০৪. উপোসি চাঁদের আলো

চার

উপোসি চাঁদের আলো তখন বাংলোটাকে ঘিরে তিরতিরিয়ে কাঁপছে। মাঝে মাঝে নির্জলা মেঘকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বাচ্চা মেয়ের মত স্কিপিং করে যেতে হচ্ছে তাকে। ছায়া নামছে সামনের লনে, নেমেই সরে যাচ্ছে। বাঘটা বসে আছে গাড়ির ছাদে, যেভাবে সেবক ব্রিজের মুখে পাথরের সিংহ বসে থাকে।

এ ঘরের দেওয়ালে সুইচ আছে, স্বজন টিপেছিল কিন্তু আলো জ্বলেনি। তীব্র পচা গন্ধটা বেশ মারাত্মক, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বমি আসে। জানলা খুলে দিলে স্বস্তি পাওয়া যেত কিন্তু বাঘের কথা ভেবে সাহস হয়নি। ঘরের ভেতর গাঢ় কফির সঙ্গে কয়েক ফোঁটা দুধ মেশা অন্ধকার। পৃথা শেষপর্যন্ত বলে ফেলল, ‘এখানে থাকতে পারছি না।’

‘বুঝতে পারছি কিন্তু এখান থেকে সকাল হবার আগে বের হবার জো নেই। তিনি অপেক্ষা করছেন।’ স্বজন অসহায় গলায় বলল।

‘একটা কিছু করো!’

সেই একটা কিছু করার জন্য স্বজন দরজা ছেড়ে এগোল। ইতিমধ্যে চোখ কিছুটা মানিয়ে নিয়েছে। আবছা দেখা যাচ্ছে একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার। পায়ের তলায় কার্পেট। যাঁর বাংলো তিনি অর্থবান মানুষ। স্বজন ঘরের মাঝখানে চলে আসতেই বুঝল পৃথা তার সঙ্গ ছাড়েনি। ওপাশে ফায়ার প্লেস; তার ওপরে স্ট্যান্ডে ঝাপসা ছবি। এপাশের দেওয়ালে ভারী পর্দা। সামান্য আলো যা ঘরে ঢুকছে তা ওরই ফাঁক-ফোকর দিয়ে। স্বজন পর্দা সরাল। না, একটুও ধুলো পড়ল না গায়ে, স্বচ্ছন্দে সরে গেল সেটা আর সঙ্গে সঙ্গে কফিতে আরও দুধ মিশল। এবার ঘরটিকে অনেকটা স্পষ্ট দেখা গেল। সুন্দর সাজানো ঘর। কিন্তু কোনও বিছানা নেই। পৃথা জানলায় চলে গেল। চিতাটা দুই থাবায় মুখ রেখে বাংলোর দিকে তাকিয়ে আছে।

‘এ-ঘরে ফ্রিজ আছে!’ স্বজনের গলা শুনতে পেয়ে পৃথা দেখল সে ঘরে নেই। পাশের দরজায় চটজলদি চলে এল সে। আবছা স্বজন তখন ফ্রিজের সামনে। হাতল ধরে ঈষৎ টানতেই খুলে গেল দরজাটা।

‘আরে! এর ভেতরটা এখনও ঠাণ্ডা আছে!’ চিৎকার করল স্বজন।

পৃথা ছুটে গেল। ফ্রিজের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা বেরিয়ে আসছে। ডান দিক বাঁ দিকে, আবছা বেশ কিছু প্যাকেট। স্বজন দরজাটা বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নিজের মনে বিড়বিড় করল, ‘ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না!’

‘কারেন্ট নেই অথচ ফ্রিজ ঠাণ্ডা থাকছে কি করে?’ পৃথা জিজ্ঞাসা করল।

‘সেইটাই তো বিস্ময়ের! তার মানে আমরা এখানে আসার আগে কারেন্ট ছিল। লোডশেডিং হয়ে যাওয়ার পর কতক্ষণ ফ্রিজ ঠাণ্ডা থাকে?’ স্বজন পৃথার দিকে তাকাল।

‘দরজা না খুললে ঘণ্টা তিনেক।’

‘তা হলে? কারেন্ট গেল কেন?’ স্বজন ঘরের চারপাশে তাকাল।

‘এই বাংলোয় নিশ্চয়ই কেউ থাকে। নইলে ফ্রিজ চালু থাকত না।’

‘কারেক্ট। চলো, অন্য ঘরগুলো দেখা যাক।’

‘আমরা কিন্তু অনুমতি ছাড়া এখানে ঢুকেছি।’

‘বাধ্য হয়ে। প্রাণ বাঁচাতে এ ছাড়া উপায় ছিল না।’ স্বজন পাশের ঘরে চলে এল। গন্ধটা এখানে আরও তীব্র। কিছু একটা মরে পচেছে। গন্ধটা সেই কারণেই। বিদ্যুৎবিহীন মর্গে গেলে এই গন্ধটা পাওয়া যায়।

অথচ এই বাংলো ছিমছাম সুন্দর। দুটো শোওয়ার ঘর পরিপাটি। কোথাও এক ফোঁটা ধুলো জমে নেই। আর ফ্রিজটাও কিছুক্ষণ আগে চালু ছিল। স্বজন দরজার পাশে কাচের জানলায় চলে এল, ওর পাশে পৃথা। জ্যোৎস্নার ভোল্টেজ একটুও বাড়েনি। চরাচর অদ্ভুত ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। আর গাড়ির ওপর চিতাটা একই ভঙ্গিতে শুয়ে। স্বজনের মনে হল ওটা ঘুমাচ্ছে।

বাড়িটাকে আরও একটু ঘুরে ফিরে দেখে ওরা দুটো তথ্য আবিষ্কার করল। প্রথমটা আনন্দের, এখানে একটা টেলিফোন আছে। স্বজন রিসিভার তুলে দেখল তাতে কানেকশন আছে। কাকে ফোন করা যায় সেই মুহূর্তে মাথায় না আসায় সে ওটা নামিয়ে রেখেছিল। দ্বিতীয়টা খানিকটা মন্দের, নীচে যাওয়ার সিঁড়ি আছে। অথাৎ মাটির তলায় একটা ঘর আছে। আর গন্ধ আসছে সেখান থেকেই। সিঁড়ির মুখের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল স্বজন। নীচের অন্ধকারে পা বাড়াতে ইচ্ছে হল না। কিন্তু এতক্ষণে বাংলোটায় যে পচা গন্ধ পাক খাচ্ছে সেটা না বের করতে পারলে স্বস্তি নেই।

কিচেনের পাশে ইলেকট্রিক মিটারের বোর্ডটার কাছে এসে স্বজন একটু ভাবল। আন্দাজে হাত বাড়িয়ে ঢাকনা খুলে টান দিয়ে বের করেই বুঝতে পারল ফিউজটা উড়ে গিয়েছে। সে চিৎকার করল, ‘পৃথা, কোনও ভুতুড়ে ব্যাপার নয়। ফিউজটাকে পালটালেই আলো জ্বলবে।’

‘কি করে পালটাবে?’ পাশ থেকে পৃথা বলল নিচুস্বরে।

‘নিশ্চয়ই তার আছে কোথাও। দ্যাখো না!’

কোথায় দেখবে পৃথা। এমনিতে বাংলোয় হাঁটা চলা করতে এখন হয়তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না কিন্তু খুঁটিয়ে দেখার মত আলো নেই। তার ওপর ওই গন্ধটা ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে তার কাছে। তবু অসাধ্যসাধন করার মতনই একটা তার আবিষ্কার করল স্বজন নিজেই। সেটাকে যথাস্থানে পুরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতেই ফ্রিজটা আওয়াজ করে উঠল। সুইচ টিপতেই টইটুম্বুর আলো। পৃথা হেসে উঠতেই স্বজন ওকে জড়িয়ে ধরল। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আরাম। স্বজন পৃথার কানে মুখ রেখে বলল, ‘আর ভয় নেই।’

পৃথা মুখ তুলে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল। কাচের ওপাশে পৃথিবীটা এখন আরও ঝাপসা। ঘরের আলো তীব্র বলেই চোখে কিছু পড়ছে না। সে বলল, ‘গন্ধটাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।’

স্বজন বলল, ‘একটু অপেক্ষা করো ডার্লিং। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ওরা এবার টয়লেটের দরজার সামনে চলে এল। সুইচ টিপতেই সেটা উজ্জ্বল হল। পৃথা মুখ বাড়িয়ে দেখল ভেতরটা চমৎকার পরিষ্কার। কল খুলতেই জল নামল। সে বলল, ‘একটু ফ্রেশ হয়ে নিই!’

‘ক্যারি অন।’ চিৎকার করল স্বজন অনেকটা কারণ ছাড়াই। তারপর একের পর এক সুইচ অন করে যেতে লাগল। সমস্ত বাংলোটা এখন দারুণভাবে আলোকিত। এমনকি বাংলোর বারান্দার আলোগুলোকেও জ্বেলে দিয়েছে সে। এত আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেদের বেশ নিরাপদ বলে মনে হল। সে জানলার কাছে চলে এল। বারান্দার আলো তার গাড়িটাতেও পৌঁছেছে। এবং আশ্চর্য, চিতাটা নেই। গাড়িটা বেশ নিরীহ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের দরজাটার অনেকটা বেঁকে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। স্বজন হাসল। নিশ্চয়ই আলো জ্বলতে দেখে ভয় পেয়েছে চিতা। ভয় পেলেও কাছে পিঠে থাকবে কিছুক্ষণ, সুযোগের অপেক্ষা করবে। করুক।

ঠিক তখনই বমির আওয়াজ কানে এল। সে ছুটে গেল টয়লেটের সামনে, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজায় ধাক্কা দিল, “কি হয়েছে? তুমি বমি করছ কেন?’ বেসিনের সামনে হাঁপাচ্ছিল পৃথা। সামনের আয়নায় নিজের মুখটাকে কিরকম অচেনা মনে হচ্ছিল। সেই অবস্থায় কোনওমতে উচ্চারণ করল, ‘ঠিক আছে।’

‘শরীর খারাপ লাগছে?’ স্বজনের উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এল।

‘না।’ কলের মুখ খুলে দিল পৃথা।

‘দরজাটা বন্ধ করতে গেলে কেন?’ স্বজনের পায়ের আওয়াজ সরে গেল।

অভ্যেস! মনে মনে বলল পৃথা। কারোর সামনে জামাকাপড় চেঞ্জ করার কথা যেমন ভাবা যায় না তেমনি বাথরুম টয়লেটের দরজা খোলা রাখার কথাও চিন্তা করতে হয় না। ওটা আপনি এসে যায়।

মুখে জল দিল সে। আঃ, আরাম। গন্ধটা যে শরীরের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল তা এতক্ষণ টের পায়নি সে। বেসিনের কাছে পৌঁছানো মাত্র শরীর বিদ্রোহ করল। এখন অনেকটা স্বস্তি লাগছে। সে টয়লেটটাকে দেখল। যাঁর বাড়ি তিনি খুব শৌখিন মানুষ। নইলে এত ঝকঝকে থাকত না টয়লেট। বাইরে বেরিয়ে এসে পৃথা দেখল স্বজন ফ্রিজ থেকে কি সব বের করছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি করছ?’

‘কিছু খাবার রয়েছে এখানে। গ্যাসটাও চালু। ডিনার রেডি করি।’

‘আমি কিছু খাব না।’

‘কেন?’

‘ভাল লাগছে না।’

স্বজন এগিয়ে এল, ‘অনেকক্ষণ খালি পেটে আছ বলেও বমি হতে পারে।’

‘তা নয়। গন্ধটাকে আমি স্ট্যান্ড করতে পারছি না।’

‘ঠিক আছে। আর একটু সময় যাক। রাত তো বেশি হয়নি।’

‘গন্ধটা ঠিক কিসের?’

‘বুঝতে পারছি না। তবে নীচের ঘর থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছে।’

‘চলো না, গিয়ে দেখি।’

স্বজন মাথা নাড়ল, ‘নীচে কি আছে কে জানে, কাল সকালে দেখব।’

‘কাল সকালে এখানে আমরা থাকছি নাকি! তাছাড়া সারারাত এই গন্ধে থাকা অসম্ভব। তোমার খারাপ লাগছে না?’

‘লাগছে। ঠিক আছে, দাঁড়াও, দেখছি। ও হ্যাঁ, চিতাটা পালিয়েছে।’

‘পালিয়েছে?’ পৃথা বিস্মিত।

‘হ্যাঁ, আলো জ্বেলে দেওয়ার পর ব্যাটা ভয় পেয়েছে।’

পৃথা ওই ঘরের জানলায় ছুটে গেল। সত্যি, চিতাটা নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। যমদূতের মত পাহারা দিচ্ছিল জন্তুটা। সে হাসল, ‘বাঁচা গেল।’

স্বজন পাশে উঠে এল, ‘টেলিফোনটা চালু আছে। আমি টুরিস্ট লজে টেলিফোন করে ওদের জানিয়ে দিই যে এখানে আটকে গেছি।’

‘কাদের জানাবে?’

সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হল স্বজনের। পৃথার পক্ষে প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক। ওকে এখন পর্যন্ত বলতে পারেনি যে এখানে আসার আর একটা কারণ আছে। শুধু ছুটি কাটানো নয় সেই সঙ্গে কিছু কাজও তাকে করতে হবে। শুনলে আনন্দটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলেই সে চেপে রেখেছিল। উত্তর দেওয়াটা জরুরি বলেই সে উত্তর দিল, ‘ওই যারা টুরিস্ট লজে আমাদের জন্যে ঘর বুক করেছে।’

‘তোমার পরিচিত?’

‘আমার নয়। স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ওদের।’ স্বজন হাসার চেষ্টা করল, ‘আসলে আজ না পৌঁছালে যদি বুকিং ক্যানসেল হয়ে যায়! টুরিস্টদের খুব ভিড় এখন। শুনেছিলাম কি একটা উৎসব আছে।’

পৃথার চোখ ছোট হল, ‘বাইরে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে এত যোগাযোগের কি দরকার!’

স্বজন বুঝতে পারছিল ব্যাপারটা ক্রমশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথার মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যি কথা বলতে ঠিক সাহস হচ্ছিল না ওর। সে দাঁড়ি টানতে চাইল, ‘সবসময় কি দরকার বুঝে কেউ কিছু করে! দাঁড়াও ফোনটা করি আগে!’

সে টেলিফোনের কাছে পৌঁছাতে পেরে যেন আপাতত রক্ষা পেল। এমন ভাবে কথা এগোচ্ছিল যে সে সত্যি কথাটা আর বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারত না। শোনামাত্র যে পৃথার মুড নষ্ট হয়ে যেত তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

টেলিফোন কোম্পানির ছাপানো বইটা খুলে সে টুরিস্ট লজের নম্বরটা খুঁজতে লাগল। দূরত্ব বেশি না হলেও দেখা গেল একই এক্সচেঞ্জের মধ্যে পড়ে না। স্বজন রিসিভার তুলে ডায়াল টোন শুনল। তারপর এস টি ডি কোড্‌ নম্বর ঘোরাল। টুরিস্ট লজের নাম্বার ঘোরানোর পর এনগেজড শব্দ শুনতে পেল। এইসব যান্ত্রিক শব্দগুলো ওকে বেশ আরাম দিচ্ছিল। এখন নিজেদের আর বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না। পৃথার গলা ভেসে এল, ‘পাচ্ছ না?’

‘এনগেজড হচ্ছে!’ রিসিভার কানে রেখে স্বজন জবাব দিল। তার আঙুল ক্রমাগত ডায়াল করে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা পৃথাকে বিরক্ত করল। স্বজনের এই এক বদ অভ্যাস। কাউকে ফোন করতে গিয়ে এনগেজড বুঝেও অপেক্ষা করে না, জেদের বশে সমানে ডয়াল করে যায়। পৃথা এগিয়ে এল। দরজার পাশের সুইচটা টিপতেই বারান্দার আলো নিভে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া মাঠ এবং জঙ্গল চোখের সামনে চলে এল। চাঁদ এখন যথেষ্ট বলবান। গাড়িটা পড়ে আছে অসহায় ভঙ্গিতে। চিতাটা ধারে কাছে নেই।

‘এই যাঃ।’ স্বজনের চিৎকার কানে আসতেই ঘুরে দাঁড়াল পৃথা।

‘কি হল?’

‘লাইনটা ডেড হয়ে গেল!’ স্বজনের গলায় আফশোস।

‘সে কি? কি করে?’ কিছুই করতে পারবে না তবু পৃথা দৌড়ে গেল কাছে। হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বোতাম টিপল কয়েকবার। কোনও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।

স্বজন বলল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার। যোগাযোগের একমাত্র রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেল!’

পৃথা রিসিভার রাখল, ‘এরকম তো হয়ই। কিছুক্ষণ পরে হয়তো লাইন ফিরে আসবে। তা ছাড়া এই বাংলোয় টেলিফোন আছে জেনে তো আমরা ঢুকিনি।’

স্বজনকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। বাঁ হাতে রিসিভারটাকে শব্দ করে আঘাত করল যদি তাতে ওটা সচল হয়। পৃথা সেটা দেখে বলল, ‘তোমাকে কিন্তু একটু বেশি আপসেট দেখাচ্ছে! আজকে পৌঁছাবে বলে কাউকে কথা দিয়েছিলে?’

‘আশ্চর্য! তোমার এ কথা মনে হল কেন?’

‘তোমার ভঙ্গি দেখে।’

‘বুঝলাম না।’

‘আমরা বেড়াতে এসেছি। গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়াটা দুর্ঘটনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা বাংলোয় পৌঁছাতে পেরেছি। ওই দুর্গন্ধ ছাড়া অস্বস্তিকর কিছু নেই এখানে। আমাদের কাছে টুরিস্ট লজও যা এই বাংলোও তা। কিন্তু তুমি ছটফট করছ ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে।’ শান্ত গলায় বলল পৃথা।

আচমকা নিজেকে পাল্টাতে চেষ্টা করল স্বজন। হেসে বলল, ‘ঠিক আছে বাবা, আমি আর টেলিফোন স্পর্শ করছি না। ও-কে!’

ওর হাসি দেখে পৃথার ভাল লাগল। সে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘একটা জানলা খুলব? গন্ধটা তাহলে বেরিয়ে যাবে!’

জানলা খুললে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। চিতাটা যদি কাছে পিঠে থাকে তাহলে দেখতে হবে না। ফাস্টেস্ট অ্যানিম্যাল!’

‘ওটা কাছে পিঠে নেই।’ পৃথা একটু চেষ্টা করেই জানলাটা খুলতে পারল। খুলে বলল, ‘আঃ। বাঁচলাম।’

হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছিল ঘরে। যে পচা বোটকা গন্ধটা ঘরে থমকে ছিল সেটা হালকা হয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। পৃথা বলল, ‘আমার খুব ইচ্ছে করছে ওই মাঠে জ্যোৎস্নায় হাঁটতে, যাবে?’

‘পাগল!’

‘চিতাটাকে দেখলেই আমরা দৌড়ে ফিরে আসব!’

‘অসম্ভব। আত্মহত্যা করার কোনও বাসনা আমার নেই।’ স্বজন পৃথার পেছনে এসে দাঁড়াল।

পৃথা একটু ঘনিষ্ঠ হল। তার গলায় গুনগুনানি ফুটল। পূর্ণচাঁদকে নিয়ে এক মায়াবী সুর খেলা করতে লাগল মৃদু স্বরে। স্বজনের ভাল লাগছিল। এবং ওর মনে হল পৃথার কাছে ব্যাপারটা লুকিয়ে কোনও লাভ হচ্ছে না। মেয়েটা এত ভাল যে ওর কাছে সৎ থাকাটাই তার উচিত। তাকে যে চিকিৎসার প্রয়োজনে এখানে আসতে হয়েছে এই তথ্যটুকু জানলে ওর হয়তো খারাপ লাগবে কিন্তু সেটাকে কাটিয়ে তুলতে বেশি সময় লাগবে না। হঠাৎ গান থামিয়ে পৃথা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার খিদে পেয়েছে বলছিলে না? চলো!’

‘থাক।’

‘থাকবে কেন? এখন আমার ভাল লাগছে। খেতে পারব।’

‘তাহলে জানলাটা বন্ধ করা যাক।’ স্বজন জানলাটা বন্ধ করতে গিয়ে থমকে গেল, দূরে, মাঠের শেষে যেখানে ঝোপঝাড় সেখানে কিছু যেন নড়ছে। চিতাটা কি ওখানে লুকিয়ে থেকে তাদের নজরে রাখছে। সে সাহস করে আর একটু লক্ষ করার চেষ্টা করল। না চিতা নয়। ঝোপের মধ্যে যে আদলটা চোখে পড়ছে তা চিতার হতে পারে না। হয়তো কোনও বেঁটে গাছ হাওয়ায় নড়ছে। কিন্তু আশেপাশের গাছগুলো তো স্থির! সে জানলা বন্ধ করে দিল!

ফ্রিজের খাবারগুলোর সবই টিনফুড। গরম করে খেয়ে নিলেই চলে। এর আগে দু-একবার খেয়েছিল পৃথা, পছন্দ হয়নি। এই বাংলো যাঁর তিনি টিনফুডের ওপরই ভরসা করেন। এমন কি অরেঞ্জ জুসও ক্যানেই রাখা আছে। গ্যাস জ্বালিয়ে খাবার রেডি করে ওরা খেতে বসল। স্বজন বেশ তৃপ্তি করেই খেল। এই ঘরে এখন আর তেমন গন্ধ না থাকলেও পৃথা সামান্যই দাঁতে কাটল। অরেঞ্জ জুসটাই তাকে একটু তৃপ্ত করল। স্বজন বলল, ‘এবার শোওয়ার ব্যবস্থা করা যাক।

‘এখন শোবে?’

‘কটা বেজেছে ঘড়িতে দ্যাখো।’

‘আমার এখনই ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া— !’

‘আবার কি?’

‘তুমি বলেছিলে গন্ধটা কেন আসছে সেটা দেখবে’!

‘কাল সকালে দেখলেই তো হয়।’

‘না। আমার ঘুম আসবে না। সবসময় মাথায় চিন্তাটা থেকে যাবে।’

অগত্যা স্বজন উঠল। দুটো ঘর পেরিয়ে নীচের সিঁড়ির দরজার কাছে পৌঁছে সুইচ টিপতে লাগল। দরজার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাওয়ায় বোঝা গেল সিঁড়ি আলোকিত। সে পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকের ওপর দিয়ে বেঁধে নিল। পৃথা পেছনে দাঁড়িয়েছিল, স্বজন বলল, ‘তুমি নীচে নামবে না।’

‘কেন?’

‘কি দৃশ্য দেখব জানি না। তা ছাড়া ওপরে একজনের থাকা উচিত!’ স্বজন দরজা খুলতেই গন্ধটা ছিটকে উঠে এল যেন। পৃথা নাকে হাত দিয়ে সরে গেল সামান্য।

সিঁড়িতে আলো জ্বলছে। স্বজন নামছিল। গন্ধটা আরও তীব্র হচ্ছে। রুমালের আড়াল কোনও কাজই দিচ্ছে না। মাটির তলায়! স্টোর রুম।

নীচে নামতেই শব্দ হল। হুড়মুড় করে কিছু পড়ল আর বিশাল মেঠো ইঁদুর ছুটে বেরিয়ে গেল এপাশ ওপাশে। স্বজনের মনে হল অনেকদিন পরে এই ঘরে আলো জ্বলছে। সে চারপাশে তাকাল। একটা লম্বা টেবিলের ওপর কফিনের মত বাক্স। বাক্সর ওপর দুটো ধেড়ে ইঁদুর সাহসী ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। বাক্সের ডালাটা ঈষৎ উঁচু হয়ে থাকলেও ইঁদুরগুলো সেখান দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারছে না। ডালাটাকে দেখেই বেশ ভারী মনে হল। উঁচু হয়ে থাকার একটা কারণ চোখে পড়ল। শেষপ্রান্তে একটা ইঁদুরের শীর্ণ শরীর ঝুলছে। বেচারা হয়তো কোনও মতে মাথা গলাতে পেরেছিল কিন্তু সেই অবধিই। ডালার চাপে ঝুলন্ত অবস্থায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে গেছে। আর ওর মৃত শরীরটাকে খুবলে খেয়ে নিয়েছে সঙ্গীরা। কিন্তু ওই সামান্য ফাঁক গলে গন্ধ বেরিয়ে আসছে বাইরে।

স্বজন এগোল। কফিনের ওপর থেকে ইঁদুর দুটো এবার তাকিয়ে নেমে গেল ওপাশে। ডালাটার একটা দিক ধরে ধীরে ধীরে উঁচু করতেই ওপর থেকে আর্ত চিৎকারটা ভেসে এল। হকচকিয়ে গেল স্বজন। তারপর ডালাটা নামিয়ে কয়েক লাফে সিঁড়িতে পৌঁছে দ্রুত ওপরে উঠে এল সে।

দরজার সামনেই পৃথা, রক্তশূন্য। তাকে দেখতে পেয়েই পাগলের মত জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগল। স্বজন ওর মাথায় হাত রেখে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে? অমন করছ কেন?’

কথা বলতে পারছিল না পৃথা। সামলে উঠতে সময় নিল খানিক। স্বজন বলল, ‘আমি তো আছি, কি হয়েছে?’

‘দুটো সাদা পা, ঝোপের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল।’

‘সাদা পা? চমকে উঠল স্বজন।

‘হ্যাঁ। কী সাদা। হঠাৎই।’

স্বজন ওকে আঁকড়ে ধরল। কফিনের ঢাকনাটা তোলার মুহূর্তে এক ঝলকের জন্যে সে যা দেখেছিল তা পৃথা ঝোপের বাইরে দেখল কী করে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *