চতুর্থ পরিচ্ছেদ
গোবিন্দর বৌ রানীই প্রথম কথাটা তুলল।
সেদিন অফিস থেকে বেরোতেই দেরি হয়ে গিয়েছিল হেমের। সিমলেয় বড় মাসিমার বাড়ি এসে যখন পৌঁছল তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বাড়িতে বিশেষ কেউ নেই। বড় মাসিমা গেছেন পাড়াতে কোথায় চণ্ডীর গান শুনতে। এ একটা যেন নেশা হয়েছে তাঁর– রোজ যাওয়া চাই। গোবিন্দ তখনও বাড়ি আসে নি। ন’টার আগে কোন দিনই আসতে পারে না সে, শনিবার ছাড়া। তাও শনিবারও ফিরতে ছ’টা সাড়ে ছটা বেজে যায়। ইস্কুল সিজন-এ অর্থাৎ শীতকালে কাজের চাপ যখন পড়ে তখন ন’টাতেও আসতে পারে না, আরও রাত হয়। সে যখন ফেরে তখন এদের এক ঘুম সারা হয়ে যায়। গোবিন্দ তার এক বন্ধুর ছাপাখানায় কাজ করে। মাইনে কম, কাজ বেশি। কিন্তু তবু এইখানেই কাজ শিখে চাকরি নিয়েছে বলে চক্ষুলজ্জায় বাধে, কাজ ছাড়তে পারে না। সাধারণ ছাপাখানা নয়– মানচিত্র ভূচিত্রাবলি ছাপা হয় সেখানে। দায়িত্বর কাজ, ঝুঁকি অনেক। ছাপাখানার ছুটি না হওয়া পর্যন্ত থাকতে হয়। কারণ মালিক ছ’টা বাজলেই বাড়ি চলে যায়– সে ছাড়া ছাপার খুঁটিনাটি গোবিন্দর মতো আর কেউ বোঝে না। সাধারণত সাড়ে আটটা অবধি খোলা থাকে– প্রেস– সব বন্ধ করে ফিরতে ন’টা তো বটেই, দেরিও হয়ে যায়।
সেই সময়টা রানীবৌয়ের নিরঙ্কুশ অবসর। সে সন্ধ্যার আগেই বিকেলের রান্না সেরে নেয়। কারণ মেয়ে আগলানো এক হাঙ্গামা। সে কাজটা ওর শাশুড়ী থাকলে করতে পারেন। কোনদিন হয়ত তিনিই রান্না করেন, ও মেয়ে আগলায় আর ঘরের খুঁটিনাটি কাজ সারে।
রান্না সেরে চুল বেঁধে গা ধুয়ে এলে ওর শাশুড়ী কাপড়-চোপড় কেচে আহ্নিক সেরে বেরিয়ে যান। কোনই কাজ থাকে না হাতে। কেউ না এলে একটু বই-টই পড়ে। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে হেমই এনে দেয় বই। হেম এলে বই-পড়া হয় না, গল্পই করে বসে বসে। অবশ্য গল্পটা একতরফাই চলে বেশি। হেম বেশি কথা কইতে পারে না, বিশেষ করে বড়বৌদির সামনে এলে যেন তার সমস্ত কথা ফুরিয়ে যায়। শুধু চুপ করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে বসে থাকে। কথা কইতে ইচ্ছাই করে না তার– মনে হয় সে সময়টা বৌদির কথা শুনলে কাজ হবে।
আজও তাই শুনছিল সে। ঘুমন্ত মেয়েকে একটা পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে কথা বলছিল বড় বৌ, আর হেম সমস্ত ইন্দ্রিয়কে চক্ষু ও কর্ণে ঘনীভূত করে বসে শুনছিল এবং দেখছিল। শিগিরই আবার ছেলেপুলে হবে, সাধ হয়ে গেছে– এখন-তখন অবস্থা। তবু কী দেহের বাঁধুনি, বোঝাই যায় না যে এত ভারী হয়ে এসেছে দেহ। দাঁড়ালে তবু যদি-বা বোঝা যায়– বসে থাকলে একেবারে টের পাওয়া যায় না। এদিক দিয়েও রানীবৌদির বরাত ভাল। পর পর হয়ে ন্যাঞ্জারি হয়ে পড়ে নি। বড়টি বোধ হয় বছর চার-পাঁচের হল– মনে মনে হিসেব করে হেম। যার ভাল হয়, তার সব ভাল।
কথাটা উঠেছিল তরু প্রসঙ্গে। তরুর ঠাকুমা-শাশুড়ী মারা গেছেন– সেই উপলক্ষে, একত্রে অশৌচ পালনকরবার নাম করে হারান নিয়ে গেছে তাকে। শ্রাদ্ধশান্তি মায় জ্ঞাতিভোজন পর্যন্ত মিটে গেছে আজ প্রায় দু-সপ্তাহ হল। তবু সেখানেই আছে। হারানের তরফ থেকে ফিরিয়ে আনবার বা দিয়ে যাবার কোন কথাই ওঠে নি এখনও পর্যন্ত 1
‘তোমরা কোন কথা তোল নি তো?’
‘পাগল!’
‘যাক–বোধ হচ্ছে তাহ’লে তোমাদের ঘাড় থেকে ও ভার সরেই গেল। ওরও টানাপড়েন হচ্ছিল তো–’
‘বিশেষ। এদান্তে তো ফি শনিবারেই আসছিল।’
তার মানে টানটা আছে এর ওপরই। তাছাড়া প্রথম সন্তান– সেটাও একটা চিন্তা আছে তো! ভালই হল। ছোট ঠাকুরঝিরও তো সময় হয়ে এল; কবে বলতে কবে হয়ে পড়বে। তোমাদের কাছে থাকলে ঐ ঝঞ্ঝাটটি পুরো তোমাদের ঘাড়ে পড়ত– আর খরচা। একটা বিয়েন তোলার কি কম খরচা!
এই বলে একটু মুচকি হেসে বলল, ‘আমাদের ইনি তো সেই নাম করে জোর করে পঞ্চাশটা টাকা আদায় করেছেন বন্ধুর কাছ থেকে। ধার বলেই চেয়েছিলেন, তা কী ভাগ্যি টাকাটা দিয়ে বলেছে যে ও আর খাতায় লিখতে-টিখতে হবে না।’
‘ভালই তো!’ হেম বলে।
হ্যাঁ! কত তো ভাল। আজকাল সবাইকে ওপরটাইম দিতে হয় নাকি বেশি খাটলেই। ছাপাখানার জমাদার থেকে সবাই পাচ্ছে। ওকে দেয়! দিলে পঞ্চাশ টাকা তো এক মাসেই পাওনা হয়ে যাবে মশাই।’
তারপর আবার হঠাৎ তরুর প্রসঙ্গ চলে যায়।
‘তা হ্যাঁ ভাই– ওদের বন্দোবস্তটা কী রকম হবে? কাদের?’
অন্যমনস্ক হেম অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
‘ঐ ছোট টাকুরঝিদের? কে থাকবে আর কে যাবে? পুরনো যিনি তিনি কি আর এখন যেতে রাজি হবেন? অসময়ে এসেছেন!
‘তা জনি না। শুনছি নাকি সেও আছে এখনও। তারও নাকি–‘
এই বলে থেমে যায় হেম। সংকোচে কথাটা শেষ করতে পারে না।
‘ওমা সেও পোয়াতী! তবেই তো বললে ভাল! তারও তো একটা কেলেম জন্মে গেল তাহলে!’
‘হুঁ। তাই তো মনে হচ্ছে। আমি জানি না– ও বলছিল। ও তো দু-তিন দিন দেখলে কিনা। ওর ওপর খুব ভক্তি। শ্রাদ্ধের আগের দিন থেকে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল। বলে বৌদি না গেলে হবেই না।’
‘তা তোমার বৌ যদি দেখে থাকে তো ঠিকই দেখেছে। সে বোকা মেয়ে নয় তাহলে কি করবে এখন হারান? দুই বৌ নিয়েই ঘর করবে নাকি?’
‘কে জানে!’
‘তা সে যাকগে মরুক গে– তোমাদের ঘাড়ে আবার না চাপিয়ে দিয়ে গেলেই হল। যার দায় সে বুঝুক!‘
তারপরই– একটু চুপ করে থেকে বলেছিল সে।
‘আচ্ছা, ছোট ঠাকুরঝি তো নিজের বাড়ি চলে গেল। খোকাও তো ছোট মাসিমার ওখানে। এবার কান্তি ঠাকুরপোকে বাড়িতে আনিয়ে নাও না! আর কেন এখানে ফেলে রাখছ।’
চমকে উঠেছিল হেম, ‘কান্তিকে?কেন, সে তো বেশ আছে। রাজার হালে আছে। অমন ভাল ভাল কাপড় জামা পরিয়ে মাস্টার রেখে কি আমরা তাকে পড়াতে পারব!
‘কী দরকারই বা তাকে অমন রাজার হাল অব্যেস করাবার। গরিবের ছেলে গরিবের মতো থাকাই তো ভাল। সেটা তো তার বাড়ি নয়, এইটেই তার বাড়ি, এইখানেই আসতে হবে থাকতে হবে তাকে। তা না করে– অমনি চাল যদি অব্যেস হয়ে যায়, তাহলে কি ও লেখা-পড়া শিখলেও তোমাদের কোন কাজে লাগবে?’
হেম চুপ করে থাকে। এমনভাবে কখনও ভাবে নি সে। মাত্র তিন-চার দিন আগে কনক ও এই প্রসঙ্গ তুলেছিল– তাকেও চুপ করিয়ে দিয়েছিল ঐ বলে। আশ্চর্য, মনে মনে স্বীকার করে হেম, সহজ সাংসারিক বুদ্ধিটা তাদের চেয়ে এই এক ফোঁটা মেয়েগুলোর কত বেশি।
রানী আবার বলে, ‘যতই হোক, ছেলে যতই ভাল হোক– তবু ওসব জায়গায় না রাখাই ভাল। জায়গাটা ভাল নয় বুঝলে….তোমরা বলো বা নাই বলো আমি তো সব জানি। ও বড় ঠাকুরঝির কী রকম ননদ, নন্দাই কী করে– কিছুই আমার জানতে বাকি নেই। তাছাড়া সে যেমনই হোক, পাড়াটাই যে খারাপ। মানুষ-খেকো রাক্কুসীর পাড়া! অমন সোনারচাঁদ ভাই তোমার– কার নজরে পড়বে, ইহকাল-পরকাল সব যাবে।’
‘কিন্তু দুদিন পরে কলেজে পড়ার কথা। তখন তো আমরা আর কিছু করতে পারব না। সে তো হাতির খরচ!’
‘কিসের হাতির খরচ এমন। এখন তো তোমার সংসার হাল্কা হয়ে এল। কোনমতে কলেজের মাইনেটা টানতে পারবে না? বই তো কত ছেলে শুনেছি চেয়ে-চিন্তে, হাতে-লিখে নিয়ে কাজ চালায়। ভাল ছেলে, চাই কি বিনা মাইনেতেও পড়তে পারবে, জলপানি পায় তো কথাই নাই। এখন আর কেন পরের বাড়ি ফেলে রাখা অমন করে। বলি সে দৈন্যদশা তো আর তোমাদের এখন নেই!’
‘তা নেই, তবুও! অনেক খরচা শুনেছি। তবে ঐ যা বলেছ, জলপানি একটা পেতে পারে। ফার্স্ট ক্লাসে উঠেছিল ক্লাসের মধ্যে ফার্স্ট হয়ে!’
‘তবে! সে তো আমিও শুনেছি! তাহলে জলপানি নিশ্চয় পাবে, দেখে নিও!’
তারপরই বুঝি কথাটা মনে পড়ে যায় তার
‘আচ্ছা, এই ফার্স্ট ক্লাসে ওঠার কথা তো কবে শুনেছি। তার তো এবার এগ্জামিন দেবার কথা।’
‘এবারই তো দেবে!’ নিশ্চিন্ত হয়ে জবাব দেয় হেম।
দেবে কী গো– সে এগ্জামিন তো হয়ে গেছে!’
‘যাঃ!’ অবিশ্বাসের সুরে বলে হেম।
‘এই দ্যাখো! কবে হয়ে গেছে। আর বোধ হয় মাস-খানেকের মধ্যেই ফলাফল বেরিয়ে যাবে।’
‘সে কি?’
‘হ্যাঁ–আমি বলছি। আমার মেজ খুড়তুতো ভাই দিলে না এবার। শেষ দিন দেখা করে গেল। সে তো কবের কথা!’
‘সে কি!’ আবারও বিমূঢ়ভাবে বলে হেম।
‘তোমাদের জানালে না, মাকে পেন্নাম করে এল না– কী কথা!’ বড় বৌ বিস্মিত হয়ে বলে, ‘তাছাড়া এগ্জামিন শেষ হয়ে গেছে, এখন তো বাড়িতে এসেই থাকবার কথা! আর তোমরা খবরও রাখো না! বেশ লোক বাবা তোমরা।’
‘তাই তো!’ এবার রীতিমতো চিন্তিত হয়ে ওঠে হেম, ‘মুস্কিল হচ্ছে এদানি তো আর ছুটিছাটাতে বাড়ি আসত না, এলেও কদাচিৎ কখনও– একদিন দু দিন থেকে চলে যেত। ওরা পয়সা খরচা করে মাস্টার রেখেছে, মিছিমিছি পড়া কামাই করানো– এই জন্যেই আমরাও কিছু বলতুম না। আর ভাল যে আছে সে তো চেহারা দেখলেই টের পাওয়া যায়– কাজেই আর পেড়াপীড়ি করতুম না। কিন্তু এগ্জামিন হয়ে গেল বলছ– অথচ আমরা একটা খবর পর্যন্ত পেলুম না! এইটে যেন বড় খারাপ লাগছে। সত্যিই কি ছেলেটা পর হয়ে গেল নাকি? রতনের ওর ওপর নজর পড়েছে খুবই– যে রকম আদরযত্ন করছিল, পুষ্যিপুত্তুর-টুত্তুর নিয়ে নেয় নি তো?’
এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে বড় বৌ, ‘মাইরি ঠাকুরপো, তোমার যা বুদ্ধি, ঘুঁটের মেডেল গড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। নিদেন একটা পেরাইজ!’
‘কেন–কী বললুম এমন? অপ্রতিভ হয় হেম। ভালও লাগে তার। বড় বৌদির কাছে বোকা বনতে দোষ নেই।
‘তা নয়! যা শুনেছি আমি বড়-ঠাকুরঝির মুখে, এত কিছু বয়স নয় ওর রতন ঠাকুরঝির যে অত বড় ছেলের মা সাজতে পারে। তাছাড়া পুষ্যিপুত্তর কেউ অত বড় ছেলেকে নেয়ও না আর তা নিলেও তোমাদের না জানিয়ে নিতে পারে কখনও? আইনে তা টিকবে কেন? তা নয় ফুটফুটে ছেলে– শান্তশিষ্ট, পড়ায় মন আছে–তাই ভালবাসে যত্ন করে।
তারপর একটু থেমে বলে, ‘তা যাই হোক’ তুমি বাপু একবার খবর নাও।’
‘নেব। তুমি তো আমায় ভাবনা ধরিয়ে দিলে।’
‘আবার নেব-তে দরকার কি, আজই যাও না। এখনও তো আটটা বাজে নি!’
‘না, আজ হবে না। এখন রামবাগানে গিয়ে দেখা করে কথা কয়ে হাওড়ায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। নটা পঁয়ত্রিশ না পেলে একেবারে দশটা চব্বিশ– বাড়ি পৌঁছতে দুপুর রাত।’
‘তবু ভাল– বাড়ির ওপর টান হয়েছে একটু!’ এক রকমের অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে মুখ টিপে হাসে রানী।
‘না,তা নয়। আবার তো সেই ভোরে ওঠা!’ অকারণেই লাল হয়ে ওঠে হেম, ‘তাছাড়া রাত্রে গেলে ওখানে দেখাও পাওয়া যায় না। দারোয়ান ঢুকতেই দেবে না হয়ত। সে বলাই আছে। গেলে সন্ধ্যের আগে।’
‘রতনের সঙ্গে না দেখা হোক– তোমার ভাইকেও ডেকে দেবে না?’
‘না– সে ওদের বারণ করাই আছে। মানে একটু পত্তর আড়াল দেয় তো এখনও, সেই ইজ্জতটা নষ্ট করতে চায় না আর কি! তাছাড়া পাড়াটা ভাল নয়, রাত্তির বেলা যেতে ইচ্ছেও করে না– আর দরকারই বা কি, পরশুই তো শনিবার, অফিসের ফেরৎ বাড়ি না গিয়ে এখানে এসে মুখ হাত ধুয়ে চলে যাব এখন– চারটে নাগাদ যাওয়াই ভাল।’
‘তাই যেও।‘
তারপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে।
বলার মতো কথা যেন হঠাৎ ফুরিয়ে যায় দুজনেরই।
এ রকম আজকাল প্রায়ই হয়।
বহু দিন বহু ঘণ্টা এমনি করে সামনা-সামনি বসে কাটিয়েছে ওরা, ওদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডী বাঁধা জীবনে কী-ই বা এত কথা থাকতে পারে?
আগে নিত্যই আসত হেম, এখনও সপ্তাহে দু-তিন দিন করে আসে। রবিবারে গোবিন্দ থাকে কিন্তু বাকি দিনগুলোতে ওরাই শুধু বসে থাকে– এমনি মুখোমুখি। সুতরাং যতরকম প্রসঙ্গ প্রায় নিঃশেষ করে এনেছে ওরা।
অবশ্য হেমের তাতে আপত্তি নেই। বরং এমনি করে চুপ করে বসে থাকতে পারলেই ও খুশি– এমনি বড়বৌদির মুখের দিকে চেয়ে
বেশিক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে কিন্তু রানীর ভাল লাগে না। তার গা ভারী হয়ে এসেছে, আলস্য করতেই ইচ্ছে করে।
সে একটু পরে বিরাট একটা হাই তুলে বলে, ‘ঠাকুরপো, আমি ভাই শুই একটু। কিছু মনে করো না।’
‘না না, মনে করব কেন? আমি বরং যাই আজ–তুমি দোর দিয়ে শোও বরং। বড় মাসিমা তো অন্য দিন এসে যান এতক্ষণ, সাড়ে আটটা তো বাজে!’
‘মার আজ ফিরতে রাত হবে। আজ বুঝি খুল্লনার সাধ গাইবে– মা সব সিধে সাজিয়ে নিয়ে গেছেন। গান শেষ হবে, সিধের থালা আজাড় হবে তবে তো আসবেন! আজ যার নাম সেই ফিরতে নটা স-নটা!’
‘তবে আমি যাই– তুমি দোর দাও।’
দোরের কাছ পর্যন্ত এগিয়ে আসে বড় বৌ। হেম চৌকাঠ ডিঙ্গোতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে সে ডাকে, ‘ঠাকুরপো!’
হেম চমকে পিছনে ফেরে। দৃষ্টিটাও কেমন যেন অদ্ভুত বড় বৌদির।
সে আবার ভিতরে একটা পা দেয়, ‘কিছু বলবে?’
বলছিলুম কি– তুমি কিছু মনে ক’রো না ঠাকুরপো, অনেক ভেবে দেখেই বলছি– বলছিলুম যে তুমি কোথাও বদলির চেষ্টা করো। তোমাদের তো রেলের চাকরি, বদলি হয় শুনেছি। হয় না?’
‘সে যারা লাইনে কাজ করে তাদেরই বেশি হয়। আমাদেরও হতে পারে– অপর কারখানায়। চেষ্টা করলে অন্য কোন কারখানায় যেতে পারি বটে, আরও দুটো জায়গা আছে। কিন্তু কেন বলো তো?’
বেশ একটু অবাক হয়েই চায় হেম তার দিকে।
ঠিক তখনই উত্তর দেয় না রানী, হয়ত দিতে পারে না। আরও কিছুক্ষণ সেই বিচিত্র দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে হেমের মুখের দিকে। সে চাহনি যেন কী রকম। হঠাৎ সে দিকে চেয়ে আজ বড় দীন বোধ করে হেম নিজেকে
একটু পরে রানী বলে, প্রায় চুপিচুপি, ‘আমার কাছ থেকে দূরে কোথাও না গেলে তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে ঠাকুরপো, এ মোহ তুমি ঘোচাতে পারবে না। তোমার জীবন শুধু নয়, ভেবে দ্যাখো আরও একটা জীবন যেতে বসেছে। এর আগেও তোমাকে বলেছি, এখনও তোমাকে বলছি, বহু ভাগ্য করলে কনকের মতো বৌ মেলে। ওর দিকটা চেয়ে দ্যাখো, ওর জীবনটা নষ্ট করো না। তুমি দূরে কোথাও চলে যাও কনককে নিয়ে– এক বছর বাইরে থাকলেই এই মোহটা চলে যাবে, বৌকে নিয়ে সত্যিকারের সুখী হতে পারবে। শুধু শুধু–। ভেবে দ্যাখো, কোন লাভ তো নেই!’
কথাটা শুনতে শুনতে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল হেমের মুখ। সেটা ডবল- পলতের বড় টেবিল-ল্যাম্পের আলোতে রানীর চোখ এড়াল না। মনে হল যেন কে এক ঘা চাবুক মেরেছে হেমের মুখে– এমনি করুণ আর অসহায় দেখাচ্ছে তাকে।
এই ভয়েই– এই রকম মর্মান্তিক আঘাত লাগবে তার বুঝেই– বহুদিন বলতে গিয়েও বলতে পারে নি সে। কিন্তু আজ সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে মিছিমিছি, অনেক অপরাধ তার জমে যাচ্ছে তারই মতো আর একটা মেয়ের কাছে। আর না!
অনেকক্ষণ পরে, যেন অসাড় হয়ে-যাওয়া জিভে কিছুক্ষণ ধরে শক্তি সঞ্চয় করে নিয়ে হেম আস্তে আস্তে বলে, ‘আমি যে এখানে এমন করে আসি–তাতে তুমি বিরক্ত হও!’
এতখানি জিভ কেটে রানী একেবারে ওর হাত দুখানা চেপে ধরল, ‘ছি ছি! স্বপ্নেও তা ভেবো না। এক-এক সময় মনে হয় তোমার মতো আমার কোন সোদর ভাই থাকলেও তাকে আমি এতটা স্নেহ করতে পারতুম না। আমার এখানে কে আছে বলো। একা-একা মুখ বুজে থাকা বুড়ো শাশুড়ীকে নিয়ে– এইতো। তবু তুমি আস, গল্পে-গুজবে হাসি-ঠাট্টায় আনন্দের মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যায়– টেরও পাই না। কিন্তু আমার ভাল লাগে সেটা বড় কথা নয় ঠাকুরপো, তোমার আর তোমার বৌয়ের সারা জীবনটা পড়ে রয়েছে, সেই কথাটা একবার ভাবো!’
‘আমি– আমি তো এখন আর ওকে অযত্ন করি না।’
‘তাও আমি জানি।’ একটু হেসে বলে রানী, ‘তুমি কি আমার চোখ এড়াতে পার! আমি বলছি– তোমাদের মধ্যে আমি যতদিন থাকব তোমরা ঠিক সুখী হ’তে পারবে না। তাই বলছি কিছু দিনের জন্যে অন্তত তুমি সরে যাও!’
আবারও কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হেম। কিছু যেন তার মাথাতে ঢুকছে না। কতকটা বজ্রাহত তাল গাছের মতো অবস্থা তার–দাঁড়িয়ে আছে খাড়া হয়ে বটে কিন্তু কোথাও যেন কোন প্রাণলক্ষণ নেই, ভেতরকার সবটা ঝলসে গেছে।
অনেক, অনেকক্ষণ পরে আবার বুঝি তার জিভে সাড় ফিরে এল।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও চেপে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, চেষ্টা করব।’
কিন্তু তার সেই রক্তহীন বিবর্ণমুখ আর দীপ্তিহীন চোখের দিকে চেয়ে রানীই এবার ব্যাকুল হয়ে উঠল। তার আঘাতটা যে এমন ভাবে বাজবে তা বোধ হয় আগে অতটা ভাবে নি। নিজের এই নিষ্করুণ হিত-বাক্যের প্রতিক্রিয়া নিজের মধ্যেই হতে শুরু করেছে।
সে আবারও হেমের হাত দুটো ধরে ফেলে বলল, ‘আমার ওপর রাগ করলে ঠাকুরপো?’
‘না। রাগ করব কেন, তুমি তো আমার ভালর জন্যই বলেছ।’
‘না না, মাইরি ঠাকুরপো, ও সব ভদ্দতা কথা রাখো। ঠিক করে বল তো!…. তুমি বরং একটু বসে যাও, মা আসুন। নইলে আমার মনে হবে রাগ করে চলে গেলে!… কী বলতে কী বলে ফেললুম, না বললেই হত।…. এখন আমার দুর্ভাবনায় সারা রাত ঘুম হবে না।…. একটু বসো। বরং কাগজ জ্বেলে একটু চা করে দিই, খেয়ে যাও!’
তার এই ছেলেমানুষী আকুলতায় হেসে ফেলল হেম। ম্লান হাসি, তবু তাতেই ক্ষমার চেহারা দেখতে পেল রানী। যে যথার্থ ভালবাসে সে কোন অপরাধই ক্ষমা না করে পারে না।
হেম ততক্ষণে কণ্ঠস্বরকেও অনেকটা আয়ত্তে এনেছে। হাসি-মুখেই বলল, ‘ভয় নেই। রাগ-টাগ কিছুই না। আজ আসি– তুমি দোর বন্ধ করে শুয়ে পড়গে। পরশু তো আসছি, সেই দিন এসে চা খেয়ে যাবো বরং–’
সে আর দাঁড়াল না। রাস্তাতে পড়েও প্রায়-বিকল পা-দুটোকে যথাসম্ভব টেনে টেনে দ্রুতই চলবার চেষ্টা করল।
এর অনেকক্ষণ পরে ট্রেন থেকে নেমে যখন বাড়ির পথ ধরল তখন কিন্তু মনে হল পা দুটো বেশ স্বাভাবিকভাবেই চলছে। কিছু পূর্বের সে দুর্বলতা আর নেই।
অন্ধকার বিজন পথ। বাজারের কাছে না গেলে, পোলটা না পেরোনো পর্যন্ত কোথাও আলো পাবে না। চারিদিকের ঝুঁকে-পড়া বহু বিচিত্র গাছের ছায়ায় নক্ষত্রের আলোও এসে পৌঁছবার উপায় নেই। নভেলের ভাষায় একেই বুঝি বলে সূচীভেদ্য অন্ধকার। কিন্তু, হেমের মনে হল নভেল যারা পড়ে সেই শহরের মানুষরা কখনই এ অন্ধকার কল্পনা করতে পারবে না।
আলো অবশ্য আছে, জোনাকীর আলো। কিন্তু তাতে পথ দেখা যায় না– বরং আরও দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে। তবে হেমের বিশেষ আর অসুবিধে হয় না। অনেকেই, যাদের ফিরতে রাত হয়, তারা স্টেশনের কাছে দোকানে লণ্ঠন রাখার ব্যবস্থা করে, ফেরার পথে আলো জ্বেলে নেয়। হেমের অত ঝঞ্ঝাট ধাতে সয় না। নিত্য গিয়ে গিয়ে অভ্যাসও হয়ে গেছে তার, অন্ধকারেই বেশ চলতে পারে।
আজ বরং কলকাতা থেকে এসে এই অন্ধকারটাই বেশ ভাল লাগল। হঠাৎ কেমন মনে হল ঐ কোলাহল আর উজ্জ্বল আলোর মধ্যে সে হারিয়ে গিয়েছিল, এখানে এসে আবার তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, নিজেকে দেখতে পাচ্ছে সে।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে কখন ডান দিকে বেশি বেঁকে গিয়ে পড়েছিল– টের পায় নি। একটা বাঁশের ডগা মাথায় লাগতে খেয়াল হল তার। ভাগ্যিস চোখে লাগে নি। হেঁট হয়ে সেটা বাঁচিয়ে আবার রাস্তার মাঝখানে এসে পড়ল। নিত্য মানুষের চলাচলে এই মাঝখানটাই পরিষ্কার থাকে, একটা মানুষের সমান উচ্চতার মধ্যে কোন ডাল-পালা এসে পড়তে পারে না।
সোজা ফাঁকা পথে পড়ে কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে চলতে চলতে এতক্ষণ পরে ভরসা করে সে রানীবৌদির কথাটা মনে করল। ওখান থেকে বেরিয়ে অবধি প্রাণপণে ও প্রসঙ্গটাকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল। জোর করে ভাবছিল বা ভাববার চেষ্টা করছিল অন্য কথা। অফিসের কথা– ছোটসাহেব বদলি হয়ে যাচ্ছে, চাঁদা দিতে হবে ফেয়ারওয়েলের। বাজার– পোস্তা থেকে অনেক দিন ডালের ক্ষুদ আনা হয় নি। একটা গরু পুষলে কী হয়? এ ছাড়া তরু, হারান, ঐন্দ্রিলা, খোকা, ছোট মাসী– সকলের কথা মনে আনবার চেষ্টা করেছে রানী ছাড়া। তার কথাটা মনে আনতে সাহস করে নি– যদি আরও দুর্বল হয়ে পড়ে? যদি না স্বাভাবিকভাবে পথ চলতে পারে?
কিন্তু এখন ভেবে দেখল সে। রানীবৌদি, তার প্রস্তাব– তার মৃদু তিরস্কার, সবই। একে একে সন্ধ্যার সব কথা ও ঘটনাগুলো ভেবে নিল। না, সত্যিই তার ওপর রাগ করে নি ও। এমন কি ক্ষুণ্ণও তেমন হয় নি। আশ্চর্য। নিজের পরিবর্তনে নিজেই যেন খানিকটা অবাক হয়ে গেল। এ কী কেরই প্রভাব? ঠিকই বলেছে বড়বৌদি। নিজে থেকে হয়ত এ মোহ সম্পূর্ণ দূর করতে পারত না কোন দিনই– ভালই হল ওদিক থেকে কথাটা উঠল 1 সত্যিই তো, কী লাভ হচ্ছে দিনের পর দিন এই কাঙালপনা করে, এই ভিক্ষাপাত্র ধরে থেকে। কী পাচ্ছে সে? মনে পড়ল আর একটা দিনের কথা। নলিনীর বাড়ি থেকে যেদিন বিতাড়িত হয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল সেই দিন সেই মুহূর্তটার কথা। ওঃ কী কষ্টই হয়েছিল সেদিন। মনে হয়েছিল বুঝি আর বাঁচবেই না সে। আত্মহত্যাই করত হয়ত, নলিনীকে দেখার আশাতেই বুঝি মরতে পারে নি। তরুণ বয়সের প্রথম প্রেমের ব্যাকুলতা মনে করলে আজ হাসি পায় বটে কিন্তু নলিনী তাকে অনেক দিয়েছিল। তার মতো সে ভালই বেসেছিল ওকে
তবু সেও দৈন্য আর কাঙালপনা ছাড়া আর কিছু নয়। এও তাই। না, চিরদিন ধনীর প্রসাদের বাইরে ভিখারী হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কিছু লাভ নেই। ওখানের উজ্জ্বল আলো ওর কি কাজে আসবে? তার পর্ণকুটিরের মাটির প্রদীপই ভালো। সে স্নিগ্ধ আলো কাজে সহায়তা করবে, দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করবে না।…
পোল পেরিয়ে বাজারে এসে পড়ল সে। হারাধন নন্দী বসে এখনও হিসেব করছে। ভোঁদার দোকানে ভিয়েন চলছে এখনও।
হঠাৎ মনে হল বিস্মৃত অতীত কোন জীবন থেকে বর্তমানে এসে পড়ল সে। তার আসল জীবন, বাস্তব জীবন।
না, কালই সে বদলির চেষ্টা করবে অফিসে গিয়ে।
॥২॥
শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না এদের, কান্তির খবরের জন্যে। শুক্রবার বিকেলে মহাশ্বেতাই এল ছুটতে ছুটতে আর হাঁপাতে হাঁপাতে।
‘বলি তোমার গুণধর ছেলের কাণ্ডটা শুনেছ! ছি ছি, কি কেলেঙ্কারটাই করলে আর কী মুখটাই পোড়ালে!’
বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই কথা বলতে শুরু করে সে। তারপর বসে পড়ে হাঁপাতে থাকে। আলো বেশিক্ষণ পাওয়া যাবে বলে আজ বাইরের ঘরের রকে এসে বসেছিলেন শ্যামা। কাজটাও একটু নতুন ধরেছিলেন আজ– চিরাচরিত পাতা চাঁচা বা গামড়া থেকে পাতা ছাড়ানো নয়– কাঁথা সেলাই করতে বসেছিলেন। অনেকগুলো ছেঁড়া কাপড় জমেছে, এদিকে আর হাত না দিলেই নয়। সামনে শীতকালেই দরকার হবে। পুরনো কাঁথা সবই প্রায় ছিঁড়ে এসেছে, সে এখন বিছানায় পাতা চলবে আরও দু-এক বছর– কিন্তু গায়ে দেওয়া চলবে না আর।
‘গুণধর ছেলের কাণ্ড’ বলতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল শ্যামার– ছুঁচটাও হাতে বিঁধে গিয়েছিল সজোরে– কিন্তু তবু কোন্ গুণধর ছেলে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। তিনি কদিন ধরে ভাবছিলেন খোকার কথাই। উমা তো ফেরে রাত ন’টার সময়- খোকা ইস্কুল থেকে ফেরে চারটেয়। তারপর যে কী করে তা কে জানে। হয়ত যত রাজ্যের পাড়ার ছোটলোকদের ছেলেদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলে, কি কী করে তার ঠিক কি! হয়ত কোন দিন বিড়ি খেতে শিখবে। শরৎ জামাই আছেন বটে তা তিনিও তো রুগ্ন, বসে বসে হাঁপান। তিনি কি আর অত বড় ছেলের ওপর নজর রাখতে পারেন?
ভয় যেটা মনে প্রবল ও প্রধান হয়েছিল সেইটেই মুখে বেরিয়ে গেল, ‘খোকা?’
‘খোকা কেন গো! তোমার গব্বের সেরা যিনি যিনি তোমার মুখ ওজ্জ্বল করবেন! কান্তিচন্দর!… বাবা, আমড়া গাছে কি আর ন্যাংড়া ফলে, বাবা এদান্তে বলত ঠিকই। কচুর বেটা ঘেঁচু– বড় জোর মান।’
মহাশ্বেতার ধরন দেখে মনে হল যেন পরমাত্মীয়ের দুঃসংবাদ নিয়ে আসে নি– কোন শত্রুর মহাসর্বনাশের আনন্দসংবাদ বহন করে এনেছে। ঠিক তেমনি বিজয়দীপ্ত চাহনি তার, তেমনিই উল্লাস।
আসলে তার সন্তানরা লেখাপড়া শেখে নি বা শিখছে না বলে এরা যত কথা শুনিয়েছেন, তার জ্বালাই মনের মধ্যে সঞ্চিত ছিল। দুর্বল মানুষকে তার আত্মদোষ দেখিয়ে দিলে প্রতিকার করতে পারে না সংশোধন করতে পারে না– কিন্তু যে দেখিয়ে দেয় তার ওপর বিদ্বিষ্ট হয়ে থাকে। তার ছেলেদের লেখাপড়া শেখার কোন ব্যবস্থাই করতে পারে না সে– সব চেয়ে বড় কথা তার তেমন প্রয়োজনও বোঝে না– তবু এঁদের গঞ্জন ও বিদ্রূপের জ্বালাটা পোষণ করে রাখে। আজ যেন তার সেই শোধ নেবার দিন এসেছে।
শ্যামা কিন্তু কান্তির নাম শুনে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে যান। কি হয়েছে, কী করেছে সে প্রশ্নও করতে পারেন না।
কনক ওধারে কি কাজ করছিল, বড় ননদের আওয়াজ পেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, সে-ই রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে বট্ ঠাকুরঝি?’
প্রশ্ন করে আর মনে মনে কাঁপতে থাকে। দুঃসংবাদের কী আর শেষ হবে না! এদের বাড়িতে দুঃসংবাদও যা আসে কখনও ছোট তো আসে না কিছু– একেবারে মহাবিপদের বার্তা নিয়েই আসে।
‘হবে আর কী বলো– কান্তিচন্দ্র তোমাদের ফেল করে বসে আছেন?’
‘ফেল করেছে! কান্তি ফেল করেছে!’ বার দুই বিহ্বলের মতো প্রশ্ন করেন শ্যামা।
বিশ্বাস হয় না কিছুতেই। বিশ্বাস করার কথাও নয়। গতবারেও যে ফার্স্ট হয়ে ক্লাসে উঠেছিল! প্রাইজ পেয়েছিল। প্রাইজের বই এখানেই রেখে গেছে সে। এখনও রয়েছে ও-ঘরে।
‘তার যে এবার পাস দেবার কথা!’ কনক প্রশ্ন করে।
‘হ্যাঁ গো– পাস দেবারই তো কথা। তা ঐ বড় পাসের আগে একটা কি ছোট পাস ও দিতে হয়– তবে বড় পাস দিতে যেতে দেয় তো, সেই পাসই দিতে পারে নি– সব বিষয়ে নাকি ফেল করেছিল।’
‘কিন্তু তা কী ক’রে হবে ঠাকুরঝি! গত বছরেই সে প্রথম হয়েছে সে কি করে সব বিষয়ে ফেল হতে পারে! হয়ত খুব ভাল না হতে পারে, হয়ত দুটো-একটায় দৈবাৎ ফেল হতে পারে– তাই বলে সবেতে ফেল! পাসের এগজামিনেই বসতে দেবে না?’
‘সে এগ্জামিন তো কবে হয়ে গেছে। সে কী আর বাকি আছে তোমার!’
‘কিন্তু সে কী রকম করে হল বঠাকুরঝি! আপনি শুনলেন কার কাছে?’
‘আবার কার কাছে। খোদ তোমার নন্দায়ের কাছে। মিথ্যে বলবার বান্দা সে নয়। তারও খুব দুঃখ হয়েছে। তার মুখটাও তো পুড়ল। বড় মুখ করে রেখে এসেছিল। আসলে ওরই ভুল হয়েছে, আমার ননদ ভালমানুষ হলে কি হবে– পাড়াটা যে খারাপ। ছেলে তো বকে যাবেই।’
সেই প্রথম একটি বিহ্বল প্রশ্নের পর একটি কথাও বলতে পারেন নি শ্যামা, কোন প্রশ্নই করতে পারেন নি। মহাশ্বেতার শেষ কথাটায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘কি বললি, কি বলেছেন জামাই– বকে গেছে! কান্তি বকে গেছে?’
এইবার বোধ হয় মার অব্যক্ত ব্যথার আর্তস্বরে লজ্জা পেল মহা, মাথা হেঁট করে বললে, তাই তো বলেছে রতন তোমার জামাইকে। অবশ্য রতন ঠিক বলে নি। সে নাকি একটা কথাও বলতে পারে নি, ঘাড় হেঁট করে ছিল সব্বক্ষণ। বলি তারও খুব লজ্জা হয়েছে তো গা, বিশ্বাস ক’রে তার কাছে গচ্ছিত রেখে এসেছিল। বলেছে ওদের মুকী ঝি, রতনের সামনেই বলেছে। খুব নাকি বকে গিয়েছিল, ওরা নাকি মোটে টের পায় নি। এদান্তে নাকি ইস্কুলেও যেত না। কাজেই কোথায় কি কখন করছে– এরা জানতে পারে নি। ঐ ছাই কী যেন এগ্জামিন–তার ফল বেরোতে তখন সবায়ের চোখ খুলল, তখন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সব খবর। তোমার জামাই তো অধোবদন একেবারে।…ঐ দিকে গেছল কী কাজে, নতুন বাজারে বুঝি কি দরকার ছিল–হঠাৎ মনে হয়েছে অনেকদিন তো খোঁজ-খবর করা হয় নি একবার খবর নিয়ে যাই। তা খবরের তো ঐ ছিরি। মাথা হেঁট করে ঐ বিত্তান্ত শুনে চলে এল। আর হবে কি, তোমরা তো কেউ খবরও নাও না ফেলে রেখে নিশ্চিন্ত!
এ অনুযোগের উত্তর দিল কনকই। সে আর থাকতে পারল না, বলল, ‘আমরা খবর নিলেই বা কী হত ঠাকুরঝি, যাদের বাড়িতে আছে তারাই কিছু টের পায় নি– একদিন দুদিনে মানুষ এত খারাপ কিছু হতে পারে না– নিশ্চয় অনেকদিন ধরেই বদ্সংসর্গে মিশেছে– তা তারাই যদি জানতে না পেরে থাকে, আমরা এক-আধ দিন গিয়ে খবর নিয়ে এলে কি আর জানতে পারতুম!’
কনকের মনটাও বড় খারাপ হয়ে গেছে। বিয়ের সময় এসে দাঁড়িয়েছিল– মনে আছে– যেন রাজপুত্তুর। যেমন রুপ তেমনি মিষ্টি কথা। সেই ছেলে এমন বিগড়ে গেল!
‘না, তবু,–, একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়ে মহাশ্বেতা—-তবু বাড়ির লোক ঘন ঘন যাওয়া আসা করলে একটু ভয় থাকে বৈকি। এ একেবারে নিশ্চিন্তি তো!’
শ্যামা উত্তর দেন না কোনটারই। আসলে তখন তিনি প্রাণপণে তাঁর অন্তরের ফেনায়িত বিষকে সংযত করছেন, প্রচণ্ড উষ্মাকে পরিপাক করছেন প্রাণপণে। তাঁর মাথাতে কথাগুলো ভাল ঢোকে নি– কিছু গুছিয়ে ভাবতেও পারছেন না, সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে– আর তার মধ্যে মনের সব যুক্তি ছাপিয়ে যেটা উঠে আসতে চাইছে তা হল একটা ভয়ঙ্কর চণ্ডাল ক্রোধ। একটা বীভৎস কিছু করতে পারলে যেন শান্তি পান তিনি, পৈশাচিক একটা কিছু। এ উষ্মা বিশেষ কোন ব্যক্তির উপর নয়–একসঙ্গে যেন অনেকের উপর। এই মেয়ে, জামাই, তার বোন, সেই বিশ্বাসঘাতক ছেলে, উদাসীন মোহাচ্ছন্ন বড় ছেলে– সর্বোপরি নিজের অদৃষ্ট এবং এই সমস্তর মূল, এই ছেলে-মেয়ের জন্মদাতা পরলোকগত স্বামীর ওপরও। সব কটাকে শিক্ষা দেবার মতো একটা কিছু করতে পারলে তবে হয়ত এ ক্রোধের শান্তি হত তাঁর।
ইচ্ছা করছিল এক-একবার ঐ মেয়েটাকে ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দেন, যে মনের আনন্দে লাফাতে লাফাতে এই খবরটা দিতে এসেছে। আবার মনে হচ্ছিল কোমর বেঁধে ছুটে গিয়ে জামাই বা তার সেই স্বৈরিণী বোনের সঙ্গে খুব খানিকটা ঝগড়া করে আসেন। ছোটলোকদের মত উগ্র কলহ– তাঁর মেজ মেয়ের মতো– ঐ রকম ভাবে কোথাও একটা মনের বিষ ঝাড়তে পারলে যেন শান্তি হয় তাঁর।
কিন্তু কিছুই করা হয় না শেষ অবধি। এ জীবন তাঁকে আর কিছু না দিক– ধৈর্যটা দিয়েছে খুব। ওটার প্রয়োজনও যেমন হচ্ছে জীবনভোর, তেমনি ভগবান তাঁকে দিয়েছেন ও খুব অকৃপণ হাতে।
সামলেই নিলেন নিজেকে শেষ পর্যন্ত। শুধু কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতায় মনের সেই প্রচণ্ড উষ্ণতার সামান্য আভাসটুকু মাত্র ধরা পড়ল।
বললেন, তা সে– সে কী করছে এখন? তার সঙ্গে দেখা হয় না জামাইয়ের? বাড়ি ছিল না সে?– তখুনি কান ধরে তাকে টেনে আনতে পারলেন না? তার বকামি বার করতুম শয়তান, পেটের শত্তুরের!
‘ও মা, সে কোথায় যে তাকে টেনে আনবে!’
বেশ সহজ ভাবেই কথাগুলো বলে রকে উঠে বসে পা ছড়িয়ে পায়ে হাত বুলোয় মহাশ্বেতা।
‘ওখানে নেই? সে কি? তবে সে কোথায়? কৈ এখানে তো আসে নি! এসব কথা তো বলিস নি এতক্ষণ।’
‘বলছি বলছি। রোস, বলবার ফুরসৎ পেলুম কোথায়।…. ওরা নাকি এখানেই পাঠাতে চেয়েছিল, বলেছিল ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও কিন্তু তোমার ছেলেই নাকি লজ্জায় আসতে চায় নি। তখন রতনের বর–’, কনককে প্রায় দেখিয়েই তার দিকে ইঙ্গিত করে চোখ টিপল মহাশ্বেতা, ‘ঐ যে কী বাবু, তার যেন কোন্ দেশে জমিদারি আছে, কী যেন বেশ বললে বাপু নামটা তোমার জামাই– কী যেন আরাম না কি– হ্যাঁ আরমবাগ অঞ্চল বলে কী এক জায়গা আছে, খুব নাকি দূরও নয় জায়গাটা এখান থেকে– সেইখানেই পাঠিয়েছে। ওদের গাঁয়ের পাশের গাঁয়েই ইস্কুল আছে, ওদের কাছারিবাড়িতে থাকবে আর সেই ইস্কুলে পড়বে এ-বছরটা। তারপর এ বছর যদি ঐ মাঝারি এগ্জামিনে পাস করতে পারে, তখন আসবে আবার এখানে।’
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা গুছিয়ে বলতে পেরে একবার যেন বিজয়গর্বে চারিদিক চেয়ে নিল সে।
শ্যামা আরও স্তম্ভিত হয়ে যান।’আরামবাগ! সে তো শুনেছি হুগলি জেলায়। আমাদের এঁদের ক-ঘর শিষ্য ছিল সেখানে– শাশুড়ীর মুখে শুনেছি। সে তো একেবারে ম্যালেরিয়ার ডিপো, যেসব শিষ্যরা ছিল কেউ টিকতে পারে নি– একধার থেকে মরে হেজে গিয়ে সব পালিয়েছিল ঘরবাড়ি ছেড়ে। সেইখানে পাঠিয়েছে আমার ছেলেকে মেরে ফেলতে! কী আস্পদ্দা তাদের। কেন পাঠায়, কার হুকুমে পাঠায় তাই শুনি। আমাদের একবার জিজ্ঞেস নেই বাদ নেই–খবর করা নেই, ড্যাং করে পাঠিয়ে দিলে! বাঃ, বেশ তো!
মহা এবার একটু বিরক্তই হয়ে ওঠে, তা বাপু একযাই তাদের দোষ দিচ্ছ কনে! তোমার ছেলে তোমাদের কাছে আসতে না চেয়ে থাকে, খবর দিতে না দিয়ে থাকে তো তারা কি করবে! ঐখানে বসিয়ে রেখে দেবে ছেলেকে আরও মাথাটি বেশি করে চিবিয়ে খাবার জন্যে! এখানে থেকে নষ্ট হয়ে যেত, ভালই তো করেছে দূরদেশে পাড়াগাঁয়ে পাঠিয়ে। কী এমন অন্যায়টা করেছে তা তো বুঝলুম না। ম্যালেরিয়া– বলি সে গাঁয়ে কি সবাই ম্যালেরিয়ায় উক্কুড় উঠে যাচ্ছে ফী বছর? তাহ’লে গাঁয়ে লোক আছে কি ক’রে, ইস্কুলটা চলছে কী করে? পড়ছে কে?’
তারপর একটু থেমে বললে, ‘তা বেশ তো, তোমাদের পছন্দ না হয়, আনিয়ে নাও না। এ তো আর জোর-জবরদস্তির কথা নয়। তোমার বড় ছেলেকে পাঠাও, ঠিকানা নাও, চিঠি লেখ কিম্বা কেউ গিয়ে কান ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এসো। এ তো তোমাদেরই করবার কথা। তোমরা কেউ খবর রাখ নি– তোমার জামাই ওপযাচক হয়ে খররটা দিয়ে তো আর এমন কিছু অন্যায় করে নি যে, সেই থেকে আমার ওপর টাইশ করছ! আমারই ঘাট হয়েছিল বলতে আসা, শুনেছিলুম, চুপ করে বসে থাকলেই হত।’
অভিমানে মহাশ্বেতার গলা ভারী হয়ে আসে।
কিন্তু শ্যামা আরও বিরক্ত হন। বোধ করি অন্তরের সেই বিষটা প্রকাশের পথ খুঁজে বেড়ায় গলার মধ্যে।
‘তুই থাম্ বাপু! কাকে বলছি কী বলছি তা কিছু ভাল ক’রে না শুনে না বুঝে তুই আর গ্যাজোর গ্যাজোর করিস নি। তোকে বলছি, না জামাইকে বলছি? আর তোরও তো ভাই– নাকি তোর পর? আমরা ওদের চিনতুম? ওদের দেখালে কে– জামাই দেখিয়েছেন তো! তোরা খবর রাখবি খবর দিবি-এ এমন আর বড় কথা কি?’
‘ঘাট হয়েছিল– হ্যাঁ সেটা স্বীকার করছি একশো বার–ঘাট হয়েছিল তার, তোমাদের ওপকার করতে আসা কি ওখানে ছেলে রেখে আসা। তার যে স্বভাব এই– এত জায়গায় এত খোয়ার হয় তবু ওপকার করতে যাওয়া চাই!….. তা অন্যায় হয়ে গেছে মানছি আমি এখন কী করবে করো। জামাইকে ধরে ফাঁসি দেবে না শূলে দেবে– যাতে তোমাদের মন ওঠে তাই করো– আমি আর কী বলব!’
এ লোকের সঙ্গে তর্ক করা চলে না, যুক্তির কোন মূল্যই নেই এর কাছে। মর্মান্তিক দুঃখের মধ্যে এই এক নূতন উপদ্রবে বিরক্ত হয়ে উঠে শ্যামা বলেন, ‘আচ্ছা হয়েছে– সে যা করবার জামাইয়ের সঙ্গে বোঝাপাড়া করব এখন। তুই এখন সরে যা দিকি সামনে থেকে—’
‘তাই যাচ্ছি। একেবারেই যাচ্ছি। থাকতে আসিও নি। ঐ যে বলে না, মনের গুণে ধন। তা তোমারও তাই, মনটা ভাল নয় বলেই যাতে হাত দাও বিষ হয়ে যায়। তুমি নেমোখারাম বলে তোমার ছেলেও তাই হয়েছে!’
সে উঠে হন হন করে বাড়ির পথ ধরল। কনক হাত ধরে টেনে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল একবার, তার হাত জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল সে।
‘না ভাই খুব শিক্ষা হয়েছে। জীবনভোরই শিক্ষা পাচ্ছি– তবু মন তো মানে না। তবে এবার এই শেষ, জন্মের শেষ!’
চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল সে।
ওর এ জন্মের শেষ এবার নিয়ে অনেক বারই হয়েছে। সম্ভবত কালই আবার ছুটে আসবে ও– তেমন লাগ-সই কোন কথা থাকলে। সুতরাং মহাশ্বেতার চলে যাওয়া নিয়ে কোন চিন্তা নেই শ্যামার। তিনি আড়ষ্ট হয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলেন– কান্তির কথাটা।
তাঁর গর্ভের শ্রেষ্ঠ সন্তান– গর্ব করার মতো ছেলে কান্তি। রূপের তো তুলনাই নেই, মেয়েদের মধ্যে ঐন্দ্রিলা, ছেলেদের মধ্যে কান্তি। কিন্তু ঐন্দ্রিলার গুণ নেই– এর তাও আছে। ঐন্দ্রিলা সুযোগ পেয়েও লেখাপড়া শেখে নি– এ সুযোগ না পেয়েও লেখাপড়ার জন্য পাগল ছিল।
শান্ত বিনয়ী ভদ্র। যেমন মিষ্টভাষী তেমনি সৎ।
মিথ্যা কথা পর্যন্ত কখনও বলতে পারে না।
সেই ছেলে এমন হয়ে গেল! এত বকে গেল!
এমন নষ্ট হয়ে গেল যে আর কোন পদার্থ রইল না!
কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয় না কথাটা।
আর এই ক-মাসের মধ্যে! এই তো মনে হচ্ছে সেদিন এসে প্রাইজের বইগুলো রেখে গেল।
শ্যামাই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন পদ্মগ্রামে–মঙ্গলা দেখে কত খুশি হলেন, কত আশীর্বাদ করলেন।
সৎপরামর্শও দিয়েছিলেন একটা। সেদিন তাঁর পরামর্শটা শুনলেই ভাল হত।
প্রস্তাবটা একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন শ্যামা।
মঙ্গলা বলেছিলেন, ‘তোমাদের পাড়ায় মল্লিকদেরই এক জ্ঞাতি পশ্চিমে থাকে শুনেছি। অগাধ সম্পত্তি করেছে– এক মেয়ে। ঘরজামাই করবার জন্যে সোন্দর ছেলে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছেলেমানুষ বর চাই– শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে। বিষয়-আশয় কারবার দেখতে পারে এমন ভাল ছেলের দিকেই ঝোঁক। দ্যাখ– তুই বলিস তো আমি খোঁজখবর করি। এমন ফুটফুটে শান্তশিষ্ট ছেলে পেলে লুফে নেবে।
‘হ্যাঁ, মার যেমন কথা! বুড়ো হয়ে আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা।… এই ছেলের ওপরই আমার ভরম্ভর–একে বিলিয়ে দিয়ে বসে থাকব! আর ঘরজামাইতে বড্ড ঘেন্না মা আমার চিরকালের। না,না, সে হয় না।’
‘দ্যাখ, যা ভাল বুঝিস। সত্যিই আমি বড্ড বুড়ো হয়েছি রে-আর বেশি দিন নেই।… তবে দিলে ভাল করতিস বামনী,–এমন ডবকা ছেলে শহরে রেখে দিয়েছিস–ফেরৎ পেলে হয়!’
সেই শেষ কান্তি এসেছিল! হ্যাঁ–মধ্যে আর একদিন এসেছিল, বিজয়ার দিন। তাও পুরো একটা দিনও থাকে নি। সন্ধ্যায় এসেছিল ভোরে চলে গেছে।
মঙ্গলা ঠাকরুণের আশঙ্কা যে হাতে হাতে ফলবে–তা কে জান্ত। তাহ’লে কি আর ছেড়ে দিতেন!
মঙ্গলা চিরদিন তাঁদের মঙ্গলই করেছেন এটা ঠিক। রাগারাগি ঝগড়া যে হয় নি তা নয়–কিন্তু আজ ঠাণ্ডা মাথায় শ্যামা ভেবে দেখেন যে, দোষ তাঁদেরই বেশি ছিল। এতটা যে সহ্য করেছেন ওঁরা এই আশ্চর্য। এখনকার দিনের মানুষ হ’লে সহ্য করত না। কী অন্যায় : না করেছে তাঁর স্বামী–ব্রাহ্মণ যদি অভিসম্পাত দিয়ে চলে যায়–এই ভয়ে সব সহ্য করেছেন ওঁরা। মহাশ্বেতার বিয়ে, ঐন্দ্রিলার বিয়ে, তরুর বিয়ে পর্যন্ত–সবই মঙ্গলার যোগাযোগে হয়েছে। চিরদিনের উপকারী মানুষ
খুব উচিত ছিল শ্যামার–মঙ্গলার কথা শোনা, অন্তত সতর্ক হওয়া!
বিষয়ী কায়স্থ পরিবারের মেয়ে, বিষয়ী কায়স্থ পরিবারের বধূ–বিষয় সম্পত্তি টাকাকড়ির মধ্যে আবাল্য প্রতিপালিত। ভূয়োদর্শী স্ত্রীলোক মঙ্গলা–তাতেও সন্দেহ নেই। অনেক দেখেছেন জীবনে, অনেক বেশি মানুষ চেনেন। তাঁর কথাটা উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হয় নি
আসলে কান্তির যে ঠিক এতটা বয়স হয়ে গেছে, সত্যিই ডব্কা হয়ে উঠেছে– সেইটেই খেয়াল হয় নি শ্যামার। অনেক বেশি বয়সে পড়াশুনো শুরুই করেছে কান্তি– সুতরাং বয়স হয়েছে বৈকি!
বকে যাবার তো এ-ই বয়স!
তাঁর ছেলে, তাঁর তাই নজরে পড়ে নি! ছেলে কবে বড় হয়ে যায় মা তা বুঝতে পারে না–পরের নজরে ঠিক পড়ে। মঙ্গলা ঠিকই ধরেছেন।
তাছাড়া তাঁর মা একটা কথা বলতেন, ‘আকরে টানে!’ যে আকর থেকে বেরিয়েছে তার কিছু প্রভাব থাকবেই। ছেলের জন্মদাতা যে কী ছিলেন–সেটাও মনে রাখা উচিত ছিল শ্যামার।….
ছুঁচ সুতো হাতে নিয়ে কাঁথার কাপড় সাজিয়েই বসে থাকেন শ্যামা–সেলাই করা আর হয় না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে ক্রমশ। কনক সন্ধ্যা দিতে চলে যায়–তবু শ্যামা বসে থাকেন। তাঁর এখনও কাপড় কাঁচা হয় নি–বাগানের অনেক কাজ বাকি রইল, সন্ধ্যাহ্নিক আছে–এসব কিছুই মনে পড়ে না তাঁর। বসেই থাকেন চুপ ক’রে।
কত ছেলে তো দস্তুরমতো বকে গিয়েও সামলে নেয় নিজেকে। আবার ভাল হয়ে পড়াশুনো ক’রে মানুষ হয়। কান্তি কি পারবে সামলে নিতে নিজেকে। আবার কি ফিরে পাবেন তাঁর ছেলেকে! তাঁর সেই ছেলে–তাঁর আশা ভরসা, তাঁর গর্ব!
কে জানে সত্যিই বকে গেছে কিনা, গেলেও ঠিক কতটা গেছে! কিছুই যে জানতে পারছেন না এখনও। হেম কাল না গেলে কিছু জানাও যাবে না। এই দীর্ঘ সময়টা কী ক’রে অপেক্ষা করবেন, এই ভেবেই ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকেন শ্যামা।
।।৩।।
হেমও কথাটা শুনে ঘুমোতে পারে না সারারাত। আশ্চর্য, কালই বড় বৌদি কথাটা বলেছে। কনকও বলেছিল তবে অতটা জোর দেয় নি। বোধ হয় সাহস করে নি দিতে। এখনও কনক তার কাছে অনেকটা ভয়ে ভয়ে থাকে। কোন কিছুই জোর ক’রে বলতে পারে না এখনও।
কথাটা সে স্বীকার করে কনকের কাছেও
‘তুমিও বলছিলে, পরশু বড় বৌদিও খুব যাচ্ছেতাই করলেন। তাঁকে বলেই ছিলুম শনিবার যাব। তাঁর মুখেই খবর পেলুম যে ম্যাট্রিক এগ্জামিন কবে হয়ে চুকে বুকে গেছে। তাইতেই তো প্রথম ভাবনা ধরেছিল। তাই বলে যে এমনটা হবে– ইস, এ কখনও ভাবতেও পারি নি।’
কনক কোন কথা বলে না। নীরবে বসে ওর পা টিপতে থাকে।
তার বুদ্ধি বা তার দূরদর্শিতা যে বড় বৌয়ের থেকে কম নয়–এটায় বেশি জোর দেওয়া ঠিক হবে না–এসব জয়লাভ শান্ত সংযত হয়ে উপভোগ করতে হয়, কচলে তেতো করতে নেই।
তাছাড়া সে জানে যে, হেম তার সব ভাই-বোনকেই মনে মনে ভালবাসে। জীবনের বহু দুর্যোগ বহু ঝড়ঝাপ্টা বহু কষ্ট সহ্য করেছে সে, বহুদিন উপবাস গেছে তার জীবনে– এখনও জলখাবারের কথা সে ভাবতেই পারে না– সুতরাং বাহ্য রুক্ষতা তার স্বাভাবিক। কিন্তু এত কষ্ট সহ্য করেছে বলেই হয়ত ভাই-বোনদের সকলের ওপরই তার টান আছে।
শুধু স্নেহ নয়– এই ভাইটি সম্বন্ধে অনেক আশা, অনেক গর্বও ছিল হেমের।
সেটা নানা কথার ফাঁকে, নানা লোকের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে প্রকাশ পেতে দেখেছে কনক।
সুতরাং আঘাতটা যে কতটা বেজেছে তার, তা সে জানে। এসময়ে নিজের কথা বলে বিরক্ত করতে নেই।
অনেকক্ষণ পরে চৈতন্য হয় হেমের– কনক এখনও বসে বসে পা টিপেই যাচ্ছে।
‘তুমি শোও, শোও। সারারাত বসে থাকবে নাকি!’
‘শুচ্ছি, তুমি ঘুমোও।’ মৃদুকণ্ঠে বলে কনক।
‘পাগল। আমার ঘুম আসতে আজ অনেক দেরি। তোমার খাটা-খাটুনি যায় সারাটা দিন, তুমি শুয়ে পড়।
‘খাটা-খাটুনিটা তোমার হয় না বুঝি!’ একটু হেসে বলে কনক।
যতটা বলেছে হেম তাইতেই সে কৃতার্থ। এর জন্যে সারারাত বসে পা টিপতেও সে রাজি।
‘হ্যাঁ, আমাদের খাটুনি তো কাগজ-কলম নিয়ে! বসে বসে কাজ। মাথার খাটুনি। নাও নাও, তুমি শুয়ে পড়।’
আজ এই প্রথম, হাত ধরে তাকে জোর করে শুইয়ে দেয় হেম।
কিন্তু কনকেরও ঘুম আসে না আজ। এই সদ্যলব্ধ অভিজ্ঞতার উত্তেজনা তো আছেই। কিন্তু তা ছাড়াও, সেও ভাবছিল কান্তিরই কথা।
ভাল হয় নি, কাজটা ভাল হয় নি এদের– অমন জায়গায়, অমন পাড়ায় রেখে আসা।
এরা এখনও ভাবে যে কনক রতনের পূর্ণ পরিচয় জানে না। হয়ত আভাসে ইঙ্গিতে কিছু বুঝেছে, তবু সবটা নিশ্চয়ই শোনে নি। তাই এরা প্রাণ খুলে ওর সামনে আলোচনা করতে পারে না। হেমও পারছে না তাই– নইলে, সব কথা খোলাখুলি বলতে পারলে বোধ হয় হাল্কা হ’ত ওর মন। ঐ বিশ্বাসটা ওদের আছে জানে বলেই, কনক চুপ করে আছে– নইলে কথাটা সেও তুলতে পারত।
কী দরকার মিছিমিছি ওদের অপ্রস্তুত করে।
সবই জানে কনক, ঐন্দ্রিলা কিছুই বলতে বাকি রাখে নি!
আরও বলেছে সে অভয়পদদের সম্বন্ধে তার একটা বিজাতীয় আক্রোশ আছে বলেই। ওদের কেলেঙ্কারি বলতে বলতে তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। যথার্থ আনন্দ পায়।
বোধ হয় বোনের সুখের সংসার বলেই তার এই আক্রোশ।
রতন অভয়পদদের মামাতো বোন্। সেটা মিথ্যে নয়। কিন্তু সেইটাই তার সম্পূর্ণ পরিচয়ও নয়। দেবার মতো পরিচয় আর নেই তার। তাই এরাও দেয় না কারও কাছে। ওর প্রসঙ্গই তোলে না, একেবারে চুপ করে থাকে। ক্রিয়া-কর্মে তাকে নিমন্ত্রণ করে পাওনার লোভে, সে আসবে না জেনে নিশ্চিন্ত হয়েই করে। লোক পাঠিয়ে লৌকিকতা করে সে– এরা বলে, ‘ও আমাদের এক আত্মীয়।’ নামটাও করে না।
সেও অবশ্য এখানে আসে না। খোঁজ-খবরও করে না। কোন আত্মীয়-সমাজেই যায় না সে।
এরা কিন্তু যায় মধ্যে মধ্যে। বেশির ভাগ অম্বিকাই যায়।
তার কারণ রতনের নাকি অগাধ পয়সা। তাই সব মান-মর্যাদা খুইয়েও সম্পর্কটা এরা ধরে আছে এখনও।
সে সম্পর্কের সূত্রেই অভয়পদ ছেলেটাকে দিয়ে এসেছিল তার বাড়ি।
এত বুদ্ধি অভয়পদর, সে এ কাজটা কেন করল আজও ভেবে পায় না কনক।
কে জানে কী বুঝেছিল সে। কনক অন্তত আজও বুঝতে পারে না এর যুক্তি। রতনের বিবরণ শুনে ওর প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় ছেলেটা সম্বন্ধেই। কাজটা ভাল হয় নি–নিজের মনে বার বারই বলেছে– উচিত হয় নি ওখানে দিয়ে আসা– কিম্বা এতদিন ফেলে রাখা। কোনমতেই উচিত হয় নি।
বিশেষত ঐ লোকটা, অভয়পদর মামা এখনও জীবিত! ঐ বাড়িতেই বাস করে।
স্বার্থপরতার এমন কুৎসিত দৃষ্টান্ত উতি বয়সের ছেলেমেয়েদের সামনে কিছুতে রাখা ঠিক নয়– মূর্খ হলেও কনক এটা বোঝে।
ছি ছি! ঐ কি মানুষের কাজ! একি মানুষ পারে!
বিশ্বাস করেনি কনক। উড়িয়ে দিয়েছিল সে, বাজে কথা বলে।
ঐন্দ্রিলা তার গায়ে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘মাইরি বলছি, এই তোমার দিব্যি, তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। ওরা মনে করে কেউ জানে না, চেপে চেপে রাখে কিন্তু জানতে কার বাকি আছে এ কেলেঙ্কার। বলি এ চত্বরে যত বামুন সবাই ওদের জানে, আত্মীয়গুষ্টি তো কম নয় ওদের। দাদাবাবুর যে বোনের বিয়ে হয়েছে– তারাও যে আবার দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি হয় ওর মামার। তারা কোন সম্পর্ক রাখে না ওদের সঙ্গে। কেউ নাম করলে সকলের সামনে থুতু ফেলে। এরাই গিয়ে পাত চাটেন। পয়সার চেয়ে বড় এদের কিছু নেই!
তবু যেন বিশ্বাস হতে চায় না।
গরিব অনেকেই থাকে! তাই বলে অমানুষ হবে! এ তো রাক্ষসের কাজ। তারাও বোধহয় নিজের সন্তানের সর্বনাশ করে না!
ঐন্দ্রিলা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘আসলে লোকটা কুড়ে মড়া। কোন্ ছাপাখানায় কম্পোজিটারী করত– খোলার ঘরে থাকত। তাও নাকি এগারো না বারো টাকা মাইনে ছিল, কাজে ফাঁকি দিত বলে অত বছর কাজ করেও মাইনে বাড়ে নি। আদ্ধেক দিন খেতে পেত না, দৈন্যদশা একেবারে। কিন্তু রূপটা ছিল খুব মিসের। দাদাবাবুর মাকে দেখে বুঝবে না, তাছাড়া সহোদর ভাই তো নয় খুড়তুতো বা জাঠতুতো নাকি মামাতো– ঠিক জানি না। তবে নিজের নয় শুনেছি। মিসের রূপই পেয়েছিল মেয়ে দুটো। খোলার ঘরে অত রূপ–সে কি চাপা থাকে। শিগগিরই পেছনে লোক লাগল। তখন ওর মোটে বুঝি তেরো বছর বয়স। মিসে পেয়ে গেল দাঁও! মোটা টাকা হেঁকে বসল– ব্যাস আর কি, ঢালাও কারবার। খোলার ঘর থেকে বড় বাড়িতে এসে উঠল। শুয়ে থাকে দিনরাত আর নভেল পড়ে। ভালমন্দ খাবার, ভাল ভাল পান তামাক। ওর মামীটা ছিল সতীলক্ষ্মী- সে মনের ঘেন্নায় পাগলের মতো হয়ে গেছল। বলতে গেলে না খেয়ে মর্ল সে!’
‘তিনি মারা গেছেন?’ অভিভূত কনক প্রশ্ন করেছিল।
‘হ্যাঁ– মরে জুড়িয়েছে সে! রতনের যে প্রথম বাবু ছিল সে ছিল খুব ভাল, স্বামী-স্ত্রীর মতোই থাকত। সে মরতে না মরতে মিসে আর একটি জুটিয়ে দিলে গা! মেয়েটাকে প্রাণভরে কাঁদতে পর্যন্ত দিল না। এ নাকি মহা বদমাইশ– দুর্দান্ত মাতাল, মেয়েটাকে পর্যন্ত মাতাল করে দিয়েছে! ছিঃ ছিঃ কানে শোনাও পাপ, ভদ্রলোক বামুনের বংশ–মেয়ে বেচে খাচ্ছিস।’
‘তা ওর আর একটি বোন?’
‘সে খুব সেয়ানা। সে দুদিনেই বাপকে বুঝে নিলে। সে বললে, তুমি বাপ হয়ে তোমার স্বার্থ দেখলে যখন– আমাদের দিকে চাইলে না, তখন তোমার কথাই বা আমরা ভাবব কেন? নিজেকে বেচে যখন খেতে হবে, তখন তোমার এন্তাজারিতেই বা থাকব কিসের জন্যে। সে আলাদা থাকে। বাপকে এক পয়সা তো দেয়ই না– বাড়িতে ঢুকতে পর্যন্ত দেয় না। সে এর মধ্যে নাকি তিন-চারখানা বাড়ি করে ফেলেছে কলকাতায়। কারও সঙ্গে সম্পক্ক রাখে না সে। এঁরা তো গিছলেন কুটুম্বিতে ঝালাতে, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, কিসের আত্মীয় তোমরা, বাবা যখন আমাদের সর্বনাশ করলে, তোমরা কেউ এসে দাঁড়িয়েছিলে? বাধা দিয়েছিলে? তোমরা নিয়ে গিয়ে যদি রাখতে তোমাদের কাছে, বিয়ে দিতে তো বুঝতুম আত্মীয়। এখন এসেছ পাপের পয়সায় ভাগ বসাতে! দূর হও, বেরোও।… এমনি তার কাটাকাটা কথা। জাঁহাবাজ মেয়ে সে– এর মতো ভালমানুষ বোকা নয়।’
এ কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য নয়– ঐন্দ্রিলা দিব্যি গেলে বললেও সে বিশ্বাস করত না, যদি না এদের এতটা ঢাক ঢাক ভাব দেখত। এত চাপাচাপি এত লুকোনো কিসের জন্যে, যদি না এদের ভেতরে গলদ থাকে। এদের ব্যাপার দেখেই কথাটা ক্রমশ বিশ্বাস হয়েছে তার। ছি ছি। অসৎ জায়গায় পড়ে অসৎ সংসর্গে ছেলেটা বুঝি বরবাদই হয়ে গেল।…. ঘুম হয় না কনকেরও। হেমও যে জেগে আছে তা সে বুঝতে পারে। তবু কথাও কয় না। নিথর হয়ে শুয়ে থাকে সে।
কথা কইলেই ঐ প্রসঙ্গ উঠবে, কী বলতে কী বলে ফেলবে সে। কনক সব জানে বুঝলে হয়ত দারুণ লজ্জা পাবে হেম। যতদিন না হেম নিজে থেকে বিশ্বাস করে সব কথা বলছে, ততদিন সেও জানতে দেবে না যে সবই জানে।
চুপ করে শুয়ে থাকার আরও কারণ আছে অবশ্য।
আর একট অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে তার। সেইটেই প্রাণপণে উপভোগ করছে সে।
মাথার দিকটা দক্ষিণ– এবং সেদিকে জানলাও আছে একটা, তবু রুজুরুজি বয় না বলে তেমন হাওয়া ঢোকে না। তার ওপর চালাঘর– জানলার ওপরই চালাটা পড়েছে এসে। গরমের সময় চাপা ভ্যাপসা গরম লাগে। অন্য দিন ঘুমিয়ে পড়ে হেম– অতটা টের পায় না। তাছাড়া এমনিতেও ঘাম তার কম।
কনকেরই গরম লাগে বেশি, সে ঘামেও খুব, কিন্তু এই ঘরেই শুয়ে শুয়ে সয়ে গেছে তার, ঘুম পেলে অনায়াসে ঘুমোতে পারে।
আজ হেমেরও গরম লেগেছে। অনেকক্ষণ পরে– কনক ঘুমিয়েছে ভেবেই সে উঠে চালের বাতা থেকে সন্তর্পণে পাখাটা টেনে নিয়েছে। যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে টেনেছে সে– পাছে কনকের ঘুম ভেঙে যায়। তারপর আলতো একবার তার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে যে কনকও ঘামছে। তারপর থেকে এমনভাবে হাওয়া খাচ্ছে যাতে কনকেরও হাওয়াটা লাগে ভালভাবে। মধ্যে মধ্যে শুধু কনকের দিকেও হাওয়া করছে।
সমস্ত শরীর জুড়িয়ে গেছে কনকের। শুধু শরীর নয়, মনও।
বহুদিনের সঞ্চিত গুমোট গরমে লেগেছে স্বামীর স্নেহের বাতাস। তার আর কোন দুঃখ নেই।
আরামে চোখ জড়িয়ে আসারই কথা– কিন্তু চেষ্টা করেই জেগে রইল সে। পাছে এই অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হয়।….
ভোরবেলা রাজগঞ্জের কলে ভোঁ বাজতেই উঠে বসতে হয়।
তার উঠে বসার ধরন দেখেই হেমের সন্দেহ হয় যে সে জেগেছিল। সে বলে, ‘ওকি, তুমি ঘুমোও নি!
তখনও ভাল করে ভোর হয় নি, তেমন আলো হয় নি। তাই কনকের মুখটা দেখা গেল না। সুখে ও লজ্জায় সে মুখে কী অপূর্ব রঙ লেগেছে তাও দেখতে পেল না হেম। কনক শুধু একটু হেসে স্বামীর হাত থেকে পাখাটা টেনে নিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে লাগল।
‘ওরে দুষ্ট মেয়ে! সারারাত মটকা মেরে পড়ে থেকে আমার সেবা খাওয়া হল! এখন আবার লোক-দেখানো বাতাস করা হচ্ছে। থাক্। এখন ভোরাই হাওয়া উঠে গেছে আর দরকার নেই!…. আচ্ছা, ঐ গরমে অত ঘামের মধ্যে চুপ করে শুয়ে ছিলে কী করে!’
এবার কনক মৃদুকণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘ও আমাদের সহ্য হয়ে যায়!’
‘নমস্কার বাবা তোমাদের সহ্যতে। গায়ে হাত দিয়ে আমার তো মনে হল কে এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছে তোমার গায়ে।’
তারপর অল্প কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে থাকে। হঠাৎ হেম বলে ওঠে, ‘দ্যাখো আমি ভাবছি– এখান থেকে চেষ্টা করে কোথাও বদলি হয়ে যাই। এখন আমি বদলি হ’লে কোয়ার্টার পাবো। তুমি সুদ্দ গিয়ে থাকতে পারবে। এখান থেকে– এসব ঝামেলা থেকে দূরে কোথাও নিরিবিলি সংসার পাততে চাই। কী বলো?’
বদলি শব্দটা শুনেই নিমেষে বুকটা যেন হিম হয়ে গিয়েছিল, বুকের স্পন্দন গিয়েছিল থেমে। এত দুঃখের এত দীর্ঘ তপস্যার ফল হাতের কাছে এগিয়ে এসেও দূরে সরে যাবে, জীবনের সুধাপাত্র ওষ্ঠের সামনে থেকে যাবে ফিরে? আবার এক যন্ত্রণাদায়ক অন্ধকার অনিশ্চয়তার মধ্যে গিয়ে পড়বে সমস্ত ভবিষ্যৎ!
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই পরের কথাটায় রুদ্ধ নিঃশ্বাস পড়তে শুরু হয়, আবার বুকের স্পন্দন অনুভব করে সে। বরং সে স্পন্দন যেন দ্রুততর হয়ে ওঠে। দেহের লোমকূপগুলো পর্যন্ত যেন কী এক পুলকে রিরি করতে থাকে। সে নিজেও টের পায় এক ঝলক উষ্ণ রক্ত যেন হৃদয়ের পাত্র উপচে মুখে এসে পড়ে।
ভাগ্যে ঘরে আলো নেই– নইলে এত আনন্দ কিছুতেই ঢাকতে পারত না সে হেমের কাছ থেকে। আর তার কাছে মনের এই গোপন সাধ, গোপন স্বপ্ন ধরা পড়ে গেলে বড় লজ্জার কারণ হত।
স্বপ্ন বৈকি!
শুধু সে আর হেম! কোন দূর দেশে গিয়ে নিরিবিলি নিভৃতে সংসার পাতবে। সে কি সত্যিই হবে কোন দিন? এ যে স্বপ্ন দেখতেও ভয় করেছে এতকাল। সুদূরতম অসম্ভব কল্পনার কথা এ সব!
মনে হল বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। স্বামী প্রশ্ন করে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছেন।
’সে তো ভালই!’ অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে কনক (তবু সুখের এই বিপুল আবেগ কণ্ঠে কি প্রকাশ পায় না একটুও?)।–কিন্তু মা? উনি তো এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও নড়তে চাইবেন ন। ওর কাছে কাকে রাখবে? এক মেজদি– কিন্তু তার ওপর ভরসা করা যায় না একটুও!’
‘সেও ভাবছি। খোকাটাকে এনে রাখতে হবে আর কি! দেখি কী হয়। যাবো বললেই তো আর এখুনি যাওয়া হচ্ছে না, বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হবে তার আগে। এমনি ভাবছিলুম কথাটা!’
আর কোন কথা বলার অবকাশ হয় না। ওঘণের দোর খোলার আওয়াজ হয়েছে, শ্যামা উঠে পড়েছেন। ঘাট থেকে ঘুরে এসেই রান্না চাপাবেন।
কনকও উঠে দোর খুলে ও-ঘরে চলে যায়। আঁচলটা পেতে ঠাণ্ডা মেঝেটায় শুয়ে পড়ে সে। শ্রান্তিতে ও শান্তিতে চোখের পাতা দুটো বুজে আসছে তার–কিছুতেই যেন চেয়ে থাকতে পারছে না!
.
হেম ফিরলো গভীর রাত্রে। এরা সকলেই তখন উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে।
তরু আর হারান হঠাৎ এসে পড়েছে বিকেলে– আজ থাকবে তারা। তরু অনেকদিন পরে বেশ হাসি-হাসি মুখেই এসেছিল, চাপা মেয়ে– তবু চোখে খুশির আভা স্পষ্ট। খুশির কারণটাও খুলে বলেছে সে কনককে এসেই। সতীন কদিন ধরে খুনসুটি করে করে ওর সঙ্গে ঝগড়া বাধাচ্ছিল, সেটা লক্ষ করে– তরু কিছু না বলতেই– আজ ওকে নিয়ে হারান এখানে চলে এসেছে, তাকে জব্দ করবার জন্যে।
কিন্তু এখানে এসে কথাটা শুনে তারও মুখ শুকিয়ে গেছে। হাজার হোক মার পেটের ভাই– তারই ঠিক পরের পিঠোপিঠি ভাই। মধ্যে একটা হয়ে নাকি মারা গেছে কিন্তু সে কথাটা বোঝবার মতো বয়স তখন ছিল না তরুর– একেই সে দেখেছে তার পরে। খেলা করেছে এর সঙ্গে। এর ওপর কত আশা-ভরসা মায়ের তাও সে জানে। সেও তাই জেগে বসে আছে খবরটা শোনবার জন্যে।
রাত হচ্ছে দেখে শ্যামার এক একবার মনে হচ্ছিল যে হেম বুঝি আজও তার বাঁধা সাপ্তাহিক আড্ডায় গেছে– সে সন্দেহ মুখেও প্রকাশ করেছিলেন একবার। কিন্তু কনক জানে যে তা নয়। সে একবার নিজের অজ্ঞাতসারেই প্রতিবাদও করে ফেলল, ‘আমার তো তা মনে হয় না মা তিনি জানেন যে এখানে সবাই ভাবছে!’ বলেই লজ্জিত হয়ে পড়ল। মার সামনে কথাটা বলা ভাল হয় নি। বড় বেশি গিােমো হয়ে পড়ল। শ্যামা একবার এ পাশ ফিরে চাইলেনও। অন্ধকারে দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা দেখা না গেলেও সেটা বেশ অনুভব করল কনক। অর্থাৎ বৌ তাঁর ছেলের খবর তাঁর চেয়ে বেশি রাখতে শুরু করেছে!
তা তিনি যা-ই মনে করুন– কনকের এটুকু বিশ্বাস আছে হেমের ওপর। আজ অন্তত আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করবে না সে– এটুকু দায়িত্বজ্ঞান তার আছে। খবরটাই ভাল নয় নিশ্চয়। আর সেই সম্পর্কিত কোন কারণেই এতটা রাত হচ্ছে।
হেম ফিরল দশটারও পর।
মুখ অন্ধকার করেই ফিরল সে। এরা তারই আসার অপেক্ষায় বসে আছে জেনেও সে কারও সঙ্গে কোন কথা কইল না, সোজা জুতো ছেড়ে নিজের ঘরে অর্থাৎ রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।
কোন রকম সম্ভাষণ পর্যন্ত না করে সটান ঘরে চলে যাওয়া তার পক্ষে নূতন কিছু নয়। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্য রকম। সে জানে যে আজ তার মুখ থেকে খবর শোনবার জন্যই এরা অপেক্ষা করে আছে। তবুও কোন কথা না বলে ভেতরে চলে যাওয়ার কারণটা সুস্পষ্ট।
অর্থাৎ কোন দুঃসংবাদ আছে।
কিন্তু কী সে দুঃসংবাদ! ঠিক কতটা খারাপ? সেটা-ও তো জানা দরকার।
প্রশ্নটা সকলের ঠোঁটের কাছে এসে নিঃশব্দে আকুলি-বিকুলি করতে লাগল। কেউই উঠতে পারল না কিন্তু। গিয়ে জিজ্ঞাসা করার সাহসও নেই কারো।
শ্যামা কোন কথাই বলতে পারছেন না। ঠোঁট দুটো বড় বেশি কাঁপছে তাঁর কথা কইবার চেষ্টা করলেই।
অনেকক্ষণ পরে কোনমতে বলেন শুধু, তুমি একবার যাও বৌমা!’
কনক ঘাড় নাড়ে।
‘আপনিও চলুন মা। আমার ভরসা হচ্ছে না।’
তবুও যেন শ্যামা উঠতে পারেন না।
অথচ একজনের যাওয়াও দরকার। লোকটা সেই ভোরে বেরিয়ে এতক্ষণ পরে তেতেপুড়ে বাড়ি ফিরেছে। তারও একটু স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা দরকার।
তাছাড়া এ সংশয়ও সহ্য হচ্ছে না।
অগত্যা শ্যামাকেই উঠতে হয়। রান্নাঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়ান তিনি। প্রশ্ন করতে সাহস হয় না তখনও।
হেম এসে জামা-কাপড় সুদ্ধই শুয়ে পড়েছিল। এদের দেখে এবার উঠে বসল।
তাকে কোন প্রশ্নও করতে হল না। নিজে থেকেই সে জানাল সব কথা।
কিন্তু জানাবারও বিশেষ কিছু ছিল না।
তার বক্তব্য থেকে এইটুকুই শুধু জানা গেল যে সে বিশেষ কিছুই জানতে পারে নি রতন দেখা করে নি তার সঙ্গে। রতনের নাকি শরীর খারাপ– দেখা করা সম্ভব নয়। মোক্ষদা এসে বলেছে যা কিছু। হ্যাঁ, পরীক্ষায় ফল একেবারেই ভাল হয় নি তাই এসব সংসর্গ থেকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছেন তার মনিব। কোন্ দেশ, কী ঠিকানা এমন কি কোন্ ইস্কুলে পড়ছে তাও বলতে পারবে না সে। ঠিকানা নাকি রতনও জানে না। তাকে এ নিয়ে বিরক্ত করেও লাভ নেই। বাবু এলে সে ঠিকানা জেনে রাখতে পারে। কিন্তু বাবুও এখন কলকাতায় নেই– তিনি বাঙ্গাল দেশে কোথায় গেছেন একটা বড় মকদ্দমা নিয়ে– ফিরতে আরও দশ বারো দিন দেরি হবে।
এ ছাড়া আর কিছুই জানা যায় নি। বহু জেরা, এমন কি অনেক অনুনয় বিনয় করেও নয়। এমন ব্যবহার এর আগে আর কখনও করে নি ওরা। হেম যখনই গেছে, ওপরে ডেকে পাঠিয়েছে রতন। চা জলখাবার খাইয়েছে জোর করে। আজ এমন ভাব দেখাল মোক্ষদা, যেন সে কোন অবাঞ্ছিত অনুগ্রহপ্রার্থী, অকারণে উত্ত্যক্ত করতে গেছে। রতনের বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতে চেয়েছিল হেম– তাও পারে নি। মোক্ষদা বলেছে, বাবুর শরীর ভাল নয়, আর মেজাজ তো জানেনই কী রকম–ও দেখা না করাই ভাল। তাছাড়া তিনি তো জানেও না কিছু। এ সব ঝামেলা ভালবাসে না তিনি মোটে!’
এর পর আর কি বলবে হেম। চলেই এসেছে।
আসার মুখে সে একেবারে মহাদের বাড়ি হয়ে এসেছে।
অভয়পদকে জানিয়ে এসেছে সব কথা। তাকেই বলে এসেছে হেম– একদিন গিয়ে ঠিকানাটা নিয়ে আসতে। তার আর যাবার ইচ্ছে নেই। ভালও দেখায় না। অভয়পদ অবশ্য এক কথাতেই রাজি হয়েছে। সব কথা শুনে সেও খুব দুঃখিত, লজ্জাও পেয়েছে একটু। কিন্তু দু-একদিনের মধ্যে পারবে না সে। কোমরে প্রকাণ্ড একটা ফোঁড়া হয়ে কষ্ট পাচ্ছে। জ্বরও হয়েছে তার তাড়সে– ফোঁড়াটা না ভাল হলে যেতে পারবে না।
তার মানে এখনও অন্তত সাত-আট দিন না গেলে কোন খবরই পাওয়া যাবে না।
কী আর বলবেন শ্যামা। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন সেখান থেকে।
তাঁর আজকাল আর দীর্ঘনিঃশ্বাসও পড়ে না, এক এক সময় নিজেই ভাবেন–ভেতরটা কি তাঁর পাথর হয়ে গেল নাকি?