এবার রিসেপশনিস্টের গল্প। রোজি বলে এক উদ্ভিন্ন-যৌবনা হোটেল-মানো টাইপ-ললনার পুনরাবির্ভাবের গল্প। কেমন করে সত্যসুন্দরদার অনুগ্রহে আমি হোটেলের সব রকম কাজ শিখলাম, সবাইকে খুশি করলাম, কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কলকাতার কালো জাদু দেখলাম, তার গল্প।
কিন্তু সে-সবের আগে সাদারল্যান্ড সায়েবের কাহিনি। আজ এতদিন পরে কেন জানি না, সাদারল্যান্ড সায়েবের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
সাদারল্যান্ড সায়েবের টানা-টানা পটল-চেরা চোখ দেখে আমার যাঁর কথা মনে হয়েছিল তার নাম কৃষ্ণ। বোসদা বলেছিলেন, তুমি বড়ো সঙ্কীর্ণ মনের। সব কিছুকে দেশি উপমা দিয়ে বুঝতে চাও। সে-উপমা তেমন ভালো না হলেও, তুমি ছাড়বে না। সেই আদ্যিকালের ঈশ্বর গুপ্তকে আঁকড়ে বসে আছ—দেখো দেশবাসিগণে, কত রূপে স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।
আমি বলেছিলাম, আক্রমণ তো ঠিক হল না! আমি বিদেশিকে ধরে দেশের ঠাকুর বানাচ্ছি।
বোসদা বলেছিলেন, যতই পাবলিসিটি করো, আমাদের কিষেণঠাদ কি সাদারল্যান্ডের মতো লম্বা ছিলেন?
আমি বলেছিলাম, দরজির ফিতে দিয়ে আমরা দেবতাদের মহত্ত্ব মাপি না।
তা মাপো না, কিন্তু রাধিকার দেহ-সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কোনো অংশই তো বাদ দাও না। বোসদা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন।
তারপর বলেছিলেন, আমাদের ঠাকুর দেবতারা আমাদের মতোই ছোট-খাট ছিলেন। সাদারল্যান্ড-এর সঙ্গে যদি কারুর তুলনা করতে হয় সে হলো গ্রিক ভাস্কর্যের। এই গ্রিক ভাস্কর্য দেখবার জন্য তোমার গ্রিসে যাবার দরকার নেই। কলকাতার পুরনো জমিদার বাড়িতে এখনও দু-চারটে ধ্বংসাবশেষ যা পড়ে আছে, তাই দেখলেই বুঝতে পারবে। ওইসব মূর্তির একটা হারিয়ে গেলে, তার জায়গায় সাদারল্যান্ডকে বসিয়ে রাখা যেতে পারে।
আজও যখন সাদারল্যান্ডের দেহটা আমার স্মৃতিতে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন বোসদার উপদেশ উলটোভাবে কাজে লাগাই। চিৎপুর রোডে আমার এক পরিচিত পুরনো বাড়িতে গ্রিক ভাস্কর্যের তৈরি একটা উলঙ্গ পুরুষমূর্তি দেখতে যাই। অবহেলায় অযত্নে এবং আঘাতে সেই অপরূপ পুরুষমূর্তি আজ ক্ষতবিক্ষত। একটা হাত ভেঙে গিয়েছে, মুখের কিছু অংশ যেন কোনো দুর্ঘটনায় উড়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে আমার বিশেষ অসুবিধে হয় না। বরং সুবিধেই হয়—লোয়ার সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রে ওঁর মুখে যে যন্ত্রণাময় বেদনা ফুটে উঠেছিল, তা আবার দেখতে পাই।
সেই যে প্রথম ওঁকে দেখেছিলাম, তখন শাজাহান হোটেলে আমার জীবন সবে শুরু হয়েছে। তখন শুনেছিলাম, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসংস্থার কাজে ভারতবর্ষে এসেছেন তিনি। তারপর তাকে অনেকদিন আর দেখিনি। আমিও খোঁজ করিনি। প্রতিদিন কত জনই তো হোটেলে আসছেন, আবার কতজনই তো শাজাহান হোটেলের ঘর খালি করে দিয়ে, ব্যাগ এবং বাক্স সমেত হাওয়াই কোম্পানির জাহাজে চড়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। এই প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়ার মধ্যে কাকে দেখব, আর কাকেই বা মনে রাখব?
শুনেছিলাম, কি একটা জরুরি ভ্যাকসিন সম্বন্ধে উপদেশ দেবার জন্য তিনি এসেছিলেন; এবং কয়েকটি সর্বনাশা রোগের জীবাণু আইস-বাক্সর মধ্যে সাজিয়ে নিয়ে তিনি আবার ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
গতরাত্রে লন্ডনের এরোপ্লেন নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে দমদমে এসে পৌঁছেছিল। সেই প্লেনে ডাক্তার সাদারল্যান্ড যখন আবার কলকাতায় ফিরে এসেছেন তখন ঘরের মধ্যে আমি গভীর ঘুমে অচেতন হয়েছিলাম।
ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে, বাইরে বেরিয়ে যে ডাক্তার সাদারল্যান্ডকে ইজিচেয়ারে বসে থাকতে দেখব, আমি কল্পনাও করিনি। একটা গেঞ্জি এবং ফুলপ্যান্ট পরে তিনি পূর্ব দিগন্তের দিকে স্বপ্নাবিষ্টের মতো তাকিয়ে রয়েছেন। দূরে রাস্তায় ভোরের বাস এবং লরির ঘরঘর শব্দ ভেসে আসছে, তিনি যেন সে শব্দও মন দিয়ে শুনছেন।
ওঁকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে, ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। আমার গায়ে কোনো গেঞ্জিও ছিল না। একটা লুঙি পরেই বেরিয়ে এসেছিলাম।
গুড়বেড়িয়া বেড-টি দিতে ঘরে আসতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওই সায়েব ছাদে এলেন কী করে?
গুড়বেড়িয়া বললে, তা জানি না হুজুর। বোস সায়েব রাত্রে ওঁকে নিয়েই উপরে উঠে এলেন। তিনশো সত্তর খালি ছিল, ওইখানেই ওঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।
উপরের এই সব ঘর গেস্টদের দেওয়া হয়? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
গুড়বেড়িয়া বললে, বোস সায়েবের কী যে মতলব জানি না। গুড়বেড়িয়া যে বোস সায়েবের উপর একটু অসন্তুষ্ট হয়ে আছে, তা জানতাম। অসন্তুষ্ট হবার কারণও ছিল, পরবাসীয়া কফি হাউসের এক ছোকরার সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করছে।
গুড়বেড়িয়া বললে, বোস সায়েব আমার জন্যে কিছুই করছেন না। অথচ অত রাত্রে এই ছাদের উপর সায়েবকে নিয়ে এসে তুললেন। প্রথমে, আমার তো ভয় হয়ে গিয়েছিল। উধারের তিনটে ঘরে ল্যাংটা মেমসায়েবরা তখন ঘুমোচ্ছেন। বোস সায়েব সঙ্গে না থাকলে, উ সায়েবকে আমি সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দিতাম—মার্কাপালা সায়েবের স্ট্রিকট অর্ডার আছে।
গুড়বেড়িয়ার কাছে আমি অনেক নতুন কথা শিখেছি। মার্কোপোলো সায়েবকে ও মার্কাপালা সায়েব বলে। ক্যাবারে পার্টির বিদেশিনীদের কে যে ল্যাংটা মেমসায়েব নামকরণ করেছে, তা জানি না।
গুড়বেড়িয়ার নিজের নামটির উৎপত্তিও গভীর রহস্যে আবৃত। বোসদা বলেন, ওদের কোনো পিতৃপুরুষ নিশ্চয়ই উলুবেড়িয়াতে গিয়ে গুড় খেয়ে এই নামটি সৃষ্টি করেছিলেন। গুড়বেড়িয়ার সামনেই তিনি নিজের এই ঐতিহাসিক সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। গুড়বেড়িয়া তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল। প্রথমত, সে বা তার বাবা তেলেভাজা খেতে ভালোবাসে; তাদের কেউই গুড়ের ভক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, তাদের বংশধর কেউ কখনও উলুবেড়িয়ার ধারে কাছে যায়নি। তাদের যা কিছু কাজকারবার সব এই কলকাতার সঙ্গে। বিশেষ করে কলকাতার পানীয় জল সরবরাহ সমস্যার সঙ্গে তারা বহুদিন জড়িত। জ্যাঠামশায় কর্পোরেশনের জলের পাইপ সারাতেন। বাবাও শাজাহান হোটেলের হোল-টাইম জল-মিস্ত্রি ছিলেন। কিন্তু টেকনিক্যাল হ্যান্ড হয়েও ওয়েটারদের থেকে কম রোজগার করবার জন্য তিনি সারাজীবন আফসোস করে গিয়েছেন। ওরা যা মাইনে পায়, তার ঢের বেশি পায় বকশিশ। দূরদর্শী গুড়বেড়িয়া-পিতা তাই ছেলেকে কলের কাজে না ঢুকিয়ে সোজা হোটেলের চাকরিতে ঢুকিয়েছিলেন।
কিন্তু কপাল। নইলে, হুজুর, আমার ছাদে ডিউটি পড়বে কেন? গুড়বেড়িয়া বলল।
আমি বললাম, ছাদেও তো গেস্ট আসতে আরম্ভ করেছে, তোমার কপাল তো খুলে গেল।
গুড়বেড়িয়ার মুখ আশার আলোকে প্রসন্ন হয়ে উঠল। বোস সায়েব তা হলে ওর মঙ্গলের জন্যই, ওই সায়েবকে তিনশো সত্তর নম্বর ঘরে নিয়ে এসে তুলেছেন।
গুড়বেড়িয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম, বোস সায়েব কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
হ্যাঁ, হুজুর। তবে আজ আর বারোটা পর্যন্ত ঘুমোবেন না। কোথায় বোধহয় যাবেন। আমাকে একটু পরেই চা দিয়ে তুলে দিতে বলেছেন।
আমি বললাম, ঠিক আছে, ভালোই হলো। ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।
গুড়বেড়িয়া এবার তার পাথর-চাপা ভাগ্যের কথা নিবেদন করতে শুরু করল। বোস সায়েব নিশ্চয় তেমন করে বলেননি। না হলে পরবাসীয়ার সাহস কি মেয়েটাকে কফি হাউসের কালিন্দীর হাতে দেবার কথা ভাবে?
আমি চুপচাপ শুয়ে শুয়ে চা খাচ্ছিলাম। কোনোরকম হা, না বলিনি। গুড়বেড়িয়া কিন্তু আমার নীরবতায় নিরুৎসাহ না হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, হুজুর, শাজাহান হোটেলের থেকে ভালো হোটেল আর দুনিয়ায় আছে?
আমি বললাম, দুনিয়াটা যে মস্ত বড়।
গুড়বেড়িয়া আমার উত্তরে অসন্তুষ্ট হয়ে বললে, হুজুর, কোথায় কফি হাউস আর কোথায় শাজাহান হোটেল!
বললাম, তা বটে। কিন্তু শাজাহান কে জানিস?
গুড়বেড়িয়া বললে, পড়া লিখি করিনি বলে কি কিছুই জানি না। উনি মস্ত বড়ো লোকো ছিলেন, দুটো হোটেল বানিয়ে লাখো লাখ টাকা করেছেন। একটা বোম্বেতে আপন পরিবারের নামে—তাজমহল, আর এই কলকাতায় নিজের নামে শাজাহান।
হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে যাবার অবস্থা। বললাম, যা আমাকে বললি বললি, আর কাউকে বলিস না। তাজ হোটেল যিনি তৈরি করেছিলেন, তার নাম জামসেদজি টাটাও তো সেদিনের ব্যাপার; আর আমরা হলাম বনেদি ঘর—আমাদের এই হোটেলের মালিক ছিলেন সিম্পসন সায়েব।
ও ব্যাপারে মোটেই আগ্রহ প্রকাশ না করে, গুড়বেড়িয়া জিজ্ঞেস করলে, তাজ হোটেলে বকশিশ হিজ-হিজ-হুজ-হুজ, না, যা ওঠে তা সবাই সমান ভাগ করে নেয়?
আমি বললম, বাবা, তা তো আমার জানা নেই।
গুড়বেড়িয়া কোথা থেকে খবর পেয়েছে, অনেক বড়ো বড়ো হোটেলে নাকি বকশিশ বিলের সঙ্গে ধরে নেওয়া হয়। তারপর প্রতি সপ্তাহে তা সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তেমন ব্যবস্থা যে একদিন শাজাহান হোটেলেও চালু হবে, সে সম্বন্ধে তার কোনো সন্দেহ নেই। তখন? গুড়বেড়িয়া প্রশ্ন করলে।
কফি হাউসের কালিন্দী আজ না-হয় চার পয়সা, ছপয়সা করে কুড়িয়ে কুড়িয়ে ওর থেকে বেশি রোজগার করছে। কিন্তু শাজাহান হোটেলে সবাই যখন বকশিশের সমান ভাগ পাবে, তখন পরবাসীয়াকে আঙুল কামড়াতে হবে। মেয়েটাকে সে যে আরও ভালো পাত্রের হাতে দিতে পারত, তখন বুঝতে পারবে।
গুড়বেড়িয়ার লেকচারের তোড়ে এই সকালেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আরও কতক্ষণ ওর দুঃখের পাঁচালি শুনতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই পাশের ঘরের অ্যালার্ম ঘড়িটা বাজতে আরম্ভ করল। গুড়বেড়িয়া বললে, এখনই বোস সায়েবকে জাগিয়ে দিতে হবে।
আমার চায়ের কাপটা তুলে নিতে নিতে সে শেষবারের মতো আবেদন করলে—এখনও সময় আছে। আমরা এখনও যদি পরবাসীয়াকে বোঝাতে পারি, কত বড় ভুল সে করতে চলেছে।
বোসদার ঘরে ঢুকতে, কাল রাত্রের ব্যাপারটা জানতে পারলাম।
অদ্ভুত মানুষ এই ডাক্তার সাদারল্যান্ড, বোসদা বললেন।
কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
আমাদের একটা ঘরও খালি ছিল না। এমনকি তিন তলাতে যে অন্ধকূপ দুটো আছে, তাও অয়েল অ্যাসোসিয়েশন ওদের বোম্বাই ডেলিগেটেদের জন্য নিয়ে নিয়েছে। ডাক্তার সাদারল্যান্ড আমাদের এয়ারমেলে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রিগ্রেট করে আমরা টেলিগ্রাম করেছিলাম।
অত রাত্রে এসে কালকে বললেন, তোমাদের তার পাইনি।
ভদ্রলোককে চিনি। আমাদের অবস্থার কথা খুলে বললাম। এমনকি টেলিফোনে অন্য জানালাম। আমার স্পেশাল রিকোয়েস্টে ওরা একটা ঘর দিতে রাজি হল।
কিন্তু ওঁর শাজাহান হোটেল কী যে ভালো লেগেছে। বললেন, কলকাতায় এই আমার শেষ আসা। শাজাহান হোটেলে থাকব বলে কতদিন থেকে স্বপ্ন দেখছি।
বললাম, যে হোটেলে আপনার ব্যবস্থা করলাম, ভারতবর্ষের সেরা হোটেলের মধ্যে সেটি একটি।
কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। বোধহয় এয়ারপোর্ট থেকে ড্রিঙ্ক করে এসেছিলেন। না হলে কেউ কি বলে, দরকার হলে শাজাহান হোটেলের মেঝেতে শুয়ে থাকব। তুমি দয়া করে যা-হয়-কিছু একটা করো।
তখন বললাম, ছাদে একটা ঘর পড়ে আছে। মোটেই ভালো নয়। টিনের ছাদ, বৃষ্টি হলে ঘরে জল পড়তে পারে।
উনি তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে আমার সঙ্গে উপরে চলে এলেন। অথচ অন্য সব কথাবার্তা শুনে মনে হল না যে, উনি মদ খেয়ে টাইট হয়ে আছেন।
ওঁকে তিনশো সত্তরে ঢুকিয়ে দিয়ে, আমিও এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রাত্রি শেষ হতে বেশি দেরি ছিল না। ব্যাটা উইলিয়ম বাড়ি যায়নি। ওই প্লেনে অন্য কার আসবার কথা আছে বলে লাউঞ্জে বসে ঢুলছিল। ওকে কাউন্টারে বসিয়ে আমি চলে এলাম।
বোসদার কথায় মনে হল, হয় মার্কোপোলো সাদারল্যান্ডকে বশীকরণ করেছেন, না হয় ভদ্রলোক গুপ্তচরের কাজ করছেন। শাজাহান হোটেলের কোনো অতিথির উপর নজর রাখবার জন্য এখানে থাকা তার বিশেষ প্রয়োজন।
বোসদার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে ঢোকার পথে সাদারল্যান্ডের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। ওঁর মুখের সরল হাসিটা যেন ছোঁয়াচে। যে দেখবে, সেই হাসিতে উত্তর না দিয়ে পারবে না। ও হাসি যে কোনো স্পাই-এর হাসি, তা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ডাক্তার সাদারল্যান্ড আমাকে কাছে ডাকলেন।
সুপ্রভাত জানালাম। বিনিময়ে সুপ্রভাত জানিয়ে তিনি বললেন, ভারি সুন্দর সকাল। তাই না?
সত্যি সুন্দর সকাল।
সাদারল্যান্ড বললেন, আমি ডাক্তার মানুষ। রোগ আমাকে আকর্ষণ করে, নেচার আমাকে কখনও বিপথে নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু আজ আমারও কবিত্ব করতে ইচ্ছে করছে—মনে হচ্ছে, বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলে সুন্দরী প্রভাত যেন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মাদার ইন্ডিয়া তার শাড়ির আঁচলের তলায় যা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলেন, বিদেশি সন্তানের সামনে তা এবার পরমস্নেহে তুলে ধরলেন।
আমি বললাম, আমাদের মা অকৃপণা। ভারতবর্ষের যেখানে যাবে সেখানেই তুমি তার এই স্নেহময়ী রূপ দেখতে পাবে।
হয়তো তাই। সাদারল্যান্ড বললেন। কিন্তু আমি সমস্ত ভারতবর্ষ ঘুরেছি যেখানে যেখানে এপিডেমিক হয়, সেখানে থেকেওছি। অথচ কোথাও তাঁকে আবিষ্কার করতে পারিনি। এতদিন পরে ছুটি নিয়ে এই কলকাতায় এসে আজ যেন তাকে সম্পূর্ণ আবিষ্কার করলাম।
বাইরের রোদ এবার প্রখর হতে আরম্ভ করেছে। নিজের চেয়ার থেকে উঠে পড়ে, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সাদারল্যান্ড আমাকেও তার ঘরে আসতে অনুরোধ করলেন।
বিছানায় নিজে বসে সাদারল্যান্ড আমাকে চেয়ারটা ছেড়ে দিলেন। বললেন, আপনার কাজের ক্ষতি করছি না তো? হয়তো আপনার ডিউটিতে যাবার সময় হয়ে গিয়েছে।
বললাম, এখন আমার ছুটি। ডিউটি আরম্ভ হবে আরও পরে। রাত্রেও বোধহয় করতে হবে।
তা হলে সারারাত আপনাকে আজ জেগে থাকতে হবে? সাদারল্যান্ড প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ। তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আপনারা ডাক্তারি পড়বার সময় নাইট ডিউটি দিতেন না? আমি উত্তর দিলাম।
হাসতে হাসতে সাদারল্যান্ড বললেন, দুটোর মধ্যে কোনো তুলনা চলে না। আমরা কতকগুলো অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য রাত্রে জেগে থাকতাম। আর হোটেল-বোঝাই একদল সুস্থ সবল লোক নরম বিছানায়, ততোধিক নরম বালিশে মাথা রেখে যখন ঘুমোবেন, তখনও তাদের পরিচর্যার জন্য কাউকে জেগে থাকতে হবে, এ আমি ভাবতে পারি না। অহেতুক ওরিয়েন্টাল লাক্সারি।
মিস্টার সাদারল্যান্ড বেশ রেগে উঠলেন। একটু থেমে বললেন, আমাকে যদি সত্যি কথা বলতে বলা হয়, আমি বলব, It its a shameful system. সত্যি লজ্জাজনক।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড টেবিলের ঘণ্টাটা বাজালেন। তুমি যদি আপত্তি না করো, এক গ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্ক পান করা যাক।
ডাক্তার সাদারল্যান্ডের ব্যবহারে এমন একটা আন্তরিকতার সুর ছিল যে
বলবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
গুড়বেড়িয়া ডিউটি শেষ করে চলে গিয়েছে। তার জায়গায় ঘন্টার ডাকে যে এল, তার নাম জানি না। তাকে নম্বর ধরে ডাকি আমরা। সে এসে সেলাম করে দাঁড়াতেই ডাক্তার বললেন, দু গ্লাস পাইন-আপেল জুস প্লিজ।
আবার সেলাম করে সে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সাদারল্যান্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে, দাঁড়াতে বললেন। এতক্ষণে আমারও নজর পড়ল। তার সারা মুখে বসন্তের দাগ। কিন্তু ডাক্তার সাদারল্যান্ড যেন হাঁ করে কোনো আশ্চর্য জিনিস দেখছেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, কবে হয়েছিল?
বেয়ারা লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। কোনোরকমে বললে, অনেকদিন আগে সায়েব।
ছোটবেলায়?
আজ্ঞে, হাঁ সায়েব।
টিকে নিয়েছিলে? সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।
না সায়েব, টিকে নেবার আগেই হয়েছিল।
আই সি। সাদারল্যান্ড সায়েব বললেন।
বেয়ারা অর্ডার তামিল করতে বেরিয়ে গেল। সাদারল্যান্ড আমাকে বললেন, ভগবান ওকে যে মুহূর্তে দয়া করেছেন। আর একটু হলেই চোখ দুটো যেত।
একটা সাধারণ হোটেল-বেয়ারার জন্য একজন অপরিচিত বিদেশি যে এতখানি অনুভব করতে পারেন, তা নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না।
মনের ভাব আমার পক্ষে চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। বলে ফেললাম, লোকটি আপনার কথা হয়তো চিরদিন মনে রাখবে। কোনোদিন হয়তো এই হোটেলের কোনো অতিথি এমন আন্তরিকভাবে তাকে প্রশ্ন করেননি।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড চমকে উঠে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। মনের ভাব চেপে রাখার জন্যই যেন বললেন, মাই ডিয়ার ইয়ং ম্যান, সব না জেনেশুনে ওই রকম মন্তব্য করে বসাটা উচিত নয়। এই হোটেলের অতীতের কতটুকু আর আমাদের জানা আছে? তাছাড়া আমি একজন ডাক্তার। এপিডেমিয়োলজিস্ট। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আমাকে যে মাইনে দিয়ে পুষছেন, গাড়িভাড়া এবং পথের খরচ দিয়ে দেশ-বিদেশে পাঠাচ্ছেন, তার একমাত্র কারণ, তারা আশা করেন, মানুষের রোগ সম্বন্ধে আমি খবর নেব। সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে পৃথিবীর মানুষদের চিরকালের জন্য মুক্ত করবার চেষ্টা করব, তাই না?
ডাক্তার সাদারল্যান্ড চুপ করলেন। কিন্তু তিনি যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, তা বুঝতে পারলাম।
কোল্ড ড্রিঙ্ক হাজির হওয়ার পর, সাদারল্যান্ড জিজ্ঞাসা করলেন, এই হোটেলে তুমি কতদিন কাজ করছ?
বেশি দিন নয়। আমাকে বলতে হল।
তুমি হোটেলের বার-এ গিয়েছ? সাদারল্যান্ড জিজ্ঞাসা করেছেন।
বার-এ আমার এখনও ডিউটি পড়েনি। তবে এমনি গিয়েছি অনেকবার।
সাদারল্যান্ড এবারে আমাকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন, তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। বললেন, আমার একটা বিষয়ে জানবার আগ্রহ আছে। বলতে পারো, তোমাদের বার কি হোটেলের গোড়াপত্তন থেকে ওই একই জায়গায় আছে, না মাঝে মাঝে স্থান-পরিবর্তন হয়েছে?
বললাম, আমাদের বার-এর জায়গাটা তো খারাপ নয়। কেন, আপনার কি কোনো সাজেশন আছে? তা হলে মিস্টার মার্কোপোলোকে জানাতে পারি।
সাদারল্যান্ড মাথা নাড়লেন। আমার কোনো সাজেশন নেই। আমি শুধু জানতে চাই, বারটা ঠিক ওইভাবে কতদিন আছে?
সে-কথা বলা শক্ত। হোটেল বাড়িটা সিম্পসন সায়েবের হাতছাড়া হয়ে বহুজনের হাতে হাতে ঘুরেছে। প্রত্যেক নতুন মালিকই নিজের খেয়াল অনুযায়ী পরিবর্তন করেছেন। বাইরের খোলসটা ছাড়া, শাজাহান হোটেলের ভিতরের কিছুই আজ অক্ষত নেই।
সাদারল্যান্ড বললেন, আমি খুব পিছিয়ে যেতে চাই না। ধরো, গত শতাব্দীর শেষের দিকে। অর্থাৎ কলকাতায় যখন বারমেডরা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে পানীয় বিক্রি করত।
ঠিক সেই সময় বেয়ারা এসে বললে, বোসদা আমাকে খুঁজছেন।
আমি বোসদাকে এখানে আসতে বললাম। তিনি এখানে আমার থেকে অনেক বেশি দিন রয়েছেন। হয়তো সাদারল্যান্ডের কৌতূহল মেটাতে সমর্থ হবেন। ঘরে ঢুকেই বোসদা বললেন, রাত্রে আপনার ঘুম হয়েছিল তো? যদি সম্ভব হয়, আজ তিনতলার একটা ঘর আপনাকে দেবার চেষ্টা করব। সাদারল্যান্ড কিন্তু বিশেষ আগ্রহ দেখালেন না। তিনি শাজাহান হোটেলের পুরনো দিনে ফিরে যেতে চাইছেন। সব শুনে বোসদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হবস সায়েবের সঙ্গে তোমার আলাপ আছে?
তার সঙ্গে সামান্য পরিচয় আগে থেকেই ছিল। সেদিন এক ডিনার পার্টিতে এসেছিলেন। কাউন্টারে এসে আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন।
বোসদা বললেন, হোটেল সম্বন্ধে সত্যিই যদি কিছু জানতে চাও তা হলে ওঁর কাছে না গিয়ে উপায় নেই।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড বললেন, তুমি কি জানো, কখনও এই হোটলে বারমেড রাখা হতো কিনা?
বোসদা বললেন, ইংরিজি সিনেমাতে অনেক দেখেছি। যুবতী মহিলা বার-এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ড্রিঙ্কস সরবরাহ করছেন। কিন্তু আশ্চর্য, এখানকার কোনো হোটেলে তেমন তো দেখিনি।
আমি বললাম, সত্যি তো, বাইরে থেকে ক্যাবারের জন্য সুবেশা তরুণীরা আসছেন; সঙ্গীত ও নৃত্যনিপুণাদের জন্য প্রচুর অর্থব্যয় করছি আমরা, অথচ বার-এ তো একজনও মহিলা রাখা হয়নি।
বোসদা বললেন, বুদ্ধিটা মন্দ নয়ত। মার্কোপোলোর মাথায় একবার লাগিয়ে দিলে হয়।
বিষণ্ণ ডাক্তার সাদারল্যান্ড এবার একটু হাসলেন। আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, তোমাদের ম্যানেজারের মাথায় বুদ্ধিটা ঢুকলেও কিছু লাভ হবে না। কারণ এদেশে কোনো বার-এ মহিলা নিয়োগ করা বে-আইনি। তোমাদের এক্সাইজ আইনে লেখা আছে, যে-বাড়িতে মদ বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া হবে, সেখানে কোনো মহিলার চাকরি করা সরকারের বিনা অনুমতিতে নিষিদ্ধ।
আমাদের দেশের আবগারি আইনে তার দখল দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, ভরতবর্ষের কোথাও প্রহিবিশন আইনের কৃপায় সায়েব বোধহয় পুলিসের খপ্পরে পড়েছিলেন। তখনই বোধহয় বিভিন্ন রাজ্যের বার-লাইসেন্স-এর নিয়মগুলো মুখস্থ করেছিলেন।
সাদারল্যান্ড জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বার-লাইসেন্সটা কখনও পড়ে দেখেছ?
হলদে রংয়ের সরকারি কাগজটা সযত্নে বার-এ রেখে দিতে দেখেছি। কিন্তু তার পিছনে কী যে লেখা আছে, তা জানবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমাদের কোনো দিন হয়নি।
সাদারল্যান্ড বললেন, দেখবে, ওখানে সরকার নির্দেশ দিচ্ছেন, পাঁচ আনার কমে কোনো ড্রিঙ্কস বিক্রি করা চলবে না!
পাঁচ আনা! এ-আইন কবেকার তৈরি? বোসদা বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন।
সেই যুগে যখন এক বোতল স্কচ হুইস্কির দাম ছিল এক টাকা বারো আনা। তখন সবচেয়ে প্রিয় ব্র্যান্ড ছিল ডানিয়েল ক্রফোর্ড। মদ খেয়ে লিভার নষ্ট করে কেউ মারা গেলে লোকে বলতো, শ্রীযুক্ত অমুক ডানিয়েল ক্রফোর্ড রোগাক্রান্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন।
আমার সন্দেহ এবার ঘনীভূত হল। বললাম, আপনি কি বিভিন্ন দেশের বার নিয়ে কোনো বই লিখেছেন?
মোটেই না, ডাক্তার সাদারল্যান্ড উত্তর দিলেন। যদি একান্তই লিখি— স্মলপক্স সম্বন্ধে লিখব। মদ সম্বন্ধে লিখে অপচয় করবার মতো সময় আমার নেই।
টেলিফোনে হবস সায়েবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ঠিক হল; ভদ্রলোক গল্প করতে এবং শুনতে ভালোবাসেন। বোসদা বললেন, সময় থাকলে আমিও যেতাম। তুমি ডাক্তারকে নিয়ে যেও। বেলা আড়াইটা নাগাদ তিনি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।
সাদারল্যান্ডের ঘর থেকে বেরিয়ে বোসদাকে বললাম, এই যে ওঁকে নিয়ে যাব, তাতে কোনো কথা উঠবে না তো?
বোসদা রেগে উঠলেন। কে কথা তুলবে? হোটেলের জন্য রক্তপাত করে তারপর আমার খুশিমতো যদি কিছু করি, তাতে কারুর নাক গলাবার অধিকার নেই। কেন, কেউ কিছু বলেছে নাকি?
না, বলেনি। কিন্তু হয়তো কোনো আইন অমান্য করবার জন্য হঠাৎ চাকরি গেল।
চাকরি নষ্ট হওয়াটা এখানে কিছু নয়। কত লোক তো আমারই চোখের সামনে এল আর গেল। অক্ষয় বটের মতো আমিই শুধু গাট হয়ে বসে আছি। আমাকে কেউ নড়াতে সাহস করে না। হাটে হাঁড়ি ভাঙবার ক্ষমতা যদি কারও থাকে, তা এই স্যাটা বোসেরই আছে। আর এও বলে রাখলাম, ব্যাটা জিমি যদি তোমার কোনো ক্ষতি করবার চেষ্টা করে, তবে সেও বিপদে পড়বে। বোসদা যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তা বুঝতে পারলাম।
একটু থেমে বোসদা নিজের মনেই বললেন, আমরা কি আর মানুষ! আমাদের মধ্যে যাদের পয়সা আছে তাদের টাকায় ছাতা ধরছে। কয়েক পারসেন্ট সুদ নিয়েই আমাদের বড়লোকরা সন্তুষ্ট হয়ে আছেন। বেলা নটার সময় ঘুম থেকে উঠছেন, তারপর চা পান করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। বিশ্রাম শেষ করে মধ্যাহ্ন ভোজন করছেন। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর আবার বিশ্রাম নিচ্ছেন। তারপর উঠে জলখাবার খেয়ে গড়গড়া টানছেন। তারপর একটু গড়ের মাঠে হাওয়া খাওয়া। ফিরে এসে আবার বিশ্রাম। বিশ্রাম শেষ করে ভোজন পর্ব। তারপর আবার বিশ্রাম। নিজের বংশ ছাড়া ওঁরা কিছুই বাড়ালেন না। তা যদি করতেন, তা হলে স্যাটা বোস দেখিয়ে দিত মেড-ইন-ক্যালকাটা ছোঁড়ারা হোটেল চালাতে পারে কি না। যাদের বুদ্ধি আছে, পরিশ্রমের ক্ষমতা আছে, মাসিক কয়েকখানা নোটের বদলে তারা সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে বসে আছে। অথচ অন্যের কাছ থেকে ধার করা টাকা, আর আমাদের গতর নিয়ে দুনিয়ার লোকরা শুধু নিজেদের নয়, নিজেদের ভাগ্নে, ভাইপো, জামাই সবার ভাগ্য ফিরিয়ে নিলে।—বোসদা এবার দুঃখে হেসে ফেললেন।
এ-সব কথা এখানে বলে যে কোনো লাভ নেই, বুঝি। চৌরঙ্গীর মনুমেন্টের তলায় দাঁড়িয়ে যদি বলতে পারতাম, তা হলেও হয়তো কিছু কাজ হতো, কিন্তু সে সুযোগ আর আমাদের কী করে জুটবে বলো।
বুড়ো হবস সায়েবের ওখানে যাচ্ছ তাহলে? লাঞ্চের সময় বোসদা জিজ্ঞেস করেছিলেন।
সরকারিভাবে লাঞ্চ আরম্ভ হয় সাড়ে বারোটা থেকে। কিন্তু কর্মচারীদের খাওয়া তার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া সেরে, তবে তারা লাঞ্চরুমের দরজা খুলে দেয়। বাইরের ব্যস্ত অতিথিরা তখন আসতে শুরু করেন। ক্লাইভ স্ট্রিটের সায়েবদের অপচয় করবার মতো সময় দুপুরবেলায় থাকে না।
হোটেলের বাসিন্দারা অনেকে একটু দেরিতে আসেন। লাঞ্চরুমে ঢোকবার আগে, অনেকে বার-এর কাউন্টারেও খানিকটা সময় কাটিয়ে যান। কেউ আবার সোজা লাঞ্চরুমে গিয়ে লাল পট্টি জড়ানো তোবারককে ডেকে পাঠান। শাজাহান হোটেল ডিক্সনারিতে তার নাম ওয়েট বয়। বোসদা কিন্তু বলেন, ভিজে খোকা! ভিজে খোকা সায়েবের সেলাম পেলেই ছুটে আসে। সায়েব সাধারণ ঠান্ডা বিয়ার অর্ডার দেন। বিয়ারের মগে চুমুক দিতে দিতে গরম সুপ এসে যায়। দূরে গোমেজ সায়েবের ইঙ্গিতে শাজাহান ব্যান্ড বেজে ওঠে। পাঁচটা ছোকরা এক সঙ্গে তাদের সামনের কোরের উপর ঝুঁকে পড়ে যন্ত্রসঙ্গীত আরম্ভ করে দেয়।
গোমেজ কন্ডাক্টর। বোসদা বলেন, ব্যান্ডপতি-কখনও আবার আদর করে ব্যান্ডোস্বামী বলেন। গোমেজ তার পাঁচটি ছেলেকে নিয়ে সবার আগে প্রাইভেট রুমে লাঞ্চের জন্য হাজির হন।
শেফকে বলেন, তাড়াতাড়ি যা হয় ব্যবস্থা করুন। শেফ আমাদের খাওয়ানোটাকে ভূতভোজন বলে মনে করেন। গোমেজ ব্যস্ত হয়ে পড়লে বলেন, অত ব্যস্ত হলে আমি পারব না।
গোমেজ বলেন, শাজাহান ব্যান্ড আজ লাঞ্চ আওয়ারে তাহলে বন্ধ থাকবে।
শেফ কপট উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আহা তাহলে সর্বনাশ হবে। কেবল বাজনা শোনবার জন্যেই তো কলকাতার নাগরিকরা বেলা একটার সময় নিজেদের কাজ ছেড়ে শাজাহান হোটেলে চলে আসেন!
গোমেজও ছাড়বার পাত্র নন। শেফ মিস্টার জুনোকে বলেন, গানই যদি বুঝবে, তা হলে হাঁড়ি ঠেলবে কেন?
শেফ তখন সবচেয়ে খারাপ কাচের বাসনপত্তরগুলো ওয়েটারদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলেন, গানের কিছু বুঝি না, কিন্তু এইটুকু জানি, পাখিরাও খাবার পর গাইতে পারে না। ভরাপেটে সঙ্গীতচর্চা একমাত্র শাজাহানেই সম্ভব।
গোমেজ তখন দলের ছেলেদের বলেন, বয়েজ, তোমরা আরম্ভ করে দাও। অনুগত ছেলেরা সঙ্গে সঙ্গে মুখে সুপ তুলতে আরম্ভ করে। গোমেজ তখন ন্যাপকিনটা কোমরে লাগাতে লাগাতে বলেন, পাখিদের সঙ্গে ওখানেই আমাদের তফাত। ওরা পেটের জন্যে গান করে না, আমরা শুধু পেটের জন্যেই এই ভরদুপুরে সঙ্গীতচর্চা করি।
কথা-কাটাকাটি হয়তো আরও এগুতো, কিন্তু বোসদা এসে টেবিলের একটা চেয়ার দখল করে বলেন, জুনো সায়েব, আমি গোঁড়া হিন্দু। আমার রিলিজিয়াস ফিলিঙে তোমরা হাত দিচ্ছ। খাওয়ার সময় আমাদের কথা বলা শাস্ত্রমতে নিষেধ। এখনই হয়তো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যাবে!
সকলেই হাসতে হাসতে কথা বন্ধ করে দেন। জুনো গদগদ হয়ে বলেন, স্যাটা, মজার কথার স্টক তোমার কি কখনও শেষ হবে না?
ডিয়ার জুনো সায়েব, আমার স্টক তোমার ওই ফ্রিজের মতো। তলার দিকে গোটা দশেক আইসক্রিম সব সময় লুকানো আছে—বোসদা বলেন।
জুনো সায়েব হা হা করে হেসে ফেলেন। বলেন, গ্রীদি। গ্রীদি বয়েজ আর নত নাইস ফর হোতেল।
বোসদার পিঠে স্নেহভরে থাবড়া মেরে জুনোনা কিচেনের দিকে চলে যান। যাবার আগে বলেন, বোস্, একটা মেরেজ কোরো। হামরা পারবে না। দ্যা ভাই তোমাকে বয়েল করে ম্যানেজ করতে পারবে।
বোসদা হাসতে হাসতে বললেন, সায়েব, তোমার সেই পুডিং-এ স্যান্ড।
হোয়াত্? জুনো না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন।
তোমার সেই গুড়ে বালি। আমার বিয়েও হবে না, তোমার পাপের ভোগও শেষ হবে না। মুখের মধ্যে খাবার পুরতে পুরতে বোসদা বললেন।
আমি অবাক হয়ে ওঁদের কথাবার্তা শুনছিলাম। ওয়েটাররা খাবার আনতে একটু দেরি করছিল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গোমেজ যেন আঁতকে উঠলেন, লাঞ্চরুমের দরজা খুলতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গোমেজ বললেন, গেট আপ বয়েজ। আর সময় নেই।
পাঁচটা ছেলে যেন বোবা। মুখে তাদের কথা নেই। এক সঙ্গে সেই অবস্থায় উঠে পড়ল।
ঘরের কোণে একটা ছোট্ট আয়না রয়েছে। তার উপর ইংরিজিতে লেখা—Am I correctly dressed? তার নীচে খড়ি দিয়ে দুষ্টুমি করে কে বাংলায় লিখে দিয়েছে—আমি কি ঠিকভাবে জামা কাপড় পরিয়াছি?
ওরা সবাই একে একে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের টাইগুলো ঠিক করে নিতে লাগল। গোমেজ দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলেন। লাইন বেঁধে মার্চ করে ওরা বেরিয়ে যেতে, দুটো হাত দোলাতে দোলাতে তিনিও ওদের শেষে লাইনে যোগ দিলেন।
বোসদা আর আমি তখনও বসে রইলাম। তিনি হেসে জুনোকে বললেন, মাই হেভেন-গন্ মাদার মরবার সময় বলেছিলেন, ফাদার সতু, থ্রি ওয়ার্লড রসাতলে গেলেও মুখের রাইস ফেলে উঠবে না।
জুনো ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারলেন না।হোয়াত্? ফাদার সতু, তোমার ফাদার সেই সময় হাজির ছিলেন?
না, সায়েব, না। তোমাকে এতদিন ধরে বেঙ্গলি শেখাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু সব বৃথা। ফাদার সতু মানে হল বাবা সতু, অর্থাৎ কি না আদর করছে। বোসদা বললেন।
জুনো এবার সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ইংরিজিতে বললেন, সত্যি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ছেলে কেমন করে বাবা হয়?
কেন হবে না? সত্যদা প্রশ্ন করলেন। তোমাদের মায়ের কাছে ছেলে যদি ডার্লিং হতে পারে তবে আর এক পা এগিয়ে বাবা হতে কী আপত্তি আছে?
জুনো এবার ঘোঁত ঘোত করে হেসে ফেললেন। তোমার সঙ্গে তর্কে কেউ পারবে না। ওনলি কোনোদিন তোমার ভাই, আই মিন ইওর জেনানা, যদি পারে।
পারবে পারবে, আর একজন পারবে। দিস বয়। বোসদা আমাকে দেখিয়ে জুনোকে বললেন। খুব ভালো ছেলে। এত ভালো ছেলে যে, ওকে তোমার একটা স্পেশাল আইসক্রিম দেওয়া উচিত; যাতে ভবিষ্যতে ও তোমার বিরুদ্ধে কখনও মুখ খুলতে না পারে।
জুনো এতই খুশি হলেন যে, ওয়েটারকে হুকুম না দিয়ে নিজেই ফ্রিজিডিয়ার থেকে দুটো আইসক্রিম বার করে এনে দিলেন।
আইসক্রিমের পর কফি এল। বোসদা কফির কাপে চুমুক দিয়ে নিজের মনেই বললেন, বারমেড! তৃষ্ণার্ত অতিথির সুরাপাত্র সুন্দরী মধুর হাসিতে ভরিয়ে দিচ্ছেন। চমৎকার। একদিন এখানেও ছিল। আজ থাকলে ক্লাইভ স্ট্রিটের সায়েবরা, শুধু সায়েবরা কেন, বাঙালি, মাড়ওয়ারি, গুজরাটি, চিনে, জাপানি, রাশিয়ান, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, কে না খুশি হত? শাজাহান হোটেলের বার-এর আরও শ্রীবৃদ্ধি হত। আরও অনেক টুল দিতে হত। আরও অনেক বোতল সোডা রোজ নিতে হত, আরও অনেক বেশি রসিদ কাটতে হত, আরও অনেক বেশি টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে পাঠাতে হত। গভরমেন্ট ট্যাক্স বাড়িয়েছে; গোদের উপর বিষফোড়ার মতো আমরা আরও মদের দাম বাড়াতে পারতাম। কী সুন্দর হত!
বারমেড! বড় ইংরেজি কথা। বোসদা নিজের মনেই আবার বললেন। তারপর আমাকে বললেন, একটা আইসক্রিম খাইয়েছি, ব্রেন নিশ্চয়ই ঠান্ডা হয়ে আছে। কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ একটা বলো দিকিনি।
আমার মাথায় কিছু আসছিল না। বললাম, রুবাইয়াতে পড়েছি সাকী।
দুর, ও তো আর বাংলা হল না—বোসদা বললেন। ওরা যা ছিল, তার একটি মাত্র বাংলা হয়। অর্থাৎ কি না বারবনিতা।
বারবনিতার নেশায় আমরা যখন কুঁদ হয়ে আছি, ঠিক সেই সময় জুনো বললেন, একজন জোয়ান মদ্দ তোমাদের দুজনকেই একসঙ্গে খুঁজছেন। বিরক্ত হয়ে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বোসদা বললেন, দেখো তো আমাদের তপোবনের এই নিষাদটি কে।
তপোবনের এ নিষাদটি স্বয়ং সাদারল্যান্ড ছাড়া আর কেউ নন। আমাকে দেখেই বললেন, আমি বাইরে লাঞ্চ করতে যাচ্ছি। যাবার আগে তোমাকে মনে করিয়ে দিয়ে গেলাম।
আমি বললাম, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। মনে করিয়ে দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। মিস্টার হবসের সঙ্গে দেখা আমাদের হবেই।
আমার এ কাহিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে দেখলে, যিনি সবচেয়ে খুশি হতেন, আজ তিনি ইহলোকে নেই। চৌরঙ্গীর অন্তরের কথা পাঠকের কাছে নিবেদন করবার পরিকল্পনা তিনিই আমাকে দিয়েছিলেন। উৎসাহ দিয়েছিলেন, উদ্দীপনা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খোঁজ করো, অনেক কিছু পাবে। কিন্তু তাঁর জীবিতকালের মধ্যে সে কাজ আমার পক্ষে করে ওঠা সম্ভব হয়নি। কলকাতার বুকের উপর তার সুদীর্ঘ দিনের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণও আজ নেই। তাঁর নামাঙ্কিত একটা দোকান চৌরঙ্গীর ইতিহাসের একটা প্রয়োজনীয় অংশ হয়ে কিছুদিন টিকে ছিল। সে দোকানটাও সকলের অলক্ষ্যে কলকাতার বুক থেকে কখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
পুরনো অনেকেই হয়তো আজও হবসকে মনে রেখেছেন, আমাদের যুগের কয়েকজনও তাকে হয়তো মনে রাখব, তারপর একদিন তার স্মৃতি চিরদিনের মতো ব্যস্ত কলকাতার ব্যস্ততর নাগরিকদের মন থেকে মুছে যাবে।
শাজাহান হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা এসপ্ল্যানেডে এসে পড়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে সাদারল্যান্ড বলেছিলেন, তোমাদের এই পথ দিয়ে হাঁটতে আমার কেমন অস্বস্তি লাগছে। প্রতি পদক্ষেপে যেন ইতিহাসের কোনো আশ্চর্য অধ্যায়কে মাড়িয়ে চলেছি। সেসব দিনের ইতিহাসের কোনো সাক্ষীই আজ নেই। পুরনো কলকাতার অনেক নিদর্শন ছিল এই রাস্তার উপর! সেসব তো কবে তোমরা ভেঙে উড়িয়ে দিয়েছ।
হাঁটতে হাঁটতে সাদারল্যান্ডের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, এখনও একটা সাক্ষী রয়েছে। ঘনগাছের বোরখার মধ্য দিয়ে সুন্দরী রাজভবন, অনেকদিন থেকে অনেক কিছুই দেখছে।
সাদারল্যান্ড বললেন, এমন একদিন আসবে, যখন টেপ রেকর্ডারের মতো Past recorder কিনতে পাওয়া যাবে। সেই যন্ত্র দিয়ে যে-কোনো পুরনো বাড়ির সামনে বসে আমরা তার আত্মজীবনী শুনতে পাব।
সত্যি, তা যদি সম্ভব হয় কোনদিন।
একেবারে নিরাশ হয়ো না-সাদারল্যান্ড বললেন। ওই যন্ত্র দেখে যাবার মতো দীর্ঘদিন আমরা নিশ্চয়ই বেঁচে থাকব। অতীতকে উদ্ধার করাটা খুব শক্ত কাজ হবে না। কারণ, আমরা যা করছি, যা বলছি, এমন কি যা ভাবছি তার কিছুই তো নষ্ট হচ্ছে না। শুধু এক জায়গা থেকে বেরিয়ে মহাশূন্যের অন্য এক কোণে জমা হচ্ছে।
আমি বললাম, সেই জন্যেই বুঝি আমাদের কবি বলে গিয়েছেন, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।
সাদারল্যান্ড হাসতে হাসতে বললেন, মূক অতীতকে যেদিন আমরা কথা বলাতে পারব, সেদিন সমস্ত পৃথিবী নতুন রূপ গ্রহণ করবে। বিপদে পড়বেন শুধু ঐতিহাসিকরা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হয়তো চাকরিও যাবে। অধ্যাপকগবেষকদের বদলে একজন অপারেটর রেখে দিলেই কাজ চলে যাবে!
সাদারল্যান্ড ছোট ছেলের মতো নিজের মনেই হেসে ফেললেন।
তাঁর কথাবার্তা শুনে কে বলবে, ওঁর বিষয় ডাক্তারি! ইতিহাসের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই?
ফুটপাথের উপর একটা খাঁচা এবং গোটাকয়েক টিয়াপাখি নিয়ে একটা ছোকরা বসে ছিল। সাদারল্যান্ড একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি?
আমি হেসে বললাম, ফিউচার রেকর্ডার। ভবিষ্যতের যত কিছু দলিল সব এর কাছে আছে। সব কিছুই এখানে জানতে পারা যাবে।
সাদারল্যান্ড বাঁ হাতের সঙ্গে ডান হাতটা ঘষতে ঘষতে বললেন, ভবিষ্যৎকে আমি বড্ড ভয় করি। একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আমরা এগিয়ে যাই।
মিস্টার হবস আমাদের জন্যই বোধহয় অপেক্ষা করছিলেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার দুটি হাত বাড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন।
বারমেড? বৃদ্ধ হবস আমাদের প্রশ্নে যেন কোন সুদূর অতীতে ফিরে গেলেন। সেসব দিন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, নেভার টু রিটার্ন।
একজন শুধু যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন। তার নাম মিসেস ব্রকওয়ে। ইউনিয়ন চ্যাপেলের পাদ্রি ফাদার ব্রকওয়ের সহধর্মিণী, তিনি নিজের মনেই বললেন।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড মাথা নাড়লেন। আমি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার ভারতবন্ধু ফ্রেনার ব্রকওয়ের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছিলাম। ওঁর মায়ের কথা জানবার খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু কোনো খবর পাওয়া সম্ভব হল না। শুধু শুনলাম, ইউনিয়ন চ্যাপেলের পাদ্রির সন্তান ফ্ৰেনার ব্রকওয়ে কলকাতাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রতি তার গভীর মমতার কারণ তখন আমার বোধগম্য হল।
হবস বললেন, মিসেস ব্রকওয়ে কলকাতার বারমেডদের জন্যে চিন্তা করতেন। ওদের জন্য চোখের জল পর্যন্ত ফেলেছেন শুনেছি। তার নজরে
পড়লে, আজও আমরা এতক্ষণ শাজাহান, কিংবা যে কোনো হোটেলের বার-এ বসে নারীপরিবেশিত বীয়ারের মগ বা হুইস্কির পেগ উপভোগ করতে পারতাম।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড গভীরভাবে অথচ লজ্জিত কণ্ঠে বললেন, আমি অবশ্য ড্রিঙ্ক করি না।
তুমি ড্রিঙ্ক করো না! হবস অবাক হয়ে গেলেন।খুব সাবধান, মিস্টার গ্যান্ডির শিষ্যরা জানতে পারলে তোমাকে আর দেশে ফিরতে দেবে না। সবরমতী বা অন্য কোনো নদীর ধারে একটা ছোট্ট চালাঘরে তোমাকে। ডিসপেন্সারি করে দেবে, এবং সেইখানেই তোমাকে চিরদিনের জন্যে থেকে যেতে হবে।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড মৃদু হাসলেন। চমক্কার হয় তাহলে। ডাক্তারি কতটুকুই বা জানি আমি। কিন্তু যতটুকু জানি তাতে এইটুকু বুঝেছি, ইন্ডিয়ার এখন অনেক ডাক্তার চাই। অসংখ্য কাজ জানা লোকের দরকার।
হবস আবার বারমেডদের কথায় ফিরে এলেন। দোজ গুড় ওল্ড ডেজ।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার জেনারেল-নলেজ একটু পরীক্ষা করা যাক। বল দেখি, সুয়েজ খাল দিয়ে কোন সালে জাহাজ চলতে আরম্ভ করল?
ফার্ডিনান্ড ডি লেসেপস নামে এক ফরাসি ভদ্রলোক সুয়েজখাল কেটেছিলেন, এইটুকু শুধু ইস্কুলে ভূগোল বইতে পড়েছিলাম। কিন্তু কবে তিনি কী করেছিলেন, কোন সালে লোহিতসাগর ও ভূমধ্যসাগরের জল মিলে মিশে ইউরোপ ও এশিয়াকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিল, তা আমার জানা ছিল না। সুয়েজখালের সঙ্গে আমাদের গল্পের কী যে সম্পর্ক আছে বুঝতে পারছিলাম না।
মিস্টার হবস বললেন, আমাদের গল্পের সঙ্গে সুয়েজখালের নিবিড় সংযোগ আছে। সুয়েজখাল যখন ছিল না, তখন উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে বেপরোয়া অ্যাডভেঞ্চার-লোভী ছোকরারা কলকাতায় আসত, হোটলের অভাবে চাদপালঘাটের কাছে বজরায় রাত্রি যাপন করত। কিন্তু তাদের চিত্ত বিনোদনের জন্য কোনো নীলনয়না সমুদ্রের ওপার থেকে ছুটে আসত না। নিতান্ত প্রয়োজন হলে এ দেশের দিশি জিনিস দিয়েই তৃষ্ণা নিবারণ করতে হত।
তারপর ১৭৬২ সালে উইলিয়াম পার্কার কলকাতার ভদ্দরলোকদের চিত্তবিনোদনের জন্য পানশালা খুলতে চাইলেন। তখন কেবল মদের কথাই উঠেছিল, কিন্তু বার-বনিতার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়নি। বোর্ডও লাইসেন্স দিয়েছিলেন এই শর্তে যে, বাগানবাড়িটা সকালবেলায় খুলে রাখা চলবে না, সকালে খোলা থাকলে, ছোকরা সায়েবসুবোরা কাজে ফাঁকি দেবে।
তারপর একে একে কত মদের দোকানই তো ভোলা হল। কিন্তু সব জায়গাতেই বারম্যান, দেশি ভাষায় খিদমতগার।
সুপ্রিম কোর্টে নন্দকুমারের বিচারের সময় ব্যারিস্টার এবং তাদের শাগরেদদের খাওয়ানো-দাওয়ানোর কন্ট্রাক্ট নিয়েছিলেন যিনি, সেই লে গ্যালের ট্র্যাভানেও বারমেড ছিল না। সেই সস্তাগণ্ডার দিনেও লে গ্যালে প্রতিটি লাঞ্চ এবং প্রতিটি ডিনারের জন্যে দুটাকা চার আনা দাম নিতেন। সুপ্রিম কোর্টে খাবার পাঠাবার অর্ডার দিয়েছিলেন মোহনপ্রসাদ। প্রতিদিন যোলোটি লোকের লাঞ্চ অর যোলোটি লোকের ডিনার।
নন্দকুমারের ফাঁসির খবর আমরা রাখি, কিন্তু লে গ্যালের খবর আমরা রাখি না। ইম্পের রায় বেরুলো, নন্দকুমার সিম্পসন কোম্পানির ফাঁসিতে চড়ে ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন, কিন্তু মোহনপ্রসাদ-এর দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত লাঞ্চ ও ডিনারের টাকা আদায়ের জন্য লে গ্যালে কোর্টে গিয়েছিলেন। মামলা করে ছশো উনত্রিশ টাকা আদায় করতে হয়েছিল তাঁকে।—মিস্টার হবস আমাদের এবার কফি-পাত্র এগিয়ে দিলেন।
আমরা আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, তিনি শুনলেন না। হেসে বললেন, আমি ভারতবিদ্বেষী নই। কিন্তু যাঁদের ধারণা ইন্ডিয়া কফিহাউস ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও কফি তৈরি হয় না, তারা এখানে এসে একবার দেখতে পারেন!
আমাদের বিমুগ্ধ মুখের দিকে না তাকিয়েই, মিস্টার হবস বললেন, বক্ষে সুধা এবং হস্তে সুরাপাত্র নিয়ে ইংলন্ডের অষ্টাদশীরা সুয়েজখাল কাটার পর থেকেই কলকাতায় আসতে লাগলেন। ১৮৬৯ সালে সুয়েজখাল কাটার পর থেকেই চার্নক নগরের রেস্তোরাঁ এবং হোটেলগুলো যেন জমজমাট হয়ে উঠলো।
আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হবস ধীরে ধীরে সেই অতীতে ফিরে গেলেন, যেখানে বার-বনিতারা বার-এ দাঁড়িয়ে মদ পরিবেশন করত। এখানকার মেয়ে নয়। খাস বিলেতের মেয়ে। কাগজে বিজ্ঞাপন বেরুতোলন্ডন থেকে অমুক জাহাজ যোগে আমাদের নতুন বারমেড এসে পৌঁছেছেন।
কেউ আসতেন ছমাসের কন্ট্রাক্টে-কেউ বা দুবছরের। শাজাহান, হোটেল ডি ইউরোপ এবং এলেনবির বিলিতি প্রতিনিধিরা লিখে পাঠাতেন—একটি সুন্দরী মেয়ে সন্ধান করেছি, প্রয়োজন কিনা জানাও। দ্রুত উত্তর যেত— তোমার রুচির উপর আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে। আশা করি তোমাকে বিশ্বাস করে কলকাতার খদ্দেরদের কাছে আমরা ছোট হয়ে যাব না! . ওদিক থেকে উত্তর আসত-শুধু তোমাদের কলকাতা নয়, দুনিয়ার বাঘা বাঘা পোর্টে এতদিন ধরে বারমেড পাঠাচ্ছি, কখনও সমালোচনা শুনিনি। আমার হাতের নির্বাচিত মেয়েরা কত হোটেলের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে—মদের বিক্রি ডবল করে দিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমার একমাত্র দুশ্চিন্তা কলকাতার হোটেলগুলো মেয়েদের রাখতে পারে না। কন্ট্রাক্ট শেষ হতে না হতে চাকরি ছেড়ে অন্য কোথাও জেঁকে বসে। তাতে আমার ক্ষতি হয়। ওদের মাইনের কিছু অংশ আমাকে পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, কিন্তু চাকরি : পাল্টালে সেটা আর পাই না।
আপনি দেখেছেন কোনো বারমেডকে? প্রশ্ন করবার লোভ সংবরণ করতে পারিনি।
হবস হেসে ফেলেছেন। আমি কি আর আজকের লোক? আর এই কলকাতাতে কি আমি আজকে এসেছি? আর কিছুদিন আগে এলে হয়তো দুএকটা ক্রীতদাসও দেখতে পেতাম।
ক্রীতদাস! আমি চমকে উঠেছি।
আজকালকার ছেলেরা তোমরা কোনো খবরই রাখো না। গত শতাব্দীর প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত কলকাতার মানুষ কেনা-বেচা হত। মুরগিহাটা থেকে ছেলে-মেয়ে কিনে এনে সায়েব মেম, বাবু বিবিরা বাড়িতে রাখতেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতেন; পুরস্কার ঘোষণা করতেন।
সাদারল্যান্ড গম্ভীরভাবে বললেন, আই ওনলি হোপ, হোটেলে যাঁরা মদ, ঢেলে দিতেন তারাও ক্রীতদাসী ছিলেন না।
বৃদ্ধের মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, না, আইনের চোখে, তারা ক্রীতদাসী নিশ্চয়ই ছিলেন না; কিন্তু তাদের দুঃখের যে দৃশ্য আমি দেখেছি, যা শুনেছি, তাতে ডিকরিতে একটা নতুন শব্দ তৈরি করে ঢুকিয়ে দিতে পারো।
এই শাজাহান হোটেলেরই একটি পুরনো বিজ্ঞাপন তোমাকে দেখাতে পারি। মিস্টার হবস চেয়ার থেকে উঠে পড়ে আলমারি থেকে একটা খাতা বার করে নিয়ে এলেন। সেই খাতার পাতায় পাতায় পুরনো দিনের ইংরেজি কাগজের কাটিং আঁটা রয়েছে। উল্টোতে উল্টোতে এক জায়গায় থেমে গেলেন। হয়তো তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ রয়েছে।
বিজ্ঞাপন পড়ে দেখলাম। শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার সগর্বে ঘোষণা করছেন-আগামী ২২শে সেপ্টেম্বর এস এস হাওয়াই জাহাজ যোগে কুমারী মেরিয়ন বুথ ও কুমারী জেন গ্রে খিদিরপুরে এসে হাজির হচ্ছেন। শাজাহান হোটেলের অতিথিদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তারা কোনোরকম ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হবেন না! বিজ্ঞাপনের তলায় মোটা মোটা হরফে পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে শাজাহানের কষ্টার্জিত সুনাম অক্ষুন্ন রাখবার জন্যই এই সুন্দরী দুটিকেও দিনের বেলায় এবং রাত্রের ডিউটি-শেষে তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হবে!
মিস্টার হবসের কাজে বাধা সৃষ্টি করছি আমরা। হারিয়ে যাওয়া দিনের গল্প শোনাবার উপযুক্ত সময় নয় এখন। মনে মনে লজ্জাবোধ করছিলাম। কিন্তু সাদারল্যান্ডের সেদিকে খেয়াল নেই। হবসও ও বিষয়ে মোটেই চিন্তা করছেন না। খাতাটা মুড়তে মুড়তে তিনি বললেন, ভাগ্যে এই কাটিংটা রেখেছিলাম। এই সামান্য সূচনা থেকে যে একদিন এমন একটা ব্যাপার হবে তা কল্পনাও করিনি।
শাজাহানের ম্যানেজার সিলভারটনের সঙ্গে আমার খুব আলাপ ছিল। সিলভারটন শেষ পর্যন্ত হোটেলটা কিনেও নিয়েছিলেন। আর্মেনিয়াম খ্রিস্টান গ্রেগরি আপকার একবার শাজাহান হোটেলে এসে উঠেছিলেন। হোটেলের তখন দুর্দিন চলেছে। মালিক কোনো কাজে নজর দেন না, বাড়িটা ভেঙে পড়েছে, জিনিসপত্তরের অভাব। গ্রেগরি আপকার চাকর-বাকরদের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন। ম্যানেজারকে শাজাহানের চিঠির কাগজেই লিখে পাঠিয়েছিলেন দুনিয়াতে এর থেকেও ওঁচা কোনো হোটেলের নাম যদি কেউ বলতে পারে, তবে তাকে পাঁচশ টাকা পুরস্কার দেব।
সিলভারটন সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন। আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু টাকাকড়ির অভাব। টাকা থাকলে ভালো হোটেল কাকে বলে দেখিয়ে দিতাম।
ইতিহাসে সেই প্রথম বোধহয় কোনো হোটেলের গেস্ট হোটেলের উপর রেগে গিয়ে হোটেলটাই কিনে ফেলেছিলেন। গ্রেগরি আপকারের পয়সার অভাব ছিল না। চেক কেটে পুরো দাম দিয়ে মালিকানা কিনেছিলেন— সিলভারটনকে করেছিলেন ওয়ার্কিং পার্টনার।
সিলভারটনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিজ্ঞাপনের ফল কী হল?
সঙ্গে সঙ্গে ফল। অনেকেই ২২ সেপ্টেম্বরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। খোঁজ করছে, ওইদিন সন্ধেতেই ওঁরা বার-এ কাজ করতে আরম্ভ করবেন তো? রসিকজনরা একটুও দেরি সহ্য করতে পারছেন না।
বাইশে সেপ্টেম্বর রাত্রে সিলভারটন আমাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। হোটেলের লোকরা সহজে কাউকে নেমন্তন্ন করে না। কিন্তু সিলভারটনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অন্যরকম ছিল-মাঝে মাঝে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন। সে-রাত্রে শাজাহান হোটেলের বার এবং ডাইনিং রুমে তিলধারণের জায়গা ছিল না। ইয়ংমেন উইথ বেস্ট অফ ম্যানারস্ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড অফ ইনটেনসন সেখানে হাজির হয়েছিল। কিন্তু নতুন বালিকারা রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন না।
কী ব্যাপার, জাহাজ কি এসে পৌছয়নি? অনেক ছোকরা প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল।
জাহাজ এসেছে। তারাও এসেছেন। কিন্তু আজ তারা অত্যন্ত ক্লান্ত সিলভারটন হাতজোড় করে ঘোষণা করলেন।
আমরাও কিছু তাজা গোলাপফুলের অবস্থায় নেই। সারাদিন কাজ করে, পচা বৃষ্টিকে কলা দেখিয়ে ভিজতে ভিজতে এখানে হাজির হয়েছি। ছো্করাদের একজন ফোড়ন দিয়েছিল।
সিলভারটন বিনয়ে গলে গিয়ে বলেছিলেন, শাজাহান হোটেলের পরম সৌভাগ্য, এত অসুবিধার মধ্যেও তাকে আপনারা ভোলেননি। আপনাদের দেহের এবং মনের অবস্থার কথা ভেবেই মিস ডিকশন সেলার থেকে কয়েকটি সেরা বোতল বার করে এনেছেন।
ছোকরারা খিলখিল করে হেসে ফেললে। উই ডিমান্ড ওল্ড ওয়াইন ফ্রম নিউ হ্যান্ড। নতুন কচি কচি হাত থেকে পুরনো মদ চাই আমরা।
একটু দূরে মুখ শুকনো করে প্রৌঢ়া মিস ডিকশন দাঁড়িয়ে আছেন। পিছনে অনেকগুলো মদের বোতল সাজানো রয়েছে। পাশে পিতলের ছোট্ট বালতি হাতে পাথরের মতো একজন জোয়ান খিদমতগার দাঁড়িয়ে রয়েছে। গেলাসে বরফের গুঁড়ো দেওয়াই তার কাজ মনে হতে পারে। কিন্তু ওটা ছুতো, আসলে সে বডিগার্ড।
কেউ আজ মিস ডিকশনের কাছে ড্রিংকস কিনছে না—আজ যেন ওই দড়ির মতো পাকানো শীর্ণ দেহটাকে এখানে কেউ প্রত্যাশা করেনি। ছোকরারা বললে, আমরা কি একটু অপেক্ষা করব? নতুন মহিলারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আসতে পারেন।
সিলভারটন আপত্তি জানালেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, ওঁরা এতই ক্লান্ত যে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সিলভারটনের পা-দুটো উত্তেজনায় কাঁপছিল। ছোকরারা চিৎকার করে বললে, প্রয়োজন হয় আমরা গিয়ে ওঁদের অনুরোধ করতে পারি; আর তাতে যদি অসুবিধা থাকে তবে আমরা চললাম। অ্যাডেলফি বার-এর লোলা আমাদের জন্যে বসে আছে। আমাদের দেখলেই লোলা ফিক করে হেসে উঠবে, আর মনে হবে যেন মেঝেতে মুক্তো ঝরে পড়ছে।
ওরা দল বেঁধে শাজাহান থেকে বেরিয়ে পড়ল। সিলভারটন মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মিস ডিকশনও সেই যে কাউন্টারের কাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আর মুখ তুললেন না।
সিলভারটনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার?
সিলভারটন আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, নিজের ঘরে বসে বসে আমরা আলাদা ডিনার করব। বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছি।
ওঁর ঘরে গিয়ে ব্যাপারটা শুনলাম। বিপদই বটে! মেরিয়ন বুথ নামে যে মহিলাটি জাহাজ থেকে নেমেছেন, তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশের কম নয়। জাহাজঘাটেই সিলভারটন ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। কিন্তু তখন কিছু বলতে পারেননি। জেন গ্রেন অবশ্য ফাঁকি দেয়নি। সিলভারটন মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। এত পয়সা খরচ করে সিলভারটন একটা বুড়ি এনেছেন, এ-খবর একবার বেরিয়ে পড়লে শাজাহানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
ব্যাপারটা পরে প্রকাশিত হয়েছিল। শাজাহান হোটেল ঠকে গিয়েছে। যে-মেয়েকে শাজাহান হোটেলের এজেন্ট পছন্দ করেছিলেন, কথাবার্তা বলেছিলেন, এমনকি জাহাজে তুলে দিয়েছিলেন সে কোনো এক সময় জাহাজের খোলে বুড়িকে রেখে, নিজে নেমে গিয়েছে। কলকাতায় এসে কনেবদল যখন ধরা পড়ল, তখন আর কিছুই করবার নেই।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে সিলভারটন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনারই নাম মেরিয়ন বুথ? আপনি সত্যি কথা বলছেন?
ভদ্রমহিলা কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন। হোয়াট? তুমি আমার ফাদারের দেওয়া নামে সন্দেহ করছ?
এবং আপনার বয়স পঁচিশ! দাঁতে দাঁত চেপে সিলভারটন বলেছিলেন।
মোর অর লেস—ভদ্রমহিলা উত্তর দিয়েছিলেন।
নিশ্চয়ই লেস—সিলভারটন নিজের মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন। আমার যে কি ক্ষতি আপনি করলেন! আপনাকে ফেরত পাঠিয়ে যে অন্য কাউকে আনব সে-টাকাও আমার নেই। টাকা যদিও জোগাড় হয়, সময় নেই। মিস ডিকশনকে নোটিশ দিয়ে দিয়েছি। একা মিস গ্রের পক্ষে এত বড় বার চালানো অসম্ভব।
আমি বলেছিলাম, এসে যখন পড়েছে, তখন কী করবেন? লন্ডনে কি বয়স্কা মহিলারা বার-এ কাজ করেন না?
প্রত্যুত্তরে সিলভারটন যা বলেছিলেন তা আজও আমার বেশ মনে আছে। দীর্ঘদিন ধরে বহুবার ব্যবহার করেও কথাটা পুরনো হয়নি। এই শহর সম্বন্ধে ওইটাই বোধহয় শেষ কথা—ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা।
সিলভারটন বলেছিলেন, লন্ডনে চলতে পারে—এখানে চলবে না। দুটো বুড়ি এইভাবে চৌরঙ্গীর দুটো হোটেলকে ঠকিয়েছে। ওদের টাকা ছিল অনেক, ফিরতি জাহাজের ভাড়া দিয়ে দিলে, কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিলে বুড়িরা অবশ্য ফিরে যায়নি, তারা খিদিরপুরে গিয়ে জাহাজি পাড়ায় নিজেদের দোকান করে বসল।
বুড়ি মিস বুথ আনুনয় বিনয় করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাকে একবার সুযোগ দাও—আমি বলছি তোমার বিক্রি কমবে না।
সিলভারটন রাজি হননি। জোচ্চুরিটা ধরবার জন্যে, চাবি খুলে মিস গ্রেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। পথের শ্রমে ক্লান্ত হয়ে বেচারা মিস গ্রে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চোখ মুছতে মুছতে লাজনা জেন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তার মুখে যে ট্র্যাজেডির ইঙ্গিত ছড়ানো রয়েছে, সেদিনই যেন বুঝেছিলাম।
সিলভারটন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মিস বুথ কিভাবে সকলকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতায় এসে হাজির হলেন, জানেন?
মিস গ্রে কোনো উত্তর দেননি। মাথা নিচু করে বলেছিলেন, আমি তখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। দেশ ছেড়ে আসছি, কোনোদিন আর ফিরতে পারবো কি না জানি না।
এই লাজুক ও নম্র স্বভাবের অষ্টাদশী শাজাহান হোটেলের বার-এ কী করে যে কাজ করবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে জেন বললেন, মিস বুথের মতো দয়ালু স্বভাবের মহিলা আমি দেখিনি। জাহাজে সমস্ত পথ আমাকে যত্ন করে এসেছেন।
সেই রাত্রে শাজাহান থেকে ফিরে এসেছিলাম। কয়েকদিন পরে শুনেছিলাম মিস বুথ লিপস্টিক এবং রুজমাখা কিডারপুর গার্লদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। আর যুবতী মিস গ্রের লাজনম্র হাত থেকে হুইস্কি গ্রহণ করবার জন্যে শাজাহান হোটেলে অনেক মেড-ইন-ইংল্যান্ড ভদ্রলোক এবং মেড-ইন-ইন্ডিয়া বেঙ্গলিবাবু ভিড় করছেন। এই বেঙ্গলি বাবুদের নিয়েই ডেভি কারসন গান বেঁধেছিলেন—
I very good Bengali Babu
In Calcutta I long time e’stop,
জেন সম্বন্ধে আমি যে ভুল করিনি, তা আবার একজনের কথা শুনে বুঝলাম—আমার বন্ধু রবি। রবি অ্যাডাম। শাজাহান-এ সাপার করতে গিয়ে জেনকে সে প্রথম দেখেছিল। কলকাতার বার-এ তার নিজের দেশের এক মেয়ের দুর্দশা সে নিজের চোখে দেখেছিল। না দেখলেই হয়তো ভালো করত। অনেক কষ্টের হাত থেকে বেঁচে যেত—বিধাতার এমন কঠিন পরীক্ষায় বেচারাকে বসতে হত না।
রবি বলেছিল, শাজাহানের নতুন মেয়েটিকে দেখেছ? চোখঝলসানো সুন্দরী হয়ত নয়—কিন্তু প্লিজিং। বেচারার কি ইংলন্ডে চাকরি জুটল না? না জেনেশুনে কেউ এখানে আসে? গত রাত্রে ক্লাইভ স্ট্রিটের এক বড়া সাব ওর হাত চেপে ধরেছিল। অনেক কষ্টে খিদমতগার হাত ছাড়িয়ে দেয়। আর একজন আব্দার ধরেছিল, আমাকে কম্পানি দাও। কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আমার টেবিলে এসে বসো, একটু ড্রিঙ্ক করো। আমি বাধা না দিলে ভদ্রলোক জোর করেই ওকে কাউন্টার থেকে বের করে নিয়ে আসতেন। তখন একটা কেলেঙ্কারি হত। বার-এর অন্য খদ্দেররা রেগে উঠত, সবাই বলত, আমার পাশে এসে বসো, আমিও লোনলি ফীল করছি।
আমাদের রবি, অর্থাৎ রবার্ট জে অ্যাডাম, তখনও পুরো ক্যালকাটাওয়ালা হয়ে ওঠেনি। বছর খানেক ক্লাইভ স্ট্রিটের এক বাঘা আপিসে কাজ করছিল। এখানকার ভাষা, সভ্যতা, চলচলন কোনো কিছুতেই সে তখনও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
এমন যে হবে তা আমি জানতাম না। কোনো অদৃশ্য আকর্ষণে রবি প্রতিদিন শাজাহান হোটেলে যেতে আরম্ভ করেছে। দিনের আলোয় ওদের দেখা হওয়া সম্ভব ছিল না। জেনকে ঘরে তালাবদ্ধ করে, সিলভারটন ঘুমোতে যেতেন। জেনও সেই সময় অঘোরে ঘুমিয়ে থাকত। সন্ধ্যার পর থেকে তার যে ডিউটি আরম্ভ। আর তখনকার বার তো আর এখনকার মতো দশটা কি এগারোটা বাজলেই বন্ধ হয়ে যেত না। সকাল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকত।
মদ্যপদের অট্টহাসি, হৈ হৈ হট্টগোল, গেলাস ভাঙার শব্দের মধ্যেও দুটি মন নীরবে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল।
হবস একটু হাসলেন। বললেন, আমি ব্যবসাদার লোক, কাব্যিক ন্যাকামো আমার আসে না। তবুও আই মাস্ট সে, ওদের দুজনের পরিচয়ের মধ্যে কাব্যের সৌরভ ছিল। শুনেছি ওরা কোডে কথা বলত। হুইস্কির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে জেন কড়া কড়া ভাষা ব্যবহার করত। মিষ্টি কথা বলা মিষ্টি হাসবার কোনো উপায় ছিল না—অন্য খদ্দেররা তাহলে হৈ হৈ বাধিয়ে দেবে।
খিদমতগারই বোধহয় সব জানত। কোনো গোপন কথা থাকলে সে-ই রবিকে চুপি চুপি বলে যেত। খিদমতগার বেচারার এক মুহূর্তের শান্তি ছিল না। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বারমেডকে কিছু বলতে অতিথিরা তবুও সঙ্কোচ বোধ করেন, কিন্তু খিদমতগারের মাধ্যমে কোনো প্রস্তাব পেশ করতে লজ্জা নেই। শাজাহান হোটেলের মদ্যরসিকরা খিদমতগারকে একটা টাকা এবং একখানা চিঠি মেমসায়েবকে পৌঁছে দেবার জন্যে দিতেন।
জেন-এর কাছে পরে শুনেছি, একরাত্রে সে তিরিশখানা চিঠি পেয়েছিল। তার মধ্যে দশজন তাকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জেন বলেছিল, মাই পুওর খিদমতগার, সে যদি তিরিশ টাকা রোজ আয় করতে পারে, আই ডোন্ট মাইন্ড।
হবস একবার টোক গিললেন। সুদূরের স্মৃতিকে কাছে টেনে আনার চেষ্টা করতে করতে বললেন, আমি কিন্তু রবিকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ডোন্ট ফরগেট, ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা।
সাদারল্যান্ডও যেন মিস্টার হবসের কথায় চমকে উঠলেন। আস্তে আস্তে বললেন, ঠিক। কলকাতা কলকাতাই।
জেন ও রবি যখন বিয়ে করবার মতলব ভঁজছে তখনও রবিকে বলেছিলাম, মনে রেখো ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা। হোটেলে যাও, ড্রিঙ্ক করো, ফুর্তি করো, কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু তাই বলে বারমেডকে বিয়ে করে বোসো না।
মিস্টার হবস এবার একটু থামলেন।
তার কথা শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। বিয়ে করে একঘরে হবার সম্ভাবনা ইংরেজ সমাজেও তাহলে আছে? এতদিন ধরে সমস্ত গালাগালিটা শুধু শুধু আমরাই হজম করে এসেছি।
মিস্টার হবস আবার বলতে আরম্ভ করলেন। আমার মধ্যে তবু সামান্য চঞ্চলতা ছিল, কিন্তু সাদারল্যান্ড পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে তার কথা শুনতে লাগলেন।
মিস্টার হবস বললেন, আমাদের কোনো আপত্তিই রবি শোনেনি। সে বলেছে, আমি কথা দিয়েছি। শাজাহান হোটেলের নরককুণ্ড থেকে জেনকে আমার উদ্ধার করতেই হবে।
জেনও আপত্তি করেনি। শাজাহান হোটেল থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে সে ছটফট করতে আরম্ভ করেছে। বার-এর কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সে যে আপনজনকে খুঁজে পেয়েছে, তা হয়তো গল্পের মতো শোনায়; কিন্তু সত্যি তা সম্ভব হয়েছে। ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে তাকিয়ে থেকেছে জেন।
সিলভারটন গুজব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। জেনকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছেন, যে-সব গুজব শুনছি, আই হোপ, সেগুলো মিথ্যে। তোমার কাজে আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমার পপুলারিটি কলকাতার সমস্ত বারমেডদের হিংসের কারণ। পরের কনট্রাক্টে তোমার মাইনে বাড়িয়ে দেব।
জেন বলছে, বিবাহিত মেয়েদের চাকরিতে রাখতে আপনার কোনো অসুবিধে আছে?
বিবাহিত মেয়ে! জেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ম্যারেড গার্ল দিয়ে কখনও বারমেড-এর কাজ চলে?
কেন? আপত্তি কী? জেন প্রশ্ন করেছে।
আপত্তি আমার নয়! শাজাহান হোটেলের পেট্রনদের। তারা অপমানিত বোধ করবেন। হয়তো শাজাহান বারকে বয়কট করে বসবেন। সিলভারটন বলেছেন।
জেন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, আমি তা হলে কন্ট্রাক্ট সই করব না। আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে।
সিলভারটন তখন লোভ দেখিয়েছেন। জেনকে সব ভেবে দেখতে বলেছেন। এমনকি বিক্রির উপর একটা কমিশন দিতেও রাজি হয়েছেন। জেন তবুও রাজি হয়নি। বড়লোক হবার জন্যে সে কলকাতায় আসেনি। অভাবে বিরক্ত হয়ে, বাঁচবার জন্যে, ভুল করে চলে এসেছিল বিলেত থেকে। এখন নিজের চোখে সব দেখছে।
সিলভারটন বলেছেন, তোমার প্রাইভেট লাইফে আমি কোনোরকম বাধা দেব না। দুপুরবেলা তালা দিয়ে রাখার ব্যাপারটা প্রচারের জন্য করেছিলাম। তুমি যদি চাও সে তালার চাবিও তোমাকে দিয়ে দেব। তোমার যা খুশি তাই করো।
জেন বলেছে, চাবির মধ্যে থাকবার আর প্রয়োজনই নেই। নতুন যে বারমেড আসবে, তাকে বরং ওই সুযোগটা দেবেন।
সিলভারটন তখন ভয় দেখিয়েছেন। নিজের সর্বনাশ এইভাবে ডেকে এনো না, জেন। এই ডেনজারাস শহরকে তুমি এখনও চেনো না। শাজাহান হোটেলের বারে তোমার একটু মিষ্টি হাসি দেখবার জন্যে যাঁরা সাধ্যসাধনা করেন, রাস্তায় বেরিয়ে তারাই অন্য মানুষ হয়ে যান। তাদের সমাজ আছে, হিন্দুদের থেকেও কড়া সামাজিক আইন আছে, সেখানে রাত-জেগে-মদ বিক্রি-করা মেয়েদের কোনো স্থান নেই।
জেন হেসে বলেছে, তাদের চরণে তো আমি স্থান ভিক্ষে করছি না। আমি যার কথা ভাবছি, কেবল তিনি আমার কথা ভাবলেই আমার চলে যাবে।
সিলভারটন রবির সঙ্গেও দেখা করেছেন। বলেছেন, একবার যে বার-বনিতা—সে চিরকালই বার-বনিতা। ওয়ান্স এ বারমেড অলওয়েজ এ বারমেড। আমরা খরচ দিয়ে বিদেশ থেকে মেয়ে আনি। অ্যাডেলফি, হোটেল-ডি ইউরোপ বেশি পয়সার লোভ দেখিয়ে তাদের ভাঙিয়ে নেয়। তারপর ওদের যৌবন যখন স্তিমিত হয়ে আসে, দৃষ্টির ছোবলে যখন আর তেমন বিষ থাকে না, তখন তাড়িয়ে দেয়। ওরা তখন দর্জিকে দিয়ে জামাগুলো আরো টাইট করে নিয়ে, খিদিরপুরে গিয়ে লাইন দেয়। ডকের ধারে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ সব একাকার হয়ে যায়; ফিরিঙ্গি, কিন্তলী, বিলিতি পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকে।
রবি বলেছে, ওই বিষয়ে আমার কোনো বই লেখবার ইচ্ছে নেই, সুতরাং আমি কিছু জানতে চাই না।
সিলভারটন শেষ চেষ্টায় রবির বড়সায়েবের কাছে দরবার করেছেন। বড় সায়েব বলেছেন, আই সি। দ্যাট গার্ল উইথ এ নটি স্মাইল। দুপুর বেলায় ওর দরজায় তোমরা যে তালা লাগিয়ে রাখো, তার কটা ড়ুপ্লিকেট চাবি আছে?
রবিকে তিনি বলেছেন, হিন্দুরা রাস্তার জুতোকে শোবার ঘরে ঢুকতে দেয় না। যদি তেমন প্রয়োজন হয় ঘরের জন্যে একটা আলাদা বাথরুম স্লিপার ব্যবহার করো!
রবি বলেছে, যখন আমি লন্ডন থেকে জাহাজে চড়েছিলাম, তখন শুনেছিলাম ইংরেজ যেখানেই যাক না কেন, তারা সব সময় অন্য লোকের প্রাইভেসিকে সম্মান করে।
বড়সায়েব আর কিছু বলেননি। শুধু মনে করিয়ে দিয়েছেন, যা কিছু আমরা করি, তার ফলও আমাদের ভোগ করতে হয়।
রবি সে-উপদেশের জন্য সায়েবকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তারপর এক শুভদিনে জেন শাজাহান হোটেলের কন্ট্রাক্ট শেষ করে রবার্ট অ্যাডামের সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধবার জন্য চার্চে গিয়েছে।
ধর্মতলা চার্চে সেদিন কিন্তু মোটেই ভিড় হয়নি। জেন-এর কোনো বন্ধু নেই, একমাত্র মিস ডিকশন ছাড়া। তিনি তখন শাজাহান হোটেলের ছাদের ঘরে তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। আর রবার্টের বিয়ে নিয়ে ক্লাইভ স্ট্রিট মহলে যে সামাজিক কেলেঙ্কারির অবতারণা হয়েছে, তাতে ক্লাইভ স্ট্রিটওয়ালাদের কারুর পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। আমার সঙ্গে ও-সমাজের তখনও তেমন জানাশোনা হয়নি। সেই জন্যেই বোধহয় বিয়েতে গিয়েছিলাম; এবং যাবার সময় জোর করেই ম্যানেজার সিলভারটনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, হাজার হোক তোমার একজন কর্মচারিণীর বিয়ে তো।
বিয়ের পর ওরা বাসা করেছিল। সে বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম, জেন বসে রয়েছে। আমাকে দেখে ওরা দুজনে হৈ হৈ করে উঠল। রবি আলমারি খুলে আমাদের জন্য ব্র্যান্ডির বোতল বার করে নিয়ে এল। স্বামীকে মদ ঢালতে দেখে জেন হেসে ফেলল। আমিও সে হাসিতে যোগ দিয়েছি। রবি তখন বলেছে, শাজাহানের কাউন্টারে তুমি অনেকবার দিয়েছ, এবার আস্তে আস্তে শোধ করবার চেষ্টা করি।
জেন যেন এতদিন জেলখানার বন্দি হয়ে ছিল। বহু কষ্টে মুক্তি পেয়েছে—তাই তার আনন্দের সীমা নেই। আর রবিও যেন হঠাৎ তাকে খুঁজে পেয়েছে, যাকে সে এতদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
ব্র্যান্ডির গ্লাসে আমরা চুমুক দিয়েছি। নববিবাহিত দম্পতির মঙ্গল কামনা করেছি! জেন বসে বসে সোয়েটার বুনছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলেছে, এতদূর যখন এসেছেন তখন দুপুরের লাঞ্চটাও সেরে যান। আমার অবশ্য
নোটিশ দেওয়া উচিত ছিল।
রবার্ট বলেছে, ওইটাই তোমার স্বভাব। সিলভারটনকেও তুমি অত্যন্ত শর্ট নোটিশ দিয়েছিলে!
জেন কপট রাগ করেছে। বলেছে, বাজে লোকদের অল্প নোটিশে ছাড়া পেতে অসুবিধে হয় না। আমাদের মতো অপদার্থকে বিদায় করবার সুযোগ পেলে মালিকরা একমুহূর্ত দেরি করতে চান না!
রবার্ট বলেছে, সবাই যদি জহুরী হত, তাহলে ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের হ্যামিলটন কোম্পানির অত কদর থাকত না।
জেন তখন বলেছে, হ্যামিলটন কোম্পানির উপর তোমার এত দুর্বলতা কেন জানি না। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে সে বলেছে, আপনার বন্ধুটিকে একটু সাবধান করে দিন না। এ-মাসের পুরো মাইনেটি তো ওঁদের হাতে দিয়ে আমার জন্যে হীরে-বসানো ব্রোচ কিনে এনেছেন। এর কোনো মানে হয় বলুন তো?
দোষটা বুঝি শুধু আমার হল? রবি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছে। যদি হ্যামিলটনের উপর তোমার এতই রাগ, তবে আমার জন্যে ওখান থেকে রুপোর টি-পট কিনে আনলে কেন?
জেন অপ্রস্তুত হয়ে বললে, তার কারণ অন্য। বিষে বিষক্ষয় করবার চেষ্টা করছি। চা দিয়ে যদি অ্যালকোহলকে তাড়াতে পারি!
সেদিন যে যত্ন করে ওরা আমার আদর-আপ্যায়ন করেছিল, তা আজও ভুলতে পারিনি। বাজনার কথা উঠেছে। রবি বলেছে, জানেন, ও পিয়ানো বাজাতে পারত। সম্ভব হলে জেনকে একটা কিনে দেবার ইচ্ছে আছে।
কয়েকদিন পরে একটা ভালো পিয়ানোর খোঁজ পেয়েছিলাম। রবি ও জেনকে খবর দেবার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু খবর দিতে হল না। আজ আপনারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, ঠিক ওইখানেই তারা হঠাৎ একদিন এসে হাজির হল। দেখেই বললাম, একটা চমৎকার পিয়ানোর খবর পেয়েছি।
জেন-এর মুখ কালো হয়ে উঠল। আর রবি যেন রাত্রে একটুও ঘুমোয়নি। রবি বললে, এখন বোধহয় পিয়ানো কেনা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
কী ব্যাপার?
আমার চাকরি গিয়েছে।
কেন? বড়সায়েবের সঙ্গে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে?
না। বার-এ অপরিচিত পুরুষদের সারারাত ধরে মদ বিক্রি করে এমন এক মেয়ে বিয়ে করে আমি নাকি কোম্পানিকে লোকচক্ষুতে হেয় করেছি। এমন লোক কোম্পানিতে রাখলে, কোম্পানির বিক্রি কমে যাবে, বিজনেসের ভয়ানক ক্ষতি হবে।
কলকাতা শহরে এমনভাবে কোনো ইংরেজের চাকরি যাওয়া যে সম্ভব তা আমার কল্পনারও অতীত ছিল। কিন্তু বড়সায়েবের নিজের হাতে লেখা চিঠিটা রবি আমার সামনে মেলে ধরল।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জেন বললে, এখন উপায়?
সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, উপায় আবার কী? অন্য আপিসে চাকরির চেষ্টা করতে হবে। কলকাতায় তো আর ফার্মের অভাব নেই।
কিন্তু এত ফার্ম থাকলেও যে চাকরি পাওয়া সোজা নয়, তা কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমরা। অনেক আপিসে ঘুরেছিল রবি। কিন্তু ওকে দেখেই কর্তারা আঁতকে উঠেছেন। যেন সে খুন করে জেলে গিয়েছিল, এখন খালাস পেয়ে চাকরি খুঁজতে বেরিয়েছে। কর্তারা বসতে দিয়েছেন। বলেছেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার কথা শুনেছি বটে। আপনিই শাজাহান হোটেলের বারমেড জেনকে নিয়ে পালিয়েছেন?
আজ্ঞে, তাঁকে নিয়ে আমি পালাইনি, তাকে আমি বিয়ে করেছি। রবার্ট আর্তকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছে।
সায়েব বলেছেন, ও আই সি। কিন্যাপিং নয়, ইলোপমেন্ট নয়, প্লেন এন্ড সিমপল ম্যারেজ।
চাকরির কিন্তু পাওয়া যায়নি। প্রথমে সন্দেহ হয়নি। কিন্তু ক্রমশ যেন রবি বুঝতে পারছে ওর চাকরি হবে না। কলকাতার কোনো আপিস তাকে আর চাকরি দেবে না। যা সঞ্চয় ছিল, তাও ফুরিয়ে আসছে। সাজানো বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে, ওদের অন্য একটা ছোট বাড়িতে উঠে যেতে হল।
জেন বললে, আমি চাকরির চেষ্টা করব।
মেয়েদের কাজ করবার সুযোগ তখন সামান্যই ছিল। টাইপ কিংবা টেলিফোনের চাকরি তখন ছিল না। হয় লেডিজ ড্রেস মেকার, না-হয় হেয়ার ড্রেসার। পার্ক স্ট্রিটে দোকান করে, বড়সায়েবদের বুড়ি বউদের সাদা চুল কালো করবার চেষ্টা করো। কিন্তু সে-সব কাজও তো শিখতে হবে। না শিখলে, কে আর জামা তৈরি করতে পারে, বা চুল ছাঁটতে সাহস করে?
কাজের খোঁজে তবু জেনকে দুএক জায়গায় পাঠিয়েছি। কিন্তু রবি কিছুতেই রাজি নয়। সে যুগের লোকরা তোমাদের মতো আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি। স্ত্রী কাজ করবে ভাবতেই তাদের মাথা ঘুরতে আরম্ভ করত। রবি বলেছে, এখন থেকেই উতলা হয় না। ব্যাঙ্কে এখনও আমার কিছু টাকা রয়েছে।
এদিকে জেনও একদিন আবিষ্কার করল, চাকরি পেলেও তার পক্ষে কাজ করা সম্ভব হবে না। সে মা হতে চলেছে। অভাব, অনটন, দুশ্চিন্তার মধ্যেই দুঃখদিনের রাজা তাদের ঘরে আসছেন।
রবি আমার কাছে প্রায়ই আসত। ওদের খবরাখবর পেতাম। বলত, কলকাতার প্রভুরা যে আমাদের জন্যে এত শাস্তি তুলে রেখেছিলেন জানতাম না। কিন্তু আমরা দুজনে এর শেষ পর্যন্ত দেখব। জেন আর আমি ওদের নাকের ডগায় সুখে-স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকব। বারমেডকে বিয়ে করা যে সমাজের চোখে এতবড়ো অন্যায় তা তো জানতাম না। এর আগে কলকাতায় কেউ কি কখনও কোনো হোটেলের মেয়েকে বিয়ে করেনি?
করেছে, আমি বলেছি। ওই তো হোটেল-সার্জেন্ট ওলে কিছুদিন আগে বিয়ে করল পেগিকে। রাত্রে পুলিসের লোক কলকাতার বারগুলো ঘুরে ঘুরে দেখত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে এক রাত্রে পেগিকে সার্জেন্ট ওলে অ্যারেস্ট করেছিল। তারপর পেগির হাতেই সার্জেন্ট নিজে গ্রেপ্তার হলেন! গবরমেন্টের আইনে বিয়ের কোনো বাধা নেই। ওরা দুজনে তো বেশ সুখে শান্তিতে সংসার করছে। ওদের দুটো ছেলেকে ইস্কুলে পাঠিয়েছে। চাকরি যাওয়া তো দুরের কথা, কপালগুণে সার্জেন্টের পদোন্নতি হয়েছে।
রবিকে শেষ পর্যন্ত একটা কাপড়ের এজেন্সি জোগাড় করে দিয়েছি। ম্যাঞ্চেস্টারের মিস্টার স্ট্রিট সেবার ব্যবসার কাজে কলকাতায় এসে শাজাহান হোটেলে উঠেছিলেন। তার সঙ্গে সামান্য পরিচয় ছিল আমার; সেই সুযোগেই ওঁকে বলেছিলাম, রবিকে রাখুন। মাইনে দিতে হবে না, কমিশনে কাজ করবে।
রবির কাছে তখন সে-ই আশীর্বাদ। কাপড়ের নমুনা নিয়ে সে সারাদিন দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াতো। বড়বাজার যেত সকালের দিকে; আর দুপুরে জেন সামান্য যা বেঁধে রাখত তাই খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ত অন্য পাড়ায়। ওদের কোম্পানির ছাতার কাপড় খুব বিখ্যাত ছিল। রবি আমাকে একটা ছাতা উপহারও দিয়েছিল। কিন্তু সারা বছরে কটা ছাতাই আর তখন বিক্রি হত বললো।
এমন কিছু বিক্রি হত না। ফলে কমিশনও সামান্য। এত সামান্য যে তাতে বেয়ারা এবং কুক রাখা যায় না। জেন নিজেই সব করে নিত। চরম দুঃখের মধ্যেই দুঃখের রাজার আবির্ভাবের দিন এগিয়ে আসছে। কিন্তু ওদের অবস্থা তখন আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে। উইলিয়ামস্ লেন-এ একটা ভাঙা ঘরে ওদের বাসা। পাশের বাড়িতে একজন চার্চের পাদ্রি থাকতেন। তাঁর সঙ্গে মিসেস ব্রকওয়েরও যথেষ্ট আলাপ ছিল। ওদের দুঃসময়ে ফাদার রোজ আসতেন। ফাদারের স্ত্রীও। জেন-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। শাজাহানের প্রাসাদে যে একদিন রাত্রি যাপন করত, নরম কার্পেটের উপর দিয়ে চলা যার অভ্যাস ছিল, সে আজ যোগিনী সেজেছে। দুটো ঘর। দেওয়ালে চুন-বালি খসে ইট দেখা যাচ্ছে। ওয়েটাররা যাকে খাতির করে ডাইনিং হল-এ নিয়ে যেত, পাছে অসুবিধা হয় বলে সযত্নে টেবিলটাকে চেয়ার থেকে সামান্য বেঁকিয়ে ধরত, সে আজ নিজেই রান্না করছে। অসুস্থ শরীরটা টানতে টানতে ঘরের জিনিসপত্তর গোছাচ্ছে।
শাজাহান হোটেল আজ যেন অনেক দূরে সরে গিয়েছে। বার-এ দাঁড়িয়ে হাসির মুক্তো ছড়িয়ে যে হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, ড্রাইজিন, রাম, ভারমুথ বিতরণ করত যে যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। জেন বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। সে বললে, শাজাহানকে আমি কোনোদিন বোধহয় ক্ষমা করতে পারব না। ওইখানেই আমি আমার স্বামীকে পেয়েছি; তবুও।
বললাম, কেন?
জেন এবার কেঁদে ফেলল। চাকরির খোঁজে, আপনাদের না বলে ওখানেও একদিন গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বার-এ কাজ করতে আমি আবার রাজি আছি। শুধু দুপুরে আমাকে তালা দিয়ে রাখা চলবে না। হোটেলে আমি খাবও না। কাজ শেষ হলেই নিজের বাড়িতে ফিরে যাব। অন্তত বিলেত থেকে নতুন মেয়ে না-আসা পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে দাও। লোকের অভাবে তোমাদেরও তো অসুবিধে হচ্ছে।
সিলভারটন তখন মুখ বেঁকিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তালা খোলা অবস্থায় থাকতে হলে খিদিরপুরে যাও। আর বিবাহিত মেয়েকে বারমেড করবার মতো দুর্মতি শুধু আমার কেন কলকাতার কোনো হোটেলেরই হবে না, শাজাহান থেকে যখন বেরিয়েছ, তখন খিদিরপুরেই তোমাকে শেষ করতে হবে।
জেন-এর চোখ দিয়ে তখনও জল গড়িয়ে পড়ছে। রবির পায়ের আওয়াজ পেয়ে সে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলেছে। সারাদিন বড়বাজার, শ্যামবাজার আর ধর্মতলায় ঘুরে ঘুরে রবির দেহটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঘামে জামা কাপড়গুলো ভিজে গিয়েছে। সারাদিন রবি কিছুই বিক্রি করতে পারেনি। আগে যা বিক্রি করেছে, তার দামও আদায় করতে পারেনি। অথচ মাস শেষ হয়ে আসছে, বিলেতে হিসেব পাঠাতে হবে।
রবিকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলেছি, তোমরা পালাও। মাদ্রাজ কিংবা বোম্বাই চলে যাও। চাকরি পেয়ে যাবে।
রবি রাজি হয়নি। জেন বোধহয় আমার কথা বুঝতে পেরেছিল। কিছুতেই নয়, সে বলেছিল এই কলকাতায় আমাদের থাকতে হবে। ওদের অপমানের যোগ্য উত্তর এখানে বসে বসেই আমাদের দিতে হবে। চিরকাল কিছু আমাদের এমন অবস্থা থাকবে না। আমরা আবার রাসেল স্ট্রিটে ফ্ল্যাট নেব। তারপর একদিন শাজাহানেই আমরা ব্যানলেয়েট দেব। ওদের সবাইকে সেখানে হাজির করব। আমাদের বিয়ের রজতজয়ন্তী উৎসব শাজাহান হোটেলে না করে আমরা কলকাতা ছাড়ছি না।
রবি আনন্দে জেনকে আমার সামনেই জড়িয়ে ধরেছে। বলেছে, ঠিক বলেছ, জেন।
চরম দুঃখের মধ্যেও ওদের আনন্দ দেখে আমার চোখে জল এসে গিয়ে ছিল। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছি, তাই যেন হয়। কিন্তু তখন কি জানতাম, চোখের জলের সবে মাত্র শুরু; আসল বর্ষা এখনও নামেনি।
সে অবস্থা আমি চোখে দেখিনি। ফাদারের মুখেই খবর পেয়েছিলাম। ফাদার বলেছিলেন, সর্বনাশা অবস্থা।
কেন, কী হয়েছে?
আপনার বন্ধু রবি অ্যাডাম-এর বসন্ত হয়েছে। আসল স্মলপক্স।
ওরা কোথায় আছে? আমি জিজ্ঞাসা করেছি।
কোথায় আর থাকবে। এখনও উইলিয়ামস লেনের বাড়িতে। কিন্তু বাড়িতে বোধহয় আর রাখা চলবে না। সংক্রামক ব্যাধির হাসপাতালে পাঠাতে হবে। কে দেখবে? কে সেবা করবে? এবং সবচেয়ে বড়কথা, টাকা পাবে কোথায়? জেন কিছুই শুনতে চাইছে না। দেহের ওই অবস্থা নিয়ে সর্বদা স্বামীর পাশে বসে রয়েছে। গতরাত্রে বেচারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল।
বন্ধুরা আমাকে বারণ করেছিলেন। বসন্ত! ওর আধ মাইলের মধ্যে যেও। যদি কিছু সাহায্য করতে চাও, ফাদারের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিও।
কিন্তু কিছুতেই চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। বৌবাজার স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওদের বাড়ির কাছে এসেছি। দূর থেকে ফিনাইল ও ওষুধের গন্ধ ভেসে এসেছে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকতে সাহস হয়নি। ফাদার তখনও বোধহয় ঘরে বসে বসে ওর সেবা করছিলেন-বসন্তের গুটিতে তুলি দিয়ে অলিভ তেল লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। রবির সর্বদেহে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেহটাকে ভুট্টার মতো করে পোড়ানো হচ্ছে।
আর জেন! মেটারনিটি কোট পরে, থলে হাতে বোধহয় বাজার করতে বেরোচ্ছিল। আমাকে দেখেই সে থমকে দাঁড়িয়েছিল। জেনকে আমি চিনতে পারছিলাম না। এই জেনকে দেখবার জন্যেই কলকাতার রসিকজনরা একদিন শাজাহান হোটেলের বার-এ ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল? হাততালি পড়েছিল; ছোকরা মাতালরা গুন গুন করে গান ধরেছিল; শাজাহান হোটেলে মদের বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল।
আপনি! আপনি এখানে? জেন আমাকে দেখে কোনোরকমে প্রশ্ন করেছিল।
রবি কেমন আছে খবর নিতে এসেছি। আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিয়েছিলাম।
রবি নিশ্চয়ই ভালো হয়ে উঠবে। ফাদার কাল চার্চে ওর জন্য প্রার্থনা করেছেন। লোকাল হিন্দু বয়েজরা খুব ভালো। ওরা শাজাহান হোটেলে, উইলসন সায়েবের হোটেলে, বড়াপোচখানায় যায় না বটে; কিন্তু জেন্টেলমেন। ওরা দল বেঁধে আজ ফিরিঙ্গি কালীর কাছে পুজো দিতে গিয়েছে। আমি পয়সা দিতে গিয়েছিলাম, ওরা নিল না। ওরা নিজেরা চাদা করে পয়সা তুলেছে। বলেছে, সায়েব ভালো হয়ে গেলে, চাকরিতে ঢুকলে আমাদের একদিন কেক তৈরি করে খাইও। ঠিক বিলিতি কেক যেমন হয়। যেমন কেক কলকাতার বড় বড় হোটেলে বড় বড় সায়েবরা চায়ের সঙ্গে খায়। যে কেকে কামড় দিতে দিতে মেমসায়েবরা খিলখিল করে হেসে ওঠে।
আমি বলেছি, জেন, যদি তুমি কিছু না মনে করো, কিছু টাকা…
জেন মাথা নেড়েছে। হ্যামিলটনের হিরের ব্রোচ এখনও আমার কাছে আছে। শাজাহান হোটেলে এক বছর কাজ করেও আমি কিছু জমিয়েছিলাম। রবি কোনোদিন তা স্পর্শ করেনি। সেগুলো আমার কাছে আজও আছে।
লোকাল বয়েজরা ঠিক সেই সময় কোথায় থেকে হাজির হল।মেমবউদি, মেমবউদি, আপনি কেন বাজারে যাবেন? আমরা রয়েছি।
মেমবউদির হাত থেকে ওরা বাজারের থলেটা কেড়ে নিয়েছে। বাজার করে নিয়ে আসছি। কিন্তু নো মাছ। স্ট্রিক্টলি ভেজিটারিয়ান। মাদার সে না হলে অসন্তুষ্ট হবেন।-ছেলেরা বলেছে।
ছেলেরা বলেছে—আজ রাত্রে বউদি আপনি ডিপ ডিপ স্টিপ। নো দুশ্চিন্তা। সায়েবদাদাকে হোল নাইট আমরা গার্ড দেব। নো ফিয়ার বউদি। স্নাইট সন্দেহ, দেন এন্ড দেয়ার কলিং বউদি।
জেন বলেছেন, তা হয় না, মাই বয়েজ। তোমরা মানুষ নও, তোমরা অ্যাঞ্জেল। কিন্তু এই সর্বনাশা রোগে তোমরা কাছে এসো না। তোমাদের বাবা মা আছেন, ভাইবোন আছেন। রোগটা মোটেই ভালো নয়।
ছেলেদের মধ্যে একজন হেসে উঠেছে। আমরা কী অততা বোকা ছেলে, বউদি। মাদার সেটুলাকে একেবারে কন্ট্রোল করে ফেলেছি। আমাদের কিছু হবে না। হকি-ইন্ডিয়ান মেডিসিন। শার্টের হাতাটা গুটিয়ে ওরা সুতোয় বাঁধা একটুকরো হর্তুকি দেখিয়েছে। কিচ্ছু হবে না। আপনার জন্যেও আমরা এনেছি। তাড়াতাড়ি স্নান করে, ওটা আজই হাতে বেঁধে ফেলুন।
জেন-এর সঙ্গে আমার আর কথা হয়নি। হকি পরাবার জন্যে ছেলেটা ওদের মেমবউদিকে প্রায় টানতে টানতেই বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
খবর পেয়েছি, রবির অবস্থা ভালো নয়। লোকাল বয়েজদের ইচ্ছে ছিল, তবু হাসপাতালে দিতে হয়েছে। হাসপাতালের বেড-এ প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় সে পড়ে আছে। লোকাল বয়েজরা যমের সঙ্গে টাগ অফ-ওয়ারে একেবারে হাল ছেড়ে দেয়নি। হাসপাতালের ওয়ার্ডে বাইরের লোকদের ঢোকা মানা। ওরা তবু ফিরিঙ্গি কালীর ফুল প্রতিদিন ওয়ার্ড-বয়ের হাতে দিয়ে এসেছে। এই দড়ি টানাটানিতে কে জিতবে জানা নেই, কিন্তু লোকাল বয়েজরা অন্তত ফলাফল ঘোষণা দেরি করিয়ে দিয়েছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে ওরা প্রতিদিন মেমবউদির কাছে গিয়েছে, মেমবউদিকে সায়েবদাদার সব বিবরণ অর্থাৎ যতখানি তারা সংগ্রহ করতে পেরেছে—দিয়েছে। মেমবৌদির যে আর রাস্তায় বেরোবার সামর্থ্য নেই। শুয়ে শুয়েই ওদের কথা তিনি শোনেন। ছেলেরা বলেছে, বুঝতে পারছি বউদি, আপনার মনের কথা বুঝতে পারছি। ভয়ের কিছু নেই।
বউদি অঝোরে কেঁদেছে। জিজ্ঞাসা করেছে, তোমরা কারা? তোমরা কেন এত করছ?
ছেলেরা বুঝতে না পেরে, প্রথমে ভড়কে গিয়েছে। মুখচাওয়াচাওয়ি করে বলেছে, কী করছি আমরা?…ও…সায়েবদাদার অসুখ তাই। অসুখ না করলে আমরা কিছুই করতাম না। ফাদারের পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে খেতাম।
ছেলেদের কাছেই আবার একদিন খবর পেলাম। খবর নিতে একদিন জেন-এর কাছে যাচ্ছিলাম। গলির মোড়ে ছেলেরা মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই ওরা সরে গেল। নিজেদের মধ্যে সভয়ে ফিস্ ফিস্ করে কী যেন বললে, আমাকে সোজাসুজি কিছুই বলতে চাইল না। অথচ বাড়িতে জেনকে দেখতে পেলাম না। সেখানে কেউ নেই।
ওরা বললে, আপনি ফাদারের সঙ্গে দেখা করুন।
ওদেরই একজন আমাকে ফাদারের কাছে নিয়ে গেল। ফাদার তখন বোধহয় ভিতরে ছিলেন। একটু অপেক্ষা করবার পর, ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ও আপনি এসে গিয়েছেন? শুনেছেন?
বললাম, না, এখনও কিছু শুনিনি।
ফাদার বললেন, সেই নবজাত শিশুকে আমার স্ত্রী দুধ খাওয়াবার চেষ্টা করছেন। বহু কষ্ট করে একটা ওয়েট নার্স যোগাড় করে এনেছি।
মানে? আমি চমকে উঠেছি।
ওদের কী দোষ? ওদের সত্যি দোষ নেই। ওরা লজ্জা পেয়েছে, ভয়ে আমার কাছে আসছে না, কিন্তু আমি জানি, অলমাইটি গডের চরণতলে তারা কিছু অপরাধ করেনি। তবে, আমাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারত। আমি তো ডাক্তারদের সঙ্গে রোজ কথা বলি। প্রয়োজন হলে আমিই বলতে পারতাম।
ফাদারের কাছে ঘটনাটা শুনলাম—
সেদিনও পাড়ার ছেলেরা ফিরিঙ্গি কালীর ফুল নিয়ে রবিকে দেখতে গিয়েছিল। অর্থাৎ ওয়ার্ডের সামনে পর্যন্ত গিয়েছিল, যেখানে লেখা—No ADMISSION, সেখানে অন্যদিনের মতো ওয়ার্ড-বয়ের হাতে তারা টিফিন থেকে বাঁচানো কয়েকটা পয়সা দিয়েছে। ফুলগুলো সায়েবের বিছানার তলাতে দেবার জন্যে বলেছে। ফুলগুলো সায়েবের বিছানার তলায় দিয়ে ওয়ার্ড-বয় আবার ফিরে এসেছে। ছেলেরা জিজ্ঞেস করেছে, সায়েবদাদা কেমন আছেন?
ওয়ার্ড-বয় বলেছে, সায়েব তোমাদের কে হয়?
কেউ নয়। আমাদের পাড়ায় থাকেন। সায়েবদাদা যে আমাদের মতো গরিব হয়ে গিয়েছেন। মেমবউদি আমাদের মতো ডাল ভাত খেয়ে থাকেন। কী করবে, পয়সা নেই।
ওয়ার্ড-বয় মাথা দুলিয়ে বলেছে, তা হলে আপনাদের বলি, পেসেন্ট আপনাদের আত্মীয় নন যখন। বত্রিশ-নম্বরের আঁখ খতম। ডাগদার সাব আজ ভোরে দেখেছেন।
অন্ধ! সায়েবদাদা জীবনে আর দেখতে পাবেন না? ছেলেদের চোখ ছলছল করে উঠেছে। যদি আমরা চাদা করে আট টাকা ভিজিটের ডাক্তার নিয়ে আসি, দারোয়ানজি?
ওয়ার্ড-বয় ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। ওদের কথা আর কানেও নেয়নি।
মেমবউদিকে ওরা প্রথমে বলতে চায়নি। মেমবউদি জিজ্ঞেস করেছেন, আজ তোমরা রবিকে কেমন দেখলে? রবি কেমন আছে?
তারা মিথ্যে বলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মিথ্যে কথা বলবার অভ্যেস নেই যে ওদের। কিছু না বলে তারা চোখের জল মুছতে আরম্ভ করেছিল। একজন এরই মধ্যে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল।
মেমবউদি তখন ওদের হাত চেপে ধরেছেন। বলো বলছি। আমি তোমাদের গুরুজন। আমাকে মিথ্যে বললে তোমাদের অকল্যাণ হবে।
ওরা বলে ফেলেছে। সায়েবদাদা যে পৃথিবীর আলো কোনোদিন চোখ দিয়ে দেখতে পাবেন না, তা আর চেপে রাখতে পারেনি।
জেন-এর জ্ঞানহীন দেহটা ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই যে মেঝেতে লুটিয়ে পড়বে, তারা তা ভাবতে পারেনি। মেমবউদির মুখ তারা জলের ঝাপটা দিতে আরম্ভ করেছে, আর একজন ডাক্তার ডাকতে ছুটেছে। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলেছেন, এখনি ওষুধ কিনে নিয়ে এসো। ওষুধ কেনার পয়সা ছেলেদের কাছে ছিল না—যা দরকার তার থেকে আট আনা কম হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা তখন ফাদারের কাছে ছুটে এসেছে। ফাদারও সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন।
জেনের সংজ্ঞাহীন দেহটাকে ফাদারের বাড়িতে আনা হয়েছে। এবং সেই রাত্রে সে এক সন্তানের জন্ম দিয়েছে—প্রিম্যাচিওর বেবি। দুঃখদিনের রাজা নির্ধারিত সময়ের আগেই ঘরে এসেছেন।
শেষ রাত্রেই ফাদার মৃত্যুপথযাত্রী জেনের জন্য নতজানু হয়ে সর্বশক্তিমানের উদ্দেশে প্রার্থনা জানিয়েছেন। রাত শেষ হবার আগেই উইলিয়ামস লেনের লোকাল বয়েজদের কাঁদিয়ে জেন যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, শাজাহান হোটেলের বার তখনও বন্ধ হয়নি। সায়েবরা তখনও নিশ্চয় চিৎকার করছেন, হে মিস, হুইস্কি সরাব, ব্লতি পানি লে আও।
ফাদার অসন্তুষ্ট হয়েছেন। দুঃখের সঙ্গে ছেলেদের বলেছেন, কে তোমাদের বলেছে, সে অন্ধ হয়ে গিয়েছে? বাজে কথা। একটা চোখওনলি ওয়ান আই–নষ্ট হয়েছে। আর একটা ঠিক আছে। মিরাকুলাসলি বেঁচে গিয়েছে।
কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গিয়েছে। জেন-এর প্রাণহীন দেহ তখন সাদা চাদরে ঢাকা দেওয়া হয়ে গিয়েছে। লোকাল বয়েজরা সেই রাত্রে হাঁটতে হাঁটতে লোয়েলিন কোম্পানিকে খবর দিতে চৌরঙ্গীতে চলে গিয়েছে। লোয়েলিন কোম্পানি—আন্ডারটেকার। ছেলেরা বলেছিল, যদি আপত্তি না থাকে, আমরাই কাঁধে করে নিয়ে যাব। আমরাই সব করব।
ফাদার বলেছিলেন, তোমরা থেকো, কিন্তু ক্রিশ্চান ফিউনারাল-এ আজও অনেক গোলমাল আছে। লোয়েলিন কোম্পানিকে না-ডাকলে অসুবিধে হবে। ওরা দিনরাত ওই কাজ করছে।
রবি ওদিকে সুস্থ হয়ে উঠছে। জ্বর কমে গিয়েছে। শরীরের অসহ্য জ্বালাটাও যেন ক্রমশ কমছে। ঘাগুলো শুকিয়ে আসছে। এতদিন সব যেন ভুলেই ছিল। আবার সব মনে পড়ছে। উইলিয়ামস লেনের একটা ভাঙা বাড়িতে জেনকে যে রেখে এসেছে তাও মনে পড়ল।
মেমসায়েব কোথায়? রবি জিজ্ঞাসা করে।
কৌন? ওয়ার্ড-বয় প্রশ্ন করে।
মেম সাব। মেরি জেনানা। রবি উত্তর দেয়।
এখানে কারুর আসা বারণ। ডাক্তাররা রবিকে বোঝাবার চেষ্টা করেন।
মন তবু প্রবোধ মানতে চায় না। রবির চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে আরম্ভ করে। মেম সাব। আমার জেনানা।
আবার কখনও সে পাগলের মতো হয়ে ওঠে। বলে, বুঝেছি। সে আসতে চায় না। শাজাহানের সুন্দরী বারমেড আমাকে বিয়ে করে মস্ত ভুল করেছিল। নিশ্চয়ই সে অন্য কোথাও গিয়েছে। সিলভারটন তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
ডাক্তাররা বলেছেন, আপনার স্ত্রীর উপর অবিচার করছেন। হাসপাতালের দরজা পর্যন্ত তিনি বোজ আসেন।
দুপুরবেলায় রবি ওয়ার্ড-বয়কে জিজ্ঞাসা করেছে, একজন মেমসায়েবকে রোজ তোমরা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখো?
না সাব, কোনো মেমসাব তো এদিক আসেন না। ওয়ার্ড-বয় উত্তর দিয়েছে।
অভিমানে রবির চোখ দিয়ে জল বেরোতে আরম্ভ করেছে।
খবর পেয়ে ডাক্তাররা ভয় পেয়ে গিয়েছেন। তারা বলেছেন, একেবারে বাজে কথা। তিনি প্রায়ই আমাদের কাছে আসেন।
রবি মাথায় হাত দিয়ে বলে, আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। জেনকে–হয় আপনারা আসতে দেন না। কিন্তু চিঠি দেয় না কেন সে? তাকে চিঠি লিখতে বলবেন?
জানলার বাইরে থেকে লোকাল বয়েজরা দেখে, সায়েব কাঁদছে। একটা চিঠির জন্যে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে। যে আসে, তাকেই জিজ্ঞাসা করে, আমার কোনো চিঠি আছে? আমার ওয়াইফ জেন অ্যাডাম, উইলিয়ামস লেন থেকে কোনো চিঠি পাঠিয়েছেন?
ছেলেদের মুখে ফাদার সবই শোনেন। হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করেন। ডাক্তার বলেন, আপনিই পারেন, ফাদার। একমাত্র আপনিই ওকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। ওয়ার্ডে আপনার ঢোকবার কোনো বাধা নেই।
ফাদার এমন কাজে অভ্যস্ত। জীবন-মৃত্যুর সীমারেখায় দাঁড়িয়ে মৃত্যুভীত জীবনকে কল্যাণের স্পর্শ দেবার সাধনা তিনি অনেকদিন থেকেই করছেন। কিন্তু তিনিও পারেননি। অতি সাবধানে, জেনের মৃত্যুসংবাদ দেওয়া সত্ত্বেও, রবি বেড থেকে আছড়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। গায়ের ঘাগুলো মেঝের ঘষটানিতে সঙ্গে সঙ্গে যেন দগদগে হয়ে উঠেছিল।
সেই রাত্রেই আবার জ্বর বেড়েছিল। রবি দুধের গেলাস ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিছুই খেতে রাজি হয়নি সে। ডাক্তাররা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। কিন্তু সফল হয়নি।
রাত্রের অন্ধকারে উইলিয়ামস লেনের ছেলেরা আবার লোয়েলিন কোম্পানিতে খবর দিতে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে লোয়েলিন কোম্পানির কজে সোজা সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রে চলে গিয়েছিল। ছেলেদের পয়সা ছিল না। মেমবউদিকে ওরা বড়ো একটা মালা কিনে দিয়েছিল। ধার করে বৈঠকখানা বাজার থেকে একটা কমদামী মালা ওরা সায়েবদাদার গাড়িতে দিয়েছিল।
তারপর আর আমি খবর রাখি না। ফাদার তার কিছুদিন পরেই হোমে ফিরে গিয়েছিলেন। যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই নবজাত শিশুকে।
হবস এবার চুপ করলেন। আমি চোখের জলকে সংবরণ করতে পারিনি। লোকাল বয়েজদের দলে মিশে গিয়ে কখন যে কাঁদতে আরম্ভ করেছি বুঝিনি। ডাক্তার সাদারল্যান্ড কিন্তু কঁদলেন না। বিচলিত হওয়ার কোনো লক্ষণই ওঁর মধ্যে দেখতে পেলাম না। ডাক্তার মানুষদের বোধহয় ওই রকমই হয়। মৃত্যুর সঙ্গে ঘর করে ওঁরা মৃত্যুকে আশ্চর্য বলে মনে করেন না।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তার সাদারল্যান্ড নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার হবস। তারপর থতমত খেয়ে আর একবার বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ইনডিড স্যর।
বাইরে বেরিয়ে সাদারল্যান্ড কোনো কথা বললেন না। কথা বলার মতো অবস্থা আমারও ছিল না। আপিস পাড়ায় ছুটি হয়ে গিয়েছে। ট্রাম বাস বোঝাই। রাস্তায় ঘরমুখো লোকদের শোভাযাত্রা।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড ঘড়ির দিকে তাকালেন। বললেন, আই হোপ, তোমার কোনো কাজ নেই।
ডাক্তারের বলার ভঙ্গিতে সামান্য দুঃখিত হয়েছিলাম। যেন ওঁর সঙ্গে ঘোরাটাও আমার চাকরির অংশ।
বললাম, এখনই আমার কাউন্টার ডিউটি আরম্ভ হবে। মিস্টার স্যাটা বোস অনেকক্ষণ কাজ করছেন।
সে-কথায় ডাক্তার সাদারল্যান্ড কোনো কান দিলেন না। শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি উইলিয়ামস লেন চেনো?
বললাম, চিনি।
লোয়ার সার্কুলার রোড কবরখানা?
চিনি।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড আমাকে নিয়েই হোটেলে ঢুকলেন। কিন্তু গেটের কাছে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে, কাউন্টারের কাছে সত্যসুন্দরদাকে পাকড়াও করলেন। সত্যসুন্দরদাকে তিনি কী যেন বললেন।
আমি কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ডাক্তার সাদারল্যান্ড আবার মোড় ফিরলেন। সত্যসুন্দরদা আমার দিকে পেন্সিলসমেত হাতটা তুলে ইঙ্গিতে বললেন, ওঁর সঙ্গে চলে যাও, তোমার ডিউটি আমি ম্যানেজ করে নেব।
ডাক্তার সাদারল্যান্ডকে আমি বুঝে উঠতে পারছি না। আমাকে সঙ্গে নিয়েছেন, অথচ সে-কথা তিনি যেন ভুলেই গিয়েছেন। যেন ট্যুরিস্ট আপিস থেকে যোলো টাকা দিয়ে তিনি এক প্রফেশন্যাল গাইড ভাড়া করেছেন। ডাক্তার সাদারল্যান্ড যেন নেশার ঘোরে নিজের মধ্যেই বিভোর হয়ে আছেন। রহস্যময় প্রাচ্যের রহস্য যেন ওঁর সমস্ত চেতনা অবশ করে দিয়েছে।
উইলিয়ামস লেনের সামনে ট্যাক্সি থেকে আমরা দুজনে নেমে পড়েছিলাম। বউবাজার স্ট্রিট থেকে ঢুকতে গলির মুখে কয়েকটা কাচ্চাবাচ্চা খেলছিল। সাদারল্যান্ড আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা?
বললাম, লোকাল বয়েজ।
বহু বর্ষ আগের সেই লোকাল বয়েজ যারা লোয়েলিন কোম্পানিতে খবর দিয়ে এসেছিল, তাদের যেন আজও উইলিয়ামস লেনে দেখতে পেলাম। তাদের যেন বয়েস বাড়েনি। আজও যেন গলির মোড়ে তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু কোথায় গেল সেই পুরনো দিনের চিহ্ন? এই লেনের কোন বাড়িটাতে যে সেদিন জীবনের বিচিত্র নাটক অভিনীত হয়েছিল, তাও বুঝতে পারলাম না। ডাক্তার সাদারল্যান্ড বললেন, হয়তো সে বাড়িটা উইলিয়ামস লেনের বুক থেকে কবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে; সেই পুরনো জায়গায় আবার নতুন বাড়ি উঠেছে।
উইলিয়ামস লেনের পথচারীদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল তারা জানে না। বহু বর্ষ আগে চোখের জল এক দুঃখদিনের রাজা যে তাদের অভিনন্দন জানিয়েছিল, তা তাদের মনেও নেই।
রাস্তার উপর একটা ভিখিরির ছেলে হাইড্রান্ট থেকে একটা ভাঙা টিনের কৌটোয় জল নিচ্ছিল। হঠাৎ পা পিছলে সে পড়ে গিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর যে এমন হবে বুঝিনি। ডাক্তার সাদারল্যান্ড ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন। তুলেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি; আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
কী করছেন? কী করছেন? আপনার জামাকাপড় সব কাদায় বোঝাই হয়ে যাবে। তাছাড়া ওর পায়ে ঘা রয়েছে।-ভিখিরির ছেলেকে সায়েবকে কোলে তুলে নিতে দেখে, কয়েকজন ভদ্রলোক ছুটে এলেন।
ডাক্তার সাদারল্যান্ডের সেদিকে খেয়াল নেই। ছেলেটার নাক দিয়ে সর্দি ঝরছিল। নিজের রুমাল বার করে মুছে দিলেন। আদর করতে করতে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললেন, তুমরা মা কীধার? তুমকো ড্যাডি-পিতাজি?
আঙুল দিয়ে ছেলেটা শিয়ালদা স্টেশনের দিকটা দেখিয়ে দিল। তারপর ভয় পেয়ে, বাচ্চাটা হঠাৎ জোর করে কোল থেকে নেমে ছুটে পালিয়ে গেল। ভেবেছে, কেউ বোধহয় ওকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে উইলিয়ামস লেন-এর মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, ডাক্তার সাদারল্যান্ড ছেলেটার সর্দিমোছা রুমালের একটা অংশ দিয়ে নিজের চোখ দুটো মুছছেন।
উইলিয়ামস লেন থেকে আমরা সোজা লোয়ার সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রে চলে এসেছি। তখন অন্ধকার একটু বল পেয়েছে—একেবারে টেম্পোরারি পোস্ট থেকে যেন কোয়াসি-পার্মানেন্ট হয়েছে।
সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার মুখে কয়েকজন মালি ফুল বিক্রি করছিল। মালিরা আমাদের দিকে এগিয়ে এল-সায়েব, ফুল।
আমার কাছে টাকা ছিল না, কিন্তু সায়েব ফুল কিনলেন।
রাত্রের অন্ধকারে ফুল হাতে করে মৃতমানুষদের সেই নিস্তব্ধ শহরে আমরা ঢুকে পড়াম। কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। এখানে বিছে বা সাপ থাকাও আশ্চর্য নয়। সাদারল্যান্ডের পকেটে টর্চ ছিল—কিন্তু সামান্য টর্চে আর কতটুকু আলো হবে? মনে হল যেন মধ্যরাত্রে কোনো ভদ্র-হোটেলে ঢুকে পড়েছি আমরা। রাতের সব অতিথি কর্মমুখর দিনের শেষে ক্লান্ত দেহে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে রয়েছেন। আইন মেনে আমরা দুজনে যেন গোপনে বাইরে পালিয়েছিলাম। এখন দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে পা টিপে টিপে দুরু দুরু বক্ষে নিজের ঘরে ফিরে আসছি।
বহুজনের এই বিচিত্র মেলা থেকে আজ আর শাজাহান হোটেলের সেই বার-বালিকাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কে জানে, এই বিশাল প্রান্তরের কোন অংশে একদিন উইলিয়ামস লেনের ছেলেরা চিরদিনের জন্যে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গিয়েছিল। তাদের কেউই হয়তো আজ নেই। তবু শাজাহান হোটেল আজও তার অনন্ত যৌবন নিয়ে বেঁচে রয়েছে। মোহিনী মায়ায় ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ও কামার্ত মানুষদের আজও নিজের কাছে আহ্বান করছে।
সামনে একটা গাছ ছিল। সেই গাছের তলায় ফুলগুলো নামিয়ে দিয়ে, ডাক্তার সাদারল্যান্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। আর আমার মনে হল, হবস যেন আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন—আমাদের কানের কাছে আপনমনে আবৃত্তি করছেন—
Gone away are the Kidderpore girls,
With their powdered faces & ticked up curls,
Gone uway are those sirens dark,
Fertile kisses, but barren of heart–
Bowing alternatively cold and hot–
Steadfastly sticking to all they got–
Filing a bevy of sailors boys
With maddening hopes of synthetic joys.
সুযোগ পেলে ডাক্তার সাদারল্যান্ড বোধহয় সারারাত ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু আমার তো হোটেলে ফেরা দরকার। আমাকে না পেয়ে মার্কোপোলো এতক্ষণ হয়তো চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন।
বললাম, ডাক্তার সাদারল্যান্ড, এবার বোধহয় আমরা ফিরতে পারি।
উত্তরে তিনি যে আমার সঙ্গে অমন অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করবেন তা প্রত্যাশা করিনি। দাঁতে দাঁতে চেপে তিনি বললেন, ফর হেভেনস্ সেক, আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
আমার চোখে তখন জল এসে গিয়েছিল। তোমার খামখেয়ালির জন্যে শেষে আমার এতকষ্টে জোগাড়-করা চাকরিটা যাক। অথচ প্রতিবাদও করতে সাহস হয়নি। হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারকে লাগিয়ে দিলেই হল—বা চিঠিতে কমপ্লেন করলেই, আমাকে আবার পথে বসতে হবে। খদ্দের সব সময়ই ঠিক, যদি কোনো দোষ হয়ে থাকে সে তোমার, একথা সত্যসুন্দরদা আমাকে অনেকবার মনে রাখতে বলে দিয়েছেন।
ফেরবার সময় ট্যাক্সিতে আমি একটা কথাও বলিনি। ডাক্তার সাদারল্যান্ডও কথা বলবার চেষ্টা করেননি। গাড়ি থেকে নেমে, তার ধন্যবাদের জন্য অপেক্ষা না করেই আমি কাউন্টারে বোসদার কাছে চলে গিয়েছি।
পরের দিন ভোরেই ডাক্তার সাদারল্যান্ড কলকাতা ছেড়ে লন্ডনের পথের রওনা হয়ে গিয়েছিল। যাবার আগে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি।
তারপর আর কোনোদিন ডাক্তার সাদারল্যান্ডের দেখা পাইনি। কিন্তু এইখানেই সব শেষ হলে কোনোদিন হয়তো তার দুর্ব্যবহারের জন্য তাকে ক্ষমা করতে পারতাম না। কয়েকদিন পরেই তাঁর কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলাম—
প্রিয় শংকর,
তোমাকে চিঠি না লেখা পর্যন্ত মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না। শাজাহান হোটেল থেকে চলে আসবার আগে তোমার সঙ্গে আমি যে ব্যবহার করেছিলাম, তা ভাবতে আজ আমার অনুতাপের শেষ নেই। তাছাড়া তোমার এবং মিস্টার হবসের কাছে সত্যকে গোপন রেখেও আমি ভগবানের চরণে অপরাধ করেছি। ভেবেছিলাম, পরের বার তোমাদের কাছে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করব। কিন্তু ভারতবর্ষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে—এবার WHO-র কাজে যেখানে চললাম, তার নাম তাহিতি দ্বীপপুঞ্জ। জীবনের বাকি কটা দিন ওখানেই কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আছে।
সেদিন তোমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিলাম, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কলকাতার অনেক দুর্নাম আমি কাগজে পড়েছি, কানে শুনেছি। কিন্তু আমি তো তোমাদের জানি। সেদিনই আমার বলা উচিত ছিল, কিন্তু পারিনি। শোনো, আমার জন্ম উইলিয়ামস লেন-এ। আমার বাবার নাম রবার্ট অ্যাডাম; মা জেন গ্রে। উইলিয়ামস লেনের লোকাল বয়েজদের দয়ায় যার প্রাণরক্ষা হয়েছিল, ফাদার সাদারল্যান্ড তাকেই বুকে করে বিলেতে ফিরে গিয়েছিলেন, আমাকে তার নামেরও অধিকার দিয়েছিলেন। এ-খবর আমার ছোটবেলায় অজ্ঞাত ছিল, কিন্তু মৃত্যুর আগে ফাদার সাদারল্যান্ড নিজেই আমাকে জানিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার শেষ রাত্রি আমি তাই শাজাহান হোটেলে কাটিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাদের দয়ায় তা সম্ভব হয়েছে।
তোমাদের বার-এ আজ বারমেড নেই, ভাবতে সত্যি আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি। মনে মনে ইউনিয়ন চ্যাপেলের ফাদার ব্রকওয়ের স্ত্রীকে প্রণাম জানিয়েছি। জীবনজোড়া যন্ত্রণা থেকে তিনি অনেক বারমেডকে মুক্তি দিয়েছেন। আজ তিনি বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে, তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসতাম। কিছু না পেরে, তার সুযোগ্য সন্তান মিস্টার ফ্রেনার ব্রকওয়েকে একটা চিঠি লিখলাম। অনেক অজ্ঞাত নারীর আশীর্বাদ তার মাথায় ঝরে পড়ছে।
সেদিন কেন যে আমার মাথার ঠিক ছিল না, তা হয়তো তুমি বুঝতে পারছ। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। ইতি–
জে. পি. সাদারল্যান্ড