৪. গণিত ধ্বংস আন্দোলন
আমি যখন নীরা মামীকে বলেছিলাম যে বড়ো হয়ে আমি আন্দোলন করে পৃথিবী থেকে অঙ্ক তুলে দেব তখন মামী মুখ টিপে হেসেছিলেন। শুধু যে হেসেছিলেন তা না, বলেছিলেন বড়ো হয়ে কেন করতে হবে, এখনই কেন করি না! সোজা কথা আমাকে মোটেও সিরিয়াসলি নেন নাই, আমার সাথে ঠাট্টা করেছিলেন।
আমি তাই ঠিক করেছি আমি এখন থেকেই আন্দোলনটা শুরু করব, বড়ো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার কোনো দরকার নাই। যদি সবাইকে জানানো যায় তাহলে শুধু এই দেশের না, সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে আমাদের আন্দোলনে যোগ দেবে। কারণ আমি জানি কোনো ছেলেমেয়ে অঙ্ক ভালোবাসে না–এর মাঝে আনন্দের কিছু নাই।
আন্দোলনটা কীভাবে শুরু করা যায় সেটা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করা যাবে না, নীরা মামী যেরকম আমাকে সিরিয়াসলি নেন নাই অন্যরাও নিবে না। তাই আমার একার বুদ্ধি দিয়েই আগাতে হবে। আমি তাই বসে বসে অনেকক্ষণ চিন্তা করলাম। বুদ্ধিটা আমার একার হবে কিন্তু কাজ একা শুরু করা যাবে না, আমাদের ক্লাসের কাউকে নিয়ে শুরু করতে হবে। আগেই কোনো মেয়েদের নেওয়া যাবে না, মেয়েরা সাধারণত লেখাপড়া বেশি করে। একটা ছেলেকে দলে টেনে নিতে হবে। সেরকম একটা ছেলে আছে আমাদের ক্লাসে, তার নাম মুশফিক আমরা শর্টকাটে মুশ ডাকি। খুবই শুকনা পাতলা তারপরেও কেউ কেউ মোষও ডাকে।
মুশ খুবই সহজ সরল ছেলে, তাকে যেটাই বলা হয় সেটাই সে বিশ্বাস করে। তাকে যদি বলি, “কাল রাতে বাসায় জিন এসেছিল, আমি ধরে একটা বোতলে ভরে রেখেছি!” মুশ তাহলে চোখ বড়ো বড়ো করে বলবে, “সত্যি? দেখাবি আমাকে? প্লিজ!” কিংবা যদি বলি, “একটা টেবলেট আবিষ্কার হয়েছে সেটা খেলে লসাগু গসাগু মুখস্থ হয়ে যায়!” তাহলে মুশ বলবে, “খোদার কসম? কোথায় পাওয়া যায় সেই টেবলেট? বর্গমূলের টেবলেট কী আছে?”
কাজেই পরের দিন আমি মুশের সাথে প্রথমে কথা বললাম। তাকে উদাস মুখ করে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা মুশ, তোর অঙ্ক করতে কেমন লাগে?”
“অঙ্ক?” মুশ মুখ বাঁকা করে বলল, “অঙ্ক আবার মানুষে করে নাকি। ছি!”
আমি খুশী হলাম, আমার লাইনেই আছে। আমি তখন বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “আসলে পুরোটাই হচ্ছে ষড়যন্ত্র।”
মুশ একটু অবাক হয়ে বলল, “কোনটা ষড়যন্ত্র?”
“এই যে আমাদেরকে এত কঠিন কঠিন অঙ্ক করায়।”
মুশ মনে হয় আরও অবাক হলো, “কারা অঙ্ক করায়?”
