০৪. একজন মানসিক রোগীর গল্প

একজন মানসিক রোগীর গল্প কেউ মাথায় নিয়ে বসে থাকে না। আমি নিজেও থাকলাম না। আমার স্মৃতিতে নলিনী বাবু চমৎকার একজন ব্লাঁধুনি হিসেবে থেকে গেলেন। কোথাও ভালো কোনো খাবার খেলে নিজের অজান্তেই বলি, বাহ্ নলিনী বাবুর রান্না।

তাঁর লিখে রেখে যাওয়া বত্রিশটি সংস্কৃত শোকের খাতা মাঝে মধ্যে দেখি, লেখালেখিতে কোনোটার ব্যবহার করা যায় কি না। কোনোটাই ব্যবহার করতে পারিনি। তবে সংস্কৃত শ্লোকের পাশে লেখা নলিনী বাবুর টীকা পড়ে মজা পেয়েছি। শ্লোকের চেয়ে টীকাগুলি মজার। উদাহরণ

শ্লোক

অধরে স্ব মৃতং হি ঘোষিতীং
হৃদি হলাহলমেব কেবলম

অর্থ

রমণীদিগের অধরে অমৃত
কিন্তু হৃদয়ে শুধুই হলাহল বিষ।

টীকা

ভুল শ্লোক। মেয়েদের এই শ্লোকে
ছোট করা হয়েছে। তাছাড়া যার মুখে
অমৃত তার অন্তরেও থাকবে অমৃত।
হৃদয়ের অমৃতই মুখে আসে। যার
হৃদয় হলাহলপূর্ণ, তার অধরে
হলাহল থাকবে। উদাহরণ আমার
বাবা শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য। (দুঃখ জগতের বাবা)

শীতকালের এক সন্ধ্যায় অবসর প্রকাশনীর মালিক, আমার পুরানো বন্ধুদের একজন উত্তরার বাড়িতে আমাকে দেখতে এলেন। তাঁর প্রকাশনা থেকে রানার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বইটি সঙ্গে করে এনেছেন। নানান কথাবার্তা হচ্ছে প্রকাশকের বই প্রকাশ নিয়ে বিড়ম্বনার কথা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, আপনার কি মিরপুরের কথা মনে আছে। কি বিপাকেই না পড়েছিলাম।

মিরপুরের ঘটনা মনে পড়ল। একই সঙ্গে নলিনী বাবুও প্রবলভাবে ফিরে এলেন। কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত।

 

আমি তখন শহীদুল্লাহ হলে থাকি। হাউস টিউটর। একের পর এক বই লিখে যাচ্ছি। নিষাদ নামে একটা সায়েন্স ফিকশন এই সময়ে লেখা। বিষয়বস্তু একটি যুবক একই সঙ্গে দুই জগতে বাস করছে। Parallel Universe কনসেপ্টের সায়েন্স ফিকশন। তখন খবর পেলাম মিরপুরের একটি মেয়ে এই বইটি পড়ার পর ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছে। সে দাবি করছে, দুটি জগতে সে ঘোরাফেরা করছে। সাতদিন পার হয়েছে সে অঘুমী। ডাক্তাররা ঘুমের ইনজেকশন দিয়েও তাকে ঘুম পাড়াতে পারছেন না। ডাক্তার বলেছেন, বইটির লেখক উপস্থিত হলে তিনি এই জটিল সমস্যার সমাধান হয়তো দিতে পারবেন।

আমি একা উপস্থিত হওয়ার সাহস করলাম না। চার-পাঁচজনের একটা দল নিয়ে উপস্থিত হলাম। দলে আছেন অবসর প্রকাশনীর মালিক আলমগীর রহমান, দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরী, বাংলা একাডেমীর একজন কর্মকর্তা ওবায়দুল ইসলাম।

বাসায় পৌঁছে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। ষোল-সতেরো বছরের এক তরুণী। তার চোখ রক্তবর্ণ। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। তাকে ঘিরে আছে আত্মীয়-স্বজন এবং ডাক্তার। মেয়েটার পুরোপুরি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত অবস্থা। সে (তার নাম এখন আর মনে করতে পারছি না) আমাকে দেখে বিড়বিড় করে বলল, আপনি আমাকে বাঁচান। মেয়েটার বাবা সম্ভবত একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি আমাকে দুঃখিত গলায় বললেন, এসব কী লেখেন। কেন লেখেন?

মেয়ের বাবা এবং আত্মীয়স্বজনের সামনে নিজেকে খুবই অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি বইটি লিখে বিরাট অপরাধ করেছি। আলমগীর রহমান ভীতু প্রকৃতির মানুষ। বইটির প্রকাশক হিসেবে তার নাম চলে আসে কি-না এই ভেবেই হয়তো বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দা এবং উঠান ভর্তি পাড়ার ছেলেপুলে। তাদের দেখে তিনি শুকনা মুখে আবার ঘরে ঢুকলেন।

আমি মেয়েটিকে বললাম, তুমি শান্ত হও। আমি বইয়ে যা লিখেছি সবই লেখকের কল্পনা। জগৎ একটাই। তুমি ভিন্ন ভিন্ন জগতে যাওয়া-আসা করছ, তা তোমার কল্পনা।

মেয়েটি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি যা দেখছি সবই সত্য। আমি কেন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলব। আমার লাভ কি?

মেয়ে কঁদছে, মেয়ের মা কাঁদছেন। বিশ্রী অবস্থা।

সেই রাতেই মেয়েটিকে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তাকে পেথিড্রিন ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হলো। সপ্তাহখানেক চিকিৎসার পর তার অবস্থা কিছুটা ভালো হলে আমি তাকে দেখতে গেলাম। দুই জগতে সে কী দেখেছে তা ভাঙা ভাঙাভাবে কিছুটা শুনলাম।

তার দ্বিতীয় জগৎটায় আলো অনেক বেশি। সবাই হাসি-খুশি। সেই জগতেও একজন হুমায়ূন আহমেদ আছে। এবং সেই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে মেয়েটা নাকি বিশেষভাবে পরিচিত। দ্বিতীয় জগতের হুমায়ূন আহমেদের বয়স কম, এবং অবিবাহিত।

মেয়েটির কথাবার্তা থেকে আমার মনে হলো লেখকের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হবার প্রবল বাসনাই তার মধ্যে দ্বিতীয় জগতের বিভ্রম তৈরি করেছে।

তারপর বহু বছর কেটেছে। আমি নলিনী বাবুর দেখা পেয়েছি। বিস্ময়ের কথা হলো, তিনিও নিষাদ বইটা পড়েছেন। এখানে মিরপুরের মেয়েটির সঙ্গে নলিনী বাবুর কিছু অমিল আছে। মিরপুরের মেয়ে নিষাদ পড়ার পর দ্বিতীয় জগতে গেছে। নলিনী বাবু দ্বিতীয় জগৎ ঘুরে আসার অনেক পরে নিষাদ বইটি পড়েছেন। তাঁর এক ছাত্রী তাঁকে বইটি পড়তে দিয়েছিল। ছাত্রীর নাম সুলতানা বেগম, দশম শ্রেণী, খ শাখা। বিজ্ঞান বিভাগ। মিসির আলির কাছ থেকে তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানার কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। আমি ঠিক করলাম, নীলগঞ্জ যাব। নলিনী বাবুকে খুজে বের করব। তার সঙ্গে কথা বলব, তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বাবুকে খুঁজে বের করব। তার সঙ্গে কথা বলব, তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলব। তার সম্পর্কে যা জানার সব জানব।

যা ভেবেছি তা করা হলো না। আমরা অতি ব্যস্ত এক জগতে বাস করি। নিজের প্রয়োজনের বাইরে সময় বের করা হয়ে ওঠে না। এক সময় নলিনী বাবুর কথা ভুলেই গেলাম। না ভুলে উপায়ও ছিল না। আমি তখন চন্দ্র-কথা নামে নতুন এক ছবিতে হাত দিয়েছি। অর্থের জোগান নেই। গল্প-উপন্যাস লিখে বাড়তি টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করি। টাকার অভাবে ছবি বন্ধ হবার জোগাড়। মহাচিন্তায় আমি অস্থির। নলিনী বাবু আমার ব্যক্তিগত চিন্তার কুয়ায় পড়ে পুরোপুরি ডুবে গেলেন। প্রকৃতি তখন ছোট্ট একটা খেলা খেলল।

প্রকৃতির খেলা ব্যাখ্যা করার আগে জল-বিলাস প্রসঙ্গে বলে নেই। জল-বিলা আমার বজরার নাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজরায় চড়ে পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়াতেন। নদীর উপর রাত্রি যাপন করতেন। রবীন্দ্রনাথ হওয়া সম্ভব না, তবে তার অনুকরণ করা সম্ভব। আমি বজরা বানালাম। নাম দিলাম জল-বিলাস। নুহাশ পল্লীর পাশের খালে বজরা ভাসানো হলো। খাল দিয়ে কিছু দূর গেলেই হাওরের মতো জায়গা পড়ে। হাওরের নাম লবণদহ। আমি ঠিক করলাম বইপত্র নিয়ে বজরায় দিন যাপন করব।

বজরার ডিজাইন করল এফডিসির সেট ডিজাইনার কুদুস। আধুনিক বজরা। ছোট জেনারেটর আছে। জেনারেটরের কারণে ফ্যান চলে, বাতি জ্বলে। টয়লেটে কমোড বসানো। বজরার ছাদে চেয়ার পাতা। মোটামুটি রাজকীয় ব্যবস্থা।

আমি মহাউৎসাহে বজরায় ঘুরে বেড়াই। নিজেকে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ মনে হয়। প্রায়ই এমন হয়েছে যে ঝুম বৃষ্টি, আমি বজরার জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনছি।

আমি কান পেতে রই আমার আপন
হৃদয় গহন দ্বারে
কোন গোপন বাসীর কান্নাহাসির
গোপন কথা শুনিবারে।
ভ্রমর সেথায় হয় বিবাগি
নিভৃত নীলপদ্ম লাগিরে
কোন রাতের পাখি গায় একাকী
সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে।

এই একটি গানই বারবার শুনা হয়, কারণ আমি নিজে তখন সঙ্গীবিহীন অন্ধকারেই বাস করছি। আমাকে নিয়ে কিছু কিছু পত্রিকা সেই সময় বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত করছে। আমাকে এবং গায়িকা-অভিনেত্রী শাওনকে নিয়ে উদ্ভট সব কথাবার্তা ক্রমাগত ছাপিয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তার নমুনা–হুমায়ুন আহমেদ শাওনকে উত্তরার একটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। শাওন সেখানে তাঁর শিশুপুত্র নিয়ে বাস করেন। মাঝে মাঝে হুমায়ূন আহমেদ সেখানে রাত্রি যাপন করতে যান। উল্লেখ্য, শিশুপুত্রটি হুমায়ূন আহমেদের ঔরসজাত, যদিও তিনি শাওনকে বিবাহ করেননি।

আমেরিকার একটি বাংলা পত্রিকায় উত্তরার সেই বাড়ি এবং বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা কুচকুচে কালো এক ছেলের ছবিও ছাপা হলো। ছেলেটি দাঁত বের করে হাসছে। তার গায়ের গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণের কারণে দাঁত ঝকঝকে সাদা দেখাচ্ছে।

একটি পত্রিকা আমার মেজ কন্যা শীলার একটা ইন্টারভিউ ছাপাল। শিরোনাম–শীলা হুমায়ূন আহমেদকে একবারও বাবা সম্বোধন করেননি।

আমি প্রতিবাদ করে লেখা ছাপাতে পারতাম, উকিল নোটিশ পাঠাতে পারতাম। কেন জানি কিছুই করতে ইচ্ছা করল না। তার একটি কারণ, আমার সংসার টিকেনি এটা সত্য এবং আমি অতি অল্পবয়সী শাওনের প্রেমে পড়েছি এটাও সত্যি।

আমি যা করলাম তা হলো নিজেকে গুটিয়ে নেয়া। বৈরী সময়ে শামুক নিজেকে খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে, আমার জল-বিলাস হলো আমার খোলস। খোলসের ভেতর দিন এবং রাত্রি যাপন। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া এবং লেখালেখির চেষ্টা।

প্রস্তাবনা শেষ হয়েছে এখন প্রকৃতির বিশেষ কাণ্ডটি বলি। আষাঢ় মাসের শেষ দিকের কথা। লবণদহে প্রচুর পানি। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। বজরার মাঝিকে বললাম, জল-বিলাসকে সুবিধাজনক কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে। আজ রাতে বজরায় নিশি যাপন করব। একটা পর্যায়ে বাতি নিভিয়ে শরৎচন্দ্রের মতো আঁধারের রূপ দেখব।

মাঝিরা তাই করল। লবণদহের মাঝামাঝি বজরা নিয়ে খুঁটি গাড়ল। আমি বাতি নিভিয়ে দিলাম। এক সময় প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। সঙ্গে বাতাসও আছে। নৌকা দুলছে। আমার ভয় ভয় করতে লাগল। আমি বললাম, রাতে ডাকাত ধরবে না তো?

মাঝি বলল, স্যার ধরতেও পারে। এই হাওরে পেরায়ই ডাকাতি হয়।

প্রায়ই ডাকাতি হয় তাহলে এখানে বজরা এনেছ কেন?

আপনে বলছেন বইল্যা আনছি। নিজ ইচ্ছায় আনি নাই।

আমি বললাম, বজরা ফিরিয়ে নিয়ে চলো। নুহাশ পল্লীর কাছে নিয়ে খুঁটি পোঁত। ডাকাতের হাতে পড়া কোনো কাজের কথা না।

ইঞ্জিনের বজরা। ইঞ্জিনে বাতাস ঢুকেছে বলে স্টার্ট নিচ্ছে না। শেষটায় মাঝিরা লগি এবং বৈঠা নিয়ে যাত্রা শুরু করল। সাপে বরের মতো হলো। ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজ থেকে মুক্তি। জল-বিলাসের ছাদে বৃষ্টি পড়ছে। অপূর্ব সঙ্গীতের মতো শুনাচ্ছে। আমি গায়ে চাদর দিয়ে বসে আছি। বৃষ্টি সঙ্গীত শুনছি। আমার সামনে কাগজ-কলম। বজরার ভেতর দুটা হারিকেন জ্বলছে। অন্য রকম পরিবেশ হয়তো আমার মধ্যেই ঘোরের মতো তৈরি করল। আমি একটা গান লিখে ফেললাম। এর অনেক দিন পর শাওন গানটি রেকর্ড করেছে। গানটি উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।

যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে… (ইত্যাদি)

গান রচনা শেষ করে কখন বিছানায় শুয়েছি আর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কিছুই মনে নেই। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে সব কিছু বদলে যায়। বজরাটা বদলে গেল। আমি দেখলাম অতি আধুনিক একটা স্টিলবডির জলযানে আমি বসে আছি। জলযান তীব্র গতিতে ছুটছে। আমার পাশে ছয়-সাত বছরের একটি বালিক। আমাদের দুজনের গায়েই লাইফ জ্যাকেট বাঁধা। আমাদের সামনে বসে আছেন নলিনী বাবু। তার পরনেও লাইফ জ্যাকেট। নলিনী বাবুর হাতে একতাড়া কাগজ। আমাদের জলযান (বড় স্পিডবোটের মতো। স্পিডবোট চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক বিদেশি। তার চোখে কালো চশমা। লাল হাফপ্যান্ট পরা। খালি গা।)

দৃশ্য রাতের না। দিনের। যতদূর চোখ যায় ঘন নীল জলরাশি। আমার পাশে বসা বাচ্চা মেয়েটির হাতে পেনসিল। সে পেনসিল দিয়ে ছবি আঁকছে। আমি মেয়েটিকে চিনতে পারছি না।

মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা! আমি মার কাছে যাব।

মেয়েটি আমাকে বাবা কেন ডাকছে বুঝতে পারছি না। অতি রূপবতী এই বালিকা আমার অপরিচিত। নলিনী বাবু বললেন, মা আমরা তোমার মার কাছেই যাচ্ছি।

মেয়েটি বলল, তুমি কথা বলবে না। আমি পেনসিল দিয়ে তোমাকে খোচা দেব।

নলিনী বাবু বললেন, আমাকে কেন খোচা দিবে? মেয়েটি বলল, পেনসিল দিয়ে খোঁচা দিতে আমার ভালো লাগে।

স্বপ্ন দৃশ্য ছাড়াছাড়া হয়। আমি যা দেখছি তা ছাড়াছাড়া কিছু না। মানুষ তার স্মৃতিতে সঞ্চিত জিনিসই স্বপ্নে দেখে এবং স্বপ্ন হয় সাদাকালো। আমি রঙিন স্বপ্ন দেখছি এবং আমার স্মৃতিতে বাচ্চা মেয়েটি অবশ্যই নেই। তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি।

নলিনী বাবু বললেন, আমি আপনার জন্যে কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছি। আমি অন্য ভুবন থেকে এসেছি। আমি আপনার পরিচিত নলিনী বাবু B.Sc না। আমি পার্টিক্যাল ফিজিক্সে Ph.D করেছি। কিছু কাগজপত্র আমি আপনাকে দেব। আপনি কাগজপত্রগুলি শার্টের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবেন। যাতে এগুলি থেকে যায়। বুঝতে পারছেন?

আমি বললাম, না। কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু আমি একটা বিচিত্র স্বপ্ন দেখছি এটা বুঝতে পারছি।

নলিনী বাবু বললেন, আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। আমি প্যারালাল ওয়ার্ল্ড থেকে এসেছি। দুটা জিনিস আপনাকে বুঝাব। একটা হলো Borrormeen ring. তিনটা রিং একত্র করা। এটা হলো টপলজিক্যাল একটা গিফ্ট। একটা রিং খুললেই তিনটা আলাদা হয়ে যাবে।

আরেকটা ইচ্ছে Hopf ring. এর একটা খুললে দুটা আটকে থাকবে। আলাদা হবে না। বুঝতে পারছেন? আমি এঁকে দেখাচ্ছি। খুকি তোমার পেনসিলটা দাও।

বাচ্চা মেয়েটা বলল, আমি পেনসিল দিব না। আমি পেনসিল দিয়ে খোঁচা দেব।

নলিনী বাবু বললেন, আপনি কাগজগুলি রাখুন। এখানে entanglement সম্পর্কে সুন্দর করে বলা আছে। সহজ কথায় entangleinent হচ্ছে দুটি Particle-এর মাঝখানের দূরত্ব এক মিলিয়ন বা এক বিলিয়ন মাইল হলেও এরা অতি রহস্যময়ভাবে একে-অন্যের সঙ্গে যুক্ত। একটির কোনো পরিবর্তন হলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যটিরও পরিবর্তন হবে। আমি মূলত স্পিন পরিবর্তনের কথা বলছি। হাতে সময় নেই। কাগজগুলি রাখুন।

আমি কাগজ হাতে নিলাম।

শার্টের ভেতর কাগজগুলি ঢুকিয়ে চাদর মুড়ি দিন। এবার কুকুর কুণ্ডলী হয়ে শুয়ে থাকুন, যেন কাগজ চলে না যায়।

আমি তাই করলাম আর তখনই বিকট বজ্রপাতে ঘুম ভাঙল। জেগে উঠে দেখি আমি বজরায় আমার ঘরে শুয়ে আছি। বজরা নুহাশ পল্লী ঘাটে বাঁধা। মাঝি বলল, স্যার কি জাগনা?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

ঠাড়া কেমন পড়ছে দেখছেন। আরেকটু হইলে বজরায় ঠান্ডা পড়ত। পুইড়া কইলা হইতাম।

আমি বললাম, চা করো। চা খাব। চা খেয়ে নুহাশ পল্লীতে চলে যাব। বজায় থাকব না।

মাঝি চা বানাচ্ছে। আমি স্বপ্ন নিয়ে ভাবছি। স্বপ্ন হচ্ছে Short time memory. কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বপ্নে কি দেখেছি তা ভুলে যাব। আমার উচিত স্বপ্নের সব খুঁটিনাটি লিখে ফেলা। লিখতে ইচ্ছা করছে না। স্বপ্নে একগাদা কাগজ বুকের ভেতর নিয়ে শুয়েছিলাম। জেগে কোনো কাগজ পেলাম না। পাওয়ার কথাও না। কাগজ খুঁজেছি এটাই হাস্যকর।

স্বপ্নের একটা ব্যাখ্যা আমি দাঁড়া করলাম। নর্থ ডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন Ph.D করি তখন আমার সহপাঠী রালফ নামের এক আমেরিকান ছাত্রের সঙ্গে পালতোলা নৌকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী এবং বাচ্চা একটা মেয়ে। আমেরিকান পালতোলা নৌকা বাতাস পেলে তীব্র গতিতে ছুটে। ঘন নীল পানিতে আমরা ছুটছিলাম তীব্র গতিতে। আমাদের সবার গায়ে লাইফ জ্যাকেট ছিল। রালফ নৌকার পাল ধরেছিল, সে ছিল খালি গায়। তার পরনে ছিল লাল প্যান্ট।

আমার স্বপ্নে দেখা জলযান রালফের পালতোলা নৌকা। এবং বাচ্চা মেয়েটি হচ্ছে রালফের মেয়ে। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে আমার হয়তো মনে হয়েছিল, ইশ এ রকম একটা রূপবতী কন্যা যদি আমার থাকত! প্রকৃতি দীর্ঘদিন পর স্বপ্নের মাধ্যমে আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে।

নলিনী বাবুর ব্যাপারটা শুধু পরিষ্কার হচ্ছে না। হয়তো অবচেতন মনে তিনি আছেন বলেই স্বপ্নে ধরা দিয়েছেন।

আমি বিজ্ঞানের বই সময় পেলেই পড়ি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমার প্রিয় বিষয়। Entenglement নিশ্চয়ই সেখান থেকেই আছে।

স্বপ্নের ব্যাপারটা পুরোপুরি যুক্তির ভিতর নিয়ে আসার পরেও নলিনী বাবু গলায় মাছের কাঁটার মতোই অস্বস্তি নিয়ে বিঁধে রইল। আমি এক সন্ধ্যাবেলা ঠিক করলাম নলিনী বাবুর খোজে বের হব। নীলগঞ্জ যাব।

মিসির আলী নামে আমার একটা চরিত্র আছে। এই মিসির আলি সব সমস্যা যুক্তি দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করেন। সমস্যা সমাধানের জন্যে হেন জায়গা নেই যেখানে সে যায় না। বাস্তবে মিসির আলির অস্তিত্ব থাকলে সে এই কাজটাই করত। অবশ্যই নীলগঞ্জে যেত। এক অর্থে আমিই তো মিসির আলি। আমি কেন যাব না? সমস্যা হচ্ছে আমি একা কোথাও যেতে পারিনি। যে কোনো যাত্রায় আমার সঙ্গী লাগে। সঙ্গী জোগাড় করতে পারছিলাম না। সবাই ব্যস্ত। আমার মতো অবসরে কেউ নেই। মাসখানেক পার হওয়ার পর সালেহ চৌধুরী (সহ-সম্পাদক, দৈনিক বাংলা) রাজি হলেন। আমরা মাইক্রোবাসে করে রওনা হলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *