তাহের এক কেজি টক দৈ কিনেছে। পঁয়তাল্লিশ টাকা বের হয়ে গেছে। বুকের ভেতর খচখচ করছে। দৈ না কিনলেও হত। মিষ্টির দোকানের সামনে সিগারেট কিনতে না দাঁড়ালে হয়ত দৈ কেনা হত না। ম্যানিব্যাগে নতুন ৫০ টাকার নোটটা থাকত। এখন আছে একুশ টাকা।
দৈ কেনা হয়েছে সিরাজউদ্দিন সাহেবের জন্যে। তাহের ঠিক করেছে মতিঝিল যাবার পথে তার বাড়ি হয়ে যাবে। সম্পর্কটা ঝালিয়ে রেখে যাবে। কে জানে পারুলকে নিয়ে এই বাড়িতেই হয়ত উঠতে হবে। নীলা হাউস ছেড়ে তাদের যদি চলে আসতে হয় তাহলে যাবে কোথায়? যাবার একটা জায়গা তো লাগবে। নানান রকম সম্ভাবনা নিয়ে তাহের চিন্তাভাবনা করছে। তার একটা হল–মেসবাউল করিম সাহেবের কাছে সমস্যার কথাটা বলা। তাঁর এত বড় বাড়ি–তার এক কোণায় সে পারুলকে নিয়ে কবে। কিছু বোঝাই যাবে না। সিন্ধুতে বিন্দু। এতে তারও লাভ হবে। দুজনে মিলে ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। তিনি এই প্রস্তাবে রাজি না হলে তাহের তার চাকরির কথাটা তুলবে। তাহেরকে একটা ভদ্র চাকরি জোগাড় করে দেয়া তার কাছে কিছুই না। টেলিফোন তুলে দুটা কথা বললেই চাকরি হবে। তবে ক্ষমতাবান লোকদের সমস্যা হল তারা সহজে টেলিফোন তুলতে চান না।
তাহের সিরাজউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে ঢুকে হকচকিয়ে গেল। বাড়ি ভর্তি মানুষ। এক তলায় প্যান্ডেলের মত করা হয়েছে। হৈচৈ-এ কান পাতা যাচ্ছে না। ভিডিও ক্যামেরা কাঁধে এক ছেলে ঘুরছে। তার সাথে একজন লাইটম্যান।
সিরাজউদ্দিন সাহেব ইস্ত্রী করা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বসার ঘরে ইজিচেয়ারে কাত হয়ে আছেন। তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে–চুল কেটেছেন কিংবা চশমার ফ্রেম বদলেছেন। তাহেরকে দেখে তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, আসুন আসুন। আপনি দেরি করে ফেলেছেন।
তাহের হকচকিয়ে গেল। মামা তাকে চিনতে পারছেন না। এই কয়েক দিনে তাকে বেমালুম ভুলে যাওয়াটাও খুবই অস্বাভাবিক। তাহেরের ক্ষীণ সন্দেহ হল–মামা হয়ত তাকে ইচ্ছে করেই চিনতে পারছেন না। সে শুকনো মুখে বলল, মামা, আমি তাহের।
ভাল আছ বাবা?
জি মামা, ভাল–বাড়িতে কি কোন উৎসব?
মীনার গায়ে-হলুদ–বরপক্ষের এরা এক কাতল মাছ এনেছে, একান্ন কেজি ওজন–যাও মাছটা দেখে আস। মাছের সাথে ছবি তুলবে? ছবি তুলতে চাইলে তোল। ভিডিও করতে চাইলে ভিডিওওয়ালাদের বলো। ভিডিও করবে।
তাহের পুরোপুরি নিশ্চিত হল সিরাজউদ্দিন সাহেব তাকে চিনতে পারছেন না। একান্ন কেজি ওজনের কাতল মাছের প্রতিও সে আগ্রহ বোধ করছে না। ছবি তোলার তো প্রশ্নই আসে না …।
সিরাজউদ্দিন হাসিমুখে বললেন, জামাই কাস্টমে আছে কাঁচা পয়সা। কাঁচা পয়সা না থাকলে একান্ন কেজি ওজনের মাছ কেউ আনে? তুমি বস, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আমার একটা কাজ আছে মামা–পরে আসব।
আচ্ছা আচ্ছা।
মামা, আমাকে কি চিনতে পেরেছেন?
হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। চিনতে পারব না কেন?
পারুল এবং আমি অনেকদিন ছিলাম আপনার এখানে।
ও আচ্ছা। ভাল। খুব ভাল।
তাহের দৈ-এর হাড়ি নিয়েই বের হয়ে এল। বিয়ে বাড়ির এই হৈচৈ-এর মধ্যে এক হাড়ি টক দৈ রেখে আসার প্রশ্নই ওঠে না। এরা হাড়ি খুলেও দেখবে না। এরচে বরং পারুলকে দিলে কাজ হবে। দৈ-এ নিশ্চয়ই অনেক পুষ্টি আছে। এই সময় পুষ্টিকর খাবার দরকার।
মতিঝিল অফিসের ম্যানেজার রহমান সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে অনেকক্ষণ তাহেরর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হল সিরাজউদ্দিন সাহেবের মত তিনিও তাকে চিনতে পারছেন না।
স্যার, আমি তাহের। নীল হাউসের দেখাশোনা করছি।
কি চাই?।
বড় সাহেব কখন আসবেন এটা জানার জন্যে…
রহমান সাহেব চশমার ফাঁক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। হাতের ফাইলপত্র দেখতে লাগলেন। তার সামনে খালি চেয়ার আছে কিন্তু তিনি বসতে বলছেন না…।
কোন ফ্লাইটে আসছেন খবর পেয়েছেন স্যার?
ঘণ্টাখানিক পরে আস। হাতের কাজটা সেরে নেই। কাজের সময় তোমরা বিরক্ত কর। আশ্চর্য!
দৈ—এর হাড়ি হাতে নিয়ে এক ঘণ্টা বসে থাকা খুব সমস্যা। সমস্যা হলেই কি। বসে থাকতেই হবে। রহমান সাহেবের হাতে এমন কোন কাজ নেই যে, বড় সাহেব কোন ফ্লাইটে আসছেন এই বাক্যটা বলা যাবে না। হাজারো কাজের মধ্যেও বলে ফেলা। যায়। না বললে করার কিছু নেই। এক ঘণ্টা পরে যেতে বললে–এক ঘণ্টা পরেই যেতে হবে।
তাহের এক ঘণ্টা সাত মিনিট পর আবার ঢুকল। আবারও রহমান সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে চিনতে পারছেন না। এর মধ্যে ভুলে গেছেন।
কি ব্যাপার?
স্যার, বড় সাহেব কখন আসবেন?
বললাম না একটু পরে আসতে–কাজ করছি।
জি আচ্ছা, স্যার।
লাঞ্চের পরে আস।
জি আচ্ছা।
লাঞ্চের অনেক দেরি। এতক্ষণ তাহের কোথায় বসবে? রিসেপশনিস্টের ঘরে বসা যায়। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি অতিরিক্ত সুন্দর। এত সুন্দর মেয়ের সামনে মূর্তির মত দীর্ঘ সময় বসে থাকা যায় না। মেয়েটা কোন কথা বলে না। সবার দিকেই অবজ্ঞা এবং অবহেলার ভঙ্গিতে তাকায়। নিজের মনেই কিছুক্ষণ পর পর ভ্যানিটি ব্যাগ বের করে ঠোঁটে লিপিস্টিক দেয়।
তাহের দৈ—এর হাড়ি হতে রিসেপশনিস্টের ঘরে ঢুকল। মেয়েটা সরু চোখে বলল, কি ব্যাপার?
একটু বসব।
মেয়েটা অসম্ভব বিরক্ত মুখে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে লিপিস্টিক বের করছে।
তাহের মনে করতে পারছে না পারুল ঠোঁটে লিপিস্টিক দেয় কি না। মনে হয় দেয়। লিপিস্টিকের নিশ্চয়ই অনেক দাম। মেয়েটার গায়ে সবুজ শাড়ি। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপিস্টিক। সবুজ এবং লালে কি সুন্দর যে মেয়েটাকে লাগছে…।
এই যে, শুনুন।
তাহের মেয়েটির কথা শুনে এমন চমকে উঠল যে, কোল থেকে দৈ-এর হাড়ি পড়ে যাবার জোগাড় হল। মেয়েটি কঠিন গলায় বলল, আপনি এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন না। এটা অসভ্যতা। এখানে শুধু শুধু বসেই-বা আছেন কেন?
ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে একটা কথা আছে।
ক্যান্টিনে গিয়ে বসুন।
জ্বি আচ্ছা।
খুব অপমানিত বোধ করার কথা–তাহের বোধ করছে না। সম্ভবত তার গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গেছে। একবার চামড়া মোটা হতে থাকলে মোটা হতেই থাকে। এক সময় সেই চামড়া গণ্ডারের চামড়াকেও ছাড়িয়ে যায়। তাহেরের মনে হল–কিছুদিন পর কেউ অকারণে তার গায়ে থুথু দিলেও সে নির্বিকার থাকবে।
ক্যান্টিনে ঢুকে তাহের এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। চা জিনিসটা তার কাছে অসহ্য। অসহ্য হলেও খেতে হবে–শুধু শুধু তো ক্যান্টিনে বসে থাকা যায় না। মনে হচ্ছে আজও দেরি হবে। ভাত না খেয়ে পারুল অপেক্ষা করবে। খাওয়ার সময় পার হয়ে যাবে–আর কিছু খাবে না। অথচ এই সময়ই খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করা উচিত। তাহের চিন্তিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। পারুলের জন্যে হঠাৎ তার মনটা কেমন করছে। বাইরে বের হলে সচরাচর পারুলের কথা তার মনে পড়ে না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, তখন মনটা খুব অস্থির লাগে। তার খুব অস্থির লাগছে…
পারুল অনেকক্ষণ ধরে গোসলখানায়। গোসলখানাটা ছোট এবং স্যাঁতস্যাঁতে। মেঝেতে শ্যাওলা পড়ে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। অসম্ভব পিছল। পা টিপে টিপে হাঁটতে হয়। শরীরের এই অবস্থায় পা পিছলে পড়া বিপজ্জনক হবে। পারুল শ্যাওলা ধরা মেঝেতেই পা ছড়িয়ে বসেছে। তার সামনে গামলা ভর্তি পানি। মগে করে এক মগ পানি সে মাথায় ঢালল। শরীর কেঁপে উঠল। কি ঠাণ্ডা পানি। ঠাণ্ডার প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেলে হিমশীতল পানিতে নাওয়ার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই। এক পর্যায়ে নেশার মত লাগে। তবে গায়ে ভেজা কাপড় থাকলে হয় না ভেজা কাপড়ে শীত বেশি লাগে। বরফের মত ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে হয় সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। পারুল তার গায়ের কাপড় খুলে ফেলল। অন্ধকার বন্ধ গোসলখানা, নিজেকে দেখা যাবে এমন কোন আয়না পর্যন্ত নেই–এখানে নগ্ন হতে বাধা নেই। পারুল তার গায়ে পানি ঢালছে। তার। নেশার মত লাগছে। গামলার পানি শেষ হয়ে গেল। চৌবাচ্চায় পানি ভর্তি। চৌবাচ্চায় নেমে গেলে কেমন হয়? সারা শরীর ডুবিয়ে শুধু মাখাটা বের করে রাখবে। অনেক পানি। নষ্ট হবে–হোক না। পারুল উঠে দাঁড়াল আর তখনি তার বুকে একটা ধাক্কার মত লাগল। মনে হল কে যেন তাকে দেখছে। বাথরুমের কোন ফুটো, কোন ফাঁক-ফোকর দিয়ে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। পারুল চারদিকে তাকাল। না, কোথাও কোন ফুটো চোখে পড়ছে না। এটা নিশ্চয়ই তার মনের ভুল। কিন্তু তার শরীর ঝিম ঝিম করছে। কেউ একজন অবশ্যই তাকে দেখছে। পারুল কঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে?
কেউ জবাব দিল না। জবাব দেবার কথাও না। কেউ যদি ফুটোর ওপাশে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে সে চুপ করেই থাকবে। মনে মনে খিক খিক করে হাসবে–ডাকলে সাড়া দেবে না।
পারুল হাত বাড়িয়ে কাপড় নিল। নিজেকে ঢাকিল। তার এখন কান্না পাচ্ছে। চোখে পানি আসছে না, কিন্তু চোখ জ্বালা করছে। লজ্জা ও অপমানে শরীর কাঁপছে—শরীর অশুচি মনে হচ্ছে। পারুল গোসলখানা থেকে বের হয়ে এল। না, আশেপাশে কেউ ইি। হালকা পায়ের শব্দ কি পারুল পাচ্ছে? যেন কেউ একজন স্যান্ডেল পায়ে সরে যাচ্ছে। স্যান্ডেলের ফট ফট শব্দ।
বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে বা দিকের আম গাছের নিচে রাখা পাথরগুলির উপর বসে আছে কামরুল। সে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। কুকুর তিনটা আশেপাশে নেই। দিনের বেলা বেশির ভাগ সময়ই তারা বাঁধা থাকে। আজও মনে হয় বাঁধা।
পারুল তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল জড়াল। তারপর নেমে গেল বাগানে। তার পায়ে স্যান্ডেল। সে স্যান্ডেলে শব্দ করতে করতে এগুচ্ছে। তারপরেও কামরুল তার দিকে ফিরছে না।
শুনুন তো।
কামরুল তাকাল। টকটকে লাল চোখ। এই মানুষটার চোখ কি আগেও এমন লাল ছিল? পারুল লক্ষ্য করেনি।
আপনি একটু আগে কোথায় ছিলেন?
কামরুল তাকিয়ে আছে। জবাব দিচ্ছে না। তাকে খুব বিচলিতও মনে হচ্ছে না। মাশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খুটছে। কামরুল পিচ করে থুথু ফেলল। সেই আগের ত থুথু চোয়ালে লেগে আছে।
কথা বলছেন না কেন? একটু আগে আপনি কোথায় ছিলেন?
তা দিয়া তোমার কি দরকার?
দরকার আছে। আপনি কি বাথরুমের ফুটো দিয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করেছেন?
তোমায় দেইখ্যা আমার লাভ কি?
লাভ-লোকসানের কথা না–আপনি আমাকে দেখার চেষ্টা করেছেন কি না বলুন।
কামরুল আবার পিচ করে থুথু ফেলল। এবারের থুথু এসে পড়ল পারুলের পায়ের কাছে। সে এখনো নির্বিকার ভঙ্গিতে দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচাচ্ছে।
পারুল কি করবে? সে কি লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, না কি সে ফিরে যাবে নিজের ঘরে? দাঁত খুটাতে খুটাতে লোকটা নিজের মনে হাসছে। হাসির দমকে তার শরীর একটু কেঁপে উঠল। পারুলের সারা শরীর কাঁপছে। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সে সত্যি সত্যি লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। পারুল ফিরে যাচ্ছে ঘরের দিকে। সামান্য রাস্তা সে যেতে পারছে না। পা মনে হচ্ছে পাথরের মত ভারি। টেনে টেনে পা ফেলতে হচ্ছে।
কামরুল সত্যি সত্যি হাসছে। হাসির খিক খিক শব্দ আসছে। পারুল পেছনে ফিরল না। পারুল আবার বাথরুমে ঢুকে গেল। তার মুখ ভর্তি করে বমি আসছে। সমস্ত শরীর যেন কেমন করছে। সে কি মারা যাচ্ছে। শীত লাগছে। প্রচণ্ড শীত লাগছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে। গায়ে একটা ভারী কম্বল দিতে হবে। দরজা খুব শক্ত করে বন্ধ করতে হবে। আচ্ছা, কুকুর তিনটা কোথায়? ওরা কি তার বিপদে পাশে এসে দাঁড়াবে না? ওদের নামগুলি কি? নাম মনে পড়ছে না। একজনের নাম কি সে? উহুঁ, সেন্টু না। সেন্টু তার ফুপাতো ভাইয়ের নাম।
দরজায় টক টক শব্দ হচ্ছে। পারুল ভাবছিল লালটা বোধহয় স্বপ্নের মধ্যে হচ্ছে। না, স্বপ্ন না। এখন সে জেগে আছে। তার সারা গা ঘেমে আছে। ঘর অন্ধকার। মাথার উপর শোঁ শোঁ শব্দে ফ্যান ঘুরছে।
পারুল! পারুল। কি হয়েছে তোমার?
তাহেরের গলা। কতক্ষণ হল সে এসেছে? ঘর এমন অন্ধকার কেন? সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? ঘুমের মধ্যেই রাত হয়ে গেছে? কত রাত? পারুল ধড়মড় করে উঠে বসল, ক্ষীণ স্বরে বলল, কে?
আমি। আমি … কি ব্যাপার পারুল?
পারুল দরজা খুলল। তাহের উদ্বিগ্ন গলায় বলল, অসুখ-বিসুখ নাকি? অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পারুল বাতি জ্বালাল। সে এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হয়নি। এখনও নিজের কাছে সব এলোমেলো মনে হচ্ছে–এটা কাদের বাড়ি? তাদের নিজেদের? তাহের আবারও বলল, পারুল, কি হয়েছে?
কিছু না।
শরীর খারাপ?
হুঁ।
ভাত আছে? দুপুরে কিছু খাইনি–দারুণ খিদে লেগেছে।
পারুল নিজেকে সামলে নিয়েছে। দুপুরের ঘটনাটা সে অতি দ্রুত মাখা থেকে মুছে ফেলে স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে তাহেরের দিকে তাকিয়ে হাসল। সহজ গলায় বলল, ভাত ঠাণ্ডা কড়কড়া। গরম করলে খেতে পারবে না। পরোটা বানিয়ে দেই?
দাও। তোমার হাতে এটা কিসের হাড়ি–মিষ্টির?
টক দৈ।
টক দৈ কি জন্যে?
তাহের জবাব দিল না। হাত-মুখ ধুতে গেল। তার ভাত খেতেই ইচ্ছা করছে। খিদে যা লেগেছে তাতে ঠাণ্ডা-গরম কিছুই বোঝা যাবে না–পরোটা বানাতে দেরি হবে। হোক দেরি–পরোটা বানানোর সময় সে পাশে মোড়ায় বসে থাকবে–টুকটাক গল্প করবে। এও মন্দ না। স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে তার ভাল লাগে। সব সময় না—পারুল যখন কোন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে তখন পারুলের ব্যস্ত ভঙ্গির কাজকর্ম দেখতে তার ভাল লাগে কেন কে জানে।
পারুল ময়দা মাখছে। তাহের পাশে বসে আছে। ময়দা মাখার মত অতি সাধারণ একটা দৃশ্যও তার দেখতে ভাল লাগছে।
পারুল বলল, করিম ভাইয়া কবে আসছেন?
তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, করিম ভাইয়াটা কে?
মেসবাউল করিম, এই বাড়ির মালিক।
তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, তাকে করিম ভাইয়া বলছ কেন?
বয়সে বড়, এই জন্যেই বলছি।
সম্মানিত লোক, এদের নিয়ে ঠাট্টা-ফাজলামি করা ভাল না।
ভাইয়া ডাকছি। ঠাট্টা ফাজলামি তো করছি না। উনি কবে আসছেন?
বুঝতে পারছি না। মনে হয় না উনি আসছেন। উনি আসার আগে অফিসে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আজ দেখলাম অফিস ঠাণ্ডা।
কাউকে জিজ্ঞেস করনি?
ম্যানেজার সাহেবের কাছে তিনবার গেলাম। যতবার যাই উনি বলেন–পরে আস।
তোমাকে তুমি করে বলেন?
হুঁ।
পারুল হালকা গলায় বলল–তুমি করেই তো বলবে। বাড়ির দারোয়ানকে ম্যানেজার জাতীয় মানুষরা তুই করে বলে–তোমাকে তাও খানিকটা সম্মান দেখাচ্ছে।
তাহের চুপ করে আছে। গভীর মনোযোগে পরোটা ভাজা দেখছে। ভাজা পরোটার খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে–পারুলের কোন কথা এখন আর তার মাথায় ঢুকছে না।
ম্যানেজার সাহেব তোমাকে তাহলে কিছু বলেন নি?
না।
তার মানে হচ্ছে করিম ভাইয়ার প্রোগ্রামের পরিবর্তন হয়েছে। উনি আসছেন না। আসতে দেরি হবে। দুএকদিনের মধ্যে তার আসার কথা থাকলে ম্যানেজার সাহেব তোমাকে অবশ্যি জানাতেন। কারণ তোমাকে বাড়ি খালি করতে হবে…
কথাটা তো তুমি ভালই বলেছ।
ম্যানেজার সাহেবের নাম কি?
লুৎফুল কবীর। সিরাজগঞ্জ বাড়ি।
কবীর ভাইয়ার সঙ্গে তুমি কাল আবার দেখা করবে। আরো কতদিন তোমাকে বাড়ি পাহারা দিতে হবে জেনে আসবে। বাড়তি দিনগুলির জন্যে খরচ চাইবে। মনে থাকবে?
হুঁ।
পারুল তাহেরের খাওয়া দেখছে। গরম পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে। গরমের জন্যে ঠিকমত চিবুতেও পারছে না। গিলে ফেলছে। আহ, বেচারার এতটা খিদে লেগেছে।
তাহের বলল, একা একা সারাদিন ছিলে, ভয় লাগেনি তো!
ভয় লাগবে কেন?
আমি প্রায়ই একা এই বাড়িতে থাকতাম, তখন ভয় ভয় লাগত।
কিসের ভয়? ভূতের?
জানি না কিসের। কুকুর তিনটাকে বেশি ভয় লাগত–এরা ডেঞ্জারাস। একটা মানুষ মারল একবার।
বল কি। কবে?
গত বৎসর। দেয়াল টপকে চোর ঢুকেছিল। চোর বেচারা জানত না এমন ভয়ংকর কুকুর আছে। ঝপ করে নিচে পড়েছে, ওম্নি কুকুর তিনটা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিঁড়ে খুঁড়ে শেষ করে দিয়েছে। চিৎকার করারও সময় পায়নি।
এই নিয়ে কিছু হয়নি?
না। কি হবে? একটা মানুষ মারা গেছে এটা কেউ বুঝতেও পারেনি। বড় সাহেব পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাতের বেলা ডেডবডি পার করে দিলেন। টাকাওয়ালা মানুষদের কখনো কোন সমস্যা হয় না।
আরেকটা পরোটা ভেজে দেব, খাবে?
দাও।
রাতে তাহলে কিন্তু ভাত খেতে পারবে না।
থাক, আজ তাহলে পরোটাই খাই–রাতে টক দৈ খেয়ে শুয়ে পড়ব।
পারুল মাথা নিচু করে হাসছে। তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, হাসছ কেন?
মজার একটা কথা ভেবে হাসছি।
আমাকে বল, আমিও হাসি।
তোমার শুনে হাসি আসবে না। সবাই সব ব্যাপারে হাসে না। কেউ কেউ হাসির শুনে রেগে যায়। তুমিও এই কথাটা শুনে রেগে যাবে।
হাসির কথা শুনে রাগব কেন? এইসব তুমি কি বল? কথাটা কি?
কথাটা হচ্ছে–কুকুর তিনটাকে দিয়ে আমরা কিন্তু অনেক মজা করতে পারি। যেমন, প্রথমে ওদের দিয়ে কুকুরের সর্দার কামরুলকে মেরে ফেললাম। ইশারা করলাম, ওরা ছুটে গিয়ে কামরুলকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়ে ফেলল। তারপর খোঁজ নিতে এলেন ম্যানেজার সাহেব কবীর ভাইয়া–যে তোমাকে তুমি করে বলে, আবারও ইশারা করলাম, ওরা কবীর–ভাইয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাকেও খেয়ে ফেলল … এক সময় এলেন মহা ক্ষমতাবন মেসবাউল করিম। আমি আবারও…
চুপ কর তো।
পারুল হাসছে। শব্দ করে হাসছে। তাহের কঠিন গলায় বলল, হাসি বন্ধ কর।
পারুল চেষ্টা করেও হাসি বন্ধ করতে পারছে না। তার হাসি বেড়েই যাচ্ছে। সে কোন মতে বলল, বললাম না হাসির কথা শুনে তুমি রেগে যাবে। এই তো রেগে গেছ।
এর মধ্যে হাসির কি আছে?
অনেক কিছুই আছে।
তাহের চিন্তিত মুখে পারুলের দিকে তাকিয়ে আছে। পারুলের কি মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? অভাবে, দুঃখে, দুঃশ্চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে যাওয়া অসম্ভব না। এখনো হাসছে। মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে এখন অবশ্যি হাসি চাপা দেবার চেষ্টা করছে, পারছে না।
হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়েই হয়ত কুকুর তিনটা ছুটে এসেছে। লোহার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়েছে। তারাও তাহেরের মতই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। পারুল হাসি থামিয়ে কুকুর তিনটার দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে, তোরা কেমন আছিস? তোরা তো আর কথা বলতে পারিস না, লেজ নেড়ে বল, ভাল আছিস।
তিনজনই লেজ নাড়ছে। পারুল তাহেরের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল মুখে বলল, দেখছ, ওরা আমার কথা বুঝে। ওদের আমি যা করতে বলব তাই ওরা করবে। কিরে, তোরা আমার কথা শুনবি না?
কুকুর তিনটির ভেতর থেকে চাপা এক ধরনের শব্দ বের হল। তারা আবারও লেজ নড়ল। পারুল বলল, তোরা কিন্তু খাবি?
তাহের রাগী গলায় বলল, তোমার হয়েছেটা কি? তুমি কুকুরের সঙ্গে কথা বলছ কেন?
পারুল তাহেরের প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, আচ্ছা, এই তিন অতিথিকে কি খেতে দেয়া যায় বল তো? টক দৈ দেব? কুকুর কি টক দৈ খায়?
তাহের বিরক্ত গলায় বলল, টক দৈ খায় কি না জানি না, গু খেতে দেখেছি। টক দৈ খেতে কখনো দেখিনি।
পারুল উজ্জ্বল চোখে বলল, ওরা কি দুধ খায়? দুধ খেলে দৈও খাবে। কুকুরকে তুমি কখনো দুধ খেতে দেখেছ? আমি দেখিনি। আমি বিড়ালকে দুধ খেতে দেখেছি। বিড়াল যখন খায় তখন নিশ্চয়ই কুকুরও খাবে, তাই না?
বিড়াল খেলেই কুকুর খাবে এটা কেমন মুক্তি? কুকুর মানুষের গু খুব আরাম করে খায়। বিড়াল খায় না।
তুমি বার বার একটা বাজে প্রসঙ্গ টেনে আনছ কেন? চা খাবে?
না
এরকম রেগে গেলে কেন? খাও না একটু চা। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। জান, আজ সারাদিন আমিও কিছু খাইনি।
সে কি!
শরীরটা ভাল ছিল না।
তাহের উদ্বিগ্ন গলায় বলল, শরীর ভাল না থাকলেও খেতে হবে। তুমি না খেলে পেটে যে আছে সে পুষ্টি পাবে কোত্থেকে?
ওকে অভ্যস্ত করে দিচ্ছি, জন্মের পর তো ওকে খেয়ে না খেয়েই কাটাতে হবে। জন্মের আগেই অভ্যস্ত হয়ে পৃথিবীতে আসুক।
পারুল চায়ের কেতলি চাপিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাহের বলল, কোথায় যাচ্ছ?
ওদের জন্যে একটু টক দৈ নিয়ে আসি। চিনি মাখিয়ে দিলে ওরা নিশ্চয়ই খাবে। খাবে না?
তাহের কিছু বলল না। সে মোটামুটি নিশ্চিত পারুলের মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এ বাড়িতে তাকে আর রাখা যাবে না। অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হবে। কোথায় নিয়ে যাবে? গ্রামের বাড়িতে? বসতবাড়ি তো এখনো আছে। চারদিকে জঙ্গল-টঙ্গল হয়ে সাপখোপের আড্ডা হয়েছে। সাফ-সুতরা করে মোটামুটিভাবে বাসযোগ্য কি করা যাবে না?
বড় একটা বাটি ভর্তি টক দৈ নিয়ে পারুল কুকুর তিনটাকে খাওয়াচ্ছে। শুধু যে খাওয়াচ্ছে তাই না, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বিড় বিড় করে খুব নিচু গলায় কি বলছে। কি বলছে তাহের শুনতে পাচ্ছে না। পারুল কথা বলছে প্রায় ফিস ফিস করে। দৈ খেতে খেতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে তারা এমন ভঙ্গিতে পারুলকে দেখছে যে, তাহেরের মনে হল ওরা মন দিয়ে পারুলের কথা শুনছে।
তাহের কান পেতে আছে–পারুলের কথা শোনার চেষ্টা করছে। পারুল শুধু কথা বলছে তাই না–মাঝে মাঝে হাসছেও। আশ্চর্য কাণ্ড।
তোর কবিতা শুনবি? আমি একটাই কবিতা জানি–রবিঠাকুরের দুই বিঘে জমি। শুনবি? গোটা কবিটাই আমার মুখস্থ।
তাহের হতভম্ব হয়ে শুনছে সত্যি সত্যি পারুল বিড় বিড় করে কবিতা আবৃত্তি করছে। কুকুর তিনটাও মনে হচ্ছে আগ্রহ করে কবিতা শুনছে।