০৪. চব্বিশ ঘণ্টার ঈশ্বর – শেষ পর্ব

মহালয়ার পর থেকেই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গা ছাড়া ভাব চলে আসে। ছুটির মেজাজে থাকেন সবাই। বেশির ভাগ মন্ত্রীরাই চলে যান জেলার বাড়িতে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা জরুরি বৈঠকে আসতে পেরেছেন কলকাতা এবং কাছাকাছি জেলার মন্ত্রীরা। ইতিমধ্যে শহরে পুলিশের গুলিতে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। তৃণমূল দাবি করেছে নিহতরা তাদের পার্টির সমর্থক, পুলিশ দোষীদের আড়াল করতে নির্দোষদের মেরেছে। একাদশীর পর বন্‌ধ ডেকেছে তারা। পুলিশ কমিশনার তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করেছেন যে, নিহতরা সমাজবিরোধী। নিজেদের মধ্যে লুঠ করা জিনিসের ভাগাভাগির সময় মারামারি করে মারা গেছে। সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিল যে, ‘তা হলে আপনি বলছেন গুলি চালায়নি পুলিশ?’ পুলিশ কমিশনারের মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকটি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘আপনি আমাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখাবার কথা ভাবছেন?’ কমিশনার বলেছেন, ‘মানুষের ভাবনার স্বাধীনতা আছে। আমার ভাবনা আমি ভাবব না, কে ভাববে? পি ডব্লিউ ডি?’
টিভিতে এই সাংবাদিক সম্মেলন দেখানো হয়েছে। সব ক’টা চ্যানেল পুলিশ কমিশনারের মুণ্ডু চটকাচ্ছে। তারা পুলিশ গুলি ছুড়ে মানুষ মারছে এই দৃশ্য বারংবার দেখিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা টেলিভিশনে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, রাস্তায় নামলে পুলিশ এবং সমাজবিরোধীদের হাতে মার খেতে হবে বলে নামছেন না। কিন্তু পাবলিক খেপে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বসেছিলেন। তাঁর পাঞ্জাবি এবং ধুতির চেয়ে মাথার চুল বেশি সাদা হয়ে গিয়েছে এই ক’বছরে! মন্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি মার্ক্সবাদী। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি গত রাতের পর থেকে আমরা সবাই এক বিদিকিচ্ছিরি ক্ষমতা পেয়েছি, যা আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করছে। আমি আপনাদের অনুরোধ করব, যখন কথা বলবেন না তখন জীবনানন্দের কবিতা মনে মনে আবৃত্তি করে যান। তাতে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকবে।’
মুখ্যমন্ত্রী হাসলেন। ঠিক তখনই এক মন্ত্রী আর এক মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জীবনানন্দ কে? পার্টির কোনও কবি?’
মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি গান জানেন?’
‘একটু আধটু। শ্যামাসংগীত।’
‘তাই মনে মনে গান।’
ভদ্রলোক মনে মনে গাইতে লাগলেন, বল মা তারা দাঁড়াই কোথা?
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আপনারা জানেন কলকাতা এখন বিপন্ন। আমরা র্যাফ নামিয়েছি, মিলিটারি কার্ফু জারি করেছে। কিন্তু তারাও এখন নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় পড়েছে। একমাত্র যাঁরা বাংলা জানেন না তাঁরা ঠিকঠাক কাজ করছেন। অদ্ভুত ব্যাপার, আপনি আমার সামনে এলে যেমন আমি বুঝছি, তেমনই আপনিও আমার মনের কথা বুঝে ফেলছেন। এই অবস্থা বেশি দিন চলতে দেওয়া যাবে না।’
মুখ্যমন্ত্রী থামতেই এক জন প্রবীণ মন্ত্রী বললেন, ‘ইতিমধ্যে সাত জন মারা গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কি জানেন, ওরা কী ভাবে মারা গেল?’
‘দেখুন, লোকগুলো মারা গেছে এটাই সত্যি। কী ভাবে মারা গেল সেটা বড় কথা নয়।’ মুখ্যমন্ত্রী বলতেই এক জন টাকমাথা মন্ত্রী হাসলেন। মনে মনে বললেন, মার্ক্সবাদী মন্ত্রী পুলিশকে আড়াল করছে!
মুখ্যমন্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী ভাবলেন? বলুন কী ভাবলেন? আমি পুলিশকে আড়াল করছি? আপনাকে বলেছিলাম জীবনানন্দের কবিতা মনে করতে আর তার বদলে আপনি আমার চরিত্রহনন করছেন?’
টাকমাথা মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, ‘সেটাই তো অবাক করছে আমাকে যে, আপনি ছাত্রাবস্থায় স্লোগান দিতেন: পুলিশ তুমি যতই মারো মাইনে তোমার একশো বারো, সেই আপনি টিভিতে বারংবার দেখানো সত্ত্বেও পুলিশ কমিশনারের মিথ্যাভাষণকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এ সব কংগ্রেসি আমলে হলে মানাত। মানুষের কাছে আমরা কী কৈফিয়ত দেব?’
‘আশ্চর্য! পুলিশ কমিশনারকে আমি কেন প্রশ্রয় দেব?’ মুখ্যমন্ত্রী হাসলেন।
এ বার টুপি পরা মন্ত্রী মুখ খুললেন, ‘কারণটা আপনি ভাল জানেন। সি এ বি ইলেকশনে আমি দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, আপনি ওকে জেতাবেন বলে আমাকে দাঁড়াতে দেননি!’
‘মাফ করবেন, ভুল বললেন। আমি না। পার্টি নিষেধ করেছিল।’
টুপি পরা মন্ত্রী বললেন, ‘এক জন পার্টির প্রতি অনুগত কর্মী হিসেবে সেটা আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে পি ডব্লিউ ডি মন্ত্রী বসে আছেন। তাঁর দফতরকে অপমান করার সাহস পুলিশ কমিশনার কী করে পেল?’
পি ডব্লিউ ডি মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লোকটা কি আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে?’
মুখ্যমন্ত্রী হাত তুললেন, ‘এখন আমাদের সামনে দুটো ইস্যু। এক, যে করেই হোক মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা লোপ পাওয়াতে হবে। আমি ইতিমধ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তাঁরাও কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।’
এক জন বৃদ্ধ মন্ত্রী বললেন, ‘আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না। মা দোলায় চেপে এসেছেন। প্রলয় তো হবেই। কিন্তু একমাত্র মা-ই আমাদের রক্ষা করতে পারেন। প্রত্যেকটা পুজো কমিটিকে নির্দেশ দিন, উদ্বোধনের আগে যেন প্রতিটি মণ্ডপে যজ্ঞের আয়োজন করা হয়। মা দশভুজার স্বামী মহাদেবের কাছে এই যজ্ঞ বর প্রার্থনা করবে, যাতে প্রত্যেকটা কলকাতাবাসীকে মানুষ করে দেন তিনি।’
মুখ্যমন্ত্রী অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তার পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা সবাই কি ওঁকে সমর্থন করেন?’
বৃদ্ধ মন্ত্রী বললেন, ‘যদি পুত্রার্থে যজ্ঞ করা যায়, যদি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্ভব হয়ে থাকে, তা হলে এটাও অসম্ভব নয়।’
অন্যান্য মন্ত্রীদের অনেকেই মাথা নেড়ে সমর্থন করলেন। মুখ খুললেন না।
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘বুঝলাম। কিন্তু আপনাদের কথা দিতে হবে এই আলোচনার কোনও কথা মিডিয়া যেন না জানে। এমনকী কেউ আজ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন না। হলেই তারা আপনাদের ভাবনা বুঝে ফেলবে। কি, রাজি?’
