৪. খবর
বুবুন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল তাদের বাসার সামনে আবছা অন্ধকারে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা তাদের বাসার দিকে আসতে শুরু করে আবার পিছিয়ে গেল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে বাসার সামনে পায়চারি করতে থাকে। সেখানে থাকে হেঁটে হেঁটে অন্যদিকে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আবার তাদের বাসায় সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
বুবুন কেমন জানি ভয় পেয়ে যায়। আম্মা রান্নাঘরে কাটাকাটি করছিলেন, বুবুন কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আম্মা, একটা লোক বাসার সামনে অনেকক্ষণ থেকে ঘোরাঘুরি করছে।”
“তুই কেমন করে জানিস?”
“আমি দেখেছি। বাসার দিকে আসতে শুরু করে আবার পিছিয়ে যায়।”
আম্মা গম্ভীর হয়ে গেলেন। সবজি কাটার ছুরিটা টেবিলে রেখে বললেন, “আয় দেখি।”
ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। বুবুন বলল, “ঐ যে, এসেছে।”
আম্মা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন, দরজার অন্যপাশে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার চোখে চশমা, মাথার চুল বেশিরভাগ সাদা। আম্মাকে দেখে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই ডক্টর রওশান। আমি একজন ডাক্তার, আমার নাম রাজীব হাসান। আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।”
আম্মা দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন, “আসেন। ভিতরে আসেন।”
ডাক্তার রাজীব হাসান ভিতরে এসে সোফায় বসে বুবুনকে দেখিয়ে বললেন, “এ নিশ্চয়ই আপনার ছেলে বুবুন?”
আম্মা মাথা নাড়লেন। ডাক্তার সাহেব মুখটা হাসিহাসি করে বললেন, “আপনার ছেলের বয়স এখন তেরো। যখন তার দুই বছর বয়স তখন থেকে আপনার হাসব্যান্ড মিসিং।”
হঠাৎ করে আম্মার মুখটা কেমন যেন কঠিন হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “আপনি ঠিক কী নিয়ে কথা বলতে এসেছেন?”
ডাক্তার রাজীব হাসান কেমন যেন কাঁচুমাচু হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ নিজের নখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বলছি। তার আগে এক গ্লাস পানি খেতে পারি?”
আম্মা উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। ডাক্তার সাহেবের পানি খাওয়া দেখে মনে হল আসলে তার পানি তেষ্টা পায়নি, এমনি সময় নেওয়ার জন্যে খাচ্ছেন। একরকম জোর করে পুরো গ্লাস শেষ করে হাতের উলটোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে বললেন, “আমি ঠিক কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। সত্যি কথা বলতে কি আমি অনেকক্ষণ থেকে আপনার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছি।”
আম্মা বললেন, “জি, আমি জানি।”
“ব্যাপারটা আপনার ছেলের সামনেই বলব কি না বুঝতে পারছি না।”
আম্মা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “কথাটা না শোনা পর্যন্ত আমিও তো বলতে পারছি না আমার ছেলের সেটা শোনা উচিত হবে কি না।”
“কোনো-না-কোনো সময়ে তাকে তো জানতেই হবে”
“তা হলে তার সামনেই বলুন।”
ডাক্তার রাজীব হাসান আবার নিজের নখের দিকে তাকালেন, তারপর একরকম জোর করে মুখ তুলে আম্মার দিকে তাকালেন। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কথাটা আপনার স্বামীকে নিয়ে।”
আম্মা হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে প্রায় আর্তচিৎকার করে বললেন কী কথা?”
“আপনার স্বামী—”
রাজীব হাসান কথা শেষ করার আগেই আম্মা প্রায় দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, “বেঁচে আছে?”
রাজীব হাসান কিছু-একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু ঠিক বলতে পারলেন না। আম্মা ভাঙা গলায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, “বেঁচে আছে এখনও?”
রাজীব হাসান আস্তে আস্তে বললেন, “আমি ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি ডক্টর রওশান। হ্যাঁ, আপনার স্বামী মাসুদ আহমেদ বেঁচে আছে, তবে
আম্মা হঠাৎ বুবুনকে ঝাঁপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বুবুন! তোর আব্বা বেঁচে আছে–
ডক্টর রাজীব হাসান সোফা থেকে উঠে আম্মার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “ডক্টর রওশান, প্লিজ আপনি আমাকে আমার কথা শেষ করতে দিন, নাহয় আপনার ভয়ংকর আশাভঙ্গ হবে, আমি তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। প্লিজ—প্লিজ–”
আম্মা রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “না ডাক্তার সাহেব, আমার আশাভঙ্গ হবে না। মানুষটা যদি শুধু বেঁচে থাকে তা হলেই হবে, আমি আর কিছু চাই না। মানুষটা পাগল হোক, বদ্ধ উন্মাদ হোক, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হোক, কিছু আসে যায় না। গত এগারো বছর প্রতি রাতে আমি খোদার কাছে দোয়া করেছি, খোদা, মানুষটাকে বাঁচিয়েং রাখো, বাঁচিয়ে রাখো–”
রাজীব হাসান আম্মার পাশে বসে বললেন, “খোদা আপনার দোয়া শুনেছেন ডক্টর রওশান। আপনার স্বামী বেঁচে আছেন সত্যি, কিন্তু পুরোটুকু আগে শুনুন”
আম্মা চোখ মুছলেন, বুবুন বুঝতে পারল আম্মা এখনও থরথর করে কাঁপছেন। ডাক্তার রাজীব হাসান বললেন, “আপনার স্বামী অর্থাৎ মাসুদ বেঁচে আছে, কিন্তু তার কোনকিছু মনে নেই। তার থেকেও যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে–” ডাক্তার রাজীব হাসান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তার ব্রেনের সেরেব্রাল করটেক্সে যে ম্যালিগনেন্ট টিউমার হয়েছিল সেটা সরানোর সময় ব্রেনে মেজর ড্যামেজ হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম সে পুরোপুরি একটা ভেজিটেবলে হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি প্রথমে তাই ছিল কিন্তু খুব ধীরে ধীরে বাউন্স ব্যাক করেছে। তার শরীরের কোঅর্ডিনেশান ফেরত পেয়েছে। কিন্তু–”
ডাক্তার রাজীব হাসান আবার একটু থেমে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের নখগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। আম্মা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললেন, “কিন্তু?”
“কিন্তু মাসুদ একটা শিশুর মতো হয়ে গেছে। তার মানসিক বয়স আট-নয় বৎসর বয়সের একটা বাচ্চার মতো।”
আম্মা বুকে আটকে-থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে আবার ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, “আমার একটা বাচ্চা আছে, এখন নাহয় দুটো বাচ্চা থাকবে।”
রাজীব হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “আপনার অ্যাটিচুড আমার খুব পছন্দ হয়েছে ডক্টর রওশান। আমি এটা নিয়ে একটু ভয় পাচ্ছিলাম। এতদিনের ব্যাপার, কিছু-একটা অন্যরকমও তো হতে পারত।”
“কী হবে? আমি এগারো বছর ধরে অপেক্ষা করছি!”
“এখনও অবিশ্যি একটা সমস্যা রয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি সবচেয়ে বড় সমস্যা।”
আম্মার মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল, “কী সমস্যা?”
‘মাসুদকে আপনাদের হাতে তুলে দেওয়া! বুঝতেই পারছেন, সে একেবারে সাত-আট বছরের বাচ্চার মতো–আমার ওখানেই মোটামুটি আছে। আপনাদের কথা জানে না–এখন সে তো আপনাদের সাথে থাকতে চাইবে না!”
বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“তুমি কি এখন তোমার মাকে ছেড়ে আরেকজনের সাথে থাকতে পারবে? সেই একই ব্যাপার। তোমার আব্বা এখন বয়সে তোমার থেকেও ছোট একটা বাচ্চার মতো!”
বুবুন কথাটা বুঝতে পারল কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব সেটা কোনোভাবেই ভেবে পেল না। রাজীব হাসান বললেন, “এখন একটা দিন ঠিক করে, খুব সাবধানে মাসুদকে এখানে আনতে হবে। প্রথম আপনাদের একসেপ্ট করবে না–“
আম্মা রাজীব হাসানকে বাধা দিয়ে বললেন, “আপনার কাছে ছবি আছে? মাসুদের ছবি?”
“হ্যাঁ। আমি একটা ছবি এনেছি। এই যে–” বলে রাজীব হাসান বুকপকেট থেকে একটা ছবি বের করলেন, আম্মা প্রায় এক নিমিষে ছিনিয়ে নিলেন ছবিটা। এক নজর দেখে ছবিটা দুই হাতে বুকের মাঝে চেপে ধরে আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
ঠিক এই সময় দরজায় শব্দ হল, আম্মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছর চেষ্টা করলেন, বুবুন গিয়ে খুলে দিল। দরজায় জাহিদ চাচা দাঁড়িয়ে আছেন, হাসিহাসি মুখে বললেন, “কী খবর মিস্টার বুবুন?”
বুবুন কী বলবে বুঝতে পারল না, জাহিদ চাচা ভিতরে ঢুকে আম্মাকে আঁচল দিয়ে চোখমুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে একেবারে থতমত খেয়ে গেলেন। জাহিদ চাচা একবার ডাক্তার রাজীব হাসান আরেকবার বুবুনের দিকে তাকালেন, তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “আমি বলেছি না, আমি প্রত্যেকবার ভুল সময়ে চলে আসি!”
বুবুন বলল, “জাহিদ চাচা আমার আব্বা বেঁচে আছেন?”
জাহিদ চাচা চমকে উঠলেন, “কী বললে?”
“আমার আব্বা বেঁচে আছেন।”
“বেঁচে আছেন? সত্যি?”
“হ্যাঁ চাচা। আমাদের কারও কথা নাকি মনে নেই!”
জাহিদ চাচা তখনও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন, কোনোমতে আবার বললেন, “বেঁচে আছেন! বেঁচে আছেন?”
“হ্যাঁ চাচা। কিন্তু ব্রেনে টিউমার হয়েছিল তো তাই আমার আব্বা নাকি বাচ্চাদের মতো হয়ে গিয়েছেন।”
জাহিদ চাচা বললেন, “বেঁচে আছেন তা হলে! কী আশ্চর্য!”
.
ডাক্তার রাজীব হাসান আর জহিদ চাচাকে রাতে খেয়ে যেতে হল। খেতে খেতে ডাক্তার রাজীব হাসান আব্বার গল্প করলেন। কেমন করে তাকে পাওয়া গেল, কেমন করে তাকে হাসপাতালে রাখা হল, কেমন করে তার নাক দিয়ে চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল কোনো উপায় না দেখে কীভাবে তাঁর অপারেশান করা হল। কীভাবে কীভাবে আব্বা সুস্থ হলেন শুনতে শুনতে বুবুনের চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। আব্বার শার্টে যে ঠিকানা সেলাই করে রাখা ছিল এবং সেটা কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল সেটা শুনে বুবুনের প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এতদিন পরে কেমন করে সেই ঠিকানাটা খুঁজে পাওয়া গেল আর ডাক্তার রাজীব হাসান কীভাবে খুঁজে খুঁজে আম্মাকে বের করল সেই অংশটা শুনে বুবুন আনন্দে প্রায় হাততালি দিতে থাকে।
গভীর রাতে সবাই চলে গেলে আম্মা বুবুনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললেন, “বুঝলি বুবুন, সবাই বলেছিল তোর আব্বাকে ভুলে যেতে। সবাই! তুই পর্যন্ত বলেছিলি। আমি তবু মানুষটাকে মনে রেখেছিলাম। প্রত্যেকদিন রাতে আমি খোদাকে বলেছি, হে খোদা, মানুষটাকে ফিরিয়ে দাও। দেখলি, খোদা মানুষটাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে!”
“আমরা আব্বাকে আনতে কবে যাব আম্মা?”
“আমি তো আজ রাতেই যেতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু ডাক্তার সাহেব যে না। করলেন! বললেন একটু সময় দিতে।”
“কেন আম্মা?”
“তোর আব্বা তো এখন একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো, জোর করে আনা যাবে না, বুঝিয়ে আনতে হবে! ডাক্তার সাহেব গিয়ে বোঝাবেন, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসবেন। আমরা এই ফাঁকে বাসাটা রেডি করে ফেলব!”
“আম্মা!”
“কীরে বুবুন?”
“আব্বা যে তোমাকে ভুলে গেছে, বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছে, সেজন্যে তোমার মন-খারাপ হচ্ছে না?”
“ধূর বোকা ছেলে, মন-খারাপ হবে কেন! তোর আব্বা আগেই ভুলোমনের ছিল। তুই কি ভাবছিস আগে সে খুব বড় মানুষের মতো ছিল?”
বুবুন আম্মার গা ঘেঁষে বলল, “আম্মা!”
“কীরে বুবুন?”
“আব্বার একটা গল্প বলো না!” শুনবি? কীরকম বোকা ছিল মানুষটা বলি শোন!”
রাতে গল্প শেষ করে যখন বুবুন আর আম্মা শুতে গেলেন তখন ঘড়িতে রাত আড়াইটা বাজে। বুবুন অনেকক্ষণ জেগে রইল, তার মনে হচ্ছিল বুঝি কোনোদিন ঘুমাতে পারবে না। কিন্তু একসময় তার চোখেও ঘুম নেমে এল, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল তার আব্বা এসেছেন,বাচ্চা ছেলের মতো মোটেই নন, কী সুন্দর তার চেহারা, বিশাল পাহাড়ের মতো শক্ত শরীর। সে তার আব্বার ঘাড়ে চেপে বসে রইল আর আব্বা তাকে নিয়ে পাহাড়-জঙ্গল নদী পার হয়ে যাচ্ছেন, খবিরউদ্দিন আসছিল হাতে রামদা নিয়ে, আব্বা এক লাথি দিতেই সে উলটেপালটে ছিটকে গেল, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল, উড়ে গেল বাতাসে! কী যে ভালো লাগল বুবুনের সে আর বলার মতো নয়।
বুবুন ঘুম থেকে উঠল বুকের ভিতরে একটা ফুরফুরে আনন্দ নিয়ে। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে এসে দেখল আম্মা কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করছেন। বুবুনকে দেখে বললেন, “কী হল? ঘুম ভাঙল?”
“কয়টা বাজে আম্মা?”
“অনেক বেলা হয়ে গেছে, ঘড়ি দ্যাখ!”
“স্কুল! আমার স্কুল?”
“হবে না আজকে।”
বুবুন ঘড়ি দেখতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল, সাথে পিয়ালের গলার স্বর, “বুবুন তাড়াতাড়ি!”
বুবুন দরজা খুলতেই দেখতে পেল বাইরে পিয়াল আর সুমি স্কুলের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। গাব্বু পিঠে ব্যাগ ঝোলাতে ঝোলাতে আসছে। সুমি অবাক হয়ে বলল, “কী হল? তুইও এখনও রেডি হোসনি? স্কুলে যাবি না?”
“নাহ্!”
“কেন?”
“আমার আব্বাকে পাওয়া গেছে!”
“কী?” একসাথে সবাই চিৎকার করে উঠল, “কী বললি?”
বুবুন মাথা নাড়ল, “আমাদের কথা অবশ্যি মনে নাই। সব স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। আর—”
“আর কী?”
তার আব্বা যে বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন সেটা এখনই বলবে কি না বুঝতে পারছিল না, কিন্তু এত বড় একটা খবর চেপে রাখে কেমন করে? বলল, “আমার আব্বা এখন বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন।”
“বাচ্চা ছেলের মতো?”
“হ্যাঁ। আম্মা বলেছেন আমার ছোট ভাইয়ের মতো দেখে রাখতে হবে। সেজন্যে আজকে ঘরদোর গোছাতে হবে। তোরা যা।”
সুমির চোখ গোল গোল হয়ে উঠল, “কীভাবে ঘর গোছাবি?”
“এখনও জানি না। ছোট বাচ্চা থাকলে যেরকম ধারালো চাকু টাকু সরিয়ে রাখতে হয়, ম্যাচ লুকিয়ে রাখতে হয় মনে হয় সেরকম।”
“সত্যি?”
বুবুন মাথা নাড়ল।
সুমি উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারল না, “স্কুল থেকে এসে আমিও তোর আব্বার জন্যে ঘর সাজিয়ে দেব। ঠিক আছে?”
পিয়াল মুখ শক্ত করে বলল, “বুবুনের আব্বা ছোট ছেলের মতো হয়ে গেছেন–ছোট মেয়ের মতো তো হননি। তুই কেন সাজাবি?”
সুমি চোখ পাকিয়ে বলল, “সেটা বোঝার মতো ঘিলু যদি থাকত তা হলে তো তুই মেয়ে হয়েই জন্মতি!”
বাকবিতণ্ডা আরও খানিক দূর এগিয়ে যেত কিন্তু স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছিল, অন্য বাচ্চারা ডাকাডাকি শুরু করেছে বলে সুমি, পিয়াল আর গাবুকে চলে যেতে হল।
আম্মা আর বুবুন মিলে ঘরদোর পরিষ্কার করল। যেটা ছিল বুবুনের ঘর সেখানে আব্বা থাকবেন, বুবুন ঘুমাবে তার আম্মার সাথে। বুবুনের টেবিলটা খালি করা হল, তার খেলনা বই আর খাতাপত্র সরিয়ে আম্মার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। একটা শেলফ এনে সেখানে কিছু বই রাখা হল, আব্বা যখন ভালো ছিলেন তখন নাকি সেই বইগুলো পড়তেন। আগে বাসায় আব্বার কোনো ছবি টাঙানো থাকত না–দেখলেই আম্মার মন-খারাপ হয়ে যেত, সেজন্যে। এখন আর সেই সমস্যা নেই তাই আব্বার ছবিগুলো বের করে টানানো হল। বুবুনের বিছানায় ডাইনোসরের ছবি আঁকা বিছানার চাঁদর আর বালিশ ছিল, সেগুলো পালটে সাদা চাঁদর বালিশ দেওয়া হল। আব্বা গান শুনতে ভালোবাসতেন বলে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আর অনেকগুলি বরীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট রাখা হল, বুবুন অবিশ্যি আপত্তি করে বলল, “আম্মা, আব্বা যদি বাচ্চা ছেলের মতন হয়ে থাকেন তা হলে কি আর বরীন্দ্রসংগীত শুনবেন?”
আম্মা ভুরু কুচকে বললেন, “কী শুনবে তা হলে?”
“রবীন্দ্রসংগীত তো শোনে বুড়োমানুষেরা–”
“আমি বুড়ো?”
“আমার থেকে তো বুড়ো।”
“তা হলে কী গান রাখতে চাস?”
“খুব হৈচৈ মার্কা তালের গান।”
আম্মা বেশি কিছু বললেন না। দিনের বড় একটা অংশ গেল খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে। আব্বা যেসব জিনিস খেতে পছন্দ করতেন সেগুলো বাজার করে আনা হল, আম্মা হৈচৈ করে যেসব রান্না করলেন। বিকেলবেলা, সুমি, পিয়াল, গাব্ব, বকুল সবাই হাজির হল। সুমি বাগান থেকে ফুল তুলে এনেছে সেটা দিয়ে ফুলের তোড়া তৈরি করে ফুলদানিতে রাখা হল। গাব্বু এনেছে একটা সুপারম্যান এর পোস্টার আব্বা যখন বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন তখন বাচ্চা ছেলেরা যেসব পছন্দ করে সেসব নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন–কিন্তু সুমি আর বকুলের প্রবল আপত্তির জন্যে সেটা টানানো গেল না!
বিকেলবেলা জাহিদ চাচা আব্বার জন্যে কিছু জামাকাপড় ভোয়ালে গেঞ্জি এসব কিনে আনলেন। আব্বা নাকি আগে ভালো চা পছন্দ করতেন সেইজন্যে ভালো দার্জিলিং চা নিয়ে এসেছেন। সাথে ভালো বিস্কুট।
সব মিলিয়ে চারিদিকে শুধু উৎসব-উৎসব ভাব। এখন বাকি শুধু আব্বার হাজির হওয়া। বুবুনের আর সময় কাটতে চায় না।