কলকাতা আসার মাস ছয়েক পরের কথা। সেদিন বাবার কোর্ট বন্ধ হলেও আমার স্কুল খোলা ছিল। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই দেখি বাবা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করছেন। আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মা, বাবা কার সঙ্গে অত গল্প করছেন?
মা হেসে বললেন, উনি ওর বন্ধু।
বাবার বন্ধু! আমি অবাক হয়ে বললাম।
হ্যাঁ। ওরা একসঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে ল পড়তেন।
এর আগে কী উনি আমাদের এখানে এসেছেন?
না। আজ ডাঃ রায়ের ওখানে হঠাৎ দুই বন্ধুর দেখা হয়েছে।
বাবার বন্ধুর কি নাম? হেমন্ত মজুমদার। উনিও কি প্র্যাকটিস করেন?
না। উনি একটা সাহেবী কোম্পানিতে ভালো চাকরি করেন।
তুমি ওকে আগে থেকেই চিনতে?
আমার বিয়ের পরই একবার শিয়ালদা দেখা হয়েছিল।
আমি স্কুলের কাপড়-চোপড় ছেড়ে খেতে বসলে মা বললেন, তোর বাবার কাছে শুনেছি হেমন্তবাবু খুব আমুদে লোক। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সারা ক্লাসের ছেলেদের জমিয়ে রাখতেন। আজ দেখে মনে হল, উনি সেই রকমই আছেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উনি থাকেন কোথায়?
বোধহয় এলগিন রোডের কাছাকাছি। একটু থেমে মা প্রায় আপন মনেই বললেন, ভদ্রলোক বিয়ে-টিয়ে না করে বেশ কাটিয়ে দিলেন।
খেয়ে-দেয়ে আমি আমার ঘরে যেতে না যেতেই বাবা ডেকে পাঠালেন। গেলাম। বাবা বললেন, আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম…
হেমন্তবাবু আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, এ ব্যাচেলার কাকু তোমারও বন্ধু।
আমি একটু নীচু হয়ে ওকে প্রণাম করতে যেতেই উনি তাড়াতাড়ি দুহাত দিয়ে আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, থাক, থাক, ও সব ফর্মালিটির দরকার নেই।
সেদিন কিছুক্ষণ গল্পগুজব করেই উনি চলে গেলেন। এর পর থেকে উনি মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। কখনও কখনও আমাকে নিয়ে এদিক-ওদিক বেড়াতেও যেতেন। সত্যি হেমন্তকাকুকে বেশ লাগত। ওরা একটা ছোট্ট মরিস এইট গাড়ি ছিল। স্কুলের গণ্ডী পেরুবার আগেই আমি ওর উৎসাহে গাড়ি চালানো শিখি। সত্যি, সেদিনের উত্তেজনার কথা ভুলব না। মনে হল হেমন্তকাকু যেন আমার হাতে আকাশের চাঁদ এনে দিলেন।
পরের বছর আমি কলেজে ভর্তি হবার পরই হেমন্তকাকু একদিন বার মার সামনে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বল কবিতা, কি চাই?
কী আর চাইব!
না, না, কিছু চাইতেই হবে।
অনেকবার বলার পরও যখন আমি কিছু বললাম না, তখন উনি বললেন, চল, তোমাকে পুরী ঘুরিয়ে আনি।
আমি কিছু বলার আগেই বাবা বললেন, আমিও ভাবছিলাম সবাইকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। কিন্তু ডাক্তার বারণ করছেন বলে বেরুতে পারছি না।
সঙ্গে সঙ্গে মা বললেন, আমরা যখন যেতে পারছি না তখন খুকি বরং ওর কাকুর সঙ্গে ঘুরে আসুক।
বাবা বললেন, তাতে আমার কি আপত্তি?
হেমন্তকাকু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, গাড়িতে যাবে? নাকি ট্রেনে?
মা বললেন, না, না, গাড়িতে অত দূর যেতে হবে না।
দিন কয়েক পর আমি হেমন্তকাকুর সঙ্গে পুরী রওনা হলাম। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখি। ফার্স্ট ক্লাস কুপে রিজার্ভ করা রয়েছে। মালপত্র রাখার পরই উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি কবিতা, ঠিক আছে তো?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমার কাকুর প্ল্যানিং-এ কী কোনো ত্রুটি থাকতে পারে?
উনি হাসতে হাসতে বললেন, আমি শুধু তোমার কাকু না, বাট অলসো ইওর ফ্রেন্ড।
আমি সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানালাম, দ্যাটস রাইট।
ট্রেন ছাড়ার তখনও দেরি ছিল। উনি বললেন, তুমি বস, আমি আসছি।
পনেরো বিশ মিনিট পরেই উনি দুটো সোডার বোতল নিয়ে আসতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ কী দু বোতল সোডা দিয়ে কী করবেন?
একটু চাপা হাসি হেসে হেমন্তকাকু বললেন, কেন? দুজনে খাব।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমার কি অম্বল হয়েছে যে সোডা খাব?
হেমন্তকাকু আর কিছু না বলে বাথরুম থেকে জামা-কাপড় বদলে নীচের বার্থে আমার বিছানা পেতে দিলেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী শাড়ি-টাড়ি বদলে নেবে?
হ্যাঁ। তাহলে যাও। বাথরুম থেকে ঘুরে এসো।
আমি বাথরুম থেকে আসতে আসতেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। কাকু আমার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললেন, এবার বস। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাক।
বসলাম।
এবার উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী এই প্রথম পুরী যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
তোমার সমুদ্র ভালো লাগে, না পাহাড়?
দু-ই, কিন্তু কোনোটাই দেখা হয়নি।
ঠিক আছে। এরপর তোমাকে নিয়ে দার্জিলিং বা সিমলা যাব।
আপনি খুব ঘুরে বেড়ান, তাই না কাকু?
উনি একটু হেসে আমার কাঁধের উপর একটা হাত রেখে বললেন, হাজার হোক ব্যাচেলার। সংসার-টংসারের ঝুট-ঝামেলা তো নেই। তাই সুযোগ পেলেই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ি।
সংসারের ঝামেলায় না জড়িয়ে পড়াই ভালো।
সে কী? তুমিও কী বিয়ে করবে না?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বিয়ে-টিয়ে করা আমার একটুও ভালো লাগে না।
তাহলে কি করবে?
কী আর করব? পড়াশুনা করার পর চাকরি করব।
একলা একলা থাকবে?
একলা থাকব কেন! বাবা মার সঙ্গে থাকব।
কিন্তু বাবা মা তো চিরকাল থাকবেন না।
তখন আর কি করব? একলাই থাকব।
বিয়ে না করে থাকতে পারবে?
খুব পারব।
উনি একবার ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হয় না তুমি বিয়ে না করে থাকতে পারবে।
আমি একটু অবাক হয়ে কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, পারব না কেন?
উনি হাসতে হাসতে আমাকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ের পক্ষে বিয়ে না করে থাকা খুব মুশকিলের।
আমি সুন্দরী?
কাকু চোখ দুটো বড় করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি সুন্দরী না?
মোটেও না।
একশোবার, হাজারবার তুমি সুন্দরী।
আপনার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই।
এ ব্যাপারে তর্ক না করাই ভালো।
কিন্তু সুন্দরী হলেই যে বিয়ে করতে হবে, এমন কোনো কারণ নেই।
কাকু চাপা হাসি হাসতে হাসতে বললেন, কারণ আছে।
কী কারণ?
ছেলেদের উৎপাতে পাগল হয়ে যাবে!
আমি লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, আমাকে কেউ উৎপাত করবে না।
ঠিক আছে। দেখা যাবে আমি ঠিক নাকি তুমি ঠিক।
দেখবেন।
.
কাকু হঠাৎ নেমে দাঁড়িয়েই বললেন, এবার শুরু করা যাক, কি বল?
কি শুরু করা যাক?
একটু আনন্দ।
আনন্দ? আমি অবাক হয়ে ওর দিকেই তাকাই।
হেমন্তকাকু অত্যন্ত সহজ ভাবে বললেন, দুজনে বেড়াতে যাচ্ছি একটু হুইস্কি খাব না?
মদ। আমি প্রথম চমকে উঠলাম।
উনি দুহাত দিয়ে আমার মখখানা তুলে ধরে বললেন, সারা পৃথিবীর লোক হুইস্কি খায়। হুইস্কি খাওয়া অন্যায় নয়, কিন্তু মাতাল হওয়া অন্যায়।
কিন্তু মদ খেলেই তো লোকে মাতাল হয়।
ডোন্ট সে মদ, সে হুইস্কি।
হুইস্কি খেলেও তো মাতাল হবে।
কোনো জিনিসই বেশি খাওয়া ভালো নয়। যে কোনো জিনিস বেশি খেলেই শরীর খারাপ হয়, তাই না?
হ্যাঁ।
বেশি হুইস্কি খাওয়াও খারাপ। প্রথম কথা মাতাল হবে, দ্বিতীয় কথা শরীর খারাপ হবে।
কিন্তু নেশা কি কেউ হিসেব করে করতে পারে?
সব ভদ্র শিক্ষিত লোকেই পারে।
আমি এবার দৃষ্টিটা নীচের দিকে করে নিজের মনে মনে ওর কথাগুলো ভাবি। দু এক মিনিট নিজের মনে মনেই তর্ক করি কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারি না।
এবার উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ভাবছ, কবিতা?
বিশেষ কিছু না।
আমার হুইস্কি খাবার কথা ভাবছ?
এবার আমি ওর দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা কাকু, আপনি হুইস্কি খান?
উনি মাথা নেড়ে বললেন, রাত্রে খাওয়া দাওয়ার আগে একটু খাই।
রোজ?
হ্যাঁ।
খাওয়া দাওয়ার আগে কেন খান?
তাতে শরীর ভালো হয়।
এবার আমি আবার ভাবি। কোনো প্রশ্ন করি না, কিন্তু উনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনোদিন আমাকে মাতাল হতে দেখেছ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না।
উনি এবার হাসতে হাসতে বললেন, আজ তো তুমিও একটু হুইস্কি খাবে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললাম, না না, কাকু, আমি ও সব খাব না।
উনি আবার দুহাত দিয়ে আমার মখখানা ধরে বললেন, আচ্ছা পাগলি মেয়ে! হুইস্কি খাবার নাম শুনেই প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়।
আমি একটু হেসে বললাম, মদ খেলে আমি মরেই যাব।
আর যদি না মরে যাও, তাহলে…
তাহলে মাতাল হব।
যদি মাতাল না হও।
তাহলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাব।
যদি তা-ও না হও?
মোট কথা, মারাত্মক কিছু হবেই।
কিছু মারাত্মক হবে না।
তবে কি মদ খাবার পরও আমি স্বাভাবিক থাকব?
একশোবার স্বাভাবিক থাকবে।
তাহলে মদ খেয়ে লাভ?
মনটা খুশিতে ভরে যাবে।
হেমন্তকাকু আর কথা না বলে হুইস্কির বোতল, ফ্লাস্ক, গ্লাস, সোডার বোতল নিয়ে বসলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, আমি একটু খাই?
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।
তোমার আপত্তি থাকলে আমি বাইরের প্যাসেজে দাঁড়িয়ে খেয়ে আসছি।
না, না, আপনি বাইরে যাবেন কেন? অসুবিধে হলে আমিই একটু বাইরে দাঁড়াব।
তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? তোমাকে বাইরে রেখে আমি এখানে বসে বসে ড্রিঙ্ক করব?
আমি বাইরে যাবই, তা তো বলছি না।
উনি একটা গ্লাসে হুইস্কি আর সোডা মিশিয়ে আমার মুখের সামনে ধরে বললেন, চিয়ার্স! ফর আওয়ার ফ্রেন্ডশিপ!
কাকু গ্লাসে চুমুক দিতেই আমি স্তম্ভিত হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।