আমাদের বাসার একটি অলিখিত নিয়ম হচ্ছে—পুরুষরা আলাদা খাবে, মেয়েরা আলাদা। রাতের খাবার খেতে বসেছি। আমি, বাবা এবং মোজোভাই। বুনোভাই খবর পাঠিয়েছেন তিনি নিজের ঘরেই খাবেন। তাকে যেন খাবার পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভাগ্যিস মা এই হুকুম শুনতে পান নি। শুনতে পেলে হইচই বেঁধে যেত। বাধরুমে পড়ে গিয়ে মা কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। মুখে বলছেন তেমন কিছু না কিন্তু তার ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে অবহেলা করার মতো ব্যথা না।
খাবার-দাবার তদারক করছেন বড় আপা। আজকের সমস্ত রান্না তার। প্রতিটিতেই লবণ কম হয়েছে। এই খবরটা বললে, তিনি কেন্দেকেটে একটা কাণ্ড করবেন। আমরা কিছু বলছি না। শুধু বাবা বলে ফেললেন, বিনা লবণে রাধা ব্যাপারটা কী বল তো?
আপা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ইচ্ছে করে লবণ কম দিয়েছি।
ইচ্ছে করে কম দিবি কেন?
তোমার জন্যেই কম দিলাম। লবণ খেলে প্রেসার বাড়ে।
জিনিসটা মুখে তো দিতে হবে। ভাত খেতে বসেছি, ওষুধ তো খেতে বসি নি।
বড় আপার মুখ কালো হয়ে গেল। বাবা খাবার রেখে উঠে পড়লেন। এরকম তিনি কখনো করেন না। তাঁর আজ মনটা ভালো নেই। বড় আপা থমথমে গলায় বললেন, বস, ডিম ভেজে দিচ্ছি।
বাবা বসলেন না। হনাহন করে চলে গেলেন। মেজোভাই হাসিমুখে বলল, আমার কাছে তো লবণ পারফেক্ট বলে মনে হচ্ছে। এমন চমৎকার একটা তরকারি বাদ দিয়ে ডিম দিয়ে ভাত খাব? বড় আপা বললেন, রঞ্জু, তোর কাছেও কি লবণ কম মনে হচ্ছে? আমি হাসিমুখে বললাম, না, তো। ঠিকই তো আছে।
তাহলে বাবা এরকম করল কেন?
বাবার শরীর ভালো না।
বড় আপা চিন্তিত স্বরে বলল, আসলেই তাই। কাল রাতে রিমিকে বাথরুম করাতে নিয়ে যাচ্ছি— দেখি বারান্দায় একটা মোড়ার উপর বাবা চুপচাপ বসে আছেন। আমি বললাম, এখানে বসে আছ কেন? বাবা বিড়বিড় করে কী-সব বলল, বুঝলামও না। তরকারিটা ভালো হয়েছে?
অসাধারণ!
রংটা সুন্দর হয়েছে। কেমন টকটকে লাল। কীভাবে হল বল তো?
জানি না। কীভাবে?
রান্না শেষ হবার পর আধ চামচ ফুড কালার দিয়েছি। তোর দুলাভাই ব্যাংকক থেকে এনেছিল। আধ চামচ দিলেই রক্তের মতো লাল হয়ে যায়।
আমি বললাম, রক্তের মতো লাল হওয়াটা কি ভালো? মনে হবে না রক্ত খাচ্ছি?
দূর পাগলা।
পরিবেশ হালকা হয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে নীতু এসে খেতে বসল। বিকেলেই নীতুর সঙ্গে মেজোভাইয়ের কঠিন ঝগড়া হয়েছে–সেই ঝগড়ার কথা এখন আর নীতুর মনে নেই। এই বয়সী মেয়েদের মন নদীর পানি মতো। কোনো কিছুই এরা জমা করে রাখে না। ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নীতু বেশ হাসিমুখে মেজো ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছে।
ভাইয়া, তোমার এক নম্বর বান্ধবীর সঙ্গে আজ দেখা— শ্ৰাবণী। ফুটপাতের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফুটপাতের দোকানগুলোতে ছিট কাপড় দেখছিল।
তাই নাকি?
আমার একটা অবজারভেশন কি জানি ভাইয়া? আমার অবজারভেশন হচ্ছে ফুটপাতে সবচে বেশি ঘোরাঘুরি করে বড়লোকেরা। এটা এদের এক ধরনের ফ্যাশন।
হতে পারে।
আমি উনাকে বললাম, কী, ভালো আছেন? মনে হল চিনতে পারল না। বড়লোকদের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল হয়। ইস, কী কুৎসিত রং হয়েছে তরকারিটার! মনে হচ্ছে রেড পেইন্ট খাচ্ছি।
মেজোভাই চোখের ইশারায় নীতুকে থামিয়ে দিলেন। ভাগ্যিস, বড় আপা সামনে নেই। নীতু নিচু গলায় বলল, ভাইয়া, তোমরা এই তরকারি খাচ্ছ কী করে? লবণ তো একেবারেই নেই।
চুপ করে খা।
নীতু মুখ বেজার করে খেতে শুরু করল। মেজোভাই বললেন, একটা খবর দিয়ে তোদের আজ চমৎকৃত করে দিতে পারি।
নীতু বলল, কোনো খবরেই আমি চমৎকৃত হব না।
এটা শুনলে চমকে যাবি। আমি তানিয়াদের বাসায় গিয়েছিলাম। নীতু সত্যি সত্যি চমকাল। মেজোভাই বললেন, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে যাই নি, জাস্ট সােস্যাল ভিজিট। ঠিকানাটা ছিল। ঐদিকে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম …নীতু হেসে ফেলল।
মেজোভাই বলল, হাসলি যে?
অন্য অথা ভেবে হেসেছি। তোমার সোস্যাল ভিজিটের সাথে আমার হাসির কোনো সম্পর্ক নেই। তানিয়ার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?
হ্যাঁ।
কী কথা জানতে পারি?
তেমন স্পেসিফিক কোনো কথা না–তবে যা বুঝতে পারলাম, তা হচ্ছে এই মেয়ের প্রচুর টাকা। বুনোভাই বলছিল, এদের হাতে টাকা-পয়সা নেই। যা ছিল বাপের চিকিৎসায় সব শেষ হয়েছে। এটা ঠিক না। এই বাড়ি ছাড়াও তাদের আরো একটা বাড়ি আছে–গুলশানে। সেই বাড়ি থেকে ভাড়াই আসে মাসে ত্ৰিশ হাজার।
ভালো কথা।
আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে–বুনোভাইয়ের ধারণা ঠিক না। বুনোভাইয়ের ধারণা— এই বাড়ি মেয়েটা তার বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য দিয়েছে এবং দিয়ে কষ্টে পড়েছে। দ্যাটস নট ট্রু।
তোমার কি ধারণা মইনুদিন চাচা আমাদের উপহার দেবার জন্যে এ বাড়ি বানিয়েছিলেন?
হতে পারে। সম্ভাবনা উড়িয়ে দেবার মতো না। বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দীর্ঘদিন আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। এই সব কথা মনে করে…।
নীতু হাসল। হাসতে হাসতে বলল— বাড়ি বাড়ি করে তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মাথা এলোমেলো হবে কেন? পুরো ব্যাপারটা অ্যানালিসিস করছি।
তানিয়া কি তোমাকে চা-টা খাওয়াল?
খাওয়াবে না কেন? চমৎকার মেয়ে। এ দেশে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। গুলশানের বাড়ি বিক্রি করার কথা বলছিল, তার থেকে মনে করছি দেশে থাকবে না। ভদ্রলোকরা আজকাল আর দেশে থাকে না। আমি অবশ্যি সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করি নি।
তুমি এক কাজ কর ভাইয়া, শ্রাবণীর পেছনে পেছনে না ঘুরে এই মেয়ের সঙ্গে ভাব কর।
মেজোভাই রাগী গলায় বললেন, ফাজলামি করছিস নাকি? নীতু হাসিমুখে বলল, হ্যাঁ ফাজলামি করছি। চট করে রেগে যাবার মতো কিছু অবশ্যি করি নি। আর তুমি যদি রেগে যাও সেটাও তোমার জন্য খারাপ হবে। আমি এমন সব কথা বলব যে সহ্য করতে পারবে না। আমি যেমন ফাজলামি করতে পারি, তেমনি কঠিন কথাও বলতে পারি।
আমি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। তারা দুজনে দুজনের দিকে তীব্ৰ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কেউ দৃষ্টি নামিয়ে নিচ্ছে না। এ যেন চেয়ে থাকার একটা প্ৰতিযোগিতা। যে প্রথম চোখ নামিয়ে নেবে সে হেরে যাবে। মেজোভাই হেরে গেলেন। তিনিই প্রথম চোখ নামিয়ে নিলেন। নীতু বিজয়ীর ভঙ্গিতে বসে আছে।