ক্ষুধার দার্শনিক উচ্চারণ
আগেই দেখেছি, অন্নসংস্থানের প্রত্যেকটি উন্নততর ধাপে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ দেখে প্রচুরতর অন্নের সম্ভাবনা। ক্ষণকালের জন্যে হলেও তার অনাহারে মৃত্যুর ভয় অন্তর্হিত হয়। ফলে জন্মহার বাড়ে। প্রজা বৃদ্ধি হয়। আর ঠিক তার পরেই দেখা যায় প্রজার সংখ্যার সঙ্গে অন্নের পরিমাণের যে সংহতি আশা করা গিয়েছিল, তা নেহাতই মরীচিকা। ক্ষুধা ও খাদ্যের অনুপাত পূর্বের মতো বিসদৃশই থাকে। মানুষের সংখ্যার সঙ্গে খাদ্যের পরিমাণের কোনও সংগতিই পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সেই ব্যাপক ক্ষুধা, সেই অনাহারে মৃত্যুর আতঙ্ক, চাহিদা অনুসারে খাদ্য জোগানের সেই বৈষম্য।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, উন্নততর কৃষিতে যে বাড়তি খাদ্য উৎপাদিত হল তা দিয়ে বর্ধিত জনসংখ্যার অন্নসংকুলান হল না কেন? দুটি উত্তর সম্ভব: প্রথমত, যে হারে জনসংখ্যার বৃদ্ধি হল তার অনুরূপ পরিমাণে, অর্থাৎ তাদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্যে যতটা খাদ্য উৎপাদন প্রয়োজন ছিল ততটা হল না। উল্টো করে বলা যায়, খাদ্য উৎপাদন যতটা বেড়েছে বলে মনে হয়েছিল তাতে প্রজাবৃদ্ধি সম্বন্ধে মানুষের মনে যে আশ্বাস জন্মেছিল, সে-দুটোর মধ্যে একটা ফারাক দেখা গেল। অর্থাৎ খাদ্যবৃদ্ধির পরিমাণ সম্বন্ধে মানুষের মনে যে ভরসা জন্মেছিল সেটার সঙ্গে বাস্তবের মিল ছিল না, তাই একটা ভ্রান্ত আশ্বাসে প্রজাবৃদ্ধি ঘটতে লাগল কিন্তু সমাজের খাদ্যভাণ্ডারে সে অনুপাতে খাদ্য মজুত ছিল না। তাই বেদ বলছে:
মানুষের প্রয়োজন অনুপাতে যে খাদ্য তা মানুষকে রক্ষা করে, কোনও ক্ষতি করে না। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্য মানুষকে রক্ষা করতে পারে না, অর্থাৎ বাঁচিয়ে রাখতে পারে না।
এ কথাগুলি একটি বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন: প্রয়োজনের তুলনায় খাদ্য কম, ক্ষুধার অনুপাতে অন্ন নেই, ফলে আধপেটা খেয়ে যখন মানুষ বাঁচে না তখন সেই স্বল্প পরিমাণ খাদ্য প্রাণ রক্ষা করতে পারে না। অর্থাৎ প্রলম্বিত অর্ধাহারের পরিণতি অনাহারেরই অনুরূপ। সে-ই অশনায়া, ক্ষুধা, যার অপর নাম মৃত্যু। যে ক্ষুধা-মৃত্যুর দ্বারা সারা সৃষ্টি আবৃত। স্বয়ং প্রজাস্রষ্টা প্রজাপতি যার কিনারা করতে পারেন না। মাঝে মাঝে এটা ওটা নানা যজ্ঞ বাৎলে দেন, কিন্তু শেষ নিষ্পত্তি হয় না। একাধিক শাস্ত্রাংশে প্রজাপতিকে যে তাঁর সৃষ্ট মানুষের জন্যে খাদ্যসংস্থানের প্রয়াস পেতে হয়েছে, এতেই প্রমাণ হয় ক্ষুধার কোনও স্থায়ী সমাধান কখনওই হয়নি। ক্ষুধা ও খাদ্যের মধ্যে বৃহৎ একটি ব্যবধান সর্বদাই বিরাজ করেছে, যাকে মানুষ চিনেছে মৃত্যু বলে।
দ্বিতীয়ত, খাদ্য যতটা বেশি উৎপাদিত হয়েছিল উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থায় তার সবটাই ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্যে ক্ষুধিত মানুষের নাগালে আসেনি। অনেকটাই ধনীর লোভকে পুষ্ট করেছে; প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগবিলাসে ব্যয়িত হয়েছে। উদরসর্বস্ব কিছু মানুষ লোভের বশে খেয়েছে বেশি। কিছু অন্ন, যা ক্ষুধিতের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারত তা পরিণত হয়েছে সুরায় এবং বিলাসী সুরাপায়ী তাতে নেশা করেছে। অন্নরূপে হোক, সুরারূপে হোক তা পণ্য হয়ে দেশ দেশান্তরে গেছে, অর্থগৃধু বণিকের লোভ চরিতার্থ করেছে। দেশের চারিদিকে অসংখ্য ক্ষুধিত লোক বরাবরই ছিল, তাদের চোখের সামনেই তাদের ক্ষুধার অন্ন শস্যরূপে বা সুরারূপে বিদেশে গেছে, বিত্ত হয়ে ফিরে এসেছে ধনীর হাতে। উদ্বৃত্ত অন্ন আহার করে ধনী তার যৎসামান্য অংশের বিনিময়ে শিল্পী ও শ্রমিকদের দিয়ে প্রয়োজনের ও বিলাসের উপকরণ নির্মাণ করিয়েছে। সেই শিল্পবস্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং নৌবাণিজ্যের দ্বারা পৃথিবীর দূরপ্রান্তে চলে গেছে পণ্য হয়ে ধনীর ধন বৃদ্ধি করার জন্যে। বিলাসীর ভোগলালসা চরিতার্থ করবার জন্যে সে খাদ্যশস্য যথার্থ সমভাবে বণ্টন করে হয়তো দেশব্যাপী ক্ষুধা, অনাহার ও অর্ধাহারের এবং তার ফলে অসংখ্য ক্ষুধিতের তিলে তিলে মৃত্যু নিবারণ করা যেত। কিন্তু মুষ্টিমেয় স্বার্থসর্বস্ব ধনীর কাছে নগণ্য দরিদ্র জনসাধারণের ক্ষুধা কখনওই এমন তীক্ষ্ণ বাস্তব সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি যাতে লোভের তাড়না দমন করে সে সেই শস্য জনসাধারণের হাতে তুলে দেবে। পৃথিবীতে ক্ষুধার এমন মানবিক সমাধান প্রায়ই ঘটেনি।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণসাহিত্যের বেশির ভাগ রচনার সময় থেকেই জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক ধর্মের প্রাদুর্ভাব হয়। এগুলি বেদ ও যজ্ঞকে অস্বীকার করে। এ ছাড়া আরও নানা যে সব সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান ঘটে সেগুলির তাত্ত্বিক ইতিহাস আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছয়নি। কিন্তু এই সব ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলি যে বেদবহির্ভূত ছিল সে কথা জানা যায়। একই সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যেও বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। যজ্ঞ তখনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কিন্তু অহিংসা, অন্তত যজ্ঞের নামে