০৪. একটি নিরুদ্দেশের কাহিনী
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন গাছের পাতা ছিঁড়তে বা তার ডাল ভাঙতে আমরা খুব সতর্ক থাকতাম। কারণ সেই জন্ম থেকে শুনে আসছি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বলেছেন গাছের প্রাণ আছে, গাছও মানুষের মতো ব্যথা পায়। পৃথিবীর কত বিজ্ঞানীই তো কত কথা বলেছেন তাদের সবার কথাই যে এরকম বেদবাক্য হিসেবে নেয়া হতো তা নয়, কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর কথার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল, তার কারণ তিনি ছিলেন বাঙালি। শুধু যে বাঙালি তা নয়–তার জন্ম হয়েছিল আমাদের বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে। বড় হয়ে জানতে পেরেছি গাছের প্রাণ আছে কথাটি সত্যি কিন্তু মানুষের মতো গাছের স্নায়ু নেই, তাই সেটা ব্যথা পায় কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। সেই সময় প্রচলিত বিশ্বাস ছিল গাছের ভেতর তথ্যগুলো যায় রাসায়নিক বিক্রিয়া দিয়ে, জগদীশচন্দ্র বসু দেখিয়েছিলেন সেটা আসলে যায় বৈদ্যুতিক সংকেতের ভেতর দিয়ে। প্রায় একশ বছর আগে আমাদের দেশের একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে এরকম গবেষণা করে কিছু একটা বের করে ফেলা খুব সহজ কাজ ছিল না।
আমরা জগদীশচন্দ্র বসুর কথা মনে রেখেছি, বইপত্রে তার কথা পড়ি, তাকে নিয়ে আলোচনা করি, তার প্রধান কারণ তিনি একজন বাঙালি বিজ্ঞানী। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের তার কথা আলোচনা করার সে রকম কোনো কারণ নেই। কিন্তু 1998 থেকে হঠাৎ করে তার নামটা ঘুরেফিরে বিজ্ঞানী মহলে উঠে আসছে তার কারণ সেই বছর IEEE-এর প্রসিডিংয়ে একটা যুগান্তকারী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে রেডিও-এর প্রকৃত আবিষ্কারক মার্কোনি নন, রেডিও এর প্রকৃত আবিষ্কারক হচ্ছেন আমাদের মুন্সীগঞ্জের বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। মার্কোনিকে রেডিও-এর আবিষ্কারক বলা হয় কারণ 1901 সালে তিনি কোনো তার ছাড়া আটলান্টিক মহাসাগরের এক তীর থেকে অন্য তীরে প্রথমবার একটা সংকেত পাঠিয়েছিলেন। রেডিও বলতে আমরা আজকাল গান বা খবর শোনার জন্যে যে ছোট যন্ত্রটা বোঝাই, যেটা আমরা আমাদের পকেটে রেখে দিতে পারি, 1901 সালে সেটা মোটেও সেরকম কিছু ছিল না। সংকেতটা পাঠানোর জন্যে যে এন্টেনা ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা প্রায় দুইশ ফিট উঁচু ছিল, সেটাকে চালানোর জন্যে 25 কিলোওয়াট বিদ্যুৎ লাগত, ভেতরে যে ক্যাপাসিটর ছিল সেটা ছিল প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু!
সংকেতটাকে শোনার জন্যে যেটা ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা ছিল আরো চমকপ্রদ! প্রায় সাড়ে চারশ ফুট লম্বা একটা এন্টেনাকে ঘুড়ি দিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে সংকেতটাকে ধরতে হয়েছিল। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসা সেই ওয়ারলেস বা বেতার সংকেতটা ছিল খুব দুর্বল, তার জন্যে দরকার ছিল খুবই সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি। যদি সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি না থাকত তাহলে এই ঐতিহাসিক পরীক্ষাটা কখনোই করা সম্ভব হতো না। মার্কোনি এই সূক্ষ্ম পরীক্ষাটি করার জন্যে যে যন্ত্রটা ব্যবহার করেছিলেন সেই সময় তাকে বলা হতো কোহেরার (coherer)। তখন যে কোহেরার ব্যবহার করা হতো সেগুলো খুব ভালো কাজ করত না–একটা সংকেত পাওয়ার পরপরই কোহেরারকে ছোট হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে পরের সংকেত পাবার জন্যে প্রস্তুত করতে হতো। মার্কোনি তার পরীক্ষায় যে কোহেরার ব্যবহার করেছিলেন সেটাই ছিল রেডিও বা তারহীন সংকেত পাঠানোর প্রক্রিয়ার একেবারে মূল বিষয়। মার্কোনি কিংবা তার সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের কেউ কখনো ভুলেও স্বীকার করেন নি যে সেটা আসলে আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু! তাই বিজ্ঞানের জগতে রেডিও-এর আবিষ্কারক হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসুর পরিবর্তে মার্কোনির নামটা ঢুকে গিয়েছে।
মজার কথা হচ্ছে এর প্রায় দশ বছর আগে 1899 সালে লন্ডনের রয়েল সোসাইটিতে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু তার এই কোহেরারটি নিয়ে একটা নিবন্ধ পড়েছিলেন। তিনি যে যন্ত্রপাতিগুলো তৈরি করেছিলেন তার অনেকগুলোই কোলকাতার বোস ইনস্টিটিউটে রাখা আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মার্কোনির অনেক আগেই তিনি কোলকাতায় ওয়ারলেস বা বেতার দিয়ে সংকেত পাঠিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তা-ই যদি সত্যি হয় তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসে রেডিও-এর আবিষ্কারক হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসুর নাম নেই কেন? উত্তরটাও খুব সোজা, এর মূল সমস্যা হচ্ছে জগদীশচন্দ্র বসু নিজেই! 1901 সালে মার্কোনির ঐতিহাসিক পরীক্ষার পর জগদীশচন্দ্র বসু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠিটা পড়লেই কারণটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। মূল চিঠিটা সম্ভবত বাংলাতেই লেখা হয়েছিল, তার ইংরেজি অনুবাদ থেকে আবার বাংলায় অনুবাদ করা হলে সেটা হয় এ রকম :
“আমার বক্তৃতার কিছু আগে একটা খুব বিখ্যাত টেলিগ্রাফ কোম্পানির কোটিপতি মালিক আমার কাছে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানাল খুব জরুরি একটা ব্যাপারে সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি তাকে জানালাম আমার কোনো সময় নেই। উত্তরে সে বলল সে নিজেই চলে আসছে, সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে সে আমার সাথে দেখা করতে চলে এলো, হাতে একটা পেটেন্ট ফর্ম। সে এসে আমাকে সাংঘাতিকভাবে অনুরোধ করে বলল, আমি যেন আজকের বক্তৃতায় কিছুতেই আমার গবেষণার সব তথ্য সবাইকে জানিয়ে না দিই। সে বলল, “এর মাঝে অনেক টাকা! আমি তোমার জন্যে একটা পেটেন্ট করিয়ে দিই, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তুমি কী পরিমাণ টাকা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছ। ইত্যাদি ইত্যাদি”, মানুষটা অবশ্যই আমাকে জানিয়ে দিল, “আমি শুধু লাভের অর্ধেক টাকা নেব, পুরো খরচ আমার ইত্যাদি!” এই কোটিপতি মানুষটি আমার কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত জোড় করে এসেছিল শুধুমাত্র আরো কিছু টাকা বানানোর জন্যে। প্রিয় বন্ধু আমার, তুমি যদি শুধু এই দেশের মানুষের লোভ আর টাকার জন্যে লালসা একটিবার দেখতে! টাকা টাকা আর টাকা–কী কুৎসিত লোভ! আমি যদি একবার এই টাকার মোহে পড়ে যাই তাহলে কোনোদিন এর থেকে বের হতে পারব না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি যে গবেষণাগুলো করি সেগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়। আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে, আমি যা করতে চাই আজকাল সেগুলো করার জন্যেও সময় পাই না। তাই আমি মানুষটিকে সোজাসুজি না বলে বিদায় করে দিয়েছি।”
এটি হচ্ছে তাঁর চিঠিটার ভাবানুবাদ–পড়লেই বোঝা যায় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর টাকা বা নামের জন্যে কোনো মোহ ছিল না। তাই যে গবেষণার ফলাফল পেটেন্ট করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করা সম্ভব ছিল তিনি সেই ফলাফল রয়েল সোসাইটির মিটিংয়ে সবার সামনে ঘোষণা করে দিয়ে এলেন। অন্য অনেক কিছুর সাথে সেখানে দুই টুকরো ধাতব পাতের মাঝখানে খানিকটা পারদ রেখে তার একটি নূতন ধরনের কোহেরারের নকশা ছিল। মার্কোনি উদ্যোগী মানুষ–তিনি জগদীশচন্দ্র বসুর নকশার অতি সামান্য গুরুত্বহীন একটা পরিবর্তন করে সেটা পেটেন্ট করে ফেললেন। জগদীশচন্দ্র বসু কোহেরার ছিল ইংরেজি ইউয়ের (U) মতো, মার্কোনির কোহেরারটা সোজা–ভেতরে বাকি সব একরকম! সেই কোহেরার বের করে তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে প্রথম বেতার সংকেত পাঠিয়ে ইতিহাসে নিজের নামটি পাকা করে নিলেন।
1901 থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মার্কোনির যুগান্তকারী রেডিও বা বেতার তরঙ্গের পরীক্ষা আলোচনা করতে গিয়ে একবারও জগদীশচন্দ্র বসুর নামটি উচ্চারণ করেন নি! তখন সাদা চামড়ার মানুষেরা পৃথিবীর সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করে এরকম সময় বাদামি চামড়ার একজন বাঙালি বিজ্ঞানী রেডিও বা বেতার যোগাযোগের আবিষ্কারের সম্মানটুকু নিয়ে নেবেন সেটি কেমন করে হয়?
তাই প্রায় একশ বছর সেটি নিয়ে কোনো আলোচনা হয় নি। শেষ পর্যন্ত 1998 সালে বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘেঁটে নূতন করে সত্য উঘাটন করা হলো। পৃথিবীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন (IEEE) আই ট্রিপল ইয়ের জার্নালে পুরো ইতিহাসটা খুঁটিনাটিসহ ছাপা হয়েছে। প্রথমবারের মতো স্বীকার করে নেয়া হয়েছে জগদীশচন্দ্র বসু আবিষ্কৃত কোহেরার ব্যবহার করে মার্কোনি তার রেডিও যোগাযোগ করেছিলেন। তাই রেডিওর আবিষ্কারক এককভাবে মার্কোনি নন-রেডিওর আবিষ্কারক একাই সাথে আমাদের মুন্সীগঞ্জের বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু! বিষয়টি এখনো সব জায়গায় পৌঁছে নি, নূতন যুগ তথ্য বিনিময়ের যুগ, তাই শুধু সময়ের ব্যাপার যখন আমরা দেখব পৃথিবীর মানুষ রেডিও আবিষ্কারক হিসেবে মার্কোনির নাম উচ্চারণ করার আগে জগদীশচন্দ্র বসুর নাম উচ্চারণ করছে!
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু অনেক কিছুই করেছিলেন সবার আগে! সবাই কী জানে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সায়েন্স ফিকশান লিখেছিলেন তিনি? 1896 সালে তার লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশানটি প্রকাশিত হয়–শিরোনাম ছিল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’!
মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীর ইতিহাসে তার অবস্থানটি আবার খুঁজে বের করা সত্যিই বুঝি একটি নিরুদ্দেশের কাহিনী।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের আরো কিছু উপন্যাস আপলোড করুন