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমি চাই শহরে শান্তি ফিরে আসুক। বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে যেন ভুল বার্তা না পৌঁছয়। তা যদি এ ভাবে শান্তি ফিরে আসে তা হলে আমি সমঝোতায় রাজি আছি।’ তিনি টুপিমাথা মন্ত্রীর দিকে তাকালেন, ‘আপনি তো তারাপীঠে গিয়ে পুজো টুজো দিয়ে এসেছেন। পুজো কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হল।’
ভদ্রলোক প্রতিবাদ করতে গেলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘না। আপত্তি করবেন না। আপনি তো বলেছেন, একমাত্র মরা মানুষকে বাঁচানো ছাড়া সব কাজ করতে পারেন। কলকাতা এখনও মরেনি, আপনি বাঁচান।’
মণ্ডপে মা এবং তাঁর সন্তানেরা তখনও পর্দার আড়ালে। কিন্তু কলকাতার সমস্ত মণ্ডপে পুরোহিতরা যজ্ঞ শুরু করে দিলেন। এই ব্যাপারটার জন্যে কোনও বাজেট ছিল না। ফলে এলাকার ধনপতিদের কাছ থেকে মন্ত্রীর নির্দেশবলে বাড়তি টাকা নিয়ে আসা হল।
যজ্ঞ শুরু হলে মানুষ মজা পেয়ে ভিড় জমাল। টিভি চ্যানেলগুলো জানিয়ে দিল, মুখ্যমন্ত্রী সি আই ডি-কে দায়িত্ব দিয়েছেন সাত জনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে তদন্ত করতে। কিন্তু লোক আপত্তি জানাল। পুলিশ কখনও পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত করে সত্যি কথা বললে কাকেরা কাকের মাংস খাবে। তৃণমূল সি বি আই দিয়ে এনক্যুয়ারি দাবি করল। সারা দিন যজ্ঞ চলছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নানান দাবি পৌঁছেছিল। শেষ তক সন্ধের মুখে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সি আই ডি তাদের কাজ করবে, কিন্তু তিনি বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত এক জন হাইকোর্টের বিচারককে দিয়ে তদন্ত করানো হবে। টুপিপরা মন্ত্রী তাঁর বাড়ির সামনের পুজোমণ্ডপে যজ্ঞ দেখতে দেখতে খবরটা শুনে বললেন, ‘দিল জল ঢেলে।’
সামনে পর্দা। ইচ্ছে করলেও শিবানী সেটা সরাতে পারছেন না। কিন্তু তাঁরা টের পাচ্ছেন পর্দার ও পাশে মণ্ডপে হইহই করে কিছু হচ্ছে। ডালডা পোড়ার গন্ধ পাচ্ছেন, কাঠ পুড়ছে। সংস্কৃত মন্ত্র ভেসে আসছে।
সরস্বতী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভাবল, ‘মা। এটা কী হচ্ছে? এখন তোমার পুজো, আমরা তাই এসেছি, কিন্তু বাইরে বাবাকে আরাধনা করা হচ্ছে কেন? অত্যন্ত অনৈতিক কাজ।’
লক্ষ্মী ভাবল, ‘বাবা তো আর মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করেননি। মায়ের হাতে ত্রিশূল দিয়ে কৈলাসেই শুয়ে ছিলেন। তা হলে?’
কার্ত্তিক ভাবল, ‘এক বার যদি দেখে আসতে পারতাম।’
এই সময় গণেশ দেখল একটা নেংটি ইঁদুর তার মাটির ইঁদুরের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। ওটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনও গর্তে থাকে। গণেশ মনে মনে জিজ্ঞাসা করল: ‘এই তুই কে?’
সঙ্গে সঙ্গে নেংটি মুখ তুলল, ‘আজ্ঞে আমি নেংটি।’
‘তুই দেখছি আমার ভাবনা বুঝতে পারছিস!’
‘আগে পেতাম না। কাল মাঝ রাত থেকে—।’
‘মানে?’
‘হঠাৎ একটা ফুল এসে পড়ল আমার গর্তের সামনে। সেই ফুলের গন্ধ পাওয়া মাত্র সবার মনের কথা বুঝতে পারলাম। ফুলটা তুলে খেতে গিয়ে টের পেলাম অনেক দূরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। তাই না খেয়ে গর্তে ঢুকিয়ে রেখেছি।’ খুশি খুশি গলায় বলল নেংটি।
শিবানীও না বলা কথাগুলো শুনছিলেন। উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘বাইরে ও সব কী হচ্ছে?’
‘আজ্ঞে, মা, যজ্ঞ করছে। বাবা যদি তুষ্ট হয়ে ওদের ক্ষমতা কেড়ে নেন। হে হে, লোকে আগে বর চাইত, এখন এরা ছাড়তে চাইছে।’
‘তার মানে এখানকার সবাই সবার মন বুঝতে পারছে এখন?’
‘হ্যাঁ মা। তাই তো মারপিট লেগে গেছে।’
শিবানী ভাবলেন, ‘গণেশ, বল তো ও কৈলাসের কিছু দেখতে পাচ্ছে কি না, বড্ড চিন্তা হচ্ছে রে।’
নেংটি ভাবল, ‘পাচ্ছি মা। বাবা ঘুমাচ্ছেন। এই চোখ খুললেন। উঠে বসলেন। তার পর তাকালেন। একটু হাসলেন। সামনের বাগানে মা মনসা ফুল তুলছিলেন। এম্মা! না। আর বলতে পারব না। দেখতে চাই না আর।’
মা ছটফটিয়ে উঠলেন, কিন্তু প্রতিমা নড়ল না। সর্বনাশ। মনসা তো ওঁরই মেয়ে। কোনও দিন দেখেনি বলে চিনতে পারবে না। এই জন্যে আমি আসতে চাই না কৈলাস ছেড়ে। গণেশ, ওকে বল, গর্ত থেকে ফুলটা আমাকে এখনই এনে দিক। আমি স্বচক্ষে তোর বাবার পতন দেখব।
নেংটি দৌড়াল ফুল আনতে।
সন্ধের পরে বৃষ্টি আরম্ভ হল। আবহাওয়া দফতর ঘোষণা করল এটা নিম্নচাপের বৃষ্টি নয়, কিছু ক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে। যজ্ঞের আগুন বৃষ্টির জলে নিভে গিয়েছিল। উদ্যোক্তারা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল উদ্বিগ্ন হয়ে। বৃষ্টির ভেতর উদ্বোধন হবে কী করে? মুম্বইয়ের স্টাররা এসেছেন কিনা। তাঁরা জানালেন, অপেক্ষা করতে হবে। মুম্বইয়ের স্টাররা ঠিক সময়ে এসে হোটেলে উঠেছেন। কলকাতায় পা দিয়েই ওঁদের চেহারা বদলে গেল। তাঁদের সঙ্গে তো বটেই, নিজেদের মধ্যেও ঝগড়া শুরু করেছেন। মূলত কে কত পাচ্ছেন, তাই নিয়ে ঝগড়া। মন বুঝতে পেরে জেনে গেছেন কে কত বেশি বা কম পাচ্ছেন। ওঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে। একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।
বৃষ্টি থামলে নেংটি ফুল নিয়ে এল। শিবানী ভাবছেন, ‘তুমি ওই ফুল নিয়ে আমার নাকের সামনে ধরো।’
‘মা, তা হলে যে তোমার শরীরে পা রাখতে হবে’, নেংটি ভয়ে ভয়ে বলল। ‘বাচ্চার পা মায়ের শরীরে তো লাগেই। এসো।’
সিংহের ওপর উঠে মায়ের পা বেয়ে কোমর পেরিয়ে দশ হাতের একটা হাত দিয়ে কানের গহনায় দুই পা রেখে মুখের ফুল মায়ের নাকের সামনে শেষ পর্যন্ত ধরতে পারল নেংটি। মা শ্বাস নিতেই দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর কথা ভাবতেই দেখতে পেলেন মহাদেব গাঁজা খাচ্ছেন। মনসা কোথাও নেই।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি একটু আগে কী করছিলে?’
মহাদেব চমকে তাকালেন, ‘ও, তুমি! এত ক্ষণে ফুলটাকে পেয়েছ? ভাল। এই তো, একটু সেবন করছি।’
‘তুমি কি মনসার দিকে তাকিয়েছিলে?’
‘অ্যাঁ, কে বলল? তুমি দেখেছ?’
‘শুনেছি। সে তোমার মেয়ে।’
‘জামাই মনে করিয়ে দেওয়া মাত্র পিতৃস্নেহে তাকিয়েছি।’
‘মরণ!’
বলা মাত্র কৈলাসের ছবি চলে গেল সামনে থেকে। আবার ঘ্রাণ নিলেন শিবানী। না। যেন টিভির চ্যানেল অফ হয়ে গেছে। ভাবলেন, ‘এটা কী হল? গণেশ, নেংটিটাকে জিজ্ঞাসা কর, সে দেখতে পাচ্ছে কি না?’
কিন্তু গণেশের ভাবনা বুঝতে পারলেন না তিনি। নেংটি নেমে গেল নীচে। শিবানী বুঝতে পারলেন তাঁদের কেউ কারও মনের কথা বুঝতে পারছেন না।
বাইরে তখন উল্লসিত উদ্যোক্তারা। কেউ বুঝতে পারছেন না সামনে দাঁড়ানো লোকটা কী ভাবছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোক এল, ‘মুম্বইয়ের স্টারদের ঝামেলা মিটে গেছে। সবাই নর্মাল। পাঁচ মিনিটের বেশি আপনাদের মণ্ডপে থাকব না। তাড়াতাড়ি রেডি হন।’
পাবলিক বলতে লাগল যজ্ঞ করার ফল হাতে হাতে পাওয়া গেল। মণ্ডপে মণ্ডপে একের পর এক উদ্বোধন হয়ে গেল। কার্ত্তিক ফ্যালফ্যাল করে চিত্রাভিনেত্রীদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল। এক জন অভিনেত্রী হেসে তাকে বললেন, ‘হাই হ্যাণ্ডসাম।’
রাত তিনটে থেকে ভোরের মধ্যে সব পুজোর উদ্বোধন হয়ে গেল।
শিবানীর কান্না পাচ্ছিল। মহাদেব মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে ওই শক্তি ফুলে ভরে তাঁর হাতে দিয়েছিলেন। কী অসভ্য লোক। কিন্তু সামনের পর্দা সরে গেছে বলে তাঁকে হাসি হাসি মুখে মহিষাসুরকে মারার পোজ দিতে হল।
ঘুম ভাঙতেই মেঝেতে কার্পেট পেতে শোওয়া স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সতর্ক হলেন সপ্তর্ষি। না। ভাববেন না। তিনি মনে মনে গান ধরলেন। চোখ মেলে বিরক্ত গলায় উর্বশী বললেন, ‘এ রকম বোকা বোকা চোখে কী দেখছ?’
সপ্তর্ষি চেষ্টা করেও না ভেবে পারলেন না, আমি বোকা? তুমি কি?
‘তুমি কী ভাবছ গো?’ পাশে উঠে এল উর্বশী।
‘কেন তুমি বুঝতে পারছ না?’
‘একদম না। আচ্ছা, আমি যা ভাবছি তা বোঝ তো?’ বলে মনে মনে ভাবলেন, টেকোটা মিথ্যে বলছে না তো?
সপ্তর্ষি মাথা নাড়লেন, ‘এ কী! কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘সত্যি?’
‘সত্যি।’
সঙ্গে সঙ্গে উর্বশী স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমাকে দশ হাজার টাকা দিও, প্লিজ। তুমি ব্ল্যাক টাকা কোথায় সরিয়েছ বুঝতে পারিনি।’
‘থাক ও কথা। মুখ ধোও। আজ পুজো। চলো, মাকে সেলাম করে আসি।’ সপ্তর্ষি উঠলেন।
‘ছিঃ। সেলাম বলতে নেই। বলো, প্রণাম।’ উবর্শীর সর্বাঙ্গে এখন আনন্দ।

[শেষ]

সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ আশ্বিন ১৪১৪ রবিবার ৭ অক্টোবর ২০০৭ থেকে ১১ কার্তিক ১৪১৪ রবিবার ২৮ অক্টোবর ২০০৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *