যার, আপনি কি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন? আমি লাইন করে দেব?
শুভ্র বলল, বাবার সঙ্গে এখন কথা বলব না। চা খেয়ে বিদায় হব।
কোথায় যাবেন?
কিছু বইপত্র কিনব।
স্যার, বইয়ের লিষ্ট দিয়ে দিন, আমি কিনে নিয়ে আসছি।
আমি নিজে দেখেশুনে কিনব।
আহসান বিব্রত গলায় বলল, স্যার, আপনার বোনের নামটা কি জানতে পারি?
শুভ্র বলল, অবশ্যই পারেন। ওর আসল নাম মর্জিনা। তবে ওকে সবাই ফুলকুমারী নামে চেনে। ওর বাবার নাম ইসহাক। আগে রিকশা চালাতেন। ট্রাকের ধাক্কায় পা কাটা পড়েছে। এখন পাইপেই বেশির ভাগ সময় থাকেন। উনার রান্নার হাত খুবই ভালো।
আহসান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার বড় সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। সেটাও করা সম্ভব হচ্ছে না। এমডি সাহেব সামনে বসে আছেন।
শুভ্ৰ চা খেয়ে টাকা নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আহসান বলল, স্যার, আমি কি আপনার সঙ্গে আসব?
শুভ্ৰ বলল, না।
আপনি তো গাড়ি আনেন নি। অফিসের গাড়ি দিয়ে দেই?
শুভ্র বলল, না। রিকশায় করে ঘুরতে আমার চমৎকার লাগে।
শুভ্রর লেখা চিঠিটা রেহানা এই নিয়ে চারবার পড়লেন। পঞ্চমবার পড়তে যাচ্ছেন তখন মেরাজউদ্দিন বললেন, দেখি কী লিখেছে। রেহানা স্বামীর হাতে চিঠি দিয়ে চোখ মুছলেন। শুভ্র চলে যাবার পর থেকে একটু পর পর তাঁর চোখে পানি আসছে।
শুভ্র লিখেছে—
মা,
কাল রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্নটা বেশ মজার। আমি চশমা হারিয়ে ফেলেছি। আর তুমি বলছি, কান্না বন্ধ করো। একটা স্পেয়ার চশমা সবসময় তোমার ড্রয়ারে থাকে। তুমি কি ড্রয়ার খুলে দেখেছ?
আমি ড্রয়ার খুললাম। দেখি ড্রয়ারে শুধু আমার মানিব্যাগটা আছে। আমি মানিব্যাগ খুলে দেখি মানিব্যাগের ভেতর আমার চশমা।
স্বপ্নে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার হয় মা। মানিব্যাগের ভেতর টাকার বদলে চশমা পাওয়া যায়। তবে স্বপ্ন যত অদ্ভুতই হোক তার ব্যাখ্যা থাকে। চশমা ছাড়া আমি আচল, কাজেই যে-কোনো দুঃস্বপ্নে আমি চশমা দেখব। এটাই স্বাভাবিক।
টাকা পয়সার হঠাৎ অভাবে ঝামেলায় পড়েছিলাম বলে মানিব্যাগ স্বপ্নে দেখেছি।
মা শোনো। আমি চিকেন ফেদার অফিসের ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে দুলক্ষ টাকা স্লিপ কেটে নিয়েছি। বাবা ঘটনাটা জানলে হয়তো মনে কষ্ট পাবেন। বাবা আমার আইডল। আমি কোনো অবস্থাতেই বাবাকে কষ্ট দিতে চাই না। মা, তুমি তোমার কাছ থেকে দুলক্ষ টাকা অফিসে জমা দিয়ে দিয়ে। আমি ভালো আছি। বেশ ভালো আছি। তুমি এবং বাবা তোমাদের দুজনের ধারণা আমি তোমাদের প্রটেকশন ছাড়া অচল। ধারণা মিথ্যা।
মা শোনো। ঐদিন একটা অসহায় মেয়েকে তুমি সাহায্য করো নি। আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি জেনে এসেছি, তুমি এবং বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। এর ব্যতিক্রম যখনই দেখি তখন অস্থির লাগে।
মা, তুমি ভালো থেকে এবং আমার ওপর রাগ করো না। কেউ আমার ওপর রাগ করে থাকলে আমার কেমন জানি লাগে। নিজেকে তখন ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হয়।
ইতি
শুভ্র
মেরাজউদ্দিন বললেন, রেহানা, তুমি upset হয়ে না। সবকিছু কনট্রোলের ভেতর চলে আসবে। আমাদের হিসেবে সামান্য ভুল হয়েছে। ভুল হবেই। ভুল থেকে আমরা শিখব। আহসান কি এসেছে?
হ্যাঁ, ড্রয়িং রুমে বসে আছে।
ওকে ডাকো। ওর সামনে এমন কিছু করবে না যাতে অস্থিরতা প্রকাশ পায়। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি অস্থির হলে সেই অস্থিরতা সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
রেহানা বললেন, আমরা কি যুদ্ধে নেমেছি?
প্রচুর বিত্ত মানেই যুদ্ধ। বিত্ত সামলানোর যুদ্ধ। বিত্ত বাড়ানোর যুদ্ধ।
মেরাজউদ্দিন এবং রেহানা খাবার টেবিলে বসে ছিলেন। আহসানকে ভীত এবং সংকুচিত ভঙ্গিতে তাদের সঙ্গে বসতে হলো। মেরাজউদ্দিন বললেন, আহসান, কেমন আছ?
আহসান বলল, স্যার ভালো আছি।
আজ আমার বাড়িতে কেক কাটার মতো একটা আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে। এই বিষয়ে কি কিছু জানো?
জানি না স্যার।
শুভ্রর M.Sc. পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। ও রেকর্ড নাম্বার পেয়ে প্রথমশ্রেণীতে প্রথম হয়েছে। সে যে KNS তা জানো?
জানি না। স্যার। KNS কী?
কালিনারায়ণ স্কলার। যাই হোক, চিকেন ফেদার অফিসে এই উপলক্ষে তোমরা একটা কেক কাটবো।
অবশ্যই স্যার।
মেরাজউদ্দিন আহসানের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, এডোলোসেন্স পিরিয়ড ১৯ বছরেই শেষ হবার কথা। অনেকের হয় না। শুভ্রর হয় নি। হয় নি বলেই সে পাইপের ভেতর বাস করার অদ্ভুত কাণ্ড করছে। তার বিষয় হচ্ছে Physics, পাইপ না।
অবশ্যই স্যার।
সে কোথায় থাকে কী ব্যাপার খোঁজ নিয়েছ?
নিয়েছি স্যার। তারা কেউ এখন সেখানে নেই। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারছে না।
রেহানা বললেন, যে মেয়েটিকে সে বোন বলছে, মর্জিনা না কী যেন নাম, ওই মেয়েটি কে?
আহসান বিব্রত গলায় বলল, বলতে লজ্জা পাচ্ছি ম্যাডাম। মেয়েটা একটা প্রস্টিটিউট।
কী বললে?
ম্যাডাম, ভাসমান পতিতা।
রেহানা এবং মেরাজউদ্দিন দুজনের কেউ বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। দুজন অবাক হয়ে আহসানের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আহসান বলল, স্যার, আমাকে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিন, আমি খোঁজ বের করে ফেলব। সব জায়গায় খবর চলে গেছে। থানাতে জানিয়েছি। থানাওয়ালরা কিছু করতে পারবে না; আমি দালাল লাগিয়েছি।
মেরাজউদ্দিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলে পুরো বিষয়টাকে যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে। তাই না?
রেহানা কিছু বললেন না। আহসান বলল, ম্যাডাম, আমার ওপর আর কোনো নির্দেশ কি আছে?
রেহানা বললেন, তুমি বলেছ শুভ্র আরেকটি মেয়েকে চিঠি লিখে গেছে। ওই চিঠি কি পৌঁছানো হয়েছে?
না। চিঠিটা আমার সঙ্গেই আছে। আপনি কি পড়ে দেখবেন?
রেহানা বললেন, দেখব।
মেরাজউদ্দিন বললেন, অবশ্যই তুমি সেই চিঠি পড়বে না। প্রাইভেসি আমাদের সবাইকে রক্ষা করতে হবে।
রেহানা বললেন, একটা সময় আসে যখন প্রয়োজনেই প্রাইভেসি ভাঙতে হয়। এখন সেই সময়। চিঠিটা আমি অবশ্যই পড়ব।
আহসান চিঠি এগিয়ে দিল।
যুথী,
আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন? সন্ধ্যাবেলা বাসায় চা খাবার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমি আসি নি। কেন আসতে পারি নি। সেই ব্যাখ্যাও করি নি।
এখন নিশ্চয়ই ব্যাখ্যাটা আপনি জানেন। আপনার বান্ধবী নীপা আপনাকে বলেছে। লাইলি কি ফিরেছে আপনাদের বাসায়?
No man is an island. আমরা কেউ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ না। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। যে কারণেই লাইলি আপনাদের কাছে ফিরেছে কি না জানার জন্যে আমি আগ্ৰহী।
আপনি কি গান শেখা শুরু করেছেন? আমি নিশ্চিত, একদিন গায়িকা হিসেবে আপনার খুব নাম হবে। পত্রিকায় ইন্টারভিউ, অটোগ্রাফ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। সেইসব ইন্টারভিউতে আমার নাম চলে আসবে। আপনি বলবেন, আমার গানের সিঁড়ির প্রথম ধাপ শুভ্ৰ নামের একজন প্রতিবন্ধী মানুষ করে দিয়েছিলেন। আমাদের সবারই প্রথম কয়েকটি সিড়ি অন্যদের কেটে দিতে হয়। বাবা-মা-বন্ধুরা কাটেন। আবার নিতান্ত অপরিচিতজনও কাটেন। যেমন, আপনার একটি সিঁড়ি হলেও আমি কেটেছি।
আমার খুব ইচ্ছা অসংখ্য মানুষের জন্যে আমি সিঁড়ি কাটব। তখন আপনি আর আমাকে গাধামানব বলবেন না। বলবেন সিঁড়ি-মানব।
ইতি
শুভ্র
রেহান চিঠিটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার ছেলে রাজমিস্ত্রি হয়েছে। সিঁড়ি বানাবার কারিগর। চিঠিটা পড়ো।
মেরাজউদ্দিন চিঠি পড়লেন। আহসানকে বললেন, মেয়েটিকে তুমি আমার এখানে নিয়ে আসবে। মেয়েটির সাহায্য আমাদের প্রয়োজন। শুভ্ৰ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলেও এই মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
স্যার, আমি এখনই যাচ্ছি।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তোমাকে এখনই যেতে হবে না। তুমি আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় চেয়েছ। আটচল্লিশ ঘণ্টা পারু হোক। তারপর যাবে। আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর শুভ্রর সন্ধান পাওয়া মেয়েটির আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারছি?
পারছি। স্যার, আমি কি উঠাব?
হ্যাঁ।
আহসান চলে যাবার পর মেরাজউদ্দিন বললেন, রেহানা! চা খাব। চা দিতে বলো।
মেরাজউদিনের অসময়ে চা খাওয়ার অর্থ তিনি কোনো আলোচনায় যাবেন। চা তার পছন্দের পানীয় না। আলোচনার অনুষঙ্গ।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেরাজউদ্দিন বললেন, একটা বয়সে প্রতিটি যুবক কিছুদিনের জন্যে কার্ল মার্কস্ হয়ে যায়। নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের জন্যে কিছু করতে হবে-এই ভূত মাথায় ভর করে। এটা হলো এক ধরনের ভাইরাস সংক্রমণ। ভাইরাসের কোনো ওষুধ নেই। এই অসুখেরও ওষুধ নেই। কিছুদিন পর আপনাআপনি ভাইরাস মারা যায়। রোগী সেরে ওঠে। তোমার ছেলের ক্যাপারেও একই ঘটনা ঘটবে।
রেহানা বললেন, আমার ছেলে অন্য দশটা ছেলের মতো না।
মেরাজউদ্দিন বললেন, সব মায়ের ধারণা তার ছেলে অন্য দশজনের মতো না।
রেহানা বললেন, রবীন্দ্রনাথের মায়েরও নিশ্চয়ই এরকম ধারণা ছিল। রবীন্দ্ৰনাথ কি আলাদা না?
মেরাজউদ্দিন বললেন, তোমার ছেলে রবীন্দ্রনাথ না। আইনস্টাইনও না। সে পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া একজন গৰ্ধব।
গৰ্ধব?
অবশ্যই। আমি চাই তার শিক্ষা সফর হোক। শিক্ষা সফর শেষে এই বাড়িতে সে ঢুকবে। তবে হেঁটে ঢুকবে না। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকবে।
এত রেগে গেছ কেন?
তোমার ছেলে একজন প্রস্টিটিউটের সঙ্গে বোন পাতাবো। পাইপে বাস করবে। আমি রাগ করব না? অফিস থেকে সে দুলক্ষ টাকা নিয়েছে। এক অর্থে চুরি করেছে। সে শুধু যে গর্ধব তা-না, চোর গর্ধব।
রেহানা বললেন, ওই টাকা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মেরাজউদ্দিন বললেন, গুড। পাঠিয়ে দাও।
এখন যুথীদের বাড়ির পরিস্থিতি বর্ণনা করা যেতে পারে।
টুনুর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। সে কোনোরকম যোগাযোগ করে নি। লাইলি এখনো নীপাদের বাড়িতে আছে। যুথীদের কারও সঙ্গে তার এখনো দেখা হয় নি বা টেলিফোনে কথা হয় নি। নীপা কয়েকবার টেলিফোন করেছে। যুথী টেলিফোন ধরে নি। টেলিফোন ধরার মতো অবস্থা তার ছিল না। জ্বরে এই কদিন অচেতনের মতো ছিল।
আজ তার জ্বর নেই। সে শুকনা মুখে বসার ঘরে বসে আছে। তার সামনে গানের টিচার অশোক মিত্র বসে আছেন। তিনি তবলা নিয়ে এসেছেন। ঝালর দেওয়া ওয়ার দিয়ে তবলা এবং বাঁয়া দুটাই ঢাকা। এই দুই বস্তু তাঁর অতি আদরের তা বোঝা যাচ্ছে।
অশোক মিত্র বললেন, আসুন শুরু করে দেই। হারমোনিয়াম কোথায়? কী হারমোনিয়াম, টিউনিং ঠিক আছে কি না দেখা দরকার।
যুথী বলল, কিছু মনে করবেন না, আমি গান শিখব না।
অশোক মিত্র বললেন, এটা কেমন কথা! আমার হিসাবের টিউশনি। আপনার জন্যে যে জায়গা রেখেছিলাম সেটা এখন কী করব? নতুন ছাত্র কই পাব?
যুথী বলল, আমার বিরাট বড় একটা আর্থিক সমস্যা হয়েছে। মাসে মাসে এক হাজার টাকা দেওয়া এখন আমার পক্ষে সম্ভব না।
যখন সম্ভব হবে তখন দিবেন। আপাতত আসা-যাওয়ার রিকশা ভাড়া আর যৎসামান্য নাস্তা দিলেই হবে। বাসে করেই আসা-যাওয়া করতাম। তবলা নিয়ে তো বাসে ওঠা সম্ভব না। হারমোনিয়াম নিয়ে পাশে বসেন।
যুথী বলল, আমার গলায় কোনো সুর নেই।
অশোক মিত্র বললেন, সুর আমি দিব। তিন বছর আমার সঙ্গে শিখবেন। তারপর বিটিভিতে অডিশন। এখন বিটিভিতে গানের অডিশন যে নেয় সে আমার ছাত্র। নাম রকিব। অডিশনে যেন পাশ করিয়ে দেয়। সেই দায়িত্ব আমার। ইদানীং শুনেছি সে অডিশনে পাশ করানোর জন্যে পার ক্যান্ডিডেট দশ হাজার করে টাকা নেয়। দেনদরবার করে সেটা হাফ করে দেব। আমি তার শুরু। গুরুর কথা সে ফেলতে পারবে না। কী হরমোনিয়াম কেনা হয়েছে একটু দেখি। খাতা লাগবে। খাতায় সরগম লিখে দিব। প্রথম দিন সারেগা এই তিনটা স্বরু। এর বেশি না। আমার শিক্ষাপদ্ধতি ভিন্ন।
যুথী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হরমোনিয়াম আনতে গেল।
ছুটির দিন। আজহার ঘুমাচ্ছিলেন। হারমোনিয়ামের শব্দে তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি বিছানায় উঠে বসে রাগী গলায় ডাকলেন, সালমা! সালমা!
সালমা ভীত মুখে উপস্থিত হলেন। আজহার বললেন, পেঁ পুঁ শব্দ কিসের?
সালমা বললেন, যুথীর গানের টিচার এসেছে।
আজহার বললেন, যুথীর গানের টিচার এসেছে মানে কী?
সে গান শিখবে বলে ঠিক করেছে।
আজহার বিস্মিত গলায় বললেন, সংসারের এই হাল। তার বড়ভাই নিখোঁজ। হারামজাদা গোপনে বিয়ে করেছে। সেই বৌ পড়ে আছে আরেক বাড়িতে। আর সে গান ধরেছে? নাচটা বাকি কেন? নাচ শিখুক। তারপর কোনো যাত্ৰাদলে ভর্তি হয়ে যাক। মেয়েকে ডাকো।
রেগাসা।
রেগাসা।
রেগা সাসারে।
রেগা সাসারে।
অশোক মিত্র বললেন, আপনার গান হবে এবং খুবই ভালো হবে। আপনার গলার স্বরে অস্বাভাবিক মিষ্টতা আছে। এই ধরনের কণ্ঠস্বরের একটা নাম আছে–কিন্নর স্বর। কিন্নর হলো দেবগায়ক। এখন আমার জন্যে একটু টিফিনের ব্যবস্থা করেন। ঘরে যদি ডিম থাকে একটা ডিম হাফবয়েল করে দিতে বলেন। আলাদা করে লবণ আর গোলমরিচ গুঁড়া। আর চিনি ছাড়া এককাপ দুধ-চা। আমার ডায়াবেটিস। ট্যাবলেট সঙ্গে আছে।
সন্ধ্যাবেলা যুথীর বড় চাচা হাজি মোবারক এক টিন মুড়ি, এক টিন চিড়া এবং কলার কাদি নিয়ে উপস্থিত। তাঁর কিছুদিন ধরে পেটে ব্যথা। কোনো চিকিৎসাতেই আরাম হচ্ছে না। তিনি ঢাকায় বড় ডাক্তার দেখাতে এসেছেন।
বাড়িতে পা দিয়েই তিনি সবাইকে কলা খাওয়ানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আজহার বড়ভাইকে খুশি করার জন্যে পর পর চারটা কলা খেয়ে ফেললেন।
মোবারক বললেন, এই কলার নাম স্বর্ণচাঁপা কলা। এখনো ঠিকমতো পাকে নাই। পাকলে মধুর চেয়ে মিষ্ট হবে। তুই আরেকটা কলা খা।
আজহার পঞ্চম কলা খেলেন।
মোবারক বললেন, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। পেটে আলসার না। কী যেন রোগ আছে, ওইটা হয়েছে। মফস্বলের চিকিৎসায় কিছু উনিশ-বিশ হয় না। ঢাকার চিকিৎসা লাগবে।
আজহার বড়ভাইকে নিয়ে সেদিনই ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার নানান টেস্ট করতে দিয়ে বললেন, আমার সন্দেহ ক্টোমাক ক্যানসার। আমি সাজেষ্ট করব হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে যেতে। হাসপাতালে থেকে টেষ্ট করাতেও সুবিধা।
তৃতীয় দিনে ডাক্তার নিশ্চিতভাবে বললেন, ক্যানসার। তিনি আজহারকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বললেন, ক্যানসারের শেষ পর্যায়। চিকিৎসায় ব্যথা কমবে, এর বেশি কিছু হবে না। ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন?
আজহার বললেন, সুস্থ সবল মানুষ। হাঁটাচলা করছে। একা চলে এসেছে ঢাকায়। ঠিকমতো দেখেছেন?
ঠিকমতোই দেখেছি। অন্য কাউকে দেখাতে চাইলে দেখান।
আজহার ভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। মোবারক বললেন, গাধা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিস। চেহারা দেখেই বুঝা যায় কিছু জানে না।
আজহার বললেন, কাল আরো বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আপনি ঠিকই বলছেন। গাধা ডাক্তার।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ডাক্তার একই কথা বললেন। মোবারক বললেন, ঢাকার সব ডাক্তারই তো মনে হয় গাধা। হয়েছে আলসার, বলে ক্যানসার। সব ডাক্তার আছে দুটা টাকা বেশি কামানোর ধােন্দায়। ক্যানসারের ভয় দেখিয়ে দুটা টাকা বেশি কামানো। আমি বাড়িতে চলে যাব। চিকিৎসা নাই খামাখা টাকা নষ্ট।
তিনি ঘুমান টুনুর ঘরে। সারা রাত ব্যথায় চিৎকার করেন। বাসার অন্য কেউ তাঁর গোঙানির শব্দে ঘুমাতে পারে না। হঠাৎ তার ব্যথা পুরোপুরি কমে যায়। তিনি উঠে বসে আনন্দিত গলায় ডাকেন, আজহার কই! আজহার!
আজহার ছুটে আসেন। মোবারক বললেন, ব্যথা একেবারেই নাই। আয় দুই চারটা সাংসারিক আলাপ করি। টুনুর কোনো সন্ধান কি পাওয়া গেল?
না।
আগে কখনো বাড়িঘর ছেড়ে গেছে?
আগেও গিয়েছে। পরীক্ষায় ফেল করলেই কিছুদিনের জন্যে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয়বার ইন্টারমিডিয়েটে ফেল করার পর তিন মাস বাসায় আসে নাই।
এইবার ঘরে ফিরা মাত্র বিয়ে দিয়ে দিবি। আমার হাতে পাত্রী আছে। মেয়ে শ্যামলা, তবে মুখের কাটিং ভালো। যুথী আম্মার চেয়েও ভালো। মেয়ের বাবার টাকা পয়সা আছে। মেয়ের জন্যে খরচপাতি করবে। আমি আভাস দিয়ে রেখেছি। তুই রাজি থাকলে ফাইনাল কথা বলব।
আজহার বিরসমুখে বললেন, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। লোকমুখে শুনতে পাই হারামজাদা গোপনে বিয়ে করেছে।
মোবারক চিন্তিত গলায় বললেন, কী সৰ্ব্বনাশ! কই আমি তো কিছু জানি না। আপনাকে ইচ্ছা করে কিছু জানাই নাই। জানানোর মতো বিষয় তো না। টুনু কি ওই বউয়ের সঙ্গে আছে?
জানি না। মেয়েটাকে যে বিয়ে করেছে তার নাম কী?
জানি না।
লাইলিকে দেখে যে-কেউ বলবে নীপাদের বাড়িতেই সে বড় হয়েছে। এই বাড়ির বাইরে তার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রথম দুদিন সে গেস্টরুমে ছিল, এখন সে নীপার সঙ্গে ঘুমায়।
নীপার বাবা আবদুর রহমান এর মধ্যে তিন দিনের জন্যে এসেছিলেন। নীপা লাইলিকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
বাবা, অনেকের পালক ছেলে পালক মেয়ে থাকে। এ আমার পালক বান্ধবী। এর নাম লাইলি। তবে আমি সংক্ষেপে ডাকি লা।
আবদুর রহমান হাসিমুখে বললেন, হ্যালো লা।
লাইলি কী বলবে বুঝতে পারল না। আবদুর রহমান বললেন, বিশাল বাড়িতে আমার মেয়ে একা থাকে। তার যে একটা সঙ্গী হয়েছে এতেই আমি খুশি। শুধু খুশি না, very happy.
আবদুর রহমান তিন দিনের জন্যে এসেছিলেন, এই তিন দিনের দুদিন ঘুমিয়ে কাটালেন। তৃতীয় দিনে ঘণ্টা চারেকের জন্যে বাইরে গেলেন এবং খুবই অল্পবয়স্ক এক তরুণীকে নিয়ে ফিরলেন। সুইমিংপুলে পানি দেওয়া হলো। দুপুরবেলা তরুণীকে নিয়ে তিনি সুইমিংপুলে নামলেন। নীপা এবং লাইলিকে খবর পাঠালেন তারাও যেন আসে।
লাইলি নীপকে বলল, ওই মেয়েটা কে?
নীপা বলল, জানি না। প্রথম দেখছি। বাবার কোনো বান্ধবী হবে। আগে কখনো দেখি নি। চলো সুইমিং করি।
লাইলি বলল, আমি না।
নীপা বলল, আমি না। আবার কী! চলো তো। সুইমিং করার সময় বাবা প্রচুর বিয়ার খায়। মজার মজার কথা বলে। শুনলে মজা পাবে।
লাইলি বলল, না।
নীপা বলল, দুবার না বলে ফেলেছ। তৃতীয়বার বললে কিন্তু চড় খাবে।
লাইলি পানিতে নেমেছে। তার গায়ে নীপার সুইমিং কস্টিউম; লজ্জায় সে নিজের দিকে তাকাতে পারছে না। অন্যদের দিকেও তাকাতে পারছে না। আবদুর রহমান বললেন, এই যে দুই বান্ধবী! পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এই অতি রূপবতী মেয়েটির নাম অনিক। সে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে। অনিকা, শুরু করো।
অনিকা সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি শুরু করল। তবে ইংরেজি কিছু না, বাংলা। সে এত সুন্দর করে আবৃত্তি করল যে শুনে লাইলির চোখে পানি এসে গেল। এ বাড়িতে ওঠার পর সে টুনুর কথা ভুলেই গিয়েছিল। টুনুর কথা মনে পড়ল।
শুধু তোমার বাণী নয় গো
হে বন্ধু, হে প্ৰিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশাখানি দিয়ো।
সারা পথের ক্লান্তি আমার
সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে
খুঁজে না পাই দিশা।
এ আধার যে পূর্ণ তোমায়
সেই কথা বলিয়ো।
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশাখানি দিয়ো।
হৃদয় আমার চায় যে দিতে
কেবল নিতে নয়,
বয়ে বয়ে বেড়ায় সে তার
যা-কিছু সঞ্চয়।
হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো,
দাও গো আমার হাতে,
ধরব তারে, ভরব তারে
রাখব তারে সাথে
একলা পথে চলা আমার
করব রমণীয়!
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশাখানি দিয়ো।
আজহার তাঁর বড়ভাইকে ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। নানান ধরনের চিকিৎসা একসঙ্গে শুরু হয়েছে। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ (গ্যারান্টি দিয়ে ক্যানসার এবং হাঁপানীর চিকিৎসা করেন। তিনবার স্বর্ণপদক প্রাপ্ত) এস নন্দি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করছেন। চব্বিশ ঘণ্টায় সাগুদানা সাইজের একটা বড়ি খেতে হয়।
ভেষজ চিকিৎসা চলছে। ওলট কম্বল গাছের পাতা ভেজানো পানি সকালে একগ্লাস করে খাচ্ছেন।
স্বপ্নযোগে পাওয়া বিকট দুর্গন্ধের সিরাপ খালিপেটে এক চামচ করে খাওয়া হচ্ছে। যে মহিলা এই সিরাপ দিয়েছেন তিনি বলেছেন, এই ওষুধের কাছে ক্যানসার সর্দিজ্বরের মতো মামুলি। সমস্যা একটাই, এই ওষুধ খেলে অন্য ওষুধ বন্ধ রাখতে হবে। ওষুধ যদি কাজ না করে এই একটা কারণেই করবে না।
রোগী এখন কোনো খাবারই খেতে পারছেন না। তবে তার নানাবিধ অদ্ভুত খাবার খেতে ইচ্ছা করছে। যেমন করলা দিয়ে টেংরা মাছের ঝোল। খইলাসা মাছের টক সালুন। ওলকচুর ভর্তা। চিতল মাছের ডিমের ভুনা।
আজহার ভাইয়ের খাবারের জন্যে প্রচুর ছোটাছুটি করছেন। রাতে তিনি হাসপাতালেই থাকেন। মাদুর এবং মশার কয়েল সঙ্গে নিয়ে যান। বারান্দায় মশার কয়েল জ্বালিয়ে মাদুর পেতে শুয়ে থাকেন। রাতে তার ঘুম একেবারেই হয় না। তিনি কয়েকবার ভাইয়ের বিছানার কাছে যান। হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকেন। চোখের সামনে মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে তার শরীরে মাঝে মাঝে কঁপুনি আসে। ভাইয়ের সঙ্গে কিছু কথাবার্তাও মাঝে মাঝে হয়। সবই সাংসারিক কথা।
আজহার, আমার দুই পুলার কারবার দেখছস? বাপ মৃত্যুশয্যায়, আর দুইভাই আছে সংসার নিয়া। এই সময় পুলাপানের মুখ দেখলেও শরীরে কিছু বল হয়। হয় না?
আজহার চুপ করে থাকেন। খবর দেওয়ার পরেও দুই ছেলের কেউ আসে নি। এই ঘটনা সত্য।
এরা কী জন্যে আসে না জানস? আসলেই চিকিৎসা খরচ দিতে হবে। এই ভয়ে আসে না। এমনিতে দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো মিল নাই! একটা দিকে মিল। বাপের জন্যে কিছু করব না; তোর ভাগ্য ভালো, তোর পুলাপান এরকম হয় নাই। টুনু তো বাপ ভক্ত। তার কোনো খোঁজ আছে?
না।
নখপড়ার ব্যবস্থা কর। নখাপড়ার মাধ্যমে সব জানা যাবে।
আজহার বললেন, কোনো প্রয়োজন নাই। বাকি জীবন এই ছেলের আমি মুখ দর্শন করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাড়িতে যদি আসে। পাছায় লাখি দিয়ে রাস্তায় বের করে দিব।
এটা ঠিক না। নিজের সন্তানের দিকে মুহাব্বত না দেখালে আল্লাপাক নারাজ হন।
তিনি যে নিজের সন্তানদের প্রতি যথেষ্টই মুহাব্বত দেখিয়েছেন তা জানা গেল বুধবার রাতে। ওইদিন রাতে তিনি ইমাম সাহেবের কাছে তওবা করলেন এবং ভাইকে ডেকে বললেন, একটা অন্যায় করেছি, মাফ দিয়া দে।
আজহার বললেন, কী অন্যায় করেছেন?
তোর বিষয়সম্পত্তি জাল দলিল করে দুই ছেলের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দিয়েছি। এখন মামলা মোকদ্দমা করে এই দুইজনরে তুই ঝামেলা করিস না। বড়ভাই হিসাবে তোর কাছে এইটা আমার আবদার। আমার গায়ে হাত দিয়া তুই কথা দে।
আজহার বললেন, হুঁ।
হুঁ কী? বল কথা দিলাম।
আজহার বললেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে আপনাকে যে জমি কেনার জন্যে দিয়েছিলাম। সেই জমিরও কি এই অবস্থা?
হাজি মোবারক জবাব দিলেন না।
হাজি সাহেব যে মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে তওবা করলেন তা-না। রাত বারোটার পর থেকে শুরু হবে জিন চিকিৎসা। ইমাম সাহেবের পোষা জিন কোহিকাফ নগর থেকে তাঁর জন্যে ওষুধ নিয়ে আসবে। যে রোগীর এই চিকিৎসা হবে তাকে নিষ্পাপ হতে হবে। তওবার মাধ্যমে নিষ্পাপ হবার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো।
রাত বারোটায় জিনের আনা দুটা কিসমিস খেয়ে রোগী বললেন, শরীর এখন ভালো। জুলাযন্ত্রণা নাই বললেই হয়। নিঃশ্বাসের কষ্ট কমে গেছে।
রাত দুটায় তিনি মারা গেলেন।
বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দুই ছেলে এসে উপস্থিত হলো। তারা খুবই হৈচৈ শুরু করল, কারণ বাবার ঠিকমতো চিকিৎসা হয় নাই! সেবাশুশ্রূষা হয় নাই। ইত্যাদি।