অধ্যায় ৪. এক থেকে অনেক
একদিন শুনতে পেলেন, আপনার প্রিয় লেখক আপনার শহরে আসছেন তার কাজ নিয়ে কথা বলতে। আপনি সেই বইয়ের দোকানে গেলেন, যেখানে তিনি তার বক্তব্য দেবেন, এবং নতুন বই থেকে কিছু অংশ তিনি পাঠ করে শোনালেন, আপনার কাছে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত চরিত্রগুলোর সাম্প্রতিক নানা অভিযানের কাহিনি। আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে এইসব চরিত্রগুলো এসেছে। কোথাও কি আসলেই তাদের অস্তিত্ব আছে? তিনি হাসলেন এবং বললেন, শুধুমাত্র আমার কল্পনায়। এই সবকিছুই তার মনগড়া। তারা সবাই এসেছে তার মস্তিষ্ক থেকে। সুতরাং তিনি তাদেরকে দিয়ে তার ইচ্ছামতো যে-কোনো কিছুই করাতে পারেন।
কী হতে পারে যদি বাসায় ফেরার পথে আপনার নিজেরই হঠাৎ করে মনে হয়, হয়তো আপনিও তাদের মতো বাস্তব কোনো চরিত্র না? আর আপনি হয়তো অন্য কোনো একজনের সৃষ্টি, কারো কল্পনা-সৃষ্ট প্লটের একটি চরিত্র?। যদি এমন কিছু ঘটে, তাহলে সেটি হবে যেন কোনো একটি বইয়ের চরিত্র অনুধাবন করতে পেরেছে যে, আসলে তার স্বাধীন কোনো জীবন নেই, তিনি শুধুমাত্র কোনো একজন লেখকের কল্পনার সৃষ্টি।
এটি সেই ধারণাটির মতো যা ভারতের সাধুদের কোনো ঐশী প্রত্যাদেশের শক্তিতে আঘাত করেছিল। তারা নিজেরাই আসলে বাস্তব নয়। শুধুমাত্র একটি জিনিসই চূড়ান্তভাবে বাস্তব : বিশ্বজনীন আত্মা অথবা স্পিরিট, যার নাম তারা দিয়েছিলেন ‘ব্রহ্ম’ (ব্রহ্ম), যা এরা নিজেকেই বহুরূপে প্রকাশ ও সৃষ্টি করেছিল। এই পৃথিবীতে সত্যিকার বাস্তবতায় যা-কিছুর অস্তিত্ব আছে, সেগুলো বাস্ত বিকভাবেই ব্ৰহ্মনের বহু ছদ্মবেশ আর রূপের একটি দিক মাত্র। যেমন, উপনিষদ বলেছে, সবকিছুর মধ্যেই এটি লুকিয়ে আছে, সব সত্তার মধ্যে সেই নিজস্ব স্বরূপ–যা সব সৃষ্টি আর কর্মের ওপর তদারকি করছে, যা সব সত্তার ভিতরে বাস করছে, সাক্ষী, পর্যবেক্ষণকারী, শুধুমাত্র একটি ‘সত্তা’। এবং তারা যেমন ব্রহ্মনের অংশ, ব্রহ্মও তাদের অংশ।
উপনিষদের একটি গল্প এই আত্মপরিচয়ের নৈকট্যটিকে খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছে। একজন পিতা তার সন্তানকে বলছেন, ‘সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম মূলসার যেটি–এই পুরো মহাবিশ্ব সেটি ধারণ করছে এর আত্মা হিসাবে–এবং …. সেটাই হচ্ছে বাস্তবতা… আর…সেটাই হচ্ছ তুমি, শ্বেতকেতু’। মানুষ হয়তো চিন্তা করতে পারে যে, তাদের একটি পৃথক, একক অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সেটি একটি মায়া বা বিভ্রম। তারা সবাই হচ্ছে সেইসব চরিত্র যারা ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকা ব্রহ্মনের কাহিনিতে বারবার আবির্ভূত হয়, আর পরের পর্বে তাদের ভূমিকা কী হবে সেটির রচয়িতা হচ্ছে তাদের কার্মা।
আর শুধুমাত্র একক সদস্যরাই নয়, যাদের ভূমিকা কী হবে সেটি তাদের জন্য পূর্বনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, বিভিন্ন শ্রেণি ও বর্ণে সমাজ কীভাবে সংগঠিত হবে, সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে পূর্বনির্ধারিত একটি নির্দেশ অনুসরণ করে। যখনই একটি মানব-আত্মার পুনর্জন্ম হয়, এটি এই শ্রেণিগুলোর কোনো-একটিতে নিজেকে আবিষ্কার করে। এবং পরবর্তী মৃত্যু আর পুনর্জন্ম হবার আগে এই শ্রেণিতে তার এই জীবনটি কাটাতে হয়। যেহেতু বিভিন্ন জাত এবং তাদের রঙের একটি সুস্পষ্ট সংযোগ আছে, আমাদের মনে করা উচিত, আর্য আগ্রাসনকারীরা যারা তাদের ভাষা আর ধর্মকে সিন্ধু উপত্যকায় নিয়ে এসেছিলেন, তাদের গায়ের চামড়ার রঙ ছিল হালকা; যখন তারা এই ভূখণ্ডে এসেছিল সম্ভবত তারা অবজ্ঞার চোখেই স্থানীয় গাঢ় রঙের চামড়ার মানুষদের দেখতে শুরু করেছিল। আর্যদের ভারতে আসার আগেই বিভিন্ন জাতের কোনো একধরনের শ্রেণিবিন্যাসের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু সর্বোচ্চ বাস্তবতার নির্দেশে সৃষ্ট একটি বন্দোবস্ত হিসাবে তারা এটি যুক্তিযুক্ত করেছিল। এবং একটি ধর্মশাস্ত্রও ছিল যা এই প্রথার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছিল।
এই মহাবিশ্ব নির্মাণ করতে ব্রহ্মন্ যে সৃষ্টিকর্তা দেবতার ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন, খানিকটা সংশয়পূর্ণভাবেই তার নাম হচ্ছ ব্রহ্মা। ব্রহ্মা প্রথম মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন, ‘মনু’, এবং প্রথম নারী, শতরূপা। আর তাদের কাছ থেকেই এসেছে সমগ্র মানবজাতি। কিন্তু সব মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। গুরুত্বে ক্রমশ নিম্নমুখী এই ক্রমবিন্যাসে চারটি পৃথক জাত বা বর্ণ ছিল। সবার শীর্ষে ছিলেন ব্রাহ্মণরা, যারা ছিলেন পুরোহিত আর শিক্ষক। এরপরে আছেন ক্ষত্রিয়রা–রাজা, অভিজাতশ্রেণি ও যোদ্ধারা এই বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। তাদের পরে এই ক্রমে আছেন বৈশ্যরা, যারা ব্যবসায়ী, কারুশিল্পী। এবং নিচের শ্রেণিতে আছে। দ্ররা, যারা ভৃত্য কিংবা জমির মজুর। ব্রাহ্মণরা ফর্সা, ক্ষত্রিয়রা লালচে, বৈশ্যরা হলদে, শূদ্ররা কালো। এবং এইসব বর্ণগুলোর সবচেয়ে নিচে আছে একটি শ্রেণি, যাদের কাজ, যেমন– ল্যাট্রিন বা পায়খানা পরিষ্কার এবং আরো অনেক ধরনের নোংরা কাজ করা, যে-কাজগুলো তাদের স্থায়ীভাবেই অপরিষ্কার এবং কলুষিত করেছে–তারা হচ্ছেন ‘অস্পৃশ্য, এমনকি তাদের ছায়া যেখানে পড়ে সেটিও নাকি অপবিত্র হয়ে যায়। খুবই কঠোর আর অনমনীয় একটি পদ্ধতি ছিল এটি, কিন্তু কার্মা আর ‘সামসারা’য় বিশ্বাস এই অস্তিত্ব থেকে খানিকটা হতাশা অপসারণ করেছিল। কার্মা দ্বারা নির্ধারিত জীবনগুলোয় তাদের জন্মজন্মান্তরের যাত্রায় মানুষ সবসময়ই আশা করতে পারে যে, সঠিকভাবে বাঁচলে হয়তো পরবর্তী জীবনে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে।
কিন্তু জাত আর বিভাজনসহ বহু বিচিত্ররূপে পূর্ণ জীবনে পৃথিবীই একমাত্র উপায় নয় যেখানে ব্রাহ্মণ তার নিজেকে প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি দেবদেবীদেরও সৃষ্টি করেছিলেন, সংখ্যায় যারা অগণিত, তারা হচ্ছেন আরো একটি উপায় যার মাধ্যমে নিরাকার’ সেই সত্তাটি বিভিন্ন আকার ধারণ করতে পারেন। কিন্তু এইসব দেবতাদের নিয়ে আমরা কীভাবে ভাবব, সে-বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। উপরিদৃষ্টিতে হিন্দুধর্ম হচ্ছে সেই ধরনের একটি ধর্ম, যাদের আমরা বলি পলিথেইস্টিক বা বহুঈশ্বরবাদী বহুদেববাদী। সেটি হচ্ছে আরেকটি উপায়ে বলা যে, তারা বহুদেবতায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু খুব সঠিকভাবে এটিকে মনোথেইস্টিক বা একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে, কারণ এর অগণিত দেবদেবী সবাই একটিমাত্র দেবতার প্রতিমূর্তি বা অংশ বা অভিব্যক্তি। কিন্তু এমনকি একজন ‘দেবতার ধারণাটিও পুরোপুরি ঠিক না। হিন্দুবিশ্বাসে, জীবনের মধ্যে দিয়ে দ্রুত ভেসে চলে যাওয়া পরিবর্তনশীল অলীক সব চরিত্রগুলোর নেপথ্যে দেবদেবীসহ একটিমাত্র ‘পরম বাস্তবতা আছে, সেই একটি জিনিস’, একক সত্তা, যেভাবে উপনিষদ এটি বর্ণনা করেছে। আর আপনি যদি বিভিন্ন জিনিসের কারিগরি নাম জানতে পছন্দ করেন, এই বিশ্বাসটি মনিজম’ নামে পরিচিত, অর্থাৎ অদ্বৈতবাদ, একেশ্বরবাদ নয়।
যেহেতু সবার সেই ধরনের মন নেই, যা কিনা এই ধরনের কোনো বিশাল ধারণার সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারে, দেবদেবীদের ছবি ‘সেই একক সত্তা’র প্রতীক হিসাবে তৈরি করা হয়, যা মানুষকে কোনোকিছুর দিকে তাকাতে এবং মনোযোগ দিতে সুযোগ করে দেয়। মনে রাখবেন : একটি প্রতীক হচ্ছে একটি বস্তু যা কোনো-একটি বড় ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে এবং আমাদেরকে সেই ধারণাটির সাথে সংযুক্ত করে। হিন্দুধর্মে বাছাই করার জন্য বহু সহস্র দেবদেবী। আর চিত্র আছে, আর উপাসনাকারীর চিন্তাগুলোকে, যার মাধ্যমে সবকিছুর অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে সেই ‘একক’ সত্তার প্রতি আকর্ষণ করতেই সেগুলো পরিকল্পিত হয়েছে।
হিন্দু দেবতারা কেমন দেখতে সেটি যদি আপনি জানতে চান, তাহলে তাদের খুঁজতে কোনো মন্দিরে আপনাকে প্রবেশ করতে হবে। সুতরাং আসুন আমরা সবচেয়ে নিকটবর্তী একটি মন্দির খুঁজে বের করি। প্রথমে আমরা সিঁড়ি বেয়ে একটি চাতালে পৌঁছাব, সেখানে আমাদের জুতা খুলে রেখে খালিপায়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে। আমরা মূল হলঘরে আসব, সেখানে একপ্রান্তে সিঁড়ি দিয়ে বাঁধানো উঁচু বেদির উপর একটি বা কয়েকটি দেবতার মূর্তি আবিষ্কার করব, যারা সেখানে বাস করেন। ভারতের বড় মন্দিরগুলো আরো অনেক বেশি মূর্তি দিয়ে পূর্ণ থাকে। তবে অন্য কোনো সাধারণ মন্দিরে হয়তো তিনটি প্রতিমা থাকতে পারে, যে-দেবতারা খুবই জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি হয়তো সেই মূর্তিটি দেখেছেন যেখানে আমরা নৃত্যরত একজন পুরুষকে দেখব, যার তিনটি চোখ আর চারটি হাত আছে, যার মাথা থেকে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত নদীটি বের হয়ে এসেছে, গঙ্গা। এছাড়া আরেকটি মূর্তিও খুব পরিচিত মনে হতে পারে, যার ভুঁড়িসহ বিশাল একটি মানবশরীর আছে এবং মাথাটি একটি হাতির মাথার মতোই। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে নাড়িয়ে দেবার মতো প্রতিমাটি অবশ্যই নারীদেবীর একটি মূর্তি, তার বিশাল জিহ্বাটি বের হয়েছে, তারও চারটি হাত, তার একটিতে সে ধরে আছে ধারালো তলোয়ার, অন্য হাতে একটি খণ্ডিত মাথা, যেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
ঐ নৃত্যরত তিন চোখ আর চার হাতসহ মূর্তিটি হচ্ছে দেবতা শিব, ধ্বংসকারী। হাতির মাথাসহ প্রতিমাটি গণেশ, দেবী পার্বতী আর শিবের পুত্রদের একজন। আর চার হাতের যে-নারীটি খণ্ডিত মস্তিষ্ক হাতে ধরে আছে তিনি হচ্ছেন কালী, শিবের স্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম একজন। গণেশের মাথাটি হাতির মতো কারণ একদিন তার বাবা তাকে চিনতে না পেরে ভুল করে মাথাটি কেটে ফেলেছিলেন। তার ভুল-বোঝার পর প্রথম যে প্রাণীর দেখা পাবেন তার থেকে নতুন একটি মাথার প্রতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে সেই প্রাণীটি ছিল হাতি। এই ধরনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সহ্য করেছিলেন যিনি, তার জন্য মানানসই পরিমাণে গণেশ খুব জনপ্রিয় আর কাছের দেবতা, যিনি তার অনুসারীদের জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সহায়তা করেন।
কালীর কাহিনিটি অপেক্ষাকৃত কম-সান্ত্বনাদায়ক। হিন্দুধর্মের দেবতারা তাদের বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন করার ব্যাপারে খুবই দক্ষ। এবং কালী হচ্ছে মা দেবীর বহু রূপের একটি, দেবতার রমণীয় দিকের একটি অংশ। অশুভের সাথে তার বহু যুদ্ধের একটিতে কালী ধ্বংসলীলায় এতটাই বেশি মত্ত হয়ে পড়েছিলেন, এবং তিনি তার সামনে আসা সবকিছুকেই জবাই করতে শুরু করেছিলেন। তার এই উন্মত্ততা থামাতে, শিব নিজেকে তার পায়ের উপর ছুঁড়ে মেরেছিলেন, এবং কালী তার এই আচরণে এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, বিস্ময়ে তার জিহ্বা বের হয়ে এসেছিল। কালী আর গণেশ বেশ বর্ণিল দুটি চরিত্র, কিন্তু শিব আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুদেবতাদের বিশাল ভাণ্ডারে তিনি স্মরণীয় তিন সর্বোচ্চ দেবতাদের একজন, অন্য দুইজন হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, যার সাথে আমাদের আগেই দেখা হয়েছে এবং বিষ্ণু, যিনি রক্ষক।
হিন্দুধর্মে এই তিন প্রধান দেবতার অবস্থান কোথায় সেটি বুঝতে হলে, সময় নিয়ে ভিন্ন দুটি উপায়ে ভাবনার বিষয়টি প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে। পশ্চিমা চিন্তায় সময় চলে কোনো নিশানা বরাবর ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরের মতো, যা নিশানার দিকে ছুটে চলে, তাহলে এর সবচেয়ে সেরা চিত্রটি হবে একটি সরলরেখার মতো, যা সামনে ধাবমান (à) ভারতীয় ভাবনায় সময়চক্র বা বৃত্তাকার চাকার মতো ঘূর্ণায়মান, সুতরাং এর সবচেয়ে ভালো প্রতীকী রূপ হবে একটি বৃত্ত (০)। ঠিক যেভাবে কার্মা প্রতিটি মানুষকে পুনর্জন্মের নিরন্তর চক্রের মধ্যদিয়ে পরিচালিত করে, মহাবিশ্বও সেই একই নিয়মে বন্দি। বর্তমান সময়ের শেষে এটি শুন্যতার শূন্যতায় ম্লান হয়ে মিলিয়ে যায়, যতক্ষণ-না ‘সেই একক সত্তা’ সময়ের চাকাটি আবার ঘোরানো শুরু করেন, এবং ব্রহ্মা আরেকটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন।
পরবর্তী চাকা-ঘোরানো অবধি তার কাজ শেষ হলে, ব্রহ্মা বিশ্রাম নেন এবং বিষ্ণু এই মহাবিশ্বের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। বিষ্ণুকে তার ডানহাতে কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে একটি গদাসহ আঁকা হয়, তিনি হলেন সেই দেবতা যিনি দয়াময় পিতার মতো মহাবিশ্বের প্রতিপালন করেন এবং এটিকে সুরক্ষিত রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেন। বিষ্ণু আমাদের আশ্বস্ত করেন ও স্বস্তি দেন, হয়তো তাকে খানিকটা ক্লান্তিকর নীরস অনুভূত হতে পারে। শিব অবশ্যই বর্ণিল একটি চরিত্র, তিনি মানবচরিত্রের যুদ্ধপ্রিয় দিকটির প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ধ্বংসকারী, ব্রহ্মা যা শুরু করেছিলেন, তিনি সেটি শেষ করেন এবং বিষ্ণু সেটি প্রতিপালন করেন। তার সবচেয়ে নাটকীয় কর্মটি হচ্ছে তাণ্ডবনৃত্য বা ড্যান্স অব ডেথ, তাণ্ডব ধ্বংসাত্মক ও পুরুষালি নৃত্য; শিব কাল-মহাকাল বেশে বিশ্বধ্বংসের উদ্দেশে এই নাচ নাচেন, তিনি সময় আর মহাজগৎকে তার পায়ের নিচে পাড়িয়ে ধ্বংস করেন, চাকার পরবর্তী ঘূর্ণন অবধি, যখন ব্রহ্মা আবার আরেকটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন।
ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা যখন তাদের দেবদেবীদের ছবির দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকান এবং সেই প্রতিমূর্তিটি যা-কিছুর প্রতিনিধিত্ব করছে সেই বিষয়ে ভাবেন, সময়ের চাকার সেই ঘূর্ণনের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, যা তাদের জন্ম-জন্মান্তরের চক্রে বিরতিহীনভাবে ঘোরাতে থাকে। এটি ঘুরতে থাকা একটি মঞ্চ, যেখানে তারা সবাই আসা-যাওয়া করেন, আবির্ভূত হন আবার অদৃশ্য হয়ে যান, তারা মঞ্চে প্রবেশ আর প্রস্থান করেন। একটি অসাধারণ কিন্তু ক্লান্তিকর একটি দৃশ্য। কোনো কি উপায় আছে, যার মাধ্যমে তারা এই মঞ্চ থেকে বের হয়ে এসে অবসর নিতে পারেন? সামসারা বা সংসারের এই আসা-যাওয়ার পর্ব থেকে কি একটি চূড়ান্ত প্রস্থান সম্ভব?
কিছু শৃঙ্খলা আছে, যা আত্মা অনুশীলন করতে পারে, যা তাদের এই সময়ের ঘূর্ণায়মান মঞ্চ থেকে পালাতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সেগুলো বুঝতে হলে যে-পরিস্থিতি আর দুর্দশার মধ্যে মানুষের বসবাস সেটি আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। তারা নিজেরাই বাস্তব নয়, কিন্তু তারপরও তারা একটি মায়ার মধ্যে আটকে আছে আর সেটি তারা নিজেই। এই মায়া থেকে মুক্তি অর্জন করা এবং নিজসত্তাটিকে অবশেষে অদৃশ্য হতে দেওয়াই হচ্ছে পরিত্রাণ। সরলভাবে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে আমরা সেই শৃঙ্খলাগুলোকে ভাগ করতে পারি, যা মুক্তিকে দুটি ভিন্ন আধ্যাত্মিক অনুশীলনের আরো নিকটে নিয়ে আসতে পারে। বাহ্যিক উপায় এবং অভ্যন্তরীণ উপায় হিসাবে আমরা হয়তো সেগুলোকে ভাবতে পারি কোনোকিছুর ওপর মনোযোগ দেবার উপায় এবং কিছু নয় এমন কিছুর ওপর মনোযোগ দেবার উপায়।
একটি বাহ্যিক উপায়, যা লাভিং ডিভভাশন বা প্রেমময় ভক্তি হিসাবে পরিচিত, যেখানে উপাসনাকারীরা কোনো একটি প্রতীকী রূপ অথবা কোনো দেবদেবীর ছবি ব্যবহার করেন নিরাকার সেই একমাত্র সত্তার সাথে একাত্মতা অর্জন করতে। তারা মন্দিরে তাদের দেবতাদের জন্যে উপহার নিয়ে আসেন, প্রেমময় ভক্তি দিয়ে তারা দেবতার সেবা করেন। এইসব আচারগুলো পালন করার সময়ে তারা নিজেদের মধ্য থেকে সেই অখণ্ড নিরাকার সত্তার সন্নিকটে আসতে বের হয়ে আসেন। এটি একধরনের আত্মবিস্মৃতি প্ররোচিত করে, যা ধীরে ধীরে তাদের মানবচরিত্রের শক্ত বাঁধন থেকে মুক্তি দেয়, যা তাদের মায়ার ফাঁদে আটকে রেখেছে। কিন্তু প্রক্রিয়াটির ধীরগতির কারণে হয়তো অগণিত জীবন অতিক্রম করতে হয় চিরন্তন প্রত্যাবর্তনের সেই চাকা থেকে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করতে।
পরিত্রাণের অন্য উপায়টি এর বিপরীত একটি পথ বেছে নিয়েছে। এটি কোনো চিত্র ব্যবহার করে আপাতদৃশ্যমান এই জগতের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে না। ধ্যানের অনুশীলন করে এটি নিজেকে মায়ামুক্ত করার চেষ্টা করে। স্থির হয়ে বসা এবং শরীরের সব অস্বস্তি আর মনের মধ্যে দৌড়ে বেড়ানো অসংখ্য চিত্তবিক্ষেপকারী চিন্তা উপেক্ষা করতে শেখার মাধ্যমে এর অনুশীলনকারীরা নিজস্ব সত্তার বিভ্রমটিকে থেকে নিজেদের মুক্ত করেন এবং বাস্তবতার সাথে একাত্মতা অর্জন করেন। কিন্তু ধ্যানও খুব দ্রুত কোনো সমাধান নয়। যে মিলনের বোধ এটি নিয়ে আসে সেটি খুবই সাময়িক এবং শূন্য মন দ্রুত আবার পূর্ণ হয়ে ওঠে পরিচিত সব কামনা আর বিভ্রান্তি দিয়ে। আর সে-কারণেই আত্মবিস্মরণের একটি স্থায়ী পরিস্থিতি অর্জন করতে আর একক সেই সত্তার সাথে মিলনের সন্ধানে কেউ কেউ তাদের সব পার্থিব সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং যাযাবর ভিক্ষুক হিসাবে চূড়ান্ত আত্মবিসর্জনে তাদের জীবনটি কাটিয়ে দেন। তারা শরীরের সব চাহিদাকে অবদমন করেন, যা তাদেরকে এই জীবনের সাথে বন্দি করে রাখে, আর তারা সেটি করেন সেই অখণ্ড সত্তার মাঝে নিজেকে বিলীন করে দিতে, শুধুমাত্র একাই যে বাস্তব।
সময়ের চক্র থেকে চূড়ান্ত মুক্তি প্রতিশ্রুতি হিন্দুধর্ম দেয়, কিন্তু সেই অসীম সংখ্যক জীবনের ভাবনা, এই মুক্তি অর্জন করার জন্যে যা প্রয়োজন, আমাদের হতবাক করে দেয়। কমন এরা শুরু হবার প্রায় ৫০০ বছর আগে কাউকে কাউকে এই সমস্যাটি নিয়ে ভাবতে প্ররোচিত করেছিল, এই অতি-আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জন। করার কি কোনো সংক্ষিপ্ত আর দ্রুততর উপায় আছে কিনা। এই উত্তরটাই দিয়েছিলেন ধর্মীয় ইতিহাসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিভাবান ব্যক্তিদের একজন, পরের অধ্যায়ে আমরা তার কথা শুনব। তার নাম ছিল সিদ্ধার্থ গৌতম এবং তিনি একজন রাজপুত্র ছিলেন। তবে বুদ্ধ নামেই তিনি সুপরিচিত।