ঘুম থেকে উঠেই কল্যাণের মনে হয়েছিল মাথা ছিঁড়ে পড়ছে, সমস্ত শরীরে ব্যথা, জুরটা বেশ জমিয়ে এসেছে। খাট থেকে নামতে গিয়েই সে টের পেল আজকের দিনটা বাড়িতেই আটকে থাকতে হবে। সে কিছুক্ষণ খাটের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। এখন কত বেলা বোঝা যাচ্ছে না। এককালে যে টেবিল ক্লকটা সময় জানাত সেটা দুহাত ছড়িয়ে স্থির হয়ে আছে বছরখানেক। সুজন নেই। যদি এখন আটটা বেজে গিয়ে থাকে তাহলে তার থাকার কথাও নয়। নাহয় প্রথম পনেরো দিন রান্নাঘরে তিনি ঢুকবেন না, তাই বলে আমার মাথা ধরলেও উনুনে হাত পোড়াতে হবে। কেন যে ছাই এখানে পড়ে আছ তা বুঝি না! গলাটা বড়বৌদির। সঙ্গে সঙ্গে মাযের গলায় ঝাজ ফুটল, হিসেবের ডিউটি করতে এসেছেন এই বাড়িতে! সকালে উনুন ধরিয়ে জল চাপিয়েই তিনি ঘরে ঢুকেছেন।
বড়দা চাপা গলায় বলল, আমি কিছু জানি না। সাড়ে নটায় বেরুবো, তার আগে খাবাব চাই। মাথা ধরলে যে তুমি সিমপ্যাথি পাবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই।
বাবার গলা শোনা গেল, কি হচ্ছেটা কি! মেজবৌমার তো এই পনেরো দিন রান্নার ঘরে ঢোকার কথা নয়। সে উনুন ধরিয়েছে এই তো অনেক কথা।
তুমি চুপ করো। এক পয়সা দেবার মুরোদ নেই কথা বলতে আস কি সাহস! মিলেমিশে না থাকতে পারলে এই বাড়ি ছাড়তে হবে বলে দিলাম। মায়ের পায়ের আওয়াজ কানে গেল কল্যাণের। তিনি রান্নাঘরে যাচ্ছেন।
এই বাড়িতে বাবা এসেছিলেন চল্লিশ বছর আগে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাকি কলকাতায় খুব সস্তায় বাড়ি পাওয়া যেত। চারঘরের এই বাড়ির ভাড়া এখনও সত্তর টাকা। শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ের কাছাকাছি এমন বাড়ির চারখানা ঘরে থাকে কল্যাণ এবং তার ভাই সুজন, বাবা মা, বড়দা বউদি এবং মেজদা মেজবউ। চারটের মধ্যে দুটো ঘর বাসযোগ্য, একটায় কোনমতে থাকা যায়, চতুর্থটায় রান্না হত আগে। মেজদা কাণ্ডটা করে বসার পর থেকে রান্না হয় বারান্দার ঘেরা জায়গাটায়, রান্নাঘরটা একটু মেরামত করে নিয়ে মেজদার ঘর হয়েছে। বাড়িটায় ইঁদুর আছে প্রচুর। মেজদার ঘরেই বেশি যাতায়াত।
কল্যাণ বাবাকে আর কথা বলতে শুনল না। কিন্তু বড়দা বলল, বাবা, মা আমার কাছে সামনের মাসে একশ টাকা বেশি চেয়েছে। আমি ভেবে দেখলাম আমার পক্ষে আর কিছু দেওয়া সম্ভব নয়।
তোমার মাকে বল, আমি কিছু জানি না। সংসার চালান তিনি।
জানেন না তো অন্যের হয়ে ওকালতি করতে আসেন কেন? এটা বড়বউদির গলা।
ঘূথিকা, আমাকে কথা বলতে দাও। কল্যাণ এখনও বাড়িতে আছে।
আছে তো আছে। আমি কি তার খাই না পরি যে ভয় করতে যাব! তুমি কথা বলবে, দেখো আবার মিন মিন করে রাজী হয়ে যেয়ো না। বউদি বোধ হয় বারান্দা থেকে নিজের ঘরে চলে গেল। আজ যদি বাড়িতে থাকতে হয় তো সারাদিন এইসব সংলাপ শুনতে হবে। কল্যাণ উঠল। হাঁটার সময় মাথা ঘুরছিল। কিন্তু সে বারান্দায় বেরিয়ে এল। তাকে দেখামাত্র সবাই চুপ করে গেল। বড়দা কিছু হয়নি এমন ভান করে রয়েছে। তার পরনে বউদির শাড়ি, লুঙ্গির মত পরা। বাবার সামনে বসে মুঠোয় সিগারেট নিয়ে আছে বড়দা। ওটা সম্প্রতি আরম্ভ করেছে। বাবা ময়লা ধুতি পরে মোড়ায় বসে আছেন। কেউ তাকে কিছু বলল না। সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল সে। এই জায়গাটা সবচেয়ে নোংরা এ-বাড়ির। চৌবাচ্চা পরিষ্কার করা নিয়ে নিয়মিত ঝগড়া হয়। চৌবাচ্চার দিকে তাকালেই কাদা চোখে পড়ে। সুজন সপ্তাহে একদিন কাজটা করে। কল্যাণ আর একদিন।
বাথরুম থেকে বেরুতে বেরুতে কানে এল, তোমার তিন ছেলে যদি কিছু না করে তাহলে আমার কিছু করার নেই। মেজ বিয়ে করেছে সে কত দিচ্ছে?
