এত সুন্দর দোতলা বাড়ি তার চাচার, যেন আনুর বিশ্বাসই হতে চায় না। আর কী চওড়া তকতকে সিঁড়ি। সারাদিন দৌড়ে দৌড়ে উঠেও ক্লান্তি হয় না আনুর। চাচাতো ভাই মনির তার বয়সী, তার সঙ্গে ভাব হয়ে যায় এক মিনিটে। মনিরের সঙ্গে ছাদে উঠে সে ঘুরে ঘুরে শহর দেখে।
বাবার সঙ্গে আনু বেড়াতে এসেছে তার চাচার বাড়িতে, সিরাজগঞ্জে। তার আপন চাচা নয়, বাবার চাচাতো ভাই। বাবা নাকি ছোটবেলায় মানুষ হয়েছে এই চাচার মায়ের কাছে।
এসব কিছুই জানতো না আনু। মহিমপুর থেকে রওয়ানা দেবার কদিন আগে শুনেছে। কদিন থেকেই মা বাবাকে বারবার বলছিলেন এখানে আসতে। বলছিলেন, যাও না একবার ছোট মিয়ার কাছে। হাজার হোক নিজের মানুষ, তার কাছে শরম কিসের?
বাবা প্রতিবাদ করেন, শরমের কথা না। সে বড়লোক মানুষ, আমি কোনদিনই তার সাথে বেশি ওঠ–বোস রাখিনি। পছন্দই করিনি এসব। আজ কোন মুখে যাই! আর গেলেই বা কি ভাববে বলো?
সন্ধ্যায় বাতি জেলে আনু পড়ছিল। বারান্দায় বসে গলা নিচু করে আলাপ করছিলেন বাবা আর মা। বাবা নামাজ পড়ে জলচৌকি থেকে আর ওঠেননি। মা থাম ধরে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আনু উৎকর্ণ হয়ে ওঠে তাঁদের চাপা গলায় আলোচনা শুনে।
ভাবাভাবি আর কি? মেয়েগুলো কত বড় হলো একেকজন? তুমি তো বাসায় থাকো না, থাকি আমি। জ্বালা হয়েছে আমার।
মার গলা বুঝি ধরে এসেছিল। বাবা বিব্রত হয়ে বললেন, আহা, সে তো বুঝলাম।
অনেকক্ষণ পরে মা বলেন, আনুকে নিয়ে তুমি একবার সিরাজগঞ্জে যাও। ভিক্ষে তো আর আমরা চাই না। আস্তে আস্তে শোধ করে দেব, বলবে।
আচ্ছা, দেখি।
বাবার দীর্ঘনিঃশ্বাস শোনা যায়। অস্পষ্ট একটা গুঞ্জন ধ্বনি ওঠে। আনু বুঝতে পারে বাবা দরুদ পড়তে শুরু করেছেন।
পড়ায় আর মন বসে না আনুর। জোর করে সে তাকিয়ে থাকে বইয়ের পাতার দিকে। অক্ষরগুলো যেন তার চোখ পোড়াতে থাকে। চোখে পানি এসে যায় তার। সে সচকিত হয়ে এদিক–ওদিক তাকায়।
ছোট দারোগার বউয়ের কথা মনে পড়ে যায় তার। সেদিন বেড়াতে এসেছিলেন। তেমনি সারা গা গয়নায় মোড়া, মুখে পাউডার, ঠোঁটে পানের পাতলা লাল রং, পায়ে হিলতোলা সোনালি স্যাণ্ডেল। আনু উঠোনে গাঁদা ফুলের গাছগুলো বাঁশের চিকন বাতা দিয়ে ঘিরে দিচ্ছিল তখন।
বারান্দায় বসে বসে মা–র সঙ্গে গাল ঠেসে ঠেসে পান খেলেন ছোট দারোগার বউ। বললেন. বুবু, একটা কথা কই। মেয়েদের বিয়ে দেন নাই যে, শেষে মুখে না কালি দেয়। শুনে অপ্রতিভ হয়ে যান মা। আমতা আমতা করেন। কিছুই বলতে পারেন না। ছোট দারোগার বউ পিচ্ করে পানের পিক ফেলে আনুকে একবার আড়চোখে দেখে গলা নামিয়ে বলেন, কিশোরগঞ্জে দেখেছি, এক ডাক্তার, তার যোয়ান মেয়ে, আপনার বড় মেয়ের মতো, বাপ মা খায়দায়, মনে করে মেয়ে আমার এখনো বাচ্চা। সে সর্বনাশী বাড়ির চাকরের সাথে, বুবু, ঘর ছাড়লো একদিন, আমার চক্ষের সামনে।
আনু তখন ভারী অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। কী একটা ছুতো খুঁজে সে বেরিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, এ কথা শোনা তার ঠিক হচ্ছে না। ভীষণ রাগ হয় ছোট দারোগার বউয়ের ওপর। তার এত মাথাব্যথা কেন? সে বুঝতেই পারে না বড় আপা মেজ আপা এদের বিয়ে দেবার জন্যে সবাই এত ভাবনা করে কেন? এমন কি তার বাবা–মাও বাদ যান না। তবু তাদের কথা শুনে খারাপ লাগে না আনুর, যতটা খারাপ লাগলো ছোট দারোগার বউয়ের কথা শুনে। আর পিন্টুর কথাও মনে পড়ে।
মনটা কালো হয়ে যায় আনুর। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতের বেতটা দিয়ে ঝোঁপঝাড়গুলো পেটাতে থাকে। কচি কচি বুনো গাছগুলো ভেঙে গিয়ে ঝাপালো একটা গন্ধ উঠতে থাকে। গন্ধটা ভারী ভালো লাগে আনুর। সে আরো পেটাতে থাকে। নেশার মতো তাকে পেয়ে বসে গন্ধটা।
ইয়াসিন কোথা থেকে এসে বলে, খোকাবাবু, হুঁশিয়ার থাকবেন, ই সব জঙ্গলে সাপ ভি থাকতে পারে।
আরে বাপ।
সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় আনুর খ্যাপা হাতটা। মুখে বলে, যাঃ।
কিন্তু চোখ তার সন্ধানী আলোর মতো দ্রুত ঘুরতে থাকে, কী জানি সত্যি সত্যি যদি সাপ টাপ বেরিয়ে পড়ে।
একটু পরেই আনু দেখতে পায় ছোট দারোগার বউ বেরিয়ে গেলেন তাদের বাসা থেকে। তার মুখটা গম্ভীর, আঁধার। অবাক হয়ে যায় আনু। একটু আগেই তো কী ডগমগে দেখাচ্ছিল বউটার মুখ।
ইয়াসিন বলে, কি খোকাবাবু। কুস্তি শিখবেন নাই?
ভুলেই গিয়েছিল আনু। সোৎসাহে সে বলে ওঠে, হ্যাঁ, শিখবো। কালকে। কাল তুমি ভোরে আমাকে ডেকে নিয়ে যেও ইয়াসিন।
রাতে রান্নার ছিল দেরি। আপাদের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিল আনু। ঘুম নয়, জাগরণ আর তন্দ্রা মেশানো একটা কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়েছিল আনু। এমন সময় ভারী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। আর নরোম একটা স্পর্শে সে আবিষ্ট হয়ে যায়। চোখ খুলে দেখে, বড় আপা তার পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়েছেন। তার পায়ের কাছে সেজ আপা বালিশে ওয়াড় পরাচ্ছেন। চোখ বুজে পড়ে থাকে আনু। তার এত ভালো লাগে, মনে হয় শূন্যে মেঘের ভেতরে ভেসে আছে সে। ভেসে ভেসে কোথায় কোন্ অজানা দেশে চলে যাচ্ছে। তার কান্না পায়। বড় আপা, মেজ আপা কত ভালো। কিন্তু সবাই মুখ আধার করে থাকে, ফিসফিস করে কথা বলে। আনু ছাড়া কেউ ভালোবাসে না তাদের। আনু সারাজীবন এভাবে শুয়ে থাকতে পারে। কোথাও যাবে সে, কিচ্ছু করবে না।
মেজ আপা তার পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বলেন, ভাত খাবি না?
উঁ। না। খাবো না।
মেজ আপা তখন তাকে আদর করতে থাকেন খুব।
ওঠ না মনি, তোকে আজ একটা সুন্দর গল্প বলবো। ওঠ। ভাত খেতে খেতে বলব।
আদরটা এত মিষ্টি লাগছিল! আনু ইচ্ছে করেই জেদ করে, অনেকক্ষণ ধরে করে। বড় আপা তাকে কাধ ধরে উঠিয়ে দেন। বলেন, বাব্বাঃ, কি ভার হয়েছিস তুই আনু। আমি তুলতেই পারি না।
সে রাতে মেজ আপা ভাত মেখে দিল, ডিমের মতো মুঠো পাকিয়ে দিল, মুখে তুলে দিল, তবে খেল আনু।
রাতে শুয়ে শুয়ে আনু ভাবে তার চাচার কথা যাকে সে কখনো দেখেনি। সন্ধ্যের সময় বাবা আর মা–র কথাগুলো, মা তাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে বলছিলেন, সেই সব ঘুরে ঘুরে ধূসর প্রজাপতির মতো মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। ও পাশের চৌকিতে বাবা শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। বাবার জন্যে ভারী মায়া করে আনুর। বালিশে মুখ গুঁজে সে পড়ে থাকে।
অন্যদিন হলে কোথাও যাবার নাম শুনে লাফিয়ে উঠতো আনু। আজ তার কী হয়েছে, বুকের মধ্যে কেমন টিপটিপ করছে, এখান থেকে, এ বাসা থেকে, কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। তার। বড় আপার ফর্সা চেহারাটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মাথায় একটি ছোট্ট টিপ। চিবুকের কাছে একটুখানি ভাজ। আনু আয়নায় দেখেছে তার চিবুকেও ওরকম ভাজ আছে। তার মায়েরও আছে। বড় আপা যখন হাসেন ভাজটা ছড়িয়ে যায়, কী সুন্দর লাগে! ইয়াসিনের কাছে কাল থেকে সে কুস্তি শিখবে। পিন্টু যদি তাকে মারতে আসে, এবার এমন একটা ঘুসি দেবে তাকে যে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে শয়তানটা।
বাবার যদি অনেক টাকা থাকতো, তাহলে ভাবনা ছিল না। আনু স্পষ্ট বুঝতে পারে, তার বাবার টাকা নেই, মা তাই চাচার কাছে যেতে বলছেন। চাচার কাছ থেকে টাকা আনবে বাবা? চাচা বোধহয় খুব রাগী। নইলে বাবা যেতে চাইলেন না কেন? মা অনেক করে বলতে তবে রাজি হলেন তিনি। আনু যেন বাবার সঙ্গে মিশে যায়। আনু বুঝতে পারে, বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবার যেতে ইচ্ছে করছে না। আনু যদি একলাফে বড় হয়ে যেতে পারতো, তো অনেক টাকা রোজগার করে ফেলত সে। পানু ভাই একটা চাকরি পেলেও হতো। তাহলে আর কোনো ভাবনা থাকত না। আনু বারবার পাশ বদলাতে থাকে বিছানায়, কুণ্ডলি পাকিয়ে শোয়, আবার পরক্ষণেই সোজা হয়।
বাবা ডাকেন, আনু, ও আনু।
তখন ঘোরটা কেটে যায় আনুর। বাবা পাশে এসে দাঁড়ান। মা ও ঘর থেকে বলেন, কি হলো?
কিছু না, ছেলেটা কেমন কাতরাচ্ছে।
কপালে হাত দিয়ে দেখেন বাবা। না, জ্বর আসে নি। বাবা আবার ডাকেন, আনু, আনু রে।
আনু ঘুমজড়িত গলায় বলে, কী?
ও রকম করছিস কেন?
চুপ করে থাকে আনু।
আয় আমার সঙ্গে শুবি।
আনুকে প্রায় কোলে করে বাবা তার নিজের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেন। বলেন, খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? ভয় কিরে, এই তো আমি এ ঘরেই আছি।
একটু একটু হাসেন বাবা। আনুর তখন ভীষণ ঘুম পায়। বাবার হাতটা ধরে সে কখন ঘুমিয়ে পড়ে। একেবারে সেই ভোরবেলায় ঘুম ভাঙে তার। সালু আপা বলে, আনু, আজ তোকে নিয়ে বাবা সিরাজগঞ্জে যাবে, চাচার কাছে।
আজ?
আনুর যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। বিছানা ছেড়ে ওঠে না। সালু আপা তার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলে, আমি মিথ্যে বলছি? যা মাকে জিগ্যেস কর। আমার বয়েই গেছে। গটগট করে বেরিয়ে যায় সালু আপা। তখন যেন বিশ্বাস হয় আনুর।
সেই আসা। আসবার উত্তেজনায় আনু ভুলেই গিয়েছিল বাবা কেন চাচার ওখানে যাচ্ছেন, কেন যেতে চাননি, তার যেতে ইচ্ছে করেনি।
সিরাজগঞ্জ বাজারে এসে ট্রেন থামলো। নামলো ওরা। মা এক বোয়াম মোরব্বা বানিয়ে দিয়েছিলেন চাচাঁদের জন্যে, আনুর হাতে সেটা। বাবা বললেন, সাবধানে আনু। বাড়ির কাছে এসে দেখিস ভাঙে না যেন।
আত্মীয়স্বজন বলতে কাউকে চেনে না আনু। বাবা কোনদিন কারো কথা বলেন না। এক মামা আছেন, তাও মা–র সৎ–ভাই। আনু শুনেছে, সৎ–ভাই নাকি খুব শয়তান আর হিংসুটে হয়। তাই তার বড় একটা টান নেই মামার ওপর। মিনু আপাকে সেদিন মামা নিয়ে গেল। ঘরে এসে মিনু আপা চোখ বড় বড় করে কত গল্প করল মামা বাড়ির, আশ্চর্য সব গল্প—- আনুর বিশ্বাস হতে চায় না।
এ চাচাও যে এতদিন কোথায় ছিলেন কে জানে। এই সেদিনই আনু প্রথম শুনলো, ওর এক চাচা আছেন, বাবার চাচাত ভাই; বাবার কোনো আপন ভাই নেই। একজন ছিল, বসন্তে মারা গেছে সেই ছোটবেলায। বাবা তাকে নিয়ে যখন ছোটবেলায় স্কুলে যেতেন, বাবা একবার গল্প করেছিলেন, পথে একটা খাল পড়ত, সেই খালটা ভাইকে কাঁধে করে পার হতেন। বাবা বলতেন, আমি দুঃখ কষ্ট করে একাই মানুষ হয়েছি। কেউ তো আর আমাকে দেখেনি। এখন আমার কি দরকার সেধে সেধে তাদের সাথে আত্মীয়তা করবার?
চাচার কাছেও আসতে চাননি বাবা। মা বারবার করে বলাতে এসেছেন। তাদের রিকশাটা দুপাশে লাইব্রেরী, স্টেশনারী, ওষুধের দোকান, ছাপাখানা, চায়ের স্টল পেরিয়ে চলেছে। সকাল বেলা বড় বড় মাছ উঠেছে বাজারে। বাজারের কাছে এসে রিকশা থামাতে বলল বাবা। আনুকে বললেন, বোস আমি আসছি।
পাঁচ মিনিট পরে বাবা একটা প্রকাণ্ড রুই মাছ নিয়ে ফিরলেন। দড়ি দিয়ে তার কানকোর ভেতরে ফোড় করে বাঁধা। কানকো দেখাচ্ছে লাল টকটকে। আনু অবাক হয়ে যায়। বাবা বলেন, কারো বাড়িতে খালি হাতে যেতে নেই মাছটা বেশ বড় না?
হ্যাঁ।
রিকশা আবার চলতে লাগল। বাবাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। আনু চুপ করে দুধারের অচেনা বাড়িঘর দেখতে থাকে। একটা উঁচু ব্রীজের নিচে এসে পৌঁছলো ওরা। ব্রীজটার ওপরে রিকশা টেনে টেনে পার করতে হবে। বাবা নেমে গেলেন। আনু রইলো রিকশায়। বাবা পাশে পাশে হেঁটে এলেন। তারপর ও–মাথায় গিয়ে আবার রিকশায় ওঠে বসলেন তিনি। এ ব্রীজটার নাম এলিয়ট ব্রীজ। এইটুকু হেঁটেই যেন হাঁফিয়ে গেছেন বাবা। মুখ ঘামে ভিজে গেছে। চকচক করছে তার সুন্দর করে ছাঁটা দাড়ি। বাবা দুহাতে মুখ মুছলেন অনেকক্ষণ ধরে।
বাসায় এসে চাচাকে পাওয়া গেল না। চাচা ঢাকায় গেছেন কাজে, কাল ফিরবেন। চাচি বিরাট ঘোমটা টেনে বাবার সামনে এসে সালাম করতে গেলেন, বাবা বললেন, থাক, থাক। মনির এক লাফে কোথা থেকে এসে মোরব্বার বোয়ামটা কেড়ে নিয়ে গেল আনুর হাত থেকে। বাবা হেসে বললেন, ও তোর ভাই। মনির।
সিঁড়ির পাশে ছোট্ট ঘরটায় থাকবার ব্যবস্থা হলো তাদের। আনুর ভারী ইচ্ছে করছিল, দোতলায় যদি থাকতে পারতো। দোতলায় কোনোদিন থাকেনি সে। না জানি, কেমন ভালো লাগে দোতলায় ঘুমোতে। মনির থাকে দোতলায়।
ভারী ভাব হয়ে গেল মনিরের সঙ্গে। আনু তার সব বই উলটে পালটে দেখল, সেও তার মতো ফোরে পড়ে। তার খেলার বন্দুকটা নিয়ে শিখে নিল কেমন করে ছুঁড়তে হয়। বলল, আমার বাবার সত্যিকার রাইফেল আছে, পিস্তল আছে। আমাকে গুলি মারতে শেখাবে বলেছে।
তারপর মনিরের সঙ্গে বেরিয়ে গেল টাউন দেখতে। এলিয়ট ব্রীজের ওপর হেঁটে হেঁটে পার হতে ভারী মজা লাগল আনুর। আহা, এরকম একটা ব্রীজ মহিমপুরে যদি থাকতো!
বিকেলে ফুটবল খেলতে নিয়ে গেল মনির। সেনবাবুদের মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলে। চরদীঘির রাজা নাকি সেনবাবু। এখন কলকাতায় চলে গেছে। বিরাট বাড়িটা, মাঠটা, পুকুরটা পড়ে আছে। কেমন ফাঁকা ফাঁকা, ভুতুড়ে বাড়ির মতো। ছেলেরা তাকে দেখে ঘিরে দাঁড়াল। সে তো নতুন, তার কেমন লজ্জা করতে লাগল তখন। ফুটবলের মাঠে একটা বলও সে কিক করতে পারল না। বল তার সামনে দিয়ে চলে যায়, ভাবে ওরাই কেউ কিক করুক, আনুর সংকোচ আর কাটে না। মনির দমাদম দুটো গোল করে। তারপর খেলা শেষে সবাই একসঙ্গে চিৎ হয়ে শুয়ে গল্প করতে থাকে। আনু পাশে বসে ঘাস ছেড়ে একটা একটা করে। ওদের একটা কথাও সে বুঝতে পারে না। কাকে যেন জব্দ করবে সেই বুদ্ধি আঁটছে ওরা। কাল স্কুলে গেলে যে ছেলেটা জব্দ হবে তার কথা ভেবে আনুর বড় মায়া করে। রাতে বাবার পাশে শুয়ে আর ঘুম আসে না। অচেনা সব শব্দ উঠতে থাকে দূর দূরান্তর থেকে, অন্ধকারে ভেতর শেয়াল ডাকে, ঝি ঝি পা ঘষে ঘষে কান অবশ করে ফেলে, কোথায় কে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়, সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দ নামে, ওঠে, আবার নামে; মা–বড় আপা–মেজ আপা–সালু আ৮ ছোট আপা–মিনু আপা কি করছে এখন? এখন ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে না, গল্প করছে। আনুর কথা বলছে। আনু বেড়াতে গেছে সেই কথা বলছে। কদিন আগে বাবা একটা কলেজ পড়া ছেলেকে জায়গীর রেখেছেন সেই মাস্টার সাহেব বোধহয় ল্যাম্প জ্বেলে মোটা মোটা বই পড়ছেন। মাস্টার সাহেবের জন্যে ভাত ঢাকা দেওয়া থাকে, অনেক রাতে খান। আনুকে একটা ছবির বই এনে দিয়েছিলেন মাস্টার সাহেব। আবার একসঙ্গে অনেকগুলো শেয়াল ডেকে ওঠে। তন্দ্রার ভেতর থেকে চমকে ওঠে আনু। এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর তলিয়ে যায় ঘুমে।
চাচা ভোরবেলায় এসে পৌঁছুলেন। বাবাকে দেখে ভারী খুশি হলেন তিনি। না, আনু যেমন ভেবেছিল, খুব রাগী হবেন চাচা, তেমন একটুও না। গোলগাল মুখ, ফর্সা, ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরনে আর লাল পাম্পশু পায়ে, হাতে মস্ত বড় একটা আংটি। ট্রেন থেকে নেমে এসে আর কাপড় বদলালেন না, হাত মুখ ধুলেন না, বাবার সঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করতে লেগে। গেলেন। ডেকে বললেন, এই কি আনু? শোনো বাবা, দেখি, দেখি।
আনু এসে সামনে দাঁড়াল। বাবা বললেন, সালাম কর।
করলো সে। চাচা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ভারী সুন্দর হয়েছে। বাপের মতো বড় হওয়া চাই, বুঝলে আনু? খালি সুন্দর চেহারায় কিছু হয় না।
লাল হয়ে যায় আনু। বাবা বলেন, আমি আর কী? আমার চেয়েও বড় হোক সেই দোয়াই করি। পুলিশের চাকরি আবার চাকরি? লোকে মনে করে পয়সাই পয়সা। দারোগারা লাল হয়ে গেল। এদিকে খবর নিয়ে দেখ, আমার একদিক দেখতে আরেকদিক কানা হয়ে যায়। এইরকম আক্ষেপ করে চলেন বাবা। একা একা। চাচা চুপ করে শোনেন। পরে বলেন, কী যে বলেন মিয়াভাই। আপনাদের অভাব? এই তো সেদিন সিরাজগঞ্জে এক বাচ্চা দারোগা এলো, তার…।
তাকে শেষ করতে দিলেন না বাবা। বাধা দিয়া বললেন, সবাই কি আর একরকম? ধর্ম যদি পানিতে ফেলা যায়, তাহলে আলাদা কথা।
রাখেন আপনার ধর্ম! আপনি সেই পুরনো কালের ধ্যান নিয়ে আছেন। যুগ এখন অন্য রকম। এখন ও–সব চলে না।
প্রায় তর্ক লেগে যায় বাবা আব চাচার। ভয়ে ভয়ে সেখান থেকে সরে আসে আনু। বাবার মুখটা কেমন কঠিন হয়ে উঠেছে একমুহর্তে, চেনাই যাচ্ছে না আর। আর চাচার ফর্সা চেহারা লাল হয়ে গেছে উত্তেজনায়। আনু চুপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। নামলে রান্নাঘর দেখা যায়। দুজন কাজের মেয়ে সনার জোগাড় করছে। চাচি একটা মোড়ায় বসে পাখা হাতে তদারক করছেন। আনুকে দেখে ডাকলেন তিনি। বললেন, এই ছেলে, শোন।
কাছে এলো আনু। আনুর খুব খারাপ লাগলো তখন। তার মা আর বড় আপা রোজ নিজ হাতে রান্না করেন। গরমে, কালিতে, ধোঁয়ায় কী বিচ্ছিরি দেখায় তাদের। এরকম কাজের মেয়ে যদি থাকতো, তাহলে আর কষ্ট হতো না। চাচিকে কী সুন্দর ছিমছাম দেখাচ্ছে! মাকে বলবে।
চাচি তাকে কাছে ডেকে তার মায়ের তার বোনদের গল্প শুনতে লাগলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করলেন কত কথা। কে দেখতে কেমন, কে কত বড়, কোথা থেকে বিয়ের কথা আসছে। আনু তার অত কি জানে সে ভাল করে কিছুই বলতে পারল না। বলতে ইচ্ছে করল না। আনু খুব বিব্রত বোধ করল, লজ্জা করল তার। সে তো জানে বাবা তার আপার বিয়ে দেবেন বলে টাকা চাইতে এসেছেন চাচার কাছে।
সেরাতে অনেকক্ষণ ধরে আবার আলাপ করলেন বাবা আর চাচা। ভাত খাবার পর আনু দোতলায় মনিরের পড়ার টেবিলের পাশে বসে রইলো। মনিরকে একটা ফুলের তোড়া এঁকে দিল আনু। মনির অবাক হয়ে আঁকাটা দেখল, তারপর আরো এঁকে দেবার জন্যে বায়না ধরলো। তখন পাতা, লাটিম, কলম একে দিল আনু। সবশেষে একটা ছবি আঁকলো সে–একটা বাড়ি, পাশে নদী বয়ে যাচ্ছে, তালগাছ কাৎ হয়ে পড়েছে, আকাশে মেঘ, মেঘের মধ্যে সূর্য।
বলল, রং নেই তোর?
না।
রং থাকলে কী সুন্দর রং করে দিতাম।
না হোক। এমনিই ভালো।
মনিরের একটা মজার খেলা ছিল। চোং–এর মধ্যে ভাঙা চুড়ির অনেকগুলো টুকরো আর একটা ঘষা কাঁচ বসানো। একদিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে চোংটা ঘোরালে নতুন নতুন নকশা তৈরি হয়! এমন অদ্ভুত খেলা জীবনে দেখেনি আনু। সেইটে অবলীলাক্রমে মনির দিয়ে দিল তাকে।
ঠকঠক করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন চাচা। তাকে ভারী গম্ভীর দেখাচ্ছে। আনু ভয় পেয়ে খেলাটা মনিরকে ফিরিয়ে দিল, বলল, কাল নেবো ভাই।
তারপর নেমে এলো নিচে। এসে দেখে বাবা এশার নামাজ পড়তে বসেছেন। চোখ বোজা, ঘরে আলোটা ছোট করে রাখা। নিবিড় একটা ছায়ার মতো মনে হচ্ছে বাবাকে। নিঃশব্দে আনু গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
পরদিন সকালে ফিরে যেতে চাইলেন বাবা। চাচা বললেন আরো একদিন থেকে যেতে। আরো একদিন থেকে গেল ওরা। তারপর দুপুর এগারোটার গাড়িতে উঠল।
গাড়িতে উঠে আনু জিগ্যেস করল, টাকা দেয়নি বাবা?
বাবা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন। তুই শুনলি কোত্থেকে?
আনু চোখ নামিয়ে নিল। থতমত খেয়ে গেল সে। তার জিগ্যেস করাই উচিত হয়নি। বাবা টের পেয়ে গেলেন, সেদিন সন্ধ্যেয় মার সঙ্গে বাবার কথাগুলো সব সে শুনেছে।
বাবা কিছু বললেন না আর। তার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি। আনুর মনে। হলো, সে মাটিতে মিশে যায়। বাবাকে ক্লান্ত, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। আনুর কেন যেন মনে হলো, টাকা দেয় নি চাচা। কিন্তু বাবার মুখের দিকে আর তাকাতে সাহস পেল না সে। ট্রেন ছুটে চলেছে চাকায় চাকায় ছড়া কাটতে কাটতে। আনু সেইটে কান পেতে শুনতে লাগল—- ঢাকা যাবো, টাকা পাবো—-ঢাকা যাবো, টাকা পাবো—-ঢাকা যাবো, টাকা পাবো।