ঘুম ভাঙলো কখন সে ঠিক বলতে পারবে না। রাতের গভীর অন্ধকারে সে অনুভব করলো একটা হাত তার চুলগুলো নিয়ে খেলছে। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো মন্তু।
গনু মোল্লার কাছ থেকে নেয়া তাবিজটা বাহুতে বাধা আছে কিনা দেখলো। তারপরে কে যেন চাপা স্বরে ওকে ডাকলো, এই। সহসা কোন সাড়া দিলো না মন্তু।
হঠাৎ ওর হাতখানা শক্ত মুঠোর মধ্যে চেপে ধরলো সে। নরম তুলতুলে একখানা হাত।
একটা অস্পষ্ট কাতরোক্তি শোনা গেল, উঃ এই।
পরমুহূর্তে হাতখানা ছেড়ে দিলো মন্তু। টুনি?
ইস, কথা কয়ো না। মায় হুব। ওর মুখের ওপরে একখানা হাত রাখলো টুনি। তারপর মুখখানা আরো নামিয়ে আস্তে আস্তে করে বলো, চুপ, শব্দ কইর না। শোন, চুপচাপ উইঠা আইও আমার সঙ্গে।
কিছু বুঝে উঠতে পারলো না মন্তু। টুনির মুখের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ও। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। একটু পরে টুনির পিছু পিছু বাইরে বেরিয়ে এলো মন্তু।
বাইরে এসে দেখলো টুনির হাতে একষ্টা মাটির কলস। শীতে দুজনে রীতিমত কাপছিলো ওরা।
মন্তু প্রশ্ন করলো, কি, কি অইছে?
টুনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, কিছু অয় নাই, এদিকে আইও। ওর একখানা হাত ধরে অন্ধকারে টেনে নিয়ে চললো তাকে। বার বাড়িতে এসে মন্তু আবার প্রশ্ন করলো, কই চললা।
টুনি শব্দ করে হাসলো আবার, বললো, কলসি গলায় দিয়া দুইজনে পুকুরে ডুইবা মরুম চল। তার পরেই মন্ডুর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সহসা প্রশ্ন করল সে, আমার সঙ্গে মরতা পিরবা না?
কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না মন্তু। কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার হেসে উঠলো টুনি হাসির দমকে দেহটা বারবার দুলে উঠলো তার। বললো, ঘাবড়ায়গা না মিয়া তোমারে মারুম না। বলে আবার চলতে লাগলো সে।
এতক্ষণ এত অবাক হয়ে গিয়েছিলো মন্তু যে শীতের প্রকোপটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি। বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতে না যেতে প্রচণ্ড শীতে দাঁতে দাতে লেগে এলো ওর।
একটা লম্বা খেজুর গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো টুনি। কলসিটা মন্তুর হাতে দিয়ে বললো, এইটা রাখ হাতে।
তারপর পরনের শাড়িটা লুঙ্গির মতো গুটিয়ে নিল সে। মন্তু কাঁপা গলায় শুধালো কি কর?
ওর প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না টুনি। নির্বিকারভাবে খেজুর গাছটা বেয়ে উপরে উঠে গেলে সে।
মন্তুর মনে হলো ও স্বপ্ন দেখছে।
একটু পরে হাতে রসের হাড়িটা নিয়ে অন্য হাতে গাছ বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো টুনি। কলসির মধ্যে রসটা ঢেলে হাঁড়িটা রেখে আসবার জন্য আবার উপরে যাচ্ছিলো টুনি। মন্তু বললো, আরে কি করো। গাছ এখন পিচ্ছিল। পইড়া যাইবা।
পেছনে ফিরে তাকিয়ে হাসলো টুনি। বললো, ইস কত উঠছি। পাশের ঝােপ থেকে দুটো শিয়াল ছুটে এসে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে মন্তুর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখজোড়া অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে ওদের। মন্তু একটা ধমক দিতে ছুটে পালিয়ে গেল ওরা।
টুনি নেমে এসে বললো, কারে ধমকাও?
মন্তু আস্তে করে বললে, শিয়াল।
আরো অনেকগুলো খেজুরগাছ থেকে রস নামিয়ে কলসি ভর্তি করলো ওরা। শীতের রাতে কুয়াশার বৃষ্টি ঝরছে চারদিকে। মাটি ভিজে গেছে। গাছের পাতাগুলোও ভেজা। আশেপাশে তাকাতে গেলে বেশি দূরে দেখা যায় না। কুয়াশার আবরণে ঢেকে আছে চারদিক। হঠাৎ মনুর গায়ে হাত দিয়ে টুনি বললো, শীত লাগছে বুঝি? মন্তু কোন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, তোমার লাগে না?
টুনি বললো, উঁহু। বলে মাথাটা দোলাল সে।
মন্তু বললো, রস দিয়া করবা কি?
টুনি বললো, সিন্নি রান্দুম।
মন্তু কোন কথা বলার আগেই টুনি আবার বললো, তোমার নায়ে চল।
মন্তু অবাক হলো, নায়ে গিয়া কি করবা?
টুনি নির্লিপ্ত গলায় বললো, সিন্নি রান্দুম।
মন্তু বললো, পাগল হইছ?
টুনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, হুঁ। বলে মন্তুর মুখের দিকে তাকালো সে, কই নাওয়ে যাইবা না?
মন্তু কঠিন স্বরে বললো, না।
ওর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলো টুনি। ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তে একটা অবাক কাণ্ড করে বসলো সে। হাতের কলসিটা উপরে তুলে মাটিতে ছুঁড়ে মারলো। মাটিতে পড়ে মাটির কলসি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।
রস গড়িয়ে পড়লো চারপাশে।
কিছুক্ষণের জন্য দুজনে বোবা হয়ে গেলো ওরা।
কারো মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরুলো না।
মন্তু নীরবে তাকিয়ে রইলো, ভাঙ্গা কলসির টুকরোগুলোর দিকে। টুনি মুখখানা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে অন্ধকারে পাথরের মত নিশ্চল দাড়িয়ে রয়েছে। পুকুর পাড়ে লম্বা তালগাছগুলোর মাথায় দুটো বাদুড় হঠাৎ পাখা ঝাঁপটিয়ে উঠলো।
টুনি আস্তে করে বললে, চল ঘরে যাই, চল।
মন্তু কোন কথা বললো না। নিঃশব্দে একে অনুসরণ করলো শুধু।
পরদিন যাওয়া হলো না মন্তুর।
টুনির মা বললো, কুটুমবাড়ি আইয়ে নিজের ইচ্ছায়, যায় পরের ইচ্ছায়। ইচ্ছা করলেই তো আর যাইতে পারব না মিয়া। যন যাইতে দিমু তহন যাইবা। অগত্যা থেকে যাওয়া হলো।
সারাদিন একবারও কাছে এলো না টুনি। অথচ সারাক্ষণ বাড়িতে ছিল সে। ঘরদোর ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করেছে। ঘাটে গিয়ে বাসনপত্র ধুয়ে এনেছে। রান্নাবান্না করেছে।
তারপর খাওয়ার সময় মা ডেকে বলছে, কইরে টুনি এই দিকে আয়। মন্তু মিয়াকে ভাত বাইড়া দে। তখন শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে থেকেছে সে।
রাতের বেলা হঠাৎ বেঁকে বসলো টুনি। বললো, কাল সক্কাল বেলাই চইলা যামু আমি।
জিনিসপত্র সব গুছাইয়া দাও।
মা বললো, আরো দুইটা দিন থাইকা যা। আবার কবে আইবার পারবি কে জানে।
টুনি বললো, না, মন্তু মিয়ার কাম কাজের ক্ষতি অইয়া যাইতেছে।
মা বললো, মন্তু মিয়াকে বুঝাইয়া কইছি। হে রাজী আছে।
টুনি তবু বললো, না, কাল সক্কালেই চইলা যামু।
পাশের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব শুনলো মন্তু।
পরদিন ভোরে রওয়ানা হয়ে গেলো ওরা।
মন্তু আর টুনি।
ওর বাবা আর চাচা দুই শিকদার খাল পাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো ওদের সঙ্গে ছোট দুই ভাইবোনও এালো। আর এলো ওদের কাল কুকুরটা।
ছই-এর মধ্যে টুনির জন্যে কথাটা বিছিয়ে দিয়েছিলো মন্তু। তার ওপর গুটিমুটি হয়ে বসলো সে।
খালের পাড়ে যতক্ষণ তার বাবা চাচা আর ভাইবোনদের দেখা গেলো ততক্ষণ সে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো টুনি।
তারপর মুখখানা ঘুরিয়ে এনে নীরবে বসে রইলো।
খাল পেরিয়ে যখন নৌকা নদীতে এসে পড়লো তখন দুপুর হয়ে আসছে।
টুনি এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি। মন্তু সারাক্ষণ কথা বলার জন্য অ্যাঁকুপাকু করছিলো। কিন্তু একবার সুযোগ দিলো না টুনি। উজান নদীতে দাঁড় বেয়ে চলতে চলতে এক সময়ে মন্তু বললো, বাইরে আইয়া বহো, গায়ে বাতাস লাগবে।
ও নড়েচড়ে বসলো কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এলো না।
একটু পরে একটা কাপড়ের পুটলি থেকে কিছু চিড়া আর এক টুকরো খেজুরের গুড় বের করে এর দিকে এগিয়ে দিলো টুনি। বললো, বেলা অইয়া গেছে-খাইয়া নাও। বলে আবার চুপ করে গেলো সে।
মন্তু বললো, তুমি খাইবা না?
না।
না কেন?
ক্ষিধা নাই।
ঠিক আছে আমারও ক্ষিধা নাই। বলে আবার দাঁড় বাইতে লাগলো মন্তু। নদীর পানিতে দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না।
ক্ষণকাল পরে টুনি আবার বললো, খাইবা না।
না।
শেষে শরীর খারাপ করবো।
করুক গা। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো মন্তু।
আর বেশিক্ষণ ছইয়ের ভেতর বসে থাকতে পারলো না টুনি। অবশেষে বাইরে বেরিয়ে এলো সে, চিড়ার বাসনটা তুলে নিয়ে ওর সামনে এসে বসলো।
নাও, খাও।
কইলাম তো খামু না।
তাইলে কিন্তু পানির মধ্যে সব ফালাইয়া দিমু আমি। টুনি ভয় দেখালো ওকে।
মন্তু নির্বিকার গলায় বললো, দাও ফালাইয়া।
কিন্তু ফেললো না টুনি। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো সে। হাসির দমকে মাথার ঘোমটাটা খসে পড়লো কাঁধের ওপর।
টুনি বললো, আমি খাওয়াইয়া দিই।
মন্তু বললো, না।
টুনি বললো, তাহলে তুমি নিজ হাতে খাও। আমিও খাই। বলে এক মুঠো চিড়ে মুখের মধ্যে পুরে দিলো সে।
মন্তুর মুখেও এক ঝলক হাসি জেগে উঠলো। এতক্ষণে টুনির কোলের ওপরে রাখা বাসন থেকে এক মুঠো চিড়ে নিয়ে সেও মুখে পুরলো।
টুনি বললো, গুড় নাও। খাজুরি গুড়।
চিড়ে খেতে খেতে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সহজ হয়ে এলো টুনি।
এক ফাঁকে ওকে জিজ্ঞেস করলো, বাড়ি পৌঁছাইতে কতক্ষণ লাগবো?
মন্তু একটু চিন্তা করে নিয়ে বললো, মাইজ রাতে।
বেশ জোরে দাঁড় বাইছিলো মন্তু।
সেই হঠাৎ টুনি বললো, এত তাড়াতাড়ি কই কেন? আস্তে বাও না।
মন্তু বললো, তাইলে বাড়ি যাইতে তিনদিন লাগবো।
লাগে তো লাগুক না। টুনির কণ্ঠরে চরম নির্লিপ্ততা।
মন্তু কোন জবাব দিলো না। ‘
আঁজলা ভরে নদীর পানি পান করলো ওরা। তারপর ছইয়ের বাইরে বসে টুনি দু’হাতে নদীর পানি নিয়ে খেলা করতে লাগলো। দু’পাশে অসংখ্য গ্রাম। একটার পর একটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ওরা। মাঝে মাঝে রবি-শস্যের ক্ষেত, নারকেল আর ঘন সুপারির বন। জেলেদের পাড়া।।
ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় চড়ে মাঝ নদীতে এসে জাল ফেলেছে ওরা।
একখানা হাত পানির মধ্যে ছেড়ে দিয়ে টুনি বললো, তুমি এইবার জিরাও।
আমি দাঁড় টানি।
মন্তু হেসে বললো, পাগল নাকি?
টুনি বললো, ক্যান?
মন্তু বললো, অত সহজ না, দাঁড় বাইতে ক্ষেমতার দরকার আছে।
টুনি আবার চুপ করে গেলো।
বিকেলের দিকে শান্তির হাটের কাছাকাছি এসে পৌছলো ওরা। নদী এখন দম ধরেছে। পানিতে আর সেই স্রোত নেই। একটা থমথমে ভাব। একটু পরে জোয়ার আসবে। তখন আর নৌকো নিয়ে এগোন যাবে না, কুলে এনে বেঁধে রাখতে হবে। তারপর জোয়ার নেমে গিয়ে ভাটা পড়লে তখন আবার নৌকো ছাড়বে মন্তু।
দূর থেকে শান্তির হাটটা দেখা যাচ্ছে।
অসংখ্য লোক গিজগিজ করছে সেখানে।
ওদিকে তাকিয়ে টুনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ওইহানে কি?
মন্তু বললো, ওইটা শান্তির হাট।
টুনি পানি থেকে হাতটা তুলে নিয়ে অপূর্ব ভঙ্গী করে বললো, ওইহানে চুড়ি পাওন যায়?
আমারে কিননা দিবা?
মন্তুর ইচ্ছে জোয়ার আসার আগে শান্তির হাটে গিয়ে নৌকো ভিড়াবে। তাই সংক্ষেপে বললো, হুঁ দিমু।
শান্তির হাটে পৌছে, একটা নিরাপদ স্থান দেখে নৌকো বাঁধলো মন্তু।
নদীর পাড়ে খালি জায়গাটায় তবু পড়ছে একটা। বিচিত্র তার রঙ।
বাইরে ব্যান্ড পার্টি বাজছে খুব জোরে জোরে। চারপাশে লোকজনের ভিড়। হাটের কাছে আসার পর থেকে ছইয়ের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে টুনি।
সেখান থেকে মুখ বের করে হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, ওইহানে কি?
মন্তু বললো, সার্কাস পার্টি। সার্কাস পার্টি আইছে।
সেদিকে তাকিয়ে থেকে টুনি আবার বললো, সেইটা আবার কি?
মন্তু বললো, নানা রকম খেলা দেহায় ওরা। মানুষের খেলা, বাঘের খেলা। আর কত কি! বাঘের নাম শুনে ভয় পেয়ে গেলো টুনি। কিন্তু পরক্ষণেই বললো, আমারে দেহাইবা?
মন্তুর কোন আপত্তি ছিলো না। কিন্তু হাটের মধ্যে মেয়ে মানুষ নিয়া যাওয়াটা সমীচীন মনে হলো না ওর। তাই বললো, না, তোমার যাইয়া কাজ নাই। তুমি বহ, আমি আইতাছি। ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ছইয়ের বাইরে এলো টুনি। বললো, ওমা, আমি একলা থাকবার পারমু না এহানে। তুমি যাইও না।
মুহূর্তে নিরাশ হয়ে গেলো মন্তু। ও নিজে এর আগে কোনদিন সার্কাস দেখেনি। ভেবেছিলো এই সুযোগে দেখে নিবে। কিন্তু টুনির কথায় ভেঙ্গে পড়লো সে। সার্কাসের তাবুর দিকে চোখ পড়তে দেখলো শুধু পুরুষ নয়, অসংখ্য মেয়েছেলেও দলে দলে ঢুকছে এসে তাঁবুর মধ্যে।
মন্তু কি যেন ভাবলো। ভেবে বললো, আই, দেরি কইরো না, আহ।
ওর পিছু পিছু নিচে নেমে এলো টুনি। মাথার ঘোমটাটা সে এক হাত লম্বা করে দিয়েছে।
আর সেই ঘোমটার ভেতর দিয়ে বিস্ময় বিমুগ্ধ চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে সে।
তাঁবুর সামনে বড় বড় দুটো হ্যাজাক জ্বালিয়ে দিয়েছে ওরা। এক পাশে এক এক দল লোক ব্যান্ড বাজাচ্ছে।
তাবুর দরজার উপরে একটা মাচায় চড়ে দুটি মেয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। সারা গায়ে, মুখে নানারকমের রঙ মেখেছে ওরা। টুনি অবাক হয়ে বললো, ওমা শরম করে না।
মন্তু বললো, শরম করবে ক্যান, ওরা মাইয়া লোক না, পুরুষ মানুষ মাইয়্যা সাজছে। অ। হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো টুনি।
দরজায় দাঁড়ান লোকটার কাছ থেকে তিন আনা দামের দু’খানা টিকেট কাটলো মন্তু। ভেতরে ঢুকে দেখে ছেলে বুড়ো মেয়েতে তিল ধারণের জায়গা নেই। তাবুর একটা কোণে অল্প একটু জায়গা নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লো ওরা।
কিছুক্ষণের মধ্যে সার্কাস শুরু হয়ে গেলো।
প্রথমে একটা মেয়ে দুটো লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা একখানা দড়ির উপর দিয়ে নির্বিকারভাবে একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে হেঁটে চলে গেলো।
লোকেরা হাতে তালি দিয়ে উঠলো জোরে।
তারপর আসলো বিকটাকার লোক। হাতের মুঠোর উপরে তিনটে মানুষকে তুলে নিয়ে চরকির মত ঘোরাতে লাগলো সে।
সবাই এক সঙ্গে বাহবা দিয়ে উঠলো।
এরপরে খুব জোরে ব্যান্ড বাজলো কিছুক্ষণ।
তার পরেই এলো বাঘ। এসেই একটা হুঙ্কার ছাড়লো সে।
মন্তুর একখানা হাত ওর মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখলো টুনি। দুচোখে ওর অপরিসীম বিস্ময়। ঘোমটার ফাঁকে একবার চারপাশের দর্শকের দিকে তাকালো সে। তাকালোমর দিকে। তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো বাঘের ওপর।
ইতিমধ্যে ভয়ে গুটিসুটি হয়ে মন্তুর বুকের মধ্যে সিঁধিয়ে গেছে টুনি।
মন্তু নিজেও জানে না কখন টুনিকে একেবারে কাছে টেনে নিয়েছে সে। সার্কাস শেষ হতে দু’জনের চমক ভাঙলো। শক্ত করে ধরে রাখা মন্তুর হাতখানা মুহূর্তে ছেড়ে দিলো টুনি। তারপর মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মন্তু নিজেও কিছুক্ষণের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো।
ইতস্তত করে বললো, চলো।
ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। ঘাটে আসার পথে মোয়র হাজীর চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে আসতে হয়। মন্তুকে দেখে হাজী দোকান থেকে চিৎকার করে উঠলো, আরে মন্তু মিয়া, কই যাও, শুন শুন?
মন্তু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলো, পারলো না।
আরে মিয়া কাজের কথা আছে শুইনা যাও। দু’হাতে ওকে কাছে ডাকলো মনোয়ার হাজী।
টুনি পেছনে দাঁড়িয়েছিলো। ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো মন্তু। কাউন্টারে আরো অনেকগুলো লোক কথা বলছিলো।
হঠাৎ মনোয়ার হাজী শব্দ করে হেসে উঠে বললো, বাহরে বাহ বিবিজানরে সঙ্গে নিয়ে সার্কাস দেখবার আইছ বুঝি?
সঙ্গে সঙ্গে আটজোড়া চোখ অদূরে দাঁড়ান টুনির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলো।
মন্তু কিছু বলবার আগেই মনোয়ার হাজী সামনে ঝুঁকে পড়ে বললো, কহন করলা, অ্যাঁ?
একবার খবর দিলা না। দাওয়াত করলা না, এইডা কেমুন কথা?
হতবুদ্ধি মন্তু কি করবে কিছু ভেবে পেলো না। সে শুধু ইতস্তত করে একবার মনোয়ার হাজীর দিকে আরেকবার টুনির দিকে তাকালো বার কয়েক। এক বিচিত্র অনুভূতির আবেশে
একটা ঢোক গিলে মন্তু বললো, কিছু চুড়ি কিনন লাগব।
হ্যাঁ, তা কিনবা না, নিশ্চয় কিনবা। একগাল হাসলো মনোয়ার হাজী। তারপর বললো, এহন চল মিয়া ভাবীরে নিয়া আজকা রাতে আমাগো বাড়ি মেহমান অইবা।
মন্তু পরক্ষণে বাধা দিলো, না না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরন লাগবো। ওর কথাটা কানে নিলো না মনোয়ার হাজী। সে জানালো থাকার কোন অসুবিধা হবে না ওদের। বাড়ি ঘর আছে অনেকগুলো, তারই একটিতে সুন্দর করে বিছানা পেতে দেবে। তাতে যদি মন্তুর আপত্তি থাকে তাহলে, আর একটা ভাল বন্দোবস্ত করে দিতে পারে নোয়ার হাজী। সার্কার্স পার্টির ওখানে হোটেল উঠেছে কয়েকটা। এক একটা ঘর এক টাকায় এক রাতের জন্যে ভাড়া দেয় ওরা। সেখানেও ইচ্ছে করলে থাকতে পারে মন্তু। পান-খাওয়া দাঁতগুলো বের করে মনোয়ার হাজী বললো, আরে মিয়া নতুন বউ নিয়া যদি একটু ফুর্তি না কইরলা তাইলে চলে কেমন কইরা। এইতো বয়স তোমাগো।
এই শীতেও ঘামিয়ে উঠেছে মন্তু। টুনির দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, ও ভীষণ ব্রিত বোধ করছে।
ক্ষণকাল পরে মন্তু বললো, আরেকদিন আইসা আপনাগো বাড়ি মেহমান হমু। আজকা। যাই।
ওর আমন্ত্রণ রক্ষা না করার জন্যে কিছুক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করলো মনোয়ার হাজী। অবশেষে বললে, আরেকদিন কিন্তুক আইবা মিয়া। আর হ্যাঁ, ভাবী সাহেবরে সঙ্গে নিয়া আইবা কিন্তুক। বলতে বলতে টুনির দিকে তাকালো হাজী।
জোয়ার পড়ে যাওয়ায়, ভাটার পানি অনেক নিচে নেবে গেছে। যেখানে নৌকোটা বেঁধে রেখে গিয়েছিলো সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে ওটা। মাঝখানের জায়গাটা পানি আর কাদায় ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে। ওর ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে অতি সাবধানে আঙ্গুলের নখগুলো দিয়ে মাটি চেপে রাখতে হয়। নইলে যে কোন মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
নিচে নামতে গিয়ে অন্ধকারে মন্তুর ফতুয়াটার একটি কোণ শক্ত করে ধরে রেখেছে টুনি। একটু অসতর্ক হতে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো সে। মন্তু ধরে ফেললো। মাথার অ্যাঁচলটা কাঁধের উপরে গড়িয়ে পড়লো, একটা অস্ফুট কাতরোক্তি করলো টুনি। কাঁধের উপর থেকে ওর মুখখানা সরিয়ে দিতে গিয়ে মন্তু সহসা অনুভব করলো, টুনির দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। নিঃশব্দে কাঁদছে টুনি!
ভাটি গাঙে নাও ভাসিয়ে দিয়ে বসে রইলো মন্তু। মনটা আজ ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে ওর। সারা দেহে আশ্চর্য এক অবসাদ। সেদিন রাতে রসের কলাসটা ভেঙ্গে ফেললো টুনি তখনও এত খারাপ লাগে নি ওর। আজ কেমন ব্যথা অনুভব করছে সে। বুকের নিচটায়। কলজের মধ্যে।
নৌকোর ছইয়ের ভেতরে চুপচাপ বসে রয়েছে টুনি। একটা কথা বলছে না সে, একটু হাসছে না।
হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরলে মন্তু।
বন্ধুরে আশা ছিলো মনে মনে প্রেম করিমু তোমার সনে।
তোমারে নিয়া ঘর বাঁধিমু গহিন বালুর চরে।
ও পরাণের বন্ধুয়ারে।।
নদীর স্রোত নৌকোর গায়ে ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ছে। যেন বহুদিনের এই স্নেহের টানকে চিরন্তন করে ধরে রাখার জন্যে প্রাণহীন কাঠের টুকরোগুলোকে গভীর আবেগে বারবার জড়িয়ে ধরতে চাইছে ওরা। টুনি এখনো নীরব।
খালের মুখের কাছে নৌকো থামাতে হলো।
ভাটার পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। পাতা পানিতে নৌকা নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না। এখানে অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না আবার জোয়ার আসে। জোয়ারের স্রোতে নৌকো নিয়ে ভেতরে চলে যাবে মন্ত। কিন্তু সে এখনো অনেক দেরি। ভোর রাতের আগে জোয়ার আসবে না।
নৌকো থামাতে দেখে টুনি এতক্ষণে কথা বললো, কি, নাও থামাইল্যা ক্যান?
হঠাৎ নিজের অজান্তে একটা কথা বলে বসলো মন্তু। বললো, বাড়ি যামু না। এইহানে থাকুম আমরা।
ক্যান? ক্যান? টুনির কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা।
শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো মন্তু। ওর হাসিটা কাটা বাঁশের বাঁশির মতো শোনাল।
নৌকো থেকে নোঙরটা তুলে নিয়ে নিচে নেবে গেলো মন্তু। ভালো করে মাটিতে পাতলো ওটা। নইলে জোয়ারের প্রথম ধাক্কায় মাঝ নদীতে চলে যাওয়ার ভয় আছে। তারপর পা জোড়া ধুয়ে নিয়ে নৌকোয় উঠতে উঠতে টুনির প্রশ্নের উত্তর দিলো মন্তু।
জোয়ার না আসা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতে হবে ওদের।
এইহানে? বলতে গিয়ে চারপাশে তাকালো টুনি।
আশেপাশে কোন জনবসতি নেই। দক্ষিণে যতদূর তাকানো যায় অথৈ পানির ঢেউ। নদী এখানে বাঁক নিয়ে ঘুরে গেছে সাগরের দিকে। কয়েকটি জেলে নৌকো মাঝ নদীতে টিমটিম বাতি জ্বালিয়ে জাল পাহারা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে একে অন্যকে জোর গলায় ডাকছে ওরা। নিশীর বাপ জাইগা আছনি, ও নিশীর বাপরে কুই-কুই।
পশ্চিমে চর পড়েছে। বিস্তীর্ণ ভূমি জুড়ে কোন লোকালয় নেই। শুধু বালু আর বালু। তার উপরে আরো এগিয়ে গেলে সীমাহীন বুনো ঘাসের বন। দিনের বেলায় অসংখ্য গরু বাছুর নিয়ে রাখাল ছেলেরা আসে এখানে, রাতে নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে থাকে সমস্ত প্রান্তর।
পুবে, ফেলে আসা নদী এঁকে-বেঁকে চলেছে শান্তির হাটের দিকে।
উত্তরে খাল। খালের পারে অসংখ্য বুনো ফুলের বন। একটু ভালো করে তাকালে ওপারে তৈরি লম্বা সাঁকোটা নজরে আসে এখান থেকে। চারপাশে এক পলক তাকিয়ে চুপ করে গেলো টুনি।
ও মাঝি। মাঝ-ও-কু-ই। জেলে নৌকো থেকে কে যেন ডাকলো, কোন হানের নাও।
অ্যাঁ?
গলা চড়িয়ে মন্তু জবাব দিলো, পরীর দীঘি।
জবাব শুনে চুপ করে গেলো জেলেটা।
এতক্ষণ নৌকো বেয়ে আসছিলো বলে শীতের মাত্রাটা বুঝে উঠতে পারে নি মন্তু।
তাড়াতাড়ি ছইয়ের মধ্যে এসে ঢুকলো সে।
টুনি নড়েচড়ে একপাশে সরে গেলো।
ছইয়ের সঙ্গে ঝোলান হুঁকো আর কটো নামিয়ে নিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে এক ছিলিম তামাক ধরিয়ে নিল মন্তু। তারপর আবার বাইরে বেরিয়ে এসে গলুইয়ের উপর আরাম করে বসে তামাক টানতে লাগলো।
দক্ষিণ থেকে কনকনে বাতাস বইছে জোরে।
আকাশে মেঘ।
মেঘের ফাঁকে আধখানা চাদ মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে আবার মুখ লুকুচ্ছে তাড়াতাড়ি।
টুনি ডাকলো, ওইহানে বইসা ক্যান, ভেতরে আহ।
মন্তু কোন জবাব দিলো না। আপন মনে হুঁকো টানতে লাগলো সে।
টুনি আবার ডাকলো, আহ না, বাইরে ঠাণ্ডা লাগবো।
মন্তু নীরব।
আইবা না? টুনির কণ্ঠে অভিমান।
বাইরে বেরিয়ে এসে ওর হাত থেকে কোটা নিলো টুনি। চলো, ভেতরে গিয়া শুইবা।
এবার আর কোন বাধা দিলো না। নিঃশব্দে ছইয়ের ভেতর গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। ওর গায়ের উপর কথাটা টেনে দিয়ে মাথার কাছে চুপচাপ বসে রইল টুনি।
বাইরের কনকনে বাতাস শূন্য প্রান্তরের উপর দিয়ে হু হু করে ছুটে চলেছে দূর থেকে দূরে। সেদিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নীরবে বসে রইলো।
ভোরে ভোরে গ্রামে এসে পৌঁছল ওরা।
মন্তু আর টুনি। পরীর দীঘির পাড়ে তিনটে নতুন কবর।
দূর থেকে দেখে বুক কেঁপে উঠলো তার। নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, কে মরলো?
ঘোমটার নিচে থেকে টুনিও চোখ বড় বড় করে দেখছিলো কবরগুলো। পথে আসতে মাঝি বাড়ির কুদুসের সঙ্গে দেখা হতে সব শুনলো মন্তু। প্রথম কবরটা এ গাঁয়ের তোরাব আলীর। আশির উপর বয়স হয়েছিলো ওর। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে চলাফেরা করতে পারতো না। মরে বেঁচেছে বেচারা। নইলে আরো কষ্ট সহ্য করতে হতো।
দ্বিতীয় কবরটা আসকর ফকিরের। পেটে পিলে হয়েছিলো। প্রায়ই রক্তবমি করতো।
বুড়োরা বলতো, শত্রুপক্ষ কেউ তাবিজ করেছে, নইলে, অমন হবে কেন।
তার পাশের কবরটা হালিমার। আবুলের বউ হালিমা। গতকাল দুপুরে ঘরের মধ্যে হঠাৎ চিতল মাছের মত তড়পাতে তড়পাতে মারা গেছে হালিমা।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো মন্তুর।
হালিমার মৃত্যুর সংবাদে কাঁদতে শুরু করেছে টুনি। ঘোমটার নিচে ফুপিয়ে কাঁদছে সে।
ইতস্তত করে মন্তু বললো, কান্দ কান, কাইন্দা কি অইবে।
বাড়ি ফিরে এলে বুড়ো মকবুল গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করলে একদিন নয়, দুদিন নয়, চার চারটে দিন। দুশ্চিন্তায় বারবার ঘর-বার করেছে সে। আইতে এত দেরি অইলো ক্যান? অ্যাঁ।
মন্তু খুলে বললো সব। কুটুম বাড়িতে গিয়ে কুটুম যদি আসতে না দেয় তাহলে কি করতে পারে সে? তাছাড়া নদীতে যে জোয়ার ভাটা আসে সেটাও কারো ইচ্ছেমত চলে না। তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে ওদের। মকবুল শুনলে সব, শুনে শান্ত হলো। তারপর কোদালটা হাতে তুলে নিয়ে বাড়ির উপরের ক্ষেতটার দিকে চলে গেলো সে। যাবার পথে আমেনাকে আর ফাতেমাকে ডেকে গেলো মকবুল। মাটি কুপিয়ে সমান করে মরিচের চারা লাগাতে হবে।
দেখতে না দেখতে হীরনের বিয়ের দিনটা ঘনিয়ে এলো।
একমাত্র মেয়ের বিয়ে, তাই আয়োজনের কোন কার্পণ্য করে নি বুড়ো মকবুল। সাড়ে আট টাকা দিয়ে একটা ছাগল কিনেছে সে। হাট থেকে চিকন চাল কিনে এনেছে আর আধ সের ঘি।
মিয়া বাড়ি থেকে কয়েকটা চিনে মাটির পেয়ালা আর বরতন ধার নিয়ে এলো আমেনা। বরপক্ষের লোকদের মাটির বাসনে খেতে দিলে ফিরে গিয়ে হয়তো বদনাম করবে ওরা, তাই।
বুড়ো মকবুলের শরীরটা ভালো নেই। চারদিকে ছুটাছুটি করবে সে শক্তি পাচ্ছে না সে। তাই বাড়ির অন্য সবার ওপরে বিভিন্ন কাজের ভার দিয়ে দিয়েছে। সুরত আলী, রশীদ, আবুল, মন্তু সবাই ব্যস্ত। বুড়ো শুধু দাওয়ায় একখানা সিঁড়ির উপর বসে তদারক করছে সব। খোঁজখবর নিচ্ছে। ভূঁইয়া বাড়ির গড়ের পাশে বড় মেহেদী গাছ থেকে মেহেদী তুলতে গেছে সালেহা আর ফকিরের মা।
আমেনা আর ফাতেমা, ঘরদোরগুলো লেপে মুছে ঠিক করে নিচ্ছে।
পুরো উঠেনটাকে ঝাড় দিয়ে পরিস্কার ঝকঝকে তকতকে করে তুলেছে ওরা। টুনি পুকুর ঘাটে, বাসনপত্রগুলো মাজছে।
যার বিয়ে, সেই হীরন রই ঘরের দাওয়ায় চুপটি করে বসে রয়েছে আর অবাক হয়ে বারবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে সবার।
দুপুর রাতে পাড়াপড়শীরা অনেকে এলো। কাচাবাচ্চা ছেলেমেয়েদের দল। দুখানা বড় বড় চাটাই বিছিয়ে নিয়ে উঠোনে বসলো ওরা। তারপর সবাই এক সঙ্গে সুর করে গান ধরলো।
মেহেদী তোমরা লাগ কোন কাজে।
আমরা লাগী দুলহা কইন্যার সাজে।
ঢেঁকির উপরে তখন আম্বিয়াও গান ধরেছে। বিয়ের ধান ভানতে এসেছে সে। সন্ধে থেকে ঢেঁকির উপরে উঠেছে ও আর টুনি। তখন থেকে এক মুহূর্তের বিরাম নেই। উঠোনে মেয়েরা গান গাইছিলো। তাদের পাল্লা দেয়ার জন্যে টুনি আর আম্বিয়া দুজনে গলা ছেড়ে গান ধরলো।
ভাটুইরে না দিয়ে কলা
ভাটুইর হইবে লম্বা গলা।
সর্ব লইক্ষণ কাম চিকণ পঞ্চ রঙের ভাটুইরে।
সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো বুড়ো মকবুল। ওর মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে আজ। জোরে জোরে কো টানছে, আর চারপাশে চেয়ে চেয়ে দেখছে সে।
হীরনকে মাঝখানে বসিয়ে ওর হাতে মেহেদী দিচ্ছে সবাই। মুখখানা নামিয়ে নিয়ে চুপ করে আছে মেয়েটা।
সুরতের ছেলেমেয়ে, কুন্দুস, পুটি, বিন্তি ওরা হাতে মেহেদী দেবার জন্যে কাঁদাকাটি শুরু করে দিয়েছে। এদের ধমকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো সালেহা।
মকবুল বললো, আহা তাড়াও ক্যান, বউ। একটুহানি মেহেদী ওগগাও দাও না।
হঠাৎ ফকিরের মা নাচতে শুরু করলো। অ্যাঁচল দুলিয়ে, কোমর ঘুরিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো সে।
কই গেলা সুরতের বিবি আমার কথা শোন। আবের পাভক্ষা হাতে করি আউলাইয়া বাতাস কর। ফুলের পাখা হাতে নিয়া জোরে বাতাস কর।
ওর নাচ দেখে ছেলে বুড়ো সবাই শব্দ করে হেসে উঠলো এক সঙ্গে।
ধান ভানা বন্ধ করে টুনি আর আম্বিয়াও বাইরে বেরিয়ে এলো।
আম্বিয়াকে আসতে দেখে নাচ থামিয়ে তার দিকে দৌড়ে এলো ফকিরের মা, হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো দলের মাঝখানে। তারপর ওকে লক্ষ্য করে ফকিরের মা গাইলো।
কেমন তোমার মাও বাপরে, কেমন ওরে হিয়া
এত বড় মাইয়া অইছ না করাইছ বিয়া।
ওর গানটা শেষ না হতেই আম্বিয়া নেচে উঠে গানের সুরে জবাব দিলো।
কেমন ওরে মাও বাপরে, কেমন ওরে হিয়া।
তোমার মত কাঞ্চন পাইলে এখন করি বিয়া।
দূর পোড়া কপাইল্যা, দূর দূর করে ওকে তাড়া করলো ফকিরের মা। দৌড়ে গিয়ে মন্তুর ঘরের মধ্যে ঢুকে দুয়ারে খিল দিলো আম্বিয়া। বাইরে ছেলে বুড়োদের রোল পড়েছে তখন। সালেহা হেসে বললো, কিরে আম্বিয়া, এত ঘর থাইকতে শেষে আমাগো মন্তু মিয়ার ঘরে ঢুইকা খিল দিলি?
আরেক প্রস্থ হেসে উঠলো সবাই।
মন্তু তখন উঠোনের মাঝখানে এসে দাড়িয়েছে।
ওকে দেখে গ্রামের রসুন নানী তার ফোকলা দাঁত বের করে একগাল হেসে বললো, কি মিয়া ডুইবা ডুইবা পানি খাও। ঘরে গিয়া দেহ কইন্যা তোমার ঘরে গিয়া খিল দিছে। মন্তু কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। হঠাৎ টুনির কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলো সবাই।
তীব্র গলায় সে বললো, কি অইতাছে অ্যাঁ। কি অইতাছে। কাম কজি ফালাইয়া কি শুরু করছ তোমরা। অ্যাঁ?
সহসা সবাই চুপ করে গেলো। একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো ওরা। টুনি ততক্ষণে রসুই ঘরের দিকে চলে গেছে।
মন্তু নির্বাক।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে আম্বিয়া। তার চোখমুখ পাকা লঙ্কার মত লাল। চিবুক আর গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে ওর। কিছুক্ষণের জন্যে সবাই যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলো। একটু আগেকার সেই আনন্দ উচ্ছ্বল পরিবেশটা আর এখন নেই। ফকিরের মা বিড়বিড় করে বললো, এমন কি কইরছি যে রাগ দেহান লাগছে। বিয়া বাড়ির মধ্যেই হৈ-চৈ না কইরা কি কান্দাকাটি করমু? সালেহা বললো, আমরা না হয় মন্তু মিয়া আর আম্বিয়ারে নিয়া একটুখানি ঠাট্টা মস্করা কইরতাছিলাম, তাতে টুনি বিবির এত জ্বলন লাগে ক্যান? ওর কথা শেষ না হতে ঝড়ের বেগে রসুই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো টুনি। কি কইলা অ্যাঁ, কি কইল্যা অ্যাঁ। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে ওর। চোখজোড়া জ্বলছে। সালেহা সঙ্গে সঙ্গে বললো, যা কইবার তা কইছি, তোমার এত পোড়া লাগে ক্যান। বলে মুখ ভ্যাংচালো সে।
পরক্ষণে একটা অবাক কাণ্ড করে বসলো টুনি। সালেহার চুলের গোছাটা ধরে হ্যাচকা টানে ওকে মাটিতে ফেলে দিলো সে। তারপর চোখেমুখে কয়েকটা এলোপাতারি কিল ঘুষি মেরে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো টুনি। ঘটনার আকস্মিকতা কেটে যেতে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সালেহা। মনে হলো মুহূর্তে ওর মা মারা গেছে।
কান্না শুনে এঘর ওঘর থেকে বেরিয়ে এলো অনেকে।
মকবুল দাওয়া থেকে চিৎকার করে উঠলো, কিরে কি অইলো অ্যাঁ। কি অইলো।
রশীদ, সুরত সবাই ছুটে এলো সেখানে।
রশীদ বললো, কি কান্দবি, না কইবি কিছু, কি অইছে? সালেহা কোন জবাব দিলো না।
ফকিরের মা বুঝিয়ে বললো সব।
সালেহার কোন দোষ নেই। আম্বিয়া আর মন্তুকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিলো ওরা। টুনি বেরিয়ে এসে হঠাৎ সালেহাকে মেরেছে।
মাইরছে। মাইরছে ক্যান? রশীদ ক্ষেপে উঠলো।
ওকে রাগতে দেখে আরো জোরে কান্না জুলে দিল সালেহা।
বুড়ো মকবুল ব্রিত বোধ করলো। ইতস্তত করে বললো, মন্তু আর আম্বিয়া কই গেছে?
মন্তুকে ঘরের দাওয়াতে বসে থাকতে দেখা গেলো। কিন্তু আম্বিয়াকে পাওয়া গেলো না সেখানে। এই গণ্ডগোলের মধ্যে নীরবে এখান থেকে সরে পড়েছে সে।
ফকিরের মা বললো, ওগো কোন দোষ নাই।
কি ভেবে বুড়ো মকবুল একেবারে শান্ত হয়ে গেলো। আস্তে করে বললো, তোমরা হৈ চৈ কইরো না। বিয়ার সময় এই সব ভালো না। যা অইছে তার বিচার আমি করমু। খাটি বিচার আমি করমু। বলে দাওয়ার দিকে চলে গেলো সে। তারপর কোটা হাতে তুলে নিয়ে আবার বললো, কই তোমরা চুপ কইরা রইলা ক্যান? গীত গাও, হ্যাঁ গীত গাও।
ছেলে-বুড়োরা আবার হৈ-চৈ করে উঠলো।
ফকিরের মা আবার গান ধরলো।
এক বাটা পান এনে ওদের সামনে নামিয়ে রেখে গেলো আমেনা। বললো, খাও। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরনো আবেশটা ফিরে এলো আবার। ফকিরের মা নাচতে শুরু করলো।
কেমন তোমার মাও বাপরে কেমন তোমার হিয়া।
এত বড় ডাঙ্গর অইছো না করাইছ বিয়া।
বিয়ের জন্যে কিনে আনা ছাগলটা ঘরের পেছনে বেঁ-তেঁ করে ডাকছে। চোখের কোণ জোড়া পানিতে ভেসে উঠেছে ওর।
ভোর রাত পর্যন্ত কেউ ঘুমালো না।
তারপর একজন দুজন করে যে যার ঘরে চলে যেতে লাগলো। মন্তু সবে তার ঝাঁপিটা বন্ধ করে দেবে এমন সময় বাইরে থেকে ধাক্কা দিল টুনি। ও কিছু বলার আগে ভেতরে এসে ঢুকলো সে। পান খেয়ে ঠোঁটজোড়া লাল করে এসেছে। মুখে একটা প্রসন্ন হাসি, হাতে মেহেদী। সঙ্গে একটা মাটির বাটিতে করে আরো কিছু মেহেদী এনেছে সে।
বাটিটা মাটিতে নামিয়ে রেখে টুনি আস্তে করে বললে, দেহি, তোমার হাত দেহি।
মন্তু বললো, ক্যান?
টুনি বললো, তোমারে মেহেদী দিমু।
মন্তু বললো, না।
টুনি বললো, না ক্যান, বলে ওর হাতটা টেনে নিলো সে। মাটিতে বসে ধীরে ধীরে ওর হাতে মেহেদী পরিয়ে দিতে লাগলো টুনি। মন্তু কোন বাধা দিলো না। নীরবে বসে শুধু তাকে লক্ষ্য করে মৃদু হাসলো। কিছুক্ষণ পরে টুনি আবার বললো, আমার একটা কথা রাইখবা?
কি?
এক বিয়া কর।
হুঁ।
দুজনের আবার চুপ করে গেলো ওরা।
ওর দুহাতের তালুতে সুন্দর করে মেহেদী পরিয়ে দিতে দিতে টুনি আবার বললো, আরেক কথা রাইখবা?
কি?
আমার পছন্দ ছাড়া বিয়া কইরবা না।
হুঁ। একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো মন্তু। টুনি পরক্ষণে ওর হাতটা কোলের ওপরে টেনে নিয়ে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, কথা দিলা? বলে অদ্ভুতভাবে এর দিকে তাকালো টুনি। মন্তু কি বলবে ভেবে পেলো না। বার কয়েক ঢোক গিললে সে।
তারপর হঠাৎ করে বললো শাপলা তুলতা যাইবা?