চারশো। বাবা বললেন, তুই যা দিস।
কল্যাণকে দেখে দাদা কিছু বলল না। সোজা ঘরে চলে এল সে। এই বাড়িতে কোন মানুষ ভদ্রভাবে থাকতে পারে না। বাবার জন্যে কষ্ট হয় কল্যাণের। চিরকাল কেমন বেচারা হয়ে রয়ে গেলেন। চাকরি করতেন সদাগরী অফিসে। মাইনে ছিল সামান্য। অথচ গর্ব ছিল, হয়তো এখনও আছে, তিনি সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। বাড়িতে মুরগির মাংস ঢোকেনি আজ পর্যন্ত। অবসর নেবার পর হাতে যা পেয়েছিলেন তা শেষ হয়ে গেছে কোনকালে। একটা চোখে ছানি পড়েছে। চিরকাল মায়ের ছায়ায় আছেন।
বড়দা কত মাইনে পায় কেউ জানে না। খুব শৌখিন হয়ে থাকতে ভালবাসে। বউদিরও সাজগোজের দিকে ঝোক। প্রতি শনি-ববি দুটো সিনেমা দেখা চাই। একটা বাচ্চা হয়েছে। বাড়ির কাউকে সেটাকে ধরতে দেন না। চারশো টাকায় যদি দুবেলা খাবার আর চা পাওয়া যায় তো মন্দ কি। আলাদা সংসার করলে এই মজাটা থাকবে না তা দুজনেই ভাল মত জানে। তবু বউদি কথা শোনাতে ছাড়ে না। একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করতে তিনি ওস্তাদ। এককালে কল্যাণের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা ছিল। এই বাড়িতে কল্যাণই একমাত্র ভাল ছেলে। ভাল বলতে পড়াশুনায় কখনও আশির নিচে নম্বর পায়নি। কোন প্রাইভেট টিউটর ছাড়াও অত নম্বর যে ছেলে পায় তার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতেই চাইবেন বড় বউদি। কিন্তু মেজদার বিয়ে নিয়ে যে কাণ্ড হয়ে গেল তারপর এখন সবার সঙ্গেই তার বাক্যালাপ বন্ধ। মেজদার বিয়ের আগে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল প্রায় সাপে নেউলের মত। আশ্চর্য ব্যাপার, মেজবউদি বাড়িতে আসার পর কিছুদিন মা ছিলেন তার দিকে, এখন মেজবউদি তার চক্ষুশূল। সব সময় মা কথা বলেন বড়বউদির পক্ষ নিয়ে।
মেজদা একটু অদ্ভুত রকমের মানুষ। ও যে কখনও বিয়ে করবে তা কেউ ভাবেনি। প্রেম করার ব্যাপারটা তো বিশ্বাসেই আসেনি প্রথমে। একটু বেহিসাবী, খামখেয়ালী, পাগলাটে ধরনের মানুষ হিসাবেই সকলে জানত ওকে। যেটা মাথায় আসবে তাই করবে। বিবেকানন্দর বই পড়া থাকায় যখন তখন তার বাণী আওড়াত। পার্ট ওয়ান পর্যন্ত পড়ে ওর মনে হয়েছিল লেখাপড়া ওর জন্যে নয়। ব্যবসাপত্তর করলে কেমন হয়? বাবার কাছে টাকা চেয়েছিল। পায়নি। দাদাও দিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত চার বন্ধু একসঙ্গে ট্রাভেলিং এজেন্সি করেছে। ট্রাভেলিং এজেন্সি বলে বটে তবে ওটা তীর্থ স্পেশ্যাল। মেজদা ওয়ার্কিং পার্টনার। রাজগীর নালন্দা থেকে হরিদ্বার হৃষিকে নিয়ে যায় পার্টি যোগাড় করে। কত থাকে কি পায় কেউ জানে না। তবে মাসে চারশো টাকা মায়ের হাতে দিচ্ছে ছমাস। মাসের পঁচিশ দিন তাকে ওই কাজে বাইরে কাটাতে হয়। অর্থাৎ দুজনের টাকায় একজন খায়। গত মাসে তাকে টাকা বাড়াবার কথা বলায় সে সবাইকে শুনিয়ে জবাব দিয়েছিল, আমি বাড়ির সবচেয়ে খারাপ ঘর নিয়েছি। পুরো টাকা দিয়ে পঁচিশ দিন একজন খাচ্ছি না। এরপর টাকা চাইছ কোন্ মুখে! এতকাল এইসব কথা বলিনি, এখন বলব। তবে হ্যাঁ, তোমরা আমার বউকে যা ইচ্ছে বলতে পার, আমি তাকে বলে দিয়েছি সে যেন কোন প্রতিবাদ না করে। তোমরা যা বলবে তা রেকর্ড করে রাখবে, আমি এসে শুনব। কেউ কারও ঘরে ঢোকে না। বড়বউদির ধারণা হয়েছিল মেজর ঘরে বোধ হয় টেপ রেকর্ডার আছে। বড়দা বলেছিল, বাইরে বাইরে ঘোরে, টানামাল নিয়ে আসতে পারে। মেজদা চলে যাওয়ার পর মা মেজবউদিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হ্যাগো, তোমরা আবার কবে টেপ রেকর্ডার কিনলে? এক বাড়িতে আছ যখন, তখন দেখাতেও তো পার!
মেজবউদি অবাক হয়ে বলেছিল, ওমা, কে বলেছে আমরা টেপ রেকর্ডার কিনেছি?
কেন, তোমার স্বামী যে বলল সেদিন।
আপনি তো ওকে চেনেন মা, কি বলতে কি বলে!
মিছে কথা বলছ না তো বাপু?
আপনি ঘরে এসে দেখুন।
তারপর থেকে আবার সোচ্চারে সংলাপ বলা হচ্ছে। মেজবউদির সঙ্গে তেমন কথাবার্তা হয় না কল্যাণের। খাবার দেওয়া নেওয়ার সময় যেটুকু! সুন্দরী তো নয়ই, তবে সুশ্রী বলা যায়। তবে অত্যন্ত রোগা। মেজদার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হবে। এই মেয়ে যে কি করে মেজদার প্রেমে পড়ল তা কল্যাণ আজও ভেবে পায়নি। প্রেম করার মত কোন গুণ মেজদার নেই। মেজদাদের টুরিং পার্টির সঙ্গে গিয়েছিল মেজবউদির বাবা মেয়েকে নিয়ে। হরিদ্বারে গিয়ে ভদ্রলোক খুব অসুখে পড়েন। দল চলে আসার সময় তাকে রেখে আসতে হচ্ছে বলে মেজদা থেকে গিয়েছিল। একটু সুস্থ হয়ে ভদ্রলোক বলেছিলেন তিনি রিটায়ার করতে যাচ্ছেন। স্ত্রী নেই। একটি মেয়েকে নিয়ে চিন্তা। টাকাও নেই যে ওই রোগা মেয়ের বিয়ে দেবেন। মেজদা বলেছিল খাওয়াপরার দায়িত্ব সারাজীবনের জন্যে নিলে তিনি কি মেয়ের বিয়ে তার সঙ্গে দেবেন? মেজদার সেবা পেয়ে ভদ্রলোক এমন কৃতার্থ ছিলেন যে না বলতে পারেননি। আর সাতদিন একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে দাদার নাকি বউদিকে ভাল লেগে গিয়েছিল। মেজবউদি হরকে পিয়ারীর ঘাটে দাঁড়িয়ে বলেছিল, বাবার যদি কিছু হয় তাহলে আমার কি হবে? তখন দাদা নাকি হাত ধরে বলেছিল, কেন, আমি আছি। আমাকে তুমি পছন্দ করবে বিনীতা?
মেজবউদি নাকি জবাবে এত মাথা নুইয়েছিল যে চিবুক গিয়ে বুকে ঠেকেছিল। এখনও এই বাড়িতে মেজবউদি ওই একই ভঙ্গিতে কাজ করে যায়। সিনেমা থিয়েটার দূরের কথা, বাপের বাড়িতে যাওয়ার সময় সুযোগ হয় না। সুজনের সঙ্গে মেজবউদির বেশ ভাব। বয়সে সুজন বছর খানেকের ছোট হবে। তাই নিয়ে বড়বউদির খোটা শুরু হয়েছে সুজনের অসাক্ষাতে।
সুজন ওদের ছোটভাই। মাধ্যমিক পাস করতে পারেনি। দুবার চেষ্টা করেছিল। এখন কান ঢাকা চুল, ঘাড়ের কাছে ঈষৎ বাবরি, অমিতাভ বচ্চনের মত একটা প্যাটার্নও এবং ওর বন্ধুদের মধ্যে চালু। মাস্তানি করার প্রবণতা আছে কিন্তু পার্টি করে। এ পাড়ার অনেক বেকার ছেলে পার্টি করার দৌলতে চাকরি পেয়েছে। পাসটাস করা থাকলে সুজনও পেয়ে যেত অ্যাদ্দিনে। কিন্তু মাধ্যমিক ফেল করা যোগ্যতা নিয়ে যে চাকরি পাওয়া যায় তা সে করবে না। কিন্তু তার আয় আছে। কোথেকে টাকা পায় কোনদিন জিজ্ঞাসা করেনি কেউ। কল্যাণের ঘরেই সে শোয় যদি রাতে ফেরে। প্রত্যেক মাসে একশ টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বলে, বিয়ে করলে চারশো দেব নইলে একশ। প্রায়ই সে কল্যাণকে শোনায়, দাদা তুই বি. এ. পাস কর, তোর চাকরির জন্যে আমি বলে রেখেছি।
কাকে বলেছিস? কৌতুক বোধ করত কল্যাণ।
অভিরামদাকে। নেক্সট ইলেকশনে পার্টির ক্যান্ডিডেট হচ্ছে।
কেন, এখন যে এম এল এ আছে সে কোথায় যাবে।
বুড়া হয়ে গেছে বহুত, চেয়ারম্যান বলেছে তরুণদের সুযোগ দেওয়া হবে।
তোর কি হবে?
আমার লাইন ফিট করা আছে। হাওয়া খারাপ বুঝলে পাল্টি খাব।
পাল্টি খাবি?
ইয়েস। ওই পার্টি থেকে দর দিচ্ছে আমাদের। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের প্লেয়ার ভাঙানোর কথা শুনিসনি? যে মাল দেবে আমরা তার প্লেয়ার।
কল্যাণ খানিক চুপ করে থেকে বলেছিল, আচ্ছা সুজন, তোর কখনও মনে হয়, এই সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার যদি পালটে যেত তাহলে কেমন হত?
অ্যাই দাদা, মজাকি করিস না। সব শালা বড়দা বড়বউদির মত। ওসব ফালতু ইমোশন কারও নেই। কেউ কিছু পালটাবে না। অতবড় নকশালরা হাপিস হয়ে গেল। মা কামাও জিন্দা রহ। এই হল শ্লোগান।
শ্লোগান?
চেঁচিয়ে বলি না। বন্দে জিন্দাবাদ!
সুজন, এই বাড়িটাকে তোর কেমন মনে হয়?
চোখ কান বুজে রাত কাটানোর পক্ষে ফাইন জায়গা।
মায়ের হাতে কল্যাণ দেয় দেড়শ টাকা। প্রত্যেক সকালে তাকে টিউশনি করতে যেতে হয়। দুটি এইট মাইনের মেয়েকে সপ্তাহে ছদিন পড়ালে মাসে দুশো টাকা পাওয়া যায়। কলেজের খরচ লাগছে না। নাম্বার কি করে ভাল হল কল্যাণ জানে না কিন্তু প্রেসিডেন্সিতে ভরতি হতে মোটেই অসুবিধে হয়নি।
অর্থাৎ হাজার পঞ্চাশ টাকায় মাকে এই সংসার চালাতে হয়। আটজন মানুষ ওই টাকায় খায়। সপ্তাহে একদিন মাছ আসে। কলকাতার বাজার দর এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে তাতে মা কি উপায়ে যে তাদের তিরিশ দিন খাবার বেড়ে দিচ্ছেন তা সত্যি গবেষণার বিষয়। ভাত ডাল সেদ্ধ আর তরকারি। তাই বা জোটে কিভাবে! বাড়িভাড়া, ইলেকট্রিক বিল থেকে আরও দশটা খরচ আছে। এইসব ভাবলে মায়ের জন্যে এক ধরনের কষ্ট হয় কল্যাণের। চিরকাল মহিলা অভাবের সঙ্গে লড়াই করে গেলেন। তবু বাবা চাকরিতে থাকতে তাকে সহজ মনে হত। যেন রাশটা ভাল ধরা থাকত। কিন্তু বড়বউদি অন্যায় করছে দেখেও তার সঙ্গে নিজেকে জুড়ে দেওয়া কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। মা জানেন বড়দাকে চটিয়ে এখন থাকা যাবে না। মেজছেলের চাকরি নয়, অর্থাগম নিয়মিত হবেই এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। ছোট দুজন চাকরি করে না। এই সময় মাকে সুজনের মতই মনে হয়। যে ক্ষমতায় তার দিকে পাল্লা ঝুলিয়ে থাকা।
এই বাড়ি কল্যাণকে কিছু দেয়নি। শুধু পরিচয় ছাড়া। স্কুল-জীবনে তার কখনও মাইনে লাগেনি। বইপত্র পেয়েছে চেয়েচিন্তে বা কখনও স্কুলের অনুগ্রহে। প্রেসিডেন্সিতে পড়ে, এখনও তার ভাল লোশাক বলতে একটা জিনসের প্যান্ট আর হ্যান্ডলুমের শার্ট। বেশির ভাগ সময় পাজামা আর খাদির পাঞ্জাবি পরে। ইদানীং সিগারেট খায় মাঝেমধ্যে। কলেজে ঢুকে প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিল আনন্দর সঙ্গে। তারপর সেইসূত্রে সুদীপ আর জয়িতা। অন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তার এক ধরনের কমপ্লেক্স কাজ করে। তিন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারার সময় সেটা হয় না। জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষা দেয়নি কল্যাণ। দিয়ে লাভ হত না। যদি মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সুযোগ পাওয়াও যেত তাহলে সেই খরচ কে টানতো? এখন আরও কয়েক বছর পড়াশুনা করলে অধ্যাপনা কিংবা মাস্টারির ক্ষীণ সুযোগ আছে। আর বি. এ.-টা পাস করলে বি সি এস দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এসব করে কি হবে! আনন্দ ঠিকই বলে। যেজন্যে গরু পোষে মানুষ, যত্ন করে শিশুকাল থেকে খোল-বিচুলি খাওয়ায়, তেমনি করে আমরা তৈরি হই একটা ডিগ্রি পাওয়ার জন্যে। সেই মোক্ষলাভ হলেই যদি চাকরি ভিক্ষে পাওয়া যায় তো প্রথমে কাছের আত্মীয়দের উপকার, পরে নিজের সংসার তৈরি করার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। এই করতে করতে একদিন বুড়ো হয়ে মরে যাওয়া। আর এই সময় যত অন্যায় অবিচার মুখ বুজে সয়ে যাওয়া, নইলে নিজের দেওয়াল ভেঙে পড়তে পারে। শুধু স্বার্থপর হওয়ার জন্যে পড়াশুনা করে চাকরি জোটানো। কিংবা এদেশের ছেলেদের কিছু করার পথ খোলা নেই বলেই পড়াশুনা নামক নিয়মটার মধ্যে আটকে থাকা। কল্যাণ এতদিন কলেজ করে স্পষ্ট বুঝে গেল তেমন কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যাবে। এবং তারপর সে তো শিক্ষিত মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হবে। কিন্তু সে নিজে জানে তার কিছুই জানা নেই। যে বিষয় নিয়ে সে অনার্স পড়ছে তার কয়েকটা অধ্যায়, বাঁধাধরা প্রশ্ন এবং কিছু বাড়তি নোটস তাকে বৈতরণী সসম্মানে পার করে দেবে। এই শিক্ষার কোন মানে হ। একটা সুপরিকল্পিত চালাকির মধ্যে তাদের প্রতি বছর ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আর তারা সেই খাতে ঘোলা জল হয়ে বয়ে যাচ্ছে।
কি হল, কলেজ নেই?
কল্যাণ আবার বিছানায় ফিরে এসেছিল। মুখ ফিরিয়ে মাকে দেখল। নিচু গলায় বলল, আছে।
কখন গিয়ে উদ্ধার করবে?
যাব না আজকে।
কেন? কিছু হয়েছে নাকি? মুখচোখ ওরকম কেন?
জানি না। হয়েছে কিছু। তোমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে?
অনেকক্ষণ। তোমার জন্যে ভরদুপুরে কেউ চা করতে পারবে না। শোন, তুমি পড়াশুনা করছ বলে আমি কিছু বলতে পারছি না। কলেজে যদি না যেতে ইচ্ছে করে তাহলে চাকরির চেষ্টা করো। সুজন বলছিল ও নাকি ইচ্ছে করলে পার্টিকে বলে চাকরি পাইয়ে দিতে পারে।
বিরক্ত কোর না। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
তোমাদের সঙ্গে কথা বললেই বিরক্ত হও। আমি কি করে সংসার চালাব বলতে পার? একজন তো বিয়ে করে আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন কন্যাকুমারিকা।
তুমি খামোকা মেজবউদির পেছনে লাগছ। অবশ্য এটা তোমাদের ব্যাপার।
মা যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন, আমি কি করছি না করছি তা নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিজেরটা দ্যাখো। মনে হচ্ছে জ্বরটর বাধিয়েছ, ওষুধ আনাব?
দরকার নেই। শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।
ভাত খাবি কি খাবি না?
না।
চোখ বন্ধ করে কল্যাণ পড়ে রইল অনেকক্ষণ। ঠিক কখন মেজবউদি ঘরে ঢুকেছিল টের পায়নি। নরম গলায় শুনতে পেল, চা।
শব্দটাকে অমৃত বলে মনে হল। চোখ খুলে সে জিজ্ঞাসা করল, কি দরকার ছিল?
মা পাঠিয়ে দিলেন। মেজবউদি বলে চলে যাচ্ছিলেন।
কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, মেজদা কবে ফিরবে?
জানি না। কেন?
তোমার ওপর যা ঝড় যাচ্ছে তা সামলানো দরকার।
এসব জেনেই তো এসেছি। মেজবউদি চলে গেল।
চা খাওয়া শেষ হলে বাবা দরজায় এসে দাঁড়ালেন, জুর কত?
দেখিনি। বেশি নয়। কল্যাণ উঠে পাঞ্জাবিটা টেনে নিল।
শুনলাম কলেজে যাবি না?
হ্যাঁ।
শরীর নিশ্চয়ই খুব খারাপ নইলে কামাই করবি কেন?
কল্যাণ জবাব না দিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিচ্ছিল।
কোথায় বেরুচ্ছিস?
কাছেই।
কলু, তোকে নিয়ে আমার কত গর্ব। আমার বংশে কেউ ফার্স্ট ডিভিশনে স্টার পেয়ে পাস করেনি। কোনরকমে বি. এ.-টা পাস করে সরকারি পরীক্ষা দিয়ে দিলেই ঈশ্বরের আশীর্বাদে চাকরি পেয়ে যাবি।
তাতে তোমার কি লাভ হবে?
মানে? বাবা যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন।
চাকরি করে তোমাদের হাতে চারশো টাকা ধরিয়ে দেব প্রতি মাসে বড়দা যেমন দেয়? তখন তোমার এই গর্ববোধটা থাকবে?
তা থাকবে। বলতে পারব তো চিরকাল আমার সেজ ছেলে স্টার পেয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। তবে কিনা একটা কথা, সন্তান তার আচরণের মাধ্যমেই পিতামাতার স্নেহ অথবা ভয় আদায় করে নেয়। তোমার দুই দাদার সঙ্গে তোমার তো চরিত্রের পার্থক্য থাকবেই। হাতের পাঁচটা আঙুল সমান নয়। ঝাঁপসা চোখে শীর্ণ বৃদ্ধ দরজায় একটা হাত রেখে যেন খুব গূঢ় তত্ত্ব বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন।
বাবা, তোমার কারও ওপর রাগ হয় না? আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ল কল্যাণ।
হয়। নিজের ওপরে হয়। কেন বাবা?
আর কারও ওপর হয় না? তোমার চারপাশে এত অন্যায় ঘটছে!
হয় না। ভোররাত থেকে কেরোসিনের লাইনে গড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে যায় অথচ দেখি সুজনের বন্ধুরা লাইন কন্ট্রোল করার নামে ব্ল্যাক করছে সমানে, তখনও রাগ হয় না। মনে হয় এই যে দাঁড়িয়ে আছি তাতেও তো সময় কেটে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির অনিলবাবু বলছিলেন, আপনার চিন্তা কি। ছেলে প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে, ভাল চাকরি পাবেই। আমি তখন খুশী হই। দ্যাখো, সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, এখন আর রাগারাগি করে কি লাভ বল! তোমার কি খুব জ্বর বেড়েছে? মুখ চোখ লাল কেন?
ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়।
তোমার মায়ের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ো না। যাকে সব সামলাতে হয় তার মাথা ঠিক থাকে না। মানুষটা কোনদিন আরাম পেল না। আমিও দিতে পারিনি, এরাও পারল না।
কল্যাণ বলতে চাইল, আমার ওপর এত ভরসা কোর না বাবা। কারণ এইভাবে ইঁদুরের মত বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না আমার। কিন্তু তার জিভ আড়ষ্ট হল। বাবার পাশ কাটিয়ে সে চুপচাপ বেরিয়ে এল বাইরে। কল্যাণের মনে হচ্ছিল এইভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। বাবার জন্যে কষ্ট হয়, মায়ের জন্যেও, যে মেজবউদি এই সেদিন এল তার জন্যেও। কিন্তু সেসব কষ্ট আলাদা আলাদা। যখন সব মিলিয়ে দেখা যায় তখন আর কষ্টটা থাকে না। বরং তার বদলে একটা ক্রোধ আসে। প্রত্যেককেই স্বার্থপর বলে মনে হয় তখন। এইখানে একটু হোঁচট খেল কল্যাণ। মেজবউদিকে ঠিক স্বার্থপর বলার কোন কারণ এখনও পায়নি। কিন্তু ওই যে সব সহ্য করে এঁটুলির মত এই সংসারে লেগে থাকা তার মধ্যেও এক ধরনের জেদ কাজ করে যা কল্যাণের মোটেই পছন্দ নয়।
বেশ রোদ উঠেছে। গলি থেকে বেরিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল কল্যাণের। চা খেয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু সেটা যে খুব সাময়িক তা বুঝতে পারেনি। কল্যাণ ধীরে ধীরে হেঁটে মোড়ের মাথায় চলে এল। বঙ্কিমদা তখন দোকান খুলে সবে বসেছে। এখনও খদ্দের আসেনি। কল্যাণকে দেখে বলল, কি হয়েছে? জ্বর?
কল্যাণ মাথা নাড়ল, বোধ হয়। কাল রাত্রে ঠিক ছিলাম, আজ সকালে উঠে দেখি কিন্তু এটাকে আজই সারিয়ে ফেলতে হবে। কালকের মধ্যে ফিট হতে হবে।
বঙ্কিমদা হাসল, ঠিক আছে। ভেতরে এসে বোস। আমি তোর জুরটা দেখি। ডাক্তার না হয়েও তোর জন্যে ডাক্তারি করছি, পুলিস জানলে–।
এই সময় একজন বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন কাউন্টারে, কাল থেকে ছবার বাহ্যি গিয়েছি। একটা ওষুধ দাও তো।
কি ওষুধ দেব?
সে আমি কি জানি? তুমি যা ভাল বোঝ তাই দাও।
বঙ্কিমদা কয়েকটা ট্যাবলেট এগিয়ে দিয়ে কিভাবে খেতে হবে বুঝিয়ে পয়সা নিল। কল্যাণ বলল, তুমি তো ডাক্তারদের বারোটা বাজাবে, দোষ দিলে আমাকেই।
জ্বর বেশি নয়। এক পয়েন্ট চার। ওষুধ খাইয়ে বঙ্কিমদা বলল, বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাক। দুপুর বিকেল রাত্রে বাকিগুলো খেয়ে নিস।
কিন্তু কাউন্টারের ভেতরের চেয়ারে বসে থাকতে ভাল লাগছিল কল্যাণের। এখান থেকে রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। তাছাড়া প্রতি মুহূর্তে ওষুধ কিনতে লোক আসছে। তাদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে ভুলে থাকা যায়। সে বঙ্কিমদাকে বলল, আমি একটু বসি বঙ্কিমদা।
বোস্। বঙ্কিমদা খদ্দের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
তখনই মনে পড়ল আজ সকালে টিউশনিতে যাওয়া হল না। বুড়ো খুব খচবে। কাউকে দিয়ে খবর দেওয়াও সম্ভব নয়। খুচুক বুড়ো, অসুখ-বিসুখ কাউকে নোটিস দিয়ে আসে না। কল্যাণ দেখছিল খদ্দেরদের। কতরকমের অসুখ মানুষের হয়। বিচিত্র সব নামের ওষুধ। প্রেসক্রিপসন দেখে বঙ্কিমদা চটপট বলে দিচ্ছে আছে কি নেই। আধ ঘণ্টা বাদে সে জিজ্ঞাসা না করে পারল না, আচ্ছা বঙ্কিমদা, তুমি কতগুলো ওষুধের নাম জানো?
একজন ভদ্রমহিলাকে প্যাকেট দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বঙ্কিমদা, মানে?
যে যা চাইছে ফটাফট দিয়ে যাচ্ছ কিংবা নেই বলছ, এত মনে থাকে?
অব্যেস বৎস অব্যেস। মাথা নেড়ে বঙ্কিমদা আর এক খদ্দেরকে বলল, ওষুধটা নেই। তবে একই জিনিস অন্য কোম্পানির আছে, দেব?
লোকটি আপত্তি জানিয়ে চলে গেল। বঙ্কিমদা চাপা গলায় বলল, ডাক্তারের কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসবে। ডবল খাটুনি।
কেন?
আগের ওষুধটা বন্ধ হয়ে গেছে সে-খবর ডাক্তার জানে না।
তুমি তো বেশ জানো।
আঃ এ ছোঁড়া তো দেখছি বড্ড জ্বালাচ্ছে!
বেশ বেশ, আমি উঠছি। কল্যাণ হাসল।
আমি উঠতে বলিনি। চা চলবে?
চলতে পারে। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। ওষুধের গুণেই হোক কিংবা এই ওষুধের ভিড়ে বসেই হোক এখন একটু ভাল লাগছিল কল্যাণের। এইসময় সে শুভব্রতকে দেখতে পেল। শুভব্রত এ পাড়ায় থাকে না। কল্যাণ হাসল, কি খবর?
আরে কল্যাণ! ব্যাপারটা কি বল তো?
কিসের ব্যাপার?
তুমি তিন মাস হঠাৎ ড়ুব মারলে কেন? বিমলেশদা তোমাকে খুব খুঁজছে। বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিল। খুব ভাল লোল ছিল তোমার নেক্সট নাটকে। কি হয়েছে?
কিছু না।
তুমি কি আর গ্রুপে যাবে না বলে ঠিক করেছ?
হ্যাঁ।
কেন?
ব্যাপারটা ব্যক্তিগত। বিমলেশদা বা তোমাদের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। আসলে আমার ভাল লাগছে না কিছু।
শুভব্রত একটু বাঁকা হাসল, গ্রুপ থিয়েটার করার মত মানসিকতা সবার থাকে না। ঠিক আছে, চলি। কল্যাণ ওর চলে যাওয়াটা দেখল। তারপর মাথা নেড়ে গলা তুলে বলল, বঙ্কিমদা চা থাক, আমি বাড়িতে যাচ্ছি।
আরে এসে গেল বলে! কাউন্টারের ভেতর থেকে চেঁচালো বঙ্কিমদা।
না থাক। হাঁটতে হাঁটতে কল্যাণ বুঝল তার শরীরে যে সুস্থবোধটা ফিরছিল শুভব্রতর সঙ্গে কথা বলার পর তা উধাও হয়েছে। আবার মাথাটা টিপটিপ করছে, হাত পা কামড়াচ্ছে, সমস্ত শরীরে ম্যাজম্যাজানি। আজ সারাটা দিন তাকে পড়েই থাকতে হবে।
গলির মুখে আসতেই বাবাকে উদভ্রান্তের মত বেরিয়ে আসতে দেখল। তাকে দেখতে পেয়েই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, সর্বনাশ হয়েছে, বড় বউমার হাত পুড়ে গেছে।
সেকি! কি করে হল?
রান্না করতে গিয়ে। আমি বঙ্কিমের দোকানে যাচ্ছি ওষুধ আনতে। তারপর একটু থেমে বললেন, সঙ্গে তো বেশি পয়সা নেই, বঙ্কিম যদি–।
আমার কথা বলল, আমি দাম দিয়ে দেব বঙ্কিমদাকে।
আশ্বত হয়ে বাবা ছুটলেন দোকানের দিকে। কল্যাণ বাড়িতে ঢুকে দেখল তুলকালাম কাণ্ড চলছে। বড়দা চিৎকার করছে, মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে। শুধু মেজবউদির অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সুজনের উপস্থিতি টের পাওয়া গেল।
সুজন বলছে, রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়েছে, এ নিয়ে এত চিলবার কি আছে। বাড়িটা মাইরি নরক হয়ে গেল!
সঙ্গে সঙ্গে বড়দা বেরিয়ে এল ঘর থেকে, চোপ। বড়দের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানোনা? রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছে, ইচ্ছে করে উনুনের ওপর এমন ভাবে সসপ্যানটা রেখেছিল যাতে ছুঁলেই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়।
কে রেখেছিল? সুজন একটু থিতিয়ে গেল যেন।
মেজ। এই পনেরো দিন তার ডিউটি নয়। বিপাকে পড়ে বলেছিলাম রান্নাঘরে যেতে। মা তীব্রস্বরে জানালেন।
কেন বলবে? তুমি যখন দুই বউকে মাসটা ভাগ করে দিয়েছ তখন কেন মেজবউদি যাবে? মেজবউদির পালা এলে কি বড়বউদি কখনও রান্নাঘরে ঢোকে?
সে বিষয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। মা ঝাঁজিয়ে উঠলেন।
এবার কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, বড়বউদির হাত কিরকম পুড়েছে?
বড়দা বলল, কি রকম মানে? আমি কি ডাক্তার?
বেশি পুড়লে হাসপাতালে নিয়ে গেলেই হত। বাবাকে কেন ছুটতে হল বঙ্কিমদার কাছে? দায়িত্বটা কার ছিল?
দায়িত্ব শেখাচ্ছে আমাকে? আমি যদি এক সময় টাকা বন্ধ করতাম তাহলে না খেয়ে মরত সবাই। দায়িত্ব! বড়দা ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল।
সুজন হঠাৎ বলে বসল, আমার কেসটা গড়বড়ে লাগছে। কই দেখি, বড়বউদির হাত কি রকম পুড়েছে!
বড়দা ঘুরে দাঁড়াল, তার মানে? তুই সন্দেহ করছিস? মা দ্যাখো, কিরকম অপমান করছে আমাদের। এর পরে আমার কি করা উচিত?
সুজন বলল, অপমান? আরে দেওর হিসেবে বউদির হাত দেখতে চাওয়া কি অপমান করা? মা তুমি কি বল?
এবার মায়ের গলায় কান্না এল, আমার আর এই বাড়িতে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না। কি ভুল করেছি বিয়েতে সম্মতি দিয়ে।
সম্মতি না দিলে চারশো টাকা লস করতে প্রত্যেক মাসে।
এই সময় বাবা ফিরে এলেন মলম হাতে, এই যে নাও, ভাল করে হাতে লাগিয়ে দাও। তবে বঙ্কিম বলল বেশি পুড়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কতটা পুড়েছে?
মা বাবার হাত থেকে মলমটা টেনে নিয়ে বললেন, হাসপাতালে যেতে হবে না।
তারপর বড়দার দরজায় এগিয়ে গিয়ে বললেন, এইটে লাগিয়ে দেখোকা। দেখিস বেশি চাপ যেন পড়ে।
বাবা কল্যাণের দিকে তাকিয়ে বললেন, বঙ্কিম আমার কাছ থেকে পয়সা নিল না। বলল, আপনার ছেলের কাছ থেকেই নেব।
সুজন হা হা করে হাসল, যাঃ বাবা, সেজদা তোরই তাহলে চোট গেল!
চোট কেন বলছিস? কল্যাণ নিজের ঘরের দিকে এগোল।
যাকে নিয়ে এত, কেন তাকে একবার নিজে দেখনি?
কাকে?
যার হাত পুড়েছে! আসলে পোড়েইনি, সব ভাঁওতা। এই হাত পোড়ার নাম করে দিব্যি পনেরো দিন কাটিয়ে দেবে খাটে বসে। রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না। মেজবউদিকে তখন হেঁসেল ঠেলতে হবে। সব ট্যাটিস বোঝা আছে আমার?
বাবা বললেন, কি বলছিস তুই?
সুজন বলল, মিথ্যে বলছি কিনা বড়বউদি বাইরে এসে প্রমাণ দিক। হাতে কাপড় জড়িয়ে এলে চলবে না। কই আসুক।
এতক্ষণে বড়দার ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ এল, মাস্তানি করছে তোমার ভাই। বলে দাও এটা মাস্তানির জায়গা নয়। মেজর সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক তা কি আমার জানতে বাকি আছে!
হঠাৎ সব চুপচাপ হয়ে গেল একটু সময়। তারপর সুজনের হো হো হাসি শোনা গেল, মা, তোমার বড়বউকে পার্টি করতে বল, হেভি টপে যাবে।
কেউ উত্তর দিল না। যে যার ঘরে চলে গেল। কল্যাণ মেজদার ঘরের দিকে তাকাল। সেখানে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে আর পারছিল না, ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সুজন জিজ্ঞাসা করল, তোর কিছু হয়েছে সেজদা?
হ্যাঁ, জ্বর।
ওষুধ খেয়েছিস? বাড়িটা ক্রমশ নরক হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে যে সটকাব তার উপায় নেই। একশ টাকায় কে আমাকে থাকা-খাওয়া দেবে, বল্?
কল্যাণ জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করল।