৪ ঘোলা জল, বিড়ালি, আর গোলাপ-মেয়ে
সব কিছু পচে গেছে;–ওই বাড়িগুলো, বাড়ির ভেতরে মানুষগুলো, মানুষের ভেতরে। মগজ, মাংস, রক্ত, অণ্ড, যোনিগুলো, যদি থাকে তবে আত্মাগুলোও পচে গেছে। জমাট দুর্গন্ধে ঢাকা পড়ছে রাশেদ, তার ত্বকের প্রতিটি ছিদ্র দিয়ে ঢুকছে একেকটি পচাগলা। লাশ, দুর্গন্ধে রক্তের প্রতিটি কণা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, প্রতিটি রক্তকণা তার ভেতরে বমি করে চলছে, বমিতে তার ভেতরটা বেশ্যাবাড়ির নর্দমার মতো ঘিনঘিনে হয়ে উঠছে। মাথার ওপরের আকাশ আর মেঘ, স্তরে স্তরে বাতাস, দূর থেকে বিচ্ছুরিত রৌদ্র, সমগ্র জলবায়ু পচে তার ওপর ঝরে পড়ছে, পচা বস্তুর অবিরল প্রপাতে রাশেদ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বড়ো বেশি দুর্গন্ধ পাচ্ছে রাশেদ, হয়তো সে নিজেই পচে গেছে; মাঝেমাঝে। নিজের অজান্তেই ঘ্রাণ নিচ্ছে সে নিজের মুঠোর। কিছু ছুঁতেই তার ইচ্ছে হচ্ছে না, বাগানের ওই গোলাপটি চুলেও তার হাত পঙ্কিল হয়ে উঠবে বলে মনে হয় হচ্ছে, মানুষের কথাই নেই, প্রতিটি মানুষ পঙ্ক্যুপের মতো। একটি সম্পূর্ণ দেশ পচে গেছে, অন্তত এ-শহর পচে গেছে। এ-শহরে কয় লাখ বদমাশ বাস করে? এ-শহরে অধিবাস করে কয় লক্ষ শুয়োরের বাচ্চা? এ-শহরে সঙ্গম করে কয় লাখ কুত্তাকুত্তি? আমিও কি একটা বদমাশ, শুয়োরের বাচ্চা, একটা কুত্তা? রাশেদ সারাটা দেশের দিকে তাকাতে চায়, হাতের তালুর রেখার মতো দেখতে চায় গ্রাম নদী ধানখেত পুকুর শহরগুলো, তার চোখে কোনো দেশ পড়ে না গ্রাম পড়ে না নদী পড়ে না; চোখে দোমড়ানো বুট ভেসে। ওঠে, লাশ ভেসে ওঠে, অসংখ্য পশুর চিল্কারে তার কান নষ্ট হয়ে যেতে চায়। আচ্ছা, এ-দেশের উত্তরে কী? দক্ষিণে কী? পশ্চিমে কী? পুবে কী? রাশেদ কিছুই দেখতে পায় না, সে অন্ধ হয়ে গেছে। পঞ্চগড় বগুড়া রংপুর রাজশাহি দিনাজপুর বোয়ালমারি চট্টগ্রাম কুমিল্লা নোয়াখালি ঠাকুরগাঁও মধুপুর মৌলভিবাজার ব্রাহ্মণবাড়িয়া যশোর নড়াইল রামপাল চরফেশন সিলেট কমলগঞ্জ সিরাজদিখান রাড়িখাল শ্রীনগর পাবনা ঈশ্বরদি কুষ্টিয়া জকিগঞ্জ চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর নাচোল পীরগঞ্জ শেরপুর চকোরিয়া মনপুরা টেকনাফ বিলাইছড়ি শ্যামনগর ডুমুরিয়া হেতালবুনিয়া সাঁথিয়া চান্দিনা চাটখিল দাগনভূঁইয়া কচুয়া নড়াইল মধুপুর নাটোর নারায়ণগঞ্জ সাতকানিয়া রামগড় বান্দরবন কেন্দুয়া মিঠাপুকুর জলঢাকা মাইজপাড়া ভাগ্যকূল কান্দিপাড়া দিঘলি কবুতরখোলা তারপাশা দামলা গাদিঘাট শিমুলিয়া সাতঘরিয়া কয়কীর্তন শ্যামসিদ্ধি ভাঙ্গা মাওয়া। দোহার শেলামইত সরসা তালা নরিয়া কোথায়? কতো দূর নষ্ট শহর থেকে? কতো দূর গেলে, কতো হাজার বছর কতো হাজার মাইল হাঁটলে, আমি দূরে যেতে পারবো। দুর্গন্ধের নগর থেকে, গলিত লাশের অভ্যন্তর থেকে? কিন্তু সুস্থ কি আছে মধুপুর, তার উরুতে পাছায় বুকে বগলে কুঁচকিতে কোনো ঘা হয় নি? হাঁটতে হাঁটতে যদি হরিণাকুণ্ড চলে যাই, তাহলে কি সেখানে দেখতে পাবো গাছে পচন ধরে নি, পচন ধরে নি জলে, ঘাসের শেকড়ে, মাছের মুড়োতে, কচুর লতিতে, পুঁইফলে? কলাপাড়া, একটা নাম মনে আসছে, যদিও রাশেদ জানে না এমন কোনো নাম আছে কিনা ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলে, মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখেছে নামটি, কলাপাড়ায় কলাগাছের সারি আছে কিনা জানে না রাশেদ, তার জানতে ইচ্ছে হয় কলাপাড়ায় কলাগাছের সারি থাকলে তার কলার কাঁদিতে কি পচন ধরে নি? না, আমি এসবের মধ্যে নেই, সঙ্গে নেই; ওই টাওয়ারের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, ওই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ, টেলিভিশন, সিনেমা, বঙ্গভবন, সচিবালয়, আমদানিরপ্তানি, বুট, ট্যাংক, স্টেনগান, কুচকাওয়াজ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, দালাল, দেশপ্রেমিক কারো সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে রাশেদের। আমি তোমাদের মতো বাঙালি নই তোমাদের মতো মুসলমান নই, আমি তোমাদের মতো বাঙালি হ’তে চাই না তোমাদের মতো মুসলমান হতে চাই না।
