০৪. এতক্ষণ এ গল্প শুনছিলাম

এতক্ষণ এ গল্প শুনছিলাম তারানাথের মুখে।

মট লেনে তারানাথের বাড়িতে আমাদের চিরাচরিত আড্ডা বসেছে। আজ ছিল জন্মাষ্টমীর ছুটি। দুপুরের পরেই কিশোরী সেন আর আমি গল্পের লোভে হানা দিয়েছি তারানাথের বৈঠকখানায়। চারির বিয়ে হয়ে যাবার পর তারানাথ বোধহয় মনের দিক দিয়ে একটু অসহায় হয়ে পড়েছে। মেয়েরা বাপের যতখানি সেবা করে, ছেলেরা ততটা পারে না। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার পর তারানাথের মুখচোখে একটা ভরসা-হারা ভাব ফুটে ওঠে মাঝে মাঝে। আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা করি না।

কী হবে প্রৌঢ় মানুষের মনে বিষণ্ণতার বোঝা বাড়িয়ে?

আজ তারানাথের বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়তে দরজা খুলে দিল চারি। অবাক হয়ে বললাম—একি রে! কবে এসেছিস তুই? গত হপ্তাতেও তো আমরা এসে গল্প করে। গিয়েছি, তোর বাবা তো বলেন নি তুই আসবি!

হাসিমুখে চারি বলল—না কাকাবাবু, আসার কথা ছিল না, গতকাল হঠাৎ এসে পড়েছি। ব্যবসার কাজে আপনাদের জামাইকে কলকাতা আসতে হ’ল, আমি ধরে পড়লাম—আমিও যাব। তাই

বললাম—জামাই তোর কথা সব খুব মান্য করে, তাই না?

চারি সলজ্জ হেসে মুখ নিচু করল। সে চিরকালই সপ্রতিভ, কিন্তু প্রগভা নয়। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছি, কন্যার মত স্নেহ জন্মে গিয়েছে তার ওপর। আগে আগে তার জন্য লেসের ডিজাইন, ছবিওয়ালা গল্পের বই ইত্যাদি নিয়ে আসতে হত। গতবছর। ভাল ঘরে-বরে বিয়ে হয়েছে চারির। স্বামী মাঝারি ধরনের ব্যবসা করে, বিশাল ধনী নয়, কিন্তু সচ্ছল অবস্থা। ছেলেটিও ভাল, বিনয়ী এবং সচ্চরিত্র। এত ভাল পাত্রে মেয়ের বিয়ে দেবার ক্ষমতা তারানাথের ছিল না, কিন্তু চারি সুন্দরী বলে দেনাপাওনা কোনও বাধা হয়নি।

চারি বলল—আপনারা ভাল আছেন তো কাকাবাবু? আসুন, ভেতরে এসে বসুন।

একটু পরেই তারানাথ বাড়ির ভেতর থেকে বৈঠকখানায় এসে বসল। তার মুখ আজ উজ্জ্বল, গত একবছরের ম্রিয়মাণ ভাবটা কেটে গিয়েছে। সে বলল-এসো হে দুই মূর্তি, আজ ছুটির দিন, আমি জানতাম তোমরা আসবে। তোমাদের বউদিদি ক্ষীরের মালপোয়া করেছেন, খেয়ে যাবে–

কিশোরী বলল—চারি এসেছে, বাড়ির চেহারাই দেখছি বদলে গিয়েছে। সত্যিই, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে মনে খুব আনন্দ হয়, তাই না?

—ঠিক। তাও এখন তো বুদ্ধি দিয়ে বুঝছ, আমার বয়েসে এলে হৃদয় দিয়ে বুঝবে।

যথাসময়ে চারি চা নিয়ে এল। আজ সব একদম সময়মাফিক ঠিকঠাক চলছে। আমরা আসবার সময় মোড়ের দোকান থেকে কিনে আনা তারানাথের প্রিয় সিগারেট পাসিং শোএর প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলাম। এটা না হলে তারানাথের গল্পের মেজাজ আসে না। নানারকম কথা হতে হতে নিজের ছোটবেলার গল্প বলতে আরম্ভ করল তারানাথ। সাধারণত সে নিজের পুরনো জীবন সম্বন্ধে কিছু বলতে চায় না, অন্তত সাধারণ পারিবারিক তথ্যগুলো আলোচনা করে না। বেছে বেছে কেবল অদ্ভুত আর অলৌকিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনায়। আজ হঠাৎ কিশোরী জিজ্ঞাসা করল—আপনি তন্ত্রসাধনার উৎসাহ বা প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে? আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কি কেউ তন্ত্রসাধক ছিলেন? মানে আমি বলতে চাইছি যে, এর ধারাটা কি পরিবারে আগে থেকে ছিল?

