কাঞ্চন-লখাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে মদন কৈবর্তের মা অধরার বিষাক্ত জিভ লকলক করে উঠল। পাড়াঘরে তার চেয়ে এ বিষয়ে অগ্রণী কেউ ছিল না। সে হাততালি দিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে এবং দেহের বিচিত্র উকট ভঙ্গিমাতে সে কথা প্রচার করে বেড়াল। এমনিতেই অধরার মার কুটনি বলে গ্রামে বিশেষ খ্যাতি আছে। মদনের জন্ম সম্পর্কে বহু জনের রকমারি সন্দেহ আছে। মদনের বাপ বেঁচে থাকা পর্যন্ত থেকে শুরু করে আজও লোকে বলে অধরা কুলটা। অধরা বলে, যে-মেয়েমানুষ আমাকে কুলটা বলে সে পুত-ভাতারি, যে ব্যাটা বলে, সে মেয়েমেগো। এ গালি সত্ত্বেও অধরার কলঙ্কমোচন হয়নি, উপরন্তু এ প্রৌঢ়া বয়সে সে বুড়ি কসবী বলে নাম কিনেছে। অর্থাৎ এখনও নাকি তার ঘরে নাগরের আবির্ভাব ঘটে থাকে। সেকথা অস্বীকার করে না অধরা, বরং আসবেই তো, বলে সকলের কাছে ডঙ্কা বাজিয়ে বেড়ায়।
যাই হোক, কাঞ্চন-লখাই সম্পর্কে অধরার এ কাহিনী প্রচারে সকলের মনই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলে উঠল। কারণ কাঞ্চনের স্বামী নারানের সঙ্গে মদনের বউ কাতুর কুসম্পর্কের ব্যাপারটা ঢাকাঢকির পর্যায় উতরে শুধু খোলাখুলি প্রচারিত নয়, সত্য-মিথ্যার বেড়া ডিঙিয়ে দৈনন্দিন জীবনে এটা গ্রামের আর সব কিছুর সঙ্গেই মিশে গিয়েছিল। এখন নারান আর আগঢ়াক না খুঁজে সকলের সামনেই নিয়মিত মদনের বাড়িতে যায় এবং কাতু সম্পর্কিত ঠাট্টা উপহাস উপভোগ করে। এ ব্যাপারেও যত দোষ লোকে দিত নারান আর কাতুকে, তার চেয়েও বেশি দোষ দিল অধরাকে। প্রকৃতপক্ষে অধরাই ব্যাপারের জন্য দায়ী। সে নিজে সব খুইয়েছে, তাই ছেলের বউকেও সে কুলটা করতে চায়। প্রতিবেশীদের এ সন্দেহ শুধু সন্দেহ নয়, সত্য। নগিন হালদার ছিল অধরার পিরিতের মানুষ। তার যৌবনের নগিন হালদার যখন সে বন্ধনের শিকড় কেটে ফেলতে চেয়েছিল তখন কাতুকে ঠেলে দিয়েছিল সে নগিনের কাছে। কাতুর আপত্তি ছিল, কিন্তু অধরার জাঁহাবাজির কাছে সে আপত্তি টেকেনি। শুধু মারধর নয়, কাতুকে কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে এমন কথাও অধরা বলেছিল। কাতুর আশ্রয় ছিল একমাত্র স্বামী মদন। কিন্তু মদনের সে স্বামীত্ব ছিল না। মদন শুধু মাতৃভক্ত নয়, মাতৃভীতও বটে। মায়ের আদেশে নিজে সে বউকে নগিনের ঘরে ঠেলে দিয়ে এসেছিল। দিয়ে এসে সে কেঁদেছিল মায়ের পা ধরে। অধিকারবোধ না থাকলেও মমত্ববোধ ছিল মদনের। ছেলের চোখে জল দেখে কী মনে করে অধরা তখন বলেছিল, ও মাগী তোর যুগ্যি নয়, তোকে আমি আবার বে দেব ছোটমোট এক মেয়ে দেখে। সে কথা শুনে মদন মায়ের কাপড় আরও জোরে আঁকড়ে ধরে বলেছিল, আর যাই হোক কাতুকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। মা কাতুকে দিয়ে যাই করাক, এ বাড়ি থেকে যেন তাড়িয়ে না দেয়।
নিষ্ঠুর অধরা তাই মেনে নিয়ে মদনের বিয়ে দেয়নি। নগিন হালদার মরে গেল। অধরা বলল, কাতুই তাকে খেয়েছে। নারান তখন কি জানি কেন, কাঞ্চনকে ছেড়ে কাতুর আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। অধরা কয়েকদিন গালাগাল শাপমন্যি করে বেরাল, নারাও তো কম নয়। গালাগাল দিতে না জানুক, অধরার গলায় পা দিয়ে নিকেশ করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। বিশেষ কাতুর সঙ্গে আড়ালে আবডালে ইতিমধ্যে তার একটা বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। কাতু তখন শুধু সেয়ানা নয়, বন্ধনহীন হৃদয়ে তার অসীম আকাঙক্ষার নিরন্তর হাহাকার। অধরার প্রতি তার ভয় কমে এসেছিল, মদনের প্রতি অসীম ঘৃণায় মন বিষাক্ত। খানিকটা বেপরোয়া উদ্ধত হয়ে উঠলেও অসহায়ত্ব ঘোচনি তার। প্রয়োজন ছিল একটা শক্ত খুঁটির মতো আশ্রয়। নারানের যোগ্যতা সেদিক থেকে পুরোপুরিই। জোয়ান নারানের বাহুবন্ধনে তাই সে বাঁধা পড়ল। বলা চলে, একটা আশ্রয় খুঁজে পেল। বেগতিক দেখে অধরা নারানের জন্য দরজা খুলে দিল। উদ্দেশ্য, নারানকে না খেপিয়ে কাতুকে ব্যবহার করা। সে অবশ্য স্যাকতার কাছে নারানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে যেতে পারত কিন্তু অধরার বুকে ততখানি সাহস ছিল না। কেন না, ছেলে মদন তো তার মানুষ নয়।
আর বিস্ময়ের হলেও সত্য বটে যে, নারানের আবির্ভাবে মদন খুশি হল। যেন সে তার কাতু বউকে সঁপে দেওয়ার একটা উপযুক্ত, শক্ত আশ্রয় পেল এবং নিজের মায়ের চেয়েও নারানের সে আশ্রয় তার কাছে নিরাপদ মনে হল।
সুতরাং নিজের ছেলের বউয়ের উপপতির বউয়ের সম্পর্কে যখন অধরাই একথা উঠে পড়ে গাঁয়ে ঘরে চেঁচিয়ে বেড়াতে লাগল তখন সকলেই খানিকটা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। নারান কোনও প্রতিবাদ করল না! উপরন্তু নিজের ভিটা সে প্রায় ত্যাগ করল।
কেবল কালী ঘরের ছেচে দাঁড়িয়ে বিচিত্র এবং সাংঘাতিক গালাগালিতে গাঁ ফাটিয়ে ফেলল। তবু রোধ করতে পারল না চোখের জল। বার বার কাঞ্চনকে বলতে লাগল, সব্বোনাশী, হারামজাদি, এ কী করলি, এ কী করলি? ঘরের মধ্যে লখাইয়ের চুলের মুঠি ধরে চাপাস্বরে বার বার বলল, মিনসে, তোর পেটে পেটে এত? আগে কেন বললিনে?
কালীর দেওয়া সমস্ত লাঞ্ছনা মাথা পেতে নিয়ে নীরবে বসে রইল লখাই। মিছে কথা বলে যাকেই হোক কালীবউকে সে ভোলাতে পারবে না।
অধরার সঙ্গে গলা মেলাল দাশুমালোর বউ, হরিকানার মা। কেননা, এ বাড়ির উপর তাদের পূর্বের একটা বিদ্বেষ থেকেই গিয়েছিল, জরিমানা দিতে হয়েছিল, তাদের সেবারের বিচারে লখাই কালীর দুর্নাম রটনায়।
স্তব্ধ হয়ে রইল কেবল শ্যাম। তবে তার এ স্তব্ধতা আজকের নয়, কয়েক বছরের। যে কালের প্রবাহে উৎকণ্ঠায় শঙ্কিত হয়ে সে নীরবে সব দেখছিল, বুঝল, এ-সবই সেই প্রবাহের ক্লেদনিকর। এমন বোধ হয় শুধু শ্যামের নয়, অনেকের এবং সারা দেশ জুড়েই। বলতে হলে কিছু গোড়ার আলোচনায় ফিরে যেতে হয়, যখন থেকে আকালের শুরু।
.
তিপ্পান্ন সালে যেদিন প্রথম রেললাইন পাতা হল কলকাতা থেকে হুগলি পর্যন্ত, সেদিন থেকেও আকালের শুরু বলা যেতে পারে। অন্তত শ্যাম তাই মনে করে। তখনও মানকুণ্ডুর খাঁয়েদের একশো একখানা নৌকা বদর বদর করে গঙ্গার উপর দিয়ে যাতায়াত করে নানান মালপত্তর নিয়ে। আজও করে। কিন্তু সেদিনের মতো আর তার জাঁকজমক কোথায়! ভদ্রেশ্বরের বাজার হল কাটরার বাজার অর্থাৎ ভাল গম ইত্যাদি জাতীয় সব জিনিস পাওয়া যায়। যা দেখে শ্যাম তার বোনের বিয়ে দিয়েছিল ভদ্রেশ্বরে। সেই ভদ্রেশ্বরে রেললাইন যেন এক উৎপাতের মতো এসে হাজির হল। কিন্তু রেললাইন যখন পাতা হল তখন ওই কাটরার বাজার হল বারো জিনিসের, খায়েদের জলপথের ব্যবসা হল একটু কানা। কিন্তু রেললাইন যখন পাতা হল তখন ওই কাটরার বাজারের মহাজনেরাই হাঁড়ি আর জালা ভরতি মিঠাইমণ্ডা নিয়ে প্রথম গাড়ি যেদিন এল, পুজো দিয়ে এল তার। জগদ্দল-স্যানপাড়ার লোকেরা নৌকা বোঝাই করে গেল সেই রেলগাড়ি দেখতে, ঢাকঢোল, সিঁদুর নৈবিদ্য নিয়ে। শ্যাম যায়নি। নানান লোকের মুখে নানান কথা, একদিনের পথ নাকি পলকে যায় সেই গাড়ি আর সে কী কাণ্ড। তোমার মনে হবে কৈলেশ পাহাড় থেকে শিবঠাকুর নেমে এসেছে। সে কী ফোস ফোস শব্দ, আকাশে মেঘ ছেয়ে গুমগুম করতে করতে ঝড়ের মতো আসে সে গাড়ি। ভূমিকম্পের মতো থরথর করে মাটি কাঁপে, কার ক্ষমতা আছে তখন সামনে থেকে। কেউ বিশ্বাস করল না ওর মধ্যে কোনও যন্ত্র আছে, ম্লেচ্ছ কোম্পানির ডাকাবুকো সাহেবরা ওতে অপদেবতা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। যে যার নিজের মনের মতো গল্প ছড়াল আশেপাশে। স্যানকর্তারা বোঝালেন এর ভালত্ব। বামুনদের মধ্যে যারা কলকাতার কেল্লায়, কোম্পানির দরবার-দফতরে কাজ করতে যেতেন, তাঁরা সপ্তাহান্তে নৌকোপথ ছেড়ে সেই গাড়ি চাপতে শুরু করলেন। সেটা এমন কিছু ছিল না, সর্বনাশ হল তখন যখন সেই গাড়িতে করে মাল নিয়ে যাওয়ার সুবিধে পেয়ে কোম্পানি যা পেল সব সাবড়ে নিতে শুরু করল। ইতিপূর্বেই ফরাসডাঙার তাঁতিদের মধ্যে সুতোর জন্য : হাহাকার পড়ে গিয়েছিল, এবার শোনা গেল, সুতো তো দূরের কথা, এ দেশের সুতো নিয়ে বিলাতে মেশিনে বানানো কাপড় আসছে শিগগিরই। তা ছাড়া, নানান বিলাতি জিনিসে বাজার তখন ভরতি। আনন্দে গা ভাসাল শুধু মহাজনেরা।
তারপরেই আর এক ধাক্কা এল পঞ্চান্ন সালে, রিষড়েতে এক কারখানা খুলে। এবার কলরব উঠল চারদিকে থেকেই। এ কী কোম্পানিও সাহেবের দেশ যে, এ মাটিতে তুমি যা করবে তাই সইবে। এ মাটির বুকের উপর দিয়ে এখনও গঙ্গা-যমুনা প্রবাহিত, মন্দিরে মন্দিরে জাগ্রত দেবতারা অধিষ্ঠিত, ব্রাহ্মণের গলায় এখনও মন্ত্রপূত উপবীত, উজ্জ্বল ব্ৰহ্মতেজ, দিন হয়, রাত্রি হয়। এখানে ও-সব মেচ্ছ কারবার চলবে না। তা ছাড়া, সকলেই ব্যাপারটাকে ঠাট্টায় উপহাসে ভরে তুলল এই বলে, হায়। তুলোয় সুতো হয়, সেই সুতোয় কাপড় হয় জানি কিন্তু পাটের তো দড়িই হয়, তার আবার যন্তর কীসের। এক, পাটের সুক্ষ্ম সুতোয় ঢাকার তাঁতির হাতে বাহারি জেল্লাদার কাপড় তৈরি হয় রেশমের। মতো কিন্তু পাটের আবার কল কীসের? গোলপাতার ছাউনি দিয়ে ইটের মস্ত মস্ত থাম খাড়া করে বিরাট ঘরের মধ্যে প্রথম চটকলের পত্তন হল। সেই ঘরে যন্ত্রের কী কেরামতি চলছে, কী বাহার হয় পাটের, তাই দেখার কৌতূহলে কেউ কেউ নাম লেখাল কাজের। কেরেস্তান পাদরির ভগবানের হদিস বলার মতো সাহেবরা লোককে ধরে ধরে বোঝাল এ যন্ত্রের কথা, ভরসার কথা এবং সব চেয়ে বড় টাকা-পয়সার কথা।…টাকার কথা শুনে অনেকেই ছুটে এল। সপ্তাহে প্রায় একটাকা পাঁচসিকে নগদ! বড় কম নয়। কিন্তু লোকের সে মেজাজ কোথায়। তারা দুদিন আসে দশদিন আসে না। কারখানা বন্ধ থাকে। এমনি তখন অবস্থা।
এদিকে কোম্পানির নতুন প্রবর্তিত খাজনা-আইনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল সারা দেশটার মাথায়। শ্যাম দেখল, গোঁসাই এবং স্যানকতারাও যুগপৎ পালটে ভিন্ন মূর্তি ধরলেন খাজনা বাড়ল তো বটেই আবার কাঁচা পয়সায় সে খাজনা দেবার নিয়ম হল। ওদিকে জোলা তাঁতি যুগী—সবাই তখন মাঠে নেমে এসেছে। সারা দেশে নাকি তুলো নেই, সুততা নেই। এমন কী, মুচি ডোম পর্যন্ত চামড়ার জন্য হা-পিত্যেশ করে রইল। দেশে নাকি চামড়াও নেই। জোলা হল জেলে, মুচি হল চাষী। হাড়ের বোতাম চিরুনি গড়ত যারা, তারাও নামল মাঠে। সারা পরগনায় পায়রার খুপরির মতো জমি ভাগ হল কুটি কুটি।
এত অনাচার দেশ সইবে কেন! আচমকা সারা দেশে দেশি সেপাইরা লড়াই লাগিয়ে দিল কোম্পানির বিরুদ্ধে। শ্যাম জঙ্গলপীরের থানে মানত করল, হে ভগমান, হে বাবাঠাকুর, তোমার দুহাতে সব অনাচার, সব পাপ শেষ করে দাও, ভূমিকম্পে ঝড়ে ওদের কলকারখানা সব চুরমার করে দাও, কোম্পানির সব্বোনাশ করো, এ ড্যাকরা সুমন্দির পোর ঘরে ঘরে ওলাউঠায় সব শেষ করো।
কিন্তু শ্যামের বাবাঠাকুর সেদিন এই কোম্পানির গোরাদের উপর সুপ্রসন্ন। সেপাইদের হার হল। গোরাদের মহারানী আশ্বাস দিলেন ধর্মেকর্মে নাকি আর কখনও কোম্পানির এ-সব বেলেল্লা করবে না। কে শুনতে চেয়েছিল সে কথা? হোক দেশি লোকের তৈরি, হিন্দুস্থানের যে মুলুকে কাপড়ের কল তৈরি হয়েছে, সে কাপড়ের কল তো উঠল না, তাঁর হুকুমে রিষড়ের পাটকল ড়ুবল না গঙ্গায় উপরন্তু দেশি খাদ্যে শস্যে হাত পড়ল গোরা কোম্পানির। দেশের নৌকা বোঝাই চাল ফসলে ভাঁটা পড়ল। এ-দেশের হাটে হাটে বিকোবার মাল কোন্খান দিয়ে কোন মুলুকে পাচার হয়ে গেল, ঠাওর পেল না কেউ।
খাজনা বাড়ল আবার। শ্রীরামপুর-চাঁতরার গোঁসাইবাবুরা রাজা, সারা হালিশহর পরগনার জমিদারি তাদের ব্রহ্মোত্তর কিন্তু পত্তনি দেওয়া কৃষক প্রজারা তো কোনও রাজরাজড়ার কুলগুরু নয়। অভাবের দায়ে দেনার জন্য হাত পাতল তারা। মহাজনেরা এগিয়ে এল ঋণ দানের জন্য।
শ্যাম নিরস্ত রইল ঋণগ্রহণ থেকে।
এল তার ঘরে মা-মনসার বরপুত্র লখাই। নতুন করে সম্পর্ক স্থাপিত হল স্যানবাবুদের সঙ্গে। বুকে আবার একটু বল ফিরে পেল সে।
কিন্তু আবার বাড়ল খাজনা। ফরাসডাঙার গোরারা খোলাখুলি ডাকাতি শুরু কল, দেশের উৎপন্ন ধন জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গেল গোরা কোম্পানি। গারলের নীলচাষীরা মাগ-ছেলে ফেলে পালাতে লাগল।
কেবল ইহুদি বাঈজীর নাচ থামল না আতপুরের রাজবাড়িতে, মেরজা ওস্তাদের সঙ্গীতের মিঠাবুলি প্রাণ রাঙানো চলল নিরন্তর। তার উপরে লক্ষ্মৌ-দিল্লির নাচওয়ালীর ঘাগরার ঝাপটা, নূপুরধ্বনি সেনবংশের দেওয়ানি ঐশ্বর্যের মহিমাকীর্তনে মেতে উঠল। গোরাদের পাতলুন-কোট পরে নতুন করে খোলস অটল বাবুভায়ারা। যে বাঙালি রাজাবাবু বিবা বিয়ের কথা বলে অনাচার করতে চেয়েছিলেন সবাই যেন শুরু করল তাঁর সাগরেদি। কিন্তু রাজাবাবুর মতো চাষার দুঃখে গোরাদের গায়ে পড়ে ঝগড়ার করলেন না কেউ।
ওদিকে নতুন রেল লাইন পাতা চলতে লাগল কলকাতা থেকে শুরু করে এই সেনপাড়ার উপর দিয়ে। স্যানপাড়ার উপর দিয়ে? ভয়ে কৌতূহলে অবুঝ উৎকণ্ঠায় লোকজন ছুটে গেল রেল দেখতে। আবার পাটকল করার কথা শোনা গেল তেলেনীপাড়ায়।
শ্যমের স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা। কানু ভড় বিশ্বকর্মা পুজো করল। ভড়েরা হল তাঁতি। গঙ্গাজলে তাঁত-চরকা ধুয়ে সিঁদুর লেপে সারাদিন সে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে রইল তাঁতের উপর। ফরাসডাঙা থেকে স্যানকতারা আনিয়েছিল কানু ভড়ের বাপকে। কানুর বাপের তখন খুবই নামডাক। একসময়ে ওদের ঘরকে চিনত নবাব বাদশারা, ওদের না জেল্লাদার বাহারে কাপড়ের সুনাম দিল্লি অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল। হিন্দুস্থানের বাইরেও ওদের হাতে তৈরি মাল নাম রেখেছে এ দেশের। সে বংশের ছেলে কানু।…পুজো সেরে শ্যামকে এসে বলল, রিষড়ের কলে পাটের বোরা বুনতে যাব রে শ্যাম।
শ্যাম বলল, কী যে বলো কানু ভাই, তুমি যাবে কলে খাটতে!
কয়েকদিন পরে ভোরবেলা সবাই দেখল কানু নতুন বানানো শেষ এবং অসমাপ্ত আগুনের মতো জ্বলজ্বলে ওড়না গলায় বেঁধে তাঁতঘরে মাচার বাঁশে ঝুলছে।
কান্নার রোল পড়ল জগদ্দল-স্যানপাড়া জুড়ে।
তবু বজরা-ভাউলে সাজিয়ে গোবিন্দপুর-ভবানীপুরের বাবুরা রাজশাহী শহরে ফুর্তি করতে যাচ্ছে। তাদের ভাউলে ভিড়ছে জগদ্দলের ঘাটে।
আগুরিপাড়ার ঘাটে বসে পাকা মাথায় চাঁটি মেরে গান গেয়েছে কালো দুলে :
মনের সুখে যাচ্ছে দেখ কত শত নারী
এরা বজরায় মেরে যায় বলি কি হারি।
কেউ
পরেছে নীলাম্বরী
কেউ পরেছে ঢাকাই শাড়ি
ঝুমকো বেড়ি চারগাছা মল ডবল মাড়ি দুই হাতে চুড়ি।
বজরা ভাউলের ছাতে উঠে আসে বাবুয়াদের রঙ্গসঙ্গিনীরা। বুকের কাঁচুলির ওড়না সরিয়ে নীলাম্বরীতে প্রাণভোলানো শহর তুলে নেচে নেচে গেয়ে ওঠে :
বাবুরা দেখে হতজ্ঞান! চায় না কোট পিরান
পকেটেতে রোমাল ঝোলে, গলেতে ঘড়ি-চেন্ দোলে
ইংরিজি বুটজুতা পায় পরে সকলে।
এ গান ফুর্তির, না ব্যঙ্গের, কে জানে!
তখন শ্যামের মাথায়ও নেমে এসেছে ঋণের বোঝা। তার উপর ঘরের মধ্যে এই অশান্তি। প্রথমটা তার সমস্ত জ্ঞান যেন গুলিয়ে গেল। তারপর ভাদ্ৰবউ কাঞ্চনের রূপের কথা মনে হতেইওর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল নারানের ওপর। সোয়ামী হয়ে সে হারামজাদা কাঞ্চনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না, সে গিয়ে আবার আস্তানা পেতেছে অধরার ব্যাটার বউয়ের ঘরে। কিন্তু বুক ফেটে গেল তার লখাইকে এর প্রতিবাদ করতে না দেখে।
তারপর সে হঠাৎ স্থির করে বসল, কালীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার। পুবে বোদাই গ্রাম কালীর বাপের বাড়ি। কালী আর মধুকে নিয়ে চলে যাবে সে। যা আছে কপালে, এ সংসারের হোক। সে আর তা দেখতে আসছে না। কালীর বাপের অবস্থা এমন কিছু খারাপ নয়, আর ভাইবোনও নেই। কালীর। শ্বশুরের সবই তো তাদের নাতি মধুর প্রাপ্য। এখন থেকে সে সেখানেই থাকবে।
কাঞ্চন কালীর পায়ে পড়ে কেঁদে ভাসাল। লখাই বার বার শ্যামের কাছে এল কিন্তু কিছুই বলতে না পেরে ফিরে ফিরে গেল। নারান এসবের কোনও খোঁজই রাখল না। কেবল নীরব রইল কালী।
শ্যাম খুব স্বাভাবিকভাবেই সংসারের সব বুঝিয়ে দিল লখাইকে। গরুগুলোর যত্ন করতে, খিরপাড়ার শীশ মণ্ডলের সঙ্গে খেতখামারের কাজকর্ম বুঝে নিতে বলল।
যাওয়ার সময় কালী চোখের ইশারায় কেবল সান্ত্বনা দিয়ে গেল। কাঞ্চন-লখাই বাপ-মা-হারা শিশু বালক বালিকার মতো স্তব্ধ হয়ে উঠোনের উপর দাঁড়িয়ে রইল।
শ্যামের চলে যাওয়াতে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল না শুধু, এর মধ্যে মনসার ছেলের কোনও কারিগরি নিশ্চয় আছে মনে করে কেউ কেউ নারানকে তাতাতে লাগল। বিশেষ অধরা।
কিন্তু লখাইয়ের মুখে শোকের ছায়া দেখে জগদ্দলের নর-নারী একেবারে চুপ হয়ে গিয়ে প্রমাণ করে দিল, মানুষের মন কত বিচিত্র। কিন্তু একদল স্পষ্টই বলে বেড়াতে লাগল, শ্যাম-নারান দু ভাইকে ঘরছাড়া করে ভিটে দখল নিয়ে বসল লখাই। ধূমকেতুর আবির্ভাব এমনি বটে।