চতুর্থ অধ্যায় – উত্তর-ভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় শূর বংশ
সেনাদলের নিছক এক নেতা থেকে কর্মজীবন শুরু করে মহম্মদ বিন তুঘলক-এর মৃত্যুর পরবর্তী উত্তর ভারতের মধ্য ১৪শ শতাব্দির বিজ্ঞ সাহসী হিসাবে অন্যতম বৃহৎ এক সাম্রাজ্যের অধিপতি হিসাবে শের শাহের উত্থান সম্ভব হয়েছিল তার অদম্য, সাহস, দৃঢ়তা ও লক্ষ্যে স্থির থাকার প্রচণ্ড জেদের ফলে এবং তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। যাইহোক এটি একজনের পক্ষে সহজ প্রসংশনীয় নেতৃত্ব দানই ছিল না বরং এটি ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব দান। আমরা আগেই দেখেছি উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া সিকান্দর লোদির চুড়ান্ত ভাবে জৌনপুর জয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল তা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যথাক্রমে বাবর ও হুমায়ুন। ইব্রাহিম লোদি ও রানা সঙ্গর বিরুদ্ধে বাবরের জয় এবং হুমায়ুনের মালব ও গুজরাট অভিযান উত্তর ভারতের পূর্বেকার রাজনৈতিক শক্তিসাম্যের সমীকরণ বদলে দিয়েছিল। এই প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন শের খান বাংলার শাসককে যুদ্ধে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। এরপর শের খানের প্রভাব চূর্ণ করতে হুমায়ুন বিহার ও বাংলা অভিযান করেন। সুতরাং এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে যোড়শ শতকে দাঁড়িয়ে মূলত মুঘল শক্তি আফগানসহ অন্য শক্তিগুলোর মধ্যে দক্ষতা দখলের লড়াইয়ে যারা জিতবে পরবর্তীকালে তারাই অবধারিত ভাবে সমগ্র উত্তর ভারতের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হবে। শেরশাহ একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন। ঠিকই, কিন্তু গুজরাট তার সাম্রাজ্যের বাইরে থেকে গিয়েছিল, যার ফলে পরবর্তীকালে আকবরের কাছে সুযোগ আসে সমগ্র উত্তর ভারতকে এক সাম্রাজ্যের আওতায় নিয়ে আসার। তাই উত্তর-ভারতীয় অখণ্ড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় শের শাহের অবদান বলতে যা কিছু বোঝায় তা হল–এই প্রক্রিয়ার প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল জুড়ে প্রবলভাবে তার বিদ্যমানতা।
একই ভাবে একজন ছোটো অভিজাত থেকে বিশাল ক্ষমতার অধীশ্বর হওয়ার মধ্য দিয়ে শের শাহের উত্থানটাও আমাদের বুঝতে হবে সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। অর্থাৎ যেখানে ক্রমাগত শক্তিশালী, নৃশংস ও নির্মম কিছু মানুষ সব কিছু বিনষ্ট করে ক্ষমতা দখলের জন্যে মরিয়া আক্রমণ চালাচ্ছিল, যেখানে রাজনীতির কানায় কানায় জমাট বেঁধে বসেছিল ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, নৈতিক দুরাচার ও রংবদলের খেলা, সেখানে কীভাবে ছোট্ট ফরিদ ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলেন ও তৈরি হলেন ইতিহাস-প্রসিদ্ধ শের শাহ হিসাবে–তা খুঁজে দেখতে হবে। না হলে শের শাহের আমলের প্রায় ৪০ বছর পরে আফগান ঐতিহাসিকরা তার উত্থানকে যেভাবে রোমান্টিকতায় মুড়ে তুলে ধরেছিলেন, তা কতটা যুক্তিযুক্ত এর যথাযথ ঐতিহাসিক মূল্যায়ন সম্ভব হবে না।
শের শাহের প্রারম্ভিক জীবন ও তার ক্ষমতায় উঠে আসা
আমরা শের শাহের পরিবার, তার প্রথম দিককার জীবন ও ক্ষমতার পরিমণ্ডলে উত্থান সম্পর্কে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রমাণ পাই না। ফলে আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকটা সচেতন হয়েই সেই ইতিহাস লিখতে হয়। যদিও আমরা এখানে মূলত তার। প্রারম্ভিক জীবনের একটা সার্বিক ছবি খুব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব। শের শাহের পিতামহ ইব্রাহিম শূর ছিলেন একজন ছোটোখাটো ঘোড়া ব্যবসায়ী, যিনি ইব্রাহিম লোদির আমলের শেষ দিকে আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছিলেন। ঘোড়া ব্যবসায়ী হিসাবে তিনি লোদি দরবারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন এবং জামাল খান লোদিই তাকে প্রথম আধুনিক হরিয়ানার হিসার-ফিরৌজা অঞ্চলের কিছু গ্রাম দান করেন ৪০টা অশ্বারোহী বাহিনীর দেখাশোনা ও ভরণপোষণের জন্যে (৪০ সাওয়ার পদ দানের মধ্য দিয়ে)। সে সময়কার টালমাটাল পরিস্থিতিতে একজন আধিকারিকের অধীনে এভাবে এতগুলো অশ্বারোহী সেনার নিয়ন্ত্রণ থাকা চারটি খানি কথা ছিল না। ইব্রাহিম শূর ও তার পুত্র হাসান ক্রমে এই সৈন্যবলকে সামনে রেখে আফগান সশস্ত্র দস্যুদের নেতায় পরিণত হয়ে যান এবং এদের সামরিক শক্তিকেই ক্ষমতা দখলের জন্যে কাজে লাগান শেখওয়াতী গোষ্ঠীর প্রধান রাইমল। এভাবেই পিতার মৃত্যুর পর দেখা যায় হাসান সমগ্র নারনউল পরগনার দায়িত্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা ঠিক জানি না কতগুলো অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর এসময় হাসানের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তবে তা যে ৪০টি অশ্বারোহী বাহিনীর (৪০ সাওয়ার পদ) থেকে বেশি ছিল তা বলাই বাহুল্য।
চূড়ান্ত ভাবে জৌনপুর জয় করে নেবার পর সিকান্দার লোদি সেখানে প্রাদেশিক শাসক হিসাবে জামাল খান সরঙ্গখানিকে নিয়োগ করেন। এই জামাল খান সরঙ্গখানি সিকান্দর লোদিকে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে সিংহাসন দখল করতে অনেক সাহায্য করেছিলেন। জামাল খানের মৃত্যুর পর জৌনপুরের দায়িত্ব লাভ করেন তাঁর পুত্র খান-ই-আজম আহমেদ খান সরঙ্গখানি, যাকে দেওয়া হয় ১২,০০০ সাওয়ার পদ। এই আহমেদ খান সরঙ্গখানি-ই এখানে নিজের অবস্থানকে শক্তপোক্ত করতে এবং তখনও সক্রিয় স্থানীয় পুরোনো জৌনপুরী অভিজাতদের শায়েস্তা করতে হাসান শূরকে নিয়ে আসেন শাহসরম ও খাওয়াসপুর-টান্ডা এলাকার ইক্তা হিসাবে নিয়োগ করে। সঙ্গে তাকে দেন ৫০ সাওয়ার পদ। এটা হাসান শূরের একটা বড়ো পদোন্নতি ছিল বলা যায়, কারণ এবার থেকে তিনি নির্দিষ্ট মর্যাদা সম্পন্ন (ধ্বজা সহযোগে) একজন ছোটো অভিজাত হিসাবে পরিগণিত হতে শুরু করলেন। এই সময় আরও একজন শূর যোদ্ধাকে চৌন্দ পরগনা ও ১৫০০ সাওয়ার পদ দান করে আহমেদ খান জৌনপুরে নিয়ে এসেছিলেন, আর তিনি ছিলেন মহম্মদ খান শূর, যার বাবার অধীনে একসময় হাসান শূরের পিতা ইব্রাহিম শূর কাজ করতেন। ফলে দেখা যাচ্ছে যখন বেশ কয়েকজন বলিষ্ঠ ও দুঃসাহসিক মানুষ নানা ভাবে চেষ্টা করছেন এমন কিছু এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যেখানে তখনও জৌনপুরের অভিজাত, রাজপুত রাজা ও উপজাতি প্রধানদের সক্রিয়তা রয়েছে, সেখানে হাসান শূরই একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি দ্রুত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন, আরও অনেকেই ছিল যারা তার ঘাড়ের পাশে রীতিমতো নিশ্বাস ফেলছিল।
আমরা কেউ জানি না ঠিক কবে ও কোথায় ফরিদ বা পরবর্তীকালের শের শাহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে তিনি নাকি ১৪৮৬ সালে নারনউল প্রদেশে জন্মেছিলেন, আর তা যদি ঠিক হয় তাহলে সময়টা ছিল বাহলোল লোদির। শাসনকাল (১৪৮৯)। আমরা ফরিদের শৈশবের শিক্ষাগ্রহণ সম্পর্কেও খুব একটা জানতে পারি না। তবে এটুকু জানা যায় যে তিনি নাকি তাঁর পিতার অল্পবয়সি এক ভারতীয় দাসীকে বিবাহ করার ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে জৌনপুরে চলে আসেন এবং সেখানকার এক প্রসিদ্ধ মাদ্রাসায় কয়েক বছর থেকে ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ, আরবি, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। কিছু সময় পর ফরিদের সঙ্গে তাঁর পিতার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং তিনি তাঁর পিতার কাছে ফিরে আসেন। পিতা তাকে এবার তার অধীনে থাকা দুই পরগনার প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলাতে দেন (১৫১৫-১৬)। এভাবেই যুবক ফরিদ প্রথম গ্রাম ও পরগনা স্তরের প্রশাসনিক কাজকর্ম সামলানোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন।
সমস্ত দিক থেকেই ফরিদ নিজের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, রাজপুত জমিদারদের দ্বারা বিভিন্ন পরগনাগুলিকে তিনি পুনরায় স্বরাজত্ব ভুক্ত করেন। এই রাজপুত জমিদাররা বনে জঙ্গলে পরিবৃত গ্রামগুলির অবস্থানের জন্য শিকদারদের অস্বীকার করার সাহস পেতেন। ফরিদ জঙ্গল কাটার জন্য স্থানীয় কর ধার্য করেন এবং অনিচ্ছুক গ্রাম বাসীদেরকে হত্যা করে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের দাসে পরিণত করেন, এই স্থানগুলিতে নতুন কৃষকদের বসতি স্থাপন করা হয়। তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাবে কর সংগ্রহ করলেও কর স্থাপনের বিষয়ে যথেষ্ট উদার ছিলেন। কিন্তু এসব করলেও দুর্ভাগ্যের। বিষয়, মাত্র তিন-চার বছর কাজ করার পর (১৫১৯) ফরিদকে তার সৎ মায়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এই প্রশাসনিক দায়িত্ব হারাতে হয়েছিল। এভাবে আচমকা কর্মহীন হয়ে পড়ে ও প্রচণ্ড ক্রোধে ফরিদ দস্যুবৃত্তি শুরু করেন। উত্তর ও পূর্ব বিহারের হিন্দু জমিদার ও রাজাদের লুঠ করার নেশায় মেতে ওঠেন তিনি। অবশেষে কিছু সময় পর তিনি কাজ পান চুনার দুর্গের সেনাপ্রধান তাজ খান সরঙ্গখানির কাছে এবং সেখান থেকে তিনি কাজ পেয়ে চলে যান গাজীপুর সরকারের মক্তব নাসির খান নুহানির কাছে। আরও কিছু সময় পর আমরা তাকে আগ্রাতে চলে যেতে দেখি নায়েব দরিয়া খানের অধীনে কাজ করার জন্যে। এখানে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি তৎকালীন শাসক ইব্রাহিম লোদির কাছে আবেদনপত্র দাখিল করে তাঁর পিতার বয়স হয়ে যাওয়া ও হিন্দু দাসী পত্নীর হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলে অবিলম্বে তাঁকে সাসারাম অঞ্চলের জায়গিরদার পদ থেকে অপসারণের দাবি জানান।নিজ পিতার বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগ করায় ইব্রাহিম লোদি খাঁকে চরম ভৎর্সনা করে সে আবেদন খারিজ করে দেন। যদিও হাসান খান মারা যাবার পর (১৫২৪) ইব্রাহিম লোদি তার প্রতি অনেকটাই নরম হয়ে যান। ফলস্বরূপ ইব্রাহিম লোদির ফরমান সঙ্গে নিয়ে ফরিদ বুক ফুলিয়ে সাসারামে প্রবেশ করেন এবং তাঁর পিতার অবর্তমানে তার সম্পত্তি ও জায়গিরের ওপর দখল করে বসে থাকা সভাইদের উৎপাটিত করেন। এবার সেখানে শুরু হয় সেই চিরাচরিত পারিবারিক কোন্দল ও ষড়যন্ত্রের কাহিনি। ফরিদের ভাইয়েরা চৌন্দের শক্তিশালী জায়গিরদার মেহমুদ খান শুরকে ফরিদের সামনে খাড়া করেন এবং এই বিবাদে মধ্যস্থতা করবার প্রস্তাব দেন। এর জবাবে ফরিদ বিহারের শাসক দৌলত খান নুহানির পুত্র বাহার খানের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। বিবাদটা মূলত ছিল এই নিয়ে যে পাঠান ঐতিহ্য অনুসারে যেভাবে ভাইদের মধ্যে মৃত পিতার সম্পত্তির সঙ্গে তাঁর জায়গিরও ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়, তা কি এক্ষেত্রে ফরিদ ও তার সভাইদের মধ্যেও হবে? তার ভাইরা এটাই চাইছিলেন কিন্তু ফরিদ তা কিছুতেই মানতে চাননি। তার যুক্তি ছিল হিন্দুস্তানে পাঠান রোহ ঐতিহ্য কখনোই কার্যকরী হতে পারে না এবং সুলতান যাকে জায়গির দেবেন সেই তা ভোগ করার অধিকারী।
ইব্রাহিম লোদির পানিপথের যুদ্ধে পরাজয়ের পর সুযোগ বুঝে বাহার খান ‘সুলতান মহম্মদ শাহ’ নাম নিয়ে নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। যেসব আফগান যোদ্ধারা তাঁর নিকটস্থ ছিলেন তারা সকলেই সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন। এই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন ছিলেন ফরিদ। আধুনিক ঐতিহাসিক কে.আর. কানুনগোর মতে, এই সময়েই ফরিদকে শের খান উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল, হয় তাঁর কাজের জন্যে, না হলে আফগান ঐতিহাসিকদের দেওয়া তথ্য অনুসারে তাঁর বাঘ (শের) মারার পুরস্কারস্বরূপ।
এভাবেই ১৫২৬ সালে একদিকে যখন পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করে বাবর ভারতে নিজের পায়ের তলার মাটিকে শক্ত করছিলেন, তখন পূর্ব দিকে বিহারের রাজনীতিতে শের শাহ একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে উঠে এসেছিলেন। শের শাহের বয়স তখন প্রায় চল্লিশ বছর হলেও তাঁর এই উত্থানটা ছিল রীতিমতো আকস্মিক ও চমকপ্রদ।
বিহারের শের খানের উত্থানের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
শের খান ও হুমায়ুনের মধ্যে সংঘর্ষটাকে অনেক সময়েই নিছক আফগান ও মুঘল বাহিনীর সংঘাত হিসাবে দেখা হয়ে থাকে, কিন্তু সেখানে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশ ও বিহারের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা যে কতবড় প্রভাব ফেলেছিল, তা নিয়ে সেভাবে কেউ মাথাই ঘামায় না। একদিকে বাংলার শাসক ও অন্যদিকে মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে নুহানিদের বিহারে পৃথক ভাবে সাম্রাজ্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে যথেষ্ট শক্তিশালী দখল রাখা সারওয়ানি ও ফারমুলিরাও ভীষণ ভাবে চাইছিল জৌনপুরে তাদের হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে। এই উদ্দেশ্যে তারা কখনও বিহারের নুহানি রাজাদের তো কখনো ইব্রাহিম লোদির কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহম্মদ লোদির সাহায্য নিয়েছিল। তবে তারা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, উলটে বিহারে নুহানি সাম্রাজ্যকেই নানা ভাবে অস্থির করে তুলেছিল। পানিপথের যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই সুলতান মহম্মদ লোদির মৃত্যু নুহানি সাম্রাজ্যের পতনকে একেবারে সুনিশ্চিত করে দেয়। শুধু শের খানের প্রচেষ্টার জন্যেই আরও কিছু দিন নুহানিরা টিকে ছিল বলা যায়।
প্রায় প্রত্যেক আফগান অভিজাত পরিবারে সে সময় ইক্তা বা জায়গির হস্তান্তর ও ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদ লেগেই থাকত। বাবর এই বিবাদের সুযোগ নিয়ে কয়েক জন প্রথম সারির অভিজাতকে নিজের শিবিরে টেনে নিতে সফল হয়েছিলেন। এভাবেই অযোধ্যার ইক্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাই মারুফের সঙ্গে বিবাদমান বায়াজিদ ফারমুলিকে বাবর নিজের শিবিরে এনে পুরস্কারস্বরূপ অযোধ্যা দান করেন। একইভাবে মহম্মদ নুহানির ভাই নাসির নুহানিকেও টেনে নেওয়া হয় এবং মহম্মদের অধিকারে থাকা গাজীপুরের ইক্তা দিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ফতেহ খান সারওয়ানিকেও একই কায়দায় খান-ই-জাহান উপাধিতে ভূষিত করে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের জায়গির দিয়ে দেওয়া হয়। এমন করে পারিবারিক বিবাদকে কাজে লাগিয়ে দল ভাঙানোর মধ্য দিয়ে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের আফগানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সব রাস্তাই বন্ধ করে দিতে পেরেছিলেন বাবর। এমনকি শের খানকেও মহম্মদ খান শূর কর্তৃক জায়গির। থেকে উৎপাটিত হবার পরে মুঘল প্রাদেশিক আধিকারিক হুসেন বারলাসের কাছে আসতে হয়েছিল এবং আনুগত্য প্রদর্শনের বিনিময়ে তিনি তাঁর পুরোনো জায়গির ফেরত পাওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু পরগনার দায়িত্ব লাভ করেছিলেন। যদিও এদের মধ্যে অনেক আফগান অভিজাতই জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। প্রথমে এরকম আঘাত হেনেছিলেন সুঙ্গরা, পরে হুমায়ুনের আমলে বাহাদুর শাহ। আসলে বারবার শত্রুদের আক্রমণের ফলে মুঘলরা সব সময় তাদের সমর্থক আফগান অভিজাতবর্গকে দেওয়া জায়গিরের অধিকার ধরে রাখতে পারতেন। না। মুঘলদের শত্রুরা প্রথমে সুলতান মহম্মদের নেতৃত্বে ও পরে সুলতান মেহমুদ লোদির নেতৃত্বে একজোট হয়ে আক্রমণ হানিয়েছিল। জায়গির হাতছাড়া হলেই বিদ্রোহ করতেন অভিজাতরা। শের খান ছিলেন এমনই একজন বিদ্রোহকারী।
শের খানের উত্থানের জন্যে সহায়ক আর একটি কারণ ছিল আফগান সমাজে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ। এটা হয়তো অধিক স্তর-বিভক্ত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের তুলনায় উপজাতি অধ্যুষিত সমাজে নারীদের স্বাধীনতা ভোগ করার বৃহত্তর ঐতিহ্যের একটা অংশ ছিল। তাই যখন পানিপথের যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের অব্যবহিত পরে বিহারের শাসক মহম্মদ শাহের মৃত্যু ঘটল, বিহারের শাসনভার সরাসরি হস্তান্তরিত হল তাঁর বিধবা পত্নী দুদু-র ওপর, পুত্র জালাল হয়ে পড়লেন গৌণ। দুদুর বিশ্বাস অর্জনে সমর্থ হলেন শের খান আর তাই দুদু তাকে পুত্র জালালের অভিভাবক হিসাবে রাজ্যপাটের দায়িত্ব ভালো করে বুঝিয়ে দেবার জন্যে নিয়োগ করলেন। রাজ্যশাসনের ভার এভাবেই চলে এসেছিল শের খানের হাতে। আর একটি ক্ষেত্রেও অনেকটা একই ঘটনা ঘটেছিল যখন চুনার দুর্গের সেনাপ্রধান তাজ খান সরঙ্গখানি মারা গিয়েছিলেন, তার যাবতীয় ধন সম্পদ ও ক্ষমতা সৎ পুত্ররা থাকা সত্ত্বেও চলে গিয়েছিল তাঁর পত্নী লাড মালিকা-র হাতে এবং এক জটিল পরিস্থিতিতে লাড় মালিকা নিজেকে বাঁচাতে শের খানকে বিবাহ করবার প্রস্তাব জানালে শের খান তাতে সম্মত হয়ে গিয়েছিলেন। আব্বাস খান সারওয়ানি জানিয়েছিলেন যে বিবাহের সময় লাড মালিকা তাকে একশত পঞ্চাশটি দুষ্প্রাপ্য অলংকার, সাত মণ মুক্তো ও ১৫০ মণ সোনা উপহার দিয়েছিলেন। এইভাবে শুধু রাশি রাশি অর্থ লাভ করে শের খান নিজের শক্তিশালী বাহিনী নির্মাণ করেছিলেন তাই নয়, একটা শক্তিশালী দুর্গ ও সঙ্গে যুক্ত একাধিক পরগনার নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, শীঘ্রই শের খানের সামনে আরও বিরাট প্রাপ্তি অপেক্ষা করছিল। গাজীপুরের শাসক নাসির খান নুহানির নিঃসন্তান পত্নী গৌহর গোসাইন বিধবা হয়ে যাবার পর নাসির খানের কাছে এক সময় কাজ করে যাওয়া শের খানকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং সঙ্গে ৩০০ মণ সোনাও দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ওদিকে এসময় সুলতান বাহনলালের ভাগ্নে মিয়াঁ মহম্মদ কালাপাহাড় ফারমুলির কন্যা বিবি ফতহ মালিকা বেশ ধনবতী হয়ে উঠেছিলেন এবং সেই অর্থ সহযোগে তিনি তার দেবর মারুফ ফারমুলিকে মুঘল-বিরোধী কার্যকলাপে সম্পূর্ণরূপে সাহায্যও করেছিলেন। কিন্তু মরুফের মৃত্যুর পর যখন তিনি তাঁর সম্পত্তি বাঁচানোর জন্য বুন্দেলখণ্ডের ভাটা (রেওয়া)-তে ফিরে যেতে চাইছিলেন তখন শের খান আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে রক্ষা করবার এবং তার সম্পত্তি ও কাজ করার স্বাধীনতায় কোনোরকম হস্তক্ষেপ না করার শপথ নিলে শের খানের হাতেই তিনি সব দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। কথিত আছে কিছুদিন যেতে-না-যেতেই তার কাছ থেকে ৩০০ মণ বা কোনো কোনো সূত্র অনুসারে ৭০ মণ সোনা নিয়ে শের খান তাকে যৎসামান্য কিছু সম্পদ ও গ্রাম ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
বাবর ঘর্ঘরায় (১৫২৯) ও হুমায়ুন দাদরাহতে (১৫৩২) আফগান প্রধান বিবন ও বায়াজিদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করেছিলেন, সেখানে শের খানের ভূমিকা কি ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। এই দুই যুদ্ধেই শের খানকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আফগান বিদ্রোহীদের সমর্থন করতে হয়েছিল কিন্তু তিনি কখনোই জৌনপুরে পৃথক আফগান রাজ্য দখলের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। কারণ এদিকে নজর দিলে সাসারামে তার কর্তৃত্বে খারাপ প্রভাব পড়তে পারত আর আলাদা করে তাঁর বিহার জয়ের লক্ষ্য তো ছিলই। তাছাড়া আফগান নেতা বিবন ও বায়াজিদকে তিনি সাহসী যোদ্ধা হিসাবে সম্মান করলেও তাদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। তবে দাদরাহের যুদ্ধ থেকে শের খানের দূরে সরে থাকাকে কখনোই আফগান নেতাদের পরাজয়ের কারণ হিসাবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। কারণ তারা শুরু থেকেই নানা গোষ্ঠীতে ভেঙে গিয়েছিল এবং তাদের যুদ্ধ করার কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনাই ছিল না।
সেভাবে দেখতে গেলে বাবরই প্রথম মানুষ যিনি শের খানকে ক্ষমতার অলিন্দে উঠে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন এবং তা যথার্থ ভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন শের খান। সুলতান মেহমুদের মৃত্যুর পর তার বিধবা পত্নী দুদু বাংলার শাসক সুলতান নুসরত শাহের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। নুসরত শাহ ইতিমধ্যেই বিহারে যথেষ্ট শক্তিশালী ভাবে নিজের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে তার কর্তৃত্ব ত্রিহুত থেকে বালিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল। নুসরত শাহকে আটকাতে বাবর নুহানি বংশকে পুনরায় শক্তিশালী করবার লক্ষ্যে এগোলেন এবং প্রতিদানে। তিনি জালালের তরফ থেকে বাৎসরিক এক কোটি টঙ্কা দাবি করলেন। আমরা আগেই বলেছি যে এইরকম একটা পরিস্থিতিতে রাজমাতা দুদু সমগ্র বিষয়টি নিজ হাতে সামলাতে না পেরে শের খানকে একাধারে নায়েব (সহকারী) ও নিজের অযোগ্য পুত্র জালালের গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন এবং কার্যত বিহারের শাসক বানিয়ে তার হাতেই শাসনকার্যের যাবতীয় দায়দায়িত্ব অর্পণ করেন। শের খান এরপর পুরোদমে। বিহারের প্রশাসনিক উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন এবং যতদিন না পর্যন্ত নুহানি প্রধান ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন ততদিন অবধি সম্পূর্ণ ক্ষমতা তিনি নিজের হাতেই রেখেছিলেন।
বাংলা ও বিহারের মধ্যে চলা ক্রমাগত সংঘর্ষে বাবর সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়তে । চাননি। তাই তিনি বিহারের কার্যকলাপ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে শের খান প্রথম বিহারে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রচনা শুরু করেছিলেন। বাংলা ও বিহারের মধ্যে এ-সময় নতুন করে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়াটাও তাকে এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর পর বিহারের শাসক জালাল খান শের খানের ক্ষমতা বৃদ্ধি দেখে শঙ্কিত। হয়ে পড়েছিলেন এবং নিরাপত্তার জন্যে বাংলার শাসক নুসরত শাহের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। নুসরত শাহও দেখলেন এই সুযোগে বিহার আক্রমণ করে শের খানকে কোণঠাসা করে দেবার। যদিও তার সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি এবং তাকে কেবল শের খানের কিছু ক্ষমতা ছাঁটা ও কিছু ধন সম্পদ আত্মসাৎ করেই ক্ষান্ত থাকতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে নুহানি পরিবারও এরপর থেকে বিহারে যেন ব্রাত্যই হয়ে। পড়েছিল।
সুলতান নুসরত শাহ ১৫৩২ সালে মারা গেলেও বিহার জয়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন তাঁর ভ্রাতা সুলতান মেহমুদ। যিনি দুটো অভিযান চালিয়েছিলেন। প্রথমটা উত্তর বিহারে নিযুক্ত বাংলার প্রতিনিধি মোকাদ্দম-ই-আলমের বিরুদ্ধে। তিনি নাকি শের খানের সঙ্গে মিত্রতার সুবাদে আগের বিহার আক্রমণে বাংলার শাসককে সেভাবে সাহায্যই করেননি–এই অজুহাত দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। যদিও সেই অভিযান ব্যর্থ হয় তবুও মোকাদ্দম-ই-আলম খুন হয়ে যান। এরপর সুলতান মেহমুদ দ্বিতীয় তথা চূড়ান্ত আক্রমণ চালান বিহার জয়ের লক্ষ্যে। এবার তিনি নুহানিদের সঙ্গে নিয়ে এক বিশাল যৌথবাহিনী বিহারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। কিন্তু শের খান সুরজগড়ের কাছে এক যুদ্ধে যৌথবাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হন (১৫৩৫)। এইভাবে বিহারের ওপর থেকে বাংলার বিপদ একেবারে কেটে যাওয়ার পর আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলেন না শের খান, ওই বছরেই তিনি বাংলা আক্রমণ করলেন এবং সুলতান মেহমুদকে বাধ্য করলেন সিক্রিগোলি পর্যন্ত এলাকা ছেড়ে দিতে ও বিপুল অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিতে। সুলতান মেহমুদ এবার গুজরাটের বাহাদুর শাহের মতো পর্তুগিজদের সাহায্যের আশায় ছুটলেন। কিন্তু সে আশা ভেঙে দিতে ১৫৩৭ সালে শের খানের পুত্র জালাল খান গৌড় আক্রমণ করেন ও কিছুকাল অবরোধ করে তা দখল করে নেন। এটা ছিল বাংলায় সুলতান মেহমুদের বংশের রাজত্বের কার্যত সমাপ্তি আর সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলায় পর্তুগিজদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কার আপাত একটা ইতি।
সুতরাং আমরা দেখলাম কীভাবে শের খানের উত্থানের পশ্চাতে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশ ও বিহারের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাংলা-বিহার ক্রমাগত দ্বন্দ্ব অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সুলতান মহম্মদের মৃত্যুর পরেও (১৫৩০) তিনি ছিলেন বিহারের প্রথম সারির ব্যক্তি যিনি বাংলার শক্তিশালী রাজপরিবারের বিরুদ্ধে একের-পর-এক যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। এভাবেই শের খান হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ুনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর একজন যোদ্ধা, যাঁকে সমীহ করা ছাড়া কোনো রাস্তাই ছিল না হুমায়ুনের।
শূর সাম্রাজ্য (১৫৪০-৫৬)
কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করবার পর শের শাহ নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল যে-কোনো প্রকারে মুঘলদের ভারত ছাড়া করা এবং কোনোভাবেই যেন তারা এদেশে ফিরে আসতে না পারে সেই ব্যাপারটা নিশ্চিত করা। মুঘল শিবিরে গভীর বিভাজন থাকায় তাকে এই কাজ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হল না। আমরা দেখেছি কীভাবে লাহোরে কামরান শের শাহের সঙ্গে যুদ্ধ করা তো দূরের কথা হুমায়ুনকে কাবুল দখল করতে পর্যন্ত দেননি, ফলে হুমায়ুনকে প্রায় একা হয়ে গিয়ে সিন্ধু অঞ্চলে ভাগ্য পরীক্ষায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। শের খানের তাড়নায় শেষমেশ কামরানকে কাবুলে সরে আসতে হয়েছিল যখন মির্জা হায়দার দুঘলত কাশ্মীরে অভিযান চালিয়ে তা জয় করে নিয়েছিলেন। শের শাহের বাহিনী খাইবার পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। শের শাহ খুসহাব অঞ্চলে থাকাকালীন রোহ অঞ্চল থেকে প্রচুর আফগান প্রধান গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে অনেকে শের শাহের বাহিনীতে যোগদানও করেছিলেন। কিন্তু শের শাহ বিচক্ষণতার সঙ্গে ঠিক করেছিলেন যে তার সাম্রাজ্যে তিনি কখনোই এই স্বাধীনতাপ্রিয় আফগানদের সঙ্গে বেশি সখ্যতার সম্পর্কে জড়াবেন না। সেই কারণেই তাঁর সাম্রাজ্য সিন্ধু অঞ্চল। পেরিয়ে আর ভারতের দিকে সম্প্রসারিত হতে পারেনি। আর তার ফলেই এ-সময় থেকে বাহলোল লোদির আমলে ভারতে প্রবেশ করা আফগান জনজাতির লোকজন। ক্রমে এদেশীয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল এবং ভারতের ভূখণ্ড তাদের কাছে পরিণত হচ্ছিল স্বদেশ ভূমিতে। যদিও এদের আটকানোর একটা উদ্যোগ শের শাহের তরফে নেওয়া হয়েছিল। সল্ট রেঞ্জ অঞ্চলে বসবাসকারী গক্ষরদের যুদ্ধে পরাজিত করে হটিয়ে দিয়ে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে এবং একই সঙ্গে ভারতে মুঘলদের আগমনের কোনোরকম সম্ভাবনাকে প্রতিহত করতে রোহতাস-এ নতুন শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। এই কাজের দায়িত্ব বর্তেছিল টোডর মল ক্ষত্রির ওপর।
হুমায়ুনকে তাড়া করে ভারত থেকে অপসারিত করার লক্ষ্যে শের শাহ একটা বাহিনী মুলতানে প্রেরণ করেছিলেন এবং নিজেও কিছুটা সময় সেখানে থেকে পরিস্থিতির ওপর নজর রেখেছিলেন। ফলে রীতিমতো চাপে পড়ে গিয়েছিলেন মুলতানের শাসক। হুমায়ুনকে সাহায্য করার বদলে তাকে অপসারিত করার কাজে নামতে হয়েছিল। পাঞ্জাবের অংশ হিসাবে মুলতান তখন শের শাহের নিয়ন্ত্রণে। তাই শের শাহের কথার অমান্য করার সাধ্য মুলতানের শাসকের ছিল না। কিন্তু শের শাহ মুলতানে এসেও উচ্চ সিন্ধু অঞ্চলের দিকে বেশি অগ্রসর হননি এবং হুমায়ুনকেও আর তাড়া করার উদ্যোগ নেননি। কারণ যেভাবে মুঘল সেনাবাহিনীকে তিনি ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিলেন, তারপর আর হুমায়ুনকে নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না তার।
দু’বছর পর ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে মুলতানে আক্রমণকারী বিলোচ উপজাতিকে উৎখাত করতে শের শাহ একটা সামরিক অভিযান সেখানে চালিয়েছিলেন। সেনাপতি হইবাত খান নৈজিকে বলা হয়েছিল ‘(কোট) বুলাহের দস্যু প্রধান ফতে খান জাটকে ধ্বংস করে ও মুলতান থেকে বিলোচদের উৎখাত করে সেখানকার সমৃদ্ধি রক্ষা করো। হয়তো এই পদক্ষেপ ভারতের সঙ্গে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বাণিজ্য পথকে নিষ্কণ্টক। করার উদ্দেশ্যে এবং মুলতানকে একটা প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে সুরক্ষিত রাখতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। হয়তো-বা শের শাহ লাহোর থেকে মুলতান পর্যন্ত যে নতুন রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন, এটা ছিল সেই লক্ষ্যপূরণের একটা পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের একটা কৌশলগত দিকও ছিল, আর তা হল– হুমায়ুনের সঙ্গে গোপন আঁতাত তৈরি করা মালদেওকে এই অভিযানের মাধ্যমে চাপে রাখা। হইবার খান দ্রুত সন্ধি স্থাপনের নীতি নিয়ে মুলতান, ভাক্কার ও সেহওয়ান সহ সমগ্র উচ্চ সিন্ধু অঞ্চলকে আফগান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন।
পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার পর শের শাহ এবার নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহের জীবন ছেড়ে একটি বলিষ্ঠ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়ার সময় পেয়ে যান। কিন্তু সে সময়ের দাবি ছিল অন্য। যুদ্ধ না করলে, আক্রমণ করে রাজ্য জয় না করলে টিকে থাকা ছিল প্রায় অসম্ভব। কাশ্মীর থেকে মির্জা হায়দার দুঘলতকে উৎখাত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল কারণ তিনি হুমায়ুনকে সার্বভৌম সম্রাট হিসাবে স্বীকার করে নিয়ে তার নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা উৎকীর্ণ করা শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনিক দিকে নজর দিতে গিয়ে শের শাহ এ-ব্যাপারে খুব একটা তৎপর হতে পারেননি। তবে দ্রুত তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে পুনরায় যুদ্ধবিগ্রহের জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন এবং প্রথমেই তিনি বাংলায় ঘনিয়ে ওঠা এক বিদ্রোহের অঙ্কুরে বিনাশ ঘটান। বাংলায় সে সময় আফগান সাম্রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক শাসক মৃত সুলতান মেহমুদের কন্যাকে বিবাহ করে সেখানকার সেনাবাহিনীকে সংঘঠিত করতে শুরু করেছিলেন এবং পূর্বের বাংলার শাসকের মতো ক্ষমতা ভোগ করার অভিপ্রায় নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু তার সে আশা শুরুতেই বানচাল করে দেন শের শাহ। এরপর তিনি মালব, রাজস্থান এমনকি মুলতান ও উচ্চ সিন্ধু অঞ্চলেও আক্রমণ চালিয়েছিলেন। আর তার শেষ পদক্ষেপ ছিল বুন্দেলখণ্ডের ওপর নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করা। আমরা আগেই বলেছি যে শের শাহের দাক্ষিণাত্যে আক্রমণের একটা পরিকল্পনা ছিল। অর্থাৎ বুন্দেলখণ্ড জয় করার পর তিনি খান্দেশ ও আহমেদনগর দখল করতে চেয়েছিলেন।
মালব থেকে হুমায়ুনকে বিতাড়িত করার পর মালু খান কাদির খান’ উপাধি নিয়ে। নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করে দেন, যদিও তাকে স্থানীয় গোষ্ঠী প্রধানদের বিশেষ করে চান্দেরি ও রাইসিনের রাজপুতদের স্বাধীন শাসক হিসাবে কাজ করার অনুমতি দিতে বাধ্য হতে হয়। শের শাহ ১৫৪২ সালে মালব জয় করার পর তাকেও স্থানীয় বহু হিন্দু রাজাদের নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীন ভাবে কাজ করার অধিকার দিতে হয়। এর ফলে সমস্যা তৈরি হওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। পরের বছরেই স্থানীয় বিদ্রোহ দমন করতে এবং চান্দেরি দুর্গ থেকে শক্তিশালী এক রাজপুত প্রধান পুরানমলকে উৎখাত করতে শের শাহকে পুনরায় মালবে ফিরে আসতে হয়। এই পুরানমল আগে একবার শের শাহকে পরাজিত করেছিলেন এবং এবারেও তিনি শের শাহের সামরিক অবরোধ প্রতিহত করে দিয়েছিলেন। তিনি চার হাজার রাজপুত সেনা সহযোগে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে শের শাহের মোকাবিলা করেছিলেন। পুরানমলকে সঙ্গ দিতে ছুটে এসেছিলেন তাঁর পরিবারের যোদ্ধারাও। কিন্তু সেই রাজপুত বাহিনী ও সকল পরিবার যখন শের শাহের শিবিরের নিকটবর্তী একটি জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। যদিও বিশ্রাম অবকাশে নিরাপদ থাকার পূর্ণ আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল শের শাহের শিবিরের তরফ থেকে, তবুও সে আশ্বাস রাখা হয়নি। কয়েকজন আফগান ঐতিহাসিক অবশ্য শের শাহের ওপর আরোপিত এই বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ মানেন না, তাদের যুক্তি যে পুরানমলের মতো একজন ধর্ম-বিরোধী রাজাকে দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখার দরকার নেই। তিনি নাকি বহু সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মহিলাকে নিজ গৃহে দাসী করে রাখতেন, তাই তিনি একজন ঘৃণ্য শাসক। যদিও পুরানমলকে নিয়ে লেখা ইতিহাসে এ-অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে, তবুও এটা উল্লেখ করতেই হবে যে এর আগে তাঁর পিতা সিলহাদির ওপরেরও এই একই ধরনের অভিযোগ আরোপ করা হয়েছিল।
মালব ও চান্দেরি জয় করার অর্থ ছিল মারওয়ার জয়ের হাতছানি আর সেখানে। ১৫৩১ সাল থেকে শাসন করছিলেন মালদেও। তিনি খুব দৃঢ় ভাবে তার শক্তিকে সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং সম্ভল ও নারনাউল সহ সমগ্র পশ্চিম ও পূর্ব রাজস্থানে নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে তার সেনাবাহিনীকে নাকি আগ্রার সীমান্তবর্তী হিন্দুয়ান ও বায়ানার কাছে প্রায়শই টহল দিতে দেখা যেত। তিনি আজমের, মেরোটা ও যোধপুরের মতো তার অধীনে থাকা দুর্গগুলির সামরিক নিরাপত্তাকে বেশ মজবুত করে ঢেলে সাজিয়ে ছিলেন এবং নানান কৌশলগত কেন্দ্রে নতুন দুর্গ। নির্মাণও করেছিলেন। সাতালমের ও পোখরান অঞ্চল জয় করার ফলে তিনি সেখানকার ভাট্টিদের বিশাল সংখ্যায় নিজ বাহিনীতে যুক্ত করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। এই ভাট্টিরা তাদের অদম্য সাহস ও শৌর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। মালদেওয়ের শেষ আক্রমণ ছিল বিকানেরের বিরুদ্ধে যেখানে শাসন করতেন তারই এক আত্মীয়। তিনি দুর্গ হাতছাড়া হওয়ার আগেই মালদেওয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে মারা গিয়েছিলেন। যদিও এর মধ্যে বিকানেরের শাসকের দুই পুত্র কল্যাণমল ও ভীম কোনোরকমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তারা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন শের শাহের দরবারে। সেখানে আশ্রয় পেয়েছিলেন মেরোটার শাসক বিরামদেও-ও।
সাম্রাজ্য বৃদ্ধির নেশায় মত্ত হয়ে মালদেও এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যে ক্রমেই তিনি তার নিজের ‘ঠিকানাদার’ (বংশানুক্রমিকভাবে জায়গির অধিকারী), ‘ঠিকানা’ থেকে উচ্ছেদ করা অধীনস্থ কর্মচারী বা নিজের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এমনকি মেবারের রারনা বা কচ্ছওয়া, শেখওয়াতি প্রভৃতি গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গেও মালদেওয়ের ঝামেলা শুরু হয়েছিল। এই অন্তর্দ্বন্দ্বই মালদের। পরাজয় ও পতনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলা যায়।
এটা বলা খুব মুশকিল যে মালদের লক্ষ্যটা আসলে ঠিক কি ছিল। তিনি যদি। সমগ্র রাজস্থান জুড়ে রাঠোর প্রাধান্য গড়ে তুলতে চেয়ে থাকতেন তাহলে তা না হয়। বোধগম্য হত, কিন্তু কে, আর, কানুনগোর মত অনুসারে তিনি যদি সত্যিই অষ্টম শতকের রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের পুনরুত্থানের মতো এক রাজনৈতিক মরীচিৎকার পিছনে ছোটার স্বপ্ন দেখে থাকেন, তাহলে তা ছিল চরম অনৈতিহাসিক একটা কাজ। কানুনগো নিজেই জানিয়েছেন যে রানা সঙ্গের মতো মালদেওয়ের বিভিন্ন রাজপুত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না। তার লাগাম ছাড়া ক্ষমতা বৃদ্ধির নীতি ও চরিত্রের নানা ত্রুটির ফলেই বিভিন্ন রাজপুত গোষ্ঠী এমনকি তার নিজের রাঠোর জনজাতির বহু মানুষও তাকে সমর্থন করতেন না। তাছাড়া যদি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি তাহলেও কেবলমাত্র রাজস্থান-ভিত্তিক কোনো সাম্রাজ্য কখনোই পাঞ্জাব ও বিহার সাম্রাজ্যের কাছে টিকতেই পারত না। মালদেও সেটা ভালো মতোই জানতেন, তাই শের শাহের সঙ্গে খোলাখুলি সংঘাতে যাননি। শের শাহ ১৫৪১ সালে তাই পূর্ব রাজস্থানের রনথম্ভর ও কচ্ছবহ অঞ্চল দখল করে নিয়েছিলেন মালদেওয়ের কোনোরকম বিরোধিতা ছাড়াই। শের শাহের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল নাগোর সহ শেখায়াতি অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। এই পদক্ষেপ ছাড়াও শের শাহ মালদেওকে স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে যদি তিনি হুমায়ুনকে বিতাড়ন বা বন্দি করেন তাহলে তাকে যেন বিকানির আক্রমণ করতে কোনোরকম বাধা দেওয়া না হয়। যদি বাধা দেওয়া হয় তাহলে শের শাহ যে মালদেওকে ছেড়ে বলবেন না তা এই বার্তা থেকেই স্পষ্ট ছিল। ফলে মালদেও বাধ্য হলেন হুমায়ুনের সঙ্গে তিক্ততা কিছুটা মিটিয়ে নিতে। তবে ইতিমধ্যেই মালদেওয়ের আগে করা এক আক্রমণের জবাবে হুমায়ুন একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী নিয়ে সহজে যোধপুর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু মালদেওয়ের মনোভাব বদলে যাওয়ায় তিনিও ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। হুমায়ুন-মালদেও সখ্যতা তৈরি হতে দেখে শের শাহ তাঁর আক্রমণ। থামিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই তবে তা ছিল সাময়িক। আসলে এটা ছিল পরবর্তী পরিকল্পনা। করার জন্যে একটা বিরতি। দিল্লি ও আগ্রা-ভিত্তিক কোনো সাম্রাজ্যই রাজস্থানে বিরোধী কোনো শক্তির বাড়বাড়ন্ত খুব বেশিদিন সহ্য করতে পারত না কারণ তা ছিল বাড়তি একটা আতঙ্ক যা পার্শ্ববর্তী মালব ও গুজরাটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াত যে-কোনো সময়। তাই শের শাহ মালদেওকে হটাতে আক্রমণ যে করবেনই তা বোঝা যাচ্ছিল।