অধিকসংখ্যক পশু হননের বিরুদ্ধে একটা মত যে গড়ে উঠেছে তা শতপথব্রাহ্মণে যাজ্ঞবন্ধ্যের গোহত্যা নিবারণের জন্যে কথাগুলোতে স্পষ্ট হয়ে যায়। ব্রাহ্মণসাহিত্যই তখন মুখ্য ধর্মগ্রন্থ। নানা শাখায় তখন বহু ব্রাহ্মণ রচনা হচ্ছে। এই ব্রাহ্মণগুলির পরবর্তী অংশ মাঝেমাঝেই আর ব্রাহ্মণ থাকছে না, অন্য এক শ্রেণির সাহিত্যে পরিণত হচ্ছে, যার পরবর্তী কালের প্রতিষ্ঠিত অবস্থান নাম উপনিষদ। ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের মধ্যবর্তী একটি স্বল্পায়তন সাহিত্য আছে, তার নাম আরণ্যক। সংখ্যায় বেশি নয় কিন্তু যুগ পরিবর্তনের চিহ্ন আরণ্যকেই প্রথম ধরা পড়ে। এগুলিতে যজ্ঞকে রূপক ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যজ্ঞে ব্যবহৃত তৈজসপত্র (অবশ্য তখন এগুলি কাঠে তৈরি হত, ধাতু দিয়ে বাসন তৈরি আরও পরবর্তী কালের), হব্য, পানীয়, অগ্নি, বেদী এবং আনুষঙ্গিক বস্তুগুলির একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। যেন যজ্ঞে যে প্রক্রিয়াটা চলছে তার প্রকৃত তাৎপর্য বস্তুজগতের নয়, দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক জগতের।
আরণ্যকের এই লক্ষণটি থেকে যে নতুন ধরনের ধর্মচিন্তা প্রবর্তিত হল তার পূর্ণতম বিকাশ ঘটল উপনিষদগুলিতে। অবশ্য কালগত ভাবে যেমন ব্রাহ্মণ রচনার শেষ দিকেই আরণ্যক রচনা এবং শেষও হয়, তেমনই বেশ কিছু ব্রাহ্মণের শেষাংশ, আরণ্যক ও কয়েকটি উপনিষদ একই সঙ্গে রচিত হয়েছিল। ব্রাহ্মণের এই শেষাংশ থেকে উপনিষদ পর্যন্ত পুরো যুগের সাহিত্যকে সাধারণ ভাবে জ্ঞানকাণ্ড বলে। এ নামটি উদ্ভাবিত হয়েছে প্রধানত পূর্ববর্তী সংহিতা ব্রাহ্মণের সাহিত্য থেকে এগুলিতে পৃথক ভাবে নির্দেশ করার জন্যে। কর্মকাণ্ড পুরোপুরি যজ্ঞনির্ভর, জ্ঞানকাণ্ডের সাহিত্য এক বিশেষ অর্থে যজ্ঞ নিরপেক্ষ। কর্মকাণ্ডে যজ্ঞে দেবতাদের স্তব ও হব্য দান করে বিনিময়ে প্রার্থনা করা হত দীর্ঘ আয়ু, স্বাস্থ্য (নিরাময়), শত্রুজয়, পশু ও সন্তান, খাদ্য ও সম্পত্তি— এক কথায় পৃথিবীতে দীর্ঘ সুখী জীবনের জন্যে যা কিছু প্রয়োজন তা-ই। অর্থাৎ কর্মকাণ্ডে মুখ্য লক্ষ্য হল ঐহিক সুখ। জ্ঞানকাণ্ডে লক্ষ্য বদলে গেল, ঐহিক সুখকে একেবারে অস্বীকার করে নয়, খানিকটা অতিক্রম করে এখন মানুষের লক্ষ্য হল যাতে জন্মান্তর না ঘটে। তত দিনে সমাজে জন্মান্তরবাদ বেশ সুপ্রোথিত এবং এর প্রথম উচ্চারণ ‘বারবার জন্ম’ নয়, ‘বারবার মৃত্যু’। এই মৃত্যুপরম্পরা থেকে নিষ্কৃতিই এখন ধর্মাচরণের প্রধান উদ্দেশ্য বলে গণ্য হল। উদ্দেশ্য যখন বদলেছে তখন উপায়ও বদলে গেল। অর্থাৎ যজ্ঞ দিয়ে তো এ ইষ্ট সিদ্ধ হবে না। এখন ওই জন্মান্তর থেকে নিষ্কৃতি, বৌদ্ধধর্মে যার নাম নির্বাণ এবং উপনিষদ যাকে বলেছে মোক্ষ, তারই জন্যে সাধনা। মোক্ষ যজ্ঞের দ্বারা পাওয়া যায় না; উপনিষদ বলল, মোক্ষ পেতে হলে জানতে হবে ব্রহ্ম আর জীবাত্মা একই। অতএব উপায় এখন জ্ঞান; তাই এ পর্বের নাম জ্ঞানকাণ্ড। যে সব কথা আগে স্পষ্ট করে বলা হয়নি এখন ধীরে ধীরে সেগুলির সংজ্ঞা নিরূপণ করা হল। ব্যাপারটা ঘটেছেও ধীরে ধীরে, দীর্ঘকাল ধরে ব্রাহ্মণসাহিত্যেই এই প্রথম লক্ষণগুলি দেখা দেয়। পরে আরণ্যকে যজ্ঞকে প্রতীকী ব্যাখ্যা করে বস্তুজগতের প্রক্রিয়া থেকে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়াতে উন্নীত করার চেষ্টা এবং উপনিষদে স্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হল জন্মান্তরের: মৃত্যুতে মানুষের শেষ হয় না, মৃত্যুর পরে মানুষ ভিন্নরূপে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু যেরূপেই জন্মাক না তার স্বরূপ হল, সে বিশ্বসংসারের কেন্দ্রসত্তা ব্রহ্মের থেকে অচ্ছিন্ন। এই তত্ত্বটিকে সে যখন জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারবে তখনই সে জন্মান্তর পরম্পরা থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মে লীন হয়ে যাবে; এ-ই মোক্ষ।
এই পটভূমিকায়, যখন বস্তুজগৎ অপেক্ষাকৃত গৌণ হয়ে যাচ্ছে, যখন মানুষের আত্যন্তিক সত্তাকে ব্রহ্ম বলা হচ্ছে, তখনকার সাহিত্যে আমরা স্বভাবতই ক্ষুধা ও খাদ্য সম্বন্ধে অন্য ধরনের মনোভাব আশা করতে পারি। এক অর্থে সে আশা পূরণও হয়, কারণ পূর্বের সংহিতাব্রাহ্মণে যেমন খাদ্যের জন্যে কয়েকশো সরাসরি প্রার্থনা আছে, এ সাহিত্যে ঠিক তেমন নেই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, ওই প্রার্থনাগুলি তো ধর্মসাহিত্যে ছিলই এবং যজ্ঞকালে সেগুলি উচ্চারিত হত। কাজেই ওই সব প্রার্থনা সমাজ-জীবনের অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল, নতুন করে ওই ধরনের প্রার্থনা রচনার আর কোনও প্রয়োজন ছিল না।
এই কালপর্যায়ে ক্ষুধা ও অন্ন সম্পর্কে মনোভাব কি বদলে গিয়েছিল? উপনিষদে সরাসরি খাদ্যপ্রার্থনা কম, তার একটা কারণ নতুন করে ওই সব প্রার্থনা রচনার প্রয়োজন কমে গিয়েছিল। পুরনো প্রার্থনা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যজ্ঞীয় অনুষ্ঠান তখনও চালু ছিল, অতএব ওই সব প্রার্থনা যজ্ঞের প্রসঙ্গে উচ্চারিত হতই এবং খাদ্যলাভের জন্যে নির্দিষ্ট যজ্ঞগুলিও নিয়মিত ভাবে সম্পাদিত হত। দ্বিতীয় কারণ হল, ওই সব প্রার্থনা দিয়ে খাদ্যলাভ করা যায়, এ বিশ্বাস হয়তো খানিকটা শিথিল হয়েছিল, কারণ যজ্ঞের অনুষ্ঠানে দেবতাদের কাছে নিয়মিত অন্নভিক্ষা করেও সমাজে অভুক্ত মানুষের সংখ্যা কমল না, ক্ষুধার সমাধান হল না। এ কথা সংহিতাব্রাহ্মণের পরে আরও কয়েকশো বছর ধরে ত মানুষ চোখেই দেখতে পেল। ফলে যজ্ঞ ও প্রার্থনার কার্যকারিতা সম্বন্ধে বিশ্বাস আর তত দৃঢ় থাকা সম্ভব ছিল না। তৃতীয়ত, আরণ্যক রচনার কালে ওই যে সব সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল সেগুলি যজ্ঞ সম্বন্ধে উদাসীন ছিল, অথচ তাদের ক্ষুধার পরিমাণ যে যজ্ঞকারী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের চেয়ে কম ছিল না তা তো অভিজ্ঞতাতেই ধরা পড়েছিল। যে কোনও উপায়ে যজ্ঞ না করেও তাদের যেমন তেমন করে খিদে তো মিটছিল? চতুর্থত, লোহার লাঙলের ফলার প্রচলনের পর চাষে যে ফসল উদ্বৃত্ত হচ্ছিল তা মানুষ প্রত্যক্ষ জানছিল। তারই সঙ্গে এ-ও দেখছিল যে সে-উদ্বৃত্ত ফসলে সমাজে পরিব্যাপ্ত ক্ষুধার নিবারণ হচ্ছিল না: সে-উদ্বৃত্ত ভোগে লাগছিল মুষ্টিমেয় একটি গোষ্ঠীর বাসনা ও লোভ চরিতার্থ করতে। কাজেই দেবতার কাছে খাদ্য চেয়ে আর কী-ই বা লাভ হবে? তা ছাড়া, ওই খাদ্য প্রার্থনা তো যজ্ঞেরই অঙ্গীভূত, এবং সপ্তম শতকের পরে আর্যাবর্তের ধর্মজগতে যে বাতাস বইছিল তা যজ্ঞের প্রতিকূলে। নতুন ধর্মসম্প্রদায়গুলি সবই যজ্ঞবিরোধী, কাজেই যজ্ঞের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে প্রার্থনা তাতে লোকের আস্থা খানিকটা টলে গিয়েছিল।
তার ওপরে তখনকার প্রবল একটি মত ছিল আজীবিকদের মত; এরা নিয়তিবাদের প্রবক্তা। এদের মতে সংসারে কোনও কিছুই কার্যকারণ-সূত্রে গ্রথিত নয়, অতএব কোনও কিছুরই কোনও বিধিসঙ্গত প্রতিকার হওয়া সম্ভব নয়। শুধু যে যজ্ঞ করে কিছু হয় না তা নয়, জ্ঞান দিয়েও, ব্রহ্মজ্ঞান দিয়েও জন্মান্তর ঠেকানো যায় না। কয়েক লক্ষ বার পুনর্জন্ম হওয়ার পর আপনিই তা বন্ধ হয়ে যায়। নিয়তিবাদ যে সমাজে প্রবল, সেখানে খাদ্য সম্বন্ধে প্রার্থনাও যেমন নিষ্ফল, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত যজ্ঞও তেমনই অর্থহীন। অবশ্য সে-সমাজে নিয়তিবাদই একমাত্র তত্ত্ব ছিল না। কিন্তু জৈন ও বৌদ্ধরাও যজ্ঞে সম্পূর্ণ আস্থাহীন ছিল, অন্যান্য ছোটবড় সম্প্রদায়ও যজ্ঞ সম্বন্ধে উদাসীন ও অবিশ্বাসী ছিল। এতগুলি প্রস্থান যেখানে যজ্ঞ বিষয়ে নিরুৎসুক, সেখানে যজ্ঞের অনুষ্ঠানে দেবতাদের কাছে খাদ্যভিক্ষা কতটা কার্যকরী হবে সে সম্বন্ধে বহু মানুষই ক্রমাগত সন্দিহান হয়ে পড়ছিল। এ সব মনে রাখলে বোঝা যায়, বাহুল্যবোধে ও নিষ্ফল জেনে মানুষ পূর্বের মতো যজ্ঞ করে দেবতাদের কাছে নিজেদের অন্নাভাব নিবেদন করে খাদ্যলাভের আশা করতে সাহস পাচ্ছিল না। কাজেই জ্ঞানকাণ্ডের সাহিত্যে সরাসরি খাদ্যভিক্ষা কমে গিয়েছিল। যদিও তার দ্বারা কোনও মতেই এটা প্ৰমাণ করা যায় না যে, সমাজে অন্নের প্রাচুর্য ছিল অথবা ক্ষুধা প্রশমিত হয়েছিল।