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম, “মনে হয় সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি।”
সাম্রাজ্যবাদী মানে কী আমি জানি না। শক্তি কেমন করে অপশক্তি হয় সেটাও জানি না, আমি যদি না জানি মুশও সেটা জানবে না। কিন্তু আমি শুনেছি কোনো খারাপ কিছু হলেই সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিকে দোষ দিতে হয়।
মুশ আমতা আমতা করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম আমাদের বোর্ডের অঙ্ক বই”
আমি মুখ বাঁকা করে হাসলাম, বললাম, “বাইরে থেকে এরকমই মনে হয়, ভেতরে পুরা ষড়যন্ত্র। আমরা যেন কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি–”
মুশ কেমন জানি চোখ ছোটো ছোটো করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “কিন্তু লেখাপড়া করলে কেমন করে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না?”
আমি ধমক দিয়ে বললাম, “এটাও বুঝিস নাই, গাধা? আমাদের আলতু ফালতু জিনিস শিখিয়ে আমাদের ব্রেন নষ্ট করে দিচ্ছে।”
“অঙ্ক আলতু ফালতু জিনিস?”
“যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ এর থেকে বেশী কিছু কারো লাগে? তুই বল কখনো তার দরকার হয়েছে? তাহলে আমাদের লসাগু গসাগু বর্গমূল ভগ্নাংশ এসব শেখায় কেন?”
“কেন?”
“আমাদের মাথা নষ্ট করার জন্য। আমরা যেন লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের পর সবাইকে একটা ক্যালকুলেটর কিনে দিতে হবে। ব্যস কাজ শেষ। আজকাল ক্যালকুলেটর দিয়ে সব করা যায়। লসাগু গসাগু থেকে শুরু করে ভগ্নাংশ বর্গমূল সবকিছু।”
মুশ কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা চুলকে বলল, “জ্যামিতি? ক্যালকুলেটরে জ্যামিতি করবি কেমন করে?”
আমি রেগে উঠার ভান করলাম, বললাম, “জ্যামিতি করতে হবে কেন? তোর জীবনেও জ্যামিতির দরকার হয়েছে? হয়েছে? বল আমাকে “
মুশ মাথা চুলকে চিন্তা করতে লাগল। বেশীক্ষণ চিন্তা করে কিছু একটা না বের করে ফেলে সেজন্য আবার দাবড়ানি দিলাম, “তুই বল কখনো কোনো ত্রিভুজের দরকার হয়েছে? জ্যামিতির বাক্স ছাড়া আর কোনোকিছুর ভেতরে ত্রিভুজ আছে?”
মুশ দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বলল, “না, নাই।”
আমি রাজ্যজয়ের মতো ভাব করে বললাম, “তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তাহলে বুঝেছিস, পুরোটা হচ্ছে একটা বিশাল ষড়যন্ত্র।” বিশাল ষড়যন্ত্র ধরে ফেললে যেরকম মুখের ভাব করতে হয় আমি সেরকম একটা ভাব করে। মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিলাম।
মুশ আবার মাথা চুলকাল, বলল, “কিন্তু—কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“তুই কী করতে চাস?”
“আমি এই ষড়যন্ত্র উন্মোচন করে সবাইকে দেখাতে চাই।” ঠিক জায়গামত উন্মোচনের মতো একটা কঠিন শব্দ ব্যবহার করতে পেরে আমার খুব আনন্দ হলো।
“কীভাবে?”
“সেটাই ঠিক করতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে অঙ্ক হচ্ছে একটা ষড়যন্ত্র–এটা তুলে দিতে হবে।”
মুশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজীজ স্যার জানতে পারলে খবর আছে।”
আজীজ স্যার আমাদের অঙ্ক স্যার, আজীজ স্যার অঙ্কের মতোই নীরস কঠিন আর ভয়ংকর। কিন্তু আজীজ স্যারের ভয়ে যদি আন্দোলন করতে সাহস
পাই তাহলে তো হবে না, আমি তাই বললাম, “আমরা সবাই যদি একসাথে থাকি তাহলে আজীজ স্যার কী করবে?”
“সবাই?”
“হ্যাঁ।”
মুশ দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করল, “সবাই?”
“একজন দুজন দালাল বের হবে কিন্তু তাতে কী আছে? যখন দেখবে অন্য সবাই একসাথে তখন তারা সুড়সুড় করে চলে আসবে।”
মুশ আবার মাথা চুলকাল, মনে হলো আজকে সে মাথা চুলকে চুলকে এক জায়গার এক খাবলা চুল তুলে ফেলবে।
ঠিক এরকম সময় আমাদের ক্লাসের ভোরা নামের সবচেয়ে পাজী মেয়েটা হাত চেটে চেটে কী একটা খেতে খেতে যাচ্ছিল আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তোরা এখানে কী গুজগুজ ফুসফুস করছিস?”
এই মেয়েটা মোটামুটি ডেঞ্জারাস, এর থেকে দূরে দূরে থাকা ভালো তাই কিছু একটা বলে বিদায় করে দেওয়া বুদ্ধিমানের মতো কাজ। আমি সেটাই করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু মুশ গাধার মতো বলে ফেলল, “টুলু একটা আন্দোলন করবে।”
ডোরার চোখ চকচক করে উঠল, “আন্দোলন! কীসের আন্দোলন?”
আমি আবার বিষয়টা এড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু মুশটা আবার গাধার মতো বলল, “অঙ্ক তুলে দেওয়ার আন্দোলন।”
ডোরা তার কেনে আঙুলটা মুখে ঢুকিয়ে চটচটে কী একটা জিনিস চুষে খেতে খেতে থেমে গেল, চোখ বড় বড়ড়া করে কাছে এগিয়ে এলো। আঙুলটা মুখ থেকে বের করে বলল, “সত্যি? খোদার কসম?”
মুশ এক পা পিছিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, “টুলু তো তাই বলছে।”
ডোরার মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, আমাদের ক্লাসের আমরা সবাই ডোরার এই হাসিটাকে ভয় পাই। ডোরা তার আঙুল চাটা ভুলে গিয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, “কী রকম আন্দোলন? জঙ্গী আন্দোলন?”
আমি শুকনো গলায় বললাম, “মানে ইয়ে–”
ডোরা আরও পরিষ্কার করে বলল, “মানববন্ধন টাইপের মেন্দা মার্কা আন্দোলন নাকি জ্বালাও পোড়াও ভাংচুর টাইপ?”
আমি দুর্বলভাবে বললাম, “এখনো ঠিক করি নাই।”
“নিরামিষ আন্দোলন হলে আমি নাই। সত্যিকারের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করবি কিনা বল–”
আন্দোলন করার দায়িত্বটা মুশ নিজের ঘাড় থেকে ডোরার ঘাড়ে তুলে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে মিনমিনে মুশ বলল, “জ্বালাও পোড়াওই তো ভালো।”
ভোরা মাথা নাড়ল, বলল, “একশবার!”
আমি বললাম, “কিন্তু কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“সবাইকে না নিয়ে একা একা আন্দোলন করবি কেমন করে?”
ডোরা তার চটচটে হাত নেড়ে বলল, “সবাইকে নিয়েই তো করব।”
“কীভাবে?”
ডোরার একমুহূর্ত দেরি হলো না, বলল, “সবাইকে বলব তাদের অঙ্ক বই নিয়ে আসতে। মাঠের মাঝখানে রেখে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দেব।”
“আ-আ-আগুন দিয়ে দিবি?”
ডোরা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আগে শ্লোগান দিয়ে মাঠ গরম করে নিতে হবে।”
মুশ জিজ্ঞেস করল, “কী শ্লোগান দিবি?”
“জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো।”
এবার মুশের মুখে একটা ফিচলে হাসি ফুটে উঠল। পাজীটা সবকিছু ডোরা আর আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দূর থেকে মজা দেখার মতলব করছে।
ডোরা বলল, “আরও কড়া শ্লোগান আছে, প্রিন্সিপালের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে। সবাই মিলে শ্লোগান দিতে দিতে যাব, একজনের হাতে থাকবে মশাল অন্যদের হাতে কেরোসিনের বোতল-”
আমি পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করলাম–আমরা মশাল, কেরোসিনের বোতল এসব নিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছি আর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কোমরে হাত দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার একপাশে রাক্ষুসী টাইপের জিনিয়া ম্যাডাম অন্যপাশে আজীজ স্যার। স্কুলের অন্য স্যার ম্যাডামরাও আছেন। আমরা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের গদিতে আগুন জ্বালো শ্লোগান দিতে দিতে মাঠের মাঝখানে হাজির হলাম, অঙ্ক বইগুলো সেখানে স্তূপ করে ছুঁড়ে দিলাম। একজন সেখানে কেরোসিন ঢালল তারপর মশাল দিয়ে সেটায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল।
আমি পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, বললাম, “উঁহু। এভাবে হবে না।”
ডোরা তার চটচটে হাত দিয়ে আমাকে একটা ঠাক্কা দিয়েই দিচ্ছিল আমি সময়মতো লাফ দিয়ে সরে গেলাম। ডোরা রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলল, “কোনভাবে হবে না?”
“শ্লোগান দিয়ে মাঠের মাঝখানে আগুন। এসব—”
“কেন?”
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম, “আন্দোলনের একটা নিয়ম আছে। ধাপে ধাপে আগাতে হয়। সবার শেষে যেটা করার কথা সেটা সবার আগে করে ফেলতে হয় না। প্রথমে দরকার জনসমর্থন—”
ডোরা ভুরু কুঁচকে বলল, “কী সমর্থন?”
“জনসমর্থন।”
“সেটা আবার কী? আমাদের ক্লাসের ব্যাপার, জনসমর্থন কোত্থেকে আসবে?”
আমি বললাম, “তাহলে দরকার ক্লাস সমর্থন।”
ডোরা তার দুই হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “কাঁচকলা।”
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম, “মোটেও কাঁচকলা না। এটা আন্দোলনের নিয়ম।”
“তুই কেমন করে জানিস?”
“আমার মামী বলেছেন। আমার মামী পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছেন। আন্দোলন করে জেলে গিয়েছেন।”
ডোরা ভুরু কুঁচকাল, “তোর আপন মামী?”
“আপন না তো কী? একশবার আপন। কিন্তু এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
মামীর ডিভোর্স হয়ে গেছে শুনে প্রথমবার ভোরার চোখে মুখে একটা মুগ্ধ মুগ্ধ ভাব চলে এলো, “ডিভোর্স? সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“আমিও ঠিক করেছি বিয়ে করার পর হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স করে দেব।” ডোরা তারপর তার ভবিষ্যতের হাজব্যান্ডকে কুৎসিত ভাষায় একটা গালি দিল।
মুশ অবাক হয়ে বলল, “তুই তো এখনো বিয়ে করিস নাই, কেমন করে জানিস তোর হাজব্যান্ড কেমন হবে?”
ডোরা বলল, “না জানার কী আছে? হাজব্যান্ডরা সবসময় বদমাইশ হয়। সবাই জানে। পুরুষ মানুষ মাত্রই বদমাইশ।”
আমি ভোরার চটচটে হাতের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের একজন পুরুষ মানুষ হয়েও তার গালাগাল হজম করলাম। তারপরেও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই ডোরা বলল, “তাহলে এটাই ঠিক থাকল।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “কোনটা ঠিক থাকল?”
“মাঠে না পুড়িয়ে ক্লাসের ভেতর পুড়াব।”
“ক্লাসের ভেতর? ক্লাসের ভেতর কোনখানে?”
“কেন? টেবিলের ওপর।”
“টেবিলে যদি আগুন ধরে যায়?”
ডোরা হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়য়ে দিয়ে বলল, “তখন দেখা যাবে।”
আমি ভোরার চটচটে হাতের ঝুঁকি নিয়েও বলে ফেললাম, “উঁহু। তখন দেখা গেলে হবে না, আগে থেকে সব ঠিক করতে হবে। তা ছাড়া ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে তোকে পোড়ানোর জন্য অঙ্ক বই দিবে কে বলেছে?”
ডোরা মুখ শক্ত করে বলল, “না দিলে কেড়ে নিব।”
আমি মাথা নাড়লাম, “কেড়ে নিলে কেউ তোর সাথে থাকবে না, উলটো স্যার ম্যাডামকে নালিশ করে দিবে।”
মুশ বলল, “আমার আরও একটা কথা মনে হয়েছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী কথা?”
“আমাদের অঙ্ক বই হচ্ছে বোর্ডের বই। বোর্ডের বই মানে হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করলে দশ বছর জেল।”
ডোরা ভুরু কুঁচকে বলল, “দশ বছর? এত?”
মুশ গম্ভীর মুখে বলল, “বেশীও হতে পারে।”
ডোরা প্রথমবার তার মাথা চুলকাল তার চটচটে হাত দিয়েই। বলল, “তাহলে?”
আমি বললাম, “প্রথমেই বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই। আস্তে আস্তে এগুতে হবে।”
ডোরা হতাশার মতো শব্দ করে বলল, “বুঝেছি। তোরা হচ্ছিস ভীতুর ডিম। তোদের ভেতরে তেজ নাই। তোরা হচ্ছিস মেদা মার্কা”
আমি বললাম, “আগে আমার কথা শোন। এটা আমার কথা না আমার ডিভোর্স করা মামীর কথা। আন্দোলনে প্রথমে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হয়।” সম্পূক্তের মতো এরকম একটা জটিল শব্দ ব্যবহার করতে পেরে আমার মনটা ভরে গেল। “সম্পৃক্ত করা বুঝেছিস তো? সবাইকে অংশ নেওয়ানোনা। প্রথমেই সবাইকে তাদের অঙ্ক বই পুড়িয়ে অংশ নেওয়ানো যাবে না–প্রথমে অন্য একটা গণিত বই দিয়ে শুরু করতে হবে। সেই গণিত বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সবাইকে একটা করে পৃষ্ঠা দেওয়া হবে, সবাই একসাথে সেটা ছিঁড়বে।”
ভোরা ভুরু কুঁচকে বলল, “পৃষ্ঠা ছিঁড়বে? পোড়াবে না?”
“না। পোড়ানো অনেক ঝামেলা, এতগুলো ম্যাচ কই পাব? কারো হাত পা পুড়ে যাবে। ধোয়া হবে খকখক করে কাশবে। ছেঁড়া সহজ–যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলবে। ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলবে “আমি মুখ খিঁচিয়ে কীভাবে কুটি কুটি করে ছিঁড়বে সেটা দেখিয়ে দিলাম।
আমার মুখ খিঁচানোটা মনে হয় ভোরার পছন্দ হলো। সে মাথা নাড়ল, বলল, “কিন্তু কুটি কুটি করে ছেঁড়ার জন্য গণিতের বই কোথায় পাবি?”
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম, “আমি নিয়ে আসব। আমার কাছে আছে।”
“তোর বাসায় বকবে না–বই ছিঁড়ে কুটি কুটি করবি?”
“উঁহু। এই বইটা আমার আন্দোলন করা মামী দিয়েছে। দেওয়ার সময় বলেছে আমি চাইলে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে বৃষ্টির পানিতে ভাসিয়ে দিতে পারি।”
“সত্যি? খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
“কী ফাটাফাটি মামী! ইশ আমার যদি এই রকম একটা ফাটাফাটি মামী থাকত।”
আমি নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করে বললাম, “এই রকম ডেঞ্জারাস মামী পাওয়া এত সোজা না। মামীর সব গল্প শুনলে তুই ট্যারা হয়ে যাবি।”
আমার কথা শুনেই ভোরা একটু ট্যারা হয়ে গেল বলে মনে হলো!
.
পরের দিন আমি ‘গণিতের একশ মজার অঙ্ক বইটা নিয়ে ক্লাসে এসেছি। মুশকে নিয়ে শুরু করেছিলাম কিন্তু মাঝখান থেকে ডোরা ঢুকে পড়ে সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। টিফিনের ছুটির সময় পুরো ঘটনাটা ঘটানো হবে। আগে থেকে কাউকে কিছু বলা হয় নাই। টিফিনের ঘণ্টার পর ম্যাডাম বের হওয়া মাত্র ডোরা ক্লাসের সামনে গিয়ে বলবে, “একটা জরুরি ঘোষণা।” তারপর কী করা হবে সেটা বলবে। প্রথমে একটা দেশাত্মবোধক গান, গানটা কে গাইবে এখনো ঠিক করা হয় নাই। কেন দেশাত্মবোধক গান গাইতে হবে সেটাও আমি বুঝতে পারলাম না। তারপর আমাকে একটা ছোটো বক্তৃতা দিতে হবে, আমি সেটা লিখে এনেছি। তারপর ডোরা বই ছিঁড়ে আমার আর মুশের হাতে দিবে। আমরা সেগুলো একজন একজন করে সবার হাতে দিব। তারপর ডোরা বলবে “ওয়ান টু থ্রি” তখন সবাই একসাথে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো কুটি কুটি করে ছিঁড়বে। এটা হচ্ছে প্ল্যান।
মুশ আমার হাত থেকে ‘গণিতের একশ মজার অঙ্ক’ বইটা নিয়ে উলটে পালটে দেখল, তারপর বইটা খুলে কিছু একটা পড়ল। কী পড়ল জানি না কিন্তু দেখলাম তার ভুরু কুঁচকে গেল। তারপর সে বিড়বিড় করে কিছু একটা চিন্তা করতে লাগল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
মুশ বলল, “কী আশ্চর্য।”
আমি বললাম, “কোনটা কী আশ্চর্য?”
মুশ বলল, “এই যে এইটা।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম “কোনটা।”
“এই যে লেখা আছে, দুটি সংখ্যা বের করো যে দুটি সংখ্যা যোগ করলে হয় দুই, গুণ করলেও হয় দুই।”
আমি বললাম, “কেন বের করতে হবে?”
মুশ বলল, “না, মানে, বের না করলে নাই। কিন্তু এটা কি সম্ভব?”
আমি একটু চিন্তা করে বললাম, “নাহ্।”
মুশ বলল, “কিন্তু এখানে যে বের করার কথা বলেছে।”
“ভুলভাল বলেছে। সব বইয়ে ভুল থাকে।”
মুশ বলল, “উঁহু। বইয়ের পয়লা পৃষ্ঠায় কী লেখা দেখ।”
মুশ আমাকে বইয়ের প্রহ দেখাল। সেখানে বড়ো বড়ো করে লেখা কেউ যদি বইয়ের কোনো ভুল বের করতে পারে তার জন্য এক হাজার টাকা পুরস্কার। কী আজব!
মুশ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে করতে বইটা আবার খুলে আরেকটা কী যেন দেখে মুখটা কেলিয়ে হাসতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
“এই দেখ, দুই সমান তিন প্রমাণ করেছে।”
আমি একটু রেগে বললাম, “তাতে তোর কী সমস্যা।
“বলেছে প্রমাণে ভুলটা কী বলতে হবে। কিন্তু কোনো ভুল দেখছি না।”
“ঠিক আছে। তাহলে এখন থেকে দুই সমান তিন, কিন্তু তাতে তোর কী সমস্যা?”
“না মানে ইয়ে—” মুশ বাক্যটা শেষ করল না।
আমি মেঘ স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “ইয়ে মানে কীয়ে?”
মুশ বলল, “না মানে বইটা ইন্টারেস্টিং।” কথা বলতে বলতে সে আরেকটা পৃষ্ঠা খুলে ফেলেছে, মাত্র বলতে শুরু করেছে, “এই দেখ কী আশ্চর্য?
আমি তাকে আশ্চর্য কথাটা বলতে দিলাম না, বইটা কেড়ে নিলাম, বললাম, “খবরদার, মুখ বন্ধ কর। কথা বলবি না। এই বইটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করা হবে, এটা পড়তে পারবি না।”
“কেন পড়লে কী হয়?” বলে সে আমার হাত থেকে বইটা কেড়ে নিল। শুধু কেড়ে নিল না, বইটা বুকে চেপে ধরে রেখে বলল, “এই বইটা আমার কাছে থাকুক। আমি তোকে অন্য আরেকটা ফালতু বই এনে দিব। সেটা কুটি কুটি করে ছিড়িস।”
আমি, হুংকার দিয়ে বললাম, “কক্ষনো না। এটা আমার বই, আমার যা ইচ্ছা হয় করব।”
“তুই তো ছিঁড়েই ফেলতে চাইছিস। তার চাইতে আমাকে দিয়ে দে–”
“নো। নেভার।” রেগে গেলে আমি মাঝে মাঝে ইংরেজি বলি।
মুশ মুখ শক্ত করে বলল, “ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে কী?”
“আমি সবাইকে বলব কেউ যেন পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে কুটি কুটি না করে। সবাই যেন আমাকে দিয়ে দেয়।”
“কেউ দিবে না।”
“দিবে। আমি বলব এখানে ইন্টারেস্টিং অঙ্ক আছে। দুইটা সংখ্যা যোগ করলে দুই, গুণ করলেও দুই এই রকম অঙ্ক।”
আমি বললাম, “কারো এসব নিয়ে মাথাব্যথা নাই।”
“আছে। তোর মাথাব্যথা নাই মানে না যে অন্য কারো মাথাব্যথা নাই। তোর মাথা মোটা তার মানে না অন্যদের মাথা মোটা।”
আমি তখন মুশকে একটা ঘুষি মারলাম। মুশ বইটা বুকে চেপে ধরে রেখে এমনভাবে চাঁচাল যে কেউ তাকে মার্ডার করে ফেলেছে। ক্লাসের অনেকে তখন ছুটে এলো এবং আমি তার মাঝেই মুশকে বেশ কয়েকটা ঘুষি মেরে দিলাম।
মুশ কোঁৎ করে শব্দ করে বসে পড়ল, কিন্তু বইটা ছাড়ল না। কী আজব!
কয়েকজন আমাকে ধরে টেনে সরাল, ডোরা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? মারামারি করছিস কেন?”
আমি চোখ লাল করে বললাম, “বেইমান দালাল–”
মুশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি বলে দিব। সব বলে দিব—”
অন্যরা বলল, “কী বলে দিবি?”
মুশ বলল, “আন্দোলনের কথা।”
“কী আন্দোলন?”
মুশ বলল, “পুরা ফালতু মাথা খারাপ পাগলামী ছাগলামী—”
অন্যরা বলল, “কী পাগলামী ছাগলামী?”
“তোরা আয় আমার সাথে, আজীজ স্যার আর জিনিয়া ম্যাডামকে বলব, তোরা নিজের কানে শুনবি”
কপাল ভালো তখন ডোরা মুশকে থামাল, বলল, “আগেই স্যার ম্যাডামকে বলতে যাবি না, নিজেদের ব্যাপার নিজেদের মাঝে রাখ। কী হয়েছে বল।”
মুশ বলল, “আমি টুলুকে মাফ করে দিতে পারি। যদি–”
“যদি কী?”
“যদি আমাকে এই বইটা দিয়ে দেয়। টুলু তো ছিঁড়েই ফেলতে চাইছে–”
কাজেই বেইমান দালাল বিশ্বাসঘাতক নিমকহারাম মিচকি শয়তান মুশকে আমার বইটা দিয়ে দিতে হলো। তার থেকে দুঃখের ব্যাপার যে পুরা আন্দোলনটার বারোটা বেজে গেল। রাগে দুঃখে আমি যে বক্তৃতাটা লিখে এনেছিলাম সেটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেললাম।
তার চাইতেও একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটল, কোন দুইটা সংখ্যা যোগ করলেও দুই হয়, গুণ করলেও দুই হয় সেটা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারলাম না। সমস্যাটা মাথার ভেতর কুটকুট কুটকুট করতেই থাকল। কারণটা কী কে জানে?