ভাঁড়গুলো বেশ জাঁকিয়ে বসছে, প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে বড়ো ভাঁড়টার ছবি, সে এখন জাতীয় ছবি হয়ে উঠেছে, জাতীয় চরিত্র হয়ে উঠছে, খণ্ডকালীন জাতির পিতাও হয়ে উঠতে পারে, যদি সে চায়; তার জারজ পুত্র হওয়ার জন্যে অনেকেই তৈরি। অন্যান্য, ছোটো ছোটো, ভাঁড়গুলোও ছোটো ছোটো মহাপুরুষের ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করছে, পেট ফুলিয়ে গাড়িতে উঠছে গাড়ি থেকে নামছে, তোরণের ভেতর দিয়ে ঢুকছে তোরণের ভেতর দিয়ে বেরোচ্ছে, ফিতা কাটছে, ফুলের মালা পরছে-হায় ফুল; তাদের পেছনে পেছনে, কুকুরের মতো, ছুটছে বাঙালি, বাঙালি মুসলমান, চিরবিদ্রোহী জাতি, রক্তের কণায় কণায় যার বায়ান্নো আর একাত্তর। বাঙালি মুসলমানের মুখের দিকে তাকালে মাঝেমাঝে কুকুরের মুখ দেখা যায়, মানুষের মুখ আর কুকুরের মুখের অদলবদল ঘটে; বাঙালি মুসলমান দু-চার বছর পর পর কুকুর হয়, ভালোবাসে কুকুর হ’তে; চারপাশে। এখন কুকুরেরা জিভ বের করে ছুটছে, পা চাটবে, প্রভুর পা চাটবে। প্রভু চাই, প্রভু দেখা দিয়েছে বলে খুব সুন্দর স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে বাঙালির মুসলমানের মুখগুলো। প্রত্যেক আবদুল আহাম্মদ মোহাম্মদ লাইন খুঁজছে, ডাস্টবিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে; এখনো। কামড়াকামড়ি শুরু হয় নি, শুরু হবে শিগগিরই। দুর্গন্ধ ভাগাড়ের একপাশে এখনো। একটি কোমল নির্মল ফুল ফুটে আছে রাশেদের জন্যে, তার নাম মৃদু; যার পাশে বসলে রাশেদ কোনো দুর্গন্ধ পায় না, পায় আশ্চর্য সুগন্ধ যাতে তার রক্ত পরিস্রত হয়ে ওঠে। রাশেদের ভালো লাগে মৃদুর সাথে কথা বলতে, আর সব কিছু তার ঘেন্না লাগে। রাশেদ জানে মৃদু, মৃদুর মতো শিশুরা সমাজরাষ্ট্র চালায় না, আহা সমাজরাষ্ট্র! সমাজরাষ্ট্র চালায় হারামির বাচ্চারা; হারামির বাচ্চা না হলে রাষ্ট্রের ভার পাওয়া যায় না, সমাজের ভার। পাওয়া যায় না। পালে পালে শুয়োরের বাচ্চাদের অধীনে জীবন কাটালাম, অতীতে পালে পালে এসেছে, এখন একপাল এসেছে, ভবিষ্যতে পালে পালে আসবে, আমি তাদের অধীনে জীবন কাটাবো, আমার জীবন ধন্য থেকে ধন্যতর হয়ে উঠবে, মনে হয়। রাশেদের। মৃদুর হাতে রাষ্ট্র নেই, মৃদু তাকে কিছু দিতে পারে না, বা সেই পারে সব দিতে, যা ওই শুয়োরগুলো কোনোদিন কাউকে দিতে পারবে না। মৃদুর সাথে জীবন। হচ্ছে জীবন, তার বাইরে গেলেই জীবন আবর্জনা জীবন ভাগাড় জীবন ব্যাশাবাড়ি; রাশেদের বাইরে যেতেই ইচ্ছে করে না, কোনোদিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না, প্রতিদিন যা ছাপা হয়ে বেরোয় নোংরা নিউজপ্রিন্টে, তার দিকে তাকালে গলগল করে বমি আসতে চায়। মৃদু তার কাছে শুধু গল্প চায়, গল্প শুনতে চায়, আরো গল্প চায়; রাশেদ গল্পের পর গল্প বানিয়ে চলে। মৃদু কোনো প্রশ্ন করে না, তার গল্পগুলো সত্যি কিনা। জানতে চায় না, ওগুলো যে সত্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই মৃদুর, যদি জানতে পারে ওগুলো সত্য নয়, তাহলে হয়তো সে কেঁদে ফেলবে, বা ওগুলো যে মিথ্যা হতে পারে। তা বোঝানো যাবে না তাকে; সে শুধু জানতে চায় তারপরে কী হলো? রাশেদও একদিন হয়তো এমনি চাইতো, তার কাছে সবই সত্যি ছিলো, শুধু গল্পের শেষ ছিলো না; যেমন মৃদুও বিশ্বাস করে গল্পের কোনো শেষ নেই, সব গল্পই সত্যি। সে যখন মৃদুকে গল্প বলে, তখন তার মনে হয় সেও আসলে ওই গল্প শুনছে, সে শুধু বলছে না শুনছেও, যেনো সেও মৃদুর মতো উদগ্রীব হয়ে থাকে গল্প শোনার জন্যে, তখন সেও মৃদু হয়ে যায়। মৃদুর থেকে বেশি মৃদু হয়ে যায়, মৃদু গল্প শোনে আর কল্পনায় হয়তো গল্পের ভেতরে ভেতরে ঘোরে, রাশেদ ঘুরতে থাকে তার বাল্যকালে। মৃদুর ওই বাল্যকাল নেই। রাশেদ একবার বলেছিলো, ছোটোবেলায় বোশেখ মাসে ঝড়ের মধ্যে আমরা আম কুড়োতে যেতাম; মৃদু প্রশ্ন করেছিলো, ঝড়ের মধ্যে কেননা আম কুড়োতে যেতে আব্বা? মৃদুর প্রশ্ন শুনে খুব ঘা খেয়েছিলো রাশেদ; সে ভেবেছিলো মৃদুও যেতে চাইবে আম। কুড়োতে, তার বদলে মৃদু জানতে চেয়েছে কারণ। ঝড়ের মধ্যে আম কুড়োতে যাওয়ার আনন্দটা কোনোদিন বুঝানো যাবে না মৃদুকে, ওতে যে আনন্দ থাকতে পারে, তা সে। কখনো বুঝবে না; তার কাছে এটাকে মনে হয়েছে একটা কাজ, তাই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে কারণটা। মৃদুর জন্যে সে একটি নায়িকা তৈরি করেছে, মৃদু নায়িকাই চায়; তাকে রাশেদ গাছ মাছ ধান মেঘের গল্প বলে দেখেছে, সে সবচেয়ে পছন্দ করে নায়িকার গল্প। মৃদু কি গাছ মাছ ধান মেঘের বাইরে পড়ে যাচ্ছে, ওসব কি মিথ্যে হয়ে গেছে ওর জীবনে; সত্য হয়ে উঠছে লিপস্টিকপরা নায়িকা? ওর ভেতরেও কি পচন। ধরছে? ওকেও কি পচিয়ে ফেলছে চারপাশ? ওর কি দোষ? ওকে তো কখনো মেঘের নিচে নিয়ে যাই নি গাছের পাতা জড়িয়ে ধরতে দিই নি ধান দেখাই নি মাছের আঁশের শোভা দেখাই নি কচুরিপানার ভেতরে ডুব দিতে দিই নি বৃষ্টিতে ভিজতে দিই নি। পৃথিবীর বদলে ও শুধু একটা টেলিভিশন পেয়েছে।
মৃদুর জন্যে একটি নায়িকা তৈরি করেছে রাশেদ; এটা নায়িকা আর নায়কদের সময়, চারপাশে নায়কনায়িকা, এতো নায়কনায়িকা আগে আর কখনো ছিলো না, পরেও কখনো থাকবে না, নাকি পরে শুধু পৃথিবী ভরে নায়কনায়িকাই থাকবে, পাঁচ মিনিটের জন্যে সব মেয়েমানুষ আর পুরুষমানুষ বিখ্যাত হবে;-একটি শাদা বিড়ালি;-একদিন রাশেদ তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কক্ষের দরোজা খুলতে গিয়ে দেখে দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিড়ালি! না, মৃদুর বিস্ময়বোধ নষ্ট হয়ে যায় নি, সে অবাক বিস্মিত বিহ্বল হতে পারে। বিড়ালি দাঁড়িয়ে আছে শুনেই ঝলমল করে ওঠে মৃদু, বিড়ালি দাঁড়িয়ে আছে! দেখতে শাদা! তোমার ঘরের দরোজায়! কী মজা! রাশেদের বিদ্যালয়টি কেমন মৃদু জানে না; শুনেছে সেটা বিরাট দালান, বারান্দার পর বারান্দা, ছাত্র আর ছাত্রী, সেখানে বিড়ালি! মৃদু বলে, আমি যদি বিড়ালি হতাম, কী মজা হতো! রাশেদ বলে, বিড়ালিটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার ঠোঁট টুকটুকে লাল, কী চমৎকার লিপস্টি পরেছে! মৃদু লাফিয়ে ওঠে বিড়ালি লিপস্টি পরেছে, টুকটুকে লাল, কী মজা, দেখতে খুব মিষ্টি, তাই না? কী লিপস্টি আব্বু? রাশেদ বলে, রেভলন, টুকটুকে লাল, সিঁদুরের মতো তার ঠোঁট, আমাকে দেখে বলে মিউ; তারপর লাফিয়ে বুকে উঠে জড়িয়ে ধরে আমাকে। রাশেদ মৃদুর চোখের ভেতরে বিড়ালিকে দেখতে পায়, যে-বিড়ালিকে আগে সে কখনো। দেখে নি, যাকে সে এইমাত্র মৃদুর জন্যে সৃষ্টি করেছে। রাশেদ যখন গল্প শুরু করেছিলো তখন বিড়ালিটিকে সে দেখে নি, ওটি ছিলো এক প্রাণীর নাম; মৃদুর মুখের, চোখের, ভুরুর, ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে সে রহস্যের মতো দেখতে পায় একটি শাদা বিড়ালিকে, যার ঠোঁট মেরেলিন মনরোর ঠোঁটের মতো লাল, যার শরীরের স্পর্শ সিল্কের স্বাদে পরিপূর্ণ। বিড়ালি রাশেদের সাথে ঘরে ঢোকে, ঢুকেই লাফিয়ে টেবিলে ওঠে, লাল ঠোঁটে ডাকতে থাকে মিউ মিউ। মৃদু চোখ এমনভাবে বড়ো করে যেন সে দেখতে পাচ্ছে। বিড়ালিকে, যে তার আব্বুর টেবিলে বসে মিউ মিউ ডাকছে, মৃদুর একটু ঈর্ষাও লাগছে, সে কোনোদিন আব্বুর ঘরে যায় নি, গিয়ে টেবিলে বসে নি। তারপর বিড়ালি কী করলো, জানতে চায় মৃদু। রাশেদ বলে, এমন সময় এক ছাত্রী দরোজায় এসে বললো, আসি স্যার? একটি ছাত্রী এসেছে শুনে মৃদু খুব সংকটে পড়লো, বললো, হায়, ছাত্রী এসে গেছে? বিড়ালির কী হবে? সে কোথায় যাবে? সে তো আর পড়তে জানে না! রাশেদ বলে, না না, বিড়ালি খুবই পড়তে জানে, বড়ো বড়ো বই পড়ে, কবিতা তার খুবই পছন্দ। মৃদুর বিস্ময়ের সীমা থাকে না, আনন্দে পাত’-র মতো কাঁপতে থাকে; বলে, বিড়ালি কবিতা পছন্দ করে, বড়ো বড়ো বই পড়ে! বাঁশবগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই? কী কবিতা পছন্দ করে সে? অনেক কবিত, তার মুখস্থ? রাশেদ মৃদুকে গল্প বলতে থাকে, আর পেরিয়ে যায় নষ্ট নগর, অনেক দূর চলে যায়, দেখে কচুরিপানার ভেতরে একটি হাঁসের পাশে পাশে সে সাঁতার কাটছে, ঘাসের ওপর শুয়ে জড়িয়ে ধরে আছে একটি ছাগশিশুকে, প্রজাপতি উড়ছে, ঘাসের গন্ধে তার বুক ভরে উঠছে। মেঘের মতো ঠাণ্ডা মসৃণ কচুরিপানার পাতা তার গালের সাথে লেগে আছে। নতুন পানিতে। পুকুর ভরে গেছে, লাল আলপনা আঁকা পুঁটিমাছের ঝাক একবার এদিকে আরেকবার। ওদিকে লাফিয়ে চলছে; পুকুরের পানিতে একটু নামতেই রাশেদকে ঘিরে লাফাতে শুরু করে চঞ্চল রঙিন পুঁটির ঝাঁক।
রাশেদ একটি খাল দেখতে পায়, খালের ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে ঘোলা জলের তীব্র কাটাল, ছুটে চলছে পদ্মার বালুকণা। ঘোলা জল মানেই পদ্মা, খালের ভেতর দিয়ে ছুটলেও পদ্মা, আর ঘোলো মাইল পাশ ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে ছুটলেও পদ্মা। রাশেদের কেনো শুধু মামাবাড়ি যেতে ইচ্ছে করতো, মৃদু তো একবারও মামাবাড়ির কথা বলে না। ওর মামা নেই বলে? ওই গ্রামটি খুব পছন্দ ছিলো রাশেদের, কেননা ওখানে ওর মামাবাড়ি; আর ওই গ্রামের নরম বেলেমাটি, চাঁদের জন্যে পাগল বাশবন, পদ্মার ইলিশের জন্যে উন্মান লেবুবন তাকে টানতো, বর্ষা এলে তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যেতো কাটালভরা ভাল। পদ্মা থেকে একেকটি খাল বেরিয়েছে, শুকনো কালে তাতে। কোনো পানি থাকতো না, কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই পদ্মানদী প্রচণ্ডভাবে ঢুকে পড়তে খাল দিয়ে, আর খাল উপচে খেত পালান কোলার ভেতর দিয়ে। খালের পানি ঘোলা, পদ্মার পানির মতোই, ওই পানি খালের দুপাশ কাঁপিয়ে বইতে বিলের দিকে। বিল। ছিলো খালের সমুদ্র। খালের কাটাল ছিলো প্রচণ্ড, আখের পাতার মতো ধার, মনে হতো খালের দুপাশ-বেতঝোঁপ, লেবুজাম্বুরা কলার ঝাড়, নারকেল শুপুরির সারি কেটে কেটে টেনে টেনে নিয়ে যাবে বিলের ভেতরে। কাটাল উজিয়ে নৌকো বাওয়া ছিলো যেমন কষ্টের তেমনি উত্তেজনার, নৌকো একবার ডানে বেঁকে যেতো আরেকবার বাঁকতো বায়ে, ডানে বেঁকে গিয়ে লাগতো বাঁশঝাড়ে বায়ে বেঁকে গিয়ে লাগতো বেতঝোপে, উঠতে থাকতো ঘোলাজলের শোঁ শোঁ শব্দ। রাশেদ অবশ্য মামাবাড়ি গেলে ওই আট বছর বয়সে নৌকো বাইতে পেতো না, বাওয়ার সাহসও হতো না, নৌকোয় উঠলে নৌকোর গুরা শক্ত করে ধরে থাকার উত্তেজনাই তার ভালো লাগতো; তবে তার সুখ লাগতো কলাগাছের ভেলা বাইতে। ওই গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে নৌকো ছিলো না, নৌকোর দরকারও পড়তো না, তবে কলাগাছের ভেলা থাকতো সবারই; তার মামাতো ভাইটিরও একটি ভেলা ছিলো। কলাগাছের ভেলায় উঠতেই কেমন যে সুখ লাগতো, পায়ের তলাটা সব সময় পিচ্ছিল থাকতো, একটু এদিক ওদিক হলেই উল্টে পানিতে পড়ে যেতে হতো, জড়িয়ে ধরে থাকতে হতো ভেলা, তারপর বুক দিয়ে বেয়ে বেয়ে। উঠতে হতো ভেলায়। যখন খুব ছোটো ছিলো রাশেদ তখনো তার ভেলায় উঠতে খুব ইচ্ছে হতো, কিন্তু তাকে উঠতে দেয়া হতো না সে সাঁতার জানতো না বলে। পিছলে খালের কাটালে পড়লে রক্ষা নেই। সে-বছর সে সাঁতার শিখেছে, অনেকটা শিখেছে, ঘাট থেকে সাঁতরে কিছু দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। দুজোড়া নারকেল। জড়িয়ে ধরে সে সাঁতার শিখেছে, তাদের পাশের বাড়ির এক বুড়ো সাঁতার শিখিয়েছে। তাকে; তার মনে হয়েছে মাটি এতোদিন যেমন তার পায়ের নিচে ছিলো এবার পানিও তার বুকের নিচে। সঁতার শেখা হচ্ছে পানিতে হাত আর বুক দিয়ে হাঁটতে শেখা। এখন সে পানিতে হাঁটতে শিখেছে।
মদুর নায়িকা বিড়ালি এবার লাফ দিয়ে রাশেদের টেবিল থেকে গিয়ে পড়ে ছাত্রীটির কোলে, জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ঘষতে থাকে তার গালে নাকে কানে; খিলখিল করে ওঠে মৃদু, কী দুষ্ট কী দুষ্টু! বিড়ালির ঠোঁটের রেভলন লেগে ছাত্রীটির গাল গোলাপের মতো লাল হয়ে ওঠে, নাক লাল হয়ে ওঠে, কান লাল হয়ে ওঠে। রাশেদ যতোই বর্ণনা দিতে থাকে, ততোই খিলখিল করে ওঠে মৃদু; রাশেদও বাড়াতে থাকে বর্ণনা, বলে বিড়ালি, ছাত্রীটির গলায় ঠোঁট ঘষতে থাকে, ঠোঁট ঘষতে থাকে, ঠোঁট ঘষতে থাকে, বিড়ালির ঠোঁট থেকে আলতার মতো গল গল করে বেরোতে থাকে লিপস্টি, মেয়েটির গলা গোলাপের মতো লাল হয়ে ওঠে। মেয়েটি ঘুমিয়েই পড়ে, স্বপ্ন দেখে সে গোলাপ হয়ে গেছে। মৃদু অবাক হয়, চোখে একটা বড়ো গোলাপ দেখতে পায়; তারও যেনো ইচ্ছে করে গোলাপ হ’তে। মৃদু জানতে চায়, তার জামা, শাড়ি? রাশেদ বলে, তার ব্লাউজ। আগে কেমন ছিলো তা তো দেখি নি, তবে বাতাসে শাড়ি একটু উড়তেই দেখি তার। ব্লাউজ গোলাপের পাপড়ির মতো লেগে আছে তার গায়ে, আর শাড়িও হয়ে গেছে। গোলাপের পাপড়ি। ওই গোলাপের গায়ে ঝুলে আছে শাদা বিড়ালি। এমন সময় বিড়ালি মিউ বলতেই মেয়েটি চোখ মেলে তাকায়, জিজ্ঞেস করে, আমি কোন বাগানে ফুটেছি? আবার সে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে, চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতে চায়; বিড়ালি তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে, মাথাটি দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দেয়। মেয়েটির শরীর থেকে সুগন্ধ বেরোতে থাকে, সুগন্ধে সারা ঘর ভরে যায়। সে-গন্ধে, রাশেদ বলে, আমার ঘরের দরোজায় ভিড় জমে যায়; মনে হয় দেশের সব মানুষ এসে বলছে, আপনার ঘরে একটা গোলাপ ফুটেছে, তার গন্ধে সারা দেশ ভরে গেছে, আমরা গ্রাম থেকে ধান খেত থেকে নদীর ঢেউয়ের ওপর থেকে দূরের শহর থেকে শহরের গলি থেকে গোলাপটিকে দেখতে এসেছি। মৃদু নির্বাক হয়ে আছে, তার খিলখিল হাসি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক। আগেই, বিস্ময়ে সেও ঘুমিয়ে পড়তে চায়; এক সময় সে জানতে চায়, তুমি কি তাদের ওই গোলাপ দেখালে? ওই গোলাপ কি দেশের সবাইকে দেখানো যায়? ওই গোলাপ কি বিক্রির জন্যে যে সবার চোখের সামনে তাকে মেলে ধরতে হবে? রাশেদ অবশ্য ঠিক করতে পারছে না সে গোলাপটিকে সকলকে দেখাবে কী দেখাবে না, মৃদু কোনটা পছন্দ করবে? মৃদু নিশ্চয়ই চাইবে গোলাপটি আর কেউ দেখতে পাবে না, শিশুরা সুন্দরকে নিজের জন্যেই রেখে দিতে চায়, মৃদুও চাইবে তাই; গোলাপটি সকলের হয়ে উঠলে। তার ভালো লাগবে না।
সাঁতার শিখেছে রাশেদ, এবং প্রথম সাঁতার শেখার পর মনে হয় যেন সব সময়ই পানিতে রয়েছি, বাতাসকে মনে হয় পানি, বিছানাকে মনে হয় পানি, শরীর সব সময়। সাঁতার কাটতে থাকে; রাশেদের ভেতরে রক্তের কণাগুলো সারাক্ষণ সাঁতার কাটছে, সব কিছুকেই জল মনে হচ্ছে আর লাফিয়ে পড়ছে, নাকে পানি ঢুকছে, চোখ লাল টকটক করছে, সে সাঁতার কেটে চলছে। সাঁতার শেখার পর মামাবাড়ি গেছে এই প্রথম, গেছে। নৌকোয় চেপে, কিন্তু যাওয়ার সময় মনে হয়েছে সাঁতার কেটে যাচ্ছে; তার গায়ে লাগছে আউশধানের ধারালো পাতা, গা খশখশ করছে, লাগছে কলমিলতা, দলঘাস, ধনচে। মামাবাড়ির খাল দিয়ে ছুটে চলছে ঘোলা কাটাল; খাল উপচে ঘোলা জল বয়ে চলছে পালানের কচুর ঝোঁপ, আর পাটচারা কাঁপিয়ে। ঘোলা জলে ঘুমিয়ে থাকার মতো পড়ে আছে কলাগাছের ভেলাটি। দুপুরের পর সে কলাগাছের ভেলাটিতে গিয়ে উঠলো। লগি দিয়ে ভেলা বাইতে গিয়ে সুখে ভরে গেছে তার শরীর; কচুঝোঁপের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় পাতাগুলো আস্তে আস্তে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, শিরশির শব্দ হচ্ছে, একটা ছিনেঝোঁক পানিতে লাফিয়ে পড়লো। লেবুপাতার গন্ধ পাচ্ছে সে, লেবুপাতার গন্ধ পেলে সে ইলিশের গন্ধও পায়, ভেলাটি একটু বেকে লেবুঝোপে ঢুকে পড়লো, বেশি। ঢোকে নি, ঢুকলে কাঁটায় আটকে যেতো। এখানে পানিতে কাটাল কম, একটু পরেই খাল। রাশেদ জোরে লগি মারতেই ভেলাটি খালে গিয়ে পড়লো, স্রোতের ধাক্কায় গোত্তা খেলো ঘুড্ডির মতো, রাশেদ চেষ্টা করলো লগি মেরে ভেলাটিকে সোজা করতে, কিন্তু। সেটি চরকির মতো ঘুরে কাত হয়ে গেলো। ধাক্কায় পিছলে রাশেদ ভেলা থেকে ছিটকে পানিতে গিয়ে পড়লো, প্রচণ্ড কাটাল তাকে অজগরের মতো টেনে সামনের দিকে ভাসিয়ে নিতে চাইলো। পানিতে পড়েই তলিয়ে গিয়েছিলো রাশেদ, ঘোলা পানিও খেয়েছে অনেকখানি, রাশেদ খালের মাটিতে পা চাপ দিয়ে দু-হাত উঁচু করে ভেসে উঠে ভেলা ধরতে গিয়েই দেখলো ভেলাটি কাটালের টানে অনেকখানি এগিয়ে গেছে, পাতার। মতো ঘুরতে ঘুরতে কাঁপতে কাঁপতে বিলের দিকে চলছে, রাশেদ আর তাকে পাবে না। রাশেদ আবার পানিতে ডুবে গেলো, ডোবার সময় তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সিরাজের মুখ, সিরাজ, যে গত বছর এখালেই ডুবে মারা গেছে, মরতে যার ভয়। লাগতো, যে তার মতোই ভেলায় উঠতে পছন্দ করতো বলে মামাবাড়ি বেড়াতে আসতো, যে আর ভেলায় উঠবে না। না, আমি মরতে চাই না, আমি মরবো না, আমি আবার মামাবাড়ি বেড়াতে আসবো, মামীর হাতে দুধভাত খাবো, মনে মনে চিৎকার করতে করতে রাশেদ পানিতে ডুবে গেলো, পা দিয়ে সে খালের তলা খুঁজতে চেষ্টা করলো, এবং তলায় পা লাগতেই দু-পা দিয়ে ঠেলা দিয়ে পানির ওপর ভেসে উঠলো। তাকে কি কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কেউ কি দেখতে পাচ্ছে না সে তলিয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
খুব অস্বস্তিতে পড়েছে মৃদু, যদি দেশের সব লোক এসে গোলাপটিকে দেখতে পায়, তাহলে গোলাপটির কী হবে? সে কোনো কথা বলছে না, তার চোখ এমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে যে বোঝা যায় সে চায় না কেউ গোলাপটিকে দেখুক। ওই গোলাপ শুধু মৃদুর হয়ে থাক, শুধু আব্বর হয়ে থাক। রাশেদ বললো, আমি দরোজায় গিয়ে দেখি কোনো মানুষ নেই, গ্রাম থেকে কেউ আসে নি শহর থেকেও আসে নি কেউ ধানখেত থেকেও কেউ আসে নি নদী থেকেও কেউ আসে নি, শুধু আমার দরোজায় বসে আছে একটি নীল। পায়রা। চমকে উঠলো মৃদু, খুশিতে তার চোখমুখ ভরে উঠলো; মৃদু জানতে চাইলো, পায়রাটি কি ঢুকলো তোমার ঘরে? রাশেদ বললো, হুঁ, আমি পর্দা সরাতেই পায়রাটি নীল মেঘের টুকরোর মতো ভাসতে ভাসতে আমার ঘরে ঢুকলো, বসলো আমার। টেবিলে, বসতেই আমার টেবিলে গজিয়ে উঠলো সবুজ ঘাস, সেখান থেকে একটা। প্রজাপতি উড়ে গিয়ে মেয়েটির মাথায় গিয়ে চুপ করে বসে রইলো। বোঝাই গেলো না যে ওটি প্রজাপতি, ওটি সোনার প্রজাপতি হয়ে গেলো। মেয়েটি ঘুমের মধ্যেই একবার হাত দিয়ে চুল থেকে কাটার মতো খুললো প্রজাপতিটিকে, ডান হাত থেকে বাঁ হাতে। নিলো, আবার ডান হাতে নিলো, তারপর নিজের গালে ঘষে প্রজাপতিটিকে সে পরিয়ে দিলো তার বুকে ঘুমিয়ে থাকা বিড়ালির মাথায়। মৃদু চুপ হয়ে গেছে, বিড়ালি গোলাপ-মেয়ে পায়রা ঘাস প্রজাপতি তাকে ঘিরে ফেলেছে, সে যে উফুল্ল হয়ে খিলখিল করে উঠবে, সে-চেতনাও তার নেই, এতো স্বপ্ন একসাথে এসে উপস্থিত হয়েছে তার চোখের সামনে যে এখুন সে পারে শুধু ঘুমিয়ে পড়তে। রাশেদ দেখতে পায় মৃদুও। অনেকটা ওই গোলাপ-মেয়ে হয়ে গেছে, তার কোলে ঘুমিয়ে আছে বিড়ালি, বিড়ালির মাথায় সোনার প্রজাপতি, ঘুমিয়ে পড়ছে মৃদু। ঘুম থেকে জেগে উঠলে আবার মনে পড়বে তার বিড়ালিকে, গোলাপ-মেয়েকে, পায়রাকে, প্রজাপতিকে, তখন জানতে চাইবে তারা কোথায়?
রাশেদকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, রাশেদও দেখতে পাচ্ছে না কাউকে, তার মগজ জুড়ে আকাশফাড়া বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিচ্ছে সিরাজ, যে ভেলা ভালোবাসতো, যে গতবছর ভেলা থেকে পড়ে গিয়েছিলো, যাকে কেউ দেখতে পায় নি, যে ভেসে। উঠেছিলো বিলের ধানখেতে, সন্ধ্যার পর যাকে খুঁজে পেয়েছিলো গ্রামের লোকেরা। রাশেদ ভেসে উঠেই একটা লেবুর ডাল ধরলো, ডালটি ভেঙে রয়ে গেলো তার। মুঠোতেই, সে আরো অনেকখানি পানি খেলো, একবার সাঁতরাতে গিয়ে উল্টে গেলো, এবং তলিয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো সে সমুদ্রে পড়ে গেছে, একটা বড়ো মাছ হাঁ করে আসছে, কী মাছ সে বুঝতে পারলো না, মনে হলো সে ঢুকে যাচ্ছে মাছের পেটে, অনেক আগে কে যেনো ঢুকে গিয়েছিলো মাছের পেটে, তার মতো সে ঢুকে যাচ্ছে মাছটির পেটে, যেখানে সে আটকে থাকবে, কোনোদিন বেরোতে পারবে না, মাছ তাকে পেটের ভেতরে নিয়ে এই সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রের দিকে চলে যাবে। মায়ের মুখ। তার মনে পড়লো একবার, সে-মুখ মায়ের কিনা সে বুঝতে পারলো না, দেখতে পেলো একটা লাটিম খড়ের গাদার নিচে লুকিয়ে আছে, একটা জাম্বুরার ফুটবল গড়িয়ে চলছে পুকুরের দিকে, তার হাত অবশ হয়ে আসছে, পা দিয়ে খালের তলা খুঁজতে গিয়ে তলা খুঁজে পাচ্ছে না, তার পৃথিবীতে কোনো বাতাস নেই, তাকে ঘিরে আছে মহাজল। মহাজগত মহাজল হয়ে তাকে ঘিরে ধরেছে। সে কী মরে যাবে, ভেলা থেকে পিছলে পড়ে মরে যাওয়ার জন্যে সে এতো ভালোবাসতো মামাবাড়ি আসতে, এতো। ভালোবাসতো বেলেমাটি, মরে যাওয়ার জন্যেই সে এমনভাবে বেড়ে উঠেছিলো? খালের তলায় রাশেদের পা ঠেকেছে, একটু সুখ লাগলো তার, মাটির ছোঁয়া লাগলে যেমন সুখ। লাগে; পা দিয়ে চাপ দিয়ে সে ভেসে উঠলো, তাকে ভেসে উঠতেই হবে, সে সিরাজ হবে না, সে ধানখেতে ভেসে উঠবে না, সন্ধ্যার পর গ্রামের লোকের অপেক্ষায় সে ধানখেতে ভাসবে না, সে খালের পাড়ে উঠবে, হেঁটে একা মামাবাড়িতে ফিরবে, তারপর বাড়ি যাবে। ভেসে উঠলেও ঘুরপাক খাচ্ছে রাশেদ, ধরার মতো কিছুই পাচ্ছে না হাতের কাছে, সে একবার সাঁতরানোর কথা ভাবলো, তারপর চিৎ হয়ে ভাসতে চেষ্টা করলো, কাটাল তাকে চিৎ হ’তে দিচ্ছে না, তবে তাকে চিৎ হতেই হবে, চিৎ হতেই হবে। তাকে। চিৎ হতে গিয়ে একটা প্রচণ্ড কাটাল তাকে টান দিলো, রাশেদ ঘুরপাক খেয়ে খালের পাশে লেবুঝোঁপের ভেতরে ঢুকে আটকে গেলো, সে একটা লেবুগাছের গোড়া ডান হাত দিয়ে শক্ত করে ধরলো। আমি বেঁচে আছি, ভাবলো রাশেদ, বেঁচে থাকবো; . কিছুক্ষণ সে শুয়ে রইলো লেবুঝোঁপের ভেতরে, শুয়ে থাকতে এতো ভালো লাগলো তার যেমন ভালো আর কখনো লাগে নি, মায়ের কোলে শুয়েও লাগে নি, কোনোদিন লাগবে না। কারা যেনো নৌকো বেয়ে যাচ্ছে, কাটাল উজিয়ে যাচ্ছে, শো শো শব্দ হচ্ছে; রাশেদ। চাইছে তারা যেনো তাকে দেখতে না পায়। কিছুক্ষণ আগেও রাশেদ চাইছিলো কেউ। তাকে দেখুক, গ্রামের সবাই তাকে দেখুক; এখন মনে হলো কেউ যেনো তাকে দেখতে না পায়, সে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকবে লেবুঝোঁপের ভেতরে, তাকে দেখুক শুধু এই লেবুঝোঁপ, যে তাকে বাঁচিয়েছে, আর সে দেখবে লেবুঝোঁপকে। কেউ যেনো না জানে। সে পানিতে পড়ে গিয়েছিলো, সবাই জানুক সে কখনো পানিতে পড়ে নি, সবাই জানুক সে সাঁতার জানে।
গিয়ে দেখি, রাশেদ শুরু করে, আমার ঘরের দরোজায় গোলাপ-মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেনো সে ওখানেই ফুটেছে, আর ভেতরে রুমঝুম নূপুরের শব্দ হচ্ছে, নাচছে কে যেনো ঘরের ভেতরে, শব্দ উঠছে রুমঝুম রুমঝুম। মৃদু চঞ্চল হয়ে ওঠে, কে নাচে কে নাচে? তোমার ঘর বন্ধ ছিলো না? রাশেদ বললো, ঘর তো বন্ধ করেই এসেছিলাম, কিন্তু তাতে কীভাবে যেনো এক নর্তকী ঢুকে যায়, আর ওই নর্তকী যে কে তা তো আমি জানি না। আচ্ছা, আমি কি আমার ঘর খুলবো? মৃদু বেশ বিপদে পড়ে যায়, রাশেদও ঠিক একই বিপদে, ঘর খুললে যদি নাচ বন্ধ হয়ে যায়? রাশেদ বললো, আমি মনে করেছিলাম নাচের শব্দ শুধু আমি একাই শুনছি, আর কেউ শুনছে না, কিন্তু গোলাপ-মেয়েটি বললো, স্যার, আপনার ঘরে কে যেনো নাচছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমিও নাচের শব্দ শুনছো? সে বললো, জি স্যার, আমিও শুনছি, তবে আর কেউ শুনছে না, শুনলে তারাও দাঁড়াতো। মৃদু বললো, আব্ব, মেয়েটির তো অনেক বুদ্ধি, সে বুঝতে পারলো, তুমি তো বুঝতে পারলে না। রাশেদ বললো, মেয়েরা এমনিই খুব বুদ্ধিমান, যেমন তুমিও বুদ্ধিমান, আমার থেকে তুমিও তো আগে বুঝে ফেলো কখন তোমার আম্মা ফিরবে। রাশেদ বললো, গোলাপ-মেয়েটির দিকে। তাকিয়ে আমি অবাক হলাম, খেয়ালই করি নি প্রথমে, পরে খেয়াল করে দেখি সে শাড়ি পরে আসে নি;-শুনে মৃদু চোখ বড়ো করলো,-রাশেদ বললো, দেখি সে জিন্স পরে এসেছে, নীর রঙের, আর পরেছে লাল টুকটুকে গেঞ্জি, তাকে গোলাপ, ঠিক গোলাপ বলেই মনে হলো। মৃদু চমকে উঠলো, ভালোও লাগলো তার আবার অস্বস্তি। লাগলো, বললো, মেয়েরা জিন্সও পরে? রাশেদ বললো, কেনো, তুমি তো পরেছে। কে যেনো মৃদুর ভেতরে উত্তরটা আগেই ঢুকিয়ে রেখেছে, যেমন প্রশ্নটাও ঢুকিয়ে রেখেছিলো, বললো, আমি তো ছোটো, ছোটোরা জিন্স পরে, বড়ো হলে মেয়েরা শাড়ি পরে। সামাজিক ব্যাকরণের অনেক প্রত্যয়বিভক্তি এরই মাঝে ঢুকে গেছে মৃদুর ভেতরে। রাশেদ বললো, জিন্সে গোলাপ-মেয়েকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছিলো, শাড়ির থেকে অনেক সুন্দর, হাতে তুলে নিয়ে ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। সে বললো, এমন মিষ্টি নাচের শব্দ আগে কখনো শুনি নি, মনে হয় এমন যে নাচতে পারে তাকে চোখে দেখা যাবে না, কিন্তু তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। রাশেদের রূপকথার প্রতিটি শব্দ সত্য বলে মনে হচ্ছে মৃদুর, এমনকি রাশেদেরও তা সত্যি মনে হচ্ছে, যেনো সত্যিই তার ঘরে নাচছে কেউ, তার দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে গোলাপ-মেয়ে। রাশেদের দরোজা খুলতে ইচ্ছে। করছে না, দরোজায় দাঁড়িয়ে শুধু নাচের শব্দ শুনতেই ভালো লাগছে তার; কিন্তু মৃদুর ইচ্ছে হচ্ছে নর্তকীকে দেখার। বললো, আলু, দরোজা খোলো, কে নাচছে দেখি। রাশেদ বললো, দরোজা খুলে দেখি নাচছে বিড়ালি।
পাশের বাসার কাজের মেয়েটির একবার চিৎকার আজ রাতেও শুনেছে রাশেদ, দু-এক রাত পরপরই মধ্যরাতে হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে, একবার, তারপর আর কিছু শোনা যায় না। ওর চিৎকারটা বিদ্যুতের মতো, হঠাৎ ঝিলিক দেয়, পরমুহূর্তে তার কোনো চিহ্ন থাকে না, কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, কিছুক্ষণ ধরে তার গর্জন চলতে থাকে শুধু রাশেদের মনে। মেয়েটির দুঃস্বপ্ন দেখার রোগ আছে? পাশের বাসার ভদ্রলোকের সাথে রাশেদের মাঝমাঝেই দেখা হয়, বেরোনোর বা ফেরার সময়; তিনি গাড়িতে যান গাড়িতে আসেন, রাশেদের থেকে বছর পনেরোর বড়ো হবেন, মুখে গাল ঘেঁষে যত্নে কামানো দাড়ি; তার বউর মুখে দাড়ি নেই, থাকতে পারতো, খুব ধার্মিক মহিলা, দুজনেই হজ করেছেন, ফিরে ভদ্রমহিলা স্ত্রীলোকদের একটি সাপ্তাহিকে ‘কাবার আলো’ নামে একটি ভ্রমণকাহিনী লিখছেন, যাতে স্বামীর পায়ের নিচে সুন্দর সুন্দর। বেহেস্ত তিনি বানিয়ে চলছেন, দুজনেই ইনশাল্লাহ্ ছাড়া কথা বলেন না, ছেলেমেয়েরা সবাই বিলেত বা সুইডেন বা আমেরিকা বা ইরানে, কী আশ্চর্য তাদের বাসার কাজের মেয়েটি মাঝরাতে একবার চিৎকার করে ওঠে, তারপর আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। রাশেদেরও এমন বদভ্যাস গোলাগুলিতে ঘুম ভাঙে না, ঘুম ভেঙে যায় পাশের। বাড়ির কাজের মেয়ের একবারের চিৎকারে, তারপর ঘুম আসতে কষ্ট হয়। অবশ্য কষ্টটা রাশেদের ভালো লাগে; বছরের পর বছর ধরে তার এতো ঘুম হচ্ছে যে মনে হচ্ছে সে গাধা হয়ে যাচ্ছে, যখন সে সিংহ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো তখন রাতের পর রাত ঘুম হতো না, এখন কাজের মেয়েটির চিৎকারেও ঘুম ভেঙে গেলে তার ভালো লাগে একথা ভেবে যে সে বেঁচে আছে। মেয়েটিকে কি সে ধন্যবাদ জানাবে যে নিজে মরে গিয়ে মাঝেমাঝে রাশেদকে সে বাঁচিয়ে তুলছে? কাল ভোরে দ্রলোককে খুব প্রফুল্ল দেখাবে, কাজের মেয়েটির চিৎকারের রাতের পর দিন দ্রলোক খুব প্রফুল্ল থাকেন, দাড়িটা ধারালো করে ছাঁটেন, ওই দিন তার স্ত্রীকে একবারও বারান্দায় দেখা যায় না। গাড়িতে বাইরে যাওয়া আর আসা, আর সম্ভবত ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়া মহিলার কোনো কাজ নেই, আল্লা তাঁকে ঠিক পায়ের নিচেই রেখেছে, কিন্তু আগামী কাল তিনি বেরোবেন না, তার মক্কা থেকে আনা ঘোমটাটা দেখা যাবে না। কাজের মেয়েটিকে বারান্দায় দেখা। যাবে দু-একবার, তার মুখটা বিষণ্ণ দেখাবে ভরাটও দেখাবে। শুকুরজানকে আর দেখা গেলো না কেনো? অনেক বছর ধরেই রাশেদের অন্তত আরেকবারের জন্যে দেখতে ইচ্ছে করে শুকুরজানকে, সেও কি রাতে একবারের জন্যে চিৎকার করে উঠতো? না, শুকুরজান চিৎকার করে ওঠার মতো ছিলো না। খা-বাড়ির বান্দী শুকুরজান তাদের গ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত যুবতীই ছিলো, শরীরে রূপে শক্তিতে সাহসে; পথ দিয়ে যখন সে হাঁটতে পুরুষরা দূর থেকেই ভয় পেতে শুরু করতো। রাত্রির থেকেও মধুর ছিলো তার কালো রঙ, এমন কালো আর দেখে নি রাশেদ, শরীর ছিলো মূর্তির মতো, তার হাঁটার সময় মাটি কাঁপতো। শক্ত করে পেঁচিয়ে কাপড় পরতো, দুধ দুটি খড়ের গাদার মতো উঁচু হয়ে থাকতো; মনে হতো মাঝখানে লুকিয়ে থাকলে কেউ দেখতে পাবে না, হাঁটার সময় ভয়ংকরভাবে কাঁপতো, তার সামনের পুরুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে পরিমাপ করা যেতো ওই কম্পনের ভয়ংকরতা। কথা বলার সময় মেঘের কণ্ঠস্বর শোনা যেতো। দেড় মণ দু-মণের ধানের ছালা সে অনায়াসে টেনে এদিকে থেকে ওদিকে নিয়ে যেতো, চাকরদের মাথায় তুলে দিতো, প্রত্যেকটা চাকর তার মুখোমুখি কুকুরের মতো দাঁড়াতো; এমনকি খা-বাড়ির পুরুষগুলোও তার সামনে কুকুর কুকুর ভাব করতো। তাদের গ্রামের পুরুষরা দিনে অন্তত একবার যদি দূর থেকেও শুকুরজানকে দেখতে না পেতো, তাহলে বাজারে যেতে স্বস্তি পেতো না, ঘাস কাটতে গিয়ে বারবার হাতে কাচির পোচ লাগতো, যুবকরা খাঁ-বাড়ির পুকুরে গোশল করতে গিয়ে পা ঘষতো বগল ঘষতে মাথা ঘষতো, কিছুতেই গোশল শেষ করতে পারতো না। সেই শুকুরজানকে আর দেখা। গেলো না। সে কি রাতে একবার চিৎকার করে উঠেছিলো? না, শুকুরজান চিৎকার। করে ওঠার মতো মেয়ে ছিলো না। এই মেয়েটি আর কতো রাত চিৎকার করে উঠবে?