ও মন!
ইদানীং তার পরিবর্তন লক্ষণীয়। অনেকদিন পর সে এমন প্রাণবন্ত! অনেক, অনেকদিন পর সে এমন সরব, হাস্যময়! বাড়িতে সকলেই খুশি, কিন্তু বিস্মিত। তাঁরা গোপন আলোচনায় সন্তোষ প্রকাশ করছেন এই ভেবে যে, হয়তো বিবাহ প্রস্তাবে সে অবশেষে পেয়ে গিয়েছে এক আলোর ঠিকানা। জীবন যে কেবল শুকনো হিসেবশাস্ত্র মাত্র নয়, এই কথাটি তার উপলব্ধি হয়েছে বুঝি-বা। হবে না কেন! বয়সের ধর্মকাঁটা হল শরীরের যাবতীয় কলকব্জা, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি ও পেশিতন্তু। তাদেরও দাবি কিছু থাকে। বোকা মেয়ে বোঝেনি কেন আগে? দেবুর মা, কাম্মা, জেম্মা ধরে নিল, দেবুটা সরল ও বালিকাবৎ। অত্যন্ত আদর প্রাপ্তি ও নিরাপদ জীবনযাপন দেবু ও শানুকে মনে-মনে বড় হতে দেয়নি। জিতুও এমনই ছিল। জটিল মনোজগৎ নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার পেশাগত দক্ষতা এখন প্রশ্নাতীত। মন নিয়ন্ত্রক ডাক্তারি তত্ত্ব ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও সে অন্যান্য যোগায়ত প্রক্রিয়া অনুধাবন করে চলেছে। বিপাসনা, উপাসনা, ধ্যান, অনুধ্যান, সম্মোহন ও কথোপকথন। চিকিৎসাশাস্ত্র বহির্ভূত বিভিন্ন প্রক্রিয়া সন্ধান করতে গিয়ে সে ক্রমাগত আবিষ্কার করছে, যোগ এবং বিবিধ লোকায়ত দার্শনিকতার তত্ত্ব বিভিন্ন নামে, আরও পরিশীলিত প্রক্রিয়ায় মনঃচিকিৎসা ও সমীক্ষণের অঙ্গীভূত হয়ে আছে। তার পাঠ ও গবেষণা তাকে এমনই আত্মবিশ্বাসী ও ব্যক্তিত্বময়ী করেছে, যাতে তাকে বয়োজ্যেষ্ঠরা সমীহ করে। কিন্তু সে যখন ভাইবোনের সঙ্গে বাল্যকালের মতো মেতে ওঠে, তখন তার মধ্যেকার খুশিয়াল ছোট্ট মেয়েটি আপনিই কি বেরিয়ে পড়ে না? আগাগোড়া তার প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফলের মান ছিল উৎকৃষ্ট। ডাক্তারি পড়ার সময়ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। শেষ পর্বে, অভ্যন্তরীণ চিকিৎসক হিসেবে কর্তব্যের অন্তিম পর্যায়ে যখন স্নাতকোত্তর বিষয়ে কে কিসে বিশেষজ্ঞ হবে তার নির্বাচন চলছিল, যখন অধিকাংশই চাইছিল মেডিসিন, গাইনিকোলজি, কার্ডিয়োলজি, চেস্ট, পেডিয়াট্রিকস প্রভৃতি বিষয়– জিতু স্থির করে, সে সাইকায়াট্রি পড়বে। পড়বেই। স্নাতকোত্তর পর্বে প্রবেশিকায় সে মেডিসিন পেয়েও যখন সাইকায়াট্রি নেয়, সকলেই এই সিদ্ধান্ত পাগলামি বা ছেলেমানুষি মনে করেছিল।
বাড়ির বড়রা এই সন্তানদের শৈশবোচিত লীলায় আনন্দিত, আবার চিন্তিতও। এখন সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেবুর জন্যই!
নিজেকে নিয়ে সবচেয়ে বিস্মিত দেবু নিজেই। যেন কোনও হঠাৎ হাওয়া শরৎকালীন আকাশপটের নীলিমা ঢাকা বাদল মেঘের দল নিয়েছে উড়িয়ে। মনখারাপ করতে আর ইচ্ছে করে না। সেই দেবোপম চোখ দু’টি মনে পড়লেই সব নতুন হয়ে ওঠে। নতুন প্রেরণা, নবউদ্যম, স্বপ্নে নতুনতর রং! চক্ষু দু’টি ভারী সুন্দর যে!
সে পাগলাস্যারের বৃত্তান্ত রসিয়ে গল্প করছে বাবা, মা, ছোটকাম্মা আর অমিয়ামাসিকে। পারমিতা বললেন, “আমি তো তোমায় আগেই বলেছিলাম, চাকরি ছেড়ে দাও, সম্পূর্ণ মনোযোগ দাও পড়ায়! দেখলে তো! কিন্তু সুভাষগ্রাম যে অনেক দূর! কলকাতায় কোথাও ভাল কোচিং নেই?”
দেবু: সেদিন তো তোমাদের বলেই গিয়েছিলাম মা। তখন তো বললে, যেখানে ভাল পড়াবে, যাবি!
পার: বলেছিলাম কারণ, তখন তোকে অত মনখারাপের মধ্যে হতোদ্যম করতে চাইনি।
দেবু: আমার মনমেজাজের সঙ্গে যদি তোমার মতামত পালটায় তা হলে তো খুব অসুবিধে মা!
পার: ঠিক আছে বাবা, আমি আর কিছু বলব না। বড় হয়েছ, যা ইচ্ছে হয় করো।
দেবু: তুমি নিশ্চয়ই বলবে। তুমি আমার মা। কিন্তু তুমি চিরকাল এত যুক্তি বুঝিয়েছ, স্বমত প্রতিষ্ঠার জন্য এত লড়তে দেখেছি তোমাকে মা যে, তুমি যুক্তিহীন কথা বললে ভাল লাগে না। কে বলল আমার মনখারাপ নেই? এত ব্যর্থতার গ্লানি তোমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়! যার এমনটা হয়, সেই বোঝে।
অরুণ: বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে সুভাষগ্রাম খুব দূর নয়।
অমিয়া: তারপর তো আধঘণ্টা ভ্যান-রাস্তা।
কাম্মা: তুমি আবার ধুয়ো ধরছ কেন অমিয়াদি? দেবু তো একা যাচ্ছে না। বন্ধুরা আছে। দিনে দিনে যাবে, দিনে দিনে ফিরে আসবে। সবসময় নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতর থাকলে ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে কী করে? যত বাইরের জগৎ বুঝবে, তত আত্মবিশ্বাস বাড়বে, যুঝবার ক্ষমতা তৈরি হবে।
অরুণ: শ্রীমন্তী, আমি তোমার সঙ্গে একমত। এর মধ্যেই দেবু ভুটান গেছে, কোচিন, বেঙ্গালুরু গেছে, আর সুভাষগ্রাম যেতে পারবে না? তোর সব বন্ধুই কি যাবে বলে ঠিক করেছে?
দেবু: না বাবা। আমি, সায়ন আর শুভায়ন যাব। রূপমের বাড়ি থেকে আপত্তি করছে। দীপংকরের স্যারকে ভাল লাগেনি। বলল, ওর পোষাবে না।
পার: ভুটান, কোচিন এসব জায়গায় অফিস থেকে গিয়েছে। প্লেনে, কোম্পানির গাড়িতে। আর কোন গ্রামের ভিতর, যাকে বলে অজ পাড়া-গাঁ, ভাঙা জমিদারবাড়ি, সেখানে আবার খেয়েও এল– কী জানি বাবা! তো রূপমের বাড়িতে আপত্তি কেন?
দেবু: সে আমি কী জানি! মা, তুমি এমন করছ যেন আমি আফগানিস্তান বা পাপুয়া নিউ গিনি যাচ্ছি!
কাম্মা: তোর কী মনে হয়, কতদিন ক্লাস করলে বুঝতে পারবি লাভ হচ্ছে কি না!
দেবু: বলা মুশকিল। হয়তো প্রথম দিনই। কিংবা দু’সপ্তাহ। যদি ভাল না লাগে কাম্মা, একমাস পড়ে, তাঁর সম্মান-দক্ষিণা দিয়ে, ছেড়ে আসব। সাত্ত্বিক, একাহারী মানুষ। আমাদের পাত কুড়িয়েছেন! উনি আর সবার মতো নন। মা অযথা ভয় পেয়ো না।
পারমিতা: ব্যাপারটা জগাখিচুড়ি নয় কি? অঙ্ক পড়ান, আবার সিএ পড়াচ্ছেন! কী করে সম্ভব? আবার ফল-ফুলের ব্যবসাও করেন। সাত্ত্বিক, কিন্তু ব্যবসাদার!
অরুণ: শোনো, মানুষকে চিনতে-বুঝতে সময় লাগে। ভদ্রলোক আর যাই হোন, পড়ানো নিয়ে ব্যবসা করেন না। এই কলকাতায় দেবু কোচিং নেয়, এক-একটা বিষয় কেউ নেয় চারশো, কেউ সাতশো! সাড়ে পাঁচ-ছ’হাজার টাকা মাসে। এর এক তৃতীয়াংশ টাকায় বহু মধ্যবিত্তের সংসার চলে। উনি দু’হাজার টাকা নেবেন, সপ্তাহে ত্রিশ ঘণ্টা পড়াবেন, আবার ছাত্রদের ভোজন করাবেন! তাই অত সহজে সমালোচনা না করে আর-একটু দেখা উচিত। আর, তুমি বলছ অঙ্ক থেকে অ্যাকাউন্টেন্সি? আমেরিকায় থাকে আমার এক বন্ধু, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিতে কী গোলমাল হল, ওয়ার্ক পারমিট চলে গেল! ওদেশে ওসব হয় তো! ধরো ডাক্তার, তাকে ক’বছর অন্তর পরীক্ষায় বসতে হয়। ফেল করলে ডাক্তারি লাইসেন্স নিয়ে নেবে! তো সেই বন্ধু, শ্যামল, কী করবে? আইন পড়ল! এখন দিব্যি ওকালতি করছে! রাসায়নিক বিষয় সংক্রান্ত মামলায় তার খুবই নামডাক। হতেই হবে তো। আরও উদাহরণ আছে। দীপনারায়ণ!
দেবু: দীপনারায়ণ সিংহরায়।
অরুণ: তোর মনে আছে? সেই নিউ মার্কেটে দেখা হয়েছিল। তুই তখন খুব ছোট।
দেবু: দীপনারায়ণ সিংহরায়। গ্রিকদেবতার মতো দেখতে। সিএ।
অরুণ: পূর্ববাংলায় ওরা ছিল বরিশালের ভাটকোলের জমিদার। আমার স্কুলের বন্ধু। অত্যন্ত মেধাবী। ক্লাসে ফার্স্ট বয় ছিল। অঙ্কে অনার্স নিল। তিনবার ফেল করল, বুঝলে? শেষে অনার্স ছেড়ে সাধারণ গ্র্যাজুয়েট! কী করবে? সিএ পড়তে চলে গেল। একবারে ফাইনাল পাশ করেছিল। অ্যান্ড হি ওয়াজ় দ্য টপার! যদি মেধা থাকে, ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিষ্ঠা থাকে, মানুষ অনেক কিছুই আয়ত্ত করতে পারে!
দেবু: তোমার এই সিএ বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ নেই বাবা?
অরুণ: ও যোগাযোগ রাখতে চায় না। কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা আছে। শুনেছি, ওর ছেলেটি মানসিক প্রতিবন্ধী!
দেবু: ইস! আহা রে!
পারমিতা: আমার মনে হয় একটি দিন তুমি ওই অসীমচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে যাও। আলাপ করে এসো। জায়গাটা দেখে এসো। পাগলাটে মানুষ! বাড়িতে আর কে কে আছে? অভিজ্ঞ চোখে দেখলেও তো একটা আন্দাজ পাওয়া যায়! তোমরা যাই বলো, কলকাতার মধ্যে একরকম, গাঁ-গঞ্জে আর-একরকম।
দেবু: বাড়িতে আর কে কে আছেন জানি না। তবে সুমা আছেন। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর নাম শুনেছি। তাঁর স্ত্রী বা আত্মীয়া।
পারমিতা: তবু ভাল বাড়িতে একজন মহিলা আছেন।
দেবু: আমি নিশ্চিত নই যে, তিনি মহিলাই। নাম শুনে মনে হল।
অমিয়া: দ্যাখো কাণ্ড!
দেবু: মা, তুমি নিজেই চলো একদিন। উচ্চস্তরের আঙ্কিক আড্ডার একটা সুযোগ পেতে পার।
অরুণ: সে আমি যাব এখন। তোদের নিয়ে গাড়িতে চলে যাব। তোর মাকে আর নিয়ে যাস না। হয়তো, ভদ্রলোক কেন সিএ পড়াচ্ছেন, এই নিয়ে বকুনি দিয়ে আসবে। কিংবা পরীক্ষা করতে বসে গেল, কতটা জানে, বোঝে! এমনিই বলছিস পাগলাস্যার! সমধর্মীতে বিকর্ষণ, ছোটবেলায় পড়িসনি?
পার: কী? আমি পাগল!
কাম্মা: না, না। শুধু বিষয়টায় একটু অঙ্ক লেগে আছে বলে আমাদের আতঙ্ক!
অমিয়া: তুমি অত চটছই-বা কেন দিদিমণি?
অরুণ: শ্রীমন্তী, তোমার মেজদিদিকে নিয়ে আমাদের জিতুমণির চেম্বারে যাও।
দেবু: সবাই মিলে মা’র মাথা গরম কোরো না তো। শোনো না! একটাই কষ্ট বাবা। কাজটা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
অরুণ: তোদের পড়ার ছুটি দেয় না?
দেবু: দেয়। দু’সপ্তাহ।
অরুণ: তুই সেই ছুটির দরখাস্ত দে। দু’সপ্তাহে যদি অসীমচন্দ্রকে ভাল লেগে যায়, ছেড়ে দিবি চাকরি। তোর মূল লক্ষ্য তো পাশ করা।
পারমিতা: আমিও তো তাই বলি। কিন্তু পরীক্ষা যদি সেই নভেম্বর মাসে হয়, সম্বন্ধটার কী হবে? আমরা যে ঠিক করলাম বৈশাখে দেবুর পরীক্ষা হলেই আশীর্বাদ সেরে ফেলব। জ্যৈষ্ঠে একটা শুভদিন দেখা হবে!
দেবু: বাপ রে! আমি কি তোমাদের গলার কাঁটা, না গলগণ্ড? আর কী অদ্ভূত! বাড়িতে বিয়ে-টিয়ে লাগলেই তোমরা মাসগুলো বাংলায় বদলে দাও!
অরুণ: বিয়ের সম্বন্ধ? সে হবে পরে। অত তাড়া কিসের? মেয়েটাকে সুস্থির হতে দাও আগে।
দেবু উদগ্রীব! সে আজ চায় এই প্রসঙ্গ আরও আলোচিত হোক। সে প্রস্তাবিত পাত্রের নাম জানতে চায়। কেন চায়? মনের কোণে কোথাও কি এই আকুলতা নেই, তার নাম রাজর্ষি দাশগুপ্ত হোক? হলে কী হবে? সে কি বিনা প্রতিবাদে, সুশিক্ষিত সারমেয়বৎ বিয়ের কনে সেজে বসে পড়বে? অসম্ভব! পাত্র রাজর্ষি হোক বা দেবর্ষি, তফাত কতটুকু? দেবাদৃতা কাউকেই চেনে না।
তা হলে সে কেন, সুভাষগ্রামের গল্প থেকে খুব সন্তর্পণে রাজর্ষি দাশগুপ্তর উপস্থিতি ছেঁটে ফেলল? কেন সরলতায় বলে ফেলল না, একজন পদার্থবিদ্যার মেধাবী অধ্যাপক অসীমচন্দ্র চৌধুরী পাগলা স্যারকে কতখানি শ্রদ্ধা ও সমীহ প্রদর্শন করছিল? যদি বলত, হয়তো পারমিতার দুর্ভাবনা নিরসনে তা সাহায্য করত! অথচ, নামটা সে মুখে আনতেই পারল না কেন?
সে জানে না। সমস্ত খুঁটিনাটি বর্ণনা থেকে একজনকে লুকিয়ে রাখার কারণ সে জানে না! বলবে বটে, প্রথমেই শানুকে নয়, জিতুদিদিকে!
সে শুনল, কাম্মা বলছে, “মেজদাদা, অত হেলাফেলা কোরো না। ভাল সম্বন্ধ সহজে পাওয়া যায় না। ছেলেটি সত্যি ব্রিলিয়ান্ট! দেখাশোনা একবার হোক না। ওদেরও তো একটা মতামত থাকবে। বড়দিদির চেনা, একমাত্র ছেলে। বাড়িতে শুধু মা। কসবায় যেখানে রুবি হাসপাতাল হয়েছে, সেখানে ফ্ল্যাটে থাকে। এখান থেকে খুব দূরেও নয়।”
পারমিতা: ওদের একটু বোঝা তো ছোট। যেমন বাবা, তেমনই মেয়ে!
কাম্মা: পাত্রের ছবিটা দেখিয়েছ দেবুকে?
দেবু: ছবি! তোমরা ছবিও এনেছ?
কাম্মা: তোমার ছবিও ও বাড়িতে গিয়েছে দেবুমণি!
দেবু: আমার ছবি কোন এক বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে, আমায় একবার বললে না? এটা ঠিক নয়! এটা ঠিক হল না কাম্মা।
কাম্মা: তোর ওপর কি আমাদের কোনও অধিকারই নেই রে দেবু? তুই এতই বড় হয়ে উঠেছিস? আমার বিয়ের পর রোজ ভোরবেলায় টুকটুক করে আমাদের ঘরে এসে ঠিক মাঝখানে শুয়ে পড়তিস। আমার গলা জড়িয়ে, পেটে পা তুলে ঘুমনো তোর অভ্যাস ছিল!
পারমিতা: আর আমাকে কী করত? দুধের নেশা পেলেই বলত, অ্যাই মা, অ্যাই মা বছা বছা। মানে বোসো, দুধ দাও। সবাই মিলে দার্জিলিং গেলাম, তোর বিয়ের আগে আগে, মলটায় ওকে কোলে নিয়ে হাঁটছি, শুরু হল, বছা বছা! কী চিৎকার!
দেবু: ধ্যুৎ! তোমরা না…
দেবু উঠে পড়ল! অভিমান নিংড়ে আবেগে ধুইয়ে স্বমতে ফেরানোর পদ্ধতি বড়রা খুব ভাল জানে! তাই বলে তাকে একবার বলা হবে না, তার ছবি যাচ্ছে? একজন ব্যক্তির উপর আর-একজনের স্নেহ-ভালবাসার অধিকার কি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী?
সে নিজের ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিল। শুনতে পেল, মা বলছে, “বড় মর্জিবাজ হয়েছে মেয়েটা! একটা ছবি দেওয়া হয়েছে বলে এত রাগ? কাল থেকে আবার গোমড়ামুখো হয়ে থাকবে!”
কাম্মা: না মেজদিদি! এ আমাদেরই দোষ। ওকে অন্তত জানানো উচিত ছিল। পরে ওকে বুঝিয়ে বলব।
মা: মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে সব বাড়িতেই এমন ছবি দেওয়া-নেওয়া হয়। সবই যদি জিজ্ঞেস করতে হয় তা হলে আমরা কিসের অভিভাবক?
অরুণ: আমরা ওর অবিভাবক নই কিন্তু। তোমরা এই ধারণা পাল্টাও। আমাদের দেবু স্বাবলম্বী। আমরা ওর পরমাত্মীয়।
মা: সবসময় মেয়ের দিক টেনে কথা বলো তুমি!
অরুণ: এ ধরনের কথা ভাল নয় মিতা! তুমি ও তোমার মেয়ে তো প্রতিপক্ষ নও। যা সঠিক আমি তাই বলেছি। ইদানীং লক্ষ করছি মেয়ের ব্যাপারে তুমি কেমন অসহিষ্ণু!
মা: আমি অসহিষ্ণু! আমি ওকে ভালবাসি না? উৎসাহ দিই না?
কাম্মা: তা ভালবাসবে না কেন! মেজদিদি, আমরা সবাই ওর সাফল্য চাই, মঙ্গল চাই। ওর ব্যাপারে আমাদের সবাইকেই একটু সংবেদনশীল হতে হবে। এই পরিবারে ওর অবস্থাই সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে অনিশ্চিত!
মা: আমার মেয়েটা আজও প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না, তাতে আমার দুঃখ হতে পারে না?
কাম্মা: তুমি মা, তোমার দুঃখ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমরা সবাই কষ্ট পাই। সবচেয়ে বেশি পায় ও।
মা: সেজন্যই তো চাইছি, জীবনের আরও তো স্বাদ আছে, সময় থাকতে সেইটুকু পাক অন্তত। তারও তো মূল্য কম নয়।
অরুণ: তুমি কি মধ্যবয়সে পৌঁছে গিয়েছ বলে এসব বলছ, নাকি তোমার ভিতরে একজন সেকেলে ধ্যানধারণার মানুষ বসে আছে! নাকি স্কুলে মাস্টারি করতে করতে তোমার মধ্যে কূপমণ্ডূকতা এসেছে মিতা? দেবুর সুখ-শান্তি আমরা কেউ নির্ণয় করে দিতে পারি না! কিছুই চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় শুধু নয়, ভুল। ও নিজে যখন চাইবে, হবে।
কাম্মা: কিন্তু বিয়ের উদ্যোগ নেওয়ায় তো অন্যায় নেই। যোগাযোগ চলুক না।
অরুণ: বিয়ে হলেই ও সুখসাগরে ভাসবে, বুঝছ কী করে? তার চেয়ে, আগে ও যা হতে চায়, হোক, তারপর বিয়ে হবে!
মা: যেমন তোমার বুদ্ধি! ওর বয়স যেন গড়াচ্ছে না!
পারিবারিক কলহ। তাদের বাড়িতে এমনতর যুক্তিতর্ককেই কলহ মনে করা হয়। কেউ উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে না। কেউ কারও নাসিকাগ্রে অঙ্গুলি-নর্তন করে না! কিন্তু এ বাড়িতেই একটি ফোটোগ্রাফ ব্যক্তির অজানিতে বিবাহের জন্য প্রদর্শিত হয়!
দেবাদৃতার বুকের মধ্যে তীব্র বিদ্যুৎরেখার মতো কষ্টের আঁকাবাঁকা ঝলক স্ফুরিত হতে লাগল ক্রমাগত! আজ এই কলহের মূলে সে। মায়ের অসহিষ্ণুতার সে-ই কারণ। তার নিরন্তর ব্যর্থতা! ভুল অঙ্কের জন্য অন্যদের যতই নম্বর দিক, তার প্রতিবারের প্রয়াস ও ব্যর্থতা মাকে অকৃপণ করতে পারেনি।
রাজর্ষি দাশগুপ্তর ওই রাজীবলোচনের আবেশ ভেঙে গেল পুরোপুরি। যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল তার বিফল ব্যথিত সত্তা। তার গম্ভীরতর আমিত্ব। সে ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। কাঁদা তার স্বভাব নয়। কিন্তু এক অজ্ঞাত, অসহায় অভিমানে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করতে লাগল। বিয়ে বিষয়ে তার এখন এতটুকু আগ্রহ নেই। তার এই বারংবার ফেল করার পরিপূরক হিসেবে একজন সুপাত্রে গাঁটছড়া বাঁধন কোনও সাফল্যের বেদি হতে পারে না। জিতুদিদি বলেছিল– তুমি আমার, আমি তোমার– দু’টি মানুষের এই পরস্পর লীন হওয়া আসলে এক গভীর উপলব্ধি। শব্দগুলো শুনতে সুন্দর লাগে। বিশ্বাস করতে ভাল লাগে– যে হৃদয় তোমার, সে হৃদয় আমার– তাই বিয়ের মন্ত্র হয়েছে, গানের পঙ্ক্তি হয়েছে, প্রেমিকদলের আবেগে সোনার নৌকার মতো বারংবার ভেসে উঠেছে! কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়! ব্যক্তির পক্ষে আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে অপরে লীন হওয়া সম্ভব নয়। যা সম্ভব, তা হতে পারে ভালবাসা! এর চেয়ে শক্তিমান এবং গাঢ়তর আর কিছু নেই। এর চেয়ে বিচিত্রও কিছু নেই। তা আকস্মিকভাবে গড়ে উঠতে পারে। ধীরে-ধীরে তৈরি হতে পারে। ভালবাসার পরম রমণীয় গৃহটির নির্মাণ পদ্ধতি যাই হোক, একবার রচিত হলে সহজে সে গৃহ কাউকে নিরাশ্রয় করে না। দৈন্য তাকে প্রভাবিত করে না, অপরাধ ক্ষমা পেয়ে যায়, সেখানে সফল-বিফল সুন্দর-অসুন্দর নেই। কিন্তু সেই রমণীয় গৃহটির সুন্দরতর কক্ষগুলিতে পৌঁছতে পারে ক’জন?
জিতুদিদির সঙ্গে তার সেই আলোচনা, সংলাপ, কিংবা বলা যেতে পারে, জিতুদিদির বলা কথা, ব্যাখ্যা করা তত্ত্ব, প্রত্যক্ষ করা মানসিক সমস্যাসমূহের বর্ণনা– এই সবই তার শিক্ষা। তার পরিণতবুদ্ধির পাথেয়। চূড়ান্ত ভালবাসার সন্ধান জিতুদিদি পেয়েছে কি না, সে জানতে চেয়েছিল।
জিতু বলে, “সেটা আজও পরীক্ষিত নয়! তেমন সংকটে পড়লে বোঝা যাবে। মনোময় আমাকে ভালবাসে, আমিও ওকে ভালবাসি। আমরা একই পেশাগত জগতে থাকি বলে পরস্পরের সুবিধে-অসুবিধে বুঝি, পরস্পরের কাজকে সম্মান করি। সম্পর্কের মধ্যে এগুলো জরুরি! বিয়ের দু’বছর পর থেকে আমরা শরীরের আদরে সমস্ত সতর্কতা তুলে নিলাম। মা হলাম না। আমি আমার বন্ধু, নারীরোগ বিশেষজ্ঞ, সংযুক্তার কাছে গেলাম। আমার শরীরে কোনও ত্রুটি নেই। এবার প্রশ্ন হল মনোময়ের পরীক্ষার! ও খুব ভেঙে পড়ল। ভয় পেল। আমাদের শরীর-মন সব নিয়ে আমরা আনন্দে কাটিয়েছি। ওর বাহ্যত কোনও অসুবিধে নেই।’’
দেবু: তা হলে ভয় পেল কেন?
জিতু: শিশুভ্রূণ তৈরির জন্য শুক্রাণু ও ডিম্বাণু লাগে ছোটবেলায় পড়েছিস, শুক্রাণু পরিমাণমতো না থাকলে, কিংবা একেবারেই না থাকলে বা দুর্বল হলে নির্বিঘ্ন যৌন সম্পর্ক সত্ত্বেও বাচ্চা না হতে পারে। আবার সব ঠিক থাকার পরেও বাচ্চা আসে না। প্রকৃতির খেয়াল। ওর ভয় হল, ও দোষী প্রমাণিত হলে কী হবে!
দেবু: দোষ কেন? এ তো নিজের ইচ্ছেয় হয় না।
জিতু: কিন্তু শরীরটা যে ওর নিজের। একজন সুস্থ সবল যুবক, কী করে সহজেই মেনে নেবে সে পিতা হতে অক্ষম? ওর ভীতি, ওর উদ্বেগ আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আমি বুঝেছিলাম, ও অক্ষম প্রমাণিত হলে পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। আমাকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে, বলে, তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? আমি সিদ্ধান্ত নিলাম। ও একজন শল্যবিদ। সবে নাম করতে শুরু করেছে। যদি অক্ষমতা প্রমাণিত হয়, মেনে নিতে পারবে না। ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অপারেশন করার দায়িত্ব নিতে পারে, কিন্তু যদি একেবারে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ও পরাজিত হয়, ও সহ্য করতে পারবে না। ওর সব যাবে। মনের দুর্বলতা ওর স্নায়ু খেয়ে ফেলবে একেবারে! স্নায়বিক দুর্বলতা ওর ব্যক্তিজীবন ও পেশাগত জীবনকে ধ্বংস করে দেবে! তার চেয়ে যা অজ্ঞাত আছে, থাক। দেবু, জীবনে কেবল মণিমুক্তোয় ভরা উপহারের চমকই নেই, প্যান্ডোরার বাক্সও থাকে। তাকে না খুললে যদি ভাল হয়, তবে খোলার প্রয়োজন কী!
দেবু: এ তো ভয়ংকর সমস্যা! কিন্তু মনোময়দা নিজে ডাক্তার! এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার জোর থাকা উচিত নয় কি?
জিতু: সমস্যা ভয়ংকর মনে করলে ভয় করবে। আমি ভয় করি না। বিয়ের দশ-পনেরো বছর পরও সন্তান আসে। কারও আসেই না। তাদের জীবনে কি আর কোনও আনন্দ নেই? মনোময় ডাক্তার, কিন্তু তার আগে ও একজন মানুষ। পুরুষদের মনস্তত্ত্বে যৌনতা অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। যৌনজীবন সংক্রান্ত সামান্য ত্রুটিও বরদাস্ত করতে পারে না। নিজেকে পর্যুদস্ত মনে করে। পরাজিত হতাশ্বাস মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল ও কঠিন রোগী। একই সঙ্গে তারা জীবিত ও মৃত! যে এখনও এলই না জীবনে, তার জন্য, যে আছে, তাকে মারতে পারব না।
দেবু: কত লোকের সন্তান তো দুর্ঘটনাতেও মরে যায়! যেমন মা’র সেই ছাত্রীটি!
জিতু: আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, আমরা দু’জন ডাক্তার, এই সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে অবৈজ্ঞানিক হল। কিন্তু তা নয়। মনোময়ের পক্ষে এটাই সর্বোত্তম নিদান! ও বিশ্বাস করতে চায় ওর সবকিছু ঠিক আছে! বিশ্বাস করুক। আমাদের কোনও অভাববোধ নেই। দু’জনেই অত্যন্ত ব্যস্ত!
দেবু: বাড়িতে এসব বলেছ?
জিতু: ওর তো জানিসই বাবা-মা গত হয়েছেন। একটা বোন সুইডেনে থাকে। বাকি আত্মীয়স্বজন যে যার মতো। কেবল কারও অসুখ-বিসুখ করলে আমাদের খোঁজ পড়ে। আমরা ডাক্তার ঠিক করে দিই। পরামর্শ দিই। হাঁচি-কাশি হলেও ফোন আসে, কোমরে বেদনা বা পশ্চাদ্দেশে ফোঁড়া হলেও আসে। যদিও, ক’জন আমাকে ডাক্তার বলে মনে করে সন্দেহ, আমি নিজে ওর এক মেসোমশাইকে বলতে শুনেছি, “মেয়েরা আবার ডাক্তারি পারে নাকি। তা-ও আবার পাগলের ডাক্তার! পাগলামি এমনিও সারে না, ওমনিও সারে না!” কত ভুল ধারণা মানুষের! সত্যের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা কত সামান্য! সামাজিক সম্পর্কগুলো কত ঠুনকো, ভঙ্গুর! আবার অসামান্য ভালবাসার পরিচয়ও পাই। একজন মনোবিদ যেভাবে সমাজের মনোজগতে শিরা-ধমনি অবধি দেখে ফেলে, তেমন অন্য কারও পক্ষে মুশকিল! আমাদের বাড়িতে অন্যরা এখনও ভাবছে, চরম আধুনিকতা ও পেশামুখিনতায় আমরা দু’জনেই এত ব্যস্ত যে, এখনই বাচ্চা চাইছি না। কাম্মারা, দু’জনেই, মাঝে-মাঝে বলে। কিন্তু মাকে কী করে ফাঁকি দিই? একে আমার জন্মদাত্রী, তদুপরি নিজে ডাক্তার! অসুবিধে কিছু আছে, স্বীকার করেছি। তোকে যেমন বললাম, অতখানি বলিনি। মা যা অনুমান করে, করুক!
দেবু: এত সহজে হার মেনে নেবে? মনোময়দার কোনও সমস্যা থাকলে ওকে বুঝিয়ে চিকিৎসা করানো যায় না? তুমি যদি মা হতে চাও, তোমার পূর্ণ অধিকার আছে, তুমি নলজাতকের কথা ভাবতে পার। অবশ্য আমার এসব তোমাকে বলা সাজে না। তোমার সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই নির্ভুল!
জিতু: এই পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত সর্বোত্তম! পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে গেলে, নলজাত বা, ধর শুক্রাণু ধার নিয়ে মাতৃত্ব, মনোময়কে হতমান করবে। এসব গোপনে করা যায় না। গোপন থাকেও না। আমরা যতই স্বাতন্ত্র্যের অধিকারের কথা বলি, সামাজিক নিষ্ঠুরতার হাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই। মানুষের মনের সৌন্দর্য যেমন অপরিমিত, অতুল, তেমনই বিপরীত দিকটি হল, মানুষের চেয়ে নির্মম অন্য কোনও প্রাণী নয়।
দেবু: জিতুদিদি, তুমি মনোময়দাকে কত ভালবাসো!
জিতু: আমিও তো ভালবাসা পাই।
দেবু: এত করছ, তবু বলছ ভালবাসার পরম রমণীয় গৃহটি পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে?
জিতু: নিশ্চয়ই। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মনের গড়ন পালটায়। আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে অন্য আমি হয়ে যেতে থাকি। কোনও জোরালো অভিঘাত এলে সেই পরিবর্তন ধরা যায়, না হলে পুরো প্রক্রিয়াই নিজের অজ্ঞাতসারে চলে। আমাদের বোধ পালটায়, দেখার চোখ, চাহিদা– সব পরিবর্তিত হয়। তুই তো জানিস, পরিবর্তনই জগতের ধ্রুব সত্য। তাই আরও সময় লাগবে এটা বুঝতে যে, আমরা পরস্পর আমাদের পক্ষে কতখানি অপরিহার্য! আমরা কতখানি পরস্পরে লীন!
দেবু: সব সম্পর্কের মধ্যেই তো এই পরিবর্তন?
জিতু: নিশ্চয়ই। যখন শিশু ছিলি, মায়ের বুকের কাছে না শুলে ঘুম আসত না। এখন তোর আলাদা ঘর, আলাদা বিছানা। ভালবাসা আছে, কিন্তু আকার বদলে যাচ্ছে। আমাদের দর্শনে নিজেকে জানার কথা বলা আছে। আবার একথাও বলা হচ্ছে, মন দুর্জ্ঞেয়। মনোরহস্যের কোনও কিনারা নেই। কারণ, মন সদা পরিবর্তনশীল!
এই মুহূর্তে দেবাদৃতা সবচেয়ে বেশি করে চাইছে তার জিতুদিদিকে। সে অস্থির বোধ করছে। জীবনে যা-ই আসুক, তার সাধনা তার লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছনো। সেজন্য তাকে শান্ত থাকতে হবে। অবিচল হতে হবে। সাধনাই সরস্বতী, বলেছিলেন জয়নাথ ভ্যানওয়ালা, যিনি কৃষক থেকে ভ্যানচালকে রূপান্তরিত হয়েছেন স্বাধীনভাবে সারেঙ্গি বাজাবেন বলে, অথচ তিনি কারও উপর নির্ভর করতেও চান না। তিনি বলেছিলেন, নির্জন সরস্বতী। তাঁকে নিয়ে লিখিত একটুকরো খবরের শিরোনাম। সবই কি সাধনা নয়? নিজেকে জানা, নিজেকে প্রস্তুত করা, ভালবাসার সেই পরম রমণীয় গৃহের রচনা, যা জিতুদিদি করে চলেছে, সবকিছুই কি সাধনা নয়?
তাই বলে একজন অজানা অপরিচিত লোক, তার ছবি দেখবে! তাকে আগুনের চারপাশে ঘুরিয়ে লাল গুঁড়ো মাথায়-কপালে ঢেলে দিলেই পিঁ পিঁ বাঁশি বাজবে, তারপর রেডি-স্টেডি-মার্ক অন ইয়োর লাইন–ফুর্র্র্র্– দৌড় শুরু করার শব্দনিশান! সঙ্গে-সঙ্গে তারা দুই যুবক-যুবতী, ভালবাসার প্রক্রিয়া শুরু করে দেবে! দৌড় দৌড়! অজ্ঞাত অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে, ভালবাসা ভালবাসা ভালবাসা, পাক বা না পাক, ভড়ংয়ের সংসারে হা জীবন, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে প্রেমের রমণীয় মন্দিরের ঠিক বাইরে, যেখানে পূজাশেষের বাসি ফুল পচে পড়ে আছে!
এভাবে হয় নাকি? ধুস!
টক্ টক্ টক্!
তার দরজায় টোকা পড়ছে। যদি জিতুদিদি হয়? সে দেখেছে, যতবার সে মনে মনে চেয়েছে, তার অব্যবহিত পরেই জিতুদিদি এসে গিয়েছে! এ হল মনে মনে নিবিড় সংযোগ। মনের চেয়ে শক্তিমান এবং রহস্যময় আর কী আছে?
টক্ টক্ টক্!
এবার তার মনে হল, জিতুদিদি নয়। সে আসে উথাল হাওয়ার মতো। এক ধাক্কায় দরজা খুলে ঢুকে পড়বে! তাদের সম্পর্ক এমনই নির্বাধ!
সে বলল, “কে?”
“তোমার কাম্মা।”
“এসো।”
“আলো নিভিয়ে শুয়ে আছিস কেন রে?”
“তাতে অসুবিধে কী!”
“চল, আজ আমার ঘরে খাবি। চিতলপেটি এনেছে তোর কাকুন। এনেই বলেছে, দেবুকে দিয়ো!”
“একটু পরে যাচ্ছি! শানু ফিরলে ডেকো।”
“ঠিক আছে। শোন, এখানে একটা খাম রেখে গেলাম। ছবি আছে। একবার দেখিস।”
“হুঁ!”
“আমাদের অন্যায় হয়েছে। ছবির কথা তোকে বলা উচিত ছিল! ছেলেটি এত ভাল, আমরা একটু বেশিই তাড়া করছিলাম।”
“ঠিক আছে।”
খেতে বসে শানুর সঙ্গে গালগপ্পো করে খানিক হালকা হল দেবু। শানু বলল, “ছবিটা দেখলে নাকি?”
দেবু: কী ছবি?
শানু: ইঃ! ন্যাকা! হলেও হতে পারে মনোময়দার ভায়রাভাইয়ের ছবি!
দেবু: দেখিনি!
শানু: আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।
দেবু: কী সন্দেহ?
শানু: দু’পোচ কালি লাগিয়ে যিশুর ছবি পাঠায়নি তো?
দেবু: না দেখলে কী করে বলব?
শানু: দেখে বোলো! আচ্ছা ভায়রা মানে কী? ভায়রাভাই! কী অদ্ভূত সব বাংলা!
দেবু: কেলিকুঞ্চিকাপতি।
শানু: কী পতি?
দেবু: কেলিকুঞ্চিকা, মানে শালি, তার পতি!
শানু: হা হা হা হা হা! কেলিকুঞ্চিকা মানে কী, যার সঙ্গে নিঃসঙ্গোচে কেলিকেত্তন করা যায়?
দেবু: তাই হবে!
শানু: কিন্তু ভায়রা?
দেবু: শোন, আমড়া যেমন কিছুটা কচি কচি আমের মতো কিন্তু আম নয়, তেমনি কেলিকুঞ্চিকাপতি কিছুটা ভাইয়ের মতো, ভায়রা, কিন্তু ভাই নয়।
শানু: হা হা হা হা! ভাল দিলে কিন্তু! সুভাষগ্রামে তোমাদের কী খাইয়েছে বললে, তোমার বুদ্ধি খুলে গেছে। ওখানেই পড়ো, বুঝলে? পাশ করে যাবে।
দেবু: নুন ছাড়া ঘ্যাঁট! ওতে ঘটে কিছু বাড়ে না। বুদ্ধি আমার বরাবরই আছে! ফলগুলো খুব ভাল ছিল। ভাত আর ডালটাও! ঘটের বুদ্ধির জন্য ঘ্যাঁট লাগে না। ভায়রা মানে ভ্রাতৃতুল্য এটা কিন্তু সঠিক। ভ্রাতৃ থেকে প্রাকৃত অপভ্রংশে ভায়র, তা থেকে কথ্য অভিযোজন ভায়রা।
শানু: তোমার সিএ-তে কি আজকাল বাংলা পেপার আছে দেবুদিদি?
দেবু: না। বাংলা ব্যাকরণ পড়তে ভাল লাগত। ফাঁকি দিইনি।
খাওয়া শেষে, আরও খানিক আড্ডা দিল ভাইবোন। শানু বলল, “গাঁজা টেনেছ কোনওদিন দেবুদিদি?”
“তুই টানছিস বুঝি? মারব গাঁট্টা!”
“দিদিগিরি ফলিয়ো না তো! খেয়েছ কি না বলো।”
“না।”
“খাবে? একদিন টেস্ট করো।”
“করব।”
“দারুণ, বুঝলে! মনে হয় শূন্যে আছি। মনে হয় যাবতীয় সূক্ষ্মতম স্নায়ুতন্তুর চলাফেরা টের পাচ্ছি। প্রত্যেকটা নিউরন যেন আমারই ইশারায় দুনিয়ার বার্তা বহন করছে। যে-অঙ্ক এমনিতে বুঝি না, গাঁজায় দু’টান দিলে সব বুঝে যাই।”
“শয়তান! নেশা করা হচ্ছে! এমন মার দেব না!”
‘‘আরে, রোজ খাই নাকি?”
‘‘খাস না?”
“তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, না। মাঝে-মাঝে। আমার নেশার মোহ নেই গো। ক্যাম্পাসে তো জানোই, এমন নেশা নেই যা পাওয়া যায় না!”
‘‘আনিস একদিন। বাড়িতে খাওয়া যাবে?”
“শীত যাক। ছাদে গিয়ে খাব। ভাল লাগবে। ফুরফুরে লাগবে। তোমার দরকার মাঝে-মধ্যে!”
“বিয়ার, ভদকায় যথেষ্ট হচ্ছে না বলছিস?”
“আরে, ওসব শিশুর হিসু। গাঁজা মানে শিবের ছিলিম বাবা! একেবারে অন্য জিনিস। টানলে বুঝবে। প্রথমদিন সিগারেটে পুরে স্টিক টানাব। ভাল লাগলে একদিন জমিয়ে ছিলিম নেব।”
“জিতুদিদিকে সঙ্গে নিবি না?”
“যদি বকে দেয়?”
“ওকে এখনও চিনলি না?”
নিজের ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে দিল সে। পরিপাটি বিছানা পাতল। পড়ার টেবিলে বইখাতা, সাইক্লোস্টাইল করা বা ফোটোকপি করা পাঠ্য বিষয়। সব নামাল। টেবিল পরিষ্কার করল। একগাদা অপ্রয়োজনীয় কাগজের স্তূপ নামিয়ে রাখল মেঝেয়। কাম্মা একটি খাম রেখে গিয়েছিল, সেটি রাখল ওয়ার্ডরোবের উপর। এখনই খুলল না। বইপত্র গুছিয়ে টেবিলটা নতুনতর করে তুলল। বসল একবার। একটি ডায়েরি টেনে লিখল– আবার নতুন করে শুরু! নির্জন সরস্বতী। নিভৃত সাধনা। সাধনায় সাফল্য চাই। নিজেকে জানতে চাই।
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ॥
শরীরের স্থূল সত্তার চেয়ে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্রিয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মন, মনের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বুদ্ধি, বুদ্ধির চেয়ে বহুগুণ শ্রেয় আত্মা।
জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আসলে শরীর থেকে আত্মার অভ্যন্তরে গমন!
অনেকদিন পর আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভাল করে দেখল সে। নিজেকে যত্ন করে না, সাজাতে ভুলে গিয়েছে। অসাফল্যের গ্লানিতে দু’চোখে অনুজ্জ্বল ক্লান্ত চাহনি!
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে একচিলতে হাসল। ফিসফিস করে বলল, “পারব। আমাকে পারতেই হবে!”
ঢিলে রাতপোশাকের নীচে তার নরম নির্মেদ মসৃণ শরীর শীতার্ত বোধ করল। একটি চাদর জড়িয়ে নিল সে। ছবির খামখানি হাতে নিয়ে কাঁপতে লাগল। এত শীত আজ? এত শীত কেন?
একটু একটু করে ছবিটি বের করতে লাগল! উলটো করে! সাদা দিক উপরে রেখে। শানু কেন বলল, যিশুর ছবিতে কালো রং? চুল? দাড়ি! জিজ্ঞেস করতে পারেনি সে!
বন্ধ করল চোখ। ছবিটি ফেরাল। আস্তে-আস্তে চোখ মেলে দেখল মায়াময় চোখে তার দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে রাজর্ষি দাশগুপ্ত!
ছবিটি দ্রুত খামে পুরে জোরে-জোরে শ্বাস নিতে লাগল সে। তার বুক ধক-ধক করছে। ভীষণ ধক-ধক করছে। হৃৎপিণ্ড ফেটে বেরিয়ে যাবে এবার!