০৪. কথাটা সালমার কানে এলো সন্ধ্যায়

কথাটা সালমার কানে এলো সন্ধ্যায়। সারাদিন রুবা ভাবির বাসায় কাটিয়েছে ও। রুবা ভাবি কিছুতেই ছাড়েনি। কতকিছু বেঁধে খাওয়ায় ওকে। কোলের ছেলেটা বছর দেড়েকের। আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। রুবা ভাবির চোখে-মুখে চাপা খুশি। ও অবাক হয়। একটুও কি ক্লান্তি নেই রুবা ভাবির? কেমন করে পারে?

কথাটা শুনে তুই রেগে যাবি সালমা, তবু না বলে পারছি না–কথাগুলো বলার সময়ে রুবা ভাবিকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল। সালমা একটু ঈর্ষা নিয়ে দেখছিল আর মুখটা গম্ভীর করে বলেছিল, শূন্যস্থান পূর্ণ করে পারলে না?

রুবা ভাবি হেসে মাথা নেড়েছিল। সালমা অনেকক্ষণ রাগে কথা বলতে পারিনি। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়েছিল। সারা দুপুর দুজন অনেক গল্প করেছিল। কত আবোল-তাবোল কথা। রুবা ভাবি বলেছিল, তোর গায়ে একটা আলগা সুগন্ধি আছে সালমা। তুই কী মাখিস?

কিছু না। তোমার যত পাগলামি।

রুবা ভাবি একটু যেন অস্বাভাবিক আচরণ করেছিল। সালমাকে জড়িয়ে চুমু দিয়েছিল। খুশির উচ্ছ্বাসটা বেশি বলে সালমার রাগও হয়েছিল। কিন্তু তবু রুবা ভাবির ওপর রাগ করতে পারেনি ও। রাগ করে লাভ নেই। রুবা ভাবি এমনই।

সন্ধ্যার সময় বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে খবরটা ওকে দিয়েছিল সাকিব।

জানিস দিদিভাই, বাবা না প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছে।

কী কারণে?

ওই যে দর্শনের ওপর লেখা বাবার বইটার জন্য।

তাহলে আর কি, খুশিতে লাফা।

তুই খুশি হোসনি?

খুশি হবার মতো কিছু হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

তুই যে কী দিদিভাই?

সালমা ওর সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালে। কাপড় ছাড়ে। বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ চোখ-মুখে পানি দেয়। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সাকিবার একটুও বুদ্ধি নেই। এত তাড়াতাড়ি কথাগুলো না বললেই পারত। অবশ্য তাও নয়। ভালো মুড়ে থাকলেও ওই কথাগুলো সালমার গায়ে জ্বালা ধরাত। সহ্য হয় না ওর। বাবা তো গুটিপোকার মতো রেশমের সুতো দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করে এক স্বপ্নের মায়াপুরীতে বাস করে। নিজের যোগ্যতা সম্বন্ধে সচেতন নয় বলেই অযাচিত মূল্য গ্রহণ করতে পারে। এ পদ্ধতিতে যত সহজে নিজেকে ঠকানো যায় তেমনি তত সহজে অন্যকে ধাপ্পাও দিয়ে চলা যায়।

মাথাটা ধরেছে। সালমা বাতি বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কপালের পাশের শিরা দুটো দপদপ করে। কী যে হয়েছে ওর। বাবা সম্পর্কিত কোনো চিন্তা মনে এলে আর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। বুনো রাগে অন্ধ হয়ে যায়। সালমা অনুভব করে অধিকারের যে সম্পর্কেই থাকুক, বাবার সঙ্গে ওর কোনো সত্যিকারের অন্তরঙ্গতা নেই। দুজনের মেজাজ ও চরিত্রে আকাশ-পাতাল তফাত। বাবা ওকে বলে ভাবপ্রবণ, মর্বিড। সালমার হাসি পায়। শব্দগুলোর সত্যিকার অর্থ বাবা জানে না। জানলে বলত না। বাবা নিজে কি তার অন্তর হাতড়ে কোনোদিন দেখেছে? বাবা অন্ধ। কিছু দেখতে পায় না। বাবা যত ইচ্ছে ওকে ভালোবাসুক তাতে ওর আপত্তি নেই। বাবার ভালোবাসায় ওর কোনো প্রয়োজন আছে কি না তার খোঁজেও বাবার দরকার নেই। অধিকারের জোরে অথবা ভালোবাসার জোরে কর্তৃত্ব খাটাতে এলেই যত আপত্তি সালমার। সালমার ক্ষেত্রে বাবার ভালোবাসার অর্থ ওর। নীতিজ্ঞান ও বুদ্ধির বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। সালমা বিড়বিড় করে, আমার স্বভাবের নিয়মের বাইরে আর কোনো অধিকার স্বীকার করি না। করি না–করি না। চেঁচিয়ে ওঠে ও।

কি হয়েছে লিমা? চিৎকার করছিস কেন?

মা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালে।

কীরে শরীর খারাপ?

হ্যাঁ। বমি লাগছে।

সালমা উঠে বাথরুমে যায়। বেসিনের ওপর বমি করে। নাড়িভুড়ি সব পাক খেয়ে উঠে আসতে চাইছে। পেট চেপে ধরে ও। টক টক গন্ধে মাথার দপদপানি আরো বেড়ে যায়।

তোর কী হয়েছে লিমা?

বাবা কাছে এসে মাথার ওপর হাত রাখে। পিঠে হাত বুলোয়। সালমা ট্যাপটা জোরে ছাড়ে। চোখ-মুখে পানি দেয়। চোখ দুটো জ্বালা করে। সালমা আবার শুয়ে পড়ে।

এক গ্লাস দুধ আর একটা নোভালজিন ট্যাবলেট পাঠিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে নিস।

মা বাতি বন্ধ করে চলে যায়। একটু পরে আনুর মা দুধ আর ট্যাবলেট নিয়ে আসে।

আপামণি?

দাও।

সালমা ঢকঢক করে দুধ খায়।

বাবা কী করছে আনুর মা?

টেলিফোন করছেন। আজকে খালি টেলিফোন আসে।

বৈঠকখানায় কে কথা বলে?

কী জানি কত লোকজন এসেছে।

সালমা আবার চুপ করে যায়। হ্যাঁ, লোকজন তো আসবেই। সবাই বাবাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। ঘনঘন টেলিফোন করছে। একদল চিরকাল অন্যের স্তুতি গেয়ে সুখ পায়। নোভালজিনের দরুন মাথাব্যথা কমে যেতে থাকে। একটু একটু ভালো লাগে সালমার। পেছন দিকের বাগানের মাথার ওপর চাঁদ দেখা যাচ্ছে। ঠিক জানালার সোজাসুজি। কখনো মেঘ এসে ঢেকে ফেলে। মেঘ সরে গেলে উজ্জ্বল আলোয় ভরে যায়। সালমা তাকিয়ে থাকে। টেলিফোনের সেই বন্ধুটির কথা মনে হয়। ও আর একদিনও টেলিফোন করেনি। সালমাও নাম্বারটা জানে না। সেই ভরাট কণ্ঠস্বর যখন কানে বাজে, মনটা শূন্য হয়ে যায়। অনুভূতি তেতো হয়ে থাকে। বড় জ্বালা। ঘুরেফিরে একটি বোবা বউয়ের কথা মনে হয়। কথা না জানলেও সুখ তৈরি করতে জানে। জংলি ছাপা শাড়ি পরে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উৎসুক দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয়। মধ্যবয়সী একটি লোক তার সান্নিধ্যে জীবনের সব ব্যর্থতার কথা ভুলে যায়। ব্যর্থতার গ্লানি ওদের হতাশ করে না। আম-কাঁঠালের নিরিবিলি ছায়া ওদের বিষণ্ণ করে না। আহ্, জীবনের কী বিচিত্র অনুভব। চাঁদটা আর দেখা যায় না। একটু করে ঘন কালো মেঘের আড়ালে চাপা পড়েছে। সালমার মনে হয়, অমন একটি কালো পাথর সালমাকেও চাপা দিয়ে রেখেছে। আজ রাতে ওই চাঁদ দেখা যাবে না।

দিদিভাই।

সাকিব এসে বিছানার ওপর বসে।

দিদিভাই ঘুমিয়েছিস?

না।

তবে চুপচাপ কেন?

বেশি কথা ভালো লাগছে না।

বাবা তোকে ডাকছে।

কেন?

জানি না।

সালমা আরো পাঁচ-সাত মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকে। সাকিব উসখুস করে।

যাবি না?

হ্যাঁ। যাচ্ছি চল।

সালমা উঠে বাবার ঘরে আসে। মা নেই। সম্ভবত বসার ঘরে অথবা রান্নাঘরে।

আমাকে ডেকেছ?

তোমার কি শরীর খারাপ?

না, এমনি মাথা ধরেছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।

বসো।

ডেকেছ কেন?

বসো না।

সালমা চেয়ার টেনে বসে। কেমন অস্থির লাগছে। গা-টা গুলিয়ে উঠছে বারবার। বাবার ওই আত্মতৃপ্তির হাসি অসহ্য। সারা মুখে কী যেন চকচক করছে।

কাল বিকেলে বাসায় একটা পার্টি দেব ভাবছি।

ভালোই তো।

তুমি আর সাকিব দুজনে বাসায় থাকবে।

আমি থাকতে পারব না। আমার বাইরে কাজ আছে।

এমন কিছু জরুরি কাজ নিশ্চয় নয়?

হ্যাঁ, খুব জরুরি।

কী কাজ বলো?

সব কথা শুনতে চাও কেন?

লিমা!

তোমার জন্য আমার লজ্জা হয়। যা তোমার প্রাপ্য নয় সে সম্মান নিতে তোমার বিবেকে বাধে না?

সালমা দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। নিজের ঘরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে। জাহিদ চৌধুরী হাঁ হয়ে থাকে। সালমা এমন আচরণ করবে ভাবতেই পারেনি। সাকিবও অপ্রস্তুত হয়ে বসে আছে।

আমার এত বড় সাফল্যে মেয়েটা খুশিই হয়নি।

দিদিভাই এমনই। ওর কথায় তুমি কিছু ভেবো না বাবা।

তা নয় রে। ওকে ছাড়া আমি অন্য কিছুই ভাবতে পারি না। কী যে হবে ওর। ওর ওপর রাগ করা মানে নিজের ওপর রাগ করা।

জাহিদ চৌধুরী আবার নিজের কাজে ড়ুবে যায়। সালমার কথা ভেবে মন খারাপ করার সময় তার নেই। তাছাড়া ওর কথার অর্থ ধরার কোনো মানেই হয় না। ও যেসব কথা বলে তার সবটাই পাগলামি। অন্তত জাহিদ চৌধুরী তা মনে করে।

পরদিন বাড়িতে উৎসব। সারা সকাল সাকিব আর ঘর-দুয়ার গোছায়-সাজায়। সালমা চুপচাপ দেখে। মা ওকে কিছু বলেনি। ও নিজে থেকেও কিছু করেনি। সাকিব ওর দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসে। সালমা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝরঝরিয়ে পানি পড়ে। একে একে কাপড় খোলে ও। সাদা পিছল গায়ের ওপর দিয়ে জলের রেখা সরু হয়ে নামে। গুনগুনিয়ে গান গায়। কেন জানি ভীষণ ফুর্তি লাগে। ধেই ধেই করে নাচলেও তার প্রকাশ বুঝি ঠিক হবে না। কণ্ঠে গান উপচিয়ে আসে। একসময় গুনগুনানি বাদ দিয়ে গলা ছেড়ে দেয়। জলের নিচে দাঁড়িয়ে সালমা আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায়। কোথা থেকে যেন মুক্তি পেয়েছে ও। জলের স্পর্শে সে মুক্তি বাঁধনহারা হয়। গত রাতে বাবার মুখের ওপর একটা কথা ছুড়ে মেরেছে। জাহিদ চৌধুরী যদি বুদ্ধিমান হয় ওইটুকুতে তার সব বুঝে নেওয়া উচিত। না, বুঝলেও বুঝবে না। এখানেই জ্বালা। নিজের অন্তরে ছায়া দেখতে পায় না জাহিদ চৌধুরী। পেলে কি তার অন্তঃসারশূন্য আমিত্বকে বিপুল কলরোলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত? জলের নিচে দাঁড়িয়ে সালমা আবার বিষণ্ণ হয়। জলের রেখা তেমনি সরু হয়ে নামে। বাবা সোরেন কেয়ারকে গার্ডের মতো হতে পারে না? লোকে তাকে পাগল বলত। তার ‘সোরেন’ নামটি পাগলের প্রতিশব্দ হয়েছিল অথচ ডেনমার্কের সেই পণ্ডিতের রচনা যখন ইংরেজিতে অনুবাদ হলো, দেখা গেল সেই নির্জনতাপ্রিয় আধপাগল লোকটি এক মৌলিক দর্শনের স্রষ্টা। সালমা চায় এমন একটি লোক যে আপন সাধনায় নিমগ্ন থেকে এক অবিস্মরণীয় আবিষ্কারের জনক হয়ে যাবে। না চাইলেও লোক যার পায়ে ভক্তি, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় লুটিয়ে পড়বে। সালমার মাথাটা কেমন যেন করে ওঠে।

জাহিদ চৌধুরী তুমি এমনই মহৎ হয়ে যাও–এমনই মহৎ। তুমি চাকরিগত কোন্দল ছাড়। ঈর্ষাবিদ্বেষ ছাৰ্ডৰ ওপরে ওঠার জন্য সব নোংরা পথ আর বেছে নিয়ো না। তাহলেই আমি তোমার অনুগত বাধ্য হয়ে থাকব। তোমাকে আমি বার হিসেবে দেখতে চাই, যে আমার অন্তরে আলোর দিশা হয়ে জ্বলবে।

জলের নিচে কতক্ষণ ক-ত-ক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সালমা জানে না। আনন্দের শিল্পিত মুহূর্তগুলো ধুয়ে মুছে নিঃশেষ। এখন জেগে থাকে সাদা বিষণ্ণতা। সাদা পিছল গায়ের মতো সে বিষণ্ণতা জলের রেখা হয়ে নামে। একটু বাতাসে জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে ও। শীত শীত লাগে। হাতের তালু কেমন চুপসে গেছে। চামড়া কুঁচকে আসছে। মাথা ভার হয়ে আসছে। সালমার মনে হয় অনন্তকাল ধরে ও জলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে ট্যাপটা বন্ধ করে। ওই জল তার সাদা বিষণ্ণতা ধুয়ে নিতে পারে না। তোয়ালে চেপে ধরে গায়ের ওপর। ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে চুল থেকে। আয়নায় নিজের মুখটা দেখে চমকে ওঠে সালমা। একদম ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ওকে। শরীরের শীত শীত ভাব কমে না। সালমার মনে হয় উত্তাপ চাই। ভীষণ উত্তাপ। একদিন রকিব ওকে চমৎকার উত্তাপ দিয়েছিল। সেই নির্জন বাউরা দুপুরের কথা প্রায়ই মনে হয়। কেমন যেন লাগে। আম-কাঁঠালের ছায়ায় হরিয়ালের ঝাঁক দেখতে পায়। মনে হয় নাভির কাছ থেকে লাল পদ্মের ঘাণ উঠে আসছে। অন্তরে আর কোনো আসক্তি নেই। জাহিদ চৌধুরী মরে গেছে। রকিব হারিয়ে গেছে। জাগতিক সুখ-দুঃখ ঘুমপাড়ানিয়া দেশের সাঁতারু মেয়ে হয়ে গেছে। শুধু জলে তার প্রাণ। জলে তার আনন্দ।

আয়নার সামনে অনেকক্ষণ বসে থাকে সালমা। যত করে নিজেকে সাজায়। সাজাতে ভালো লাগে। জানালার পাল্লার ওপর দুটো বুলবুলি খেলা করে। সালমা পাউডারের পাফ গালে বুলোয়। জানালার ধারে আসে। ওর নির্জন পৃথিবীতে অনেক ঘাস গজিয়েছে। গাছগুলো কেমন নিজীব দেখাচ্ছে। আঙুরলতা শুকনো। যেন কোনো বসন্তের প্রতীক্ষায়। সালমা ঘুরেফিরে আবার আয়নার সামনে এসে বসে। নিজের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় ওর কোনো স্মৃতি নেই। ছোটবেলার কোনো পবিত্র স্মৃতি? না নেই। ভাবল থাকলে ভালো হতো। অন্তত মাঝে মাঝে সেইসব স্মৃতির মাঝে বিচরণ করে ও বিশুদ্ধ হয়ে যেত। আহ, স্মৃতি কত আকাক্ষিত। ছোটবেলার কোনো কথা ওর তেমন করে মনে পড়ে না। শুয়ে শুয়ে ওই স্মৃতি নিয়ে লোফালুফি করা যায়। অনেক খেলা জমে ওঠে। রুবা ভাবির চমৎকার স্মৃতি আছে। সালমার কাছে যখন সেসব গল্প করে তখন তন্ময় হয়ে যায়। রুবা ভাবির বারো বছর পর্যন্ত একটা মুক্ত জীবন ছিল। গ্রামীণ পরিবেশে অবাধ বিচরণ ছিল। বনবাদাড়, খালবিল, ধানক্ষেত, নদীর ধার প্রভৃতি নিয়ে। অনেক স্মৃতি রুবা ভাবির মনে। তরতরিয়ে গাছে উঠতে পারত। একবার জাম পাড়তে গিয়ে লাল পিঁপড়ের কবলে পড়েছিল, একবার ভরা বর্ষায় নৌকা করে পিকনিক করতে গিয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছিল, গ্রামের একটি ছেলে আত্মহত্যা করে পেয়ারা গাছে ঝুলেছিল–সব মনে আছে রুবা ভাবির। আরো কত অসংখ্য খুঁটিনাটি ব্যাপার আছে। শুনতে ভালোই লাগে। ওর এসব নেই। সালমার মনে হয় জীবনের বিশুদ্ধ ক্ষণ বড় পবিত্র। আর পবিত্র বলেই মানুষ তাকে ভুলতে পারে না। রুবা ভাবি এখনো নাকি স্বপ্ন দেখে সেই ছোটবেলার পরিবেশে। বর্তমান কাল, বর্তমান মানুষ, অথচ পরিবেশ সেই বিশ বছর আগের হারিয়ে যাওয়া স্থান। সেসব স্মৃতি রুবা ভাবির মনে কী সাংঘাতিক প্রভাব বিস্তার করেছে! নইলে অবচেতন মনের সেই স্মৃতি স্বপ্ন হয়ে বারবার। ভেসে আসত না।

বাইরে সাকিবের কথা শোনা যায়। বাবার কোনো ছাত্র এসেছে, তার সঙ্গে কথা বলছে। একদিন একটি ছেলেকে সালমা অপমান করেছিল। সে আর কোনোদিন আসেনি। তার চাকরি হয়েছে কি না কে জানে। সালমা আলমারি খুলে শাড়ি বের করে। ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ আসে। এ গন্ধটা ওর ভালো লাগে। আলমারির ভেতর মুখ ঢুকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। বাইরে হঠাৎ রোদ কমে যায়। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, মেঘ করেছে। মন্দ না। যা গরম! এক পশলা বৃষ্টি এলে ভালোই লাগবে। হাওয়া বইছে জোরে। শাড়িটা পরে নেবার পর সালমার মনে হলো, কোথায় যাবে সেটাই এখনো ঠিক করা হয়নি। কোথায় যাওয়া যায়? এদিকে যা মেঘ করেছে যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে। হ্যাঁ ঠিক, টুক করে নাসিমা’পার ওখানে উঠে গেলে মন্দ হবে না। সাকিব একটু পরে বেরিয়ে যাবে মিষ্টির জোগাড় করতে। আর মা বাথরুমে ঢুকলেই হয়। কেউ টের পাবে না যে সালমা কোথায় গেল।

দুপুরের একটু আগে চুপচাপ দোতলায় উঠে আসে সালমা। ওকে দেখে হাসে নাসিমা।

কিরে কী খবর?

তোমার এখানে এলাম একটু শ্বাস ফেলতে।

বস।

নাসিমা ঘর গোছায়। জাপানি কায়দায় ফুল সাজিয়েছে। ক্রুশে বোনা টেবিলক্লথ, একদম নতুন ফ্রিজের ওপর কাচের নীল রঙের ফুলদানিতে তাজা গোলাপি গোলাপ শুধু। মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ আসে। ডিভানে হালকা নীল ভেলভেটের চাদর। চারদিকে চমৎকার ছিমছাম ভাব।

কী ব্যাপার, কেউ আসবে নাকি নাসিমা’পা?

না তো!

যা চমৎকার ঘর সাজিয়েছ।

এ আমার নিজের জন্য সালমা। সবাই পরের জন্য সাজায়। নিজের কথা একটুও ভাবে না। আমি করি নিজের জন্য। ঘরটা সাজাবার পর এখন আমার নিজেকে বেশ পবিত্র লাগছে। দেখ না, একটু পর ধূপ জ্বালিয়ে দেব। ধূপের গন্ধ তোর ভালো লাগে না?

হ্যাঁ। ভীষণ।

তুই আজ আমার সঙ্গে থাকবি সালমা।

সাব্বির ভাই কই?

ও চিটাগাং গেছে।

সালমা মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। এটাই ও চাচ্ছিল। কিন্তু এত সহজে কি নাসিমা’পার কাছে সবকিছু প্রকাশ করা যায়? সোফার ওপর কাত হয়ে বসে সালমা একটা বিদেশি পত্রিকায় চোখ বুলায়। নাসিমা তখনো ফুল নিয়ে ব্যস্ত। নানা কায়দায় ফুলদানি সাজাবার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনোটাই তার পছন্দ নয়। সে কারণেই মাঝে মাঝে তার গানের গুনগুনানি থেমে যায়। বিরক্তি প্রকাশ করে। আবার ফুলপাতা নিয়ে মেতে ওঠে। শিস বাজায়।

আজ নিজের হাতে বেশ কিছু রান্না করেছি সালমা। খেলে তুই অবাক হয়ে যাবি।

বেশ মজা। দিনটা আজ ভালোই কাটবে দেখছি। জানো নাসিমা’পা, তোমার এখানে এলে আমি অন্য জগতের স্বাদ পাই। নিজেকে হালকা মনে হয়। অথচ লোকে তোমাকে কত কথা বলে।

লোকের কথায় আমার কিছু এসে যায় না।

তুমি আজ ইউনিভার্সিটি যাওনি? ক্লাস ছিল না?

নাসিমা ফুলাদনিটা টিপয়ের ওপর রেখে সালমার পাশে এসে বসে।

কদিন থেকে একটা জিনিস নিয়ে আমি খুব ভাবছি সালমা। সাতদিন ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারিনি। নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।

নাসিমার মুখটা চিন্তিত দেখায়।

কী ব্যাপার নাসিমা’পা?

ভাবছি ইউনিভার্সিটির চাকরিটা ছেড়ে দেব।

কেন? কেন?

ইদানীং মনে হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের পড়ানোর যোগ্যতা আমার নেই। নিজেই কিছু জানি না, অন্যকে কী শেখাব।

কী যে বলো নাসিমা’পা। ইউনিভার্সিটিতে টিচার হিসেবে তোমার তো খুব নাম। সবাই তোমার লেকচার পছন্দ করে।

সে তুই বুঝবি না সালমা। ভীষণ গ্লানি আমাকে পেয়ে বসেছে। কাউকে নতুন কিছু শেখাতে পেরেছি বলে মনে হয় না। কদিন থেকে আমি মরমে মরে যাচ্ছি।

সালমা অবাক হয়ে নাসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাসিমা সোফার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। কী ভীষণ আত্মআবিষ্কার! বরাবর ব্রিলিয়ান্ট ক্যালিবারের মেয়ে ছিলেন। বিদেশ থেকে ডিগ্রি করেছেন। কিছু জানেন না বলে প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধা নেই। সালমা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। ওর উচ্ছাসে নাসিমাপা হয়তো আত্মঅহংকারে মেতে উঠবেন। না, সেটা হয়তো সম্ভব নয়। যে লোভ মোহ অতিক্রম করে সত্যকে চিনতে শেখে সে কী আবার নতুন করে ভুলে পথে পা বাড়ায়? কখনো না। জাহিদ চৌধুরীর মতো লোভী দুর্বলচিত্তের ব্যক্তিরাই মোহের গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়ায়।

নাসিমা চোখ বুজে বসে আছে। পা নাচাচ্ছে। পরনে হালকা ঘিয়ে রঙের শাড়ি। গায়ের রঙের সঙ্গে প্রায় মিলে যায়। সালমা গা ঘেঁষে বসে আছে। সুন্দরের মাঝে নিজেকে পবিত্র করে তোলার আকাঙ্ক্ষায় নিবেদিত। একটু পরে ঘরে ধূপ জ্বলবে। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে আলো জ্বালবে। তারপর হয়তো গান শুনবে অথবা নিজে গিটার বাজাবে। হঠাৎ নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয় সালমার। মনে হয় অর্থহীন জীবনযাপন করছে ও। এ জীবনের বড় মূল্য নেই।

নাসিমা মাথা ঝাকিয়ে সোজা হয়ে বসে।

যাকগে, এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই। সাব্বির এলেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব। কী বলিস?

চাকরি ছেড়ে দিয়ে কী করবে?

অন্য কিছু নিশ্চয় করব। এখনো ভেবে ঠিক করিনি।

নাসিমা শোবার ঘরে যায়। ধূপদানিতে ধূপ নিয়ে এসে জ্বালে। পর্দা টেনে জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়।

একটা আপন পৃথিবী তৈরি করিনি সালমা?

করেছ।

নাসিমা ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে টেবিলে সাজায়। বুড়ি ঝিকে ইচ্ছে করে আজ ছুটি দিয়েছে। বেরি নাকি অনেকদিন মেয়ের বাড়ি যায়নি। অবশ্য অজুহাতের দরকার ছিল না। বুড়ি ছুটি না চাইলেও। নাসিমা আজ তাকে ছুটি দিত। সালমা আড়চোখে তাকায়। টেবিলে অনেক কিছু সাজিয়ে ফেলেছে নাসিমা’পা। এককোণে ফুলদানিও রেখেছে।

আয় সালমা, খেয়ে নিই।

সালমা অবাক হয়।

এত আয়োজন করেছ তোমার একলার জন্য?

তুই তো রয়েছিস। আমি তো হঠাৎ এলাম। নইলে তো তুমি একলা খেতে?

তা খেতাম। ওই যে বললাম, নিজের জন্য আজ সব আয়োজন পূর্ণ করে তুলতে ভালো লাগছে।

সাব্বির ভাই থাকলে বেশি ভালো লাগত।

তা অবশ্য নয়। সেটাও ভিন্ন জগৎ। দুয়ের মধ্যে তফাত অনেক।

দুজনেই খাওয়ায় মনোযোগী হয়। কোনটা রেখে কোনটা খাবে ভেবে পায় না সালমা।

তোমার কে কে আছে নাসিমা’পা?

বাবা-মা, ভাইবোন সব।

তারা খোঁজ-খবর নেয় না?

না। তোমার খারাপ লাগে না?

মাঝে মাঝে লাগে। তবে সেটা সাময়িক? খুব একটা বেদনাদায়ক নয়। আমার এক দাদু আছে। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমি চলে আসার পর আমি তার অসুখের কারণ হই। ভাবতে মজা লাগে যে, নাসিমা একটি অসুখের নাম।

সালমাও হাসে। নাসিমা হাসতে হাসতে বলে, দাদু মরে গেলে কষ্ট পাব। তবে তেমন কিছু নয়। অনেক কষ্ট আছে, যা অনায়াসে খোলা যায়।

নাসিমা ভাত নেড়েচেড়ে উঠে পড়ে। হাত ধুতে বাথরুমে যায়। সালমা অবাক হলো। হঠাৎ এ পরিবর্তন কেন নাসিমা’পার? দাদুর জন্য মন খারাপ হয়েছে? অনায়াসে কষ্ট ভুলতে গিয়ে কষ্টের ফাদে বন্দি হয়নি তো আবার? কী জানি, কে জানে। কাউকে বোঝা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সালমা ভাবল। নাসিমা শুধু একটি অসুখের নাম নয়। কারো কারো নাসিমা নামে ভীষণ অ্যালার্জি। ও আরো গভীর কিছু ভাবতে চাইল। বাজে কথা, কষ্ট ভুলতে চাইলে অনায়াসে ভোলা যায় না। ওটা আরো গভীর করে গেঁথে যায় মনে।

নাসিমা তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে ফিরে আসে।

তুমি তো কিছু খেলে না নাসিমা’পা?

আমি এমনই খাই।

তাহলে এত আয়োজন–

আয়োজনটা আনন্দের জন্য। তুই আবার খাওয়া ছেড়ে উঠে যাস না। যেন।

পাগল। কষ্ট ভুলতে গিয়ে আমি খাওয়া ছেড়ে দিই না কিন্তু নাসিমা’পা।

নাসিমা শব্দ করে হাসে। ফ্রিজের ওপরে রাখা কৌটো খুলে মসলা মুখে দেয়।

আমার জীবনটা এমনই, এই মৌরির গন্ধের মতো। বুঝলি সালমা, কেবলই সুগন্ধির পথে পথে আমাকে টেনে নিয়ে যায়।

কী জানি, অত বুঝি না। তবে সোজা পথ থেকে নেমে যেতে আমার ভালো লাগে।

কেউ কোনো কথা বলে না। নাসিমা চেঞ্জার ছেড়ে ডিভানের ওপর শুয়ে থাকে। লম্বা চুলের গোছা মেঝেতে গিয়ে ঠেকে। সালমা মাছের কাঁটা বেছে ভাত মুখে পপারে। বাড়িতে বাবা ওকে জোর করে খাবার জন্য বকে। আর এখন সালমার কেবলই খেতে ইচ্ছে করছে। মনে হয়, সারারাত ধরে খেলেও বুঝি তৃপ্ত হবে না। ক্লান্তি আসবে না।

বাইরে মেঘ মেঘ দুপুর ঝিমিয়ে আছে। গাছের পাতা থমথমে, পাখির ডাক নেই। ঝড় আসতে পারে। সালমা খেয়েদেয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। বাড়িতে এখন কে কী করছে কে জানে। বাবা হয়তো ফেরেনি, তার জন্য সালমার কোনো চিন্তা নেই। ওই বাড়িতে সারাবছর উৎসব লেগে থাকলেও ওর কিছু এসে যায় না। সালমা এমনি নিস্পৃহ থাকতে পারে। নাসিমা চোখ বুজে আছে। ঘুমিয়েছে কি? চেঞ্জারে হিন্দি গান বাজছে। সালমার মনে হলো একদিন এমন এক দুপুরবেলা নাসিমা বলছিল যে মিউজিকে রং দেখা যায়। সালমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়। আজকের দিনটা তো সম্পূর্ণ নাসিমার নিজের। নিশ্চয়ই সে মুহূর্তগুলো নাসিমার সামনে অবলীলায় আসবে। সালমা ডিভানের পাশ ঘেঁষে মেঝের কার্পেটের ওপর বসে। নাসিমার চুলে হাত দেয়। মসৃণ তেলতেলে চুলের গোছা রেশমের মতো নরম।

কিছু বলবি নাকি সালমা?

নাসিমা চোখ না খুলেই কথা বলে।

আচ্ছা নাসিমা’পা আজকের দিনটা তো সম্পূর্ণ তোমার, না?

হুঁ। আজ তোমার আর কিছু করতে ইচ্ছে করছে না?

করছে।

কী?

নেশা।

বাহ চমৎকার। মন্দ হবে না।

মোটেই চমৎকার নয়। তার আগে তোকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।

কখনো না।

সালমা একটু চেঁচিয়ে বলে!

তোকে যেতে হবে।

আমি কিছুতেই যাব না। তুমি তাড়িয়ে দিতে চাইলেও আমি যাব। জোর করে থাকব।

বাপস একদম মিলিটারি মেজাজ।

নাসিমা হেসে ফেলে।

ঠিক আছে তুই থাক। কিন্তু সহ্য করতে পারবি তো?

খুব পারব।

নেশা কিন্তু সাংঘাতিক সালমা। জীবনের রং একদম বদলে দেয়।

সেই স্পর্শবোধে জীবনকে আমিও রাঙাতে চাই নাসিমা’পা।

নাসিমা চেঞ্জারটা বন্ধ করে দেয়। সালমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে উপুড় হয়ে শোয়। মাদকদ্রব্যে নয়, শুধু নামেই যেন নাসিমার নেশা পেয়েছে।

জানিস ড্রাগসের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া বিভিন্নভাবে অনুভব করা যায়। আপার্সের অনুভূতি এক, ডাউনার্সের অনুভূতি অন্য। আর সাইকেডেলিক হলো একদম আলাদা। আপার্স স্নায়ুকে একদম উত্তেজিত করে তোলে। তখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ঘুম আসে না। কথা বলতে ইচ্ছে করে। যাকে বলে বিরামহীন বকবকানি। চিন্তার গতি অসম্ভব বেড়ে যায়। বাস্তব ভিত্তিহীন কাজ এবং কথা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ডাউনার্স হচ্ছে এর উল্টো। এটা স্নায়ুকে অত্যন্ত দুর্বল, অন্য কথায় নিস্তেজ করে ফেলে। একটা ঢুলুঢুলু তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আচ্ছন্ন করে রাখে। অথচ গভীর ঘুমও আসে না। না ঘুম, না জাগরণ অবস্থা আর কি। কোনোকিছু ভাবার ক্ষমতা থাকে না। সারাক্ষণ একটা বিষাদময় ঝিমুনির মধ্য দিয়ে সময় কেটে যায়। স্নায়ুর দুর্বলতার জন্য হাত-পা ঝিমঝিম করে। মনে হয় শরীরে কোনো শক্তি নেই। হেরোইন, হাশিশ খেলে এমন হয়। সাইকেডেলিক হচ্ছে আপার্স এবং ডাউনার্সের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। উত্তেজনা ও অবসাদ দুটোই থাকে। দুটোর মিশ্রণে অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম হয়। এমন এমন সব ঘটনা বা ভাবনা জন্ম নেয়, যা বাস্তবে একদম অসম্ভব। যেমন ধর পুরোপুরি এ অবস্থার মধ্যে মনে হবে চেঞ্জারে তুই যে মিউজিকটা শুনছিস তার একটা রং আছে, যা-ই দেখতে পাচ্ছিস। যেমন বাঁশির শব্দের রং নীল, ড্রামের শব্দের রং লাল, ভায়োলিনের রং ধূসর। এমনও দেখতে পারিস যে তোর সামনে ওই ফুলদানিটা হঠাৎ একটা বিরাট গণ্ডারের মুখ হয়ে গেল। তুই ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলি। অথবা হাসতে আরম্ভ করলি কিংবা কান্না। যে-কোনো কিছু তোর মধ্যে হতে পারে। তার কোনো ঠিক নেই। তুই দেখবি, এই ঘটার আশপাশে কোনো দেয়াল নেই। চারদিকে শুধু আকাশ আর আকাশ। দেখবি রংধনু তোর সামনে একটা রঙিন সাকো হয়ে গেছে। তুই তার ওপর দিয়ে নির্বিবাদে পার হয়ে যাচ্ছিস। দেখবি তুই পানকৌড়ির মতো কেবল জলে অনবরত ড়ুবছিস আর উঠছিস। অবশ্য এ সবই আমার অভিজ্ঞতা সালমা। তোর অন্যরকম অনুভূতি হতে পারে। তবে জানিস, প্রায় সব ড্রাগসই তেতো।

তবে তোমরা কেমন করে খাও?

নাসিমা হাসে।

এখানেই তো মজা। এজন্যই তো একে বলে মাদকদ্রব্য। আমি বলি মামদো ভূত! একবার পেয়ে বসলে ওইসব তেতো-ফেতে কিছু না। পথিবীর শ্রেষ্ঠ বস্তুর চাইতেও সুস্বাদু মনে হয়। নাসিমা অনেক কথা বলে যায়। সালমার কানে কিছু ঢোকে না। মামদো ভূত শব্দটা মনে মনে আউড়ে যায়। নাসিমা’পা একটা শব্দ বের করেছে। একবারের জন্য হলেও ওই অনুভূতির স্বাদ সালমার চাই।

কিরে কী ভাবছিস?

মামদো ভূত—

নাসিমা শব্দ করে হাসে।

তোর সাব্বির ভাইয়েরও ওই শব্দটা খুব পছন্দ। যখন তখন বলবে, নাসিমা তোমার মামদো ভূতটা আমার ঘাড়ে চাপাও।

নাসিমা’পা আমিও তাই চাই।

পাগল! সহ্য করতে পারবি না।

পারব। তুমি দেখে নিয়ে ঠিক পারব।

সালমা জোর দিয়ে কথা বলে।

বলো, তুমি দেবে?

সালমা নাসিমার গলা জড়িয়ে ধরে।

আচ্ছা, আচ্ছা দেব। বেলা পড়ক। বিকেলের পর, সন্ধ্যার আগে। এই মাঝামাঝি সময়টা আমার খুব পছন্দ।

সালমা পর্দা ফাঁক করে জানালা দিয়ে বাইরের আলো দেখে। বিকেল নিস্তেজ হয়ে এসেছে। নিচতলা থেকে আনন্দমুখর কথাবার্তা ভেসে আসছে। উৎসব জমে উঠেছে। একতলায় এখন অনেকগুলো রঙিন বাতি জ্বলছে। লাল নীল সবুজ হলুদ। সালমার হঠাৎ মনে হয়, সাকিবের গিটারের শব্দ আসছে। কান পেতে শোনে। হ্যাঁ, ঠিকই। কোনো ভুল নেই। অতিথিদের অনুরোধে সাকিব হয়তো গিটার বাজাচ্ছে। সালমার কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। জানালা বন্ধ করে দিয়ে নাসিমার ডিভানের পাশে এসে দাঁড়ায়।

নাসিমা’পা ওঠো। তোমার প্রিয় সময় পার হয়ে যাচ্ছে।

প্রথম প্রথম সালমা কিছু বুঝতে পারে না। খেতে গিয়ে মুখটা বিকৃত করে মাত্র। তীব্র নসিয়া পেয়ে বসে ওকে। দিশেহারার মতো চারদিকে তাকায়। প্রচণ্ড অস্বস্তি বুকের আকাশে মেঘের মতো গুরুগুরু শব্দ করে। নাসিমা খিলখিল করে বলে, বাবা, বলছিলাম না, মামদো ভূত। ঘাড় ধরে যেদিকে ঘোরাবে ঠিক সেদিকে ঘুরতে হবে। ছাড়াছাড়ি নেই।

নাসিমার এলোমেলো ভঙ্গ কণ্ঠ ফ্যাসফ্যাস করে। বিননি খুলে চুলগুলো ছড়িয়ে দেয় পিঠে। শাড়িটা খুলে দলামোচা করে ছুড়ে মারে সোফায়। তারপর টলতে টলতে চলে যায় শোবার ঘরে। সালমা আর নিজেকে চেপে রাখতে পারে না। পেটের ভেতর একটা দৈত্য যেন লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে তুলছে। কিছুতেই তাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সালমা অন্ধকার হাতড়ে বাথরুমের দরজা খুলে হড়হড় করে বমি করে। দুপুরে খাওয়া নাসিমার প্রিয় রান্নাগুলো সব উঠে আসে। অবসন্ন দুর্বল লাগে। মুখে হাতে পানি দেয়। শাড়ি ভিজে যায়। খুলে বাথরুমে রাখে। ফিরে এসে ডিভানের ওপর শুয়ে পড়ে। বমি বমি গন্ধ আসে শরীর থেকে। কোনো কিছুই এখন আর ওর খারাপ লাগছে না। অবদমিত ইচ্ছেটা ঘুরেফিরে মনের মধ্যে নড়াচড়া করে। যেটা পারবে বলে দুম্ভ করেছে, সেটা পারেনি। পরাজয়ের গ্লানি মনকে সংকুচিত করে রাখে। উপরন্তু মিউজিকের রংটা দেখা হলো না। কোনো অভিজ্ঞতাও হলো না সালমার। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় ও। প্রথম দিন পারেনি বলে দুঃখ কী? আবার চেষ্টা করবে, আবার। মামদো ভূত আর যেই ভূতই হোক বাগে আনতেই হবে সালমার। ইচ্ছের পরাজয় কখনোই হতে দেবে না।

চোখ জড়িয়ে আসে। মনে হয় ওর চারপাশে সাকিব খুব মিষ্টি করে। গিটার বাজাচ্ছে। খুব মোলায়ম আঙলে তার স্পর্শ করছে। নাইটিঙ্গেলের গান যেন। সাকিব তুই কত ভালো–তুই বুঝেছিস এখন আমার ঘুম দরকার। প্রিয় ঘুম। প্রিয়তম ঘুম। সালমার ঠোঁটজোড়া কেঁপে কেঁপে থেমে যায়।

বাইরে রাতের শরীরে যৌবনের ছোঁয়া লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *