করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কিসের কার্ড জহির?
জহির কোনো শব্দ করল না। মাথা নিচু করে ফেলল। নিজের বিয়ের কার্ডের কথা মুখ ফুটে বলা যায় না, লজ্জা লাগে। করিম সাহেব খাম খুলতে খুলতে বললেন, বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল?
জ্বি স্যার।
ঐ মেয়ে? মালিবাগ না কোথায় যেন থাকে বলছিলে?
যাত্রাবাড়িতে থাকে স্যার।
ও আচ্ছা যাত্ৰাবাড়ি। ভেরি গুড। খুবই খুশির সংবাদ।
মেয়ে স্যার ইন্টারমিডিয়েট পাস। হায়ার সেকেন্ড ডিভিশান পেয়েছে। পাঁচশ বিরাশি, ফোর্থ পেপার থাকলে ফার্স্ট ডিভিশান পেয়ে যেত। সায়েন্স গ্রুপ স্যার।
ভালো, খুবই ভালো। বিয়ে কবে?
সামনের মাসের বার তারিখ। এই মাসেই হত—এই মাসটা আসমানীর জন্ম মাস।
মেয়ের নাম বুঝি আসমানী? জ্বি। ডাকনাম বুড়ি। আদর করে ছোটবেলায় ডাকতে-ডাকতে বুড়ি নাম হয়ে গেল।
জহিরের হয়ত আরো অনেক কথা বলার ছিল। বলা হল না। করিম সাহেব সময় দিতে পারলেন না। তাঁর হাতে অনেক কাজ। জহিরের শার্টের পকেটে আসমানীর একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি। তার খুব ইচ্ছা স্যারকে ছবিটা দেখায়। সেই সুযোগ হল না। করিম সাহেব বললেন, দেখ তো জহির ইদ্রিস এসেছে কি-না? ওকে ক্যালকুলেটারের ব্যাটারি আনতে পাঠালাম। এখন খোঁজ নেই। এদের বিন্দুমাত্র রেসপনসিবিলিটি যদি থাকে।
জহির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ইদ্রিসের খোঁজে গেল। আসমানীর ছবি গত চারদিন ধরে সে পকেটে নিয়ে ঘুরছে। কাউকে দেখাতে পারছে না। কেউ দেখতে চাইলে দেখানো যায়। না চাইলে তো আর পকেট থেকে ছবি বের করা যায় না? তবু টিফিন টাইমে সদরুল সাহেবের সামনে পকেট থেকে কাগজ বের করার সময় এমনভাবে বের করল যে ছবিটা বেরিয়ে পড়ল। সদরুল সাহেব বললেন, বাহ্ সুন্দর মেয়ে তো! কে?
ব্যাস এই পর্যন্তই। একবার কে বলাতেই তো জহির হড়হড় করে সব বলে দিতে পারে না। চক্ষুলজ্জা আছে না?
কারোর কোনো উৎসাহ নেই। কেউ কিছু জানতে চায় না। বিয়ের কার্ডটা দেখেও কিছু বলে না।
জহির ভেবেছিল অফিসের সবাইকে দাওয়াত করবে। সেই ভাবনা বাতিল করতে হল। বৌভাত করবে; টাকা কোথায়? খাওয়াদাওয়া বাবদ আলাদা আট হাজার টাকা জমা করা ছিল। সেই টাকাটা এক মাসের কথা বলে টান্সপোর্ট অফিসার সদরুল সাহেব ধার নিলেন। পাঁচ মাস হয়ে গেল টাকাটা ফেরত পাওয়া যায় নি। এখন যদি না পাওয়া যায় তাহলে বৌভাত হবে না। সদরুল সাহেব কি দয়া করবেন? এ বিপদে টাকাটা তাকে ফেরত দেবেন?
জহির কার্ড আগাতে-আগাতে বলল, স্যার আমার বিয়ের কার্ড।
সদরুল সাহেব না দেখেই বললেন, ভেরি গুড।
জহির হাত কচলাতে-কচলাতে বলল,মুরুী কেউ নেই স্যার। আপনিই মুরুী। আসবেন।
আসব, অবশ্যই আসব। অফিসসুদ্ধ দাওয়াত করেছ নাকি?
জ্বী না স্যার। টাকাপয়সার টানাটানি, অল্প কয়েকজনকে বলেছি।
সদরুল সাহেব ফাইলে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়লেন। জহিরের দাঁড়িয়ে থাকা-না-থাকা এখন আর কোনো ব্যাপারই না। জহির ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার একটা ব্যাপারে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
সদরুল সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, পরে বললে হয় না? এখন খুব ব্যস্ত। ফাইল দিয়েছে দেড়টায়, বলেছে তিনটার মধ্যে ক্লিয়ার করতে—আরে আমি কি আলাউদ্দিনের দৈত্য নাকি?
জহির বলল, টাকাটার ব্যাপার মনে করিয়ে দেবার জন্য স্যার, বলেছিলেন বিয়ের আগে-আগে….
কিসের টাকা?
জহিরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। সদরুল সাহেব এসব কী কথা বলছেন।
জহির বলল, আপনি নিয়েছিলেন স্যার।
ও আচ্ছা, Now I recall, দেখি কী করা যায়, কাল একবার মনে করিয়ে দিও, কত নিয়েছিলাম যেন, আট? আমি দশ ম্যানেজ করে দেব। বিয়েশাদীতে টাকাপয়সা বেশি লাগে।
জহির বিশেষ ভরসা পেল না। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, কাল কখন মনে করিয়ে দেব স্যার? এগারটার দিকে?
আমার এম্নিতেই মনে থাকবে তবু ইন কেইস যদি ভুলে যাই? তুমি বরং সাড়ে দশটার দিকে মনে করিয়ে দিও।
পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় খবর নিয়ে জানা গেল সদরুল সাহেব আসেন নি। তিন দিনের ছুটি নিয়েছেন। ক্যাজুয়েল লিভ। জহিরের প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। বৌভাতের আইডিয়াটা বাতিল করা ছাড়া কোনো উপায় রইল না। কার্ড থেকে বৌভাত—আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারদুপুর দেড়টা—এই অংশ কেটে বাদ দিতে হচ্ছে। ওদের এগার শ টাকা এ্যাডভান্স দেয়া আছে। ঐ টাকা এখন ফেরত পাওয়া যাবে কি-না কে জানে। এ দেশে রিফান্ডেবল টাকা বলে কিছু নেই। যে টাকা একবার পকেট থেকে বের হয় সে টাকা আর ফেরত আসে না। জহির অফিস থেকে সদরুল সাহেবের বাসার ঠিকানা নিয়ে নিল। একবার যাবে ওদিকে। লাভ হবে না, তবুও যাওয়া।
অরুদের বাসাও ঐ দিকে, ওকেও একটা কার্ড দিয়ে যাওয়া দরকার। অরু অবশ্যি বিয়েতে আসবে না। সে এখন আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গে দেখা হয় এমন কোনো জায়গায় যায় না।
অরুরা থাকে সাত তলায়। উঠতে-উঠতে বুকে হাঁফ ধরে যায়, মাথা ঘুরতে থাকে। সবচে কষ্ট হয় যখন এর উঠবার পর দেখা যায় অরুরা নেই। আজ ছিল, কলিং বেল টিপতেই অরু দরজা খুলে দিল, বিরক্ত মুখে বলল, কি ব্যাপার? জহির বলল, সন্ধ্যাবেলা ঘুমুচ্ছিলে?
হ্যাঁ ঘুমুচ্ছিলাম। সন্ধ্যাবেলা ঘুমুনোযাবে না এমন কোন আইন নেই। জহির ভাই আপনি কোন কাজে এসেছেন, না লৌকিকতা?
আছে একটা ছোটখাট কাজ।
অরু হই তুলে বলল, কাজটা এখানে দাঁড়িয়ে সেরে ফেলা যায় না? ভেতরে ঢুকলেই আপনি কথাবার্তা বলবেন। শুধু-শুধু সময় নষ্ট। আমি দুরাত ঘুমুই নি।
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, ঘুমাও নি কেন?
সত্যি-সত্যি জানতে চান?
হ্যাঁ।
হাইড্রোজেন খেলেছি।
হাইড্রোজেন খেলেছি মানে? হাইড্রোজেন আবার কী খেলা?
আপনি বুঝবেন না। কী বলতে এসেছেন বলে চলে যান। আমার ঘুম কেটে যাচ্ছে।
ঘরে আর কেউ নেই?
না।
আমি বরং বসার ঘরে চুপচাপ বসে থাকি, তুমি ঘুমাও। ঘুম ভাঙলে কথা বলব।
কথা বলতেই হবে?
হ্যাঁ।
বেশ তাহলে বসুন।
জহির বসে আছে। অরু ঘুমুতে গেল। এটা যেন কোনো ব্যাপারই না। অরু খুব গোছানো মেয়ে, অথচ ড্রইংরুমের অবস্থা কী করে রেখেছে। মনে হচ্ছে এক সপ্তাহ ঝাঁট পড়ে নি। একটা মুরগির হাড় অসংখ্য লাল পিঁপড়া টেনে-টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সোফার সাদা কাপড়ে কে যেন চা ঢেলে দিয়েছে, যা ধোয়ার কোনো চেষ্টাই করা হয় নি। টেবিলের উপর একটি ইংরেজি পত্রিকা। সেই পত্রিকায় বিশালবা একটি তরুণীকে দেখা যাচ্ছে। তাকাতে খারাপ লাগে আবার চোখ ফিরিয়ে নিতেও ইচ্ছে করে না।
পুরোপুরি তিন ঘন্টা ঘুমুলো অরু। তিন ঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকা খুব কষ্টের। আবার অরুকে কিছু না বলে চলে যাওয়া যাচ্ছে না। অরুর শোবার ঘরের দরজা খোলা। জহির বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে আবিষ্কার করল—অরু শুধু একটা শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে। গায়ে ব্লাউজ বা কাঁচুলি কিছুই নেই। অরুর মতো মেয়ে এমন ভঙ্গিতে ঘুমুবে এটা কল্পনাও করা যায় না। জহির চেয়ার বদলে বসল যাতে অরুকে দেখতে না হয়।
ওমা সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সরি, অনেকক্ষণ ঘুমালাম। আরো অনেকক্ষণ ঘুমাতাম, মশা কামড়াচ্ছিল বলে ঘুসুতে পারলাম না। এমন মশা হয়েছে।
অরু জহিরের সামনের চেয়ারে বসে হাই তুলল। নিতান্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনার বিয়ে তাই তো? পকেটে কার্ড দেখে বুঝতে পারছি। এটা বলার জন্যই এসেছেন?
হুঁ। বলে চলে গেলেই হত। খামাখা কষ্ট করলেন। বিয়েটা হচ্ছে কবে?
বার তারিখ।
ভালো কথা। বিয়ে করুন। বিয়ে করে দেখুন একটা মেয়ের সাথে ঘুমুতে কেমন লাগে।
জহির হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। অরু এসব কী বলছে? ওর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে? হঠাৎ ঘুম থেকে উঠলে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। উল্টা-পাল্টা কথা মনে আসে।
জহির বলল, আজহার সাহেব কোথায়?
জানি না কোথায়।
কখন আসবেন?
তাও জানি না। আসবে হয়ত একসময়। আবার নাও আসতে পারে। মাঝে মাঝে সে আসে না। আগের স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমুতে যায়। ফরম্যাল ডিভোর্স তো হয় নি, রাত কাটাতে অসুবিধা নেই। আমাকেও ছাড়বে না ওর স্ত্রীকেও ছাড়বে না। আমও থাকবে আবার বস্তাও থাকবে, হি হি হি।
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, তোমার কি শরীর খারাপ অরু?
না গা একটু ভারি হয়েছে। এ ছাড়াও দুএকটা লক্ষণ দেখে মনে হয় কনসিভ করেছি। এখনো টেস্ট করি নি। আচ্ছা জহির ভাই!
হুঁ।
আমি আপনার সঙ্গে তুমি তুমি করে বলতাম, না আপনি আপনি করে বলতাম? আমি পুরোপুরি কনফিউজড বোধ করছি মনে পড়ছে না।
তোমার সঙ্গে আমার তেমন কথাই হত না।
দ্যাটস্ ট্রু।
তবে আপনি করেই বলতে, তুমি বলতে না।
তাও ঠিক। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে তুমি করে বলব। আপনার কি কোনো। অসুবিধা আছে?
জহির কী বলবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটার কি কোনো সমস্যা হয়েছে। বড় ধরনের কোনো সমস্যা? মাথা ঠিক আছে তো?
অরু হাসতে-হাসতে বলল, তুমি ডাকের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের ব্যাপার আছে, এই জন্যেই তুমি। এখন তুমি বললে কারো কিছু বলার নেই। কারণ আপনার তো বিয়ে হয়েই যাচ্ছে। আমার এখন কোন বন্ধু নেই জহির ভাই, একজন বন্ধুর দরকার।
জহির শংকিত গলায় বলল, আজহার সাহেবের সঙ্গে তোমার কি ঝগড়া চলছে?
মোটই না। সে তার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এখানে আসে, মাঝে-মাঝে হাইড্রোজেন খেলে। আমিও খেলি। ওরা হুইস্কি-টুইস্কি খায়। আমি দেখি, ভালোই লাগে।
কী বলছ ওসব?
আহা সবদিন তো খায় না। এসব খেতে পয়সা লাগে। এত পয়সা পাবে কোথায়? একেকটা বোতলের অনেক দাম। সাত শ মিলিলিটারের একটা বোতলের দাম আট শ নশ পড়ে যায়। ব্ল্যাক লেভেল হলে তো কথাই নেই।
জহির ভয়ে-ভয়ে বলল, অরু তুমি নিজেও কি হুইস্কি-টুইস্কি খাও?
অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মাঝে-মাঝে খাই। এমন কোনো মজাদার কিছু না। তবে খানিকটা খেলে কী হয় জানেন, খালি কথা বলতে ইচ্ছা করে। তখন বেশ মজাই লাগে। এই যে আপনার সঙ্গে এত কথা বলছি এর কারণ কি জানেন? আপনি আসার আগে-আগে আধ গ্রাস হুইস্কি খেয়েছি। আধ গ্রাস মানে কত পেগ জানেন? এবাউট ফোর। আপনি তো নিতান্তই বোকা তাই গন্ধ থেকে কিছু টের পান নি।
জহির পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। অরুর সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় না। শেষ। দেখা তিন মাস আগে। এই তিন মাসে এই অবস্থা? আজহার সাহেবের সঙ্গে তার কি বনিবনা হচ্ছে না? এই অবস্থায় অরুর কি উচিত না…
জহির ভাই?
হুঁ। আচ্ছা, আজহার সাহেব সাধারণত কটার দিকে আসেন?
ঠিক নেই। মাঝে-মাঝে অনেক দেরি করে। আবার মাঝে-মাঝে আসেও না। আজ মনে হচ্ছে আসবে না। আজ এই বাড়িতে একা-একা থাকব।
একা-একা থাকতে ভয় লাগে না?
ভয় লাগলেইবা কী করব? আপনি কি থাকবেন আমার সঙ্গে? আছে আপনার এই সাহস? না নেই। রাত আর একটু বাড়লেই আপনি বিদেয় হবেন।
আপনি কি মনে করেন আমি বুঝতে পারি না। কেন আপনি ঐ চেয়ারটি পাল্টে এই চেয়ারে বসেছেন? যাতে আমাকে এলোমেলো অবস্থায় দেখতে না হয়। আপনি কি ভাবছেন আপনার এই আচরণের কারণে আপনাকে আমি অতি ভদ্ৰ, অতি ভালো একজন মানুষ বলে ভাবছি? মোটেই না। আমি আপনাকে ভাবছি সাহস নেই একজন মানুষ হিসাবে। আপনার মতো সাহস নেই মানুষ যেমন আছে আবার খুব সাহসী মানুষও আছে। জহির ভাই, আপনি কি একজন সাহসী মানুষের গল্প শুনবেন?
আজ বরং উঠি। আজ মনে হচ্ছে তোমার শরীরটা ভালো না।
আজ আমার শরীর খুবই ভালো আছে। সাহসী মানুষের গল্পটা আপনাকে বলি, আপনি শুনুন। একদিন হল কি, ওরা কয়েকজন মিলে তাস খেলছে। আমি রান্নাঘরে ওদের জন্যে চা বানাতে গিয়েছি। তখন ওর এক বন্ধু এসে বলল, দিয়াশলাই দিন তো ভাবী।
দিয়াশলাই দিলাম। সে সিগারেট ধরালো। তারপর বলল, ভাবী আপনার পেটে ঐটা কি কাটা দাগ? মাই গড! কী করে কাটল? বলেই নাভীর উপর হাত দিল।
জহির স্তম্ভিত হয়ে বলল, তুমি কী করলে?
আমি বললাম, আমার হার্টের কাছাকাছি এর চেয়েও গভীর একটি ক্ষতচিহ্ন আছে। একদিন আসবেন আপনাকে দেখাব।
জহির হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আজহার সাহেব ঢুকলেন। হাতে বাজারের ব্যাগ। বাজারের ব্যাগের ভেতর একটি ইলিশ মাছ উঁকি দিচ্ছে বেশ কিছু আনাজপাতিও দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, আরে জহির সাহেব আপনি! কখন এসেছেন?
অনেকক্ষণ।
বিয়ের খবর দিতে এসেছেন, তাই না?
হ্যাঁ।
অরুকে কি আপনার স্ত্রীর ছবি দেখিয়েছেন?
অরু বিরক্ত গলায় বলল, জহির ভাই বুঝি স্ত্রীর ছবি নিয়ে ঘুরছেন।
অফকোর্স, সমস্ত পুরুষ যখন বিয়ের দাওয়াত দিতে যায় তখন তাদের বুক। পকেটে থাকে স্ত্রীর ছবি। জহির সাহেব ছবি বের করুন। ওয়ান-টু-থ্রি।
জহিরের মানুষটাকে পছন্দ হচ্ছে।
এতক্ষণ অরুর সঙ্গে কথা বলে বুকের মধ্যে কেমন আতংক ধরে গিয়েছিল। এখন আর সেই আতংক সে বোধ করছে না। মনে হচ্ছে অরুত্র অনেক কথাই বানানো। মেয়েরা অনেক কিছু বানায়। অরুর মুখও কেমন হাসি-হাসি দেখাচ্ছে।
আজহার বলল, কী ভাই ছবি দেখান।
জহির ছবি বের করল।
অরু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, মেয়েটা কি সত্যি এত সুন্দর?
আজহারের দিকে ছবিটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, দেখ দেখ একটা পারফেক্ট ছবি। এ পারফেক্ট ফেস।
আজহার দেখল।
হাসতে-হাসতে বলল, হ্যাঁ পারফেক্ট ফেস তো বটেই তবে চিবুকের তিলটা আমার মনে হয় বানানো। যে ফটোগ্রাফারের দোকানে তোলা হয়েছে সেই ফটোগ্রাফার নিজেই এটা বসিয়ে দিয়েছে। যেখানে তিলটা প্রয়োজন প্রকৃতি বেছে-বেছে ঠিক সেইখানেই তিল দিয়েছে এটা বিশ্বাস করা শক্ত।
যুক্তি শুনে জহির মুগ্ধ হয়ে গেল। আজহার সাহেব মানুষটাতো অসম্ভব বুদ্ধিমান।
জহিরকে রাতের খাবার খেয়ে তারপর আসতে হল। আজহার সাহেব ছাড়লেন না। বললেন, আপনার বোনের রান্না যে কত খারাপ এটা টেস্ট না করে আপনাকে যেতে দেব না।
খাওয়ার টেবিলে আজহার সাহেব মজার-মজার গল্প বলতে লাগলেন। একটি গল্প রামকৃষ্ণ পরমহংসের। বানর-শিশু এবং বিড়াল-শিশুর গল্প। জহিরের খুব ভালো লাগল। আহা এই মানুষটা কত কিছু জানে। অরু কি গল্প শুনেশুনেই লোকটির প্রেমে পড়েছিল? শুধুমাত্র গল্প বলেই কি কেউ কাউকে ভোলাতে পারে?
নিশ্চয় পারে। না পারলে এই লোক কী করে ভোলালো? আধুবুড়ো একজন মানুষ। চুলে পাক ধরেছে। একটি চোখ ছোট আর একটি চোখ বড়। ঠোঁট দুটি ভারি। দাঁত অসমান। কিন্তু কথা যখন বলেন মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। কত রকম ক্ষমতাই না মানুষের থাকে।
জহির সাহেব।
জ্বি।
অরুর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনার জীবনের দুটি নাকি উদ্দেশ্য?
জহির অবাক হয়ে তাকাল। এ রকম কথা সে কখনো শোনে নি।
আজহার সাহেব বললেন, শুনলাম প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যের সেবা করা এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল অন্যের কাছ থেকে কোনো সেবা না নেয়া। এই যে এখন বিয়ে করছেন। আপনি কি আপনার স্ত্রীর কাছে থেকে কোনো সেবা নেবেন না?
অরু বিরক্ত গলায় বলল, খামাখা বক-বক করবে না। কথা বলার জন্যেই শুধু কথা বলা এটা আমার খুব অপছন্দ।
সরি। আচ্ছা জহির সাহেব?
জ্বি।
আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি?
জ্বি করুন।
মজার ধাঁধা। এ দেশেরই একজন নৃপতির নাম বলুন যিনি সিংহাসনে বসেই হুকুম দিয়েছিলেন– যার গায়ে সামান্যতম রাজরক্ত আছে তাকে যেন হত্যা করা হয়। তিনি এটা করতে চাইলেন নিষ্কণ্টক করার জন্যে। তাঁর হুকুম অক্ষরে-অক্ষরে পালন করা হল। রক্ত-গঙ্গা বয়ে গেল। রাজা তখন প্রধান সেনাপতিকে বললেন, এমন কেউ কি আছে এখনো যার দেহে রাজরক্ত প্রবাহিত? প্রধান সেনাপতি বললেন–আপনার নিজের গায়ে রাজরক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, কাজেই আমি আপনার হুকুম মতোই আপনাকেও হত্যা করব। এই কাজেই এসেছি–বলেই প্রধান সেনাপতি রাজাকে হত্যা করলেন এবং যোষণা করলেন পৃথিবীতে আর রাজরক্ত বলে কিছু নেই। এখন জহির সাহেব আপনি বলুন ঐ রাজার নাম কি? এবং ঐ সেনাপতির নামইবা কি?
আমি জানি না। এ রকম অদ্ভুত গল্প আমি আজ প্রথম শুনলাম। রাজার নাম কি?
তা বলব না। আপনি খুঁজে বের করুন। এ রকম মজার মজার গল্প বলে আমি মানুষকে ইতিহাসের দিকে আকৃষ্ট করি। আমার টেকনিকটা চমৎকার না?
জ্বি চমৎকার।
খাওয়াদাওয়ার পর আজহার জহিরকে নামিয়ে দিতে চললেন। সাততলা ভেঙে নিচে নামার কোন দরকার নেই তবু তিনি যাবেনই। অরু বলল, জহির ভাই ওকে আপনার সঙ্গে যেতে দিনও সম্ভবত আপনাকে কিছু বলতে চায়। নয়ত ওর মতো অলস লোক সিঁড়ি ভাঙত না।
রাস্তায় নেমে আজহার বলল, সিগারেট খাবেন জহির সাহেব? যদি খেতে চান দুটি সিগারেট কিনুন। ডাক্তার আমার জন্য সিগারেট নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কাজেই আমি এখন নিজে সিগারেট কিনি না। অনন্য দিলে খাই। জহির দুটা সিগারেট কিনল।
জহির সাহেব?
জ্বি।
অরুর কাছ থেকে যা শুনেছি তাতে মনে হয় আপনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন। না। কথাটা আশা করি মিথ্যা না।
মিথ্যা বলার দরকার পড়ে না। দরকার পড়লে হয়ত বলব।
আসুন আপনার সঙ্গে একটু হাঁটি। হাঁটতে-হাঁটতে কথা বলি।
বলুন।
অরুর সঙ্গে আপনার কি খুব অন্তরঙ্গতা ছিল?
জ্বি না।
আজহার সিগারেটে একটি দীর্ঘ টান দিয়ে বললেন, জহির সাহেব, ওর সঙ্গে। আপনি কি কখনো ঘুমিয়েছেন?
আমি আপনার কথা বুঝলাম না।
না বোঝার মতো আমি তো কিছু বলছি নাHaveyou made love with her?
জহির চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। আজহার সাহেব অল্প হাসলেন। হাসতে-হাসতেই বললেন আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি এই জিনিস কখনো ঘটে নি। অরু কিন্তু আমাকে বলে। সম্ভবত আমাকে হার্ট করতে চায় বলেই বলে। আমি অবশ্যি সহজে হার্ট হই না। শারীরিক শুচিতা নিয়ে আমার খুব মাথাব্যথা নেই। আমার চেহারাটা ওল্ড ফ্যাশানড় তবে আমি মানুষটা ওল্ড ফ্যাশানড় নই। Iama modem man, জহির সাহেব।
জ্বি।
আপনি যখন ওদের বাসায় থাকতেন, কোথায় থাকতেন?
ওদের বসার ঘরে।
ভেতর থেকে ঐ ঘরের দরজা বন্ধ হয় না—তাই না?
জ্বি।
অরু সেই কথাই বলছিল। তার বর্ণনা, তার বলার ভঙ্গি সবই এত বিশ্বাসযোগ্য যে…আপনি কি বাসে যাবেন? যদি বাসে যান তাহলে এটাই বাসস্ট্যান্ড। বাসের জন্য অপেক্ষা করুন। আমি তাহলে যাই। আমি আপনার বিয়েতে থাকব। I will be there, অরু আসবে কি-না আমি জানি না।