০৪. ওসমান সাহেবের বাবা ফয়সল সাহেব

ওসমান সাহেবের বাবা ফয়সল সাহেবের বয়স তিয়াতুর। এই বয়সেও তিনি বেশ শক্ত। রোজ ভোরে দুমাইল হাঁটেন। বিকেলে ঘড়ি ধরে পনেরো মিনিট ফ্রি হ্যাঁন্ড একসারসাইজ করেন। চোখের দৃষ্টি ঠিক আছে। কিছু দিন আগেও চশমা ছাড়া পড়তে পারতেন। এখন অবশ্যি প্লাস ওয়ান পাওয়ারের চশমা লাগে। লোকটি ছোটখাটো এবং রোগা-পাতলা। রোগা লোকেরা যেমন হয় দারুণ রািগচটা। দুমাস আগে তাঁর ছোটখাটো একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। ডাক্তার রাগারগি না। করার জন্যে কঠিন নিষেধ জারি করেছেন। বাড়ির লোকজনদেরও বলা হয়েছে যেন কিছুতেই তাকে রাগানো না হয়। যা বলেন। তাই যেন সবাই মেনে চলে। সবাই করেছেও তাই। এতে ফয়সল সাহেব আরো রেগে যাচ্ছেন। আজও মিলিকে ঢুকতে দেখে তিনি রেগে গেলেন। রাগের যদিও কোনো কারণ ছিল না।

তিনি বসেছিলেন বারান্দায় ইজিচেয়ারে। নিচু একটা কফি টেবিলে পা তুলে দিয়েছেন। কোলের উপর খবরের কাগজ। তিনি কাগজ পড়ছিলেন না। মিলিকে ঢুকতে দেখে কাগজের উপর চোখ রাখলেন। মিলি ক্ষীণস্বরে বলল, কেমন আছ বাবা?

ভালই আছি, খারাপ থাকব। কেন?

না মানে শরীর ঠিক আছে তো?

ঠিক না থাকলে তুই কী করবি, ঠিক করে দিবি?

মিলি কী বলবে বুঝতে পারল না। বাবার সামনে একটি চেয়ার আছে। সেখানে কী বসবে খানিকক্ষণ? কিন্তু বাবা নিশ্চয়ই তা পছন্দ করবেন না। মিলি সংকুচিত হয়ে বসেই পড়ল। ভয়ে ভয়ে বলল, নানান ঝামেলায় থাকি আসাই হয় না।

আসতে বলি নাকি?

না বলবেন কেন? নিজে থেকেই তো আসা উচিত।

আমি সুখেই আছি। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। নিজেদের কথা ভাব। নিজেদের চরকায় তেল দে। আই থিং ইওর চরকা নিডস ওয়েলিং।

ফয়সল সাহেব ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন এবং অতিদ্রুত পা নাচাতে শুরু করলেন। এটা তার একটা সিগন্যাল। যার মানে হচ্ছে আমি আর একটি কথারও জবাব দেব না, এখন বিদেয় হও। মিলি তুব আরেকবার চেষ্টা করল। বেশ উৎসাহের ভঙ্গি করে বলল, রানু ভাবীর বাসায় গিয়েছিলাম। ওরা ভালই আছে। তবে টগরের গা গরম।

ফয়সল সাহেব পত্রিকাটি চোখের আরও কাছে নিয়ে এলেন। যেন হঠাৎ দারুণ একটা খবর চোখে পড়েছে।

আপনি যদি রানু ভাবীকে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলেন তাহলে মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি বুঝিয়ে বলব কেন? হুঁ এম আই? এখানে আমার কথা আসছে কেন? যুদের ঝামেলা তারা মিটাবে।

ভাবী আপনাকে খুব রেসপেক্ট করে।

সে রেসপেক্ট করতে চাইলে করবে। তার মানে এই না…

ফয়সল সাহেব কথা শেষ করলেন না; পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। আগে দিনে এক প্যাকেট করে খেতেন। সেন্ট্রাক হবার পর পর ডাক্তার সিগারেট নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। ফয়সল সাহেব কারো কোনো কথা কানে নেন না। কিন্তু এই কথাটি মেনে চলেন। সিগারেট খান না। কিন্তু মুখে দিয়ে বসে থাকেন।

মিলি দেখল তার বাবা আগুন না ধরিয়ে সিগারেট টানছেন এবং নাকে ধোয়া ছাড়ার ভঙ্গি করছেন। মিলি কিছু বলতে গিয়েও বলল না। তার খানিকটা ভয় ভয় করতে লাগল। ফয়সল সাহেব বললেন দেখা তো হয়েছে এখন চলে যা। নাকি আরো কিছু বলবি? মিলি ইতস্তত করে বলল মেয়ের একটা নাম দেন না। বাবা। তিন অক্ষরেব। মা দিয়ে শুরু হবে।

তোর মেয়ের কী স্বাস্থ্য ভাল?

জি।

তাহলে নাম রাখ মুটকি। তিন অক্ষর মা দিয়ে শুরু। যা যা চেযেছিলি সবই আছে।

ফয়সল সাহেব দুলে দুলে হাসতে লাগলেন। চোখে পানি এসে গেল মিলির। সে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। এ বাড়িতে এসে তার নিজের ঘর না দেখে সে যেতে পারে না। দোতলায় তার ঘরটি তালা দেয়া। তালাচাবি তার কাছেই আছে। সে যখনি আসে তার ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তার খুব কান্না পায়। আজও সে তার ঘরে ঢুকলা। সব কিছু আগের মত আছে। একটি জিনিসও উলট পালট হয়নি। মিলি ছোট্ট খাটটাতে শুয়ে পড়ল। সে যেদিন তার ঘুমের ওষুধ খাবে–এই খাটে শুয়েই খাবে। মিলি বালিশ জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে নিচে নেমে এল।

বাবা এখনো বারান্দায় বসে আছেন। তাঁর সামনে বসে আছে বীথি নামের ঐ কম বয়েসী। মেয়েটি। বাবার সেক্রেটারি। তাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনায়। ডিকটেশন নেয়। মিলি লক্ষ্য করল মেয়েটি বসে আছে খালি পায়ে। তার মানে কি এই যে সে এখন এ বাড়িতে থাকে? কেন থাকে?

বাবা যাই?

ফয়সল সাহেব জবাব দিলেন না। মাথা নাড়লেন। বীথি বলল তুমি কখন এসেছি। আমি জানি না তো? চা-টা খেয়েছ?

মেয়েটি এভাবে কথা বলছে যেন এ বাড়ির একজন অতিথি আপ্যায়ন করছে। সবচে মজার ব্যাপার হচ্ছে তাকে তুমি তুমি করে বলছে। তাকে সে তুমি করে কেন বলবে? মিলি ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনি ভাল আছেন?

হ্যাঁ আমি ভাল। সারের শরীর ভাল না। দেখা-শোনারও লোকজন নেই। আমি তাই কিছুদিন ধরে এ বাড়িতেই থাকি। তুমি জানো বোধ হয়।

না। আমি জানতাম না। এখন জানলাম। আচ্ছা যাই।

ফয়সল সাহেব মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন বোধ হয়। এই বয়সে লোকজন আচমকা ঘুমিয়ে পড়ে। বীথি বলল, তুমি আসবে ঘন ঘন। খোঁজ-খবর নেবে।

মিলি বলল, আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন কেন?

ফয়সল সাহেব চোখ মেললেন। মিলি ভাবল বাবার কাছ থেকে সে প্রচণ্ড একটা ধমক খাবে। কিন্তু ফয়সল সাহেব কিছু বললেন না। আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। খুব দ্রুত তাঁর পা দুলতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *