গৃহহীন লাটসাহেব
ডালহৌসি স্কোয়ার, অর্থাৎ বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগের দক্ষিণে একটু গেলে লাটসাহেবের বাড়ি, রাজভবন। বাড়িটি তৈরি হয়েছিল মোটামুটি পৌনে দু’শো বছর আগে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। কিন্তু ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠা আরও অনেক আগে হয়েছিল। কলকাতার জনক জোব চার্নকের নাম সবাই জানে। দুবার কলকাতায় এসে বসবাস করবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন, পারেননি। তৃতীয়বার ১৬৯০ সালের আগস্ট মাসে তিনি কয়েকটি নৌকো নিয়ে এখনকার কলকাতার উত্তরদিকে সুতানুটি বলে একটি জায়গায় এসে উঠলেন। কয়েকটি ছোট ছোট চালাঘর, প্রায় ভেঙে গিয়েছে, আকাশের রঙ কালো, থেকে থেকে বৃষ্টি পড়ছে, মেঘ ডাকছে, নদীর জলের কাছে একটানা ব্যাঙের ডাক। কাছাকাছি আর কোনো জনমানব নেই। এইভাবেই কোম্পানির রাজত্বের শুরু হল।
জোব চার্নককে কেউ গভর্নর বলত না। তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট। কয়েক বছর পরে কলকাতা বড় হতে লাগল। প্রথম দিকে বুঝবার উপায় ছিল না যে, চার্নক একদিন ভারতবর্ষে ইংরেজ শক্তির প্রতিষ্ঠাতা হবেন। এই সাধারণ ঘরে জোব চার্নক কোম্পানির জিনিসপত্রের দরদাম করতেন, হুঁকোয় তামাক খেতেন, গাছের তলায় বসে ব্যাপারীদের সঙ্গে ব্যবসার কথা বলতেন। একটি বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন, সে তাঁর সংসার দেখত।
জোব চার্নক মারা গেলেন ১৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। তখন তাঁর জিনিসপত্র, বিষয়সম্পত্তি যা ছিল বিক্রি হয়ে গেল। নিলামে দাম উঠল ৫৭৫ টাকা। কোম্পানির কাগজপত্র কিন্তু এই কুঁড়েবাড়িতে থাকত না। দপ্তরের কাগজপত্র রাখবার জন্য চার্নক একটি ছোট বাড়ি বানিয়েছিলেন। চার্নকের মৃত্যুর পর মাদ্রাজ থেকে একজন বড়কর্তা এসে কোম্পানির বাড়িঘরের ব্যবস্থা করলেন। ইটের তৈরি বাড়ি হল, মাটির গাঁথুনি। চারদিক ঘিরে দেয়াল। আশা ছিল অনুমতি পেলে এই বাড়িটিকেই অদলবদল করে দুর্গ বানানো হবে। জোব চার্নকের উত্তরাধিকারী তাঁর জামাই এলিসকে করা হল না। তাঁকে বলা হত অকর্মণ্য। তাঁর জায়গায় বসানো হল চার্লস আয়ার বলে একজনকে।
কোম্পানির কর্তারা একথা জানতেন যে, কেল্লা বানাবার অনুমতি বাদশা বা সুবেদারের কাছ থেকে সহজে পাওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত তিন-চার বছর পরে কেল্লা বানানো শেষ হল। ইংরেজদের তখনকার রাজার নামে তার নাম হল ফোর্ট উইলিয়ম। গঙ্গার ধারে কেল্লা, পশ্চিম দিক দিয়ে ইচ্ছে করলে গঙ্গার জলে নেমে কেল্লায় ওঠা যায়। এখন যেখানে স্ট্র্যাণ্ড রোড, সেখানে তখন গঙ্গার জল আসত। কেল্লার ভেতরে অবশ্য গভর্নরের থাকবার বাড়ি ছিল। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করলেন, তখন তাঁর সৈন্যদের হাতে ফোর্ট উইলিয়মের খুব ক্ষতি হল। গভর্নরের বাড়ির যা ক্ষতি হল তাতে সেখানে আর বসবাস করা সম্ভব নয়। দুর্গ অবরোধের সময় গভর্নর ড্রেক পিছনের দরজা দিয়ে নৌকোয় উঠে মেয়েদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে যখন শান্তি হল কিছুদিনের জন্য, তখনও গভর্নরের থাকবার কোনো বাড়ি ছিল না।
রবার্ট ক্লাইভ দেখতে-দেখতে বাংলা দেশে কোম্পানির কর্তা হলেন, তিনিই সর্বেসর্বা। কিন্তু তাঁরও থাকবার কোনো জায়গা নেই। নতুন করে ফোর্ট উইলিয়ম গড়া হল। আগেকার ফোর্ট উইলিয়ম ছিল এখন যেখানে বড় ডাকঘর কিংবা ফেয়ার্লি প্লেসের রেলের আপিস, তার অনেক দক্ষিণে, ময়দানে গঙ্গার গা ঘেঁষে। ক্লাইভ দুবার বাংলার গভর্নর হয়েছিলেন। কিছুদিন থাকতেন এখনকার রাইটার্স বিল্ডিংসের পিছনে। ঠিক কোন বাড়িতে, তা নিয়ে মতভেদ আছে। সেই সব আলোচনায় দরকার নেই। কখনও থাকতেন হুজুরিমল বলে একজন ব্যবসায়ীর বাড়িতে। ধনী বলে হুজুরিমলের তখন খুব নাম ছিল। ক্লাইভের পরে ভ্যান্সিটার্ট গভর্নর হয়ে এলেন। তিনি মিরজাফরকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জামাই মিরকাশিমকে নবাব করে দিলেন। মিরজাফর তখন বেশ বুড়ো হয়েছেন। তাছাড়া অনেক দিন ধরে আফিং খেতেন বলে বুদ্ধিসুদ্ধিও পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু তিনি একটি কথা বুঝেছিলেন যে, মুর্শিদাবাদে তাঁকে রাতারাতি খুন করে গেলেও কেউ কিছু বলবে না। তাঁর কথা শুনে ক্লাইভ তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। প্রথমে তাঁকে রাখা হত চিতপুর অঞ্চলে। পরে তাঁর জন্য অন্য জায়গা ঠিক হল। ভবানীপুরের দক্ষিণে তখন বাড়িঘর বেশি ছিল না, খোলা জায়গা। মিরজাফর আলি তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে কয়েক বছর এইখানে থাকলেন। তাঁর নামে জায়গার নাম হল আলিপুর।
ক্লাইভ অনেক রকম পরিবর্তন এনেছিলেন। কিন্তু নিজের জন্য ভাল করে বাড়িঘর করার সময় বা ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কলকাতার উত্তরে এখনকার যশোর রোডের ধারে একটি বড় পুরনো বাড়ি পড়ে আছে। এটিকে বলা হয় ক্লাইভের কান্ট্রি হাউস অর্থাৎ বাগানবাড়ি। এখন সে-বাড়িতে অনেক লোকজনের আবাস। তাঁরা অবশ্য ক্লাইভের কেউ নন। ক্লাইভের পরের গভর্নর ছিলেন ভ্যান্সিটার্ট, যিনি ১৭৬০ সালে মিরকাশিমকে নবাব করেছিলে। তাঁর থাকবার জন্য কি কোনো সরকারি বাড়ি তৈরি হয়েছিল? ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের (এখনকার বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ) দক্ষিণে একটি ছোট গলি আছে। কেউ কেউ বলেন এখানে সেনাপতি স্যার আয়ার কুটের বাড়ি ছিল। সম্ভবত ভ্যান্সিটার্ট এখানে কিছুদিন বাস করেছিলেন। এই গলিটির নাম ভ্যান্সিটার্ট রো। ওয়ারেন হেস্টিংস যখন কোম্পানির চাকরি নিয়ে এলেন তখন তাঁর বয়স চোদ্দ। তখন তিনি কনিষ্ঠ কেরানিদের মধ্যে একজন। তাঁর মতো বিচিত্র অভিজ্ঞতা বোধহয় আর কোনো গভর্নরের হয়নি। তিনি প্রথমে গভর্নর হয়েছিলেন। তারপর রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন। অর্থাৎ শুধু বাংলা নয়, বোম্বাই ও মাদ্রাজও তাঁর অধীনে এল। আগে যে রাস্তাকে হেস্টিংস স্ট্রিট বলা হত, এখন তার নাম কিরণশঙ্কর রায় রোড। সেই রাস্তার উপরে দক্ষিণ দিকে মুখ করে একটি বড় বাড়িতে ওয়ারেন হেস্টিংস অনেকদিন ছিলেন। লোকে তখন বাড়িটিকে হেস্টিংস মেমসাহেবের বাড়ি বলত। এখন সে-বাড়ির একতলায় খোপের মতো অনেক দোকানঘর হয়েছে। দোতলার একটি বড় ঘরে ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে যে টানাপাখা ঝুলত, তার অবশিষ্ট কিছুদিন আগেও ছিল। কাঠের উপর নানা রংয়ের বিচিত্র কারুকার্য। হেস্টিংস অন্তত আরও একটি বাড়ি করেছিলেন। তাকে এখনও হেস্টিংস হাউস বলা হয়। বাড়িটি আলিপুরে আদিগঙ্গার কাছে। এই বাড়িতে শুনেছি ভূতের উপদ্রব হত। বছরে একদিন হেস্টিংসের ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াত। এখন সে-বাড়িতে শিক্ষিকাদের জন্য স্কুল খোলা হয়েছে। ভূতের আসা-যাওয়ার কথাও আর শোনা যায় না।
গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিস বিলেতে বড় বংশের সন্তান ছিলেন। কিন্তু তাঁর থাকবার ব্যবস্থা যে খুব ভাল ছিল, তা নয়। তিনি থাকতেন এসপ্ল্যানেডে। এসপ্ল্যানেড বলতে তখন অনেক বড় জায়গা বোঝাত। গভর্নরের বাড়ি নিয়ে তিনি বিশেষ কোনো আপত্তি করেননি। আপত্তি হল যখন ওয়েলেসলি গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন। তিনি একটু মেজাজি লোক ছিলেন। বাড়ির হাল দেখে তিনি বিলেতে চিঠি লিখলেন। এ কী কথা! এই সব ঘরবাড়ি কি গর্ভনর জেনারেলের থাকার যোগ্য! তাঁর লোকজন, কর্মচারী, বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে এরকম ছোট আর খারাপ বাড়িতে কি কেউ থাকতে পারে? অনেক ভারতীয় কলকাতায় থাকেন, যাঁদের বাড়ি এর চেয়ে বড়। এতে কি লাটসাহেবের মর্যাদা লাঘব হচ্ছে না? অবিলম্বে নতুন বাড়ি তৈরি করা উচিত। বাড়ি তৈরি হল বটে, কিন্তু এ নিয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ওয়েলেসলির সম্পর্ক খুব তিক্ত হয়েছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত লাটসাহেবের থাকবার ব্যবস্থা হল।