সিগারেটের দগ্ধাবশেষ ছাইদানি হিসেবে ব্যবহৃত নারকেলের মালায় গুঁজে দিতে দিতে তারানাথ বলল—তা বলতে পার। একেবারে রক্তাম্বরধারী তান্ত্রিক কেউ না থাকলেও বাপ-ঠাকুর্দা-প্রপিতামহের ভেতর অনেকেই রীতিমত সাধকশ্রেণীর মানুষ ছিলেন। আমার আপন ছোট ঠাকুর্দা, মানে বাবার ছোটকাকা-তিনি কৈশোরেই গৃহত্যাগী হয়ে চলে গিয়েছিলেন। তাছাড়াও আমাদের পরিবারে নানাসময়ে নানান আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে, যার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। আর কিছু কিছু তো তোমাদের বলেছি।

বললাম—আপনার ছোট ঠাকুর্দা আর কখনো সংসার জীবনে ফিরে আসেন নি?

–না। তবে একবার তার সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল। সেও এক বলবার মত গল্প—

–বলুন না, আজকের আসর সেইটে দিয়েই শুরু হোক।

তারানাথ বলল-এ কাহিনী আমার বাবার কাছে শোনা। বাবা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প বলতে পারতেন—এ বিষয়ে তাঁর নাম ছিল। আমাদের গাঁয়ের সরসী চাটুজ্জের বৈঠকখানায় সন্ধেবেলা বোজ জমাট আড্ডা বসত, বাবা ছিলেন সে আড্ডার প্রধান কথক। মেজাজ ভাল থাকলে বাড়ি ফিরে সেদিন কী গল্প হল আমাদের শোনাতেন। তারপর তো আমিও অল্পবয়েসে বাড়ি থেকে উধাও হলাম। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে আসি, তবে সে খুব কম। তিন-চার বছরে একবার কী দুবার। ওই ভবঘুরেমির সময়টা আমার যে কী সুন্দর কেটেছে তা আর কী বলব! কোনও পিছুটান নেই, দায়দায়িত্ব নেই, কেবল বিরাট এই পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো। বাইরে থেকে দেখলে এটা হয়ত স্বপ্নদর্শী অলসের জীবনযাত্রা বলে মনে হবে, যে বাস্তব জগতের থেকে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সোজা নয়। আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন দুনিয়ায় সম্পূর্ণ সম্বলহীন অবস্থায় ভেসে পড়তে হলে খুব সাহসের দরকার। কে খেতে দেবে ঠিক নেই, কোথায় থাকব তার কিছু ঠিক নেই, মন্দিরের চাতালে, পোড়ড়া বাড়ির বারান্দায় ঝড়ে-বৃষ্টিতে রাত কাটিয়েছি। কত অদ্ভুত চরিত্রের লোক দেখেছি, তাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত সাধক, কেউ নৃশংস কাপালিক, কেউবা জুয়াচোর। কত সময়ে অসুখ করেছে, প্রবল জ্বরে পথের ধারে গাছতলায় পড়ে কষ্ট পেয়েছি, জলতেষ্টায় বুক ফেটে গিয়েছে, কিন্তু জল দেবার কেউ ছিল না। মরেও যেতে পারতাম। সেক্ষেত্রে বাড়িতে কোনও খবরও পৌঁছত না। তবু কখনো ভয় হয়নি। মৃত্যুকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখিনি, দেখেছি ঈশ্বরের তৈরি এই জগতের একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে। যে পরিণতিতে ভয়ের কিছু নেই, আছে স্রষ্টার অপার করুণা।

এই পর্বেই বীরভূমের শ্মশানে মাতু পাগলীর সঙ্গে পরিচয়, বরাকর নদীর ধারে নির্জন শালবনে মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব দেখতে পাওয়া। ওঃ, সেসব কী উত্তেজনাপূর্ণ দিন গিয়েছে। মনে হয়েছিল বুঝিবা সৃষ্টির সব রহস্য জেনে ফেলব, সাধনার তীব্রতায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মকানুন ধরা দেবে আমার চেতনায়–

কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থেমে গেল তারানাথ। বললাম—কেন, অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তো হয়েছে—

—তা হয়েছে। যা পেয়েছি তা একজন সাধকের একটা জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আসলে তো কিছুই জানা হল না। এই জগতের মানে কী, কী করে এই চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি হল, না হলেই বা কী এসে যেত, সেই ভেতরের আসল কারণগুলো সব অজানা থেকে গেল। এখন মনে হয়–

আবার থেমে গেল তারানাথ। কী ভাবতে লাগল।

জিজ্ঞাসা করলাম-কী মনে হয়?

—মনে হয় সৃষ্টির গভীরতম কারণটা ঈশ্বর মানুষের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য আড়াল করে রেখেছেন। সে রহস্য জানতে পারলে সৃষ্টির আর কোনও সার্থকতা থাকবে না। গোলোকধাম খেলেছ তো? সেই যে কড়ি চেলে, কাগজে ছাপা ছকের ওপর গুটি এগিয়ে খেলা। জন্ম থেকে শুরু হয়ে বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, আদালত, পতিতালয়, শৌণ্ডিকালয়, মন্দির ইত্যাদির খোপে আঁকা ঘর পেরিয়ে খেলুড়েকে একটু একটু করে ওপরে উঠতে হয়। সবচেয়ে ওপরের খোপের নাম হচ্ছে গোলোকধাম। সেখানে পৌঁছলেই খেলা শেষ। তারপর ছক আর গুটি তুলে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। আমাদের জীবনেও তাই। সবকিছু জেনে ফেললেই খেলা শেষ। সেটা ভগবান চান না। তা একদিক দিয়ে ভালই, খেলা চলছে চলুক না।

দেখলাম তারানাথ গল্প থেকে দর্শনের দিকে সরে যাচ্ছে। বললাম-তারপর যে কথা বলছিলেন, আপনার অল্পবয়েসের গল্প, সেটা বলুন–

তারানাথ বলল—একবার বাঁকুড়ার ইন্দাস অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সারাদিন হাটেমাঠে ঘুরি, রাত্রে যেখানে হোক আশ্রয় নিই। সেদিন বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বেশি পথ না হেঁটে আলো থাকতে থাকতে একটা ছোট গ্রামের সীমানায় শিবমন্দিরের চাতালে আশ্রয় নিয়েছি। বেশ বড় চওড়া চাতাল, আট-দশটা থামের ওপর ছাদ রয়েছে। কাজেই ওপরটা ঢাকা, বৃষ্টি হলেও ভিজতে হবে না। গায়ে উড়নি, পায়ে খড়ম এক পৈতেধারী বুড়োমত লোক দেখি মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোথায় যাচ্ছে। মনে হল এখানকার পূজারী। এগিয়ে গিয়ে বললাম—আজ্ঞে, এখানে রাত্তিরটা একটু থাকা যাবে?

লোকটি একান্ত নীরস এবং অমিশুক প্রকৃতির। কিছুক্ষণ আপাদমস্তক আমাকে ভাল করে দেখে সে শুকনো গলায় বলল—থাকতে ইচ্ছে হলে থাকো, আমাকে জিজ্ঞাসা করার কী প্রয়োজন?

—না, ভাবলাম আপনিই বোধহয় এ মন্দিরের পূজারী। কাজেই আপনার অনুমতি নেওয়াটা–

—কিছু দরকার নেই। আমি এখানকার পূজারী বটে, কিন্তু নাটমন্দিরে যে কোনও যাত্রী আশ্রয় নিতে পারে। তবে এখানে অতিথিশালা নেই, খাবারদাবার দেবার ব্যবস্থাও নেই। থাকার মধ্যে ওই নাটমন্দির, থাকতে চাইলে থেকে যাও।

–আপনি কোথায় থাকেন?

বৃদ্ধ আমাকে কড়া চোখে তাকিয়ে দেখল, তারপর বলল—কেন বল তো?

—না, তাই জিজ্ঞেস করছি–

—আমি এই গ্রামেরই ভেতরে থাকি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে স্থানাভাব, সেখানে আশ্রয় দিতে পারব না।

হেসে বললাম—আপনার আশ্রয়ে থাকার চেয়ে গাছতলায় থাকা ভাল। ভয় নেই, থাকতে চাইব না, কথাটা এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম। গাছপালারা অন্তত আশ্রয়গ্রহণকারীকে কটু কথা বলে না–

বৃদ্ধ আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে হুম্ শব্দ করে গ্রামের দিকে চলে গেল।

আমার পথ হাঁটার সম্বল বলতে একটা ঝোলা। তার মধ্যে একখানা ঘটি, গায়ের চাদর, একখানা রুদ্রডামরের পুঁথি, কয়েকটা বাবলাডালের দাঁতনকাঠি, আর একটাকা বারো আনা পয়সা। এর বেশি কিছুর প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনো। পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসা সেই হিন্দিভাষী সাধু শিক্ষা দিয়েছিলেন আগামীকালের জন্য কোনও সঞ্চয় না করতে। তার উপদেশ মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। পরবর্তীকালেও যে উপার্জন বা সঞ্চয় করেছি, তা করেছি স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মঙ্গলের জন্য, নিজের প্রয়োজনে নয়। আজ পর্যন্ত সেই অভ্যাস বজায় রেখেছি।

ক্রমেই আকাশ মেঘে অন্ধকার করে আসছে। ঝোলাসহ নাটমন্দিরের ওপর উঠে একখানা থামের গোড়ায় গুছিয়ে বসলাম। বাঁকুড়া জেলায় গিয়েছ কখনো? বড় সুন্দর জায়গা। বিশাল বিশাল লালমাটির প্রান্তর, ঝুঁটিবাঁধা বৈরাগীর মত তালগাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে মাঠের মধ্যে, ধুলোওড়া গ্রামের রাস্তায় একতারা হাতে গান গাইতে গাইতে বাউল হেঁটে যাচ্ছে। জেলাটার মাটিতে শান্তি আছে। থামে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলাম।

হঠাৎ নাটমন্দিরের চাতালে কিছুদূরে কী একটা নড়ল বলে মনে হল। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে, পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না। কিন্তু কোনও কিছু নড়লে আবছা আন্দাজ করা যায়। ভাল করে তাকিয়ে দেখি কেউ একজন শুয়ে রয়েছে সেখানে, শোয়া অবস্থায় পাশ ফেরায়। নড়াচড়াটা চোখে পড়েছে। হেঁকে বললাম—কে? কে ওখানে?

মনুষ্যমূর্তিটি উঠে বসে বলল—আমি।

—আমি কে? পৃথিবীতে সবাই তো আমি। যাত্রী?

লোকটি সামান্য হাসল, বলল—সংসারে সবাই যাত্রী, কোথাও না কোথাও চলেছে।

বাপ রে! এ যে গুরুমশায়ের মত কথা বলে। তবে তার কণ্ঠস্বর মৃদু, ভদ্র ও মার্জিত। পথচলতি লোকের কথা বলার ভঙ্গি সাধারণত এমন মার্জিত হয় না। একটু কৌতূহল হওয়ায় বললাম—এসো, এদিকে এসে বোসো

লোকটি উঠে এল আমার সামনে। আলো নেই, পরিষ্কার তাকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু মনে হ’ল তার বয়েস বছর চল্লিশ কী পঁয়তাল্লিশ হবে। এ বয়েসের কোনও লোককে। ‘তুমি’ বলাটা আমার উচিত হয়নি। বললাম—কিছু মনে করবেন না, অন্ধকারে ভাল দেখতে পাইনি, তুমি’ বলে ফেলেছি।

—তাতে কী হয়েছে? জগতে সকলে সকলের বন্ধু। বন্ধুকে ‘তুমি’ বলা যায়।

লোকটির পরণে খাটো ধুতি আর হাফহাতা শার্ট। সাধারণ দরিদ্র পথিক। কিন্তু তার আচরণে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা সমীহ আদায় করে। বললাম কোথায় যাবেন? আসছেন কোথা থেকে?

এবার বেশ মজার ব্যাপার হ’ল। পথিক মানুষটি আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে লাগল, কিন্তু তার অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও আমি কিছুতেই তা পারলাম না। সে বলল—কোথাও যাচ্ছি না ভাই, অনেকটা তোমারই মতন। পথে পথে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। যা পাই তাই খাই, যেখানে খুশি থেমে যাই—এই আরকি।

আমার সেই বয়েসের অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি, কিছু লোক আছে যারা হেঁয়ালি করে। কথা বলতে ভালবাসে। ভেতরে শূন্যগর্ভ বলেই বোধহয় তারা বড় বড় দুর্বোধ্য কথা বলে। প্রথমে আমি এই লোকটিকে তাদের দলে ফেলেছিলাম, কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম তা সত্যি নয়। মানুষটার ভেতর গভীরতা আছে।

বললাম—আমারই মতন মানে? আপনি কী করে জানলেন আমি কী রকম?

-–ও জানা যায়। আমি বুঝতে পারি।

বয়েস অল্প হলেও তারই মধ্যে আমি অনেক সাধক এবং অদ্ভুতকর্মা তান্ত্রিকের সঙ্গে মিশেছি। তাদের আশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ দেখেছি। এ আর আমাকে নতুন কী ভড়ং দেখাবে?

বললাম—কী করে বোঝেন? কাকচরিত্র বা লক্ষণশাস্ত্র চর্চা করেন নাকি?

—না। বুঝি এইভাবে যে, মন আসলে একটাই—তোমার আমার যদু কিম্বা মধুর, পৃথিবীর সব প্রাণীর। মায়ার আবরণে আলাদা আলাদা দেখায়। পর্দা টাঙিয়ে দিলে ওপারে কী আছে দেখা যায় না, পর্দা সরিয়ে দিলে আবার সব স্পষ্ট দেখা যায়। মায়ার পর্দা সরিয়ে দিলে সবই এক। তখন কারও মনের কথা জানতে অসুবিধে হয় না।

বললাম—আপনি তো বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের কথা বলছেন। এ দর্শন শিক্ষা করেছেন কোথায়? খুব ভাল গুরু ছাড়া অদ্বৈতবাদের পাঠ নেওয়া যায় না। কে আপনার গুরু?

—আমার বাবা।

—ও, আপনি বুঝি শাস্ত্রাধ্যায়ী পণ্ডিতের সন্তান?

সে চুপ করে রইল। ভাবলাম কোনও কারণে সে হয়ত নিজের পরিবারের কথা আলোচনা করতে চায় না। এক্ষেত্রে কথা না বাড়ানোই ভদ্রতাসঙ্গত হবে।

ঠিক এইসময় ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা ঝাপটা দিয়ে ঝড় এসে পড়ল। বর্ষাকাল হওয়া সত্ত্বেও সারাদিন প্রখর রোদুর ছিল, গুমোটে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এখন শুকনো পাতা ধুলোবালি আর কুটোকাটা উড়িয়ে ঝোড়ো বাতাস এসে চারদিকে ঠাণ্ডা করে দিল। ঝড়ের মুখে পাক খেতে খেতে দুটো শালিক এসে নাটমন্দিরের কড়িকাঠের ফাঁকে আশ্রয় নিয়ে গুছিয়ে বসল। অথবা ওইটাই ওদের বাসা, ঝড়ের দাপটে কোনওরকম ফিরে এসেছে।

বললাম—আপনার নামটা তো জানা হ’ল না—

লোকটি চুপ করে থেকে বলল—আমার নাম অমর। অমরজীবন।

–বাড়ি কোথায়? এই জেলাতেই বুঝি?

অমরজীবন কোনও উত্তর দিল না। বুঝলাম নিজের কথা বলতে সে আদৌ আগ্রহী নয়। অন্য প্রসঙ্গে যাবার জন্য বললাম—আশ্রয় তো যাহোক পাওয়া গেল, কিন্তু খাওয়াটা বোধহয় জুটবে না

–না না, তা কেন? ঝড়টা থামুক, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে এখন–

—তা কী করে হবে? কাছাকাছি কোনো দোকানপাট দেখছি না। গ্রামে হয়ত আছে, কিন্তু তারা কি এই ঝড়বাদলে দোকান খুলে রাখবে? মনে হয় না।

অমর বলল-রাত্তিরে কী খাও তুমি? ভাত না রুটি?

বললাম–আমি ঠিক সন্ন্যাসী না হলেও পথে ঘুরছি অনেকদিন। সবই অভ্যেস আছে।

–বেশ, বেশ। ভাল। খাবার এসে যাবে।

অন্ধকারে অমরের মুখচোখ ভাল দেখতে পাচ্ছি না। লোকটা পাগল নয় তো? কোথায় খাবার?

অমর বলল—কালকেও আমি এখানে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আজ তুমি আসবে, তাই একটা দিন বেশি থেকে গেলাম। এমনিতে আমি দু-রাত্তির কোথাও থাকি না–

হ্যাঁ, নিশ্চয় পাগল। গতকাল রাত্তিরে স্বপ্ন দেখেছে আজ আমি আসব! বদ্ধ পাগল ছাড়া কী?

বললাম—আপনি জানতেন আমি এখানে আসব?

-হ্যাঁ।

–স্বপ্নে দেখেছেন?

-হ্যাঁ। স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন হলে আমাকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে সেখানে থাকতে হয়।

বেচারী! এমনিতে বেশ ভাল লোকটা, ভদ্র আর মিষ্টি কথাবার্তা। দোষের মধ্যে পাগল।

এরপরেই অমরজীবন হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি বাড়ি চলে যাও।

আমি প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি সে কী বলছে। বললাম—তার মানে? বাড়ি যাব কেন?

—কিছু না। ভবঘুরে জীবন ত্যাগ করে সংসারে ফিরে যেতে বলছি না। সে যখন সময় হবে যাবে। তোমার নিজের ভালর জন্য বলছি, কয়েকটা দিনের জন্য বাড়ি যাও—

আচ্ছা বিপদ তো! বললাম—কিন্তু কেন?

—মনে করো না আমি তোমার বন্ধু, আমি অনুরোধ করছি তাই যাচ্ছ।

তার কথাগুলো একটু কেমন কেমন। কিন্তু গলার স্বরে একটা ব্যক্তিত্বপূর্ণ দৃঢ়তা আছে। তার কথা মনোমত না হলেও অকস্মাৎ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তখনকার মত তাকে শান্ত করার জন্য বললাম–আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবে এখন। বিড়ি চলে?

সে হাসল। বলল—সব চলে। আছে? দাও–

তাকে দিয়ে নিজে একটা বিড়ি নিলাম। বাতাসের দাপটে চার-পাঁচটা কাঠি নষ্ট করেও ধরাতে পারছিলাম না। অমর হাত বাড়িতে বলল—আমাকে দাও দেখি–

তারপর দেশলাইটা হাতে নিয়ে অদৃশ্য কার দিকে যেন ধমক লাগাল—আরে একটু থাম্ তো রে বাপু! একটা বিড়ি ধরাতে কি একটা আস্ত দেশলাই খরচ করব নাকি?

কাকতালীয় কিনা জানি না, হাওয়ার ঝাপটা সামান্য কয়েক মুহূর্তের জন্য কমে গেল। ঝড় চলতে চলতে এরকম অবশ্য হয়ই, তবু মনে রেখাপাত করল জিনিসটা। দেশলাই ফেরৎ দিয়ে অমর বলল—সবকিছুর ব্যাখ্যা চাইতে নেই। ব্যাখ্যা হয়ও না। তার চেয়ে সরল বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা ভাল। আদেশ পেলে পালন করা ভাল।

—আদেশ কে পাঠায়?

বিড়িতে গোটাদুই টান দিয়ে অমর বলল—তা জানলে তো সব সমস্যাই মিটে যেত।

—আপনার কাছে আদেশ পৌঁছয় কেন? আপনি কে?

উত্তরে অমর বলল—বিড়িটা ভাল। খুব নরমও না, খুব কড়াও না। বেশ মিঠেকড়া ধরনের। কোত্থেকে কিনেছ? খাওয়ার পরে আর একটা দিও তো–

ঝড় থেমে গিয়ে নামল বৃষ্টি। চলল বেশ কিছুক্ষণ। দিকদিগন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মন্দিরের পেছনে কোথা থেকে ব্যাঙ ডাকতে লাগল। বৃষ্টি যখন থামল, তখন পাড়াগাঁর হিসেবে বেশ রাত। দেখি পথে জমা জলে ছপ ছপ করে কে একজন হেঁটে এসে নাটমন্দিরে উঠল। সামনে ঝুঁকে অন্ধকারে ঠাহর করার চেষ্টা করে ডাকল—ঠাকুরমশাই! ও ঠাকুরমশাই–

অমর বলল–এই যে, আমি এখানে। দাও–

কাছে এলে দেখলাম লোকটির হাতে একটা বড় শালপাতার ঠোঙা। সে ঠোঙাটা অমরের হাতে দিতে দিতে বলল—আর এক মূর্তি এয়েচে দেখচি। তা হয়ে যাবে’খন দুজনের। দাঁড়াও, খাবার জল দিয়ে যাই। নতুন লোক, জল আনতে গেলে পুকুরঘাটে আছাড় খাবে।

বোধহয় পথিকদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মন্দিরের চাতালে রাখা একটা মাটির কলসী নিয়ে লোকটি অন্ধকারে কোথায় চলে গেল। অমর বলল—মন্দিরের পেছনেই একটা পুকুর আছে, সেখানে গেল জল আনতে। ভাল, পরিষ্কার জল—

তারপর আমার মুখের দিকে তাকিলে বলল-খাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলেছিলাম আর খাবার এসে গেল—এর ভেতর কিন্তু অলৌকিক কিছু নেই। এই লোকটির একটা ময়রার দোকান আছে গ্রামে, গতকালও আমাকে খাবার দিয়ে গিয়েছিল। অতিথিসেবা করতে ভালবাসে। পয়সা দিতে চেয়েছিলাম—নেয়নি। আজকের খাবারও দিতে বলা ছিল। যা খাবার দেয় তা আমি একা খেতে পারি না, আজও দুজনের হয়ে যাবে এখন। দেখি কী দিয়েছে–

উঠে গিয়ে যেখানে সে শুয়েছিল সেখান থেকে একটা কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে এল অমর। তার ভেতর থেকে একটা মোমবাতি বের করে বলল—দেখি, দেশলাইটা আর একবার দাও–

শালপাতার ঠোঙা খুলে দেখা গেল ভেতরে গোটা পনেরো বড় মাপের পুরী, আলুর তরকারী, আর অনেকখানি মোহনভোগ। দেশী ঘি দিয়ে তৈরি, দারুণ গন্ধ বেরুচ্ছে। তখনো গাঁয়ের দিকে খাবারে ভেজাল দেবার কথা কেউ ভাবতে পারত না।

জল ভরে মেটে কলসীটা নিয়ে ফিরে এল ময়রা। আমাদের পাশে নামিয়ে রেখে বলল—এই জল রইল। এ খাবারে হয়ে যাবে তো? নাকি আর কিছু এনে দেব?

খাবারের প্রাচুর্য সম্বন্ধে তাকে আশ্বস্ত করে বিদায় করা হ’ল। অমর বলল—অন্ধকারে গল্প করা যাবে, কিন্তু খাওয়া যাবে না। মোমবাতি বেশি পুড়িয়ে লাভ নেই, এসো খেয়ে নেওয়া যাক–

অমর খুব কম খায়। মাত্র চারখানি পুরী সে খেল, বাকি সবগুলো খেতে হল আমাকে। অবশ্য পথ হেঁটে আমার খিদে পেয়ে গিয়েছিল। কলসী কাত করে কানায় হাত দিয়ে জল খেলাম। তারপর মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে অমর বলল—এসো, এইবারে গল্প করি।

অন্ধকারের ভেতর থেকে তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে লাগল। কত গল্প সে শোনাল সারারাত ধরে। তেমন কথা আমি কারও কাছে কখনও শুনিনি। সাধারণ ডাল-ভাত খাওয়া জীবনের কথা নয়, যেন অচেনা ভাষায় অচেনা সুরে অদ্ভুত গান শোনাচ্ছে কেউ। আকাশ আর নক্ষত্রের গল্প, সমুদ্রের ঢেউয়ের গল্প, আগুন-বাতাস-পাহাড়-মাটির গল্প। সে। আমি তোমাদের ভাষা দিয়ে ঠিক বোঝাতে পারব না। সৃষ্টির আদিম গল্প সে, আমাদের প্রত্যেকদিনের জীবনে তার কোনও প্রতিচ্ছবি হয় না। সেই রাতের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কথা বলতে বলতেই অমরজীবন হঠাৎ বলল–তোমার ছোট ঠাকুর্দা গৃহত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, না? উনি এখনো বেঁচে আছেন।

আশ্চর্য তো! কী করে সে কথা জানলো এই লোকটা? কিন্তু তখন আমার এত ঘুম পেয়েছে যে, যথেষ্ট অবাকও হতে পারলাম না।

তখন রাত বোধহয় তিনটে পেরিয়ে গিয়েছে, অমর বলল—না, আর কথা না। এবার তুমি ঘুমোও। বাড়ি চলে যেও কিন্তু। কালকেই। তোমার ভালর জন্যই বলছি।

আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে। বললাম—আপনিও চলুন না আমার সঙ্গে। যাবেন?

—না, এবার না। এবার থাক। তবে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার।

আমার কানে যেন কে নিদুলির মন্ত্র পড়ে দিয়েছে। আর তাকাতেই পারছি না। ঘুম-ঘুম।

যখন ঘুম ভাঙল তখন রোদুর উঠে গিয়েছে। গতকাল রাত্তিরের মেঘ-বৃষ্টির চিহ্ন নেই কোথাও, ঝকঝক করছে দিনের আলো।

পাশে অমরজীবন নেই। তার ঝোলাঝুলিসহ কখন সে চলে গিয়েছে কে জানে।

কাল সন্ধেবেলা দেখা সেই পুরোহিত এসে মন্দিরের দরজা খুলে সকালের পুজোর উদ্যোগ করছে। আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকাল কবার। জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, এখানে যে আর একজন পরশু থেকে ছিলেন, তিনি চলে গিয়েছেন?

সে বলল—কে ছিলেন?

—একজন যাত্রী। আমার আগে থেকেই তো ছিলেন—

–দেখিনি। খেয়াল করিনি। অমন কত লোক যাচ্ছে আসছে—

লোকটি শুধু নীরস নয়—নিরুৎসুক, নিরুদ্বেগ এবং সম্পূর্ণ নিরুত্তাপ।

যাই হোক, অমরজীবন লোকটিকে আমার খুবই অদ্ভুত লেগেছিল, তার কথা অমান্য করতে মন চাইল না। সেদিনই রওনা হলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছনোর পর প্রতিবারের মতই প্রথমে বাবার বকাঝকা, তারপরে মায়ের কান্নাকাটি, এবং তারও পরে আত্মীয়স্বজনের আবেগের বন্যা সহ্য করতে হ’ল। দুপুরে খেতে বসে বাবা বললেন—গত পরশুদিনই সরসী চাটুজ্জের আড্ডায় তোমার কথা হচ্ছিল। আমার যে একটা এমন বাড়িপালানো হাড়জ্বালানো ছেলে হবে সে কথা অনেক আগেই একজন বলে দিয়েছিল—

বললাম–কে? কোনও জ্যোতিষী?

—না। এমনিই একজন পথিক। আমার ছোটবেলায় একদিনের জন্য আমাদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল। তার নাম অমর, অমরজীবন। সেই গল্পই হচ্ছিল সরসী চাটুজ্জের বাড়ি

চমকে উঠে বললাম—অমর! অমরজীবন!

বাবা বললেন—হ্যা! চমকে উঠলে কেন?

—না, কিছু না। গল্পটা বরং বলুন, শুনি—

খেয়ে উঠে গড়গড়ায় তামাক খেতে খেতে বাবা বলতে শুরু করলেন।

নিজের বাবার কাহিনী লেখকের বর্ণনার ভঙ্গিতে বলে গেল তারানাথ। তারপর থেমে একটু দম নিয়ে বলল—এই ব্যাপারটার সবচেয়ে বিচিত্র দিক কোনটা জানো? যে লোককে চল্লিশ বছর আগে বাবা পঁয়তাল্লিশ বছরের দেখেছিলেন, তাকে এতকাল পরে আমিও সেই বয়েসে দেখলাম কী করে?

ছোট ঠাকুর্দার খবরটা বাবাকে জানাবো ভেবেছিলাম, দেখলাম অমরজীবন মারফৎ সেটা তিনি আগেই জানেন।

পরদিন বুঝলাম কেন অমরজীবন বাড়ি চলে আসতে বলেছিল। পরদিন থেকে আমার এল প্রবল জ্বর। প্রায় দেড়মাস ভুগে সেরে উঠলাম। পথে থাকলে প্রাণসংশয় হত সন্দেহ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *