৪
বিষ্যুদবার। কুলখানি উপলক্ষে আসরের নামাজের পর থেকে বিপুল আয়োজন চলছে। মাদ্রাসার দশজন তালিবুল এলেম কোরান খতম দিচ্ছে। তালিবুল এলেমদের আরেকটি দল তেঁতুলের বিচি নিয়ে বসেছে। তারা খতমে জালালি নিয়ে ব্যস্ত।
এশার নামাজের পর বড়খানা শুরু হল। জসু বিশাল টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে খাবার নিয়ে চলে এসেছে। তার চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল। সে শুধু খাবার নিয়ে আসে নি, খেয়েও এসেছে।
ঝড়-বৃষ্টির কারণে কুলখানির অনুষ্ঠান সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হল। রাত বারোটা পর্যন্ত জিকিরের ব্যবস্থা ছিল। এগারটার মধ্যেই তালিবুল এলেমরা চলে গেল। মুনশি- মৌলবিরা খাওয়াদাওয়ার পরে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন।
মিসির আলি শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শোনা তাঁর পছন্দের একটি বিষয়। দরজা ধাক্কানোর শব্দে তিনি জাগলেন। দরজা খুলে দেখেন রেইনকোট পরা মল্লিক সাহেব। মল্লিক সাহেব আহত গলায় বললেন, আমার দুই হারামজাদার কাণ্ড দেখেছেন! বাপ জীবিত, তার কুলখানি করে বসে আছে।
মিসির আলি বললেন, ভেতরে আসুন।
মল্লিক ঘরে ঢুকলেন। মিসির আলি বললেন, আপনি বাড়িতে গিয়েছিলেন, নাকি সরাসরি আমার এখানে এসেছেন?
বাড়িতে গিয়েছিলাম, আমাকে দেখে আমার দুই পুত্র দুই দিকে দৌড় দিয়ে পালায়া গেছে।
আপনি ছিলেন কোথায়?
বিষয়সম্পত্তির দেখভালের জন্য গিয়েছিলাম।
ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি?
বড়টার সাথে একবার মোবাইলে কথা হয়েছে। তারপরেও দুই কুলাঙ্গার কুলখানি করে ফেলেছে। নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে।
কী মতলব থাকবে?
আমাকে খুনের পরিকল্পনা করেছে। সকালেই আমার মৃত্যুসংবাদ শুনবেন। কীভাবে মারবে তাও জানি। ধাক্কা দিয়ে কুয়াতে ফেলে দিবে।
মিসির আলি বললেন, আপনার কুয়ার মুখ তো বন্ধ। ফেলবে কীভাবে?
মল্লিক বললেন, এইটাই ঘটনা। ঘরে পা দিয়ে প্রথমেই গেলাম কুয়ার কাছে। মনে সন্দেহ, এইজন্য গিয়েছি। গিয়ে দেখি কুয়ার মুখ খোলা। এরা কারিগর ডেকে খুলেছে।
মিসির আলি বললেন, বসুন, চা খান।
মল্লিক বললেন, চা খাব না। ক্লান্ত হয়ে এসেছি। স্নান করব, তারপর নিজের কুলখানির খানা খাব।
মিসির আলি বললেন, খাওয়াদাওয়ার পর যদি মনে করেন আমার সঙ্গে কথা বলবেন তা হলে চলে আসবেন। আমি জেগে থাকব।
আপনার জেগে থাকতে হবে না। আপনি ঘুমান। বটি হাতে নিয়ে আমি জেগে থাকব। দুইজনকে বটি দিয়ে কেটে চার টুকরা করব। কুয়ার ভেতর ফেলে কুয়া আটকে দিব। যেমন রোগ তেমন চিকিৎসা।
মিসির আলি বললেন, আপনি উত্তেজিত। উত্তেজনা কোনো কাজের জিনিস না। উত্তেজনা কমান। বসুন, গা থেকে রেইনকোট খুলুন। চা বানাচ্ছি, চা খান।
মল্লিক সাহেব গা থেকে রেইনকোট খুললেন। হতাশ মুখে সোফায় বসলেন, নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, কেউ কোনোদিন শুনেছে ছেলে বাপ বেঁচে থাকতেই বাপের কুলখানি করে ফেলে? শুনেছে কেউ? বাপের জন্মে এই ঘটনা কখনো ঘটেছে?
চায়ে চুমুক দিয়ে মল্লিক সাহেব কিছুটা শান্ত হলেন।
মিসির আলি বললেন, আপনাকে মাঝে মাঝে ধূমপান করতে দেখি। উত্তেজনা প্রশমনে নিকোটিনের কিছু ভূমিকা আছে। একটা সিগারেট কি ধরাবেন?
বৃষ্টিতে সিগারেটের প্যাকেট ভিজে গেছে।
মিসির আলি তাঁর প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। মল্লিক সিগারেট ধরিয়ে আরো খানিকটা শান্ত হলেন। মিসির আলি বললেন, কখন থেকে আপনার দুই ছেলে আপনার কাছে অসহ্য হয়েছে?
মল্লিক বললেন, যখন বড়টার বয়স পাঁচ আর ছোটটার তিন।
তারা করত কী?
আমার সামনে যখন দাঁড়িয়ে থাকত তখন আমার দিকে তাকাত না। দুইজনেই আমার দুই ফুট দূরে, আমার ডানদিকে তাকায়ে থাকত। আমি কোনো প্রশ্ন করলে সেই দিকে তাকিয়েই উত্তর দিত।
এই কাজ কেন করত জিজ্ঞেস করেন নাই?
করেছি। একবার না, অনেকবার করেছি।
তাদের জবাব কী?
তারা নাকি দুইজন বাবা দেখে। একটা বাবা খারাপ, একটা ভালো। তারা তাকিয়ে থাকে ভালো বাবার দিকে।
আপনি তা হলে তাদের কাছে খারাপ বাবা?
হুঁ। যতবার দুই ভাই এই রকম কথা বলেছে ততবার এদের শক্ত মাইর দিয়েছি। একবার তো বড়টার গলা চিপে ধরলাম। গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আমি ভাবলাম, মরে গেছে। কিছুক্ষণ পর উঠে বসে চিঁ চিঁ করে বলে, বাবা, পানি খাব।
আপনার দিকে তাকিয়ে কি বলেছে?
না, ওই যে বললাম, দুই ফুট দূরে তাকায়। আমার ডানে।
এরা দু’জন দেখি সব সময় একই রকম কাপড় পরে। এটা কখন থেকে শুরু হল?
যমজ বোন। একটার কোনটা কে। আমি
মল্লিক সাহেব হতাশ গলায় বললেন, তারা দু’জন যে শুধু একই রকম কাপড় পরে তা না, তাদের বউ দুইটারও একই চেহারা। নাম পারুল, আরেকটার নাম চম্পা। বুঝার উপায় নাই, কোনোদিনই বুঝি না। আমার ধারণা, আমার দুই বদ পোলাও জানে না কোনটা কে?
পুত্রবধূদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
খারাপ।
কতটা খারাপ?
পারুলকে আমি ডাকি বড় কুত্তি, চম্পাকে ডাকি ছোট কুত্তি। এখন বুঝে নেন সম্পর্ক কত খারাপ। এদের স্বভাব চরিত্রও কুত্তির মতো। কেন তা বলব না। শ্বশুর হয়ে পুত্রবধূদের বিষয়ে নোংরা কথা বলা যায় না।
মল্লিক উঠে দাঁড়ালেন, মিসির আলিকে কোনো কিছু না বলেই হঠাৎ করে বের হয়ে গেলেন। ঘুমুতে যাওয়ার আগে মিসির আলি ব্যক্তিগত কথামালার খাতা খুলে কিছুক্ষণ লিখলেন—
ছক্কা-বক্কা এবং তাদের বাবার ব্যাপারে আমি কিঞ্চিৎ আগ্রহ বোধ করছি। তাদের পুরো কর্মকাণ্ডে এক ধরনের অসুস্থতা আছে। ছেলে দুটি মানসিক রোগগ্রস্ত, নাকি তাদের বাবা? বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার না। মল্লিক সাহেবের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তাঁর পুত্রবধূদেরও কিছু সমস্যা আছে।
দুটি ছেলেই বাবাকে অসম্ভব ভয় পায়। সেটাই স্বাভাবিক। যে বাবা শাস্তি হিসেবে গলা চেপে ধরে অজ্ঞান করে ফেলেন, তাকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই।
এমনকি হতে পারে, বাবাকে অসম্ভব ভয় পায় বলেই এরা অন্য এক বাবাকে কল্পনা করেছে, যে বাবা ভালো, স্নেহময়? কল্পনার সেই বাবা, খারাপ বাবার ডানদিকে দুই ফুট দূরত্বে থাকেন। মস্তিষ্ক চাপ সহ্য করতে পারে না। চাপ মুক্তির পথ খোঁজে। একটি ভালো বাবা কল্পনা করে নেওয়া চাপমুক্তির পথ।
দুটি ছেলেই অন্তর্মুখী। এদের পক্ষে দুই যমজ বোনের প্রেমে পড়ে নিজেদের ইচ্ছেয় বিয়ে করা অসম্ভব। আমি নিশ্চিত, মল্লিক সাহেব দুই ছেলের বিয়ের জন্য যমজ বোন খুঁজে বের করেছেন। তাঁর আগ্রহেই বিয়ে হয়েছে।
দুই ভাই একই পোশাক পরে। বিষয়টা তারা করেছে, না তাদের বাবা ঠিক করে দিয়েছে?
একই চেহারার দুই স্ত্রী যিনি ঠিক করে দিয়েছেন, তিনিই একই পোশাকের ব্যাপারটা করবেন। সাধারণ লজিক তা-ই বলে।
আরো রহস্য আছে। ছক্কা-বক্কা দু’জনেরই একটি করে ছেলে (যদিও মল্লিক বলেন তাদের চারটি সন্তান)। তাদের বয়স কাছাকাছি। দুই থেকে তিন বছর। বেশিরভাগ সময় তারা বাবার কোলে থাকে। দুই বাবাই সন্তান কোলে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তিহীন হাঁটাহাঁটি করেন। ছক্কার ছেলেই যে ছক্কার কোলে থাকে তা না, কখনো সে থাকে বক্কার কোলে। কে কার কোলে থাকবে তা নিয়ে ধরাবাঁধা কোনো ব্যাপার নেই। রহস্য হচ্ছে যখন যে শিশু যার কোলে থাকবে তাকেই বাবা ডাকবে।
মল্লিক সাহেব দাবি করেন, তিনি মৃত মানুষদের দেখতে পান। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেন। একটি পরিবারের সবাই ডিলিউশনে ভুগবেন, এটাই বা কেমন কথা! কোনো পরিবারে একজন কঠিন মানসিক রোগী থাকলে তার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়বে। এটা স্বাভাবিক। তবে সুস্থ মানুষ কখনোই অসুস্থ হয়ে পড়বে না।
দুর্বোধ্য রহস্যের মুখোমুখি হলে বেশিরভাগ মানুষ এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে শেক্সপিয়ার আওড়ায়। দার্শনিক ভাব ধরে বলে — There are many things in heaven and earth…
মিসির আলি হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না। তিনি রহস্যের ভেতর ঢুকতে চাইছেন। দুই ভাইয়ের কাছ থেকে কয়েকটা জিনিস জানা তাঁর খুবই প্রয়োজন। দুই ভাইকে তিনি পাচ্ছেন না। তারা সারা দিন নানান জায়গায় ঘোরে, গভীর রাতে বাবার কাচ্চি হাউসে ঘুমিয়ে থাকে।
মিসির আলি কয়েকবার তাদের খোঁজে জসুকে পাঠিয়েছেন। জসু তাদের পায় নি।
দুই ভাই বিষয়ে মল্লিক এক রাতে তথ্য দিলেন। মিসির আলিকে আনন্দের সঙ্গে জানালেন, ওরা হাজতে।
মিসির আলি বললেন, হাজতে কেন? কী করেছে?
নতুন কিছু করে নাই। পুরোনো পাপে হাজত বাস করছে। রমনা থানার ওসি সাহেবকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলেছি, দু’জনকে ধরে নিয়ে যেন ভালোমতো ডলা দেওয়া হয়। তিন দিন হাজত বাস করে ফিরবে। শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা। এরকম শিক্ষা সফর আগেও একবার করেছে।
আপনি ব্যবস্থা করেছেন?
হ্যাঁ, ওসি সাহেবের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। প্রায়ই ওনাকে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস উপহার হিসেবে পাঠাই। একবার পাঠিয়েছিলাম এক কলসি রাবরি। রাবরি চেনেন?
চিনি।
আরেকবার পাঠিয়েছিলাম একশ একটা ডাব। ডাব পাঠানোর পর উনার সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে। মাই ডিয়ার লোক। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব। পুলিশের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো। কখন কোন কাজে লাগে। চা খাব, আপনার কাজের ছেলেটাকে সুন্দর করে এক কাপ চা বানাতে বলেন। বাসায় ঝামেলা, চা বানানোর অবস্থায় কেউ নাই বিধায় আপনার এখানে চা খেতে এসেছি।
মিসির আলি বললেন, কী ঝামেলা?
ছক্কার ছেলেটা মারা গেছে। নিউমোনিয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা বুঝে না-বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক বিষ ছাড়া কিছু না।
মল্লিক সিগারেট ধরালেন। মিসির আলি বললেন, আপনার নাতি মারা গেছে, আর আপনি স্বাভাবিকভাবে গল্পগুজব করছেন?
মল্লিক বললেন, মৃত্যু হল কপালের লিখন। দুঃখ করে লাভ কী? যত স্বাভাবিক থাকা যায় ততই ভালো।
মিসির আলি বললেন, ছক্কা কি তার ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানে?
মল্লিক বললেন, না। পুলিশের ডলা খেয়ে বাড়ি ফিরে জানবে। ডাবল অ্যাকশান হবে।
জসু চা বানিয়ে এনেছে। মল্লিক তৃপ্তি করেই চা খাচ্ছেন। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন মানুষটার দিকে।
মল্লিক সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে মিসির আলির দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, আপনাকে বলেছি না আপনার বাসায় একজন মৃত মানুষকে ঘোরাফিরা করতে দেখি?
জি বলেছেন।
এই মানুষটার পরিচয় জেনেছি। উনি আপনার পিতা।
ও আচ্ছা।
মল্লিক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, “ও আচ্ছা’ বলে উড়ায়ে দিবেন না। উনি আমাকে বলেছেন, আপনি মহাবিপদে পড়বেন। গাড়ি চাপা পড়ে মারা পড়বেন। গাড়ির রঙ কালো। গাড়ি চালাবে অল্পবয়সী মেয়ে। বুঝেছেন?
জি।
আছে-
সাবধানে থাকবেন। সাবধানে। সাবধানের কোনো ‘মাইর’ নাই। কথায়
বামে না ডানে
চল সাবধানে।
আপনার পিতা আমাকে বলেছেন আপনাকে সাবধান করে দিতে। সাবধান করে দিলাম।