মৃদু হেসে মাথা নাড়লো টুনি। না।
তাইলে চল, মাছ ধরি গিয়া।
টুনি আরো জুরে মাথা নাড়লো, না।
না ক্যান? মন্তুর কণ্ঠে ধমকের সুর।
টুনি হেসে বললো, লোকে দেইখ্যা ফেলাইলে কেলেঙ্কারী বাধাইবো। বলে উঠে দাঁড়ালো সে। মন্তুকে কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে পরক্ষণে সেখান থেকে চলে গেলো টুনি।
বিয়ের পরে কটা দিন বাড়িটা একেবারে জন্য মনে হলো। ছেলে-বুড়ো সবাই চলে গেছে হীরনের সঙ্গে তার শ্বশুর বাড়ি। শুধু যায় নি মকবুল আর মন্তু।
মকবুল যায় নি তার অসুখ বলে। প্রায় বিকেলে জ্বর আসছে ওর। সকালে একেবারে ভালো।
মন্তুরও শরীরটা ভালো নাই বিয়ের দিন-রাতে বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লাগিয়েছে সে। বুড়ো মকবুল বলেছে, থাক, তোর গিয়ে কাজ নেই। তুই পরে যাইছ। তাই থেকে গেছে সে।
বাড়ির মেয়েছেলেরা কদিন ধরে ঘুমুচ্ছে খুব। বিয়ের সময়ে দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি কেউ, তাই।
বুড়ো মকবুল সাবধান করে দিয়েছে ওদের, অমন করে ঘুমায়ো না তোমরা, চোর আইসা সর্ব্বনাশ কইরা দিবো।
আর আইলেই-বা কি নিবো। আছেই-বা কি। আমেনা শান্ত স্বরে জবাব দিয়েছে। এর মনটা ভালো নেই। একমাত্র মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে শান্তি পাচ্ছে না সে। বড় একা একা লাগছে। কে জানে স্বামীর বাড়ি গিয়ে কত কষ্টই না সহ্য করছে হীরন।
আজ সকাল থেকে মরাকান্না জুড়েছে ফকিরের মা। মৃত ছেলেটার কথা মনে পড়েছে ওর। বেঁচে থাকলে হয়তো সে এখন বিয়ের বয়সী হতো।
জ্বর নিয়েও বুড়ো মকবুল পুকুর পাড়ে বসে মরিচের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। ফাতেমা দুবার এসে ডেকে গেছে ওকে, আপনের কি অইছে। এই রকম কাজ কইরলে তো দুই দিনে মরবেন আপনে।
কথাটা কানে নেয় নি মকবুল। একমনে পানি ঢালছে সে।
মন্তুকে পাঠিয়েছে গাঁয়ের কোবরেজ মশায়ের কাছে। লক্ষণ বলে ঔষধ নিয়ে আসার জন্যে।
উঠোনে টুনিকে ডেকে তার হাতে ওষুধগুলো দিয়ে দিলো মন্তু। বললো, কবিরাজ মশায় কইছে, এইগুলান ঠিকমত খাইতে।
টুনি ওষুধগুলো হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বললো, কি অইবো ওষুধ খাইয়া, বুড়া মরুক। বলেই চারপাশে তাকালো টুনি, কেউ শুনলে কিনা দেখলো। মন্তু কোন জবাব দিলো না ওর কথায়। বেড়ার সঙ্গে ঝুলানো হুঁকো আর কল্কেটা নিয়ে রসুই ঘরের দিকে চলে গেলো সে। একটু পরে এক বাটি তেঁতুল মরিচ মেখে এনে মন্তুর সামনে বসলো টুনি।
অল্প একটু তেঁতুল মুখে পুরে দিয়ে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে তার স্বাদ গ্রহণ করতে করতে টুনি শুধালো, খাইবা?
বাটিটার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে মন্তু বললো, না। তারপর একমনে হুঁকো টানতে লাগলো সে।
টুনি বললো, কবিরাজ কি কইছে?
একরাশ ধুয়ো ছেড়ে মন্তু জবাব দিলো, কইছে, কিছু না, ভালো অইয়া যাইবো।
ভালো অইয়া যাইবোর চোখজোড়া কপালে তুললো টুনি।
নেড়ী কুকুরটা টুনিকে কিছু খেতে দেখে আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিলো। হঠাৎ দাওয়া থেকে পিঁড়ি তুলে ওর গায়ে ছুঁড়ে মারলো টুনি।
সারাদিন কেবল পিছে পিছে ঘুরে, কোনহানে গিয়া একটু শান্তি নাই।
পিঁড়ির আঘাতে ঘেউ ঘেউ করে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো কুকুরটা।
চৈত্র মাসের রোদে মাঠটা খা খা করছে।
যেদিকে তাকানো যায় শুধু শুকনো মাটিপাথরের চেয়েও শক্ত। আর অসংখ্য ফাটল। মাটি উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে ফেটে যায়। দাঁড়কাকগুলো তৃষ্ণায় সারাক্ষণ কা-কা করে উড়ে বেড়ায় এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে বাড়ির আনাচে কানাচে।
নদী-নালাগুলোতে পানি থাকেনা। মানুষ গরু ইচ্ছেমত পায়ে হেঁটে এপার-ওপার চলে যায়। পুকুরগুলোর পানিও অনেক কমে আসে।
গরমে ঘরে থাকে না কেউ। গাছের নিচে চাটাই বিছিয়ে শুয়ে বসে দিন কাটায়। বাতাসে একটি পাতাও নড়ে না। সারাক্ষণ সবাই শুধু হা-হুতাশ করে। এমনি সময়ে হীরনকে দেখবার জন্যে ওর শ্বশুরবাড়িতে গেছে বুড়ো মকবুল। যাবার সময় একটা ন্যাকড়ার মধ্যে এককুড়ি মুরগীর ডিম সঙ্গে নিয়ে গেছে সে। শূন্য হাতে বেয়াই বাড়ি গেলে হয়তো ওরা লজ্জা দিতে পারে, তাই। পথে বামুন বাড়ির হাট থেকে চার আনার বাতাসাও কিনেছে সে। বাড়ির বাচ্চাদের হাতে দেবে।
ভর সন্ধ্যায় মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে এলো মকবুল। বার বাড়ি থেকে ওর ক্লান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল সুরত! সুরত! ও মন্তু, কেউ কি নাই নাকি রে।
মন্তু গেছে মিয়া বাড়ি। গাছ কাটার চুক্তি নিয়েছে সে।
সুরতও সেখানে।
আবুল বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, কি ভাই সাব, কি অইছে?
টুনি আর আমেনাও বেরিয়ে এলো বাইরে।
মকবুল বললো, সুরত, রশীদ ওরা কই?
আমেনা বললো, সুরত কাজে গেছে, রশীদ গেছে হাটে, সালেহার লাইগা সাবু আনতে।
ওর জ্বর হইছে ভীষণ।
জ্বর নাহি, আহা কখন আইলো? গায়ের ফতুয়াটা খুলতে খুলতে মকবুল বললো, বাপু তোমরা সক্কলে একটু সাবধানে থাইকো। ও বিন্তির মা, বঁইচির মা শোনো, তোমরা একটু সাবধানে থাইকো।
গেরামে ওলা বিবি আইছে।
ইয়া আল্লা মাপ কইরা দাও। আতঙ্কে সবাই শিউরে উঠলো।
গনু মোল্লা ওজু করছিলো, সেখানে থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করলো, কোন্হানে আইছে। ওলা বিবি? কোন্ বাড়িতে আইছে?
মকবুল বললো, মাঝি বাড়ি।
মাঝি বাড়ি? এক সঙ্গে বলে উঠলে সবাই। কয়জন পড়ছে?
তিনজন।
তিনজন কে কে সেকথা বলতে পারবে না মকবুল, পথে আসার সময় ও বাড়ির আম্বিয়ার কাছ থেকে শুনে এসেছে সে। বাড়ির সবাইকে আরেক প্রস্থ সাবধান করে দিলো বুড়ো মকবুল, তোমরা সক্কলে একভু হুইসারে থাইকো বাপু। একডু দোয়া দরুদ পাইড়ো। বলে খড়মটা তুলে নিয়ে ঘাটের দিকে চলে গেলে সে।
ফকিরের মা বুড়ি এতক্ষণ নীরবে শুনছিলো সব। এবার বিড়বিড় করে বললো, বড় খারাপ দিন কাল আইছে বাপু। যেই বাড়িডার দিকে একবার নজর পড়ে সেই বাড়িডারে এক্কেবারে শেষ কইরা ছাড়ে ওলা বিবি। বড় খারাপ দিন-কাল আইছে। বলে নিজের মৃত ছেলেটার জন্য কাঁদতে শুরু করলো সে।
টুনি দাঁত মুখ শক্ত করে তেড়ে এলো ওর দিকে, বুড়ি যহন তহন কান্দিছ না কইলাম। শিগগীর থাম।
ধমক খেয়ে ফকিরের মা চুপ করে গেলো। সেই বিয়ের সময় সালেহাকে মারার পর থেকে টুনিকে ভীষণ ভয় করে বুড়ি।
ইতিমধ্যে মন্তু, সুরত ফিরে এসেছে।
কাঁধের উপর থেকে কুড়োলটা মাটিতে নাবিয়ে রাখতে না রাখতে টুনি একপাশে টেনে নিয়ে গেলো ওকে।
মাঝি-বাড়ি যাও নাই তো?
মন্তু ঘাড় নাড়লো না, ক্যান কি অইছে।
টুনি বললো, ওলা বিবি আইছে ওইহানে। বলতে গিয়ে মুখখানা শুকিয়ে গেলো ওর।
মন্তুর দুচোখে বিস্ময়। বললো, কার কাছ থাইকা শুনছ?
ও কথার কোন জবাব না দিয়ে টুনি আবার বললো, শোন, ওই বাড়ির দিকে গেলে কিন্তু আমার মাথা খাও। যাইও না ক্যাম?
মন্তু সায় দিয়ে মাথা নাড়লো কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারলো না সে। আজ সকালে মিয়া-বাড়ি যাওয়ার পথে একবার করিম শেখের সঙ্গে দেখা করে গেছে মন্তু। নৌকোটাকে ভালোভাবে মেরামত করার বিষয়ে অনেকক্ষণ আলাপ করে গেছে ওর সঙ্গে। কিন্তু তখন তো এমন কিছু শুনে নি সে।
আম্বিয়ার সঙ্গেও দেখা হয়েছিল, সেও কিছু বলে নি।
উঠোনের এক কোণে দাড়িয়ে সাত পাঁচ ভাবলো মন্তু। বুড়ো মকবুলকে তামাক সাজিয়ে দেবার জন্যে রসুই ঘরে গেছে টুনি। এই সুযোগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সে।
দীঘির পাড়ে মন্তু শেখের ভাইঝি জামাই তোরাবের সঙ্গে দেখা হলো। পরনে লুঙ্গি আর কুর্তা। হাতে লাঠি। বগলে একজোড়া পুরনো জুতো। ম্যুকে দেখে প্রসন্ন হাসির সঙ্গে তোব প্রশ্ন করলো, কি মিয়া খবর সব ভালো লো? মন্তু নীরবে ঘাড় নাড়লো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, কই যাও, শ্বশুর বাড়ি বুঝি? হুঁ, তোরাব শ্বশুরবাড়িতেই যাচ্ছে। কাজকর্মের ফাঁকে অনেক দিন আসতে পারে নি, খোঁজ-খবর নিতে পারে নি। তাই সুযোগ পেয়ে একবার সকলকে দেখে যেতে এসেছে। সে।
পকেট থেকে দুটি বিড়ি বের করে একটা ম্যুকে দিয়ে আরেকটা নিজে ধরালো সে। বিড়ি খেতে ইচ্ছে করছিলো না ওর। তবু নিতে হলো। সগন শেখের পুকুর পাড়ে এসে থামলো তোরাব। জুতো জোড়া বগল থেকে নামিয়ে নিয়ে হাত-পা ধোঁয়ার জন্যে ঘাটে নেমে গেলো সে।
বললো, একটুহানি দাঁড়ান মিয়া। অজু কইরা নি।
হাত-পা ধুয়ে জুতোজোড়া পরে আবার উপরে উঠে এালো তোরাব।
পকেট থেকে চিরুনি বের করে নিয়ে বললো, মাঝি-বাড়ির খবর জানেন নাহি, সক্কলে ভালো আছে তো?
মন্তু বললো, ভালো তো আছিলো, কিন্তুক একটু আগে শুনছি, ওলা লাগছে। ওলা? তোরাব যেন অ্যাঁতকে উঠলো। পায়ের গতিটা কমিয়ে এনে সে শুধালো, কার কার লাগছে।
মন্তু বললো, কি জানি ঠিক কইবার পারলাম না।
হুঁ। হঠাৎ থেমে গেলো তোরাব। কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল, তারপর পায়ের জুতোজোড়া খুলে আবার বগলে নিতে নিতে বললো, এই দুঃখের দিনে গিয়া ওনাগোরে কষ্ট দেয়নের কোন মানি অয় না মিয়া। যাই ফিইরা যাই। যেতে যেতে আবার ঘুরে দাঁড়ালো সে। আস্তে করে বললো, আমি যে আইছিলাম এই কথাডা কেউরে কইয়েন না মিয়া। বলে মন্তুর উত্তরের অপেক্ষা না করে যে পথে এসেছিলো সে পথে দ্রুতপায়ে আবার ফিরে চললো তোরাব।
হাতের বিড়িটা অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মন্তু।
মাঝি-বাড়ি থেকে করুণ বিলাপের সুর ভেসে এলো সেই মুহূর্তে। একজন বুঝি মারা গেলো। কলজেটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠলো মন্তুর। মাঝি বাড়ির দেউড়িটা পেরিয়ে ভেতরে আসতে সারা দেহ কাঁটা দিয়ে উঠলো ওর। নন্তু শেখ মারা গেলো। হাঁপানি জর্জর করিম শেখ মৃত বাবার পাশে বসে কাঁদছে। আম্বিয়া কাঁদছে তার বিছানায় শুয়ে। ওলা বিবি তাকেও ভর করেছে। তাই বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তি পাচ্ছে না মেয়েটা। সেখান থেকে কাঁদছে সে।
দাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে রইলো মন্তু।
মাঝি-বাড়ির ছমির শেখ ওকে দেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো। এই কি মুছিবত আইলো মিয়া, আমরা বুঝি এইবার শেষ অইয়া যামু। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো মন্তু। তারপর ওর কাছ থেকে বাকি খোঁজ-খবর নিলো সে। ছোট ভাই জমির শেখ কবিরাজ আনতে গেছে দুক্রোশ দূরে রতনপুরের হাটে। এখনন আসে নি; ভোরের আগে যে আসবে তারও কোন সম্ভাবনা নেই। এই একটু আগে ছমির শেখ, পরিবারের ছেলেমেয়ে সবাইকে তার মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বুড়োরা মরে গেলেও ছেলেমেয়েগুলো যাতে বাঁচে। নইলে বাপ-দাদার ভিটার ওপর বাতি দিবার কেউ থাকবে না। ছমির শেখের দুগণ্ড বেয়ে পানি ঝরছে। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের চোখজোড়াও ভিজে এলো ওর। আম্বিয়ার ঘরের দিকে তাকাতে দেখলো, বিছানায় শুয়ে বিলাপ করছে মেয়েটা।