দিনে দিনে মাস কাটিয়া গেল। মাসে মাসে বৎসর পূর্ণ হইল। কামিনী একাগ্ৰ চোখে মেয়ের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াছিল, এইবার তাহার মনে হইল, কমলকোরক দিনে দিনে ক্রমশ পূর্ণ-প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল। কমল আজ পূর্ণ যুবতী। পূর্ণতার গভীর্যে সেই চাপা চাপিলটুকু যেন ঈষৎ ভারাক্রান্ত। আপনার দিকে চাহিয়া কমলিনী আপনি আপনাকে একটু মন্থর করিবার চেষ্টা করে। কিন্তু স্বভাবের চটুলতাও ভোলা যায় না। মৃণালের বৃন্তে কমলদলের মত মধ্যে মধ্যে সে হেলিয়া দুলিয়া ওঠে। সে চটুল –লজ্জার রূপ অপূর্ব রসিকদাস সে রূপ দেখিয়া বিভোর হইয়া পড়ে। মাঝে মাঝে সে গুনগুন করিয়া গান ধরিয়া দেয়—
ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি
অবনী বহিয়া যায় রে-অবনী বহিয়া যায়।
কমল ভ্রূকুটি করিয়া বলে, বলি-বয়স হল কত?
রসিক একগাল হাসিয়া উত্তর দিল, ভোমরা বয়েস মানে না। রাইকমল! আমরণ ফুলের রূপের বন্দনা গেয়েই বেড়ায়।
কমল ঝঙ্কার দিয়া ওঠে, বেশ, তুমি থাম মহান্ত।
আজ পরম কৌতুকে হাসিয়া ওঠে রসিকদাস। তাহার সে হাসি আর থামিতে চায় না।
রসিকের হাসি মিলায় না। সে বলে, আমি না হয় থামছি। কিন্তু তুমি ‘মহান্ত’ নামটি ছাড় দেখি।
কমলিনীর লাজরক্ত রোষদৃপ্ত অধরে হাসির রেখা দেখা দিল। চাপা হাসিতে মুখ ভরিয়া সকৌতুকে সে বলিল, কেন, তুমি মহান্ত নাও নাকি?
খুব জোরে মাথা নাড়িয়া মহান্ত বলিল, না।
তবে তুমি কি?
রসিক বলিল, আমি রাইকমলের বগ-বাবাজী।
এবার কমল মুখে কাপড় চাপা দেয়। মুখের চাপা কাপড় ঠেলিয়া তরুণীকণ্ঠের অবাধ্য হাসি জলকলধ্বনির মত বাহির হইয়া আসে।
সঙ্গে সঙ্গে অবাধ্য বাউল গানটির পাদপূরণ করে–
ঈষৎ হাসিয়া তরঙ্গ-হিল্লোলে
মদন মূরছা যায় রে-মদন মূরছা যায়।
কামিনীর দুইটি ইচ্ছা ছিল-কমলের বিবাহ এবং নবদ্বীপের পুণ্যভূমি গৌরচন্দ্রের চরণাচ্ছায়ায়, গঙ্গার কোলে চিরদিনের মত চোখ বুজিয়া শেষশয্যা পাতা।
ইদানীং সে মেয়ের বিবাহের আশা ছাড়িয়া দিয়া কামনা করিত শুধু নবদ্বীপচন্দ্রের চরণাশ্ৰয়। তাহার সে ইচ্ছা অপূর্ণ রহিল না, হঠাৎ সে মারা গেল। নবদ্বীপেই দেহ রাখিল। হয় নাই বেশি কিছু। সামান্য জুর, তাও বেশি দিন নয়–চার দিন।
কামিনী সেটা বুঝিতে পারিয়াছিল। শেষের দিন সে বলিল, মরণে আমার দুঃখ নাই মহান্ত। গোরাচাঁদের চরণে মা-গঙ্গার কোলে এ আমার সুখের মরণ। তবে–
রসিক বাধা দিয়া বলিল, মিছে ভাবিছ কেন রাইয়ের মা, কি এমন হয়েছে তোমার?
ঈষৎ হাসিয়া কামিনী বলিল, হয়েছে সবই মহান্ত, তোমরা বুঝতে পারছি না, আমি কিন্তু মরণের সাড়া পাচ্ছি। আমার কি মনে হচ্ছে জান? আমি যেন তোমাদের হতে দূরে—অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। কথা বলছ তোমরা, আমি যেন শুনছি। অনেক দূর হতে। শোন, মরণে আক্ষেপ নাই, শুধু মেয়ের ভাবনা আমার মহান্ত। কমলির আমার কি হবে মহান্ত?
চোখের জলে রসিকের বুক ভাসিয়া গেল। সে বলিল, ভেবো না তুমি রাইয়ের মা। তাই যদি হয়, তবে তোমার কমলের ভার আমি নিলাম।
কামিনীর মুখে হাসি দেখা দিল। সে বলিল, সে আমি জানি মহান্ত। কই, কই কমলি আমার কই?
পাশেই কমলিনী বসিয়া নীরবে কাঁদিতেছিল। মায়ের বুকে মাথা রাখিয়া সে অবরুদ্ধ স্বরে ডাকিল, মা।
অবশ হস্ত মেয়ের মাথায় রাখিয়া কামিনী হাসিতে হাসিতেই বলিল, কাঁদিস কেন রে বুড়ো মেয়ে? মা! কি চিরদিন কারও থাকে?
কমলিনী তবুও কাঁদিল। বহুকষ্টে অবশ হস্তখানির একটি স্পর্শ মেয়ের এলানো চুলের উপর টানিয়া দিয়া মা বলিল, শোন, কাঁদিস না। যাবার সময় নিশ্চিন্ত কর।
কমলি বলিল, বল!
শোন, যে লতা গাছে জড়ায় না, সে চিরদিন ধুলোয় গড়াগড়ি যায়। জানোয়ারে মুড়ে খায় তার–
কমল বাধা দিয়া বলিল, কষ্ট হচ্ছে মা তোমার?
না। তা ছাড়া, মানুষের মুখে বড় বিষ, ওরে কলঙ্কের বিষে রাধার সোনার অঙ্গ পুড়ে গিয়েছিল। না, সে তুই সইতে পারবি না। আমায় কথা দে তুই।
সে হাঁপাইতেছিল।
কমল বলিল, কেন মা? দেবতার হাতে দিয়ে যেতে কি তোর মন সরছে না?
দরদরধারে কামিনীর চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। বার বার ঘাড় নাড়িয়া সে বলিল, না। কমলি, আমায় নিশ্চিন্ত কর। বল, কথা দে।
মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া এবার কমল বলিল, বিয়ে করব মা।
কামিনী একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আঃ!
তারপর সে দুইটি কথা কহিয়াছিল। একসময় বলিল, বাপ-মায়ের ছেলে কেড়ে নিস না যেন।
হাসিয়া কমল বলিল, না মা।
মহান্ত তখন নাম আরম্ভ করিয়াছে, জয় রাধে রাধে—
কামিনী বলিল, গোবিন্দ গোবিন্দ!
ওই শেষ কথা।
ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি
অবনী বহিয়া যায় রে-অবনী বহিয়া যায়