গ্রামের খালটির কথা প্রায়ই মনে হয়, যে খালটি রৌহার বিলের পানি থেকে উৎসারিত হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে একটি হাতের আঙুলের মতো বিস্তৃত হয়ে গেছে। যে পূর্ণিমা রাতে মফিজুদ্দিন মিয়া নিহত হয়, তারপর ক্রমান্বয়ে গ্রামের লোকেরা সব জানতে পারে এবং তখন তারা এই তথ্যটি অবগত হয় যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার আততায়ীরা এই খাল বেয়ে উঠে আসে। গ্রামের লোকেরা এই কথা বলে যে, পুলিশ জানতে পেরেছে, ঘটনার দিন ধানঘড়ার উত্তরে শিমলা গ্রামের পাশে করতোয়া নদীর পশ্চিম কিনার ঘেঁষে ছটি নৌকো সারা দিন পড়ে থেকে কুমিরের মতো রোদ পোহায়, তারপর রাত গভীর হয়ে এলে ছৈতোলা মাঝারি আকারের এই নৌকোগুলোকে কেউ কেউ দেখে দড়ি খুলে নিঃশব্দে ভাটির দিকে নেমে যেতে। নৌকোগুলো ধানঘড়া বাজারের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত নেমে আসার পর পূর্ব দিকে প্রবাহিত খালে প্রবেশ করে, তারপর লক্ষ্মীকোলা গ্রামের কাছে রৌহার বিলের ভেতর পড়ে, এখান থেকে নৌকোগুলো বিলের পানির ওপর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মিয়াবাড়ির পেছনে খালের ধারে ভেড়ে; এবং আততায়ীদের আগমন-পথের কথা শুনে সুহাসিনীর লোকেরা অদৃষ্টের এই পরিহাসের বিষয়ে সচেতন হয় যে, সুহাসিনীর এই খালতে মূলত মফিজুদ্দিনই কেটেছিল। সুহাসিনীর প্রবীণ লোকদের তখন তাদের শৈশবের কথা মনে পড়ে, যখন প্রতি বছর খরায় তাদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল এবং যখন একদিন মফিজুদ্দিন এবং তার যুবক বন্ধুরা মিয়াবাড়ির বৈঠকখানায় বসে সলাপরামর্শ করার পর কোদাল হাতে মাঠের মাঝখানে গিয়ে ডাক দেয় এবং তারপর গ্রামের তাবৎ লোক কোদাল হাতে করে মফিজউদ্দিনের পিছন পিছন রৌহার বিলের দিকে এগিয়ে যায়। তাদের মনে পড়ে, সেদিন মহির সরকারের ভিটা এবং মিয়াবাড়ির মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গিয়ে রৌহার ধারে পৌছে মাটির বুকে কোদালের কোপ বসিয়ে দিয়ে মফিজুদ্দিন বলে, কাটো; তখন সুহাসিনীর খরাপীড়িত কৃষকেরা ধপাধপ শব্দ করে মাটি কাটতে শুরু করে এবং তারা যখন খালটি জাহাঁ বক্সের বাড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে আনে, তারা দেখে যে, খালের ঠিক মাথায় আসকার আলির ভিটা পড়ে যায়, তারা তখন মাটি কাটায় ক্ষান্ত দিয়ে মিয়াবাড়িতে উঠে আসে এবং উঠোনে বসে তামাক টানে এবং তখন মিয়াবাড়ির বৈঠকখানায় মাটির মেঝের উপর কয়লা দিয়ে আঁক কষে মফিজুদ্দিনসহ সাত জন যুবক ঠিক করে খালের ধারা কোন দিক দিয়ে কোন দিকে যাবে; পরিণতিতে সুহাসিনীর মাঠের ভেতর দিয়ে, মিয়াবাড়ির বৈঠকখানার লেপা মেঝেয় আঁকা নকশার মতো, পানি ভরা একটি বিস্তৃত খাল ফুটে ওঠে। সুহাসিনীর লোকেরা, এখন, যখনই এই ইতিহাস স্মরণ করে, তারা বলে যে, তাদের গ্রামের খাল, যে খালটি রৌহার বিল থেকে উৎপন্ন হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে হাতের পাঁচটি আঙুলের মতো প্রবাহিত, তাদের পূর্বপুরুষেরা চার বছর পরিশ্রম করে খনন করেছিল। তারা তাদের বয়স্ক আত্মীয়দের কাছ থেকে, যারা এই খাল কাটায় অংশ নিয়েছিল, শুনেছিল যে, নয়নতারার হাট লাগানো এবং তারপর খরাপীড়িত লোকদের জন্য এই খাল কাটার কাজের দ্বারা মফিজুদ্দিন সুহাসিনীতে তার স্বাভাবিক নেতৃত্বের গুণ প্রকাশ এবং প্রতিষ্ঠা করতে পারে; কিন্তু তারা এ কথাও ক্রমাগতভাবে জানতে পারে যে, দীর্ঘদিন পূর্বে সুহাসিনীর বাড়িঘর এবং ফসলের মাঠের ওপর দিয়ে কাজিদের পাগলা কুকুর তাড়া করে ফেরার ঘটনার ভেতর সুহাসিনীর লোকেরা মফিজুদ্দিনের যে একরোখামি একদা দেখেছিল, তা মফিজুদ্দিনের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত টিকে থাকে এবং পরবর্তীকালে অনেক সময়ই তা সুহাসিনীর লোকদের জন্য সুখকর হয় না। সুহাসিনীর প্রবীণ লোকেরা বলে যে, খরার বছরগুলো আঙুলের মতো বিস্তৃত খাল বেয়ে রৌহার পানি জীবনের আশ্বাসের মতো গ্রামের চতুর্দিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল, যেন করুণাময়ী মায়ের একটি শীতল হাত স্থাপিত হয়েছিল সুহাসিনীর মাথার ওপর। কিন্তু পরবর্তী সময়ে খালের পানির আশীর্বাদের বিপরীত দিকটি সুহাসিনীর লোকদের নিকট প্রকাশিত হয়, যখন করতোয়া নদীর বন্যার পানি রৌহার বিল থেকে খালের ভেতর দিয়ে জেগে উঠে তাদের ফসলের মাঠ এবং বসতবাড়ি প্রতি বছর প্লবিত করে দিতে থাকে। তখন একটা কিছু করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং সুহাসিনীর লোকেরা ভাবে যে, মফিজুদ্দিন হয়তো কিছু একটা করবে, কিন্তু মফিজুদ্দিন এবার কিছু করে না; বরং গ্রামের লোকেরা দেখে যে, মফিজুদ্দিন এই খাল কাটার কীর্তির কথা ক্রমাগতভাবে বলে চলে। তখন অনেক দিন অপেক্ষা করার পর গ্রামের লোকেরা মিলিত হয় এবং মফিজুদ্দিন ও সেই ছজন লোককে, যারা অনেক দিন আগে একদা মিয়াবাড়ির বৈঠকখানায় বসে এই খালের ছক কেটেছিল, তাদের এই নূতন দুর্গতির বিষয়ে কিছু একটা করতে বলে; তারা তাদেরকে বলে যে, সেচের পানি পাওয়ার চাইতে বানের পানি আটকানো এখন জরুরি হয়ে পড়েছে, এই খালটি তাই ভরাট করে ফেলা দরকার। খাল কাটার মূল স্থপতিদের ভেতর মফিজুদ্দিন ছাড়া অন্য ছজন বিবেচনা করে দেখে যে, বহুদিন গ্রামে খরা নাই, বরং প্রতি বছর বন্যার পানির প্রকোপ হয়; তারা তখন ভাবে যে, এই ক্রমাগত বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য খালের উৎসস্থল ভরাট করে দেয়া যায়, তাহলে রৌহা বিলের পানি বর্ষার সময় খালে প্রবেশ করে ফসলের মাঠে উপচে পড়া বন্ধ হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা কার্যকর করা যায় না, কারণ, মফিজুদ্দিন এই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সম্মত হয় না, এই খাল বন্ধ না করে দেয়ার পক্ষে তার যুক্তি ছিল দুটো, এক, বন্যা কোনো চিরস্থায়ী ব্যাপার নয়, এখন বন্যা হচ্ছে কিন্তু পরে হয়তো বন্যা হবে না; এবং দুই, এখন খরা না থাকলেও, অনেকদিন আগে যেমন এই গ্রাম খরার প্রকোপের কবলে পড়েছিল আবার কখনো তেমন খরা দেখা দেবে না, তা কেউ বলতে পারে না। সুহাসিনীর লোকেরা বন্যার বিপর্যয় আটকানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝে কিন্তু মফিজুদ্দিনের দেয়া যুক্তির উত্তর কেউ দিতে পারে না; সে তার জীবৎকালে এ ব্যাপারে কারো কথা শোনে না, গ্রামের বন্যাক্রান্ত চাষিদের ঘোলা মুখের দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে পরবর্তী ত্রিশ বছর সুহাসিনীর ভেতর দিয়ে কাটা এই খালের সাফল্য এবং উপকারিতার কথা বলে চলে। সে বলে, এই গাঁওয়ে তোমাগোরে ভালোর নেইগ্যা আমি কি সব সময় চিন্তা করি নাই? সুহাসিনীর বন্যাপীড়িত লোকেরা বলে, হে হইরছেন; মফিজুদ্দিন তখন ক্রমাগত সব প্রশ্ন করে যায় এবং গ্রামের লোকেরা এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, সে গ্রামের মানুষের জন্য এ সবকিছুই করেছে, তখন বন্যার হাত থেকে বাঁচার শেষ আশাটুকু নির্বাপিত করে দিয়ে সে বলে, তাইলে, এই বইন্যা আর এই খালের ব্যাপার আমার উপুর ছাইড়া দেও, দরকার হইলে আমিই তোমাগোর খাল বুজায়া দিব্যার কমু। তখন এক সময় সুহাসিনীর লোকেরা বুঝতে পারে যে, সুহাসিনীতে বন্যা এবং মফিজুদ্দিন মিয়াকে গ্রহণ করেই তাদেরকে বাঁচতে হবে; এবং যে দিন মফিজুদ্দিন মিয়ার পতনের খবর গ্রামের লোকেরা শোনে তারা বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তারপর তারা যখন জানতে পারে যে, আততায়ীরা রৌহার ভেতর দিয়ে, কাটা খাল বেয়ে এসে মিয়াবাড়ির ভিটার পেছনের ঘাটে নৌকো ভিড়িয়ে ছিল, তারা খুব বিভ্রান্ত বোধ করে; তখন তাদের এ খালের ইতিহাস মনে পড়ে, তাদের মনে পড়ে যে, এই খাল মফিজুদ্দিনের খুব প্রিয় ছিল, এ নিয়ে তার অনেক গর্ব ছিল; কারণ, তাদের মনে পড়ে যে, উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে করিম খাঁর পরিবারের সঙ্গে মফিজুদ্দিন মিয়ার সংঘাত যখন প্রকাশিত হতে থাকে তখন সে একদিন নয়নতারা হাটে গিয়ে হাজির এবং পুরনো কড়ই গাছতলায় দাঁড়িয়ে হাটে উপস্থিত গ্রামবাসীকে দুহাত উঁচু করে কাছে ডেকে আনে এবং বহুদিন পূর্বের মতো তার চতুর্দিকে জড়ো হয়ে আসা মানুষের মাথার ওপর দিয়ে তার দীর্ঘ বাহু পুনরায় ছড়িয়ে দিয়ে বলে যে, সুহাসিনী এবং আশপাশের গ্রামের মঙ্গলের জন্য সে তার পুরো জীবন ব্যয় করেছে, মানুষের সঙ্গে থেকেছে সব সময়, এবং তখন সে পুনরায় সেই খালটির কথায় ফিরে আসে। এই খালটি খরাপীড়িত মানুষের মঙ্গলের জন্য গ্রামের সকলকে সঙ্গে নিয়ে কাটার গল্প যখন সে বলে, সুহাসিনীর বন্যা-পীড়িত মানুষ বিমূঢ় বিস্ময়ে দেখে যে, শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ মফিজুদ্দিনের নিষ্প্রভ ঘোলা চোখে বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো কেমন চকচক করে ওঠে এবং তখন হাটে উপস্থিত লোকেরা বুঝতে পারে যে, মফিজুদ্দিন যে তাদের নূতন উপজেলার চেয়ারম্যান হবে সে বিষয়ে কোনো ভুল নাই। কিন্তু আততায়ীর গুলি মফিজুদ্দিনকে থামায় এবং ইদ্রিস খাঁ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হয়, তারপর জেল থেকে ফিরে আসার পর যেদিন বিকেলে সে মিছিল করে সুহাসিনীতে এসে নয়নতারা হাটে দাঁড়িয়ে এই হাটের নাম পাল্টে করে রসুলপুরের হাট, সেদিন সেখানে সমাগত জনতার উদ্দেশে সে বলে যে, সুহাসিনীর দুঃখ ওই খাল বন্ধ করার ব্যবস্থা সে করবে। কিন্তু সুহাসিনীর লোকেরা পরে এই কথা বলে যে, তারা সম্ভবত সেদিন বিকেলে ইদ্রিস খার কথা বুঝতে পারে নাই; কারণ, তারা দেখে যে, রৌহার বিলের সঙ্গে এই খালের সংযোগস্থল বন্ধ না করে ইদ্রিস খা গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়, যেখানে বহুদিন পূর্বে মোল্লা নাসিরউদ্দিন একদিন ঘাড়ে করে দুলালিকে খালের পানি পার করেছিল, সেখানে মাটি কাটার কাজ শুরু করে। তখন সুহাসিনীর লোকদের রায়গঞ্জ থেকে আসা এই রাস্তাটির কথা মনে পড়ে, রাস্তাটি রায়গঞ্জ থেকে পূর্বদিকে এগিয়ে এসে এই খালের কারণে কাটা পড়ে যায়; রাস্তাটা খাল পার হয়ে আসতে পারলে সেটা সোজা গিয়ে সুরধ্বনি গ্রামকে রায়গঞ্জের সঙ্গে যুক্ত করত। এই রাস্তার বিষয়টি সুহাসিনীর লোকদের কাছে আর এক রহস্য হয়ে থাকে, তারা এই কথাটি কখনো বুঝতে পারে না যে, মফিজুদ্দিন কেন এই রাস্তাটিকে সোজা সুরধ্বনির দিকে এগিয়ে যেতে দেয় না, তবে তাদের অনেকে বলে যে, এটা হয়তো ছিল মফিজুদ্দিন মিয়ার একটি খেয়াল; কিন্তু অন্য একদল লোক এই কথা বলে যে, মফিজুদ্দিনের মনে ছিল এক গভীর ক্ষত, যে ক্ষতের কথা প্রকাশ করার সাহস এবং সুযোগ তার ছিল না। এই রাস্তাটি সোজা খাল পার হয়ে এসে সুরধ্বনি গ্রামের দিকে যেতে চাইলে, তাঁতের মালিক মোবারক আলির পোড়োভিটার ওপর দিয়ে তা যেত, এবং মফিজুদ্দিন মিয়া চায় নাই যে, এই রাস্তা মোবারক আলির পোড়োভিটার ওপর দিয়ে যাক। কারণ, এই পোড়োভিটার ওপর এক সারিতে রচিত হয়েছিল ছটি মাটির কবর, এবং এই কবরের সারির সর্বোত্তরে জামগাছের ছায়ায় ঢাকা কবরটি ছিল দুলালির, মোল্লা নাসিরউদ্দিন যাকে একদিন ঘাড়ের ওপর তুলে রাস্তার এই কাটা জায়গায়, খালের কোমরসমান পানি পার করেছিল।
প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পূর্বে সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে পানি পার হওয়ার ভেলা না পেয়ে দুলালি রাস্তার এই জায়গায় খালের কিনারায় বসে ছিল, তখন মোল্লা নাসিরউদ্দিনের জীবনের চূড়ান্ত ঘটনাটি ঘটে; সে রায়গঞ্জের দিক থেকে এসে হাজির হয় এবং কিছু না বুঝে এতে জড়ায়। কলার ভুরাটা না থাকায় পানি পার হওয়ার অন্য উপায় যখন সে দেখে না, সে বালিকা দুলালিকে ঘাড়ের ওপর তুলে নিয়ে সন্তর্পণে খালের পানিতে নেমে আসে এবং ক্রমাগতভাবে গভীরতার দিকে এগোয়। পানি যত বাড়তে থাকে সে তার পরনের লুঙ্গিটাও টেনে ওপরের দিকে ওঠায়, এভাবে পানি যখন তার কোমরসমান হয় সে তার লুঙ্গি উল্টে বুকের কাছে জড়ো করে ধরে, পানির ভেতর তার নগ্ন নিম্নাঙ্গ ঢাকা পড়ে থাকে এবং ঘাড়ের ওপর তার মাথা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে দুলালি। তারপর গভীর পানি পার হয়ে এলে, অন্য কূলের দিকে পানি যখন আবার কমতে থাকে, সে তার লুঙ্গিও নিচে নামিয়ে আনে। কূলে নেমে কয়েক পা বাড়ির দিকে হাঁটার পর দুলালি বিষয়টি লক্ষ করে, সে দেখে যে, তার পা বেয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে যাচ্ছে; বালিকা মেয়েটি রক্ত দেখে প্রথমে হকচকিয়ে যায় তারপর সে তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার করে বাড়ির দিকে ছোটে। নাসিরউদ্দিন বিষয়টি বুঝতে পারে না, দুলালিকে চিৎকার করে ছুটে যেতে দেখে সে পেছন পেছন যায় এবং হঠাৎ করে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দুলালিদের বাড়ির বাইরে মোবারক আলি তার রক্তাপুত মেয়েকে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তারপর সে মেয়ের ফ্রকের ঝালর তুলে ইজারের ভেতর থেকে রক্তের ধারা নেমে আসতে দেখে। এক মুহূর্তে মোবারক আলির গলার রগ ক্রোধে ফুলে উঠে, সে শুধু অস্ফুটে জিজ্ঞেস করে, কেড্যা হইরছে? তখন দুলালি আঙুল তুলে পিছনে আসা মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দেখিয়ে দেয়। মোবারক আলি একটু দূরে নীরবে দাঁড়ানো মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দেখে, তারপর একটি চিতা বাঘের মতো লাফ দিয়ে প্রাঙ্গণে পড়ে থাকা একটি বাঁশ তুলে নিয়ে অপেক্ষমাণ বালকের ওপর চড়াও হয়। হঠাৎ এই আক্রমণে নাসিরউদ্দিন হকচকিয়ে যায়, সে প্রথম একটা দুটো আঘাত হাত দিয়ে ঠেকায় তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দেয়; সেদিন সুহাসিনীর লোকেরা দেখে, মোবারক আলি রাস্তা এবং মাঠের ওপর দিয়ে মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে তাড়া করে নিয়ে যায়। পলায়নপর নাসিরউদ্দিন নিজের বাড়ির নিকটবর্তী হলে মোবারক আলি তাকে প্রায় ধরে ফেলতে থাকে, এই অবস্থায় সে বাড়ির ভিটায় ওঠার চেষ্টা না করে পুকুরের দিকে দৌড় দেয় এবং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুহাসিনীর লোকেরা, সেদিন যারা মিয়াবাড়ির আশপাশে ছিল তারা এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পায়; নাসিরউদ্দিন সাঁতার কেটে পুকুরের এক ধারে পৌঁছার চেষ্টা করতেই মোবারক আলি ছুটে গিয়ে বাঁশ হাতে পুকুরের সেই প্রান্তে ডাঙায় দাঁড়ায়, আর এটা দেখে নাসিরউদ্দিন তখন পুনরায় উল্টোদিকে যায় এবং মোবারক আলিও একইভাবে দৌড়ে গিয়ে উল্টো দিকের ভাঙার ওপর অপেক্ষা করে। এই সময় কেউ, হয়তোবা মিয়াবাড়ির কোনো চাকর, মফিজুদ্দিনকে খবরটা দেয় এবং সে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে ছেলের এই দুরবস্থা দেখে। কিন্তু মোবারক আলি যখন তাকে সব কথা খুলে বলে, সে মোবারক আলির চাইতেও ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং প্রাঙ্গণের ওপর থেকে একটি বাঁশ কুড়িয়ে নিয়ে আসে, তারপর তারা দুজন মিলে মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে তাড়া করে। গ্রামের লোকেরা যারা পুকুরের উঁচু পাড়ের ওপর কলাগাছের ঝোপ অথবা পেঁপে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তারা দেখে যে, পুকুরের মাঝখানে একটি চুবানো মুরগির মতো মোল্লা নাসিরউদ্দিন মাথাটা পানির ওপর উঁচা করে রেখে চুপচাপ ভেসে আছে এবং পুকুরের দুপাশে পানির কিনারায় বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে আছে মফিজুদ্দিন ও মোবারক আলি। সুহাসিনীর লোকেরা যারা মিয়াবাড়ির পুকুরের উঁচু পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে দেখে, তারা তখন এই ঘটনার কারণ জানতে পারে না; তবে কয়েক দিন পর গ্রামের নারী এবং পুরুষেরা এ কথা জানতে পারে যে, মোবারক আলির দশ বছরের বালিকা কন্যা হায়েজবতী হয়েছে, এবং কয়েক দিন আগে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ঘাড়ে চড়ে খালের পানি পার হওয়ার সময় তার প্রথম রক্তপাত ঘটে, তখন মোবারক আলি বিচার-বিবেচনা ছাড়াই মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে পুকুরের পানিতে ফেলে। গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, মোবারক আলি চিৎকার করে বাঁশ হাতে নাসিরউদ্দিনকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়ার পর দুলালি তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তার মা ছমিরুন্নেসা রক্তাপ্লুত মেয়েকে দেখে বুঝতে পারে, তার কি হয়েছে; সে দুলালির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়, তারপর বড় ছেলে আব্দুল জলিলকে পাঠায় তার পিতাকে ডেকে আনার জন্য। তখন মিয়াবাড়ির পুকুর পাড়ে তামাশা দেখায় রত সুহাসিনীর লোকেরা দেখে যে, আব্দুল জলিল এসে তার বাপের কানে কি কথা বলে, আর তার কথা শুনে মোবারক আলি হাতের লাঠি নামিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। এই ঘটনার পর দুলালির বেশভূষার পরিবর্তন ঘটে; সুহাসিনীর লোকেরা তাকে সালোয়ার পরে স্কুলে যেতে দেখে বুঝতে পারে যে, দুলালি নারী হয়ে উঠেছে, যদিও তখনো সে একই সঙ্গে সমতলবক্ষা বালিকা মাত্র। দুলালিকে নিয়ে গ্রামে যেসব ঘটনা ঘটে, তার কারণে সুহাসিনীর মানুষের কাছে দুলালি খুব পরিচিত হয়ে ওঠে এবং এই মেয়েটির মৃত্যুর পরও তারা তার কথা ভুলতে পারে না, বহুদিন বহুবার তার কথা তাদের মনে পড়ে। সুহাসিনীর লোকেরা এ কথা বলে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ঘাড়ের ওপর ঋতুমতী হয়ে পড়ার বিষয়টির তাৎপর্য বালিকা দুলালি তখন বুঝতে পারে নাই, প্রকৃতির এই অবধারিত নিয়ম পালনের জন্য তার শরীর এবং মন তখনো প্রস্তুত হয় নাই, নিজের রক্তাপুতোর ঘটনার চাইতে নাসিরউদ্দিনকে তার বাপের বাশ নিয়ে তাড়া করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় সে বেশি আগ্রহী হয়; তার মনে হয় যে, তাকে মোরগের বিচি খাওয়ানোর জন্য বালক মোল্লা নাসিরউদ্দিনের এটা প্রাপ্য ছিল। কিন্তু দুলালির মন দ্রুত পরিণত হয়ে ওঠে, তার দ্বাদশ বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই সে তার লজ্জার ব্যাপারটি বুঝতে পারে এবং তখন একদিন মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দেখার জন্য তার বুকের ভেতরটা ছটফট করে ওঠে; কিন্তু তখন গভীর রাত থাকায় সে মিয়াবাড়িতে যেতে পারে না, হারিকেন জ্বালিয়ে তার স্কুলের খাতায় লেখে, নাসির ভাই, তোমাক দেইখপ্যার ইচ্ছা কইরত্যাছে; এবং এই কাগজটা ছিঁড়ে শাড়ির আঁচলে বেঁধে ঘুমিয়ে পড়ে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, কোনো এক রাতে অন্ধকার ঘরের ভেতর নিদ্রিতা মায়ের সঙ্গে শুয়ে বালিকা দুলালির মনে সেই অসময়ে মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দেখতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং তৎক্ষণাৎ তা সম্ভব না হওয়ার যে যন্ত্রণা জেগে ওঠে, সেই আকাক্ষা এবং যন্ত্রণাই এই বালিকার জীবন বিপর্যস্ত করে দেয়। সেদিন রাতে চিরকুটটা আঁচলে বেঁধে সে আবার বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে, তারপর সে হয়তো ঘুমায় অথবা ঘুমায় না, সকাল হওয়ার প্রতীক্ষা করে। পরদিন সকালে সে একটি মোরগের বাচ্চা নিয়ে মিয়াবাড়ির উঠোনে গিয়ে ওঠে এবং জানতে পারে যে, মোল্লা নাসির সিরাজগঞ্জ থেকে বাড়ি ফেরে নাই, এবং ব্যাখ্যার অতীত এক পীড়নে জর্জরিত এই বালিকাকে সিরাজগঞ্জে মাদ্রাসা-পড়ুয়া মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দেখার জন্য এক মাস উনত্রিশ দিন অপেক্ষা করতে হয়। সুহাসিনীর লোকেরা দুলালিকে একটি কালো রঙের চটপটে মোরগের বাচ্চা বুকের কাছে চেপে ধরে এই ঊনষাট দিনের প্রতিদিন মিয়াবাড়ির দিকে যেতে দেখে। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান যেদিন ঘটে, কাল-গণনার ষাটতম দিনে গ্রামের লোকেরা যখন জানতে পারে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিন গ্রামে ফিরেছে, তার পরদিন সকালে তেরো জন কৃষক মোরগ কোলে বাড়ির ভিটায় এসে ওঠে এবং এদের সঙ্গে মোবারক আলির কিশোরী কন্যা দুলালিকেও দেখা যায়। কিন্তু সেদিন সকালে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের পক্ষে মোরগের অণ্ডকোষ খসানোর কাজ করা সম্ভবপর হয় না এবং ঊনষাট দিন অপেক্ষা করার পর নাসিরউদ্দিনকে একমুহূর্তের বেশি দেখার সুযোগ হয় না দুলালির। সেদিন সকালে তেরোজন কৃষক এবং কালো মোরগ কোলে দুলালি মিয়াবাড়ির ভিটার ওপর চারচালা টিনের বৈঠকখানার পাশে অপেক্ষা করার সময় বাড়ির ভেতর থেকে কলহের ওয়াজ শোনে এবং এক পর্যায়ে গরু তাড়ানোর পাচন দিয়ে মোল্লা নাসিরকে পেটাতে পটাতে তাড়া করে বাড়ির ভেতর থেকে মফিজুদ্দিন মিয়া বাইরের প্রাঙ্গণে বের হয়ে আসে। তাড়া এবং মার খাওয়া নাসিরউদ্দিন তখন এক হাতে তার লুঙ্গি তুলে ধরে প্রাঙ্গণে মোরগ কোলে জড়ো হওয়া গ্রামের কৃষক এবং দুলালির সামনে দিয়ে দৌড় দেয় এবং ভিটা থেকে নেমে প্রান্তরের ওপর দিয়ে ছুটে সুহাসিনীর গভীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। সুহাসিনীর সেইসব কৃষক, যারা সেদিন মিয়াবাড়ির প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিল, পরবর্তী সময়ে তাদের মনে পড়ে যে, মারমুখো মফিজুদ্দিন মিয়ার আগে আগে ছুটে বেরিয়ে আসা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের লুঙ্গি উঁচিয়ে দৌড়ে পালানোর দৃশ্য দেখে তাদের হাসি পেয়েছিল; কিন্তু নাসিরউদ্দিনের চিৎকার শুনে দুলালি কাঁদতে শুরু করে। গ্রামের এই কৃষকেরা ভাবে যে, হৈ চৈ এবং মারামারি দেখে মেয়েটি হয়তো ভয় পেয়ে যায়, তখন তারা যখন তার কান্নার হেতু জানতে চায়, কি রে তুই ক্যা কান্দিস, তখন দুলালি বলে, এমনি কান্দি, এবং তারপর সে তার মোরগের বাচ্চাটা বুকে চেপে ধরে ধীরপায়ে ভিটা থেকে নেমে যায়। সেদিন সুহাসিনীর লোকেরা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের বিদ্রোহের কথা জানতে পারে; তারা জানতে পারে যে, নাসিরউদ্দিন পিতার অনুমতি ছাড়াই মাদ্রাসা ত্যাগ করে সিরাজগঞ্জ শহরে বি. এল. স্কুলে ভর্তি হয় এবং খবরটা গোপন করে রাখে। তারপর একদিন, বালিকা দুলালির ঊনষাট দিন অপেক্ষার পর, বাড়ি ফিরে সকালবেলা সে যখন এই কথা প্রকাশ করে যে এতদিন সে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে নাই, দাখিল পরীক্ষার বদলে বি. এল. স্কুল থেকে সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে এল, তখন তার পিতা, পৌঢ় এবং একরোখা মফিজুদ্দিন কথাটা বুঝতে পারামাত্র বেড়ার সঙ্গে গুঁজে রাখা গরুর পাচন তুলে নিয়ে তাকে প্রহার শুরু করে এবং সুহাসিনীর তেরোজন কৃষকের সম্মুখ দিয়ে নাসিরউদ্দিন চিল্কার করতে করতে ছুটে পালায়, আর দুলালি কালো মোরগের ছানাটি বুকে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করে; এবং সুহাসিনীর লোকেরা পরবর্তীকালে বলে যে, দুলালির এই কান্না যেন আর শেষ হয় না, তার এই কান্না যেন তার মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরদিন সকালে মিয়াবাড়ির ভিটায় দুলালিকে পুনরায় উঠে আসতে দেখা যায়, নাসিরউদ্দিন উঠোনে জড়ো হওয়া কৃষকদের মোরগের মুষ্ক ছেদন করলে তারা চলে যায়, তখন দুলালি তার মোরগটি বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। নাসিরউদ্দিন দুলালির মোরগের গায়ে হাত দেয় না, সে তার চোখের দৃষ্টি নিষ্ঠুরের মতো কঠিন করে এনে বলে, তর মোরগ নিয়া বাড়িত যা ছেমড়ি, এবং মোরগ খাসি করার সরঞ্জামাদি একটি কাপড়ে জড়িয়ে বাঁধে; তখন নাসিরউদ্দিনের এই অচিরণে দুলালির চোখ পানিতে ভরে আসে, সে তার আঁচলের খুঁট খুলে বেঁধে রাখা চিরকুটটা নাসিরউদ্দিনকে লক্ষ করে ছুড়ে মারে, তারপর ছুটে পালিয়ে যায়। নাসিরউদ্দিন দুলালির ছুড়ে দেয়া, ভাঁজ করা কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে পড়ে, তোমাক দেইখপার ইচ্ছা কইরতাছে নাসির ভাই, এবং কাগজের টুকরোটি ছিঁড়ে দূরে ফেলে দেয়; তাকে বাঁশের লাঠি নিয়ে তাড়া করে পুকুরের পানিতে ফেলার জন্য দুলালির বাপের অপরাধের কথা সে ভুলতে পারে না। সেবার সুহাসিনীতে নাসিরউদ্দিন দুমাস থাকে, সে মিয়াবাড়ির উঠোনে প্রতিদিন সকালে জড়ো হওয়া লোকদের মোরগের বিচি কেটে বের করে, কিন্তু দুলালির কালো মোরগের পেট অকর্তিত থেকে যায়। প্রতিদিন ভীরু পায়ে এসে দুলালি একটু দূরে দাঁড়ায়, নাসিরউদ্দিন যখন সব কাজ শেষ করে ফেলে কিন্তু তার দিকে তাকায় না তখন তার চোখে প্লাবন আসে এবং প্রতিদিন সে তার শাড়ির আঁচলের খুঁট খুলে একটি চার ভাঁজ করা কাগজ নাসিরউদ্দিনের মুখের ওপর ছুড়ে মেরে পালিয়ে যায়; নাসিরউদ্দিন প্রতিদিন একই বাক্য লেখা এক লাইনের একটি করে চিরকুট পড়ে এবং ভালোমতো কিছু না বুঝে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। নাসিরউদ্দিন যদিও একষট্টি দিন গ্রামে থাকে, সাতান্ন দিন পর দুলালি মনে হয় যেন তার প্রান্ত সীমায় পৌঁছায়; এদিনও নাসিরউদ্দিন যখন দুলালির মোরগ স্পর্শ করতে অস্বীকার করে, দুলালির চোখ পুনরায় পানিতে ভরে ওঠে এবং সে তার শেষ চিরকুটটা ছুড়ে মেরে পালিয়ে যায়। নাসিরউদ্দিন দুলালির লেখা এই সাতান্নতম চিরকুটটিতে একটি ভিন্ন বাক্য দেখতে পায়, কাঠপেন্সিল দিয়ে দুলালি লেখে, হারামযাদা তুমি আমাক মোরগের বিচি খাওয়াও নাই। তখন, এতদিন পর যেন মোল্লা নাসিরউদ্দিনের সম্বিৎ ফিরে আসে, তার চোখের আলো নরম এবং চপল হয়ে ওঠে, ঠোঁটে চাপা হাসি ফুরিত হয় এবং তারপর পূর্বের মতো সে চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু নাসিরউদ্দিন জানতে পারে নাই যে, তার হৃদয় যখন হেসে ওঠে তখন বালিকা দুলালি তার দুঃসাহস এবং লজ্জার প্রান্তে পৌঁছে ছিল; পরদিন সকালে নাসিরউদ্দিন তাদের উঠোনে দুলালিকে দেখতে পায় না, এবং সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, পরবর্তী কয়েক দিন নাসিরউদ্দিনের কাতর চোখ তাদের প্রাঙ্গণের ওপর মোরগের বাচ্চা কোলে দুলালিকে খুঁজে ফেরে; কারণ, তারা বলে যে, এই সময় মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ভেতর একধরনের অস্থিরতা এবং অন্যমনস্কতা দেখা যায়, যার ফলে এই কয়েক দিন পেটের ভেতর আঙুল দিয়ে ছেঁড়ার সময় তিনটি মোরগের বিচি গলে যায় এবং একটি মোরগের বিচির সঙ্গে সে নাড়ি টেনে বার করে আনে, যা এর আগে তারা একবারও ঘটতে দেখে নাই; গ্রামের লোকদের এই কথা এবং অনুমান হয়তো সত্য ছিল, যদিও প্রথমে মনে হয়েছিল যে, তা সত্য নয়। মোল্লা নাসিরউদ্দিন এক বৃহস্পতিবার সুহাসিনী ত্যাগ করে সিরাজগঞ্জ গিয়ে কলেজে ভর্তি হয় এবং পরবর্তী একটি বছর সে, মাত্র এগারো মাইল দূরে নিজ গ্রামে ফেরে না। পরবর্তী বর্ষায় সে যখন ফেরে, হেঁটে না এসে, ট্রেনে করে উল্লাপাড়া এবং সেখান থেকে বাসে করে সে রায়গঞ্জ এসে নামে, তারপর দুমাইল পথ পায়ে হেঁটে সে যখন সুহাসিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ভরা খালের পাড়ে এসে দাঁড়ায়, দুলালিকে ঘাড়ে তুলে খাল পার করার কথা তার মনে পড়ে এবং তখন তার মনে পড়ে দুলালির ছুড়ে দেয়া সাতান্নটি চিরকুটের কথা। তখন কলার ভুরার দড়ি টেনে খাল পার হয়ে সে দুলালিদের বাড়ির পথের ধারে একটা ঝোপের পাশে বসে থাকে, এভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর যখন দুপুরের সূর্য হেলে পড়তে থাকে, দুলালিকে দেখা যায় বুকের ওপর স্কুলের বই চেপে ধরে হেঁটে আসতে। তখন মোল্লা নাসিরউদ্দিন কাধে ঝোলানো ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়ায় এবং দুলালি নিকটে আসার পর সে ঝোপের আড়াল থেকে ছোট একটা লাফ দিয়ে অকস্মাৎ দুলালির সামনে এসে পড়ে এবং সে দেখে, ভয় পেয়ে যাওয়া দুলালির খয়েরি রঙের মুখটা এক মুহূর্তের জন্য আতঙ্ক এবং বিস্ময়ে নীলাভ হয়ে ওঠে; তখন নাসিরউদ্দিন দুলালির মাথার ওপর দিয়ে দূরে রৌহার ঝিলমিলে পানির ওপর দৃষ্টি রেখে বলে, কাইল বিয়ানে আসিস। পরদিন সতেরো জন কৃষক তাদের মোরগের বাচ্চা নিয়ে মিয়াবাড়ির উঠোনে হাজির হয় এবং মোল্লা নাসিরউদ্দিন যখন প্রথম মোরগটির পেট কেটে উন্মুক্ত করে তখন সে দেখে, পুবের মেঠো পথ বেয়ে ভোরের নরম আলোর ভেতর থেকে দুলালি একটি উজ্জ্বল বর্ণের মোরগের বাচ্চা বুকে চেপে ধরে তাদের ভিটায় উঠে আসে। এই দিন নাসিরউদ্দিন দ্রুত কাজ করে, কত দ্রুত বলতে না পারলেও সুহাসিনীর লোকেরা বলে, খুব তাড়াতাড়ি; এমন জলদি এত্তগুলান মোরগের বিচি কাইট্যা আমাগোরে বিদায় কইরা দিল নাসিরদ্দি, থাইকলো খালি দুলালি। সুহাসিনীর কৃষকেরা বিদায় হয়ে যাওয়ার পর সেদিন নাসিউদ্দিনের সম্মুখে দুলালি মাটিতে হাঁটু ঠেকিয়ে তার মোরগের বাচ্চাটা চিৎ করে ধরে, এবং নাসিরউদ্দিন যখন মোরগটার তলপেটের পালক খসাতে থাকে তখন সে বলে, তোমার মোচ হইছে, তখন নাসিরউদ্দিন ভূমিমুখী দৃষ্টি উঠিয়ে তার মুখের কাছে উঁচু হয়ে থাকা বালিকার মুখের ওপর স্থাপন করে এবং সে তখন সেই মুখে কি দেখে, তা আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মীমাংসা করতে পারে না, সেই কালো বালিকার মুখে কি আলোর বর্ণ অথবা স্বপ্নের ঘোর ছিল, নাসিরউদ্দিন পুরোপুরি তা বুঝতে পারে না; সে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে এবং বলে, মোচ আমার হইব না তো কি তর হইব! তারপর সে ঈষৎ গোলাপি রঙের দুটো বিচি বের করে সামনে সরার ওপর রাখে এবং পেট সেলাই করে চুন মেশানো বাটা হলুদ লাগিয়ে দিয়ে মোরগের বাচ্চাটা দুলালির হাতে তুলে দেয়। দুলালি মাটির ওপর হাঁটু ভেঙে রেখে শরীর সোজা করে, আঁচলের গিঁট থেকে ভাজ করা চৌকো এক টুকরো কাগজ খুলে নিয়ে সরার ওপর মোরগের ছত্রিশটি ছিন্ন অণ্ডকোষের পাশে রাখে, তারপর উঠে নাসিরউদ্দিনের দৃষ্টিরেখার ওপর দিয়ে ভিটার বাইরে প্রান্তরের প্রকাশিত রোদের ভেতর নেমে যায়। নাসিরউদ্দিন মাটির সরার ওপর থেকে তার সেদিনকার উপার্জন সতরোটি এক আনার মুদ্রা এবং চারকোণা করে ভাঁজ করা কাগজের টুকরাটা তুলে নেয়, পয়সাগুলো পকেটে রাখে এবং একটু সন্তর্পণে কাগজের টুকরাটা ভাঁজ খুলে মেলে ধরে; সেই চিরকুটে কাঠপেন্সিল দিয়ে একটি বাক্য লেখা ছিল, কেমন আছ তুমি নাসির ভাই। নাসিরউদ্দিন এবার চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে না, সে সেটা ঘরে নিয়ে তার কাঁধে-ঝোলানো ব্যাগের ভেতর রেখে দেয় এবং এভাবে তার জীবনে চিরকুট সগ্রহ শুরু হয়। পরদিন মুষ্ক ছেদন করা আর একটি মোরগের বাচ্চা বুকে চেপে ধরে সম্মুখে স্থাপিত মাটির সরার ওপর পূর্বদিনের মতো একটি ভাঁজ করা ছোট্টো চৌকো কাগজ রেখে দুলালি চলে যায় এবং নাসিরউদ্দিন সেটা চোখের সামনে মেলে ধরে দেখে যে, দুলালি একই কাঠপেন্সিল দিয়ে, একই খাতার পাতা ছিঁড়ে, একই বাক্য রচনা করেছে, তুমি কেমন আছ নাসির ভাই। নারিউদ্দিন এবার সাত দিন সুহাসিনীতে থাকে, ছয় দিন দুলালি তাকে ছুটি চিরকুট দেয়, তাতে একটি বাক্যই সে ক্রমাগতভাবে লিখে যায়, তুমি কেমন আছ, কেমন আছ তুমি, আছ কেমন তুমি! সপ্তম দিন সকালে পাঁচ জন কৃষক তাদের মোরগ নিয়ে ফিরে যাওয়ার পর দুলালির দিকে তাকিয়ে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ নাসিরউদ্দিনের মন বিষণ্ণতায় ভরে যায়, তার কাজ শেষ হলে দুলালি সরার ওপর পরিচিত আকারের কাগজের টুকরোটি রাখে, এবং তখন ধুলোর ওপর হাঁটু গেড়ে শরীর সোজা করে রাখা দুলালির কোলে, বাহুর ভেতর খোজা মোরগটার দিকে তাকিয়ে মোল্লা নাসিরউদ্দিন শুকনো কণ্ঠে বলে, আমি ভালো নাই দুলালি। তারপর দুলালি চলে যায় এবং সেদিন নাসিরউদ্দিন হয়তো ক্লান্ত ছিল, বিরক্ত অথবা বিভ্রান্ত ছিল, ফলে এই দিন ভাঁজ করা চৌকো কাগজটা সে আর খোলে না, ঘরে গিয়ে তার ঝোলা ব্যাগের ভেতর একই আকারের অন্য ছটি চিরকুটের সঙ্গে রেখে দেয়। নাসিরউদ্দিন পুনরায় আরো এক বছর বাড়ি ফেরে না, ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে সিরাজগঞ্জে ব্যস্ত হয়ে থাকে; সেখানে তার টিনের ট্রাঙ্কের একটি পকেটে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের পুরিয়ার মতো সাতটি ভাঁজ করা চৌকো কাগজের টুকরো প্রহর গোনে এবং সুহাসিনীতে প্রহর গোনে বালিকা দুলালি এবং মোরগের বাচ্চা খাসি করতে আগ্রহী কৃষকেরা। পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর মোল্লা নাসিরউদ্দিন পুনরায় বাড়ি ফিরলে গ্রামের লোকেরা সে খবর জানতে পারে এবং সকালবেলা কৃষকেরা মোরগ হাতে করে মিয়াবাড়ির ভিটায় এসে জড়ো হতে থাকে; মোল্লা নাসিরউদ্দিনের হলুদ এবং চুন রাখা সরার ওপর একটি করে এক আনার মুদ্রা রেখে দিয়ে তারা তাদের খোজা করা মোরগের বাচ্চা নিয়ে চলে যায়। কিন্তু দুলালি আসে না। মোল্লা নাসিরউদ্দিন বুঝতে পারে না কেন সে আসে না, সে এবার দেড় মাস গ্রামে থাকে, কিন্তু যে দুলালি ক্রমাগতভাবে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কেমন আছ, সে সকালবেলার মোরগের বিচি কাটার আয়োজনে ক্রমাগতভাবে অনুপস্থিত থাকে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিন যেমন দুলালিকে এক বছর প্রতীক্ষায় রাখে, সেও তাকে তেমনি করে; নাসিরউদ্দিনকে গ্রামে ফেরার পর সতেরো দিন অপেক্ষা করতে হয়, অষ্টাদশতম দিনে সে একটি পায়ের আওয়াজ পায় এবং বুঝতে পারে, এটা দুলালি; তার চোখ তখন নিবদ্ধ ছিল সামনে চিৎ করে ধরা একটি খয়েরি রঙের মোরগের বাচ্চার পালক তোলা তলপেটের ওপর, আঙুল ছিল উন্মুক্ত কাটা ছিদ্রের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো এবং চেতনা নিয়োজিত ছিল আঙুলের ডগায় মোরগের পেটের ভেতর নরম গুটির মতো একজোড়া বিচি অনুভব করায়; তখন, এই অবস্থার ভেতরও, সে মাটিতে খসে পড়া পাতার শব্দের মতো পদপাতের নরম ধ্বনি এগিয়ে আসতে শোনে। সৈদিন তাদের প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া সব গ্রামবাসী চলে যাওয়ার পর নাসিরউদ্দিন দুলালির দিকে তাকায়, বালিকার শ্যামল মুখের নিচে, শাড়ির আঁচলের তলায় সে নবীন স্তনের ক্ষীণ স্ফীতি দেখে। নাসিরউদ্দিন দুলালির মোরগের পেট সেলাই করে হলুদ এবং চুন লাগিয়ে দেয়ার পর দুলালি যখন তার মোরগ নিয়ে চলে যায় তখন নাসিরউদ্দিন তার রেখে যাওয়া চিরকুটটা খোলে এবং কাঠপেন্সিলে লেখা একটি নূতন বাক্য দেখতে পায়, দুলালি এবার জানতে চায়, মোল্লা নাসির কেন কোনো কিছু বলে না; এবং পরবর্তী তেরো দিনে আরো তেরোটি চিরকুট পায় সে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, এই চিরকুট চালাচালির বলি হিসেবে ছমিরুন্নেছার মোরগগুলোর একাধিকবার খোজা হওয়ার অবস্থা এসে যায়; এ সময় প্রথম দু’দিন দুলালি দুটো মোরগের বাচ্চা নিয়ে আসে, কিন্তু তারপর এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, নাসিরউদ্দিন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তৃতীয় দিন দুলালি একটি বড় তাগড়া মোরগ হাতে করে নিয়ে আসে, মোরগটি এত বড় এবং তেজী ছিল যে, দুলালির পক্ষে সেটাকে চিৎ করে ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন নাসিরউদ্দিন রশি দিয়ে মোরগটির পা এবং পাখা বেঁধে দিলে দুলালি সেটাকে চিৎ করে রাখে এবং সে মোরগের তলপেট কেটে আঙুল প্রবিষ্ট করিয়ে দিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তার অভিজ্ঞ আঙুল অনেক চেষ্টা করেও মোরগের পেটের ভেতর অণ্ডকোষের সন্ধান করতে পারে না। দীর্ঘক্ষণ প্রচেষ্টার ফলে যখন তার নাকের ডগায় পরিশ্রম এবং উত্তেজনার ঘাম জমে ওঠে, সে এই পণ্ডশ্রম ত্যাগ করে এবং হতাশ হয়ে বলে, এই মোরগাটা আসলে মোরগ না, এইটা হিজড়া, তখন এই কথা শুনে দুলালি মুখের ভেতর আঁচল গুঁজে দিয়ে হাসে এবং সরার ওপর চিরকুট রেখে দিয়ে চলে যায়; নাসিরউদ্দিন সেটা খুলে দেখে তাতে লেখা, কিছু কও না কেন তুমি? পরবর্তী কয়েক দিন নাসিরউদ্দিন হিজড়া মোরগের পেটের ভেতর অনুপস্থিত বিচি খুঁজে ক্লান্ত এবং দুলালির চিরকুটে তুমি কিছু কও না কেন’ পড়ে পড়ে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। চতুর্দশতম দিনে দুলালি তার চিরকুটটা সরার ওপর রেখে দিলে নাসিরউদ্দিন তার মুখের দিকে তাকায় এবং বলে, তুইও তো কিছু কইস না; নাসিরউদ্দিনের কণ্ঠ যেন সেদিন হাহাকার করে এবং তার এই কথা শুনে দুলালির শরীর কেঁপে ওঠে এবং কান্নার প্রান্ত থেকে চাপা ও তীব্র কণ্ঠে সে বলে, মিথুক! দুলালি এরপর কয়েক দিন আর আসে না এবং নাসিরউদ্দিন যদিও বুঝতে পারে না দুলালি কেন আসে না, সে নূতন চৌদ্দটি চিরকুট, সাতটি পুরানো চিরকুটের সঙ্গে একত্রে টিনের ট্রাঙ্কের পকেটে রেখে দেয়।
