চতুর্থ অধ্যায় – কাব্য
কাব্য মানুষের আদিম শিল্প। আদিম যুগে কাব্যের কোনো স্বাতন্ত্র্য ছিল না, কারণ তখন মানুষের সমস্ত বোধ ও অনুভূতি মূর্ত হয়ে উঠত কাব্যে। ধর্ম, ইতিহাস, জাদুবিদ্যা, আইন প্রভৃতি সবকিছুর বাহন ছিল কাব্য বা গীত। সে—কাব্য আধুনিক অর্থে কাব্য নয়, তার বৈশিষ্ট্য ছিল আবেগময় ভাষা। শব্দে, ঝংকারে, ছন্দে, অনুপ্রাসে মিলে আদিম ভাষার যে—মোহ, যে—আকর্ষণ ছিল, তাতেই সে নির্বিবাদে কাব্যের আসন দখল করে বসেছিল। সুরই ছিল আদিম ভাষার প্রাণ। বিদ্যুৎপ্রবাহে সে—ভাষা ইন্দ্রিয়স্থানে গিয়ে পৌঁছোত। সে—ভাষা ছিল বেশি চিত্তাকর্ষক ও চিত্রাত্মক। প্রাচীন অনবচ্ছিন্ন ভাষার মারফত যেকোনো ভাব অপরের মনে পরিপূর্ণরূপে প্রতিফলিত হত। আদিম ভাষা ও কবিতার মধ্যে এই কারণেই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল। আদিম মানুষ প্রত্যেকটি শব্দ ব্যবহার করত রূপকভাবে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে যন্ত্র—সভ্যতার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার যে—বিবর্তন ঘটেছে তাতে অনেক প্রাচীন শব্দালংকারের সরসতা ও সৌন্দর্য গিয়েছে নষ্ট হয়ে। জীবনযাত্রার প্রণালী যখন ক্রমেই জটিল হতে লাগল, ভাষার সেই আদিম সরসতা ও স্ফূর্তি লোপ পেয়ে ক্রমে জন্ম হল গদ্যের। গান ও গীতিকবিতার যখন জন্ম হয়েছিল তখন গদ্যের জন্ম হয়নি। মানুষের শিল্পের বা নন্দনশাস্ত্রের আলোচনাতে সেইজন্যই কাব্য সর্বপ্রথম দাবি করে।
…..Warbling rose
Man’s voice in verse before he spoke in prose.
(Oehlenschlager)
বিষাদময় কর্মপ্রবণতাকে কেন্দ্র করে ভাষা গড়ে ওঠেনি, স্ফূর্তি ও বালসুলভ প্রফুল্লতার মাঝখানে ভাষার জন্ম হয়েছিল। যেসব হৃদয়াবেগের আঘাতে সংগীত ঝংকৃত হত তার মধ্যে প্রেমের স্থান ছিল সকলের উঁচুতে। আদিম কথাবার্তার ভিতর দিয়ে শুনতে পাওয়া যেত বালক—বালিকা, যুবক—যুবতির আনন্দের কোলাহল, যখন প্রেমিকের একজোড়া প্রশংসাতুর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা প্রাণ খুলে গাইত ও নাচত। জেসপার্সন বলেন :
Language was born in the courting days of mankind; the first utterances of speech I fancy to myself like something between the nightly love-lyrics of puss upon the tiles and the melodious love songs of the nightingale. (Language)
কিন্তু একমাত্র প্রেমই আদিম সংগীতের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল না। যেকোনো প্রীতিকর উত্তেজনা, অনুভূতি বা শঙ্কা সংগীতের ছন্দে মূর্ত হয়ে উঠত। অসভ্য বুনোরা একটু উত্তেজিত হলেই গান করত, ভূমিকম্পের সময়, শিকারের সময়, বিহারের সময়—মুখে মুখেই তারা এইসব গান রচনা করত। নদীর বুকে নৌকায় দাঁড় বাইবার সময় নিগ্রোরা হয় কোনো প্রণয়কাহিনি, না—হয় কোনো সুন্দরী নারীর রূপ বর্ণনা করত গান গাইতে গাইতে। পূর্ব আফ্রিকার বাসিন্দারা কতকগুলি এলোমেলো অর্থহীন শব্দ একসঙ্গে সুর করে আবৃত্তি করত ক্লান্তি না—আসা পর্যন্ত। কার্ল বুশার (Karl Bucher) বলেন, জগতের সমস্ত জাতির দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপের একমাত্র সহায়ক হচ্ছে এই ছন্দোবদ্ধ গান (Arbiet und Rhythmus)। আদিম যুগে যেখানে মহাকাব্যের কোনো নিদর্শনই পাওয়া যায় না সেখানে গীতিকাবিতার চিহ্ন একটু—আধটু মেলে। বোয়াস বলেন :
Even where the slightest vestiges of epic poetry are missing, lyric poetry of one form or another is always present. It may consist of the musical use of meaningless syllables that sustain the song; or it may consist largely of such syllables, with a few interspersed words suggesting certain ideas and feelings, or it may rise to the expression of emotions connected with war-like deeds, with religious feeling, love or even to the praise of the beauties of nature. (International Journal Amer. Ling,1.8)
যেখানে মহাকাব্যের কোনো চিহ্নও নেই, সেখানে গীতিকবিতার কিছু চিহ্ন মিলতে পারে। এই গীতিকবিতা অর্থহীন সংগীতধর্মী শব্দবিন্যাস হতে পারে; অথবা এই শব্দঝংকারের মধ্যে এমন কয়েকটি শব্দ ছড়িয়ে থাকতে পারে যার দ্বারা কোনো বিশেষ ভাব বা অনুভূতি ব্যক্ত হতে পারে, কিংবা যুদ্ধ, ধর্ম, প্রেম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে কোনো ভাবাবেগের বিকাশও হতে পারে।
গ্রিনল্যাণ্ডের এস্কিমোদের জাদুমন্ত্রের মধ্যে, থ্যালবিত জার (W. Thalbitzer) বলেন, এমন অনেক শব্দ উচ্চারিত হত যা কখনো বাইরে কথাবার্তার মাঝখানে ব্যবহৃত হত না। মাওরি ও আফ্রিকার নিগ্রোদের ধর্মসূত্রের মধ্যেও এইরকম পাওয়া যায়। জেসপার্সন ‘The Oath of the Canting Crew’ থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করেছেন :
No dimber, dambler, angler, dancer
Prig of cackler, prig of pancer;
No swigman, swaddler, clapper-dudgeon,
Cadge-gloak, curtal, or curmudgeon;
…(Farmer’s Muse Pedestris).
প্রাচীন যুগের এই সংগীতধর্মী ভাষার আলোচনা প্রসঙ্গে আধুনিক যুগের কয়েকজন পাশ্চাত্য সাহিত্যিকের ভাষা সম্বন্ধে কিছু বলা যেতে পারে। এঁদের মধ্যে জেমস জয়েস, মার্শেল প্রুস্ত ও মিস গার্টরুড স্টাইনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এঁরা ভাষাকে ভেঙেচুরে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিত্তির উপর গড়বার চেষ্টা করছেন। জয়েস ও স্টাইনের ভাষা আদিম ভাষার মতো সংগীতধর্মী। শব্দের ধ্বনি—প্রতিধ্বনিতে চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। যেমন :
Nuvoletta in her lightdress, spunn of sixteen shimmers were looking down on them, leaning over the bannistars and listening all she childishly could… She tossed her sfumas-telliacinous hair like la Princesse de la Petite Bretagne, and she rounded her mignons arms like Mrs. Cornowallis West and she smiled over herself like the beauty of the image of the post of the daughter of the queen of the Emperor of Irelande…. (James Joyce).
Sweet sweet sweet sweet sweet tea.
Susie Asado.
Sweet sweet sweet sweet sweet tea.
Susie Asado.
Susie Asado which is a told tray sure.
A lean on the shoe this means slips slips hers.
(Gertrude Stein)
নুভোলেটার রূপ ও চরিত্রের দোষগুণ জয়েস ফুটিয়েছেন শুধু তরঙ্গায়িত শব্দের ভিতর দিয়ে। পাখির মতো নৃত্য গীতমুখরা একটি মেয়ের চরিত্র সুসি এসাডোর মধ্যে ফুটে উঠেছে শুধু শব্দের ঝংকারে। সুসির সরলতা গৃহকর্মে অখণ্ড নিষ্ঠা, তীব্র তরল কণ্ঠস্বর, সযত্ন অবহেলা ও অপরিচ্ছন্নতায় আনন্দ—সব শুধু শব্দের ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আদিম ভাষার অর্থহীনতা ও সুরঝংকারের প্রতি এই আকর্ষণের মূলে রয়েছে বর্তমানের বিরোধক্লিষ্ট, সংগ্রামমুখর জীবনের প্রতি অশ্রদ্ধা, প্রত্যাবর্তনের মনোভাব। এইসব শিল্পীর অবচেতন মনের অভিপ্রায় সেইজন্য এই অধুনালুপ্ত আদিম ভাষার সাবলীলতায় পরিতৃপ্তি খোঁজে।
কবিতার বিশেষ গুণ হচ্ছে সংগীত। সংগীতের ছন্দের মধ্যে সংঘ—আবেগ (Collective Emotion) প্রকাশের অবকাশ আছে প্রচুর। আদিম কাব্য তাই সংগীতধর্মী। কিন্তু আদিম মানুষের এই সংঘ—আবেগের প্রয়োজন ছিল কেন? বাঘের, শত্রুর, ভূমিকম্পের বা বৃষ্টির ভয় দূর করবার জন্য সংঘবদ্ধ হওয়া তো মানুষের সহজাত স্বভাব। সকলেরই বিপন্ন হবার সম্ভাবনা যেখানে, সকলেই একত্রে সেখানে সাড়া দেবে। এক্ষেত্রে এই সংঘ—ভাব জাগ্রত করবার জন্য বাইরের কোনো উপায় অবলম্বনের আবশ্যকতা কী? অর্থাৎ নৃত্য বা উৎসবের মধ্যে গান গেয়ে সেই মনোভাব জাগরণের প্রয়োজন তখনই হয়, বিশেষ করে সমাজের দিক থেকে, যখন বাইরে কিছু দৃশ্যমান না থাকলেও ভবিষ্যতে ঘটবার সম্ভাবনা থাকে। এখনই হয়তো বাঘ আক্রমণ করেনি বা অতিবৃষ্টি হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে বাঘ আক্রমণ করতে পারে, শুধু অতিবৃষ্টি হতে পারে। এ নিছক কল্পনা নয়, এই আশঙ্কার পিছনে রয়েছে অতীতের অভিজ্ঞতা। সুতরাং দৃশ্যত বাইরে না ঘটলেও, ভবিষ্যতে ঘটবার সম্ভাবনা থাকার দরুন এমন কোনো উপায়ের সাহায্য প্রয়োজন হয় যার দ্বারা মধ্যে মধ্যে এই সংঘ—ভাব সকলের মনে জাগ্রত করা যেতে পারে। সুতরাং সংগীতের আবশ্যকতা। এইভাবে জীবিকা ও নিরাপত্তার প্রয়োজন থেকে হল কবিতার জন্ম, এবং বাস্তব (Reality) থেকে হল অবাস্তবের (Illusion) সৃষ্টি।
আদিম মানুষকে তার অজৈব অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য শিকারলাভ বা ফসল উৎপাদনের জন্য ঘন ঘন পরিশ্রম করতে হত। শুধু সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নায় এই উদ্দেশ্য—সাধন সম্ভব হত না। সেই সহজাত প্রবৃত্তির কোনো সামাজিক উপায়ে ফসলের চাহিদা মেটানোর জন্য নিয়োজিত হত। এই সামাজিক উপায়ের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল সংঘ—উৎসব (Group Festival), যেখানে সকলের পুঞ্জীভূত হৃদয়াবেগ মুক্ত হয়ে পরিচালিত হত ঐক্যবদ্ধ সুনির্দিষ্ট পথে। আদিম কাব্যের জন্ম এই সংঘ—উৎসবে। আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ফসলের অস্তিত্ব তখন হয়তো নেই। তখন সেই ফসল থাকে কল্পনায় এবং কাল্পনিক ফসল উৎসবমত্ত মানুষের দৃষ্টিপথে বিরাজ করে। নৃত্যের উন্মত্ততায়, সংগীতের সুরাবর্তে ও কবিতার ছন্দে প্রত্যক্ষ বাস্তব থেকে আদিম মানুষ নিজেকে ছিন্ন করে অভিক্ষেপ করত এই কাল্পনিক জগতে, যেখানে তাদের চোখের সামনে অসংখ্য ফসল মৃদু বাতাসে হেলত—দুলত। তখন সেই কাল্পনিক জগৎ সংগীতের উন্মাদনায় মনে হত বাস্তবতর জগৎ। উৎসব শেষে সে—জগৎ মিলিয়ে যেত না। ফসলের সেই কাল্পনিক জগৎকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য আদিম মানুষ সংগীতের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একত্রে মহানন্দে পরিশ্রম করত।
কিন্তু কী উপায়ে এই সংঘ—ভাব সজাগ হত? যেসব শব্দ (Words) দৈনন্দিন কর্মজীবনে প্রত্যেক মানুষের ভাবানুষঙ্গ (Emotional Association) অধিকার করেছে তারাই ক্রমশ সংগৃহীত হয়ে ছন্দের ভিতর দিয়ে সংগীতে মূর্ত হয়ে উঠত।
‘গিজাড় তে গিজদে’ বাদ্যের শব্দ, তার সঙ্গে ‘খেত’, ‘ধান’ ও ‘হাল’ ফসলের ইঙ্গিত জানায়। এই কয়টি শব্দকে ছন্দোবদ্ধ করে গেঁথে সকলেরই মনে ফসলের ভাব উদ্রেক করবার জন্য গাওয়া যেতে পারে। জাগরণের মুহূর্ত থেকে কর্মে অনুপ্রাণিত হবার সময়ের মধ্যে এই ভাব অন্তর্ধান করত না। প্রত্যেক মানুষ গোষ্ঠীজীবনের (Tribal Life) সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজে পরিবর্তক হত। এই পরিবর্তনের মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল উৎসব ও পরিবর্তক ছিল সংগীত।
আদিম শিল্প এইভাবে সংঘ—আবেগ (Collective Emotion) সৃষ্টি করে তাকে নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের পথে চালনা করত। এর ফলে শ্রমের অবসাদ অনেক লঘু হত এবং শ্রমে আনন্দ পেত মানুষ। সমবেত হয়ে সকলে জমি চষত, শস্য বপন করত। এই সম্মিলিত শ্রমের সঞ্চালনী শক্তি ছিল সংঘ—আবেগ এবং এই সংঘ—আবেগের জনপ্রিয়তা ছিল সংগীত বা আদিম কাব্য।
সমাজের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই হৃদয়াবেগ পরিবর্তিত হল। আদিম খাদ্যসংগ্রহকারী, শিকারি মানুষ প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে অভিক্ষেপ করত তার বাসনা ও আকাঙ্ক্ষার চরিতার্থতার জন্য। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখবার জন্য তার নিজের সামাজিক রূপ পরিবর্তিত হত। সেইজন্য আদিম শিল্প ছিল প্রাকৃতিক ও প্রত্যক্ষ (Perceptive)। যেমন পুরোপলীয় মানুষের (Palaeolithic Man) চিত্রাঙ্কন এবং অস্ট্রেলিয়ান অসভ্যদের পাখি বা পশু অনুকরণে নৃত্য ও সংগীত। টোটেম (Totem) ছিল উপলক্ষ, মানুষ ছিল প্রকৃতি। তারপর আর—এক স্তর ঊর্ধ্বে এল শস্য উৎপাদনকারী ও পশুপালনকারী মানুষ। প্রকৃতিকে গ্রহণ করে তাকে পরিবর্তন করবার চেষ্টা করা হল নিজেদের ইচ্ছাপূরণের জন্য। সেইজন্য এদের শিল্প হল ইচ্ছাপ্রসূত। যেমন নবোপলীয় মানুষের (Neolithic) খেয়ালি ছবির শোভা এবং আফ্রিকান ও পোলিনেসিয়ান গোষ্ঠীর ধর্মোৎসব। এর উপলক্ষ হল শস্যদেবতা ও পশুদেবতা এবং প্রকৃতি হল মানুষ। তারপর এইভাবে গোষ্ঠীর মধ্যে প্রকৃতিকে বরণ করবার ফলে শ্রমবিভাগের (Division of Labour) সূচনা হল এবং ক্রমে ক্রমে প্রভুর, পুরোহিতের ও শাসকশ্রেণির আবির্ভাব হল। শিল্প তখন প্রভুর স্তুতিগান করত এবং দেবতারও গুণকীর্তন করত। মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বিভেদ ও একতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ক্রমে নিজের অভ্যন্তরীণ বিরোধ সম্বন্ধে সচেতন হল, কারণ এই সচেতনতার পরিবেষ্টন তখন বিদ্যমান।
এইভাবে সমাজের ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানুষ পরিবেষ্টনের সঙ্গে সংগ্রাম করে কাব্যকে সমৃদ্ধ করল। অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য উৎপাদনের অস্ত্র যেমন ক্রমে উন্নীত হল, তেমনি কাব্যও অজৈব প্রেরণা থেকে উন্নততর উপায়ে রূপায়িত হল। উৎপাদনের অস্ত্র মানুষের হাতেই নূতন কার্যে নিযুক্ত হল। হাতের আকৃতির পরিবর্তন হল না বটে কিন্তু অস্ত্রের ব্যবহার বদলে গেল। তেমনি কাব্য মানুষের অন্তরে নূতন অনুভূতি সৃষ্টি করে তাকে রূপ দিতে প্রয়াস পেল, কিন্তু হৃদয়ের ধর্ম যে আকাঙ্ক্ষা তার কোনো পরিবর্তন হল না। আদিম মানুষের সঙ্গে এ—যুগের মানুষের যদি কোনো আন্তরিক ঐক্য থাকে তাহলে সে হচ্ছে মানুষের হৃদয়ের সহজ বৃত্তির সঙ্গে অর্থাৎ মানুষের চিরাকাঙ্ক্ষামুখর, বাসনাস্পন্দিত হৃদয়ের সঙ্গে। সমাজের ক্রমবিকাশের স্তরে স্তরে অনুভূতি বদলায়, বাসনা নূতন বাসনায় রূপ নেয়, কিন্তু মানুষের অন্তরের দুর্বার কামনাস্রোত কখনো শুকিয়ে যায় না, তা চিরপ্রবহমান, গতিশীল। ক্রমোন্নতিতে যুগে যুগে তার বিকাশ। আদিম কাব্যের মতো যুগে যুগে মানুষ কাব্যের প্রেরণায় এক কাল্পনিক জগতে অভিক্ষিপ্ত হয়, কারণ এই কাল্পনিক জগৎ হচ্ছে তাৎকালিক বাস্তব জগৎ অপেক্ষা বাস্তবতর—এই বাস্তবতর জগৎ তখনও প্রত্যক্ষ জীবন্ত বাস্তবে পরিণত হয়নি, এবং সেই পরিণতির জন্য কাব্য কল্পনায় তাকে অভিনন্দন জানায়। এখানে ভুল বোঝবার হয়তো অবকাশ আছে, কিন্তু ভুল কিছু নেই। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে কাব্য তাহলে এমন কিছু রূপায়িত করবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। তা নয়। খামারভরা ধান বা ফসলের প্রাচুর্য সম্বন্ধে কাল্পনিক উৎসব না করলে মানুষ সেই ফসল উৎপাদনের জন্য পরিশ্রম করবে না। সংগীতের মত্ততা তার ক্লান্তি দূর করবে। একসঙ্গে সংগীতের ছন্দে কোদাল চালিয়ে, কাস্তে নেড়ে, লাঙল চষে, সে ফসল বুনবে। ফসলের চাহিদা তার রয়েছে, ফসল উৎপাদনের উপযুক্ত পরিবেষ্টনও রয়েছে, প্রয়োজন প্রেরণার। এই প্রেরণা কাব্য জোগায় উন্নততর বাস্তবের মধ্যে অভিক্ষেপ করে। এই উন্নততর বাস্তবে অভিক্ষিপ্ত (projected) মানুষ তখন কাব্যের উন্মাদনায় তাকে প্রত্যক্ষ বাস্তবে রূপান্তরিত করবার চেষ্টা করে নিজের শ্রম দ্বারা। অন্ধ সহজ প্রবৃত্তি থেকে এই রূপান্তর ঘটে না, অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের সক্রিয় চেষ্টার ভিতর দিয়ে এই রূপান্তর ঘটে। কাব্যের উপাদানের প্রত্যক্ষ অস্তিত্বই কাব্যের সত্য (truth) নয়, কাব্যের গতিশীলতা ও সংঘ—আবেগই (Collective Emotion) কাব্যের সত্য।
Not poetry’s abstract statement—its content of facts, but its dynamic role in society—its content of collective emotion, is therefore poetry’s truth. (Christopher Caudwell—Illusion & Reality)
ভাবের গভীরতায় নিমজ্জিত হবার অবসর যাদের ছিল না সেই আদিম মানুষের মনকে ঘন ঘন অনুপ্রাসের সশব্দ আঘাতে, সংগীতের সুরে, উত্তেজিত ও অনুপ্রাণিত করা হত। মাঠে যখন ফসল নেই, আকাশে যখন বৃষ্টির মেঘ নেই, তখন ফসলের চারধারে নৃত্য করে, গান গেয়ে, মাঠভরা ফসলের এক কাল্পনিক জগতে মানুষ বিক্ষিপ্ত হত, একসঙ্গে ব্যাঙের ডাক ডেকে, মেঘের গর্জন অনুকরণ করে এক কাল্পনিক ঘনবর্ষার পরিবেষ্টন সৃষ্টি করা হত। সেই ছন্দের ও সুরের প্রেরণায় মানুষ মাঠে যেত একসঙ্গে, কাল্পনিক জগৎকে বাস্তবে রূপ দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে। সে—কল্পনা তখন হত তার কাছে প্রত্যক্ষ বাস্তব অপেক্ষাও বাস্তবতর, সেইজন্য তাকে রূপায়িত করবার জন্য শ্রম করতে সে অবসন্ন হত না। ক্রমে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের ফলে ও উন্নততর সমাজব্যবস্থার ফলে, মানুষ কর্মময় কাব্যের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে, অবসর জীবন বিনোদনের জন্য কাব্যকে গ্রহণ করেছে। কারণ শ্রমবিভাগের (Division of Labour) ফলে সমাজ যে শ্রেণিবিন্যস্ত রূপ ধারণ করেছে, সেখানে শাসকশ্রেণির শাসনব্যবস্থা একশ্রেণিকে প্রচুর অবসর দান করে আর—এক শ্রেণিকে দিয়েছে শ্রমের পরিবর্তে জীবনধারণের অধিকার। শ্রেণিহীন সমাজ ভিন্ন (Classless Society) কাব্যের মধ্যে সেই সংঘ—আবেগ মূর্ত হয়ে মানুষকে কর্মপ্রবণ করতে পারবে না। এ—যুগের কাব্যের তাই মঙ্গলবাণী নেই, গতি নেই, স্ফূর্তি নেই। যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে সে—ই নিজে হয়েছে যান্ত্রিক, যন্ত্রের মধ্যে বিরাট শক্তির পরিচয় সে পায়নি। সে মুক্ত শক্তির আস্বাদে তার বিমুখতা, বিতৃষ্ণা। এ—যুগের কাব্যে কোথায় সেই কল্পনা ভবিষ্যতের সেই উন্নততর বাস্তব, সে—ই গতিশীলতা, সেই সংঘ—হৃদয়াবেগের অভিব্যক্তি? অথচ এ—যুগের কাব্যের সৌন্দর্যের ও পূর্ণতার উপাদান প্রচুর।