০৪. কার্তিক মাসের শেষ

কার্তিক মাসের শেষ।

উত্তরের গারো পাহাড় থেকে শীতের হিমেল হাওয়া উড়ে আসতে শুরু করেছে। এবারের লক্ষণ ভালো না। মনে হয় ভালো শীত পড়বে। দু’বছর পরপর হাড় কাঁপানো শীত পড়ে। গত দু’বছর তেমন শীত পড়ে নি।

হরিচরণ চাদর গায়ে পুকুরপাড়ে এসে বসেছেন। তাঁর মন বেশ খারাপ। তিনি খবর পেয়েছেন ধনু শেখের দোতলা লঞ্চে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভেদবমি করতে করতে একজন মারা গেছে। বান্ধবপুরে কলেরা এসে ঢুকেছে। গ্রামের পর গ্রাম শূন্য করে দেয়া এই ব্যাধির কাছে মানুষ অসহায়। তিনি মনে মনে বললেন, দয়া কর দয়াময়। যেন দেবী ওলাউঠা লঞ্চে করে বান্ধবপুর না নামেন। তার প্রার্থনার সময় বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটল। তার দিঘিতে একজোড়া শীতের হাঁস নামল। শীতের পাখি নামে হাওরে, মনে হচ্ছে এই প্রথম কোনো দিঘিতে নামল। দিঘিও এমন কিছু বড় দিঘি না। এরা কি মনের ভুলে নেমে পড়েছে? নাকি কোনো কারণে দলছুট হয়েছে? দলছুট হবার সম্ভাবনাই বেশি।

দুটি হাঁসের একটি পানিতে স্থির হয়ে আছে। অন্যটি একটু পরপর ড়ুব দিচ্ছে। এদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ থাকলে জিজ্ঞেস করা যেত, ঘটনা কী?

হরিচরণ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। দুটা পাখিই ঘাটের কাছে। ভয় পেয়ে ওদের উড়ে যাওয়া উচিত, তা গেল না। সম্ভবত এরা মানুষ দেখে অভ্যস্ত না। মানুষ যে বিপদজনক প্রাণী এই তথ্য এখনো জানে না। হরিচরণ বললেন, তোদের সমস্যা কী রে? একটা হাঁস তার দিকে তাকাল। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ ক্লান্ত। রোগা শরীর। দুই থেকে আড়াই মাস এরা থাকবে। মোটাতাজা হয়ে দেশে ফিরে যাবে। একটা পাখি তার একজীবনে কতবার আসা যাওয়া করে এই তথ্য কি কেউ জানে? হরিচরণ ঠিক করে ফেললেন গদিতে পৌঁছেই পাখিবিষয়ক কোনো বইপত্র পাওয়া যায় কি-না জানতে চেয়ে কোলকাতায় চিঠি লিখবেন। ‘মানব বুক হাইস’ নামে একটা বইয়ের দোকানের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। তার প্রয়োজনীয় বইপত্র এরাই পাঠায়।

জুলেখা বাটিভর্তি খেজুরের রস নিয়ে এসেছে। নিজেদের গাছের রস। সে জ্বল দিয়ে ঘন করেছে। অপূর্ব ঘ্রাণ ছেড়েছে। খেজুরের রস খেজুরপাতা দিয়ে জ্বাল না দিলে ভালো ঘ্ৰাণ হয় না। জুলেখা খেজুরপাতা দিয়েই রস জ্বাল দিয়েছে।

জুলেখা লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, আপনার জন্যে খেজুরের রস আনছি।

ভালো করেছ। রস ভালো হয়েছে। সুঘ্ৰাণ ছেড়েছে। তাকিয়ে দেখ দিঘিতে দুটা হাঁস নেমেছে।

ও আল্লা। কী আচানক! আরো কি নামবে?

নামতে পারে। সব পশুপাখি নিজেদের ভেতর যোগাযোগ রাখে। এই দুটা পাখি হয়তো অন্যদের খবর দিবে। আমি ঠিক করেছি আজ আর গদিতে যাব না। ঘাটে বসে থাকব। দেখি আরো পাখি নামে কি-না।

জুলেখা মুখে আঁচল চাপা দিতে দিতে বলল, বাবা, আপনি আজব মানুষ।

হরিচরণ বললেন, আমরা সবাই আজব মানুষ। তুমি আজব, তোমার ছেলে আজব, তোমার স্বামী আজব। ঈশ্বর নিজে আজব, সেই কারণে তিনি আজব জিনিস তৈরি করতে পছন্দ করেন। রসের বাটিটা দাও, এক চুমুকে খেয়ে ফেলি।

জুলেখা বিস্মিত হয়ে বলল, এতটা রস একসঙ্গে খাবেন?

কোনো অসুবিধা নাই, দুপুরে ভাত খাব না।

হরিচরণ তৃপ্তি করে বাটিভর্তি ঘন খেজুরের রস শেষ করলেন। পুকুরের পানিতে ঠোঁট ধুতে ধুতে বললেন, মা, তুমি নানান সময়ে নানান ভাবে আমার সেবা করছি। তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। কী পেলে তুমি খুশি হবে?

জুলেখা জবাব দিল না। যদিও তার ইচ্ছা করছে বলে, আমাকে একটা কলের গান কিনে দেন। এই যন্ত্রটার জন্যে আমি আমার জীবন দিয়ে দিতে রাজি। কী অদ্ভুত জিনিস! পিতলের এক চোঙ। চোঙের ভেতর দিয়ে আসে কী সুন্দর গান। একটা গান ইচ্ছা করলে দশবার শোনা যাবে। সুরে ভুল হবে না। তালে ভুল হবে না। বাজনায় ভুল হবে না। কী আজব যন্ত্ৰ! ইশ সে যদি তার বাপজানকে যন্ত্রটা দেখাতে পারত!

হরিচরণ বললেন, তোমার মনের মধ্যে কিছু আছে, বলে ফেল।

জুলেখা বলল, মনের মধ্যে কিছু নাই। বলতে বলতে সে হরিচরণের পাশে বসল। হরিচরণ বললেন, এই হাঁসের একটা নাম আছে, সেটা জানো?

জুলেখা বলল, না। এর নাম ‘দেশান্তরী পাখি’। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায়, এই জন্যেই দেশান্তরী।

জুলেখার মনে হলো— কী সুন্দর নাম! দেশান্তরী। পাখিদের মতো দেশান্তরী মানুষও তো আছে যাদের কাজ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া। তার নিজের বাবাও তো দেশান্তরী। জুলেখার ইচ্ছা করছে দেশান্তরী দিয়ে একটা গান লেখে। প্রথম লাইন—

দেশান্তরী বান্ধই গো, কোন দেশেতে যাও?

পরের লাইনটা মাথায় আসছে না। সে যদি লেখাপড়া জানত এই লাইনটা লিখে রাখত। লেখাপড়া শেখা খুব কি জটিল? সে কোরান মজিদ পাঠ করতে পারে। লিখতে পারে না।

হরিচরণ বললেন, জুলেখা, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও? বলতে চাইলে বলো।

জুলেখা মাথা নিচু করে বলল, আমি বাংলা লেখা বাংলা পড়া শিখতে চাই।

হরিচরণ বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকা তরুণীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি নিজে তোমাকে শেখাব। তুমি তোমার স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাখবে। মুসলমানদের মধ্যে এই বিষয়টা দেখেছি। তারা স্ত্রীদের লেখাপড়া পছন্দ করে না।

জুলেখা বলল, স্ত্রী লেখাপড়া শিখলে স্বামীর হায়াত কমে, এইজন্যে পছন্দ করে না।

এইসব তো ভুল কথা।

সবাই জানে ভুল কথা, তারপরও ভুল কথাই মানে।

তুমি সুলেমানকে আমার কাছে পাঠাবা, আমি তারে বুঝায় বলব।

সে দেশে নাই। মৈমনসিং গেছে কমে। ফিরতে একমাস লাগব। আমি কি এর মধ্যে শিখতে পারব না?

হরিচরণ কিছুক্ষণ জুলেখার দিকে তাকিয়ে বললেন, অবশ্যই পারবা। বলো—অ।

জুলেখা বলল, অ।

এখন বলো, আ।

জুলেখা বলল, আ।

এক টুকরা কয়লা আনা। আমি অক্ষর দুইটা লিখব। আজ সন্ধ্যায় তোমার জন্যে বাল্যশিক্ষা কিনে আনব।

জুলেখা এক টুকরো কয়লা এনেছে। শ্বেতপাথরে সেই কয়লার দাগ বসছে না। হরিচরণ উঠে দাঁড়ালেন। ঘাটে বসে থাকার পরিকল্পনা তিনি বাদ দিয়েছেন। তিনি বাজারে যাবেন। মেয়েটার জন্যে প্লেট পেন্সিল কিনবেন। বাল্যশিক্ষা কিনবেন।

হরিচরণ ঘাট থেকে যাবার কিছুক্ষণ পরই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। দিঘিতে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস নামতে শুরু করল। দেখতে দেখতে দিঘি হাঁসে পূর্ণ হলো। অদ্ভুত দৃশ্য। যেন দিঘিতে হাঁসের সর পড়েছে। সেই সার উঠানামা করছে। হাঁসদের কারণে দিঘি থেকে হোঁ হোঁ হোঁ, জাতীয় গম্ভীর ধ্বনি উঠছে।

একই সময় বাবু মনিশংকরের বাড়ি থেকে অসময়ে শাখের শব্দ হতে লাগল। মনিশংকরের এক জেঠির ভেদ বমি শুরু হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে দেবী ওলাউঠার দয়া। দেবীকে দূর করার জন্যেই শঙ্খধ্বনি। অদ্ভুত শব্দ আসছে শঙ্খ থেকেও। ভোঁ ভোঁ ভোঁ। যেন দূর থেকে লঞ্চ ভোঁ দিচ্ছে। শঙ্খের শব্দের সঙ্গে হাসের শব্দ মিলে একাকার হয়ে গেল।

 

সুলেমানের স্ত্রী জুলেখা আয়োজন করে পায়ে আলতা দিচ্ছে। সে বসেছে বেতের মোড়ায়। তার পা জলচৌকিতে রাখা। পাটকাঠির মাথা কলমের নিচের মতো কেটে তুলি বানানো হয়েছে। জহির মুগ্ধ চোখে মা’র পায়ের শিল্পকর্ম দেখছে। একটু দূরে ছোট ধামা ভর্তি মুড়ি এবং খেজুর গুড় নিয়ে বসেছে সুলেমান। সে তিন দিন হলো ফিরেছে। স্ত্রীর জন্যে। কচুয়া রঙের একটা শাড়ি এনেছে। এই বিষয়ে স্ত্রীর কোনো উৎসাহ নেই দেখে আহত হয়েছে। জুলেখা সেই শাড়ির ভাজ এখনো খুলে নি। নতুন শাড়ি পেয়ে কদমবুসি করা প্রয়োজন, তাও করে নি। তার পুত্র জহির মুড়ি খাওয়া বাদ দিয়ে মায়ের সাজ দেখছে, এতেও সুলেমান মহা বিরক্ত। আজ জুম্মাবার। জুম্মাবারে এত সাজসজ্জা কী?

সুলেমান জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ পুলা, মুড়ি খাইয়া যা।

জহির মা’র দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই গম্ভীর গলায় বলল, না।

জুলেখা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, পাও আলতা দিতে ইচ্ছা করে?

জহির সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার ছোট্ট পা জলচৌকিতে তুলে দিল। জুলেখা ছেলের পায়ে লাল টুকটুকে একটা মাছ। এঁকে দিল। জহিরের মুখভর্তি হাসি।

রাগে সুলেমানের শরীর জুলে যাচ্ছে। ছেলেকে নিয়ে সে জুম্মার নামাজ পড়তে যাবে, এর মধ্যে পায়ে আলতা! তার উচিত ছেলের গালে শক্ত করে একটা চড় দেয়া। এটা সে করতে পারছে না। জহিরের শরীর ভালো না। কালরাতেও জ্বর ছিল। এখনো হয়তো আছে।

সুলেমান বলল, সক্কালবেলা আলতা নিয়া বসিলা। কাজটা উচিত হয়েছে?

জুলেখা বলল, সক্কালে আলতা দেওয়া যাবে না। এমন কথা কি হাদিস কোরানে আছে?

এইটা কেমন কথা? তোমার উপরে কি জিন ভূতের আছর হইছে? জিন ভূতের আছর হইলে মেয়েছেলে স্বামীর মুখের উপরে ফড়িফড় করে। জঙ্গলায় ঘুরে। সময় অসময়ে গীত ধরে।

জুলেখা জবাব না দিয়ে ছেলের অন্যপায়ে আরেকটা মাছ আঁকছে। সুলেমান বলল, পুরুষ মাইনষের পাও আলতা দিতাছ?

জুলেখা বলল, জহির পুলাপান। পুলাপানের পায়ে আলতা দিলে দোষ হয় না।

এই কথা কোন বুজুর্গ আলেম তোমারে বলেছে?

জুলেখা জবাব দিল না। স্বামীর বেশিরভাগ প্রশ্নেরই সে জবাব দেয় না।

সুলেমান বলল, জহিররে নিয়া জুম্মার নামাজ পড়তে যাব। তখন যদি পাও রাঙা থাকে–

জুলেখা ফিক করে হেসে ফেলল।

সুলেমান বলল, হাসলা যে? কী কারণে হাসলা?

জুলেখা বলল, কী কারণে হাসছি আপনেরে বলব না।

জুলেখা হাসছে কারণ সে তার স্বামীকে ভালো ফাঁকি দিয়েছে। তাকে না। জানিয়ে লেখাপড়া শিখে ফেলেছে। যে-কোনো লেখা সে এখন পড়তে পারে।

সুলেমান বলল, তুই অবশ্যি বলবি।

তুই তোকারি কইরেন না।

সুলেমান কঠিন গলায় বলল, আগে বল তুই হাসলি কী জন্যে? হাসির কথা কী হইছে?

জুলেখা কিছুই বলল না, নিজের মনে পায়ে আলতা দিতে লাগল। সুলেমান মুড়ি খাওয়া বন্ধ করে উঠে এলো। প্রথমে ভেবেছিল স্ত্রীর গালে কষে থাপ্লড় দিবে। বেয়াদব স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার সব স্বামীর আছে। মাওলানা সাহেব বলেছেন আল্লাহপাক পুরুষ মানুষরে এই অধিকার দিয়েছেন। কারণ পুরুষের অবস্থান নারীর উপরে। তবে শাসনের সময় খেয়াল রাখতে হবে স্ত্রীর মুখমণ্ডলে যেন মারের চিহ্ন না থাকে। সুলেমান থাপ্পড় উঠিয়ে এগিয়ে এলেও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলাল। থাপ্পড় দেবার বদলে আলতার শিশি উঠানে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

জুলেখার একপায়ে আলতা দেয়া হয়েছে। অন্য পা খালি। আবার কবে আলতা কেনা হবে, কবে পায়ে দেয়া হবে কে জানে! বেদেবহর নৌকা করে এখনো আসে নি। তারা চলে এলে সমস্যা নেই। গাইন বেটির ঝুড়ি ভর্তি করে কাচের চুড়ি, আলতা, গন্ধতেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে। বাহারি জিনিস বেচবে। একইসঙ্গে কাইক্যা মাছের কাটা দিয়ে শরীরের বন্দ রক্ত দূর করবে। গাইন বেটিদের কাছ থেকে শখের জিনিসপত্র কেনার জন্যে এবং বাদ রক্ত বের করার জন্যে সব মেয়েই টাকা-পয়সা জমিয়ে রাখে। জুলেখারও জমা টাকা আছে।

সুলেমান বলল, ঝিম ধইরা বইসা থাকবা না। ছেলের পাওয়ের আলতা ঘইসা তোলা। আইজ জুম্মাবার। নামাজে যাব। ছেলেরে ঘাটে নিয়ে যাও। রিঠা গাছের পাতা দিয়া ডলা দাও।

জুলেখা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ছেলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছেলের দুই পায়ে দুই মাছ। কী সুন্দরই না দেখাচ্ছে মাছ দুটা! এই সুন্দর দুটা মাছ তুলে ফেলতে হবে? কাজটা বড়ই কঠিন। সুন্দর নষ্ট করা যায় না। সুন্দর নষ্ট করলে পাপ হয়। এই কথা তার ব্যাপজান তাকে বলেছিলেন।

পুকুরঘাটে পা ড়ুবিয়ে জহির বসেছে। জুলেখা তার সামনে। জুলেখার হাতে গায়ে মাখা গন্ধ সাবান। এই সাবান গত বছর গাইনবেটিদের কাছ থেকে কেনা, গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখা। সুলেমান এত দামের সাবান দেখতে পেলে রাগবে।

জহির বলল, মা গীত কর।

কোন গীত?

পাও ধুয়ানি গীত।

জুলেখা সঙ্গে সঙ্গে গাইল—

সোনার পায়ে সোনার মাছ
বিলমিল বিলমিল করে।
এই মাছেরে দিয়ে আসব
দক্ষিণ সায়রে।

গানের কথাগুলি জুলেখা এখনই তৈরি করল। তার এত ভালো লাগল। তার বাপজানের গুণ কি তার মধ্যে আছে? কোনোদিন কি সে তার ব্যাপজানের মতো মুখে মুখে গান বাঁধতে পারবে?

 

মাওলানা ইদরিস খুতবা পাঠ শেষ করলেন। মুসুল্লিদের দিকে তাকালেন। মাত্র নয়জন। তাঁর হিসেবে আরো বেশি হবার কথা। কাঠমিন্ত্রি সুলেমান তার পুত্ৰকে নিয়ে এসেছে। এটা ভালো। সুলেমান সবসময় আসে না। মাঝেমধ্যে একা আসে, ছেলেকে আনে না। শিশুদের শুরু থেকেই ধর্মকর্মে আগ্রহী করা পিতামাতার কর্তব্য। যে পিতা-মাতা এই কর্তব্যে অবহেলা করবেন। রোজ হাশরে তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির বিধান আছে।

মাওলানা বললেন, আপনাদের জন্য সামান্য শিন্নির ব্যবস্থা আছে।

মাওলানা শিন্নির হাঁড়ি এবং চামচ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মুসুল্লিরা কলাপাতা হাতে নিলেন। নবিজি মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন। নবিজির পছন্দের জিনিস করা তার উম্মতের জন্যে সোয়াবের কাজ।

শিন্নি মাওলানা নিজেই তাঁর বাড়িতে প্ৰস্তুত করেছেন। দুধ, আলোচল, গুড়, সঙ্গে কিছু কিশমিশ এবং তেজপাতা। খাঁটি দুধ। দীর্ঘসময় জ্বাল হয়ে অপূর্ব স্বাদু বস্তু তৈরি হয়েছে। সবাই আগ্রহ করে খাচ্ছে। মাওলানা দ্বিতীয়বার শিন্নি দিতে দিতে বললেন, আল্লাহপাক আমার উপর বড় একটা দয়া করেছেন বলেই এই শিন্নির ব্যবস্থা। আপনারা আমার জন্যে আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করবেন। সবাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কেউ জানতে চাইল না— বড় দয়াটা কী?

মাওলানা নিজেই খোলাসা করলেন। তিনি কোরান মজিদ পুরোটা মুখস্থ করেছেন। এখন তাকে কোনো আলেম হাফেজের কাছে যেতে হবে। তাকে কোরানমজিদ মুখস্থ শোনাতে হবে। হাফেজ সাহেব যদি বলেন ঠিক আছে, তাহলে নামের শুরুতে তিনি হাফেজ টাইটেল ব্যবহার করবেন। তার টাইটেল হবে হাফেজ মাওলানা ইদরিস।

জীবনের একটা আকাঙ্ক্ষাই তখন অপূর্ণ থাকবে- নবিজির মাজার জেয়ারত। হজ্ব তাঁর জন্যে ফরজ না। তিনি বিত্তহীন সামান্য মাওলানা। হজে তাঁর না গেলেও হবে, কিন্তু নবিজির মাজার জেয়ারত করা তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। তিনি নবিজির মাজারের কাছে যাবেন, দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে বলবেন, হে জগতের আলো, পেয়ারা নবি! আসসালামু আলায়কুম। আমি আল্লাহপাকের নাদান বান্দা গুনাগার ইদরিস। যে পাক কোরান। আপনার মাধ্যমে দুনিয়াতে এসেছে সেই পাক কোরান। আমি মুখস্ত করেছি। আমার দিলের একটা খায়েশ আপনেরে কোরান মজিদ আবৃত্তি করে শোনাব। যদি অনুমতি দেন।

 

জুমার নামাজ শেষ করে মাওলানা নিজের ঘরে ফিরেছেন। আজকের দিনটি স্মরণে যেন থাকে। এইজন্যে বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা লিচুগাছের চারা লাগালেন। গাছ বড় হবে’। একসময় ফল আসবে। নবিজি গাছ রোপণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। একবার এক হত্যাঅপরাধীর মৃত্যুদণ্ড রদ করে গাছ রোপণের দণ্ড দিয়েছিলেন। তার শাস্তি হয়েছিল সে একশ’ খেজুর গাছ লাগবে এবং প্রতিটি গাছকে সেবাযত্নে ফলবতী করবে।

এই অঞ্চলে লিচুগাছ নেই। হিন্দুবাড়িতেও নেই, মুসলমান বাড়িতেও নেই। লোকজ বিশ্বাস— বসতবাড়ির আশেপাশে লিচুগাছ লাগানো যাবে না। লিচুগাছ মানুষকে নির্বংশ করে।

মাওলানার চালাঘরটা সুন্দর। উঠানে একটা পাতা পড়ে নেই। দু’বেলা এই উঠান মাওলানা নিজে ঝাঁট দেন। সপ্তাহে একদিন গোবর-মাটির মিশ্রণ লেপে দেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর ইসলাম ধর্মে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

লিচুগাছ লাগানোর পরপরই মাওলানা অনুভব করলেন তাঁর জ্বর আসছে। শরীর কেমন যেন করছে। গা গুলাচ্ছে। বমি আসছে। আজকের দিনের অতিরিক্ত উত্তেজনায় কি এমন হচ্ছে? মাওলানা ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন। দীর্ঘ কয়েক বছর পর আজ প্রথম তাঁর আসরের নামাজ কাজা হলো। মাগরেবের নামাজ কাজা হলো। বমি করে তিনি ঘর নষ্ট করলেন, নিজের পায়জামা-পাঞ্জাবি নষ্ট করলেন।

একজন কোরানে হাফেজ অপবিত্র থাকতে পারেন না। তাকে সবসময় অজুর মধ্যে থাকতে হবে। কারণ তাঁর শরীরে পবিত্র কোরান মজিদ। তিনি জ্বর গায়েই গোসল করলেন। ধোয়া পায়জামা-পাঞ্জাবি পরলেন।

 

সুলেমানের বাড়ি অন্ধকার। সন্ধ্যার পরপর বাড়িতে আলো দিতে হয়। সন্ধ্যায় আলো না দিলে বসতবাড়িতে ভূত-প্ৰেত ঢোকে। খারাপ বাতাস কপাটের পেছনে স্থায়ী হয়ে যায়। সুলেমানের স্ত্রী জুলেখা বাড়ির পেছনের উঠানের জলচৌকিতে বসে আছে। তার হাতের কাছে কুপি, সে এখনো কুপি ধরায় নি। সন্ধ্যা থেকে কাদছিল, এখন কান্না বন্ধ। গালে পানির দাগ বসে গেছে। আজ তাকে কঠিন শাস্তির ভেতর দিয়ে যেতে হবে তা সে জানে। শাস্তি কী হবে জানে না বলেই অশান্তি।

আজ সে অপরাধও করেছে গুরুতর। দুপুরে যখন ঘরে কেউ ছিল না। (সুলেমান গেছে হাটে। তার পুত্ৰ গেছে হরিচরণের বাড়িতে হাতি দেখতে।) তখন সে বাড়ির পেছনের পুকুরে গোসল করতে গেল। পুকুর ঠিক না, বড়সড় ডোবা। বর্ষায় পানি হয়। সুলেমান কাঠের কয়েকটা গুড়ি ফেলে ঘাটের মতো করে দিয়েছে। ডোবার চারদিকেই ঘন জঙ্গল। আরু রক্ষার আলাদা ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। জুলেখা গোসল করতে ঘাটে গেল। পানিতে নামল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। গায়ে কোনো কাপড় ছাড়া পানিতে ভেসে থাকার অন্যরকম আনন্দ। কেউ তো আর দেখছে না।

জুলেখা অতি রূপবতীদের একজন। আজ তাকে আরো সুন্দর লাগছে। শঙ্খর মতো শাদা গা থেকে অলো ঠিকরে আসছে। খাড়া নাক আজ অনেক তীক্ষ্ণ লাগছে। বড় বড় চোখ। ছায়াদায়িনী দীর্ঘ পল্লব যেন আরো গাঢ় হয়েছে। পান না খেয়েও ঠোঁট লাল। মাথার চুল ঈষৎ পিঙ্গল। সেই চুল নেমে এসেছে হাঁটু পর্যন্ত।

বাড়ির সীমানার বাইরে যাওয়া জুলেখার নিষেধ। বাপের দেশে নাইয়র যাওয়াও নিষেধ। বিয়ের পর সে একবার মাত্র তিনদিনের জন্যে বাপের দেশে যাবার সুযোগ পেয়েছিল। যেতে হয়েছে বোরকা পরে। সুলেমান কঠিন নিষেধ করে দিয়েছিল, পুরুষ আত্মীয়ের সামনেও বোরকার মুখ খোলা যাবে না। বাবা এবং ভাইদের সামনে খোলা যেত। জুলেখার বাবা কোথায় কেউ জানে না। ভাই যারা তারা সৎ মায়ের গর্ভের, কাজেই বোরকার মুখ খোলার প্রয়োজন পড়ছে না।

হাট থেকে সুলেমান ফেরে সন্ধ্যায়। সেদিন কোনো কারণে বা ইচ্ছা করেই সে হাটে না গিয়ে দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরল। বসত বাড়ির সদর দরজা দিয়ে সাড়াশব্দ করে না। ঢুকে ঢুকল বাড়ির পেছন দিয়ে। চুপি চুপি ঘাটলার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। কী দেখছে সে! জুলেখা সাঁতার কাটছে। চোখ বন্ধ করে চিৎ সাতার দিচ্ছে। তার নগ্ন শরীরের পুরোটাই পানির উপর ভাসছে। গুনগুন শব্দও আসছে। গান করছে না-কি! সুলেমান চাপা গর্জন করল— এই বান্দি! তুই করস কী?

মুহুর্তের মধ্যে জুলেখা পানিতে ড়ুব দিল। মানবী জলকন্যা না, দীর্ঘ সময় সে জলে ড়ুবে থাকতে পারে না। জুলেখাকে ভেসে উঠতে হলো। সে অতি দ্রুত গায়ে কাপড় জড়াল। আতঙ্কে অস্থির হয়ে সে তাকাল সুলেমানের দিকে।

সুলেমান বলল, কারে শরীর দেখানোর জন্যে নেংটা হইছস?

জুলেখা বলল, কাউরে দেখানোর জন্যে না।

সুলেমান বলল, মিথ্যা বইল্যা আইজ পার পাবি না। অবশ্যই কেউ আছে। তারে খবর দেয়া আছে। সে জংলার কোনো চিপায় আছে। তার নাম বল।

এমন কেউ নাই।

মুরগি যেমন জবেহ করে তোর গলা সেই মতো কাটব। নাম বল। তুই তো কারণে অকারণে ঐ হিন্দুর বাড়িতে বইসা থাকাস। তার ঘর ঠিক করাস। উঠান ঝাড় দেস। তার সাথে তোর কী?

উনারে আমি বাবা ডেকেছি। উনার বিষয়ে কিছু বলবেন না।

মালাউন হইছে তোর বাবা? আমারে বাবা শিখাস?

জুলেখা চুপ করে গেল। রাগে উন্মাদ একজন মানুষের সঙ্গে যুক্তি তর্ক করা অর্থহীন। সুলেমান দা হাতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাটে বসে রইল। দু’জন মুখোমুখি বসা। জহির এখনো ফিরে নি। এটা ভালো। হরিবাবুর বাড়িতে আরো কিছুক্ষণ থাকুক। হাতি দেখবে। খেলবে। রাতে তাকে নিয়ে আসবে। সবচে’ ভালো হয় রাতে ছেলে ঐ বাড়িতে যদি থেকে যায়। এখানে কী ঘটনা ঘটবে কিছুই বলা যায় না। খুন খারাবিও হয়ে যেতে পারে। পুলাপানদের এইসব দেখা ঠিক না।

সুলেমান ফিরল বিছুটি পাতার বড় একটা ঝাড় হাতে নিয়ে। তার মুখভঙ্গি শান্ত। রাগের প্রথম ঝড় পার হয়েছে। প্রথম ঝড়ের পর দ্বিতীয় ঝড় আসতে কিছু সময় নেয়। সুলেমান কুপি জ্বলিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, নেংটা হইতে তোর মজা লাগে। এখন নেংটা হা।

জুলেখা বলল, না।

সুলেমান বলল, কোনো কথা না। যা করতে বললাম করবি। শাড়ি খোল।

না।

আবার বলে না! এক্ষণ খুলিবি। তোর নেংটা হওনের স্বাদ জন্মের মতো মিটায়ে দিব। শাড়ি খোল।

জুলেখা শাড়ি খুলল। সুলেমান বিছুটি পাতার বাড়ি শুরু করল। দু’হাতে মুখ ঢেকে জুলেখা পশুর মতো গোঙাতে শুরু করল। তার শরীর ফুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। জায়গায় জায়গায় কেটে রক্ত বের হচ্ছে। ফর্সা শরীর হয়েছে ঘন লাল। বিষাক্ত বিছুটি পাতার জুলুনিতে জায়গায় জায়গায় চামড়া জমে গেছে। জুলেখার মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। দুটা চোখই টকটকে লাল।

সুলেমান বিছুটি পাতার ঝাড় ফেলে দিয়ে বলল, শাস্তি শেষ, এখন শাড়ি পর।

জুলেখা পশুর মতো গোঙাতে গোঙাতে বলল, শাড়ি পরব না। এই বাড়িতে আমি যতদিন থাকব নেংটা থাকব।

সুলেমান বলল, কী বললি?

জুলেখা বলল, কী বলেছি আপনি শুনেছেন। আমি বাকি জীবন এই বাড়িতে নেংটা ঘুরাফেরা করব।

সুলেমান বলল, জহিররে আনতে যাইতেছি। কাপড় পর। ঠাণ্ডা মাথায় কইরা দেখ—আমার জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ হইলে শাস্তি আরো বেশি হইত।

সুলেমান ছেলেকে নিয়ে রাত ন’টার দিকে ফিরল। দরজায় খিল দেয়া। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর খিল খুলল। জুলেখা কাপড় পরে নি। সে সম্পূর্ণ নগ্ন। এক হাতে কেরোসিনের কুপি নিয়ে সে স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুই হয় নি।

সুলেমান স্ত্রীর হাত থেকে কুপি নিয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। এমন দৃশ্য ছেলের দেখা ঠিক না। জহির কাঁদতে শুরু করল।

সুলেমান চাপা গলায় বলল, তুই নেংটা থাকবি?

হুঁ।

তোরে তো জিনে ধরেছে।

ধরলে ধরেছে।

আমার ঘরে তোর জায়গা নাই।

না থাকলে চইল্যা যাব।

তোরে তালাক দিলাম। তালাক। তালাক। তালাক। এখন ঘর থাইকা যাবি। নেংটা অবস্থায় যাবি।

জুলেখা স্বাভাবিক গলায় বলল, আচ্ছা।

 

মাওলানা ইদরিসের জ্বর আরো বেড়েছে। শরীর এবং হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আরেকবার বমি আসছে। দ্বিতীয়বার বিছানা নষ্ট করা কোনো কাজের কথা না। তিনি অনেক কষ্টে হারিকেন হাতে দরজা খুলে বারান্দায় এসে খুঁটি ধরে বসলেন। শরীর উল্টে বমি আসছে, তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন। মনে হচ্ছে তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন এবং আজ রাত্রিতেই তাঁর মৃত্যু হবে।

শরীরের এই অবস্থায় তাঁর মনে হলো, অতি রূপবতী এক নগ্ন তরুণী। উঠানের কাঁঠাল গাছের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। শয়তান তাকে ধান্ধা দেখাতে শুরু করেছে। মৃত্যুর সময় তিনি যাতে আল্লাহখোদার নাম নিতে না পারেন শয়তান সেই ব্যবস্থা করেছে। পরীর মতো এক মেয়ের রূপ ধরে এসেছে।

মাওলানা ইদরিস বললেন, হে আল্লাহপাক, তুমি আমাকে শয়তানের ধোকা থেকে রক্ষা কর। তিনি আয়াতুল কুরসি পাঠ শুরু করলেন। তাঁর দৃষ্টি কাঁঠাল গাছের দিকে। মেয়েটা এখনো আছে। মাওলানা ভীত গলায় বললেন, তুই কে?

নগ্ন মেয়ে কাঁঠাল গাছের আড়ালে চলে গেল।

মাওলানা বললেন, ইবলিশ দূর হ। তোকে আল্লাহর দোহাই লাগে তুই দূর হ। দূর হ কইলাম।

মেয়েটা দূর হলো না। কাঁঠাল গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। মাওলানা জ্ঞান হারালেন।

গভীর রাতে তার জ্ঞান ফিরল। তিনি বারান্দাতেই শুয়ে আছেন। তবে তার গায়ে চান্দর। মাথার নিচে বালিশ। তারচেয়ে আশ্চর্য কথা, শয়তানরূপী মেয়েটা আছে। হারিকেন হাতে তাঁর পাশেই গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তার গায়ে বিছানার চাদর জড়ানো।

মাওলানা ভীত গলায় বললেন, তুমি কে?

মেয়েটা জবাব দিল না। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল।

মাওলানা দৃষ্টি ফেরাতে পারলেন না। কী সুন্দরই না মেয়েটার মুখ! বেহেশতের হুরদের যে বর্ণনা আছে। এই মেয়ে সে-রকম। মাওলানা আবারো বললেন, তুমি কে?

মেয়েটা বলল, আমি জুলেখা।

মাওলানা বিড়বিড় করে বললেন, জুলেখা। জুলেখা। জুলেখা। কোরান মজিদে জুলেখার কথা উল্লেখ না থাকলেও তাঁর স্বামী নবি ইউসুফের কথা অনেকবার বলা হয়েছে।

মেয়েটা বলল, আপনের কলেরা হয়েছে।

মাওলানা বললেন, জুলেখা, পানি খাব।

জুলেখা বলল, কলেরা রোগীরে পানি দেওয়া যায় না। পানি খাইলে রোগ বাড়ে।

মাওলানা বললেন, পানি খাব। জুলেখা পানি খাব।

জুলেখা ঘরে ঢুকে গেল। মাওলানার মনে হলো, শয়তান তাকে নিয়ে যে খেলা দেখাচ্ছিল সেই খেলার অবসান হয়েছে। মেয়েটা ফিরবে না।

মেয়েটা কিন্তু ফিরল। হাতে কাসার গ্রাস নিয়ে ফিরল। মাওলানা আবার বমি করতে শুরু করলেন। জুলেখা তাকে এসে ধরল। মাওলানা বললেন, তুমি কে গো?

জুলেখা জবাব দিল না।

বাজারের দিক থেকে কাসার ঘণ্টা বাজার শব্দ শুরু হয়েছে। খুব হৈচৈ হচ্ছে। কেউ একজন মারা গেছে কলেরায়। ঘণ্টা বাজিয়ে ওলাউঠা দেবীকে দূরে সরানোর চেষ্টা। দেবী একবার যখন এসেছেন এত সহজে যাবেন না। তিনি এসেছেন মায়ের বাড়ির দেশে।

 

ওলাউঠা দেবী কোনো সহজ দেবী না। বড়ই কঠিন দেবী। তিনি যখন দেখা দেন অঞ্চলের পর অঞ্চল শেষ করে দেন। শীতলা দেবীর মতো তিনি তার চেহারা দেখান না। তিনি ঘোমটায় মুখ আড়াল করে হাঁটেন। হৈচৈ পছন্দ করেন না। ধূপ ধোনার গন্ধ পছন্দ করেন না। তাঁর সবচেয়ে অপছন্দ নদী। শীতলা দেবী যেমন অনায়াসে নদীর পানির উপর দিয়ে হেঁটে চলে যান, তিনি তা পারেন না। তাকে খেয়ামাঝির সাহায্য নিয়ে নদী পারাপার করতে হয়।

ওলাদেবীর হাত থেকে বান্ধবপুরের হিন্দুদের রক্ষার জন্যে বীটকালীর মন্দিরে কালীপূজা দেয়া হয়েছে। পাঠা বলি হয়েছে। মাটির হাড়িতে পশুর রক্ত সংগ্ৰহ করা হয়েছে। সেই রক্ত দিয়ে সবাই ভক্তিভরে কপালে ফোঁটা দিয়েছে। কপালে যতক্ষণ এই রক্ত থাকবে ততক্ষণ ওলাউঠা দেবী কাছে ভিড়বে না। তিনি পূজার পশুর রক্ত পছন্দ করেন না। মন্ত্রপূত একটা কালো ছাগলের গলা সামান্য কেটে ছেড়া দেয়া হলো। যন্ত্রণাকাতর এই পশু যেদিকে যাবে তার পেছনে পেছনে যাবেন ওলাদেবী। ছাগল যদি ভিন্ন গ্রামে গিয়ে মরে যায় দেবীকে সেখানেই থাকতে হবে। এই ছাগলটা প্রথমে ছুটে গ্রাম সীমানার বাইরে গিয়েও কী মনে করে আবার ফিরে এলো। মারা গেল বাজারের মাঝখানে।

ওলাদেবীকে দূর করার জন্যে মুসলমানরাও কম চেষ্টা চালাল না। তারা গায়ে আতর মেখে ধূপকাঠি হাতে বের হলো। ওলাদেবী তাড়ানোর মুসলমানী মন্ত্র একটু ভিন্ন। দলের প্রধান বলেন—

বলা দূর যাওরে
আলী জুলফিকার
এই গেরাম ছাড়িয়া যাও
দোহাই আল্লাহর।

দলের প্রধানের বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র বাকি সবাই বুক থাপড়ে জিগির ধরে –

হক নাম, পাক নাম
নাম আল্লাহর হু।
আল্লাহর নূরে নবী পয়দা
হু আল্লাহ হু।।

হরিচরণ খুব চেষ্টা করলেন ভয়াবহ এই দুর্যোগে কিছু করার জন্যে। কোনো হিন্দুবাড়িতে তিনি ঢুকতে পারলেন না। এই সময়েও জাত অজাত কাজ করতে লাগল। ওলাদেবী কিন্তু জাতিভেদ করলেন না। তিনি শূদ্রের ঘরে যেমন উপস্থিত হলেন, ব্ৰাহ্মণের ঘরেও গেলেন। দেখা গেল তার কাছে সবই সমান। ঝাপ দিয়ে পড়ল। শশী মাস্টার। যেখানেই রোগী সেখানেই তিনি। অতি আদরে রোগীর শুশ্রুষা করছেন। ডাবের পানি খাওয়াচ্ছেন। কোলে করে রোগীকে ঘর থেকে বের করছেন, আবার উঠান থেকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন।

রোগের প্রকোপ সবচে’ বেশি জেলেপল্লীতে। শশী মাস্টার সেখানে উপস্থিত হতেই একজন জোড়হস্ত হয়ে বলল, বাবু আমার নামশূদ্র। আপনি ব্ৰাহ্মণ, আমাদের এখানে ঢুকবেন না।

শশী মাস্টার বললেন, কিছুদিনের জন্যে আমিও নমশূদ্র। এখন ঠিক আছে?

ওলাদেবীকে আটকানোর জন্যে প্রথম খেয়া পারাপার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বান্ধবপুরের মুরুব্বিারা পরে চিন্তাভাবনা করে ঠিক করল, খেয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্তটা ভুল। তাদের উচিত ওলাদেবীকে নদী পার করে দেয়া। দেবীর বিদায় মানেই রাহুমুক্তি। খেয়া বন্ধ করে দেবীকে আটকে রাখার অর্থ বিপদ মাথায় নেয়া।

দেবী দিনে চলাফেরা করেন না। উনার হাঁটাচলা সূর্য ডোবার পর। বড়গাঙে সন্ধ্যার পর খেয়া চলাচলের ব্যবস্থা নেয়া হলো। খেয়া পারাপার করবে শেখ মার্দ। অতি সাহসী মানুষ। তাকে বলে দেয়া হলো, ঘোমটায় মুখ ঢাকা কেউ যদি উঠে তাকে পার করতে হবে। তার সঙ্গে কোনো কথা বলা চলবে না। পারানি চাওয়া যাবে না। দেবী যেন নৌকায় উঠেন। সেই ব্যবস্থাও করা হলো। বান্ধবপুরে সন্ধ্যার পর থেকে কাসার ঘণ্টা বাজে, ঢোল খোল করতাল বাজে। মশাল হাতে লোকজন ছোটাছুটি করে।

এমন অবস্থায় রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে ঘোমটায় মুখ ঢেকে কেউ একজন শেখ মৰ্দর নৌকার পাশে এসে দাঁড়াল। অসীম সাহসী শেখ মর্দর বুক কেঁপে উঠল। সে কোনো কথা না বলে নৌকা ছাড়ল।

আকাশে মেঘ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘোমটা পরা তরুণী দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণীর নাম জুলেখা। একসময় সে অস্ফুট স্বরে বলল, কী সৌন্দর্য গো! কী সৌন্দর্য

ঠিক একই সময় জুলেখার বয়সি একটা মেয়েও জাহাজে করে আটলান্টিক পার হচ্ছিল। সে একা একা জাহাজের ডেকে বসেছিল। সেও মহাসাগরের শোভা দেখে জুলেখার মতোই মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছিল— কী সুন্দর! কী সুন্দর!

মেয়েটি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মাদাম কুরি। তিনি রেডিও অ্যাকটিভিটি আবিষ্কার করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ট্রাষ্টের আমন্ত্রণে বেড়াতে যাচ্ছেন আমেরিকায়।

আমাদের জুলেখার সেই বৎসর স্থান হলো কেন্দুয়ার বিখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীতে। স্থানীয় ভাষায় যার নাম রঙিলা নটিবাড়ি’।

————-

Encyclopedia Britanica’র প্রাচীন সংস্করণে কেন্দুয়ার উল্লেখ ছিল। সেখানে লেখা ছিল Kendua a place for dancing girls. আনন্দদায়িনী নর্তকীদের মিলনমেলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *