০৪. কলার ভেলার ওপর শবদেহ

কলার ভেলার ওপর শবদেহটি ভাসতে ভাসতে চলল। কখনও আটকে যায় কচুরিপানায়। কখনও সাহেবদের কলের জাহাজ ভোঁ বাজিয়ে গেলে বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় সরে যায় পাড়ের দিকে।

পরের দিন সন্ধ্যাকালে সেই কলার ভেলা এসে ঠেকল একটা মস্ত বড় গাছের শিকড়ে। সেখানে নদীর পাড় ভাঙছে, গাছটির গুড়ির কাছেই ছলাৎ ছলাৎ করছে ঢেউ।

পাশেই একটা গ্রাম্য ঘাট। সেই ঘাটে সারাদিন পুরুষরা এলেও সন্ধের সময় শুধু নারীরাই জল সইতে আসে।

ঘাট মানে তিনখণ্ড তালগাছের গুড়ি ফেলা। তিনজন রমণী সেই ঘাটে দেহ প্রক্ষালন করছে। গ্রামটি মুসলমান-প্রধান। দিনমানে রমণীরা ঘাটে আসে না।

রমণীরা নিজেদের মধ্যে কলস্বরে কথা বলছিল, হঠাৎ যেন তারা কাছেই। উঃ শব্দ শুনতে পেল।

সঙ্গে সঙ্গে কথা থামিয়ে তারা উৎকর্ণ হল।

কয়েক মুহূর্ত পরেই তারা আবার পরিষ্কার শুনতে পেল উঃ। খুব কাছেই, পুরুষের কণ্ঠ।

দুজন রমণী সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে দৌড় দিল আলুথালুভাবে। একজন দাঁড়িয়ে রইল, তার নাম রাবেয়া খাতুন, তার বিশেষ ভয়ডর নেই। ভয়ের চেয়েও তার কৌতূহল প্রবৃত্তি বেশি।

আরও কয়েকবার অস্ফুট শব্দ শুনে সে পাড়ে উঠে বটগাছটির কাছে গিয়ে। দেখতে পেল কলার ভেলাটাকে। তার ওপরে একজন মনুষ্য শয়ান।

রাবেয়া এই গ্রামে ধাইয়ের কাজ করে। কোনও কোনও গুরুতর রুগ্ণ মানুষের সেবার জন্যও ডাক পড়ে তার। সে মৃত ও অর্ধমৃত মানুষ দেখায় অভ্যস্ত। সে বুঝতে পারল, এই দেহটির মধ্যে এখনও প্রাণ ধুকপুক করছে। চেষ্টা করলে হয়তো বাঁচানো যায়।

কিন্তু কলার ভেলা থেকে সে মানুষটাকে তুলবে কী করে? একার পক্ষে তো সম্ভব নয়।

সে তখন উচ্চস্বরে ডাকতে লাগল ও খাদিজা, ও ফতিমা, তোরা ফিরে আয় রে, ভূত-জিন কিছু না। একজন জিন্দা মানুষ।

কয়েকবার ডাকেও তারা ফিরল না, সাড়াও দিল না। কিন্তু অন্য তিনজন রমণী এল কিছু না-জেনে। রাবেয়ার কথা শুনে তারা ধরাধরি করে মানুষটাকে তুলল। তার আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। সর্বাঙ্গে মারি-গুটির চিহ্ন।

একজন বলল, জিন্দা না মুদা? ও রাবেয়া, এরে নিয়ে কী করবি? রাবেয়া সেই দেহের নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে বলল, দ্যাখ, এখনও শ্বাস আছে। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। এরে আমি ঘরে নিয়ে যাব।

আর একজন বলল, কোন জাতের মানুষ কে জানে। রাবেয়া বলল, আল্লার জীব তো বটে। রাবেয়ার পীড়াপীড়িতে অন্য নারীরা ধরাধরি করে মৃতবৎ পুরুষটিকে পৌঁছে দিল রাবেয়ার কুটিরে। বেশি দূর নয়, কাছাকাছি এক তালপুকুরের। পাশে।

রাবেয়ার এক পুত্র ও কন্যা, তার স্বামীও বেঁচে আছে। কিন্তু সে থাকে তার তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে অন্য গ্রামে। মেয়েটির শাদি হয়েছে আজিমগঞ্জে, ছেলে। চলে গেছে খুলনা। রাবেয়া নিজেই নিজের পেট চালায়।

পুরুষটি দু-তিনবার মাত্র যন্ত্রণার শব্দ করেছে। তারপর আর তার নড়াচড়া নেই। চোখও মেলেনি। সে বেঁচে আছে, না এর মধ্যে মৃত্যু ঘটে গেছে তাও বোঝা যায় না। রাবেয়ার বিশ্বাস সে বেঁচে আছে।

পানি গরম করে, তাতে ন্যাতা ভিজিয়ে মানুষটির সারা গা ভালো করে মুছে দিল সে। পুঁজ-রক্তে তার ঘৃণা নেই। এই মানুষটি কতদিন ধরে জলে ভাসছে, তাই-ই বা কে জানে!

রাবেয়ার নিজস্ব গোরু নেই, এককালে ছিল, সেই গোয়ালটি এখন শূন্য পড়ে আছে। সেখানেই সে শয়া পেতে দিল এই আগন্তুক রোগীর। এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে চেয়ে আনল এক বাটি দুধ। সেই দুধ গরম করে, তার মধ্যে পলতে ডুবিয়ে একটু একটু করে খাওয়াল মানুষটিকে।

তিনদিন ধরে চলল এরকম অক্লান্ত সেবা।

মানুষের সেবা করাও এক প্রকার নেশা। যাদের এই নেশা থাকে, তারা একজন মৃতপ্রায় মানুষকে বাঁচিয়ে তুলে যে-আনন্দ পায়, তার সঙ্গে আর কোনও আনন্দেরই তুলনা চলে না। কেউ কেউ আবার মানুষের ক্ষতি করে, মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে আনন্দ পায়। আর কেউ কেউ আনন্দ পায় নিঃস্বার্থ সেবায় কারুর জীবন ফিরিয়ে দিয়ে। দুনিয়াটা এইভাবেই চলছে।

প্রথম চক্ষু মেলে লালু অস্ফুট স্বরে বলল, মা। 

সেই স্বর শুনে খুশির আবেগে কেঁপে উঠল রাবেয়া। তার পরিশ্রম সার্থক। কোনওক্রমে আবেগ দমন করে সে বলল, আমি তোমার মা নই বাছা। তুমি আর একটু সেরে ওঠো, তারপর মায়ের কাছে যাবে।

ঘরে একটি রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলছে। তার অস্পষ্ট আলোয় লালু দেখল, তার সামনে ঝুঁকে আছে এক রমণীর মুখ। মানুষ চেনার ক্ষমতা নেই। লালু আবার বলল, মা!

রাবেয়া লালুর প্রায় মায়েরই বয়সি। আনন্দে তার চোখে জল এসে যাচ্ছে। সে বলল, পানি খাবে? তেষ্টা লেগেছে?

পরদিন সকালে লালু আস্তে আস্তে উঠে বসল। তার শরীরে এখনও অসহ্য ব্যথা, একটা চক্ষু খুলতে পারছে না, কিন্তু জীবনের স্পন্দন ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে ক্ষুধা বোধ। (৩)

রাবেয়া জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী বাছা?

 লালু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। নাম? তার মনেই পড়ল না সে কে। রাবেয়া আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার বাড়ি কোথায়? গ্রামের নাম কী?

লালু দুদিকে মাথা নাড়ল। তার কিছুই মনে নেই। তার অতীত ঝাঁপসা হয়ে গেছে।

একটু পরে সে বলল, আমার ক্ষুধা লাগে।

রাবেয়া বলল, আমি তো ভাত ফুটাচ্ছি। তোমার জাত-ধর্ম তত কিছু জানি না। এই কয়দিন ভাত খাইতে দিই নাই। আমার হাতের ভাত কি তুমি খেতে পারবে?

জাত বা ধর্ম কথাগুলির কোনও মর্মও বুঝল না লালু। সে আবার কাতর ভাবে বলল, আমার ক্ষুধা পাইছে।

রাবেয়া বলল, আহা রে! দুবলা মানুষ, ক্ষুধার সময় খাইতে না-দিলে গুনাহ হয় না?

একটা কলাইকরা শানকিতে সে খানিকটা ফেনা ভাত, বেগুন সেদ্ধ আর লবণ দিয়ে মেখে খেতে দিল লালুকে। লালু পরম তৃপ্তির সঙ্গে সেই অন্ন খেয়ে আবার একটা লম্বা ঘুম দিল।

আরও দিন তিনেক পরে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল লালু, উঠে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু শরীর বেশ দুর্বল। রাবেয়া তার সারা শরীরে হলুদ মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিল। গুটিগুলো খসে গেলেও গায়ে মুখে তার কালো কালো দাগ, বাঁ চোখটা খোলে না। হেঁটে বাইরে যাবার ক্ষমতা নেই। পূর্ব পরিচয় তলিয়ে গেছে বিস্মৃতিতে, সে যাবেই বা কোথায়?

রাবেয়াও তাকে নিজের আশ্রয়ে রাখতে মোটেই অরাজি নয়। আছে থাকুক না।

রাবেয়া স্বামী পরিত্যক্তা হলেও স্বাবলম্বী, সংসারে আর কেউ নেই, লালুর অসীম ভাগ্য যে, এরকম একজন দয়াবতী রমণীর নজরে পড়েছিল বলেই উদ্ধার পেয়েছে। পুরোপুরি সংসারী কোনও পরিবারের কেউই এমন একজন ছোঁয়াচে অসুখের মুমূর্ষ রুগিকে বাড়িতে আশ্রয় দিত না।

গ্রামের অনেকেই রাবেয়ার বাড়িতে এরকম একজন অতিথির কথা জেনে গেছে। তারা কেউ কেউ লালুকে দেখতে আসে। কিন্তু কথাবার্তা জমে না। লালু তো কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে না। শুধু মুখখানা হাসি-হাসি করে রাখে।

রাবেয়ার স্বামীর এক ফুফাতো ভাইও আসেন মাঝে মাঝে। তিনি একজন ফকির। তিনি গ্রামে গ্রামে, জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ান, কোনও এক জায়গায় স্থির বসতি নেই। এই অঞ্চলে এলে রাবেয়ার বাড়িতে দু-একদিন বিশ্রাম নিয়ে যান। তিনি এলে তার কাছ থেকে এই গ্রামের বাইরে যে-পৃথিবী, তার খবর পাওয়া যায় কিছু কিছু।

সবাই তাঁকে ফকির সাহেব বলে ডাকে। তিনি অবশ্য সহাস্যে বলেন, ফকির না ছাই! আমার কি জানবুঝ কিছু আছে? পড়া-লিখা জানি না। কোরান হাদিস পাঠ করি নাই, আল্লাহর কুতই বা কতটুকু বুঝি? ভ্যাক ধরছি, দাড়ি লম্বা করছি, মাইনষে ভয়-ভক্তি করে। বাড়িতে গ্যালে খাইতে দেয়। বেশিদিন থাকি না তো ওই জন্যই, যদি আমার বিদ্যা-বুদ্ধি ধরা পইড়া যায়।

এর মধ্যে ফকির এলেন একদিন রাবেয়ার বাড়িতে। রাবেয়া তাঁর পা ধুইয়ে দিয়ে আসন পেতে বসতে দিল দাওয়ায়। এই ফকিরের প্রতি তার খুব শ্রদ্ধা।

ফকির গ্রামে ঢুকলেই কিছু কিছু মানুষ তার পিছু নেয়। তারাও এসে বসে রাবেয়ার বাড়ির উঠোনে। ফকির তাদের খবরাখবর দেন। ফকিরের কাছ থেকেই গ্রামের মানুষ জেনেছে যে, টুপিওয়ালা সাদা চামড়ার মানুষগুলোই এখন রাজার জাত। মোগল-পাঠানদের আমল শেষ। এর মধ্যে দেশি সেপাইরা হঠাৎ একবার খেপে গিয়ে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিয়েছিল মালিক সাহেবদের দিকে। হিন্দু-মুসলমান সব এককাট্টা, তবে শেষ পর্যন্ত আর স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারেনি, সাহেবদের কামানের মুখে বিদ্রোহীরা সব ছাতু হয়ে গেছে।

কামান কী? কামান কেমন দেখতে?

ফকির একটা তালগাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ওই তালগাছের লাহান। লোহার, কিন্তু ভিতরে ফুটা। মইধ্যা থিকা ভলকে ভলকে আগুনের গোলা বাইরায়। শব্দে কান ফাটে।

এই বর্ণনা শুনে যার যা বোঝার বুঝে নেয়।

ফকির এমনিতে উপদেশ দেন না, তবে গান শোনান। তাঁর গানের গলা বেশ ভালো।

লালুকে দেখে, তার সব বৃত্তান্ত শুনে তিনি একটুক্ষণ মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, দ্যাখো, দ্যাখো, এই একজন খাঁটি মনুষ্য। এর নাম নাই, ঠিকানা নাই, জাতি, ধর্ম, কিছুই নাই। তাই এর কোনও হাঙ্গামাও নাই। খোদা যখন মানুষের সৃষ্টি করছিলেন, তখন হবা আর হাওয়ার কি কোনও জাইত-ধরম ছিল? কী সরল, সুন্দর জীবন ছিল তাদের, খোদা তো তাগো কোনও ধর্মে দীক্ষা দ্যান নাই।

একজন কেউ প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ফকির হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, রও, রও, তর্কে কাম নাই। আমার কথা মানতে না চাও মাইনন্যা না। শোনো, একখান গান শোনো।

সন্ধের পর আর সবাই চলে গেলে ফকির, রাবেয়া আর লালু একত্রে খেতে বসে।

রাবেয়া ফকিরকে জিজ্ঞেস করল, সাঁই, আপনে বলেন তো, এই মানুষটার আগামীতে কী হবে? কিছুই বোঝে না, কোনও কর্মই জানে না, আমার ওপর নির্ভর করে আছে। আমার এখানে যতদিন থাকে থাক, আমার আপত্তি নাই, আল্লার ইচ্ছায় খাওয়া জুটে যাবে, কিন্তু পুরুষ মানুষ, একটা কিছু তো করা লাগে! সারাজীবন তো এমন যাবে না!

ফকির হেসে বললেন, কে বলেছে, কোনও কর্মই জানে না? এই যে ভাতের গেরাস নিজেই মুখে তুলে নিতেছে, সে কি ওরে শিখাতে হয়েছে? সব তো ভুলে যায় নাই, না-হলে বস্ত্র পরে কেন? উলঙ্গ তো থাকে না। আগুনে কি হাত দেয়? কথা কইতেও জানে। এসবও কি কম জানা গো?

লালু অবাক হয়ে ফকিরের দিকে চেয়ে থাকে।

রাবেয়া বলল, আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কিছু অপরাধ করছি না ত? হয়তো কোথাও ওর মা-বাপ আছে, ভাই-বোন আছে, বউ ছেলে মেয়ে আছে, তারা কান্নাকাটি করে, অথচ ও আটক আছে আমার। কাছে। এতে কি আমার গুনাহ হয়?

ফকির বললেন, তুমি যা পুণ্য করেছ একে বাঁচিয়ে, তাতে তুমি যদি বেহেস্তে যেতে চাও, সোজা চলে যাবে, কেউ আটকাবে না।

রাবেয়া বলল, যদি কইলেন ক্যান? আপনি বেহেস্তে যেতে চান না?

ফকির বললেন, হিন্দুরা যারে কয় স্বর্গ, মোছলমানরা কয় বেহেস্ত, সে দুটাই আমার যে মনে হয় কারাগার। একবার গেলে আর বাহির হতে পারব না। থাক, আমার অত সুখে কাম নাই।

রাবেয়াও এবার হাসতে হাসতে বলল, আপনি কী যে বলেন, এমন। কখনও শুনি নাই।

ফকির বললেন, এই মানুষটার অতি কঠিন রোগ হয়েছিল। মাথাতেও চোট লেগেছিল কি না কে জানে! এ যখন কিছু কিছু জিনিস মনে রেখেছে, তখন অন্য বিষয়েও চৈতন্য ফিরে আসবে। পায়ে এখনও জোর হয় নাই, মাথায় জোর হবে কী করে? আরও দুই-চার দিন যাক।

এবার লালু জিজ্ঞেস করল, তারপর আমি কী করব? কোথায় যাব? ফকির বললেন, যেদিকে দুচোখ যায় ঘুরে বেড়াবে। দুনিয়ায় কি জায়গায় অভাব? পেটের ভাত জুটে গেলেই হল। সকলের আগে খুঁজে বার করতে হবে, তুমি কে? ভাইটি, মনে রেখো, সব খোঁজাখুঁজির মধ্যে বড় হল নিজেকে খোঁজা।

লালু বলল, আমি কে? খুঁজতে হবে।

ফকির বললেন, আর একটা কথা বলি। কখনও মানুষের সঙ্গে তর্ক করতে যেয়ো না। কোনও লাভ নাই। অনেকে যেন কুতর্কের দোকান খুলে বসে। যার যা বিশ্বাস সে তাই লয়ে থাকুক না। পাপ-পুণ্যও তো দেশে দেশে বদল হয়। তিব্বত নিয়মে যা পুণ্য, আমাগো নিয়মে তাই-ই পাপ।

রাবেয়া জিজ্ঞেস করল, তিবত কী?

ফকির বললেন, তিবত না, তিব্বত। ওই নামে এক দেশ আছে। সে-দেশে এক নারীর বহু পতি হয়। আর এই দেশে তা হল ব্যাভিচার। এখানে সেই নারীরে পিটায়ে মেরে ফেলাবে। অথচ সকলেই তো সমান মানুষ।

রাবেয়া বলল, আমরা তো অনেক মানুষের কথা জানি না। সাঁই, আপনি জানেন।

ফকির বললেন, ইতিউতি যাই, মানুষের মুখে নানান কথা শুনি। আমাগো এখন রাজা যে-দেশের মানুষরা সেই দেশের নাম বিলাত। সেখানকার রাজার যে রাজা, তার নাম কী জান? যিশু। খুব বড় অবতার। তিনি তাঁর শিয্যদের বলেছেন, গোরু আর শুয়ার দুটাই খেতে পার। তারা দিব্যি তাই খায়, লম্বা চওড়া চেহারা, লড়াইও করতে পারে। অথচ দ্যাখো, হিন্দু আর মোছলমান এই গোরু আর শুয়ার নিয়ে কত লাঠালাঠি আর নষ্টামি করে। অথচ সকলেই তো সমান মানুষ!

কথায় কথায় রাত বেড়ে যায়। একসময় সবাই শুয়ে পড়ে।

দুদিন পরে ফকিরের বিদায় নেবার পালা এসে গেল। এর মধ্যে লালু বেশ ন্যাওটা হয়ে গেল ফকিরের, তার মুখেও কিছু কিছু কথা ফুটেছে।

ফকির যখন নিজের পুটুলিটা কাঁধে তুলে নিলেন, সে ব্যাকুলভাবে বলল, ফকিরসাহেব, আমারেও আপনার সাথে নিয়ে চলেন।

ফকির বললেন, আমার সাথে যাবে, আমি তো সারাদিনই হাঁটি। পারবে? আচ্ছা দেখি তো।

একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে ওপরের একটা ডাল দেখিয়ে বললেন, এইটা ছোঁও দেখি।

ফকির নিজে লাফিয়ে লাফিয়ে তিনবার সেই ডালটা স্পর্শ করলেন। ফকিরের চেয়ে লালুর বয়স অনেক কম, কিন্তু সে ফকিরের মতন লাফাতেই পারল না। তৃতীয়বার বসেই পড়ল।

ফকির মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু, এখনও সব ঠিক হয় নাই। পায়ে জোর আসে নাই। আরও কয়েকদিন লাগবে। তারপর যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাইও।

লালু বলল, ফকিরসাহেব, আপনার সাথে কি আর দেখা হবে না?

ফকির বললেন, কোনওদিন হয়তো পথেই দেখা হয়ে যাবে। আর পরিপূর্ণ বর্ষার সময় ঘোরাঘুরি করা যায় না, তখন আমি কিছুদিন কুমারখালি গ্রামে থাকি। যদি কখনও সেখানে যাও, দেখা হতে পারে। আমি ফকির-টকির কিছু না। একসময় পালকি বইতাম। আমার নাম সিরাজ, তখন লোকে বলত সিরাজ কাহার। এখন বলে সিরাজ সাঁই। ধনী লোকেরা আমারে চেনে না, গরিব মানুষদের আমার নাম করে পুছলে আমার ঘর দেখায়ে দেবে। এসো তুমি।

হাঁটতে হাঁটতে সিরাজ সাঁই মিলিয়ে গেলেন পথের বাঁকে।

আবার লালু একা। রাবেয়াও প্রায়ই দিনেরবেলা বাড়ি থাকে না, লোকের। বাড়িতে ডাক পড়ে। লালুর জন্য খাদ্যদ্রব্য রেখে যায়।

একা একা কুটিরের মধ্যে লালুর আর মন টেকে না। সে একটু একটু বাইরে যায়। গুটি গুটি পায়ে নদীর ধারে গিয়ে বটগাছের তলায় বসে।

সারাদিন পুরুষরা এই নদীর ঘাটে স্নান করতে আসে। নদী দিয়ে নৌকো যায় অনেক। কতরকম মানুষ! বর্ষা নেমে গেছে, নদী এখন স্বাস্থ্যবতী, ওপার দেখা যায় না। অনেক নৌকোয় পাল তোলা থাকে। বাতাস যখন পড়ে যায়, তখন পাড় দিয়ে এক-একজন গুণ টেনে নিয়ে যায়।

সন্ধের পর পুরুষদের এখানে থাকতে নেই, তাও লালু জানে। সে তখন ঘরে ফিরে যায়। এখন সে গুনগুন করে গানও গায় আপন মনে। কুঁড়েঘরের ডান দিকে তালগাছে একটা ইস্টিকুটুম পাখি এসে ডাকে। দুদিক থেকে দুটো ঘুঘু সুর করে ডাকতে থাকে, ঠাকুর, গোপাল, ওঠো, ওঠো, ওঠো! এই ডাক তার চেনা লাগে!

কোনও বাড়ির কাজ থেকে ফিরে রাবেয়া রান্নাবান্না করে। লালু আগে থেকেই আলো ধরিয়ে বাসন মেজে রাখে। ঘরকন্নায়ও সাহায্য করে নানারকম।

রাবেয়া বলে, থাক, থাক, তোমাকে আর ঘর ঝাঁট দিতে হবে না। আমার নিজের ছেলেও তো আমারে কোনওদিন একটু কুটো নেড়েও সাহায্য করে নাই। নিজের সন্তান আমারে ছেড়ে দূরে চলে গেছে, আল্লা আমারে আর একটি সন্তান এনে দিয়েছেন।

একদিন লালু নদীর ধারে বসে আছে দুপুরবেলা। বহতা জলের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার চোখে একটু একটু তন্দ্রা এসে যায়। ভাঙা ভাঙা স্বপ্নের মধ্যে সে দেখতে পায় দূরের কোনও দেশ, অচেনা মানুষ। কোনও নৌকো থেকে ভেসে আসে মাল্লাদের গান।

একটা নৌকো এসে ভিড়ল এই ঘাটে। একজন কেউ সেই নৌকো থেকে তড়াক করে লাফিয়ে নেমে ছুটে গেল ঝোপঝাড়ের দিকে।

এটা একটা যাত্রাদলের বেশ বড় আকারের নৌকো। দলের অধিকারী স্থূলকায় তাহের দস্তিদার সামনের গলুইতে বসে হুঁকোয় তামাক খাচ্ছেন। বটগাছের গুঁড়িটার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আরে, এইডা আমাগো সেই লাউল্লা না?

ছইয়ের ভেতর থেকে গুপি বেরিয়ে এসে ফিমেল অভিনেতার কণ্ঠে বলল, হ, আমাগো লালুই তো। এই লালু। তুই এখানে বইয়া কী করো?

লাউল্লা, লালু এই শব্দ দুটো শুনে লালুর মাথার মধ্যে ঝনঝন করে উঠল। খুব চেনা! এ তো তারই নাম। আর ওই তো তাহের ভাই, আর গুপি!

স্মৃতির রহস্য বোঝা ভার। কেনই বা অ লোপ পেয়েছিল আর কেনই বা তা অকস্মাৎ ফিরে এল, তা কে বলতে পারে।

লালুর সব মনে পড়ে গেছে।

যাত্রার দলটি অনেকদিন ধরে ভ্রাম্যমাণ। তারা লালুর বৃত্তান্ত কিছু জানে। ঘনবর্ষায় যাত্রাপালা বন্ধ, তাই এখন ঘরে ফেরার পালা।

তাহের লালুকে বললেন, গেরামে যাবি নাকি? আমাগো নৌকায় জায়গা আছে, যাইতে পারোস।

গুপি বলল, চল, চল। এহানে তোর কে থাকে?

লালু পড়ে গেল দোটানায়। মনশ্চক্ষে সে দেখতে পাচ্ছে তার মাকে, স্ত্রীকে, বাড়ির সামনে জম্বুরা গাছটিকে, উঁচু মাটির রাস্তা, তার একদিকে পাট। খেত, অন্য দিকে জলাভূমি, কখনও-সখনও সেই জলাভুমির মধ্যে দেখা যায় আলেয়া, এইসব তাকে টান মারছে। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে যেতে।

আবার মাতৃসমা রাবেয়াকেই বা ছেড়ে যাবে কী করে। সে তাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এ-ঋণ তত কোনওদিনও শোধ করা যাবে না।

যাত্রাদলের আরও কয়েকজন নৌকো থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙতে লাগল। গুপি জিজ্ঞেস করল, তোর বাসা কোথায় রে লালু? তুই বেড়াইতে। আইছোস না কাম-কাজ কিছু আছে?

গুপি আর তাহেরকে লালু নিয়ে এল রাবেয়ার কুটিরে। রাবেয়া আজ আর কাজে যায়নি, উঠোনে বসে বড়ি দিচ্ছিল, অতিথিদের বসাল দাওয়ায়।

লালু যখন বলল, এরা আমার গ্রামের মানুষ, রাবেয়া কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লালুর দিকে। এরকম কণ্ঠস্বরে লালুকে কখনও সে কথা বলতে শোনেনি।

সে তাহেরকে বলল, আপনারা অরে চেনেন? খুব ভালো হইল। এতদিন তো কোথায় অর বাড়ি-ঘর, কে আছে সংসারে, এমনকী নিজের নামও কইতে পারে নাই।

তাহের বললেন, কেন, ওর কী হইছিল?

রাবেয়া সংক্ষেপে সব জানাল। শুনতে শুনতে লালুর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল কান্নার ধারা। সে ধরা গলায় বলল, আম্মা, তোমারে ছেড়ে আমি। কোথাও যেতে পারব না!

রাবেয়া বলল, তা কি হয় বাছা! আমি তোেমারে কয়দিন মোটে পালছি। কিন্তু তোমার নিজের জননী পুত্রহারা হয়ে কত না কেন্দেছেন। তোমারে ফিরে পেলে তিনি আনন্দ সাগরে ভাসবেন। এরপর তোমারে এহানে ধরে রাখলে আমার পাপ হবে না?

গুপি বলল, অর মা আছে। ঘরে একখান কচি বউও তো আছে। অর বউ গোলাপি আমার বউয়ের মামাতো বইন।

রাবেয়া চোখ বড় করে বলল, হিন্দু? ও তো কিছু বলতে পারে নাই। আমার রান্না ভাত খাইছে।

তাহের বললেন, আপনে অরে জীবন দান করছেন। ভাত না খাইলে বাঁচত কেমনে? ভাত এমন চিজ, খোদার সঙ্গে উনিশ-বিশ।

এরপর রাবেয়া চক্ষের পানিতে বিদায় দিল লালুকে। সেও ফোঁপাতে ফোঁপাতে গিয়ে নৌকোয় উঠল।

ঘাটে দাঁড়িয়ে রইল রাবেয়া। নৌকো স্রোতে ভাসল, ক্রমশ রাবেয়া অস্পষ্ট

থেকে অস্পষ্টতর হয়ে গেল।

তাহের একটু পরে লালুর পিঠে একটা চাপড় মেরে বললেন, তোর তো জাইত গেছে রে লাউল্লা। মোছলমানের ভাত খাইছস মায়েরে গিয়া কী কবি?

গুপি বলল, মায়ের কাছে আবার সন্তানের জাত আছে নাকি? নে লালু, একটা গান গা, তাইলে কষ্ট কমবে।

বেশি অনুরোধ করতে হল না, লালু স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটা গান গেয়ে উঠল:

এ দেশেতে এই সুখ হল আবার কোথা যাই না জানি
পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা জনম গেল ঘেঁচতে পানি।
কার বা আমি কেবা আমার
আসল বস্তু ঠিক নাহি তার…

তাহের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার গান রে, কে রচেছে? লালু উদাসীনভাবে বলল, জানি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *