ক্যা গো, নিন্দা পাড়ো? ওঠো, ওঠো।
গতকাল শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো, মরার ঘুম আর চোখ ছাড়ে না। বুলু মাঝির ধাক্কায় কুলসুম গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে; এতেই মনে পড়ে, বুলু মাঝি মারা গেছে কাল দুপুরবেলা, তাকে দাফন করে তমিজের বাপ ঘরে ফিরেছে অনেক রাতে। তমিজের বাপ শুয়ে পড়েছে না খেয়েই, মণ্ডলদের বাড়ি থেকে সে খেয়ে এসেছিলো পেট ভরে। শরাফত মণ্ডল বুলুকে মরণোত্তর পুরস্কার দিয়েছে ৮/১০ জন গোরযাত্রীকে পেট ভরে ভাত খাইয়ে। বুলুর নিজের হাতে চাষ করা জমির ধানের ভাত, ভাত কী মিষ্টি! মণ্ডলের চার বিঘা জমি বুলু এবারেই প্রথম বর্গা নিয়েছিলো, জমিতে আউশের ফলন দেখে মণ্ডল খুব খুশি। অথচ প্রথমে এই জমিটা তাকে দিতে মণ্ডল দোনোমনো করছিলো। হাজার হলেও জমির মালিক ছিলো বুলু নিজেই, আড়াই বছর আগে আকালের সময় মণ্ডলকে বেচে দেয়। তা এবার বুলু খুব কারুবারু করলো এবং বিশেষ করে মণ্ডলের ছোটোবেটা তার পক্ষে সুপারিশ করলে মণ্ডল নরম হয়। তা বুলুর হাতে ধান হলোও বটে! হাজার হলেও নিজের জমিই তো ছিলো, ভিটার সাথে লাগোয়া বাপদাদার আমলের জমি তো, বুলুর রোগা শরীরের অমানুষ খাটনিতে জমি কি সাড়া না দিয়ে পারে? হয়তো ঐ জমিতে আউশ ফলাবার জন্যেই আল্লা এই বছরটা হায়াৎ। দিয়েছিলো তাকে, নইলে পেটের ওই ব্যারাম নিয়ে তার চলে যাবার কথা অনেক আগেই। বৌ তো ভেগেছে আরো আগে। শরাফত মণ্ডল গোরযাত্রীদের খাবার সময় কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়েছিলো নিজেই। তার ইশারায় বুলুর বেটা আফাজের পাতে ভাত তুলে দেওয়া হলো কয়েকবার। মাছ সবার জন্যে জুটলো এক টুকরা করে, আফাজের পাতে পড়লো দুটো পেটি। তার লাশ দাফন করে একেকজনের খিদেও পেয়েছিলো খুব, খেয়েও নিয়েছে ঠেসে। বোয়াল মাছের সালুন দিয়ে পেট ভরে খাবার তৃপ্তিতে তমিজেরক্ষ্মাপ কুলসুমের কাছে বুলুর জন্যে শোক ও আফসোসের কথা বয়ান। করে তারিয়ে তারিয়ে। তার বিলাপ ঝাপসা হতে হতে নাক ডাকার একটানা ধ্বনিতে ড়ুব দিলে কুলসুম কী আর করে, মেঝেতে বসে হাঁড়ির ভাত সব খেয়ে নিলো একাই। মাচায় তমিজের বাপের পাশে শুয়ে তার ঘুম আর আসে না। বাইরে বৃষ্টি-বোয়া জ্যো ত্যা, চাঁদের আলো চাল চুয়ে ঢুকে ঘরের অন্ধকারকে অনেকটা পাতলা করে তোলে। এবার বর্ষায় বৃষ্টিতে চালের ছন অনেকটা ক্ষয়ে গেছে। চাল ফুটো হলে বর্ষার পানি তবু হড়িকুড়ি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু শীত ঠেকাবে কী দিয়ে? তমিজ যদি নতুন শাড়ি আনে তার জন্যে তো তার ভেঁড়া শাড়িটা আর তমিজের পুরনো বন আর ন্যাকড়া-ট্যাকড়া জোগাড় করে কুলসুম একটা কথা সেলাই করতে পারে। কাঁথার লাল নীল সবুজ সুতা পাতলা অন্ধকারে তার চোখে শিরশির শিরশির করে। সামনের শীতে নতুন কাথার ওমে ঘুমাবার সুখে তখন কুলসুমের চোখ ভরে ঘুম নামে।
তমিজের হাঁকে সেই ঘুম ভাঙলে কুলসুমের বুক কাঁপে : ছোঁড়া এতোদিন বাদে বাড়ি এসেই বাপটাকে বকাঝকা শুরু না করে। দুয়ার ভেতর থেকে বন্ধ, তার মানে তমিজের বাপ সারাটা রাত ঘুম পাড়লো এই মাচার ওপরেই, ঘুমের মধ্যে উঠে সে একবারও বাইরে যায় নি। সারাটা রাত এরকম বেঘোরে ঘুমালো কি বুলুর শোকের তাপে? তা যতোই ঘুমাক, রাতভর বাইরে বাইরে হাঁটার মেহনত যখন হয় নি, তখন কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঘুম ভাঙবে। বাপ উঠলেই বেটা তাকে বকবে। বাপকে বকায় ব্যস্ত থাকলে তমিজ তাকে বাঁকা বাঁকা কথা শোনাবার ফুরসৎ পাবে না বলে কুলসুম একটু স্বস্তি পায়। আবার বেটার বকাঝকায় তমিজের বাপের কাচুমাচু মুখ ঐ স্বস্তিতে চিড় ধরায়।
এদিকে বাইরে তমিজের গলা শোনা যাচ্ছে ফের, আফাজের বাপের দাফন হলো কোটে? তমিজ নিশ্চয়ই বাইরে কারো সঙ্গে কথা বলছে। এই সুযোগে কুলসুম এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার সরা তুলে ফেলে, হাঁড়ির ভেতর থেকে ধোঁয়ার মতো উঠে আসে তমিজের পুরনো পিরানের গন্ধ। বাইরে মেয়েলি গলায় তমিজের কথার জবাব দিচ্ছে কেউ। হাঁড়ি সরাচপা দিয়ে মুখ তুলে কান খাড়া করলে কুলসুম বোঝে তমিজের সঙ্গে কথা বলছে আবিতন। ছি! মাগীর লজ্জাশরম কিছু নাই। মাস ছয়েক আগে গফুর কলুর সঙ্গে নিকা বসলো, তারপর থেকে মাঝিপাড়ায় তার পা দেওয়াই নিষেধ। আজ এতো সাহস সে পায় কোত্থেকে? নিজের বাপের বাড়ি কি মাঝিপাড়া দূরে, থাক, গিরিরডাঙা গ্রাম থেকেই তাকে খারিজ করা হয়েছে চিরকালের জন্যে। গফুর কলুর সঙ্গে মাঝিদের ওঠা-বসা তো দূরের কথা, তার কাছে কেউ কিছু বেচেও না। এমন কি কাদেরের দোকানে কাজ নেওয়ার পর সে অবস্থা অনেকটা ভালো করেছে, কিন্তু মাঝিদের কেউ তার কাছে টাকা হাওলাত নিতেও যায় না। এই অবস্থায় কাদের তাকে দিয়ে লীগের কাজ করায় কী করে? মাঝিপাড়ার মাথাগুলোকে নিয়ে সে কয়েকবার বৈঠক করলো। সে বোঝায়, কলু হোক তেলি হোক, গফুর তো মুসলমান। কী? আবদুল গফুরের ধর্ম কী?-ইসলাম। ইসলামে এসব ভেদাভেদ নাই। মুসলমানের এখন একজোট হওয়া দরকার, একজোট না হলে হিন্দুদের সঙ্গে আর কি। পেরে উঠবো?—তা মাঝিরা আরো বেশি একজোট। গফুর মানুষ হিসাবে যাই হোক, মাঝির বেটিকে বিয়ে করে মাঝিদের সে যেভাবে বেইজ্জত করেছে, তার ও তার বৌয়ের কোনো মাফ নাই। মাঝিদের সিদ্ধান্তে বিরক্ত হয় কাদের, হিন্দুদের মতো জাতপাত মানলে মুসলমান কওম থেকে তোমরা খারিজ হয়া যাও, সেটা বোঝো? ওইসব বৈঠকের একটিতে বুলু নিজেও হাজির ছিলো, এর তিন চার মাস আগে সে বৌকে তালাকও দিয়েছে। আবার কাদেরের সুপারিশেই শরাফতের জমিতে বর্গা করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু সেও মহা গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসে জ্ঞাতিগুষ্টির ক্রোধে ইন্ধন জোগায়। শেষ বৈঠকে শেষ মুহূর্তে কালাম মাঝি এসে একটি কথা বলেই কাদেরকে চুপসে দেয়, আপনার বাপজানের সঙ্গে কথাবার্তা কয়েন। আপনে কি কোনো মাঝির বেটিক বিয়া করবেন? মাঝিগোরে আপনেরা কী চোখে দ্যাখেন, কন তো?
বাড়িতে শরাফত মণ্ডলও ছেলেকে প্রায় একই যুক্তি দেয়, আজ তুমি কলুর সাথে মাঝির বেটির নিকা সাপোর্ট করো, ভালো কথা, কিন্তু কোনো মাঝি তোমার বোনের সাথে সম্বন্ধ করবার আসে তো তুমি রাজি হবা? কাদের জবাব দিয়েছিলো, ছেলে যদি লেখাপড়া জানে তো আপত্তি করবো কেন? সে বলে, লেখাপড়া শিখে চাকরিতে ঢুকেছে বলেই না তার বড়োভাইয়ের এতো খাতির, টমটমে করে গ্রামে ঢোকার সাথে সাথে তাকে দেখতে ভিড় জমে যায় রাস্তার দুই পাশে। আবার মানুষ তাকে হিংসাও করে। এসব তো তার চাকরির জন্যেই। এসব অকাট্য যুক্তি। কিন্তু শরাফত মণ্ডল আবদুল কাদের মিয়া, শোনো, বললে কাদের তার পুরো নাম এবং নামের পর ইজ্জত-বাড়ানো শব্দটি শুনে চোখ নিচে নামিয়ে লতিশুদ্ধ দুই কান পেতে দেয় বাপের। কথা শুনতে, লীগের কামে নামিহো। সামনে ভোট। ভোট চাও তো সমাজ তোমার মানাই লাগবি। মানুষের মন বুঝা কাম করো। বইপুস্তকের কথা থোও। ইগলান কথা কলে ভোট পাওয়া যাবি না। ভোটের কথায় কাজ হয়। গিরিরডাঙা গ্রামে লীগের কাজ থেকে গফুরকে বিরত রাখতেও সে বাধ্য হয়েছে।
যে মাগীকে নিকা করে গফুরের মতো মানুষের হেনস্থার শেষ নাই, সেই আবার তার আগের ভাতার মরতে না মরতে মাঝিপাড়ায় আসার সাহস পায়? ছি! ছি! আবিতনের গলা শুনেই কুলসুম লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে বাইরে আসে। তাকে দেখেও তমিজ আবিতনকে জিগ্যেস করে, আফাজের বাপের প্যাটের বিষ তো অনেক দিনের, না? জবাব না দিয়েই আবিতন দ্রুত পায়ে চলে যায় গোলাবাড়ির দিকে। কড়া চোখে তার যাওয়া দেখে কুলসুম তমিজকে ঘরত যাও বলতে বলতে ডোবার দিকে রওয়ানা হয়। ঘরে ঢুকে তমিজ বলে, বাজান নিন্দা পাড়ো?
প্রশ্নটি তমিজের বাপের কানে ঢোকে শাসনের মতো এবং সে উঠে বসে ধরফর করে। এ তার চিরকালের ব্যারাম। ঘুম থেকে জাগার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের মাঝখানে ধক করে আওয়াজ হয় : হায়রে, বেলা বুঝি মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছের বকদের সাদা শরীর বেয়ে নেমে এসেছে গাছের হাঁটু অব্দি, আর এখনো তার চেতন হলো না। এই উদ্বেগ থেকে রেহাই পেতে কিংবা উদ্বেগের ক্লান্তি মোচন করতে সে মেঝেতে থাকলে মাচায় ওঠে এবং মাচায় থাকলে মাচাতেই ফের পাশ ফিরে শোয়। ঘুম অবশ্য তার আর আসে না, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাপসে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে সে হাঁপায়। হাজার হলেও ঘুম হলো তমিজের বাপের এক ধরনের কাজ, তার খুব প্রিয় পেশাও বলা যায়। ঘুমালে তার মেহনত মেলা। ঘুমে ঘুমে তার চলাচল, তার খোঁজাখুঁজি, তার ভাবনাচিন্তা, তার উদ্বেগ ও উত্তেজনা এবং নানারকম বুদ্ধি করা ও ফন্দি আঁটা। সে কী খোজে, ভাবনা তার কী নিয়ে, তার উদ্বেগের কারণ কী, কেনই বা তার এতো উত্তেজনা এসব ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় তার মুশকিল আরো বেশি। তাই ঘুম তার যখনি ভাঙুক অন্তত খানিকটা জিরিয়ে না নিলে তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানোটাই কঠিন। কিন্তু এখন সে জিরাবে কি? ঘরের মধ্যে তমিজ। তবে পিঠের নিচে সাপ না বিছার অবিরাম খোঁচায় তমিজের শাসন চাপা পড়ে, ওই শাসন থেকে অব্যাহতির সময়টা আরেকটু বাড়াতেই অদৃশ্য সরীসৃপের ওপর বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিড়বিড় করে শালার বেটা শালা বলতে বলতে পিঠের দুর্গম জায়গায় হাত দিয়ে সে বার করে আনে অপরিচিত একটি জীবকে। জীবের দুই পাশে চোখা আগাওয়ালা কয়েকটা ডানা। ডান হাতে চোখের সামনে ধরলে জিনিসটা স্পষ্ট হয় এবং ঝাপসা হয়ে ফুটে ওঠে গত সন্ধ্যার দাফনের ছবি। কাল গোরস্তানের একটি দুই দিনের বাসি কবর থেকে সে এটি তুলে এনেছে। গোরস্তানের খেজুর ডালের গুণ অনেক, এটা সঙ্গে থাকলে রাত্রে কেউ ঘাটাতে সাহস পায় না, এর শক্তি আগুন ও লোহার পরেই। রাতে কাৎলাহার বিলের সিথানে পাকুড়তলায় যাবার সময় এটা সঙ্গে রাখা ভালো। কিন্তু গত রাতটা তার কাটলো শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। অপচয়! অপচয়!-একটি দীর্ঘ রাত্রি বৃথা কাটাবার বেদনায় দমে গিয়েও ঐ রাতটির নষ্ট তেজ ফিরে পাবার লোভে তমিজের বাপ চোখজোড়া বন্ধ করে। এতে কাজও হয় বৈ কি! কালাহার বিলে হাবুড়ুবু খেতে খেতে সাঁতার কাটে ভেড়ার পাল, নিজেদের গজার মাছের সুরত ফিরে পাবার আশায় তারা সাঁতার কাটে খুব মন দিয়ে। এইসব দেখতে দেখতে চোখ মেলে তমিজের বাপ তাকায় ছেলের দিকে। জীবিত একমাত্র সন্তানের কড়া চোখ তার নজরে পড়ে না, ছেলের ঝাঁকড়া চুলে সে দেখে কালো পাগড়ি, তার হাতে লোহার পান্টি, গলায় শেকল।
টাসকা মারা গেলা ক্যা গো ওঠো না কিসক? তমিজের এই ধমকে ১৪ অক্ষরের পয়ারের আভাস থাকলেও তমিজের বাপের কানে তা এমনি কষে ধাক্কা দেয় যে চোখের পলকে তার চোখের সমুখের পান্টি মিশে যায় তমিজের হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত, গলার শেকল ঢুকে পড়ে তমিজের কণ্ঠার হাড়ে এবং মাথার কালো পাগড়ি লুকায় তার ঝাঁকড়া চুলের ভেতর। তমিজের বাপ মাচায় উঠে বসে বলে, ক্যা বাবা, সোমাচার ভালো? ছেলের ধমক খাবার ঝুঁকি এড়াতে ছেলের কুশল না জেনেই নিজের চোখমুখদাড়ি দুই হাতে ঘষতে ঘষতে তমিজের বাপ জরুরি তথ্য দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, বুলুর খবর শুনিছিস? কও তো বাপু, তাজা মানুষটা, বেনবেলা প্যাট ভরা পান্তা খায়া বার হছে, পান্তা খাছে, পান্তার সাথে।
শুনিছি। এক কথায় তমিজ তাকে থামিয়ে দিলে আরো কথা বলার খাটনি থেকে রেহাই পেয়ে এবং বুলুর শেষ খোরাক গেলার মুখরোচক বর্ণনা বয়ান করা থেকে বঞ্চিত। হয়ে এখন কী করবে ঠিক বুঝতে না পেরে তমিজের বাপ হঠাৎ করেই মেঝেতে নামে এবং বেলা কুটি গেছে গো বলে ডোবার দিকে যেতে যেতে আপন মনে বলে, আজ শমশেরের জমিত মাঙুন কামলা দেওয়ার কথা। আজ বুধবার লয়?
লিজেগোরে নাই এক চিমটি জমি, হামাগোরে আবার মান কামলা খাটা কিসক গো? তমিজের এই কথার জবাব না দিয়ে তার বাপ বাইরে গেলে তমিজ জোরে জোরে বলে, যার জমিত মাঙুন খাটবা, তাই তোমার খ্যাটা দিবার পারবি? তোমার জমি কোটে? তমিজের এই খেদোক্তির প্রতিবাদ করা মুশকিল। জমিতে মাঙুন খাটা মানে পরস্পরকে মাগনা সাহায্য করা, তমিজের বাপ জমির কাজে সাহায্য করার সুযোগ কোথায়?
তমিজের বাপ বাইরে মুখ ধুতে গেলে তমিজ যায় ভেতরের দিকের নতুন ঘরটিতে। ফাল্গুনে খিয়ার থেকে টাকা এনে এই ঘরটা সে তুলেছিলো নিজের থাকার জন্যে। সে বাইরে গেলে বৃষ্টি বাদলায় কুলসুম এখানে রাঁধে, ধানের বস্তা রাখে। মুরগিটাকে ওমে বসিয়েছিলো এখানেই, বাচ্চাগুলো মরতে মরতে এখন দুটিতে এসে ঠেকেছে, রাতে মুরগিটা দুটি সন্তানকে নিয়ে এখানেই থাকে। আজ মেঘ নাই, তার। ওপর তমিজও বাড়ি এসেছে। কুলসুম তাই উঠানের চুলায় ভাত চড়াবার জন্যে চাল ধুচ্ছিলো। একটা চটের ঝোলা তার হাতে এগিয়ে দেয় তমিজ, গোলাবাড়ি থাকা কয়টা মাছ লিয়া আসিছি। কুলসুম তার দিকে না তাকিয়ে ঝোলাটা নিয়ে চাল ধোয়া অব্যাহত রাখলে তমিজ হঠাৎ নতুন করে গলা চড়ায়, কালাম ভায়েক কয়া গেলাম, তাই বাঁশ দিবি, খ্যাড় দিবি, চুলার উপরে চালা তুল্যা লিবার কলাম। কিছুই তো করো নাই দেখিচ্ছি।
গতবার তমিজ এসে কালাম মাঝির পাতকুয়ার পাট বদলে দেওয়ার কাম করলো, মজুরি নেয় নি। কথা হয়েছিলো ধান দেবে আধ মণ। তমিজের ঘরেই তখন মেলা ধান, কালামের কাছ থেকে ধান এনে দেওয়া মানে আরো কয়েক দিন বাপটাকে বসে খাওয়ার সুযোগ দেওয়া। তমিজ তাই কালামকে দুটা বাঁশ আর কিছু খড় দিতে বলে যায়, ওই দিয়ে তমিজের বাপ উঠানে একটা চালা করে দিলে কুলসুমেরই সুবিধা হয়। চড়া রোদে কুলসুম ভাত রাঁধে, বৃষ্টি নামলে ছোটাছুটি করে ঘরে উঠে তোলা-উনান ধরায়। এসব কষ্ট থেকে তাকে রেহাই দিতেই চালাটা তোলার কথা। তা তাড়াতাড়ি করে তাকে খিয়ারের দিকে যেতে হলো। বাপকে কতোবার বলে গেলো। কোথায় চালা, কোথায় কী? বাঁশের একটা খুঁটি পর্যন্ত নাই। তমিজের মেজাজটা খিচড়ে যায়, ক্যা গো ফকিরের বেটি, হামি না থাকলে একটা কামও কি হবি না গো?
ভোরবেলা বাড়ি এসেই তমিজ গফুর কলুর নিকা-করা বৌয়ের সাথে কথা বলে কুলসুমের দিনটা তো মাটি করে দিয়েছে। সতীনের বেটার এখন শুরু হলো ত্যাড়া ত্যাড়া কথা। কুলসুম কয়েকবার গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিলে চুলায় আগুন জ্বলে দপ করে, তার আঁচে মুখটা তার হয়ে ওঠে বেগুনি রঙের। আগুনের তাপে তার গলা বাজে গনগন। করে, হামাক তো তোমরা রাখিছো চাকরানি কর্যা, আবার হামাক দিয়া কামলাও খাটাবার চাও? একবার কথা শুরু করলে কুলসুমের পক্ষে থামাটা কঠিন। তাই তাকে অবিরাম বকে যেতেই হয়, কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ের বাঁশ কি ক্যাটা আনা লাগবি হামাকই? খুঁটি কি হামিই পুঁতমু? রাগে ও চুলার আঁচে তপ্ত বেগুনি মুখটা তমিজের দিকে পলকের জন্যে একবার ঘুরিয়ে ফের চুলায় মনোযোগী হয়ে কুলসুম বলে, হামরা ফকিরের ঘরের বেটি, হামরা কি জেবনে পাকঘর দেখিছি; না-কি পাকঘরত পাকশাক। করিছি? হামাক ওদেত পোড়া লাগবি, বিষ্টিত ভিজা লাগবি। এখন থেকে অন্তত বিকালবেলা পর্যন্ত এই কথাই, একই বাক্য নানা বিন্যাসে সে পুনরাবৃত্তি করে চলবে। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কথা যোগ হবে।-কী? হামার কপালের দোষ। কেন?আগুন ও লোহার পরেই-না, সে ফকিরের বেটি, সে পড়েছে খানদানি মাঝিদের ঘরে। মাঝিদের নিজেদের পাছায় ত্যানা নাই, নিজগিরিরডাঙার হাভাতে চাষারাও এদের সঙ্গে এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করা দূরের কথা, ওঠা বসা পর্যন্ত করে না।—সেই গুষ্টির মানুষ। হয়ে তমিজ কথায় কথায় তাকে খোটা দেয় ফকিরের বেটি বলে। কৈ, তমিজের বাপ তো কুলসুমকে অন্তত বংশ তুলে কখনো কথা শোনায় না। মানুষটা বোকাসোকা আবোর হোক আর পাইঙ্গা হোক, হাজার হলেও কয়েকটা বছর তো চেরাগ আলির পিছে পিছে ঘুরলো। দাদা কি তাকে কিছুই দিয়ে যায় নি। এই যে ঘুমের মধ্যে উঠে সে বাইরে যায়, আবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ঠিকঠাক ঘরে ফেরে, এইসব সম্ভব হয় কী করে? তেনাদের কেউ তার ওপর ছাতা ধরে আছে বলেই তো! চেরাগ আলি থাকলে তাকে। সতীনের বেটার এতোই খোটা সহ্য করতে হয়? কুলসুমের দুই চোখের পাতাই ভারি। হয়ে আসে। তবে সাতসকালে ছিনাল মাগী আবিতনের সঙ্গে তমিজের কথাবার্তার। অস্পষ্ট ধ্বনি চুলার আগুনকে উসকে দিলে তার আঁচে চোখ খরখর খরখর করে এবং তার ক্ষোভ বেরিয়ে আসতে থাকে প্রবল তোড়ে। কিন্তু কুলসুমের কথার কি চুলার আগুনের ঝাঁঝ তমিজকে ছুঁতে পারে না, সে কথা বলে চলে তার বাপকে লক্ষ করে। কী,-না, আকালের বছর তার সবেধন নীলমণি তিন বিঘা জমি শরাফত মণ্ডলকে বেচে সে শোধ করলো জগদীশ সাহার দেনা, তার গোরুটা পর্যন্ত নিয়ে গেল জগদীশের মানুষ এসে। তাতেও নাকি সাহার সুদের টাকা সব শোধ হয় নি। সেই মানুষ আবার যায় মান কামলা খাটতে! এরকম হাউস সে করে কোন আক্কেলে? তমিজের বাপ জবাব দেয় না। জবাবের জন্যে পরোয়া না করে তমিজ হাঁটা দিলো রাস্তার দিকে।