মফিজুদ্দিনের ছেলেরা তার কোনো শখ এবং স্বপ্নই পূরণ করে নাই, তারা সারা জীবন তাদের নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী পথ চলে; সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিন তার কথামতো মাদ্রাসার শিক্ষা গ্রহণ করে না, তারপর একদিন, তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে সে তার শতরঞ্জি জড়িয়ে বিছানা বেঁধে এবং টিনের ট্রাঙ্ক গুছিয়ে তৈরি হয়। তখন সে মফিজুদ্দিনের দ্বিতীয় অনুরোধটি প্রত্যাখ্যান করে; সে ঢাকা চলে গিয়ে সিরাজগঞ্জ কলেজে তার সহপাঠী আব্দুল বাকীর সঙ্গে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়। মফিজুদ্দিনের এই অনুরোধটি তার পরবর্তী ছেলে আবুবকর সিদ্দিকও রাখে না, সেও তার অগ্রজের মতো ব্যক্তিগত স্বপ্ন নির্মাণে জীবন ব্যয় করে। এই ঘটনার শুরু হয় মোল্লা নাসিরউদ্দিন ইন্টারমিডিয়েট পাস করার এক বছর আগে, যখন মফিজুদ্দিনের দশ নম্বর ছেলে আব্দুল আজিজ বিএ পাস করে; তখন সুরধ্বনি গ্রামের আফজাল খাঁর বড় ছেলে ইলয়াস খাঁর মিলিটারিতে চাকরি নেয়ার খবর গ্রামের লোকেরা জানতে পারে, এবং তখন মফিজুদ্দিন তার বিএ পাস ছেলেকে বলে, তুমি বাপু মিলিটারিত যাও। আব্দুল আজিজ প্রথমে তার পিতার এই আকাঙ্ক্ষার কারণ বুঝতে পারে না, এবং যদিও মিলিটারিতে চাকরি নেয়ার জন্য ইন্টারমিডিয়েট পাস হলেই চলে, সে তার পিতার কথা মেনে নিয়ে বগুড়া শহরে গিয়ে একদিন সেনাবাহিনীর প্রাথমিক নির্বাচন কমিটির সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু সে প্রথম শারীরিক পরীক্ষাতেই অযোগ্য প্রমাণিত হয়; গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিনের হয়তো একধরনের দূরদৃষ্টি ছিল অথবা নিছক প্রবৃত্তির দ্বারা সে বুঝতে পেরেছিল যে, তার বাল্যের প্রিয় বন্ধু করিম খার বড় নাতি ইলিয়াস খাঁর মতো তার একটি ছেলেরও মিলিটারিতে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু মফিজুদ্দিনের এই ইচ্ছায় কোনো কাজ হয় না, আব্দুল আজিজ সেনাবাহিনীতে ঢুকতে ব্যর্থ হয় এবং তার অন্য ছেলেরা তা করতে অস্বীকার করে। আব্দুল আজিজ যেদিন বগুড়ায় আর্মি রিক্রুটমেন্ট কেন্দ্র থেকে হাঁটুবিষয়ক জটিলতার কারণে ব্যর্থ হয়ে গ্রামে ফিরে আসে, সেদিন সকল কথা শুনে মফিজুদ্দিন খুব চিলিত হয়ে পড়ে এবং বিকেলের মরা আলোয় মিয়াবাড়ির ভেতরের উঠোনের ওপর লুঙ্গি কাছা দিয়ে উপরে তুলে সে যখন দুপায়ের গোড়ালি একত্র করে দাঁড়ায়, সে তার এত অহঙ্কারের এই জীবনের ভেতরকার তুচ্ছতা অনুভব করতে পারে; কারণ, সে দেখতে পায় যে, তার নিজের দুপায়ের হাঁটুর ভেতরের দিক পরস্পরের সঙ্গে লেগে আছে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, এই প্রাথমিক হতাশার ভেতরও মফিজুদ্দিন তার বুদ্ধি হারায় না, সে সেই বিকেলেই তার ছেলেদের ডেকে এনে উঠোনে দাঁড় করায় এবং বাড়ির মেয়েরা দেখে যে, ছেলেরা লুঙ্গি মালকোচা মেরে পায়ের গোড়ালির সঙ্গে গোড়ালি সন্নিবেশ করে দাঁড়ালে মফিজুদ্দিন একটি খাতার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসে এবং তা উঠোনে দাঁড়ানো প্রত্যেকের দুপায়ের ফাঁকের মাঝখানে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে ওপর দিকে টেনে নেয়। এভাবে সেদিনকার ব্যর্থতা এবং হতাশার ভেতর সে তার ছেলেদের ভেতর থেকে তাদেরকে বেছে বার করে, যারা যোগ্য হাঁটুর অধিকারী; এবং সে আনন্দের সঙ্গে দেখে যে, তার তরুণতম দুটো ছেলে, মোল্লা নাসিরউদ্দিন এবং আবুবকর সিদ্দিকের হাঁটু পরস্পরের সঙ্গে ঠুকে যায় না। কিন্তু মফিজুদ্দিনের এই আনন্দ স্থায়ী হয় না, তার আকাভক্ষা ক্রমাগতভাবে অপূর্ণ থাকে; নাসিরউদ্দিন তার অনুরোধ রক্ষা করে না এবং তার অনুজ আবুকর সিদ্দিক তার চাইতেও বড় দুঃখ দেয় মফিজুদ্দিনকে; সে সিরাজগঞ্জের লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা গিয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়, সেখানে সে নগ্ন নারীর ছবি আঁকা শেখে এবং মিলিটারিতে একটি ছেলেকে ঢোকানোর মফিজুদ্দিনের পরিকল্পনা অবাস্তবায়িত থেকে যায়। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, প্রবল গোয়ার্তুমি সত্ত্বেও তার মনের কোনো এক গভীর স্তরে একধরনের শঙ্কা হয়তো ছিল, এবং ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা রাতের বিহ্বলকর ঘটনার পর ক্রমান্বয়ে তাদের মনে হয় যে, মফিজুদ্দিন এবং আফজাল খাঁর পরিবারের বিরোধ জারি ছিল বহুদিন থেকে। রায়গঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে আসা রাস্তাটিকে মফিজুদ্দিন তার জীবদ্দশায় খাল পার হয়ে আসতে দেয় নাই, কিন্তু মফিজুদ্দিনের মৃত্যুর পর সিরাজগঞ্জ শহরের জেলে ছয় মাস আটক থাকার পর রায়গঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান ইদ্রিস খা ছাড়া পায় এবং গ্রামে ফিরে সকলের আগে এই রাস্তাটি নির্মাণের কাজে হাত দেয়; তখন খাদের সঙ্গে মফিজুদ্দিনের বিরোধের দীর্ঘ এবং গোপন প্রকৃতির বিষয়টি গ্রামের লোকেরা পুনরায় অনুধাবন করে। সুরধ্বনি গ্রামের জন্য এই রাস্তাটি খুবই প্রয়োজনীয় ছিল, এবং সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, এই রাস্তাটির খুবই প্রয়োজন ছিল খ পরিবারের; কারণ, এই রাস্তাটি না থাকায় দু’বার দুটো মোটরগাড়ি আটকা পড়ে যায় এবং গ্রামের লোকদের তামাশা দেখার অসাধারণ সুযোগের সৃষ্টি করে। সুরধ্বনি গ্রামের খায়েরা মিলিটারি এবং মোটরগাড়ির অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে মফিজুদ্দিনের পরিবারের চাইতে এগিয়ে থাকে এবং সুহাসিনীর লোকদের মনে হয় যে, মফিজুদ্দিন এই অবস্থার সুরাহা করার চেষ্টা করে তার কোনো একটি ছেলেকে মিলিটারিতে ঢুকিয়ে এবং সুরধ্বনি গ্রাম পর্যন্ত রায়গঞ্জ থেকে আসা রাস্তাটিকে এগিয়ে যেতে না দিয়ে, যদিও উভয় ক্ষেত্রেই সে ব্যর্থ হয়; তার ছেলেদের মিলিটারির বিষয়ে উৎসাহ দেখা যায় না, তারা ইঞ্জিনিয়ার হয়, চিত্রকর হয়, এবং লাল বই পড়া কম্যুনিস্ট হয়; অন্যদিকে রাস্তা না থাকলেও খাবাড়ির ভিটায় মোটরগাড়ি মফিজুদ্দিনের জীবদ্দশাতেই গিয়ে পৌঁছয়। মোটরগাড়ির বিষয়ে সুরধ্বনি গ্রামের খায়েরা এগিয়ে যায় যখন চান্দাইকোনায় মোটরগাড়ির হেলপারের কাজ করা, বেলায়েত হোসেন নামে ভিনদেশী এক লোকের সঙ্গে আফজাল খাঁ নিজের ছোটো বোনের বিয়ে দেয় এবং বেলায়েত সুরধ্বনিতে খদের বাড়িতে এসে বসবাস শুরু করে। সুহাসিনীর লোকেরা, সুরধ্বনি এবং রৌহার লোকেরা, খাবাড়ির জামাই বেলায়েতের কথা যখন জানতে পারে তাদের প্রথমে এই কথা ভেবে ঈর্ষা হতে থাকে যে, বেলায়েত সকাল থেকে রাত অব্দি গাড়ি চড়ে বেড়ায় এবং এজন্য তার একটি পয়সাও খরচ হয় না বরং বাস মালিক উল্টো তাকেই বেতন দেয়। বেলায়েতকে গ্রামের কেউ কেউ হয়তো এই সব কথা বলে, অথবা এমনও হতে পারে যে, নিজের জীবিকার ঈর্ষণীয়তার বিষয়টি হয়তো সে নিজেই বুঝতে পারে; এবং এই বুঝতে পারাটা তার নিজের জন্য ঝামেলা এবং এই এলাকার লোকের জন্য ক্ষণিক মজা নিয়ে আসে, যখন সে কোনো এক অবসরের দিনে তার বাসের ড্রাইভারকে বলেকয়ে রাজি করায় এবং একটি বড় হাতির মতো পেট মোটা এবং মন্থর বাহনটিকে তার শ্বশুরবাড়ির দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। করতোয়া নদীতে তখন গরুগাড়ি পার করার জন্য জোড়া নৌকোর যে ফেরিটি ছিল তাতে এই বাসটি উঠতে পারবে না বুঝতে পেরে বেলায়েত হয়তো ভেবেছিল যে, শুকনো দিনের হাঁটুপানির করতোয়া ফেরি ছাড়াই পার হওয়া যাবে। কিন্তু তার এই হিসেবে ভুল ছিল, ধানঘড়ার পশ্চিম পাশের গ্রামের লোকেরা দেখেছিল বাসটিকে কিনারার বালি এবং কাদার ওপর দিয়ে এগিয়ে এসে পানির ভেতর নাক ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে। এরপর সেদিন বাসটিকে টেনে তোলার জন্য মোটা কাছি বেঁধে পঞ্চাশ জন লোক লাগাতে হয়; এক সার পিপড়ের মতো মালকোঁচা মারা গ্রামের লোকেরা মনে হয় যেন বাসটিকে লেজ ধরে পেছন দিকে টেনে নদীগর্ভের বাইরে নিয়ে আসে এবং পুনরায় রাস্তার ওপর ওঠায়। আশপাশের গাঁয়ের লোকেরা এই খবর বিশদ জানতে পারার আগেই এই কাজের জন্য বেলায়েত হোসেন তার চাকরি হারায় এবং সুহাসিনীতে মফিজুদ্দিন মিয়া একদিন বিকেলে দুটো খবর একসঙ্গে শোনে এবং সে এতে একদম আমোদিত বোধ করে না, সে তার কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, ছাগল একখান! কিন্তু বেলায়েত হোসেন প্রমাণ করে যে, যে তোক একবার বিনে পয়সায় গাড়ি চড়ার সুযোগ পায়, সে সেই নেশা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না; বাসের হেলপারের চাকরি চলে যাওয়ার ঘটনায় জীবিকা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তার হয়তো একধরনের লজ্জা এবং জেদ হয়। সে সুরধ্বনিতে শ্বশুরবাড়িতে বৌ ফেলে রেখে ঢাকা চলে গিয়ে মোটরগাড়ির ড্রাইভিং শেখে তারপর এটা-ওটা চালাতে চালাতে এক বিদেশী দূতাবাসে ড্রাইভারের চাকরি নেয় এবং তখন দেখা যায় যে, শ্বশুরবাড়ির গ্রামের বিস্মিত এবং বিহ্বল কৃষকদের সামনে দিয়ে মোটরগাড়ি চালিয়ে যাওয়ার তার অল্প বয়সের স্বপ্ন অম্লান রয়ে গেছে; কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যায় যে, দশ বছর আগে চাকরি হারানোর গ্লানির কথা সে বিস্মৃত হয় নাই, সে তার কালো রঙের চার দরজার ঝকঝকে কারটা এবার জোড়া নৌকোর ফেরিতে তুলে করতোয়া নদী পার করে ধানঘড়া হাটের ওপর এনে ওঠায়। কিন্তু দশ বছর লেগে থাকার পর তার সাফল্য এটুকুর ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে যে, স্মরণকালের ভেতর তার গাড়িই ধানঘড়া হাটের ওপর দিয়ে এসে এক পাশে দাঁড়ায়। বেলায়েত হোসেনের বাকি স্বপ্নটুকু অপূর্ণ থাকে, গাড়ি নিয়ে ধুলো উড়িয়ে সুরধ্বনির দিকে এগিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না; ভাঙা রাস্তার চেহারা দেখে সে অবস্থাটা বুঝতে পারে, তখন হাটের বাইরে একটি গাছের নিচে গাড়ি রেখে সে পায়ে হেঁটে রওনা হয়। শ্বশুরবাড়ির গায়ের লোকদের সামনা-সামনি গাড়ি দেখাতে না পারলেও, বেলায়েত হোসেনের কালো রঙের এই ঝকঝকে গাড়িটির কথা চারদিকের গ্রামের লোকেরা পুনরায় জানতে পারে; যারা ধানঘড়া হাটে এসে এই গাড়ি দেখে তারা বিস্ময় এবং উত্তেজনায় অভিভূত হয়ে থাকে এবং বলে, এই গাড়ির চাইরডো দরজা। বেলায়েত হোসেনের এই নূতন গাড়ির কথা যখন সুহাসিনীর লোকেরা জানতে পারে তখন তা মফিজুদ্দিন মিয়াও শোনে এবং ভ্রু কুঁচকে অন্য কোনো রকম মন্তব্য ছাড়া বিড়বিড় করে সে শুধু বলে, আদেখলা! সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিনের মনে কি ছিল তা তাদের জানা নাই, তবে রাস্তা বানাতে না দিয়ে সে সুরধ্বনির খাদের মোটরগাড়ির অগ্রযাত্রা আটকাতে সক্ষম হয় না; খায়েরা যেন পণ করে বিষয়টার পেছনে লাগে। বেলায়েত হোসেনের চার দরজার কালো ফিঙে পাখির মতো ছিমছাম গাড়িটি প্রথম যেদিন ধানঘড়া হাটখোলার ওপর এসে ওঠে এবং আর এগোনোর রাস্তা না পেয়ে এক ধারে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকে, এই এলাকার লোকেরা উত্তেজিতভাবে এই গাড়ির গল্প করে, তারপর তারা এই গাড়ির কথা ভুলে যায় এবং নিত্যদিনের কাজে লাগে। বেলায়েত হোসেনের এই গাড়িটির ধানঘড়ায় আগমনের পর, কতদিন পর তা গ্রামের লোকেরা বলতে পারে না, মফিজুদ্দিনের অঘোষিত প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে, এবং একদিন গ্রামের লোকেরা একটা বিশাল জন্তুর গোঙানোর মতো শব্দ শোনে এবং দৌড়ে বের হয়ে এসে, ধীর অথচ জেদি ভঙ্গিতে এগোনো ষাড়ের মতো, একটি খাকি রঙের জিপ গাড়ি দেখতে পায়; মেজর ইলিয়াস খাঁর এই গাড়ি সেদিন ধুলো উড়িয়ে ভাঙা রাস্তার ওপর দিয়ে এগোয়, কোনো কিছুই এর গতিরোধ করতে পারে না; সুহাসিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় খালের হাঁটুপানির ভেতর দিয়ে পার হয়ে চাষের জমির ওপর দিয়ে সুরধ্বনির খা-বাড়ির বাইরের উঠোনে জামতলায় গিয়ে থামে। সুহাসিনীতে মোটরগাড়ি আসার আগেই সুরধ্বনির কৃষক এবং তাদের রমণীরা একটি আসল এবং আস্ত মোটর গাড়ির অধিকারী হয়, তারা এই যানটিকে একদল মাছির মতো সর্বক্ষণ ঘিরে রাখে এবং ছুঁয়ে দেখে। তখন একদিন ধানঘড়া থেকে রায়গঞ্জ হয়ে একদল লোক মাটির কাঁচা রাস্তার ওপর নূতন মাটি ফেলে মেরামত করতে করতে সুহাসিনীর দিকে এগিয়ে আসে এবং খালের সেই জায়গায় এসে থামে, যেখানে একদিন মোল্লা নাসিরউদ্দিন বালিকা দুলালিকে পানির কিনারায় অপেক্ষা করতে দেখে। সুহাসিনীর লোকদের কাছে অনেক কিছু এবং জায়গার ভেতর, খালপাড়ের এই মাথাভাঙা রাস্তার প্রান্তের সঙ্গে দুলালির স্মৃতির প্রসঙ্গ বহুদিন পূর্ব থেকে জট পাকিয়ে যায়। আইউব খানের ওয়ার্কস প্রোগ্রামের আমলে রায়গঞ্জ, রৌহা ও সুরধ্বনির কর্মহীন কৃষকেরা যখন গমের বিনিময়ে মাটি কেটে একটি রাস্তা বানিয়ে রায়গঞ্জের দিক থেকে এগিয়ে আসে এবং মফিজুদ্দিনের গোয়ার্তুমির কারণে তা খাল পার হয়ে সুহাসিনীতে এসে সুরধ্বনির দিকে এগিয়ে যেতে পারে না, তখন সুহাসিনীর লোকদের দুলালির কথা মনে পড়ে। মফিজুদ্দিন মিয়ার অনেক কিছুর মতো, এই রাস্তাটি পূর্ণরূপে নির্মিত না হওয়ার বিষয়ে তার ইচ্ছের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুহাসিনীর লোকেরা বিভ্রান্ত বোধ করে, তাদের বহুদিন এ রকম মনে হয় যে, সুরধ্বনির খায়েরা যাতে আরাম করে তাদের মোটরগাড়ি চালিয়ে গ্রামে আসতে না পারে, মফিজুদ্দিন সে জন্যই এই রাস্তাটিকে এগিয়ে আসতে দেয় না। ব্ৰহ্মগাছা ইউনিয়নের বৃদ্ধ চেয়ারম্যান মফিজুদ্দিন রায়গঞ্জ থানার সিও সাহেবকে মুখের ওপর এই কথা বলে যে, এই রাস্তা খালের এ পাড়ে সুহাসিনীতে আসবে না, সুহাসিনীর লোকেরা মাটি কাটার বদলে রিলিফের এই সব গম খায় না। কিন্তু সুহাসিনীর অনেকের তখন এই রাস্তাটিকে এগিয়ে না আসতে দেয়ার অন্য সম্ভাব্য কারণটির কথা মনে পড়ে, তাদের অনেকে বলে যে, এই রাস্তাটি আশপাশের খালের কারণে কেবল একটি জায়গার ওপর দিয়ে সুরধ্বনি গ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে পারতো, এটা এগিয়ে যেতে পারতো কেবল মোবারক আলির পতিত ভিটার ওপর দিয়ে। মফিজুদ্দিন যে কথা কোনোদিন বলে নাই, গ্রামের লোকেরা সেই কথা বলে, তারা মফিজুদ্দিনের হৃদয়ে এক গোপন এবং গভীর ক্ষতের বিষয়ে নিশ্চিত হয় এবং বলে যে, একটি কবর রক্ষা করার জন্য মফিজুদ্দিন এত কিছু করে; মোবারক আলির পোড়ো ভিটার ওপর দিয়ে এই রাস্তা সে যেতে দেয় না, কারণ, এই জঙ্গলাকীর্ণ ভিটার ওপর একটি জামগাছ তলায় ছিল দুলালির কবর।
গ্রামের লোকদের মনে তখন অবিস্মরণীয় সেই স্মৃতি জাগরিত হয়। সুহাসিনীর লোকেরা জানতে পারে যে, যখন একের পর এক চৌদ্দটি চিরকুটে তুমি কিছু কও না কেন লেখা পড়ার পর বিভ্রান্ত এবং বিপর্যস্ত মোল্লা নাসিরউদ্দিন দমকা বাতাসে কেঁপে যাওয়া পাতার শব্দের মতো উচ্চারণ করে, তুইও তো কিচু কইস না; তখন, সেদিন, দুলালির হৃদয়টি চাপ খেয়ে থেঁতলে যায়। তারপর দুদিন মোল্লা নাসিরউদ্দিন সুহাসিনীতে থাকে, কিন্তু দুলালি আসে না এবং তখন নাসিরউদ্দিন দুলালিকে আর না দেখেই ঢাকা রওনা হয়। দুলালির এই কথাটি জানা ছিল না যে, দুদিন পরে নাসিরউদ্দিন চলে যাবে, এবং নাসিরউদ্দিনও কোনো এক ধরনের অভিমান অথবা বেখেয়ালে দুলালির খোঁজ করে না; এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, এই ভুলের আর কোনো সংশোধন থাকে, নাসিরউদ্দিন এবং দুলালির আর দেখা হয় না; দুলালির মৃত্যুর পর সে গ্রামে ফিরে এসে সাদা কাফনের ভেতর তার বিবর্ণ শীতল মুখে দেখে। সুহাসিনীর লোকেরা এই প্রক্রিয়াটি অবলোকন করে এবং তারা যখন এ বিষয়ে কথা বলে তাদের শুধুই বিষণ্ণতা হয়, তারা বলে যে, চৌদ্দটি চিরকুট ছুড়ে দেয়ার পর দুলালি আর আসে না; কিন্তু নাসিরউদ্দিন চলে যাওয়ার পর দিন সে কোলের ভেতর দুবার পেট কাটা একটি মোরগ নিয়ে এসে মিয়াবাড়ির ভিটায় প্রাঙ্গণের ওপর দাঁড়ায়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মিয়াবাড়ির চাকরেরা তখন গরুর পরিচর্যা এবং জাবনা দেয়ার কাজে ব্যস্ত ছিল, সে সময় তারা বিষণ্ণ ছায়ার মতো বালিকাকে দেখতে পায়, তাদের কাছ থেকে গ্রামের লোকেরা পরে বিশদ জানতে পারে। মিয়াবাড়ির এই কামলারা গ্রামের লোকদের বলে যে, তারা যখন দুলালিকে এই খবরটি দেয় যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিন আগের দিন রাতে ঢাকা চলে গেছে তার নিষ্কম্প পুকুরের মতো চোখ দুটো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তারপর বড় নীরব চরণে সে সেই প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে যায়। মিয়াবাড়ির এই চাকরেরা বলে যে, বিষয়টি তারা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে নাই, তারা মনে করে যে, এটা একটি সাধারণ ঘটনা; মোল্লা নাসিরউদ্দিনের গ্রাম ত্যাগের খবর জানা না থাকায় দুলালি হয়তো ভুল করে প্রথম দিন মোরগ নিয়ে আসে। কিন্তু মোল্লা নাসিরের ঢাকা চলে যাওয়ার কথা বলার পরও দ্বিতীয় দিন সকালে দুলালি যখন মোরগ কোলে এসে দাঁড়ায় তখন মিয়াবাড়ির চাকরেরা বিস্মিত হয়, তারা এই ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ঢাকা চলে যাওয়ার খবর তারা এই মেয়েটিকে আদৌ বলেছিল কি না এবং তখন তারা পুনরায় দুলালিকে খবরটি দেয় এবং দুলালি তাদের দিকে কিছুক্ষণ নিস্পলকভাবে তাকিয়ে থেকে শুকনো মুখে চলে যায়। মিয়াবাড়ির চাকরেরা বলে যে, বিভ্রান্তিটা যে তাদের নয় দুলালির, দুলালি যে চেতন এবং অচেতনের মধ্য রেখায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা তারা বুঝতে পারে যখন তৃতীয় দিন সকালে তারা দুলালিকে মোর কোলে করে এসে দাঁড়াতে দেখে। কারণ, এই দিন এ জিনিসটি তারা নিশ্চিতরূপে মনে করতে পারে যে, তারা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ঢাকা চলে যাওয়ার কথা আগের দিন এই বালিকাটিকে বলেছিল। তারা তৃতীয়বার দুলালিকে খবরটা দেয় এবং তখন দুলালি ধীরপায়ে মিয়াবাড়ির ভিটার ওপর থেকে মাঠের ধূসর সকালের ভেতর নেমে গেলে, এই অপসৃয়মাণ বালিকার দিকে তাকিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাসে চির ধরে এবং বিভ্রান্তি পুনরায় উঁকি দেয় এবং তাদের এই সন্দেহ হতে থাকে যে, নাসিরউদ্দিনের ঢাকা চলে যাওয়ার খবরটি তারা দুলালিকে ঠিক দিয়েছিল কি না। তারা তখন বিপর্যস্ত বোধ করলে নিজেরাই নিজেদের কাছে প্রমাণ করতে পারে না যে, তারা কথাগুলো বলেছিল, এবং তখন তাদের একজন গোয়ালঘরের পাশে গজানো খোকসা গাছের একটি পাতা ছিঁড়ে এনে সকলের সামনে তুলে ধরে বলে, এই যে দেহ, এই, নাসিরদ্দি ঢাহা চইল্যা গেছে; এবং এই কথা বলে সে খোকসার পাতাটি সকলের সামনে গোয়ালঘরের পাটখড়ির বেড়ার ফাঁকে গুজে রাখে। পরদিন চতুর্থবারের মতো তারা যখন দুলালিকে দেখে, তারা পুনরায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে চায়, তখন তাদের গোয়ালঘরের বেড়ার সঙ্গে গুঁজে রাখা খোকসার পাতার কথা মনে পড়ে এবং নীরবে অপেক্ষমাণ বালিকার দিকে তাকিয়ে, বমাল চোর ধরতে পারার মতো সাফল্যের আনন্দে তারা হেসে ওঠে; তাদের একজন গোয়ালঘরের বেড়ার গা থেকে পাতাটা খুলে নিয়ে দুলালির সামনে উঁচু করে ধরে বলে, এই যে দেহ থোকসার পাতা, তোমাক তো কইছি যে নাসিরদ্দি ঢাহা চইল্যা গেছে। তখন দুলালি খোকসার পাতাটি নিয়ে শোকে এবং নাকে ও গালে এই খসখসে পাতার ঘর্ষণে তার শরীর শিরশির করে ওঠে এবং মনে হয় যেন নাসিরউদ্দিনের গ্রাম ত্যাগের বিষয়টি হাতের মুঠোয় খোকসার পাতা চেপে ধরার পর সে উপলব্ধি করতে পারে; তার শুকনো পুকুরের মতো চোখে শোকেরা জেগে ওঠে এবং তার দুগাল বেয়ে হেমন্ত রাতের শিশিরের মতো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নামে। মিয়াবাড়ির কাজের লোকেরা এই সব কথা তখন, অথবা পরবর্তী কোনো এক সময়, গ্রামের লোকদের বিশদভাবে বলে এবং সুহাসিনীর লোকদের এই কথা মনে পড়ে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিনের অদর্শনে এই মাটির মতো ধূসর গ্রাম্য বালিকাটির জীবন অন্তঃসলিলহীন হয়ে পড়ে এবং তার চেহারা খরাপীড়িত বিদীর্ণ কাননের মতো বিধস্ত হয়। সেদিন মিয়াবাড়ির প্রাঙ্গণে দুলালি খোকসার পাতা গালে ঘষলে তার চোখে পানি আসে এবং সে বিড়বিড় করে বলে, তুমি ক্যান চইলা গেলা; তারপর এই কথা যখন গ্রামে প্রচারিত হয় তখন সুহাসিনীর লোকেরা দেখতে পায় যে, মোবারক আলির চতুর্দশ বর্ষীয়া কন্যাটি দিনে দিনে ম্লান হয়ে আসে এবং কোনো এক উদ্ভিদের পাতার সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলে। সুহাসিনীর এই লোকেরা বলে যে, তারা অনেক দিন অনেক জায়গায় কাছ থেকে দুলালিকে পাতার সঙ্গে কথা বলতে শোনে এবং তারা বলে যে, দুলালি এই সময় সর্বক্ষণ একটি কথাই ক্রমাগতভাবে বলে, এবং কেবল মৃত্যুতে তার এই আহাজারি থামে। দুলালি খোকসার পাতা হাতে করে মিয়াবাড়ির ভিটা থেকে নেমে যাওয়ার পর থেকে গ্রামের লোকেরা মিয়াবাড়ির আশপাশে ছোটো ছোটো কাগজের টুকরো কুড়িয়ে পেতে শুরু করে এবং তাদের ভেতর যারা পড়তে পারে তারা দেখে যে, এইসব কাগজের টুকরোয় একই হস্তাক্ষরে একটি মাত্র বাক্য লেখা হয়ছে, যে বাক্যটি একটি খসখসে খোকসার পাতা গালে ঘষে ঘষে মোবারক আলির মেয়ে দুলালিকে গ্রামের লোকেরা বহুবার আওড়াতে শুনেছে। দুলালির এই উন্মাদনা সম্পর্কে প্রায় সমগ্র গ্রাম জেনে যাওয়ার পরও বিষয়টি একমাত্র মফিজুদ্দিনের অজানা থাকে; গ্রামের লোকেরা তাকে এ কথা বলে না, কারণ, তারা তাদের ঔচিত্যের সীমা সম্পর্কে সংশয়ে ভোগে এবং ভাবে যে, এইসব কথা মফিজুদ্দিন নিজেই শীঘ্র জানতে পারবে; মিয়াবাড়ির চাকরদেরও কিছু বলার সাহস হয় না, আর চন্দ্রভান সব জেনেও অপেক্ষা করে মোল্লা নাসিরের প্রত্যাবর্তনের পর এ সম্পর্কে তার কথা শোনার জন্য। কিন্তু চন্দ্রভানের এই প্রতীক্ষায় লাভ হয় না, কারণ, নাসিরউদ্দিনের শীঘ গ্রামে ফেরার আশা দেখা যায় না এবং এই সময় এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, চন্দ্রভানকে মফিজুদ্দিনের কাছে বিষয়টি খুলে বলতে হয়। তখন কোনো একদিন, গ্রামের লোকেরা বলতে পারে না কতদিন পর কোনদিন, তারা জানতে পারে যে, দুলালির বিষয়টি মফিজুদ্দিন জেনেছে; তারা এরকম শুনতে পায় যে, অন্য কোনো একদিন, সকালে অথবা সন্ধের আগ দিয়ে মফিজুদ্দিন তার ভিটার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের নামায় একখণ্ড নিচু পতিত জমির ওপর পায়চারি করছিল, তখন ঘাস ও আগাছা ছাওয়া এই ভূমিখণ্ডের ওপর শালুক ফুলের মতো ফুটেছিল এক টুকরো সাদা কাগজ। পায়চারি করতে করতে মফিজুদ্দিন কাগজের টুকরোটির বিষয়ে সচেতন হয় এবং তারও কিছুক্ষণ পর অর্থহীন কৌতূহলের কারণে সে টুকরোটি হাতে তুলে নিয়ে সেই বাক্যটির দিকে তাকায়, যে বাক্যটি সুহাসিনীর কিছু লোক এ ধরনের কুড়িয়ে পাওয়া চিরকুটে ইতোমধ্যে পাঠ করেছে এবং সুহাসিনীর সব লোক তা জেনেছে; কিন্তু মফিজুদ্দিন মিয়া পড়তে না পারায় কিছুই বুঝতে পারে না, সে কাঠপেন্সিলে বাকাচোরা অক্ষরে লেখা বাক্যটির দিকে একনজর দেখে বিষয়টি গুরুত্বহীন ভেবে কাগজের টুকরোটি দলা পাকিয়ে একটু দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু নিরীহ কাগজের টুকরোয় লেখা বাক্যটি পড়ে মানে না বুঝতে পারলেও মফিজুদ্দিনের ইন্দ্রিয় শীঘ্রই সচকিত হয়ে ওঠে, প্রথম দিনের পর সে তার বাড়ির আশপাশে ক্রমাগতভাবে টুকরো কাগজের চিরকুট পড়ে থাকতে দেখতে পায় এবং সে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়ে, এটা আর গুরুত্বহীন মনে হয় না। পরবর্তী দুদিনে সে নিজের বাড়ির ভিটা, সামনের সবজির বাগান ও পতিত জমি এবং নিকটের রাস্তার পাশ থেকে একই আকারের সাতটি কাগজের টুকরো সগ্রহ করে এবং যদিও এই চিরকুট পড়তে পারে না, সে দেখে যে, কাঠপেন্সিল দিয়ে যা লেখা হয়েছে তা প্রতিটি টুকুনরায় একই রকম দেখতে এবং তখন সে বুঝতে পারে যে, সবগুলো কাগজের টুকরোয় একই কথা লেখা হয়েছে। তখন তার মনে হয় যে, কাগজের টুকরোগুলোয় একই লোক একই কথা বারবার লিখে তার বাড়ির ভিটার চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং এ ধরনের সন্দেহ হওয়ায় সে বিচলিত হয়ে পড়ে, সে কাগজের টুকরোগুলো ঘরে এনে লুকিয়ে রাখে। পরবর্তী দুদিনে সে আরো তিনটি কাগজের টুকরো পায় এবং তখন সে ভয় পেয়ে যায়, তার মনে হয় যে, কেউ কি তার পেছনে লেগেছে, কোনো দুষ্ট মানুষ কি তার বাড়ি বন্ধ করার জন্য কোনো কিছু করছে, অথবা এসব কি কোনো দুষ্ট জিনের কাণ্ড? তখন মফিজুদ্দিনের মনে পড়ে চন্দ্রভানের জিনের কথা এবং অবস্থাদৃষ্টে সে নিশ্চিত হয় যে, এটা চন্দ্রভানের সেই পুরনো দুষ্ট জিনেরই কাজ; সে বুঝতে পারে যে, তাকে এই বিপদের প্রতিকারের জন্য পুনরায় চান্দাইকোণা যেতে হবে, ইয়াকুব মৌলবির ছেলে ইয়াসিন মৌলবির কাছে। সুহাসিনীর লোকেরা এই সব ঘটনার কথা পরে জানতে পারে, তারা বলে যে, সে রাতে বিচলিত নিরক্ষর মফিজুদ্দিন বিষয়টি সম্পর্কে চন্দ্রভানের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার স্ত্রীর কাছে তাদের ভিটার চতুর্দিকে মন্ত্র লেখা কাগজের টুকরো ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনার কথা বলে এবং চন্দ্রভানকে ভয়াবহ কাগজের টুকরোগুলো বের করে দেখায়। অল্পশিক্ষিত চন্দ্রভান খাতার পাতা ভেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোতে কাঠপেন্সিলে লেখা হৃদয় ছিন্ন করা হাহাকারের মতো বাক্যটি পড়ে সব বুঝতে পারে। সম্ভবত সেই মুহূর্তে বালিকা দুলালির জন্য চন্দ্রভানের হৃদয় বিগলিত হয়, সে চিরকুটগুলো হাতে নিয়ে নিরুত্তর হয়ে থাকলে মফিজুদ্দিন প্রথমে বিভ্রান্ত বোধ করে, তারপর তার মনে হয় যে, চন্দ্রভানও তার মতো ভয় পেয়েছে; তখন সে তার হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে বেড়ার ধারে কাঠের তাকের ওপর রেখে স্ত্রীকে সাহস দেয়ার জন্য বলে, ভয় পায়ো না, কাইলই চান্দাইকোনা যামু, ইয়াকুব মৌলবির ছাওয়াল ইয়াসিন মৌলবির কাছে। মফিজুদ্দিনের এই কথা শুনে প্রৌঢ়া চন্দ্রভান তার দিকে নীরবে তাকায় এবং নিম্ন কণ্ঠে বলে যে এই সবগুলো কাগজের টুকরায় কেবলমাত্র একটি কথা লেখা আছে, তুমি কেন চইল্যা গেলা। এই কথা শুনে মফিজুদ্দিনের ভয় বেড়ে যায়, সে পরিষ্কার বুঝতে পারে যে, এটা চন্দ্রভানকে লিখেছে বদমাশ জিন; কিন্তু বাক্যটি পড়ার পর চন্দ্রভানের অস্বাভাবিক নীরব এবং বিষণ্ণ আচরণে মফিজুদ্দিন বিভ্রান্ত এবং বিচলিত বোধ করে, তার মনে হয় যে, জিনের লেখা এই চিঠি চন্দ্রভানকে দেখানো তার উচিত হয় নাই। তখন মফিজুদ্দিনের বিচলিত এবং ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভান বলে যে, এই চিরকুটগুলো মোবারক আলির মেয়ে দুলালি লেখে এবং সুহাসিনীর প্রান্তরের ওপর ছড়িয়ে দেয়। চন্দ্রভানের কথা শুনে মফিজুদ্দিনের জিনের ভয় কেটে যায়, কিন্তু তার বিভ্রান্তি কাটে না; তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভান বিড়বিড় করে বলে যে, এই চিরকুটগুলো দুলালি মোল্লা নাসিরকে লেখে, দুলালির মাথা ঠিক নাই। তখন বিচলিত এবং বিভ্রান্ত মফিজুদ্দিন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, তার বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ এবং একই সঙ্গে ক্রোধ ফিরে আসে; সুহাসিনীর লোকেরা সব জানতে পারে, তারা জানতে পারে যে, ক্রমাগতভাবে সুহাসিনীর মানুষের জীবনের গতিপথ নির্ধারণকারী মফিজুদ্দিন সে রাতে তার স্ত্রীর নিকট থেকে সকল বৃত্তান্ত শোনার পর সেই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে, যার দ্বারা, লোকেরা বলে যে, উন্মাদিনী দুলালি এবং পলাতক মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যায়; তাকের ওপর থেকে চিরকুটগুলো নিয়ে দলামোচড়া করে জানালা দিয়ে ঘরের পেছনে ফেলে দিয়ে পৌঢ়া চন্দ্রভানের নীরব মুখের দিকে তাকিয়ে সে, আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিন বলে যে, কোনো জোলার মেয়ের সঙ্গে সে তার ছেলের বিয়ে দেবে না। সুহাসিনীর লোকেরা এই কথা শুনতে পায় এবং পরবর্তী সময়ে তারা মনে করতে পারে যে, মফিজুদ্দিন মিয়া তার জীবকালে সব চূড়ান্ত বাক্যাশ্রিত সিদ্ধান্তাবলি উচ্চারণ করে চলে, এবং মোবারক আলির মেয়ের সঙ্গে নিজের ছেলে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের বিয়ে না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের দশ বছর পর যখন এক দল লোক মাটি কেটে একটি রাস্তা নির্মাণ করতে করতে খাল পার হয়ে মোবারক আলির ভিটার ওপর এসে পড়তে চায় তখন ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের বৃদ্ধ চেয়ারম্যান সফেদ পাঞ্জাবি পরে এসে দাঁড়ায় এবং বলে যে, খাল পার হয়ে এই রাস্তা সুহাসিনীতে প্রবেশ করবে না; থানার সিও সাহেবের অনুরোধ ও হুমকি এবং রংপুর ক্যান্টনমেন্টের মেজরের প্রভাব, কোনো কিছুই তার উচ্চারিত বাক্যটিকে বদলাতে সক্ষম হয় না। সুহাসিনীর লোকেরা সব শোনে এবং দেখে, এবং তারা এ সম্পর্কে গল্প করতে থাকে; তারা বলে যে, সুহাসিনীর খাল অতিক্রম করে এই রাস্তাকে এগিয়ে আসতে না দেয়ায় তাদের প্রথমে মনে হয়েছিল যে, মফিজুদ্দিন মিয়া সুরধ্বনির খাদের জব্দ করতে চায়। কিন্তু তারপর তারা এর রকম ভাবতে থাকে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার বুকের গভীরে একটি ক্ষত ছিল, যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল দুলালির জন্য মোল্লা নাসিরউদ্দিনের সংসার-বিবাগী হয়ে যাওয়ার কারণে এবং, তারা বলে যে, একটি সময়ের পর প্রবল জেদের ভেতরও পাগলিনী দুলালির জন্য তার হৃদয় আপ্লুত হয়েছিল। গ্রামের লোকেরা বলে যে, স্বীকার না করলেও, কারণ, নিজের ভুল স্বীকার করতে পারার মতো মানসিক গঠন মফিজুদ্দিনের ছিল না। তার মনের ভেতর একধরনের অপরাধবোধ এবং বেদনা ছিল, যে বেদনার ভার তার জীবনের ভয়ঙ্কর পূর্ণিমা রাত পর্যন্ত অটুট ছিল; কারণ, গ্রামের লোকেরা এই সত্য ভুলতে পারে না যে, মফিজুদ্দিনের হত্যাকাণ্ডের পরেই কেবল এই রাস্তা এগিয়ে এসে মোবারক আলির পোড়ো ভিটার ওপরকার ছটি কবর খুঁড়িয়ে দিয়ে সুরধ্বনি গ্রামের দিকে অগ্রসর হয় এবং সুহাসিনীর লোকেরা এই খবরটি পায়, এবং তারা সেদিন, তখন, অগ্রসরমাণ কোদালের তল থেকে তাদের স্মৃতির কুমারীর দেহাস্থি সগ্রহ করে। তাদের মনে পড়ে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিন গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মিয়াবাড়ির চাকরেরা দুলালির হাতের ভেতর একটি খসখসে খোকসা পাতা গুজে দিয়ে যখন বলে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিন ঢাকা চলে গেছে, তখন দুলালির চোখে কান্না নামে এবং তখন সে চেতন ও অচেতনের মাঝখানের রেখাটি অতিক্রম করে, তার জীবনে বাস্তব এবং অবাস্তবের প্রভেদ অবলুপ্ত হয় এবং সুহাসিনীর লোকেরা মনে করতে পারে, গ্রামের কাঁচা রাস্তা এবং ফসলের ক্ষেতের ওপর ছিন্ন নক্ষত্রের মতো কাগজের টুকরো ছড়াতে ছড়াতে বালিকাটি কেমন ছায়ার মতো হালকা অবয়বহীন হয়ে ওঠে। তখন একদিন সকালে মোবারক আলি তার এই অল্প বয়সে পীড়িত এবং বিপর্যস্ত বালিকা কন্যাকে নিয়ে মিয়াবাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায়, গ্রামের লোকেরা বলে যে, তাকে দেখে মিয়াবাড়ির চাকরেরা ভীত হয়ে পড়ে; কারণ, তারা সঠিকভাবেই একটি বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে, তারা কেউ মোবারক আলির নিকটে এগিয়ে না এসে দূরে সরে থেকে কাজের ব্যস্ততার ভান করে, কিন্তু কি ঘটে তা দেখার জন্য একই সঙ্গে তারা দৃষ্টি এবং শ্রুতি সীমার ভেতরে থাকে। সেদিন মিয়াবাড়ির উঠোনে উপস্থিত লোকেরা দেখে যে, বৈঠকখানার সামনে রোদের ভেতর দাঁড়ানো মোবারক আলি তার দুবাহুর ভেতর স্লান বালিকা দুলালিকে এবং এই ম্লান বালিকা তার দুবাহুর ভেতর একটি কালো মোরগ ধারণ করে আছে, এবং তখন, কিছুক্ষণ পর মফিজুদ্দিন মিয়াবাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। সেই সময় মিয়াবাড়ির প্রাঙ্গণে উপস্থিত লোকদের নিকট থেকে গ্রামের লোকেরা এই গল্প শোনে এবং সুহাসিনীর এইসব প্রবীণ লোক এখন বলে যে, সেটা মফিজুদ্দিন মিয়ার এক বড় সংকট ছিল; তার ভালোমতো জানা ছিল না এর সমাধান সে কিভাবে করবে, কতটুকু বিবেচনা সে দেখাবে, অথবা প্রশ্রয় দেবে কতটুকু ক্রোধের; সেদিন মাটির দিকে মুখ করে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে সে মোবারক আলির সামনে দাঁড়ায়, তখন, গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন কেবল একবার মোরগ কোলে দাঁড়ানো বালিকার শুকনো চোখের দহনের ভেতর নিজের চোখ রাখে এবং তখন, সেই একটি মুহূর্তের ভেতর, তার হৃদয়ে চিরস্থায়ী ক্ষতটির সৃষ্টি হয়; কিন্তু তারা বলে যে, মফিজুদ্দিন চিরজীবন মফিজুদ্দিনই ছিল, সে এক মুহূর্তেই তার চোখ সরিয়ে নেয় এবং দ্বিতীয়বার বালিকার মুখের দিকে তাকায় না, এবং মেয়েটির যন্ত্রণার তীব্রতার উপলব্ধি তার হৃদয়কে দ্রবীভূত করতে চাইলে সে তার ক্রোধকে মুক্ত করে; সে নির্মমতার সঙ্গে তার সিদ্ধান্ত নেয়, মোবারক আলি কেন এসেছে তা সে জানতে চায় না, তাকে সে একটি কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে সেই কথাটি বলে, যে কথা কয়েক দিন আগে রাতের বেলা সে চন্দ্রভানের সামনে উচ্চারণ করেছিল। তখন তার কথা শুনে মোবারক আলির রাগ হয়, না লজ্জা হয়, না দুঃখ হয়, তা গ্রামের লোকেরা বলতে পারে না; তারা বলে যে, এই বৃদ্ধ, মফিজুদ্দিনের দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তারপর এক হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মিয়াবাড়ির উঠোন থেকে নেমে যায়; সেদিন মোবারক আলির মেয়েকে সঙ্গে করে নিজের ভিটায় ফিরে যাওয়ার পর গ্রামের মানুষ দুলালিকে আর দেখতে পায় না। তখন একবার কয়েক দিন ধরে একটানা বৃষ্টি পড়তে শুরু করে, সূর্যের মুখ কেউ দেখতে পায় না, গ্রামের লোকেরা পাঁচ দিন ঘরের ভেতর আটকা পড়ে থাকে; পাঁচ দিন পর বৃষ্টি একটু কমে আসে কিন্তু আকাশের ঘন মেঘ পরিষ্কার হয় না এবং এরপর পুনরায় প্রবল হয়ে বর্ষণ নামে, এই বারিপাত পরবর্তী সাত দিন ধরে চলে। শ্রাবণের এইসব দিনে সুহাসিনীতে সেই ঘটনাটি ঘটে যার স্মৃতি কালোত্তীর্ণ হয়ে গ্রামের লোকদের মনে জেগে থাকে; তারা বলে যে, কোনো এক দিন ভোরে অথবা দুপুরে মোবারক আলি যখন মিয়াবাড়ির ভিটার ওপর তার পীড়িত কন্যাকে বাহুর ভেতর নিয়ে দাঁড়ায় এবং মফিজুদ্দিন মিয়া ক্ষিপ্ত চাপা গলায় বলে যে, তন্তুবায় জেলার মেয়ের সঙ্গে সে তার ছেলের বিয়ে দিতে পারে না, তখন বেদনাক্লিষ্ট এবং লজ্জিত পিতা মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে ফিরে যায় এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, দুলালিকে এরপর আর গ্রামের পথ এবং কৃষিভূমির ওপর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখা যায় না। মোবারক আলি দুলালির বেদনা এবং লজ্জাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে চাপা দেয়, সে তার একটি লম্বা টিনের ঘরের মাঝখানের সব পার্টিশন-বেড়া সরিয়ে ঘরটিকে বড় করে এবং দুলালিকে ঘরের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে রাখে। দুলালি এই ঘরের ভেতর খাঁচায় আটকানো হরিণীর মতো হেঁটে বেড়ায়, বিছানায় শুয়ে নিজে নিজে কথা বলে, অথবা খাতার পাতা ছিঁড়ে সেই একটি বাক্য রচনা করে। ঘরের ভেতরটায় বিড়বিড় করে বলা তার কথার অনুচ্চধ্বনি এবং মাটির কাঁচা মেঝের ওপর চিরকুটের স্থূপ জমে ওঠে; এই সময় শ্রাবণের ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে যায় এবং সুহাসিনীর প্রান্তরের ওপর ক্রমাগত বৃষ্টি পড়তে থাকে। গ্রামের লোকেরা একটি ঘরের ভেতর দুলালির আটক হওয়ার খবর পায় এবং তারা যখন সবকিছু জানতে পারে, তারা এই জিনিসটি বুঝতে পারে না যে, দুলালি কতটুকু পাগল হয়েছিল; কারণ, বন্ধ ঘরের ভেতর আটকা থাকার সময়, জগৎ-সংসার সম্পর্কে বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত হওয়ার পর সে এমন দুটো কাজ করে, যাতে মনে হয় যেন তার স্বাভাবিক শরীরবৃত্তিক অনুভূতি এবং পরিপার্শ্ব সম্পর্কে সম্বিৎ রয়ে গেছে। ক্রমাগত বৃষ্টি এবং মেঘাচ্ছন্ন স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার বিষয়টি মনে হয় যেন ঘরের ভেতর আটকা থাকা সত্ত্বেও তার চেতনায় ধরা পড়ে; একটানা বৃষ্টির দরুন সূর্যের আলোর অভাবে সুহাসিনীর মানুষদের যখন বিরক্তি এবং কষ্ট হতে থাকে তখন, মনে হয় যেন, দুলালির মনের ভেতরও আলোর অভাব বোধ জেগে ওঠে এবং সে এই বিষয়টি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে যে, সূর্যের আলোর রঙ হচ্ছে হলুদ–নীল কিংবা সুবজ নয়। এই ক্রমাগত বৃষ্টির সময় মোবারক আলির তাঁতঘরে জায়গার সমস্যা দেখা দেয়, তখন তার বড় ছেলে আব্দুল জলিল একটি সাধারণ ভুল করে, যেটা অসাধারণ এবং ভয়ানক হয়ে ওঠে এবং যার আর কোনো প্রতিকার থাকে না। কারখানা ঘরের টিনের চালের ভেতর দিয়ে একদিন পানি পড়তে থাকলে স্থানাভাবের কারণে সুতো ভেজানো তিনটে রঙের ড্রাম সে দুলালির ঘরে স্থানান্তর করে; এই ড্রামগুলোর একটিতে গোলানো তরল সবুজ রঙ ছিল, অন্য একটায় ছিল নীল রঙ এবং হলুদ রঙ ছিল তৃতীয়টায়; লম্বা ঘরের ভেতর হাঁটাচলা, নিজে নিজে ক্রমাগত কথা বলা এবং খাতার পাতা ছিঁড়ে চিরকুট লিখে ছড়িয়ে দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে কোনো এক সময় দুলালি এই ড্রাম এবং ভেতরকার রঙ পরখ করে দেখে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, তখন, চেতনার সেই বিভ্রান্তির ভেতর দুলালির মনে হয় যে, বহুদিন সে সূর্যের আলো দেখে না, এবং মোল্লা নাসিরউদ্দিনের মতো সূর্যের আলোর স্পর্শের জন্যও তার বুকের ভেতরটা ছটফট করে ওঠে। তখন কোনো এক সময় ড্রামের হলুদ রঙের তরলের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় যে, তার জন্য এক ড্রাম উষ্ণ সূর্যের আলো ধরে রাখা হয়েছে এবং সে আঁজলা ভরে এই রাসায়নিক তরল ক্রমাগতভাবে পান করতে থাকে এবং তার বিষক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে বিষয়টি কারো নজরে আসে না, কারণ, দুলালির শারীরিক নিরাপত্তার বিষয়ে সকলের একধরনের নিশ্চিন্ততা ছিল। কিন্তু ঘরের ভেতর আটকে রাখা মেয়েটির বিষয়ে তাদের নিশ্চিন্ততার ভুল শীঘ্র ভাঙে; সেদিন বিকেলে ছমিরুন্নেছা বাইরে থেকে লাগানো দরজার শেকল খুলে ঘরে ঢুকে দুলালিকে একটি ছিন্ন লতার মতো ভূমিতে লুণ্ঠিত অবস্থায় দেখে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, ছমিরুন্নেছা প্রথমে কিছু বুঝতে পারে না, সে ভাবে যে এটা হয়তো পাগল মেয়ের খেয়াল, তারপর সে যখন মেঝের ওপর দুলালির বমি দেখে তখন সে কিছুটা শঙ্কিত বোধ করলেও বিষয়টা বুঝতে পারে না। সে যখন দুলালিকে ভূমি থেকে তুলে বিছানায় আনে দুলালির তখন জ্ঞানরহিত হয় নাই, তাকে দেখে তার মা এবং পরিবারের অন্যরা ভাবে যে, উন্মাদনার ঘোরের কারণে সে হয়তো মূৰ্ছা গিয়েছিল; তখন দুলালি বিষয়টি পরিষ্কার করে দেয়ার জন্যই যেন বলে যে, সে রঙের ড্রামের ভেতর থেকে রোদের আলো পান করেছে। কিন্তু ড্রামের ভেতর থেকে রোদের আলো পান করার বিষয়টি দুলালির পরিবারের সদস্যদের বুঝতে তার পরেও সময় লেগে যায়, তারা যখন বুঝতে পারে যে, দুলালি ড্রামে রাখা রঙ গোলানো পানি খেয়েছে, তখন দুলালির মুখ দিয়ে লালা গড়ানো এবং শরীরে খিচুনি শুরু হয়ে যায়। মোবারক আলি এবং তার সাত ছেলে বৃষ্টির ভেতর ছোটাছুটি করতে থাকে, তারা বুঝতে পারে না তারা কি করবে অথবা গ্রামের কে তাদেরকে এই বিপদে সাহায্য করতে পারবে; অবশেষে তারা জুম্মা মসজিদের ইমাম নইমুদ্দিন সরকারকে ডেকে আনে এবং তার পরামর্শে সেই বৃষ্টির ভেতর ধানঘড়ায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁশ কেটে একটি খাটিয়া বানিয়ে দুলালিকে তাতে ওঠায়, তখন তার বুকের ওপর কান চেপে ধরে রোরুদ্যমান ছমিরুন্নেছা আর্ত চিৎকার করে ওঠে, আল্লাহ কিংবা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের নাম উচ্চারণ ছাড়াই অচেতন বালিকার মৃত্যু হয় এবং তখন জুমা মসজিদের ইমাম নইমুদ্দিন সরকার এবং সেখানে উপস্থিত গ্রামের কৃষকদের চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে এবং তাদের কান্নাভেজা নরম কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। যদিও, পরদিন দুলালির পরিবার এবং সুহাসিনীর লোকেরা বুঝতে পারে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিনের নাম দুলালির সঙ্গে সর্বদাই ছিল, তখন ঘটনাপ্রবাহ এক অবিস্মরণীয় বাক নেয়; লজ্জিত, অপমানিত, ভীরু এবং বেদনাবিদীর্ণ মোবারক আলি এমন এক ধর্মদ্রোহী এবং খ্যাপা কর্মকাণ্ড শুরু করে, যার ফলে সুহাসিনীর লোকদের মনে হয় যে, মফিজুদ্দিন মিয়া তার জীবনে প্রথমবারের মতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সুহাসিনীর লোকেরা বিস্ময়ের সঙ্গে একটি জিনিস লক্ষ করে যে, দুলালির মৃত্যুর সঙ্গে বৃষ্টি থেমে যায় এবং তারা বলে যে এই অঝোর বৃষ্টি হয়তো ছিল দুলালির শেষ কান্নার মতো; তার মৃত্যুতে এই কান্না থামে এবং পরদিন সকালে সুহাসিনীর লোকেরা ঝকঝকে রোদ উঠতে দেখে এবং তারা শুনতে পায় যে, মোবারক আলির কিশোরী কন্যা দুলালি তার যন্ত্রণা এবং লজ্জার জীবন অতিক্রম করে গেছে; বৃষ্টির অন্ধকার এবং ভেজা দিনে ড্রামে গুলিয়ে রাখা হলুদ রঙ সে রোদের আলো মনে করে পান করেছিল। তারা বলে যে, সততা ভেজানো এই রঙ, অথবা তরল রোদ খেয়ে নেয়ায় দুলালির দেহের ভেতর রঙ অথবা আলোর ক্রিয়ার ফলে তার দেহের সকল কোষকলা তাদের পার্থিব অবস্থা এবং অবয়ব হারিয়ে স্ফটিকের মতো হয়ে ওঠে; এবং বহুদিন পর সুহাসিনীর প্রবীণ লোকেরা, যারা এই সব ঘটনা চাক্ষুষ করেছিল, যখন এই কথা বলে, তখন তাদের শ্রোতারা তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারে না; কিন্তু এইসব বিভ্রান্ত এবং সংশয়বাদী শ্রোতার মুখের দিকে তাকিয়ে তারা বলে, গপ্পো না, হাচা কই; তারা বলে যে, সে দিন সকালে দুলালির মৃত্যুর খবর শুনে এতদিন বৃষ্টির পর ঝকঝকে রোদ ওঠার আনন্দ তাদের শেষ হয়ে যায়, তারা শোকার্ত এবং নীরব পাখির ঝকের মতো মোবারক আলির উঠোনে এসে জড়ো হয়। দুলালির মৃতদেহ তখন দক্ষিণদুয়ারি লম্বা ঘরের চৌকির ওপর রাখা ছিল, এই সময় মৃত দুলালির পরনের শাড়ির আঁচলের খুঁটে বাঁধা এটি চিরকুট আবিষ্কৃত হয়, এই চিরকুটে সে লেখে, তুমি কোনে নাসির ভাই; এবং তখন, দুলালি যে ঘরে রঙ গোলানো পানি পান করে, সেই ঘরের মেঝেতে দুলালির লেখা অসংখ্য চিরকুট ছড়িয়ে থাকলেও, তার আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখা চিরকুটটি পাওয়ার পর মোবারক আলি প্রথমে একেবারে ভেঙে পড়ে, সে মৃত। মেয়ের লাশ জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, এই সময় চোখের পানিতে মোবারক আলির লজ্জা এবং ভীরুতার গ্লানি মুছে যায়; চরম রিক্ততার শোকের ভেতর তার জীবনের প্রথম সাহস এবং জেদ দেখা দেয়, সে দুলালির মৃতদেহ ছেড়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় এবং মিয়াবাড়ির দিকে রওনা হয়; তখন সেখানে উপস্থিত সুহাসিনীর লোকেরা বুঝতে পারে, মোবারক আলি কোথায় যায় এবং তারা তার পেছনে একটি মিছিল করে আসে। মোবারক আলি এবং তার পেছনে সুহাসিনীর লোকেরা যখন মিছিল করে আসে তারা মফিজুদ্দিন মিয়াকে বাড়ির বাইরের উমেনে গাবগাছ তলার ছায়ায় একটি চেয়ারে একা উপবিষ্ট দেখতে পায়; মোবারক আলি তখন রাস্তা থেকে ভিটার ওপর উঠে আসে, কিন্তু মিছিল করে আসা গ্রামের লোকেরা ভিটার ওপর ওঠে না, দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। মোবারক আলি, মফিজুদ্দিনের সামনে দাঁড়িয়ে ফোঁপায় এবং দুলালির মৃত্যুর খবর বলে এবং জানায় যে দুলালির শেষ ইচ্ছে ছিল মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দেখার। মফিজুদ্দিন নির্বাক এবং নিশ্চল মূর্তির মতো বসে থেকে মোবারক আলির কথা শোনে এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিনকে তাদের চেনা ছিল, তার সামনে মোবারক আলির কান্নার শব্দ এবং কথা শুনে তারা বিস্ফোরণের জন্য প্রতীক্ষা করে এবং শীঘ্রই সেটা ঘটে। মোবারক আলি পুলালির শেষ ইচ্ছের কথা বলার পর মফিজুদ্দিনকে অনুরোধ করে একটা খবর পাঠিয়ে মোল্লা নাসিরকে ডেকে আনার জন্য; তখন মফিজুদ্দিনের দেহে মনে হয় যেন প্রাণ ফিরে আসে, চেয়ারের হাতলের ওপর নিষ্প্রাণভাবে পড়ে থাকা হাত দুটো সক্রিয় হয় এবং মুঠোর ভেতর হাতল চেপে ধরে, তারপর চাপা কিন্তু ক্ষিপ্ত কণ্ঠে সে মোবারক আলিকে জোলার ছেলে জোলা বলে গাল দেয় এবং তারপর চেয়ার ছেড়ে ভিটার নিচে অবস্থানরত সুহাসিনীর লোকদের দিকে হাত উঁচিয়ে চিক্কার করে তেড়ে আসে, হারামযাদা, তরা এইখানে খাড়ায়া খাড়ায়া কি দেহিস! সুহাসিনীর লোকেরা সেদিন তাড়া খেয়ে ছুটে পালায় এবং তারপর তারা মোবারক আলিকে ধীর এবং ভীরু পায়ে চোখ মুছতে মুছতে মিয়াবাড়ির ভিটা থেকে নেমে আসতে দেখে; তারা বলে যে, তারা মনে করেছিল বিষয়টির এখানেই শেষ, কিন্তু তারা একই সঙ্গে বলে যে, এই একটি বার তারা মোবারক আলিকে বুঝতে পারে নাই এবং এই একটিবার তারা দেখতে পায় যে, মফিজুদ্দিনের সকল জিদ অভঙ্গুর নয়; দুলালির মৃত্যুর পর মফিজুদ্দিন মিয়া এবং মোবারক আলির ভেতর এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যার পরিণতিতে মফিজুদ্দিন তার জীবনে প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বারের মতো পরাজয় মেনে নেয়। মফিজুদ্দিনের ভিটা থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর দুলালির লাশ ঘরের ভেতর থেকে বের করে একটি গাছের ছায়ায় চৌকির ওপর রাখা হয়, কাপড় দিয়ে এই চৌকিটার চারদিক ঘিরে দিয়ে পর্দা তৈরি করার পর বরই গাছের পাতা ডোবানো অল্প গরম পানি দিয়ে ছমিরুন্নেছা এবং অপর একজন রমণী তাকে শেষ গোসল করায় এবং, এই পর্দার ঘেরের বাইরে দাঁড়ানো জুমা মসজিদের ইমাম নইমুদ্দিন সরকারের নির্দেশানুযায়ী, সাদা মার্কিন কাপড়ের বিভিন্ন আকারের তিন প্রস্থ কাফনের কাপড়ে মৃত দুলালির দেহ জড়িয়ে দেয়। কাফন পরানোর পর পর্দা সরিয়ে নেয়া হয়, তখন কদু ফুলের সাদা পাপড়ির মতো কাফনের বাঁধন খুলে মোবারক আলি যখন মেয়ের মুদিত চোখ এবং নির্লিপ্ত বিষণ্ণ মৃত মুখ দেখে, তার বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে; তখন মৃত বালিকার আঁচলে বাধা চিরকুটটির কথা তার পুনরায় মনে পড়ে এবং তার মনে হয় যে, এই দুঃখিনী মেয়েটিকে এভাবে কবর দেয়া যায় না; সে লাশ রাখা খাটিয়ার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং মলিন পাঞ্জাবির আস্তিনে চোখ মুছে বলে যে, সে তার মেয়েকে কবরস্থ করবে না, আমার ম্যায়ক আমি কবর দিমু না; একধরনের খ্যাপামির সঙ্গে সে বলে যে, দুলালির লাশ গলে পচে পোকা ধরুক, সুহাসিনী লাশের গন্ধে ভরে যাক গ্রাম এবং পৃথিবী রসাতলে ডুবুক, তবু মোল্লা নাসিরউদ্দিন গ্রামে না ফেরা পর্যন্ত সে তার মেয়েকে কবরে নামাবে না। মোবারক আলির কথা শুনে গ্রামের মুসলমান কৃষকেরা শিহরিত হয়, তারা তাদের জীবনে এমন কথা শোনে নাই; তারা বলে যে, এটা ধর্মবিরোধী কাজ, মুর্দা নিয়ে খেলা করা অনুচিত, মুর্দাকে কবর দিতে যত দেরি করা হবে মুর্দার গোর আজাব তত বৃদ্ধি পাবে। গ্রামের লোকেরা তখন নইমুদ্দিন সরকারকে খুঁজে বের করে এবং তার পরামর্শানুযায়ী লাশ দাফনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য তৎপর হয়; মোবারক আলির প্রাঙ্গণ থেকে গ্রামের লোকেরা দুলালির লাশ রাখা খাটিয়া বহন করে মিয়াবাড়ির ভিটার উত্তর-পূর্ব পাশে টিনের ছাপড়া মসজিদের সামনে এনে রাখে, তখন নইমুদ্দিন সরকার একটি পুরনো পাঞ্জাবি এবং টুপি পরে এসে সুহাসিনীর লোকদের জানাজার নামাজে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান করে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, এই পুরো সময়টাই মফিজুদ্দিনের জিদ এবং অহমের জন্য ছিল বিপর্যয়কর; জানাজার নামাজের সময় এই কথাটি তাদের মনে হয় যে, মফিজুদ্দিন এখন কি করবে, সে কি এই নামাজে শরিক হবে, নাকি হবে না; গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে না, তবে তারা এটা বুঝতে পারে যে, সে যা-ই করুক না কেন কোনোটাই তার জন্য সহজ সিদ্ধান্ত হবে না। সেদিন মসজিদের সামনের খালি জায়গাটা যখন গ্রামের মানুষের পূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন তারা সাদা কাপড়ের গোল টুপি মাথায় মফিজুদ্দিন মিয়াকে এগিয়ে আসতে দেখে এবং তারা বুঝতে পারে যে, মফিজুদ্দিন গ্রামের লোকদের সামনে থেকে লুকিয়ে থাকার মানুষ নয়। তখন গ্রামের লোকেরা বিস্ময় এবং উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করে, তারা নীরবে সম্মুখের সারির মাঝখানে মফিজুদ্দিনের জন্য জায়গা করে দেয়; কিন্তু সে সোজা হেঁটে গিয়ে একেবারে পেছনের সারিতে দাঁড়ায়। নামাজের পর গ্রামের লোকেরা লাশ নিয়ে মোবারক আলির ভিটায় ফেরে এবং সেখানে ইতোমধ্যে খনন করা কবরের পাশে, জামগাছ তলার ছায়ায় খাটিয়া নামায়; কিন্তু লাশ দাফন করা তাদের হয় না, তারা দেখে যে, জানাজার নামাজের পর খানিকটা সুস্থির হয়ে এলেও মোবারক আলির খ্যাপামি যায় না। মোবারক আলি এই সময় তার পূর্বে বলা কথাগুলো যখন পুনরায় বলে, আমার মায়াক আমি কবর দিমু না, গ্রামের লোকেরা তার কথা শুনতে চায় না, তার সাত ছেলে তাকে বোঝায়। দুলালির ব্যাপারে মফিজুদ্দিন মিয়ার হৃদয়হীনতায় ক্ষুব্ধ হলেও সুহাসিনীর লোকদের কাছে লাশ দাফন না করে ফেলে রাখার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয় না, বিশেষ করে তারা যখন পরিষ্কার বুঝতে পারে পারে যে, মফিজুদ্দিনের জিদের কথা বাদ দিলেও, এই লাশ পচে গলে উবে যাওয়ার আগে মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে সুহাসিনীতে এনে হাজির করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তারা যখন কবরে লাশ নামানোর প্রস্তুতি নেয় তখন মোবারক আলি তার ছেলেদের হাতের বাঁধন ছিন্ন করে উন্মুক্ত কবরের ভেতর লাফিয়ে নেমে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে এবং ফোঁপাতে থাকে, আমাকও তোমরা কবর দেও! সুহাসিনীর লোকেরা তখন নিরস্ত হয়, মোবারক আলির কান্নায় মনে হয় যেন তাদের কোনো সহানুভূতি জাগে না, তার এই আচরণে তারা ক্লান্ত, বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে, এবং তারা কবরের ভেতরে শায়িত মোবারক আলি এবং উপরে জামগাছের ছায়ায় দুলালির লাশ রেখে নিজেদের বাড়ির দিকে ফিরে যায় এবং বিষয়টি ভুলে যাওয়ার অথবা ভুলে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রামের এই সব বিষয় থেকে গ্রামের লোকদের পক্ষে দীর্ঘক্ষণ দূরে সরে থাকা সম্ভবপর হয় না, রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে দিনের বেলাটা কাটিয়ে দিলেও সন্ধের পর থেকে তাদের ঔৎসুক্য বাড়তে থাকে, কি অবস্থা অবশেষে দাঁড়াল জানার জন্য; এবং তখন গভীর রাতে যারা কোনো কারণে জেগে থাকে, তাদের জন্য অপেক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। অবশেষে খুব সকালে গ্রামের লোকেরা মোবারক আলির বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়, তারা দেখে যে, জামগাছ তলায় খাটিয়ার ওপর সাদা কাফন জড়ানো দুলালির লাশ পড়ে আছে; তারা সারা দিন মোবারক আলির উঠোনে এবং বাড়ির পেছনে কবরের কাছে ভিড় করে থাকে, তাদের মনে হয় যে, দুই রাত এক দিন পর কাফনের ভেতর নিশ্চয়ই দুলালির লাশ পচতে শুরু করেছে এবং এখনই তারা গন্ধ পেতে শুরু করবে, কিন্তু তারা কোনো গন্ধ পায় না। রাতের বেলা গ্রামের লোকেরা বাড়ি ফিরে যায় এবং কোনোরকমে রাত কাটিয়ে সকালে পুনরায় ফিরে আসে, তারা এই ব্যাপারটা বুঝতে পারে যে, একটি শোকাবহ এবং ধর্মবিরোধী বিষয় যুগপৎ তামাশার বস্তু হয়ে উঠেছে, কিন্তু তারা ঘটনাপ্রবাহ এবং নিজেদের আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। এদিন সকালে মোবারক আলির ভিটায় এসে হাজির হওয়ার পর তারা দেখে যে, জামগাছ তলায় খাটিয়ার ওপর একটি চাদর রশি দিয়ে চার কোনায় বেঁধে দোয়ার মতো টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে; তারা লাশের কাছে ঘোরাঘুরি করে, কিন্তু ক্রমাগতভাবে জ্বালানো লোবানের গন্ধ ছাড়া পচা মাংসের কোনো গন্ধ তাদের নাকে আসে না। গ্রামের লোকেরা হিসাব করে দেখে যে, দুলালির মৃত্যুর পর তিন রাত এবং দুই দিন অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু তারা তবু কোনো গন্ধ পায় না, লাশে পচনের কোনো লক্ষণ দেয়া যায় না; তারা ভাবে যে এটা কি সম্ভব যে, শুধুমাত্র কয়েকটি লোবান কাঠির মৃদু ঘ্রাণের নিচে তিন দিনের পচা লাশের গন্ধ ঢাকা পড়ে যাবে; তারা তখন কাফনের মাথার দিকের বাঁধন খুলে ষাট ঘন্টা পূর্বে মৃত বালিকার মুখ অনাবৃত করে। সুহাসিনীর প্রবীণ লোকেরা পরবর্তী সময়ে বছরের পর বছর এই গল্প সেই সব লোকের কাছে বলে, যারা এই ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় ছোটো ছিল এবং সব ভুলে গিয়েছিল অথবা যারা এই সময় জন্মই নেয়নি। তারা বলে, এই রহম ব্যাপার আর কোনোদিন দেখমু না; তারা মুর্দা নিয়ে এই কাণ্ড করায় মোবারক আলির নিন্দা করে, কিন্তু লাশ পচে না যাওয়ার প্রসঙ্গে এসে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, এবং বলে যে, এটা ছিল আল্লাহর এক কুদরত। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, দুলালির মৃত্যুর পর তৃতীয় দিন সকালে লাশের কাফনের গিঁট খুলে তারা যখন তাকায় তখন মৃত দুলালির মুখ সাদা মেঘের কোলে ফুটে থাকা পূর্ণচন্দ্রের মতো লাগে, হলুদ বর্ণপ্রাপ্ত মুখটি চিনেমাটির তৈজসের মতো চকচক করে। মৃত বালিকার মুখ দেখে গ্রামের লোকেরা তখন এই বিষয়টি বুঝতে পারে যে, এই শব ক্ষয় হতে দেরি হবে এবং মোবারক আলি অথবা মফিজুদ্দিন মিয়ার একজন যদি আপস না করে, তাহলে এই লাশ হয়তো অনন্তকাল ধরে মাটির ওপরেই থেকে যাবে, কবর দেয়া হবে না। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মোবারক আলির ওপর বিরক্ত হলেও বিষণ্ণ বালিকা দুলালির জন্য তাদের হৃদয় বেদনা এবং মমতায় পূর্ণ হয়ে ছিল; তারা যখন বুঝতে পারে যে, এই লাশে পচন শুরু হতে দেরি হবে, তারা মোবারক আলিকে আর চাপ না দিয়ে, মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে যাতে ডেকে আনার ব্যবস্থা করা হয়, সে উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা বলে যে, বিষয়টিতে জড়িত না হয়ে তাদের উপায় ছিল না, অবস্থাটা বিশদ অনুধাবন করতে পারার পর বয়স্ক গ্রামবাসীদের কয়েকজন মিলে পরামর্শ করে এবং একদল যুবককে পাঠায় গ্রামের ভেতর থেকে কয়েকটি বেওয়ারিশ কুকুর মেরে আনার জন্য; তারা বলে যে, এটা ছিল গর্তের ভেতর থেকে বাঘকে খুঁচিয়ে বের করে আনার মতো ব্যাপার। এই যুবকেরা, সেদিন দুটো মর্দা এবং একটি মাদি, মোট তিনটি কুকুর মেরে বাঁশে ঝুলিয়ে কাঁধে করে নিয়ে আসে। গ্রামের লোকেরা তখন মোবারক আলির ভিটা ত্যাগ করে উন্মুক্ত কৃষি জমির ওপর এসে দাঁড়ায়, মুঠোয় করে ধুলো নিয়ে আকাশের দিকে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে তারা দেখে যে, তাদের ছুড়ে দেয়া এই গুঁড়ো মাটি মফিজুদ্দিন মিয়ার বাড়ির দিকে না গিয়ে, মোবারক আলির বাড়ির দিকেই উড়ে যায়। গ্রামের লোকেরা তখন তিনটি মরা কুকুর সঙ্গে নিয়ে বাতাসের দিক পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে এবং দুপুর পর্যন্ত একাধিকবার ধুলো ছুড়ে পরীক্ষা করার পর তারা অনুকূল বায়ু পায়, তাদের ছুড়ে দেয়া ধুলো মিয়াবাড়ির দিকে যেতে থাকে। গ্রামের লোকেরা তখন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে লাগে, তারা খোলা মাঠ ত্যাগ করে মিয়াবাড়ি এবং মোবারক আলির ভিটার মাঝামাঝি জায়গায় একটি জঙ্গলাকীর্ণ পোডড়া ভিটায় মৃত কুকুরগুলো নিয়ে আসে। তারা তখন কিছু খড়ি জোগাড় করে একটি অগ্নিকুণ্ড বানায় এবং একটি মৃত কুকুরের শব এই আগুনে নিক্ষেপ করে আস্তে আস্তে পোড়াতে থাকে এবং তখন, এই পোডড়া ভিটার উত্তর পাশের পুরো গ্রাম তীব্র কটু পোড়া গন্ধে ভরে যায়। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, পুরো অবস্থা বিবেচনায়, এই উৎপাত সহ্য না করে তাদের উপায় ছিল না; তারা নাকে গামছা বেঁধে অপেক্ষা করে এবং সবকিছু জেনেশুনেও বলে, পচা লাশের গন্ধ পাওয়া যায়। গ্রামের লোকদের কেউ কেউ তখন ইচ্ছাকৃতভাবে মফিজুদ্দিন মিয়ার ভিটার আশপাশে হাঁটাহাটি শুরু করে এবং এদের অনেকে মিয়াবাড়ির চাকরদের সঙ্গে গল্প করার ছলে বলে যে, এই গন্ধ মোবারক আলির মেয়ে দুলালির লাশের এবং মোবারক আলি বলেছে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে না দেখিয়ে সে তার মেয়ের লাশ দাফন করবে না। গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে না তাদের এই সব কায়দা-কৌশল কাজ দেয় কি না, তাদের দেয়া খবর চাকরদের কাছ থেকে মিয়াবাড়ির ভেতরে প্রচারিত হয় কি না; তখন, তাদের কুকুরের মৃতদেহ পুড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না, পরে তারা বলে যে, তারা এমন কাণ্ড করেছিল এটা ভাবলে তাদের এখন হাসি পায়; সেদিন মরা কুকুর পোড়াতে পোড়াতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় তারপর বিকেল গড়াতে থাকে পল পল করে, তখন দ্বিতীয় কুকুরটি পুড়ে একেবারে ভস্ম হয়ে গেলে গ্রামের লোকেরা অগ্নিকুণ্ডে আরো খড়ি যোগ করে তাতে তৃতীয় ককুরটিকে নিক্ষেপ করে। মরা মাদি কুকুরটি যখন পুড়তে থাকে তখন, গ্রামের লোকেরা বলে যে, তারা যে ব্যাপারটিকে পরিণতিতে অসম্ভব বলে মনে করছিল, সেই ঘটনা ঘটে; অপরাহ্নের ম্লান আলোয় একটি কিশোর এবং একজন কামলার সঙ্গে ঘোমটা দেয়া একটি স্ত্রীলোক মিয়াবাড়ির ভিটা থেকে রাস্তায় নেমে আসে, সুহাসিনীর কৃষকেরা বহুদিন পর আলি আসগর মিয়ার মেয়ে চন্দ্রভানের মুখ দেখে। সেদিন চন্দ্রভান যখন তার ছোটো ছেলে আবুবকর সিদ্দিককে সঙ্গে নিয়ে মোবারক আলির বাড়িতে গিয়ে ওঠে, তখন গোটা সুহাসিনীর লোক সেখানে গিয়ে জড়ো হয়; তারা বলে যে, মফিজুদ্দিনের স্ত্রী মোবারক আলির বাড়িতে লাশের কোনো গন্ধ পায় না, সে জামগাছ তলায় গিয়ে লাশের মাথার দিকের কাফনের কাপড় ফাঁক করে দুলালির মুখ দেখে এবং তখন তার কালো দুটো চোখ পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়। মোবারক আলির এক ছেলে একটি নিচু টুল এনে দিলে চন্দ্রভান লাশের কাছে বসে এবং গ্রামের লোকেরা ঘোমটার ফাঁক দিয়ে তার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, অবস্থা আসলে কি দাঁড়াল; তারা বলে যে, মোবারক আলির ভিটায় চন্দ্রভানের আগমনের ঘটনার দ্বারা মফিজুদ্দিনের জিদের পরাজয় সূচিত হলেও তাতে মৃত বালিকা দুলালির আর কোনো লাভ হয় না, সে কাফন জড়ানো অবস্থায় জামগাছ তলায় পড়ে থাকে। সেদিন দুলালির মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানের, এই নারী এবং বালিকার জন্য শোক হয়, তখন মোবারক আলির স্ত্রী ছমিরুন্নেছা মৃত্যুকালে দুলালির পরনের শাড়িটি নিয়ে আসে এবং শাড়ির আঁচলের খুঁট খুলে সেই চিরকুটটি চন্দ্রভানের হাতে তুলে দেয় এবং সেটা পড়ে ইতোমধ্যে বিচলিত চন্দ্রভানের হৃদয় দৃশ্যত ভেঙে পড়ে; তার চোখ পুনরায় পানিতে ভরে গিয়ে গড়িয়ে নামে এবং তার ডান হাতের করতল মৃত বালিকার মুখ স্পর্শ করে একটি গাছের কম্পিত শাখার মতো সঞ্চরমাণ হয়। সে বিকেলে মোবারক আলির বাড়ি থেকে চন্দ্রভান ফিরে যাওয়ার পর গ্রামের লোকেরা দুটো ঘটনা ঘটতে দেখে, প্রথমে তারা দেখে যে, মফিজুদ্দিনের ছোটো ছেলে আবুবকর সিদ্দিক কাঁধে কাপড়ের একটি ঝোলা-ব্যাগ ফেলে মিয়াবাড়ি থেকে বের হয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে হেঁটে যায়, তারা তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারে এবং বলে, ঢাহা যায়। প্রায় একই সময়, মফিজুদ্দিনের চারজন কামলা চান্দাইকোনা গিয়ে চটে জড়ানো দুই চাঙড় বরফ, এক কস্তা কাঠের গুঁড়ো এবং পাঁচ সের চা-পাতা কিনে নিয়ে আসে। রাত একটু গভীর হওয়ার পর মিয়াবাড়ির এই কামলারা তাদের কেনা দ্রব্যাদি এনে মিয়াবাড়ির উঠোনে রাখে। পরবর্তী সময়ে সুহাসিনীর কৃষকেরা বলে যে, যাদের বাড়ি এই পথের ধারে পড়ে এবং তপ্ত রাতের কারণে যারা ঘুমোতে না গিয়ে জেগে ছিল, তার সেদিন দেখেছিল মফিজুদ্দিন মিয়ার চাকরেরা বাঁশের ভারে ঝুলিয়ে কিসব বোঝা যেন নিয়ে যায়। সুহাসিনীর এইসব লোক তাদের স্মৃতির ভেতর থেকে এইসব কথা তুলে আনে; কত দিন পর তা তারা নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না, দিনের হিসাব তারা ভুলে যায়, তারা বলে যে, দুলালির মৃত্যুর পর তৃতীয়, চতুর্থ অথবা পঞ্চম দিনের রাতে মফিজুদ্দিনের নয় নম্বর ছেলে বড় বাক্সের অকারের দুই চাঙড় বরফ, কাঠের গুঁড়ো আর চা-পাতাসহ মোবারক আলির বাড়িতে আসে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মোবারক আলি মেয়ের মৃত্যুর শোক সত্ত্বেও বিষয়টি সম্পর্কে মফিজুদ্দিনের নমনীয়তায় সন্তুষ্ট বোধ করে, সে মিয়াবাড়ি থেকে প্রেরিত এই সব সামগ্রী গ্রহণ করে, ফরিদ হোসেনকে সমাদর করে একটি নিচু কাঠের টুলে বসতে দেয় এবং একটি কাজের মেয়ে তাল পাখা নিয়ে তাকে বাতাস করে; মনে হয় যেন ফরিদ হোসেন আসলে দুলালির জন্য পয়গাম নিয়ে এসেছে। মফিজুদ্দিন মিয়ার পাঠানো চা-পাতা এবং কাঠের গুঁড়ো দিয়ে খাটিয়ার ওপর শোয়ানো দুলালির লাশ ঢেকে দেয়া হয়, খাটিয়ার দুপাশ ঘেঁষে রাখা হয় বরফের দুটো টুকরো। গ্রামের লোকেরা বলে যে, এই লাশ এমনিতেও হয়তো পচত না, কারণ, তারা দেখেছিল যে, দুলালির লাশে পচনের কোনো লক্ষণ নাই, তা কেমন চিনামাটির মতো অথবা স্ফটিক কাচের মতো হয়ে উঠেছিল; তখন কোনো এক সময় চা পাতা ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং কাছে রাখা হয় বরফ। পরদিন সকালে মিয়াবাড়ির চারজন কামলা পুনরায় চান্দাইকোনা যায় এবং চার চাঙড় বরফ এনে মোবারক আলির বাড়িতে পৌঁছে দেয়; এভাবে কতদিন মফিজুদ্দিন মিয়ার পয়সায় কেনা বরফে দুলালির লাশ সংরক্ষণ করা হয় গ্রামের লোকেরা তা বলতে পারে না, তারা শুধু বিস্ময়ের সঙ্গে এই পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করতে থাকে। তারা বলে যে, মফিজুদ্দিনের নিজেরই মনের পরিবর্তন হয়েছিল, কারণ, প্রথম দিন মোবারক আলির বাহুর ভেতর দুলালির চোখের দিকে তাকিয়েই তার হৃদয়ে অনপনেয় ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং এই বালিকার মৃত্যুতে সে অন্তর্গতভাবে ভেঙে পড়ে, এবং সে যখন কুকুর পোড়া গন্ধ পায় তখন সে বিষয়টা মেনে নেয় এবং চন্দ্রভানকে মোবারক আলির বাড়িতে পাঠায়। কিন্তু সুহাসিনীর লোকেরা এই ব্যাপারটি সম্পর্কে তার পরেও নিশ্চিত হতে পারে না, তারা পুনরায় বলে যে, ভেতরে ভেতরে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও মফিজুদ্দিনের পক্ষে তার নিজের জিদ থেকে নিজেকে মুক্ত করা সম্ভবপর ছিল না, তার স্ত্রী চন্দ্রভান সেদিন তাকে এ বিষয়ে সাহায্য করে; কুকুর পোড়া গন্ধ পাওয়ার পর চন্দ্রভান যখন বুঝতে পারে যে, দুলালির লাশ পচতে শুরু করেছে, সে কাঠের সিন্দুক খুলে একটা ভালো কাপড় বের করে পরে এবং চাদর জড়িয়ে তৈরি হয়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন সেদিন নীরবে তার স্ত্রীর এই সাজসজ্জা দেখে এবং চন্দ্রভান যখন ছোট ছেলে আবুবকর সিদ্দিক এবং একজন কামলাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হয় তখন সে পরিষ্কার বুঝতে পারে, চন্দ্রভান কোথায় যায়, এবং তা বুঝতে পেরেও সে কিছু বলে না।