কুলসুম দেখে হাঁড়ির ভেতরটা, ভাত হতে আর কতক্ষণ? তমিজ ততোক্ষণে চলে গেছে নজরের বাইরে। এ কী রকম জোয়ান মানুষ গো? সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় খালি পেটে? হাঁটা দিলো বুঝি শরাফত মণ্ডলের বাড়ির দিকে। বুলুর বর্গা-করা জমিটা এবার নিজেই বর্গা নিতে পারে তো আমনের খন্দটা ধরতে পারে। আমন রোপার সময় এখনো যায় নি। কড়া কড়া কথা বলতে বলতেই সে বাপকে এই পরিকল্পনার কথা একবার বলেছে। বাপের সাড়া না পেয়ে হনহন করে ছুটলো।
না খেয়ে তমিজ ঝাল ঝেড়ে গেলো কুলসুমের ওপর। ওদের বাপবেটার ঝগড়া হলে দুজনেই কথা শোনায় কুলসুমকেই। এই ঘরে বিয়ে দিয়ে গিয়ে দাদাটা তার কী সর্বনাশটাই যে করে গেছে! বুড়া নিজে তো দিব্যি কেটে পড়েছে, এতিম নাতনিটার কথা কি তার একবার মনেও পড়ে না? তমিজের বাপের খোয়াবে তো সে নিত্যি আসা-যাওয়া করে, কুলসুমের চোখের ভেতর কি একবার উঁকিটাও দিতে পারে না? কী। জানি, বিটকেলে বুড়া মরেই গেলো কিনা কে জানে? মরে গিয়েছে?-মরলে কিন্তু একদিক থেকে ভালোই। যদি বেঁচে থেকে থাকে তো চোখের আলো তো তার এ্যাদ্দিনে একেবারে নিভু নিভু; একা একা ক্রোশের পর ক্রোশ সে পাড়ি দেয় কী করে? জেয়াফতের বাড়িতে খেতে বসলে তার পাতে এক টুকরা গোশত কি এক হাতা ডাল তুলে দিতে বলবে কে? কুলসুমের সামনে হাঁড়ির ওপর ধোঁয়ায় কাঁপে কালো টুপিপরা চেরাগ আলির মাথা। হাতের ছড়ি ঠুকে ঠুকে বুড়া কোন মেলায়, কোন হাটে, কোন নদীর ঘাটে বটতলায় ঘোরে আর দোতারা বাজিয়ে গান করে। চুলায় ভাত ফোটে টগবগ করে, সেই আওয়াজে তৈরি হয় চেরাগ আলির শোলোক। কিন্তু গানের কথা কুলসুম কিছু বুঝতে পারে না। গান করতে করতে বুড়া মানুষটা হাপসে যাচ্ছে, শুধু দোতারাই বাজিয়ে চলেছে, মুখে তার কথা ফোটে না। তাকে একটু আরাম দিতে কুলসুম বাকি কথাগুলো গুনগুন করবে তার জো নাই। চেরাগ আলির গানের কথা তো। কিছুই ধরা যাচ্ছে না।
অনেক দূরের অচেনা জায়গায় চেরাগ আলির অস্পষ্ট কথার ধ্বনি ছাপিয়ে ওঠে। তমিজের বাপের হুঁশিয়ারি, ক্যা রে ভাত উথলায়, দেখিস না? চুলার আঁচ কমিয়ে মাড় বসিয়ে হাঁড়ি নামাতে নামাতে কুলসুমের সমস্ত শরীর ভেঙে ভেঙে পড়ে, হায়রে, গান করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ হলেও দাদার কাছে কেউ নাই যে তাকে একটু জিরাতে দিয়ে পরের কথাগুলো গায়।