১৫৪৩-এর শুরুর দিকে শের শাহ ৪,০০০ অশ্বারোহী বাহিনী ও একটি শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনীর গোষ্ঠী সহযোগে আগ্রার অভিমুখে অভিযান শুরু করলেন এবং যোধপুর ও আজমেরের মাঝামাঝি জৈতরনের কাছে সামরিক ঘাঁটি বানালেন। মালদেওয়ের কাছেও ৫০,০০০ সেনা ছিল, কিন্তু তাদের কাছে গোলন্দাজ বাহিনী ছিল না। ফলে মালদেওয়ের রাজপুত বাহিনী আফগানদের তুলনায় শুরু থেকেই অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে শের শাহ প্রথমেই তার শিবিরের চারপাশে পরিখা ও মাটির কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করে গোলন্দাজ বাহিনী সহ সমগ্র বাহিনীকে নিচ্ছিদ্র নিরাপদ বলয়ের মধ্যে ঘিরে ফেলেছিলেন। এই রকম একটি সুসঘবদ্ধ নিরাপদ বেষ্টনী-সম্বলিত আফগান শিবিরে মালদেওয়ের আক্রমণ করতে যাওয়া ছিল প্রায় আত্মহত্যা করতে যাওয়ার সমান। কিন্তু আক্রমণ তাকে করতেই হত। টানা একমাস ধরে দুই শিবিরের খণ্ডযুদ্ধ চলার পর দেখা গেল রাও মালদেও ক্রমে যোধপুর ও সিওয়ানার দিকে সরে আসছেন। হয়তো এটা একটা কৌশল ছিল নিজের শিবিরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও কিছুটা সংগঠিত করে নেবার। কিন্তু এভাবে যুদ্ধ থেকে সরে আসা, তা সে যতই রণকৌশলের অঙ্গ হোক না কেন–মালদেওয়ের যোদ্ধা রাজপুত সর্দারদের কাছে ছিল চরম অসম্মানজনক একটা ব্যাপার। তাই তারা মালদেওয়ের এই পদক্ষেপে প্রচণ্ড অখুশি ছিল। এইভাবে সেনাবাহিনীর মধ্যে মতপার্থক্যের খবর, শের শাহের আক্রমণ করতে আসার ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদি একাধিক কারণে মালদেও তার কয়েকজন যোদ্ধা রাজপুত সর্দারের আনুগত্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। ফলে মালদেওয়ের শিবিরের এই মতানৈক্যের বাতাবরণ শের শাহকে আক্রমণ করার সুবিধাজনক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। শের শাহের সেনার আক্রমণে বেশিরভাগ রাজপুত সেনাই পিছু হটতে বাধ্য হলেও একটা সাহসী সেনাদলের সঙ্গে লড়াইয়ে শের শাহকে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়েছিল। যাই হোক, খুব দ্রুত যোধপুর ও আজমের আফগানদের দখলে চলে আসে। মালদেও সিওয়ানার দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেন। যোধপুর ও আজমেরে সেনা মোতায়েন করে শের শাহ ফিরে আসেন মেবারে। মেবারের রানা শের শাহের হাতে চিতোর তুলে দেন ও শান্তিচুক্তি করেন। এরপর শের শাহ মাউন্ট আবু পর্যন্ত নিজের অধিকার কায়েম করতে পেরেছিলেন। আর এভাবেই পশ্চিমের কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে শের শাহ সমগ্র রাজস্থানের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত হয়েছিলেন। শের শাহ একটা কথা প্রায়শই বলতেন যে, ‘দুহাত ভরা খাদ্যশস্যের বিনিময়ে দিল্লির সাম্রাজ্য আমার হাতে অর্পণ করা হয়েছিল। এর অর্থ এই নয় যে দিল্লি তাকে নিজে থেকে জয় করতে হয়নি, এমনিই পেয়ে গিয়েছিলেন আর রাজস্থান তাঁকে লড়ে জয় করতে হয়েছিল কারণ মালদেও যদি আর-একটু আগ্রাসনের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন তাহলে শের শাহ তার কাছে হেরে গেলেও যেতে পারতেন। আসলে ওই কথার মাধ্যমে শের শাহ হয়তো এটাই বলতে চেয়েছিলেন যে রাজস্থানের তুলনায় দিল্লি জয়ের জন্যে তাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অর্থাৎ পরোক্ষ ভাবে রাজস্থানের লড়াকু রাজপুত যোদ্ধাদের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়েও হার না মানার স্পৃহাকে শের শাহ কুর্নিশ করেছিলেন। সম্মান জানিয়েছিলেন মাড়ওয়ার বাহিনীর দুই নেতা–জয়িতা ও কুপার-এর অদম্য সাহস ও পরাক্রমকে।
রাজস্থান জয় করার পর আশা করা হয়েছিল শের শাহ গুজরাট, উচ্চ সিন্ধু অঞ্চল ও তার রাজধানী ভাখার অঞ্চল (এটি একবার শের শাহ দখল করেছিলেন, কিন্তু পরে হাতছাড়া হয়ে যায়) জয়ের জন্য অগ্রসর হবেন। কিন্তু কিছু অদ্ভুত কারণে তিনি তা না করে রাজস্থান থেকে সোজা বুন্দেলখণ্ডের ভাটা (রেওয়া) অভিযানে চলে গিয়েছিলেন। ভাটার কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ করার সময়ে কামান থেকে ছোঁড়া একটি গোলা দুর্গের প্রাকারে ধাক্কা লেগে নিচে রাখা একাধিক গোলার ভাণ্ডারে পড়ে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। ঘটনাস্থলেই দাঁড়িয়েছিলেন শের শাহ। ফলে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে মারা যান তিনি (১৫৪৫)। তবে তার মৃত্যুর আগেই দুর্গের ওপর দখল নিতে সক্ষম হয়েছিল তার বাহিনী যা তিনি শেষবারের মতো দেখে যেতে পেরেছিলেন।
শের শাহের উত্তরাধিকারী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তার দ্বিতীয় পুত্র জালাল খান যিনি আবার ইসলাম শাহ উপাধি ধারণ করেছিলেন। এই ইসলাম শাহের প্রায় নয় বছরের শাসনকাল মূলত কেটেছিল তার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা আদিল খান ও অন্যান্য অভিজাতদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ করে। যদিও শের শাহের সময়ে ইসলাম শাহ তার বাহিনীর একজন উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলেন, তবুও ক্ষমতায় আসার পর সেই ইসলাম শাহ তার পিতার ঘনিষ্ঠ ও সাম্রাজ্যটা মনপ্রাণ দিয়ে গড়ে তুলতে ইচ্ছুক অভিজাতদের কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতেন না এবং তাদের সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, আফগান ঐতিহ্য অনুসারে অভিজাতদের সাম্রাজ্যের অংশীদার ভাবার বদলে ইসলাম শাহ তাদের নিজ পদস্থ কর্মচারী মনে করতেন, অভিজাতদের সর্বময় প্রভু হতে চাইতেন। সেই কারণেই তিনি এক আচরণবিধি জারি করেছিলেন যা প্রত্যেক শুক্রবার উচ্চ পদাধিকারী অভিজাতদের জমায়েতে পড়ে শোনানো হত। এই জমায়েতে সুলতানের জুতো ও তির-ধনুক বহনকারী অভিজাত বসতেন উঁচু একটি চেয়ারে (কুর্সি) এবং ২০,০০০, ১০,০০০ বা ৫,০০০ সওয়ারধারী সেনা রাখা উচ্চ অভিজাতরা ক্রম অনুসারে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতেন ও নত হয়ে তাদের অভিবাদন জ্ঞাপন করতেন। ইসলাম শাহ ইত্তা ব্যবস্থা তথা অভিজাতদের প্রদেয় জায়গিরের ওপরও বৃহত্তর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি সমস্ত জায়গিরকে তাঁর রাজকীয় ছত্রছায়ায় (খালিসা) আনতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীকে জায়গির প্রদানের পরিবর্তে নগদে বেতন দিতেও চেয়েছিলেন।
এইসব পদক্ষেপ একটু একটু করে আফগান অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষের বারুদকে পুঞ্জীভূত করছিল যা সম্পূর্ণরূপে বিস্ফোরিত হয়ে যায় ১৫৫৩ সালে ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর। এভাবেই শূর সাম্রাজ্যের ওপর নেমে আসে অবক্ষয়ের কালো ছায়া। আর এটাই মুঘলদের সামনে একটা সুযোগ এনে দেয় দিল্লিতে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার।
শের শাহ ও ইসলাম শাহের অবদান
যদিও শের শাহ মাত্র পাঁচ বছর শাসন করেছিলেন তবুও তার অবদানের কিন্তু শেষ ছিল না। তার প্রথম অবদান ছিল দীর্ঘ সাম্রাজ্যের সর্বস্তরে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। তিনি সব সময় রাস্তাঘাট নিরাপদ রাখার দিকে জোর দিতেন, চোর ডাকাতদের তিনি কড়া হাতে দমন করেছিলেন। তিনি ভালো মতোই বুঝেছিলেন যে রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হলে সবার আগে স্থানীয় জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কারণ এমন বহু জমিদারের সঙ্গে চোর ডাকাতদের গোপন আঁতাত থাকত। এভাবেই তিনি ফতে খান জাঠের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এই ফতে খান জাঠ সমগ্র লাখি জঙ্গল এলাকায় (এটি বর্তমানে মন্টোগোমারি জেলা ও দিপালপুরের পুরোনো সরকার এলাকার অন্তর্গত) তাণ্ডব করে বেড়াত এবং লাহোর থেকে দিল্লি আসার পথে বারবার লোকজনদের নানা হিংসাত্মক কাজের মাধ্যমে হয়রান করত। সম্ভল। (মোরাদাবাদের কাছে) ও লখনউ সরকারের প্রাদেশিক আধিকারিকরা নাছোড়বান্দা জমিদার ও ডাকাতদের জ্বালাতনে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। এই সব। লুঠেরারা যে জঙ্গলকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করত সেই জঙ্গলকেই আস্তানা বানানোর জন্য নির্মম ভাবে কেটে ফেলত আর তাণ্ডব চালিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায় চুরি-ডাকাতি চালাত। এদের নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন শের শাহ। একইভাবে কনৌজের আধিকারিক দিয়ে সেই এলাকার ডাকাতি ও রাজপথে লুঠতরাজের ঘটনার ওপর অনেকটাই রাশ টানতে পেরেছিলেন তিনি। এইভাবে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি যে শুধু রাস্তাঘাটকে নিরাপদ করেছিলেন তাই নয়, ভূমি রাজস্ব প্রদান ও রাজকীয় আদেশ পালনে অবহেলা করা জমিদারদের শায়েস্তাও করেছিলেন।
শের শাহ রাস্তাঘাট নিয়মিত মেরামতি করা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতিতে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। কারণ এর ফলে সামরিক কার্যকলাপ ও ব্যবসা-বাণিজ্য দুটোই বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ ছিল। রাস্তাগুলো আবার গ্রামাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তাই তিনি পশ্চিমে সিন্ধু নদী থেকে সুদূর পূর্বে বাংলার সোনারগাঁও পর্যন্ত প্রাচীন রাজকীয় রাস্তার (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড) মেরামতি করে নতুন রূপ দিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি আগ্রা থেকে যোধপুর ও চিতোর পর্যন্ত নতুন রাস্তা নির্মাণও করেছিলেন যার সাহায্যে খুব সহজেই গুজরাটের সামুদ্রিক বন্দর এলাকাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় ক্যারাভান সফরের সূচনা হত যেখান থেকে, সেই লাহোর ও মুলতানের মধ্যেও যোগাযোগ স্থাপন করে তিনি তৃতীয় রাস্তাটি নির্মাণ করলেন। আমরা আরও জানতে পারি যে রাস্তার মধ্যে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ও ভ্রমণকারীদের আরও বেশি। সুযোগ-সুবিধা দিতে শের শাহ নাকি রাজপথের প্রতি দুই কারোহ বা কোশ/ক্রোশ (চার মাইল) অন্তর একটি করে ‘সরাই তৈরি করেছিলেন। সেখানে হিন্দু ও মুসলিম ভ্রমণকারীদের জন্যে পৃথক পৃথক কামরা রাখা হয়েছিল যাতে তারা ঠিকঠাক মতো শয়ন করতে ও খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন। এমনকি সেই উদ্দেশ্যে সেখানে পৃথক মুসলিম ও ব্রাহ্মণ রাঁধুনিও নিযুক্ত করা হয়েছিল। হিন্দুদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতের নিয়ম অনুসারে বাইরে থেকে কঁচা খাবার সরবরাহেরও সুবিধা রাখা হয়েছিল। আব্বাস খানের মতে, শের খান আইন করে বলে দিয়েছিলেন যে ‘সরাইতে যেই আসুক না কেন তাকেই সরকারি অর্থে খাদ্য পরিষেবা দিতে হবে এবং তার ঘোড়াকে দানা ও পানীয় যথাযথভাবে সরবরাহ করতে হবে। বণিকদের পণ্য দ্রব্যের নিরাপত্তার জন্যে প্রত্যেক সরাইতে একজন করে প্রহরী (শাহনা) মোতায়েন করা হয়েছিল এবং মুসলমানদের জন্য নির্মিত মসজিদে নিয়োগ করা হয়েছিল ইমাম ও মুয়েজ্জিন। এদের ভরণপোষণের খরচ জোগাতে সরাইয়ের পাশেই নিষ্কর জমি বরাদ্দ করা হয়েছিল।
আমরা জানতে পারি যে শের শাহ সর্বমোট ১৭০০টি এমন সরাই নির্মাণ করেছিলেন। সেগুলি সত্যিই অত্যন্ত মজবুত ও নিরাপদ পান্থশালা ছিল কারণ এখনও এগুলির কয়েকটি টিকে রয়েছে। শোনা যায় শের শাহ নাকি প্রত্যেক সরাইতে বাজার বানাতে চেয়েছিলেন। অনেক সরাই তাই পরে মাণ্ডিতে পরিণত হয়েছিল যেখানে কৃষকরা। তাদের উৎপাদিত জিনিস বিক্রি করতে আসত। আর কিছু সরাই নতুন শহরের (কসবা) উত্থানের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসাবে ব্যবসা বাণিজ্য ও হস্তশিল্প কেনাবেচার কেন্দ্রের রূপ নিয়েছিল।
সরাইগুলো অবশ্যই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, না হলে ইসলাম শাহ শের শাহের বানানো প্রত্যেক দুই সরাইয়ের মাঝে আরও একটি করে সরাই নির্মাণের নির্দেশ দিতেন না। সরাইগুলো অনেক সময় ডাক চৌকির (ডাকঘর) কাজ করত আর তাই প্রত্যেক সরাইতে দুটি করে ঘোড়া মজুত রাখা হত যাতে প্রত্যেক দিনে ঘোড়ার দল চিঠিপত্রের বোঝা নিয়ে ৩০০ কোশ/ক্রোশ পথ পাড়ি দিতে পারে।
ব্যবসা ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্যে শের শাহ আরও অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেমন, তিনি আগেকার মিশ্র ধাতুর কম মূল্যবানের মুদ্রার পরিবর্তে একক মূল্যের রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। তার প্রচলিত রৌপ্য মুদ্রার মান দীর্ঘদিন ধরে আদর্শ মান হিসাবে গ্রাহ্য হয়েছিল। এছাড়াও তিনি ওজন ও পরিমাপের একটি স্থায়ী ও নির্দিষ্ট একক ধার্য করার ব্যাপারেও উদ্যোগী হয়েছিলেন।
শের শাহের সাম্রাজ্যের পণ্য পরিবহণের জন্য কেবলমাত্র দু’বার শুল্ক দিত হত একবার পণ্য আনার সময় ও আর একবার বিক্রির সময়। উদাহরণস্বরূপ আব্বাস সারওয়ানি আমাদের জানিয়েছেন—’যখন বাংলা থেকে পণ্যদ্রব্য আসত, তখন গরহির (সিক্রিগলি) কাছে তা থেকে (প্রথম) শুল্ক আদায় করা হত।’ কিন্তু সেগুলির আলাদা বিক্রয় শুল্ক নেওয়া হত না। একেবারে বৈদেশিক পণ্যের বিক্রয় শুল্কের সঙ্গেই সেগুলিকে। আদায় করা হত। তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘যখন (পণ্যদ্রব্য) খুরাসানের দিক থেকে। আসত তখন প্রথম শুল্ক আদায় করা হত রাজ্যের সীমান্তে, আর দ্বিতীয় বারের শুল্কটা। আদায় করা হয় পণ্যদ্রব্য বিক্রির সময়।’ কেন যে বাংলা থেকে আগত পণ্যদ্রব্যকে বৈদেশিক পণ্যের সঙ্গে মিশিয়ে একসঙ্গে সেগুলির থেকে বিক্রয় শুল্ক আদায় করা হত তা আমাদের জানা নেই। তবে একই সঙ্গে আব্বাস সারওয়ানি এও জানিয়েছেন –‘স্থলপথে তোক বা জলপথে, গ্রামে হোক বা শহরে, (সেসব পণ্যের ওপর) কেউ আর অন্য কোনো শুল্ক আদায়ের সাহস দেখাতে পারত না।
বাণিজ্য পথগুলি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ রাখার জন্যে শের শাহ একটি নিয়ম বানিয়ে মুকদ্দম (গ্রাম প্রধান) ও জমিদারের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করলেন যে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার রাস্তাঘাটে কোনোরকম চুরি বা পণ্যদ্রব্যের ক্ষয়ক্ষতি হলে সংশ্লিষ্ট দোষীকে তারাই গ্রেফতার করবে আর গ্রেফতার না করতে পারলে তার সব দায় তাদেরকেই নিতে হবে। যদি খুনোখুনির ঘটনা ঘটত ও খুনিকে পাকড়াও করা না যেত তাহলে মুকদ্দমকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। যদিও এভাবে নিরপরাধ মানুষদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার নিয়ম একপ্রকার বর্বরোচিত পদক্ষেপ ছিল, তবুও এই নিয়ম এই ভেবেই বানানো হয়েছিল যে এইসব চুরি ও রাজপথে লুঠ, খুনোখুনির মতো ঘটনা এইসব মুকদ্দমের প্রছন্ন মদতেই ঘটত বা এদের কাছে এসবের পূর্ণ তথ্য থাকত। যাই হোক, শের শাহের এই পদক্ষেপের হয়তো সুফল পাওয়া গিয়েছিল। আর তাই আব্বাস সারওয়ানি পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রথাগত একটি রূপক ব্যবহার করে বলেছিলেন ‘শের শাহের শাসনকালে যদি একজন সাদা চুলের বুড়ি মাথায় ঝুড়ি ভরতি মালপত্র ও অলংকার নিয়ে রাস্তা দিয়ে যেত, তাহলে শের শাহের ভয় ছাড়াও এমনিই কোনো চোর বা রাতের তস্কররা তার ধারে-কাছে আসার সাহস পেত না।’ এই সাদা চুলের বুড়ির কথাটা একটা প্রথাগত গল্প যা বহু আফগান লেখক রাস্তাঘাটের নিরাপত্তার উদাহরণ দিতে গিয়ে রূপক হিসাবে ব্যবহার করতেন। আব্বাস খানও লিখেছিলেন, ‘যদি তুমি দেশকে জনবহুল ও সমৃদ্ধশালী করতে চাও তাহলে সবার আগে রাস্তাঘাট ডাকাতদের তাণ্ডব থেকে মুক্ত করতে হবে।’
শের শাহ স্থানীয় ও অন্যান্য আধিকারিকদেরও আবেদন করেছিলেন ভ্রমণকারী ও বণিকদের কোনোভাবে আঘাত না করতে এবং রাস্তাঘাটে যদি কোনো বণিকের সম্পত্তি বেওয়ারিশ ভাবে পড়ে থাকে তাহলে কেউ যেন তাতে হাত না দেয়। এছাড়া শের শাহ তার আধিকারিকদের এটাও আদেশ দিয়েছিলেন যে তারা যেন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জিনিসপত্র যথাযথ বাজার দরেই ক্রয় করেন। যদিও এইসব নির্দেশ বাস্তবে মানা হত না। না হলে পরবর্তীকালে জাহাঙ্গিরকেও এই একই রকম আদেশ জারি করার প্রয়োজন পড়ত না। আর বানিয়ে তো পরিষ্কার ভাবেই শাহজাহানের আমলে উচ্চ অভিজাতদের দ্বারা বণিক ও ব্যবসায়ীদের ওপর দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছিলেন।
এটা বলা হয়ে থাকে যে শের শাহের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল তার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সাধন। পিতার জায়গিরের দায়িত্বে থাকাকালীন ও ১৫৩০-এর পর থেকে টানা দশ বছর বিহারের কার্যত শাসক হিসাবে কাজ করার সুবাদে যেভাবে তিনি পূর্বের রাজস্ব ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন তাতে তার পক্ষেই সম্ভব ছিল সেই ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করে তার সংস্কার করার। শের শাহ মনে করতেন যে ভূমি রাজস্বের নির্ধারণ কখনোই উৎপাদিত ফসলের ভাগ বা ফলনের আগাম হিসেবের ওপর ভিত্তি করে করা উচিত নয়। গ্রাম প্রধান বা জমিদারদেরও উচিত নয় নিজেদের রাজস্ব ভার সমাজের দুর্বল অংশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। তিনি শাসক হিসাবে রাজস্ব নির্ধারণের জরিপ পদ্ধতি (জাবত)-র ওপরেই নির্ভর করতেন। কৃষি জমির জরিপ করে রাজস্ব নির্ধারণের পদ্ধতি ভারতে অনেক পুরোনো এবং তা আলাউদ্দিন খলজি এক সময় নতুন করে চালু করেছিলেন। কিন্তু শের শাহ যে জরিপ পদ্ধতি প্রচলন করেছিলেন তা প্রথাগত পদ্ধতির থেকে আলাদা ছিল। প্রথাগত পদ্ধতিতে কোনো একটি কৃষি জমিতে কাটা ফসলের ওপর ভিত্তি করে সমগ্র জমির রাজস্ব পরিমাপ করা হত। কিন্তু শের শাহের আমলে জমিকে ভালো, খারাপ ও মাঝারি–এই তিন ভাগে ভাগ করা হল এবং এই সবরকম জমির কাটা ফসলের গড় পরিমাপ করা হল। তারপর সেই গড় পরিমাণের এক তৃতীয়াংশ নির্ধারিত হল রাষ্ট্রের ভাগ হিসাবে। এই হিসাবে একটি নির্দিষ্ট ফসল উৎপাদন হার (রায়) খাড়া করা হল যাতে যত জমিই জরিপ করা হোক না কেন এই হার অনুসারে রাষ্ট্রের ভাগটা যেন ঠিকঠাক ধার্য করা যায়। এই ফসলের উৎপাদন হারকেই স্থানীয় বাজারদরের নিরিখে নগদ টাকায় রূপান্তরিত করে নির্ধারিত হত রাষ্ট্রের প্রকৃত রাজস্বের দাবি। কৃষকদের হয় নগদে না হয় ফসলের মাধ্যমে এই দাবি মেটানোর সুযোগ দেওয়া হত, যদিও শের শাহ নগদে রাজস্ব পরিমাপ পদ্ধতি প্রচলন করেছিলেন। বিশেষ কারণে মুলতানে তিনি তা করতে পারেননি। সেখানে পুরোনো পদ্ধতিই বলবৎ ছিল এবং রাষ্ট্রের রাজস্ব দাবি ছিল মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ। শের শাহ কিন্তু জরিপের খরচ কৃষকদের থেকেই উশুল করতেন। প্রত্যেক বছরে বছরে জমি জরিপ করে রাজস্ব নির্ধারিত হত। আর প্রতি বছরের অবশ্যম্ভাবী দুর্ভিক্ষের ফলে রাজস্ব আদায়ে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই প্রতি বিঘা পিছু আড়াই সের ফসল দূরে একটি অতিরিক্ত কর আগে থেকেই নিয়ে রাখা হত।
ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার এই সংস্কার প্রক্রিয়া কি শের শাহ ও ইসলাম শাহের নেতৃত্বাধীন সমগ্র সাম্রাজ্যেই প্রযুক্ত হয়েছিল নাকি প্রত্যেক কৃষক বা গ্রাম প্রধান (মুকদ্দম) ও জমিদারদের সঙ্গে পৃথক পৃথক ভাবে এই নতুন পদ্ধতিতে ভূমি বন্দোবস্ত করা হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। একদিকে আবুল ফজল বলেছেন। যে শের শাহ ও ইসলাম শাহের আমলে সমগ্র হিন্দুস্তানেই রাজস্ব নির্ধারণ পদ্ধতি অনুমানের ভিত্তিতে ফসলের ভাগ করে নেওয়ার প্রথা থেকে পরিমাপ করে রাজস্ব নির্ধারণের প্রথায় রূপান্তরিত হয়েছিল। অন্যদিকে মুঘল আমলের কৃষি অর্থনীতির ওপর বিস্তর গবেষণা করে অধ্যাপক ইরফান হাবিব জানিয়েছেন যে এমনকি আকবরের সময়েও পরিমাপ পদ্ধতির মাধ্যমে ভূমি বন্দোবস্ত কেবল দোয়াব, পাঞ্জাব ও মালবের নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গাতেই করা হত। অর্থাৎ এক পদ্ধতি কোনো প্রদেশেই সমগ্র অঞ্চল জুড়ে প্রয়োগ করা হয়নি। তবে ‘জাবত’ ব্যবস্থার প্রচলন নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল এটা বলাই যায়। জানা যায়, প্রত্যেক কৃষককে কত পরিমাণে রাজস্ব দিতে হবে তা একটা কাগজে লিখে রাখা হত, যাকে বলা হত ‘পাট্টা এবং প্রত্যেককে সে ব্যাপারে অবগত করানো ছিল রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কেউ এই লিখিত পরিমাণের অতিরিক্ত রাজস্ব দাবি করতে পারত না। আধুনিক কালের অনেক ঐতিহাসিক এই পদ্ধতিকে ব্রিটিশ আমলে প্রচলন করা রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন; যেখানে রাষ্ট্র কৃষকের সঙ্গে ভূমি রাজস্বের ব্যাপারে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করত। তবে আধুনিক গবেষণায় এসব ধারণা ভ্রান্ত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেছে যে, প্রত্যেক কৃষকের সঙ্গে সরাসরি বন্দোবস্ত করা হলেও সেখানে জমির পরিমাপ ও রাজস্ব আদায়–উভয় কাজই গ্রাম প্রধান বা জমিদারদের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্পূর্ণ হত না, আর সে জন্যে তারা দেয় রাজস্বের একটা ভাগও পেত। মধ্যযুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো শাসকের পক্ষেই মুকদ্দম ও জমিদারদের সম্পূর্ণ বাইরে রেখে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। শুধু এদের জোরজুলুম করে রাজস্ব আদায়ের কার্যকলাপে বিভিন্ন সময় কেউ কেউ কিছুটা অঙ্কুশ লাগাতে চেষ্টা করেছিলেন এই যা।
কৃষক সমাজের প্রতি শের শাহের মনোভাবের মধ্যে কিছু স্ববিরোধিতা আমাদের নজরে পড়ে। শোনা যায় তিনি নাকি কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে খুব সচেতন। ছিলেন। যখন পিতার জায়গির সামলাতেন তখন তিনি নাকি বলেছিলেন– ‘আমি জানি আমার কৃষক বন্ধুরা কৃষির কেন্দ্রবিন্দু। যদি তারা সুখে থাকে কৃষিকাজও ভালো হবে। যদি তাদের অবস্থা খারাপ হয় কৃষির উৎপাদনও শোচনীয় হয়ে পড়বে।’ তাই যখন তার সেনাদল কোনো কৃষিক্ষেত্র বরাবর টহল দিত তখন যাতে কোনোভাবেই জমির ফসলের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে তিনি সর্বদা কড়া নজর দিতেন। তিনি লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন যারা সেনাবাহিনীকে কৃষিজমির কাছে আসা থেকে বিরত করত এবং যেসব সৈনিক এই নিয়ন্ত্রণ অমান্য করত তাদের বিরুদ্ধে শের শাহ কড়া ব্যবস্থা নিতেও পিছপা হতেন না। আব্বাস খান জানিয়েছেন যে যদি কোনো কৃষিক্ষেত্রের পার্শ্ববর্তী সংকীর্ণ পথ দিয়ে যেতে গিয়ে সেনাবাহিনীর দ্বারা অনিচ্ছাকৃত ভাবে জমি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেত তাহলে খুব দ্রুততার সঙ্গে একজন বিশ্বস্ত আমিনকে নিয়োগ করে কৃষিক্ষেত্রের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা যাচাই করা হত এবং ক্ষতিগ্রস্ত জমির চাষিকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হত।
যদিও শের শাহের এসব চিন্তা কেবল সেইসব কৃষকদের প্রতিই ছিল যারা তার প্রতি পুরোপুরি ভাবে অনুগত থাকত, রাজকীয় নিয়মকানুন মেনে চলত এবং বকেয়া খাজনা সময়মতো মিটিয়ে দিত। যেসব কৃষক বা জমিদাররা বকেয়া খাজনা মেটাতে অবহেলা করত বা সময়মতো আমিলের দফতরে হাজিরা দিত না তাদের কোনোভাবেই ক্ষমা করা হত না। তখন জমিদারদের অধিকারে থাকা গ্রাম কেড়ে নেওয়া হত, তাদের হত্যা করা হত, তাদের বউ-বাচ্চাকে দাস বানানো হত, সম্পত্তি ও গৃহপালিত পশু বাজেয়াপ্ত করা হত, এমনকি তাদের জমি থেকে উৎখাত করে নতুন কৃষকদের সেখানে জমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা হত। এগুলিই ছিল কার্যত প্রথাগত রীতি।
এটা সাধারণত মনে করা হয় না যে তিনি এ-দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন এনেছিলেন। রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তরে ছিল কয়েকটি গ্রামকে নিয়ে গঠিত পরগনা। প্রত্যেক গ্রামের একজন করে প্রধান ছিলেন (মুকাদ্দম) যিনি গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন এবং ছিলেন একজন করে পাটোয়ারি যিনি হিসাবপত্র দেখতেন। এরা কেউ সরকারি কর্মচারী ছিলেন না, কিন্তু তাও উৎপাদিত ফসলের একটা অংশ। তাদেরকে দিতে হত। পরগনার দায়িত্ব ছিল শিকদারের ওপরে, যিনি পরগনার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও সাধারণ প্রশাসনিক কাজকর্ম করতেন। আর ছিলেন। মুন্সিফ বা আমিল যারা ভূমি রাজস্ব নির্ধারণের জন্যে মাপজোকের কাজ করতেন। এরা রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এদের এই কাজে সহায়তা করতেন। দু’জন সহকারী আধিকারিক যাদের মূল কাজ ছিল রাজস্ব পরিমাপ ও সংগ্রহের যাবতীয় হিসাবপত্র ফারসি এবং স্থানীয় ভাষায় (হিন্দভি) লিপিবদ্ধ করে রাখা। এ। ছাড়াও ছিলেন খাজনাদার বা পোদ্দার নামক এক শ্রেণির কর্মচারী যারা আদায়ীকৃত নগদ অর্থ জমা রাখতেন। শের শাহ মনে করতেন যে আমিল পদটি বেশ লাভজনক তাই প্রতি দু’বছর ছাড়া এই পদে আসীন কর্মচারীদের পরিবর্তন করতেন যাতে তার নিকটস্থ মানুষজন সেই পদে নিযুক্ত হয়ে কিছুটা আর্থিক মুনাফা করতে পারে। ফলে। শের শাহ অতিরিক্ত কর আদায় রুখতে যেসব নিয়ম-কানুন বানিয়েছিলেন তাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারই প্রিয়পাত্ররা হিসাব বহির্ভূত অর্থ আদায় করে নিজেদের পকেট ভরাতেন অথচ শের শাহ সব দেখেও কিছুই করতে পারতেন না।
পরগনার ওপরে ছিল শিক, যাকে লোদি আমল থেকে সরকার বলা হত। যদিও বলা হয়ে থাকে যে সরকারের প্রধান পদটির নাম ছিল “শিকদার-ই শিকদারান’, কিন্তু বাস্তবে এ-ধরনের পদাধিকারী বা উপাধিধারী কোনো মানুষের খোঁজ কোথাও পাওয়া যায়নি। সরকারের প্রধান হিসাবে যে পদের নাম ব্যবহৃত হত তা হল ফৌজদার বা মুকতা এবং তাকে সহযোগিতা করতে মুন্সি বা মুন্সিফ-ই-মুন্সিফান, যার প্রধান কাজ ছিল ভূমি রাজস্ব নির্ধারণ ও পরগনার মধ্যে সীমান্ত সংক্রান্ত বিবাদের সমাধা করা। এরাও সরাসরি ভূমি রাজস্ব আদায়ের কাজে যুক্ত থাকতেন এবং এদের অনেককেই আমরা সামরিক কার্যকলাপে অংশ নিতেও দেখি।
শের শাহের সাম্রাজ্যে প্রাদেশিক শাসনের কোনো ব্যবস্থা ছিল কিনা সে নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে যেটা দেখা গিয়েছে তা হল সুলতানি আমলে এ-ধরনের কোনো প্রাদেশিক সংস্থা ছিল না, কিন্তু অনেক সময়েই একদল শিক একজোট হয়ে যেত, তখন তাদের বলা হত খিত্তা বা ভিলায়াত। এ ধরনের ঘটনা মূলত বাংলা বা পাঞ্জাবের মতো সীমান্তবর্তী এলাকাতে বা অনেক সময় আরও প্রত্যন্ত এলাকায় ঘটত। মোটের ওপর শের শাহ এই এক রকম ব্যবস্থাই বজায় রেখেছিলেন। লাহোর, বিহার, মুলতান, যোধপুর, রনথম্বর এবং নগরকোটের পার্বত্য এলাকায় একজন আমিন বা মুকতার নেতৃত্বে একাধিক শিক বা সরকার জোটবদ্ধ হয়ে আলাদা শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিল। এভাবেই পাঞ্জাবের ভিলায়াত পদে নিযুক্ত হন হইবাত খান নৈজি, হাজি খানকে পাঠানো হয় সমগ্র মালবের দায়িত্বে এবং খাওয়াস খান যোধপুরের ভিলায়াত হিসাবে কাজ শুরু করেন। যোধপুরের ভিলায়াতের হাতে আজমের, নাগোর, মেওয়াট প্রভৃতি অঞ্চলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। বাংলার প্রশাসন মূলত বিদ্রোহের কারণে একাধিক শিকদার গোষ্ঠীর। মধ্যে বিভক্ত ছিল। তাই তাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে এক অসামরিক ব্যক্তি কাজী ফজিলতকে আমিন হিসাবে নিযুক্ত করে পাঠানো হয়েছিল।
ফলে দেখা যাচ্ছে যে প্রাদেশিক শাসনের ধারণা মুঘলদের নেতৃত্বেই মূলত বিকশিত হয়েছিল। শের শাহের আমলে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থার প্রসার ঘটেনি। কেবল শিক বা সরকারের মতো আমলাতন্ত্রের গঠন ও পরিসীমাকে সুদৃঢ়করণের ব্যাপারে শের শাহের কৃতিত্ব ছিল অনস্বীকার্যতা। এগুলিই ছিল প্রশাসনের আসল স্তম্ভ যা মুঘল আমলেও সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
শের শাহের নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্রের কাঠামোটা ঠিক কী ছিল সে ব্যাপারে আমরা খুব বেশি জানতে পারি না। জানা যায় যে তিনি নাকি মুঘল রাষ্ট্র পদ্ধতি মোটেই পছন্দ করতেন না কারণ সেখানে বিশাল পরিমাণে ক্ষমতা সেই সব মন্ত্রীদের হাতে ন্যস্ত থাকত যারা ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই শের শাহ নিজেই সবদিকে নজর রাখতেন এবং তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সব কাজ করতেন। এছাড়া তিনি পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণের জন্যে নিয়মিত দেশ পরিভ্রমণেও বেরতেন।
ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে থাকা এ ধরনের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শের শাহকে তার সামরিক বাহিনীর সাহায্য যে নিতে হত তা বলাই বাহুল্য। তিনি তার সেনাবাহিনীর ঘোড়াগুলিকে চিহ্নিতকরণ (দাগ) ও বর্ণনাত্মক ক্রমিক সংখ্যা (চেহরা) প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে খুব সহজেই অকেজো ঘোড়াগুলিকে চিহ্নিত করা যায়। শুধু কি ঘোড়া, তিনি এই চিহ্নিতকরণের পদ্ধতি খুব নিষ্ঠুরভাবে তার দরবারের ঝাড়ুদার ও মহিলা পরিচারিকাদের ওপরও জারি করেছিলেন এবং তাদের চেহারার বিবরণ নথিভুক্ত। করে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। শোনা যায় শের শাহ না কি প্রত্যেক সৈনিককে তার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার আগে ব্যক্তিগত ভাবে তাদের প্রত্যেকের সাক্ষাৎকার নিতেন। এবং তাদের বেতন ঠিক করে দিতেন। এমনকি তার সামনেই নাকি ঘোড়াদের চিহ্নিতকরণ করা হত। তার কাছে তার নিজস্ব বাহিনীতে ছিল ১৫০, ০০০ জন অশ্বারোহী সেনা, ২৫,০০০ পদাতিক সৈনিক, যার মধ্যে বন্দুকধারী ও তিরন্দাজ সেনাও ছিল, একটি গোলন্দাজ বাহিনীর গোষ্ঠী আর ৫,০০০টি যোদ্ধা হস্তী। এর সঙ্গে ছিলেন একাধিক অভিজাত যাদের মধ্যে অনেকেই ২০,০০০ সওয়ার বা ১০,০০০ সওয়ার কিংবা ৫, ০০০ সওয়ারের সামরিক প্রধান ছিলেন। আমরা জানি না কীভাবে সৈনিকদের নিয়োগ করা হত বা মোট কতজন সওয়ার প্রকৃতপক্ষে তার বাহিনীতে ছিল। তবে মনে হয় আফগান অভিজাতরা নিশ্চয়ই এদের উপজাতিগত ভিত্তিতে নিয়োগ করতেন। যদিও আমরা আগেই জেনেছি যে শের শাহ নিজে উপস্থিত থেকে সৈনিকদের মাসিক ভাতা নির্ধারণ করে দিতেন, তবুও সেই ভাতার পরিমাণটা ঠিক কত ছিল বা ভাতা হিসাবে। কী দেওয়া হত তা জানা যায় না। মনে হয় অভিজাত ও সেনাবাহিনী উভয়কেই বেতন হিসাবে জমি দান বা ইক্তা প্রদান করা হত। কোনো সামরিক অভিযানে যাওয়ার আগে শের শাহ তাঁর প্রধান ও সৈনিকদের কাছ থেকে জানতে চাইতেন কেউ ইক্তাবিহীন অবস্থা রয়েছে কিনা। যদি কেউ থাকত তাহলে তাকে অভিযানে যাওয়ার পূর্বেই বকেয়া ইক্তা মিটিয়ে দেওয়া হত। সেনাপ্রধানদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা ছিল যেন কেউ নির্ধারিত ইক্তা বহির্ভূত অন্য কোনো কিছুর সুবিধা গ্রহণ না করে। তাই শের। শাহ ইক্তা বা জায়গির ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করতে চেয়েছিলেন এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি পূর্বের ব্যবস্থাকেই অব্যাহত রেখেছিলেন।
যতই নিজের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধান থাকুক না কেন, হিন্দুস্তানের মতো এত বিশাল একটা দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে একা হাতে সামলানো ছিল তার পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। তাই ধরে নিতে হবে যে তাঁর প্রশাসনে পৃথক রাজস্ব দপ্তর ও সামরিক বিষয় দেখানোর জন্যে পৃথক দফতর ছিল। এছাড়াও ছিলেন সদর নামক এক শ্রেণির কর্মচারী যারা মূলত ধর্মীয় ব্যক্তি, পণ্ডিত প্রমুখদের যে নিষ্কর জমি প্রদান করা হত তার হিসাব রাখতেন। সদরদের শের শাহ পূর্বে প্রদত্ত সকল নিষ্কর ভূমিদানের পুনর্বিবেচনা করে দেখতে বলেছিলেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে পূর্বের সব দফতর প্রায় একই রেখে দেওয়া হয়েছিল, শুধু পরিবর্তন বলতে এদের ওপর আগের তুলনায়। হয়তো কিছুটা বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল এই যা। অতি কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ও বিভিন্ন কর্মচারীর হাতে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান পরবর্তীকালে যখন শের শাহের মতো এমন সুনিয়ন্ত্রক প্রশাসক আর ছিল না, তখন এক ভয়ংকর প্রবণতার জন্ম দিয়েছিলেন।
বিচার ব্যবস্থার ওপর শের শাহ প্রভূত জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ন্যায় বিচার হল সবথেকে উত্তম ধর্মীয় কর্ম এবং রাজার বিচার ধর্মে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয়ের জন্যেই সমান। তিনি এও বলতেন যে, কোনো আরাধনা, প্রার্থনা বিচারের সমতুল্য হতে পারে না এবং এখানে ইসলাম ও ইসলামে অবিশ্বাসী সকল প্রকার মানুষের স্থান সমান।সুবিচারের ফলে কখনো সাজাপ্রাপ্ত মানুষটার সঙ্গে তার নিজের জাত, নিজের পরিবার, আত্মীয় পরিজন বা অন্য কারোর কোনো ভেদাভেদ তৈরি হতে। পারে না এবং তা ক্ষমতাশীল ও উচ্চ সুযোগ-সুবিধাভোগী মানুষদের ক্ষমতাহীনদের প্রতিহিংসা মূলক আচরণ করা থেকে আটকায়। নিপীড়িত ও অত্যাচারিত মানুষের আর্তনাদ মুছে দেয়। এটা বলা খুব কঠিন যে এই ধরনের কথা শুনতে ভালো লাগলেও আদৌ বাস্তবে প্রয়োগ হত কি না। কারণ প্রচুর গুপ্তচর না থাকলে এত বড়ো সাম্রাজ্যের কোথায় অন্যায় ও অবিচার ঘটছে তার খবর শের শাহের কাছে পৌঁছোনো ছিল কার্যত অসম্ভব। তবে গোটা সাম্রাজ্যে একাধিক কাজি নিয়োগ করা হয়েছিল মুসলিমদের মধ্যে সুবিচার প্রদানের উদ্দেশ্যে, কিন্তু তারা কী কী কাজ করেছিল তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। হিন্দুদের মধ্যে দেওয়ানি আইন রক্ষার্থে বিভিন্ন পঞ্চায়েত ও নিজ জাতের মাথাদের নিয়ে গঠিত বিচারকমণ্ডলীই শেষ কথা বলত আর ফৌজদারি। বিচার দান করত জমিদার ও শিকদাররা।
স্থপতি হিসাবে শের শাহের কৃতিত্ব বলতে মনে আছে সাসারামে তার নিজের জন্যে বানানো চিত্তাকর্ষক সমাধিটির কথা–যার কাঠামো, স্থায়িত্ব, মজবুতি ও চারপাশের সুন্দর সমন্বয়ী পরিবেশ নিজেই নিজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ছিল অনন্য। দিল্লি শহরটাকে তিনি যমুনার তীর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং সেখানে তিনি একটি সুন্দর দুর্গ ও ভিতরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন যা আজও টিকে রয়েছে। এইসব দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি স্থপতি হিসাবে শের শাহের একটা ধারণা ও সচেতনতা ছিল।
যদিও শের শাহ ধর্মীয় সাধক ও বুদ্ধিজীবীদের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানে সর্বদাই তৎপর ছিলেন তবুও সমগ্র শূর বংশের ইতিহাসে এ ব্যাপারে তেমন কোনো বিরাট পদক্ষেপের কথা জানা যায়নি। একমাত্র উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের জাইস এলাকার লেখক মহম্মদের লেখা হিন্দি গ্রন্থ ‘পদ্মাবতী’র কথা জানা যায় এ ব্যাপারে।
শূর আমলে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র
শের শাহের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বলা হয়ে থাকে ‘আফগান ও তুর্কি সার্বভৌমত্ব আদর্শের মধ্যে একটা সমঝোতা। আফগান সর্দাররা শূর রাজবংশের অংশীদার না হলেও শের শাহের মতো তাদের অনেকেই ছিল সিংহাসন দখলের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী। যদিও শের শাহ ছিলেন একজন স্বৈরাচারী শাসক এবং গুপ্তচরদের দৌলতে তার অভিজাতদের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ রাখতেন, কিন্তু তাই বলে তিনি অন্ধ সন্দেহবাতিক ছিলেন না, কারণ অভিজাত ও সৈন্যদের প্রতি পদে পদে তার প্রয়োজন পড়ত। তার কাছে সমবেত হওয়া আফগানদের মধ্যে থেকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শের শাহ বিশেষ নজর দিতেন। অভিজাতদের বিপুল পরিমাণে জায়গির বা ইক্তা প্রদান করা হত। শের শাহের অন্যতম প্রিয় ও প্রথম সারির অভিজাত খাওয়াস খান ইক্তা হিসাবে সমগ্র সিরহিন্দ সরকারের অধিকার পেয়েছিলেন যা তিনি পরে তার এক ক্রীতদাস ভগবন্তকে দেখাশোনার জন্য দিয়েছিলেন। এটা মনে রাখা দরকার যে খাওয়াস খান কিন্তু আফগান ছিলেন না, তিনি ছিলেন শের শাহের এক ভারতীয় দাস মালিক সুক্কার পুত্র। তবে শের শাহ ও ইসলাম শাহের আমলে অভিজাততন্ত্রের সিংহভাগই দখল করে ছিল আফগানরা। সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে শের শাহের আর এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসভাজন অভিজাত যাকে কে আর. কানুনগো ব্রহ্ম জিৎ গৌর নামে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের একজন ব্রাহ্মণ হিসাবে ভেবে ভুল করেছিলেন, তিনি আসলে ছিলেন একজন শূর আফগান বর্মজিৎ কৌর এবং তার হাতে শের শাহ আজমের জয় করার পর সেখানকার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। কৌর’ কথাটা সে সময়ের অনেক আফগান ঐতিহাসিকই বুঝতে পারেননি। আসলে “কৌর” কথার অর্থ হল একচোখা বা তির্যক চোখ এবং তা বর্মজিৎ উপাধি হিসাবে ব্যবহার করতেন। নৃশংস একজন। যোদ্ধা হিসাবে তার খ্যাতি ছিল কারণ যখন কনৌজের যুদ্ধে পরাজয়ের পর হুমায়ুন আগ্রায় পালিয়ে এসেছিলেন তখন বর্মজিৎ তাঁর দলের শতাধিক মুঘল সৈন্যকে ধরে প্রত্যেক নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। তিনি কাজ হয়ে যাবার পর তার নিজের গুপ্তচরদেরও খুন করে দিতেন। কাহিনী।
শের শাহ তার স্বৈরতন্ত্রকে সাজিয়েছিলেন উদারতা ও সহিষ্ণুতা দিয়ে। জানা যায়। তিনি প্রত্যেক শহর, নগর ও প্রদেশের অন্ধ ও প্রতিবন্ধী মানুষদের তালিকা তৈরি ও চালু রাখার আদেশ দিয়েছিলেন তার উচ্চ আধিকারিকদের। এই বিশেষ মানুষদের প্রত্যেককে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। তিনি গরিব। ও অসহায় মানুষদের জন্যে একটি বিশাল লঙ্গরখানা (দাতব্য ভোজনালয়) চালাতেন। যা দেখে তার কয়েকজন অভিজাতও এই মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
শের শাহ ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তিনি প্রত্যহ নামাজ পাঠ করতেন। তিনি ধর্মীয় বিজ্ঞান সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত ছিলেন এবং বিশিষ্ট জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি ও ধর্মীয় গুরুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তবে তাই বলে তিনি গোঁড়া। ছিলেন না। চন্দেরির পুরানমলকে যে নৃশংসতার সঙ্গে গ্রে শাহ হত্যা করেছিলেন তাতে অনেকে ধর্মীয় প্রতিহিংসার রং লাগালেও সেটা ছিল নিছকই একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সেই ঘটনা দিয়ে শের শাহের সামগ্রিক ধর্ম ভাবনাকে বিচার করা ঠিক হবে না। যদিও জিজিয়া কর আদায় থামেনি তান আমলে, তবুও সেটা ছিল একটি নগরের কর যা কেবল নগরের মানুষদের কাছ থেকে ভূমি রাজস্বের অংশ হিসাবে আদায় করা হত। তার আমলে মন্দির মসজিদে কোনো ভেদাভেদ করা হত বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মন্দির ধ্বংসেরও কথা জানা যায়নি। মুসলিমদের নিষ্কর। জমি প্রদানের যে তথ্য পাওয়া যায় সেগুলিও একতরফা ছিল না। এই জমি দান মুসলিম ছাড়াও বিদেশি পণ্ডিত, ব্ৰহ্মণ, মন্দির ও মঠকেও করা হত বলে জানা গিয়েছে। শোনা যায়, শের শাহের কালিঞ্জয় জয় করতে যাওয়ার পথে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এবং সেই ব্রাহ্মণের অকপট কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে শের শাহ তাকে কল্পি সরকারের সমস্ত গ্রাম ও নগদ পাঁচশো টঙ্কা দান করেছিলেন।
উলেমাদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে ইসলাম শাহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। প্রশাসনিক ও রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ে অবশ্য পালনীয় কিছু কড়া নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি ইসলাম শাহ ধর্মীয় ব্যাপারেও কিছু বিস্তারিত আদেশ জারি করে বলে দিয়েছিলেন তা শরিয়ত বিরুদ্ধ হোক বা না হোক, ‘কেউ সেই আদেশ অমান্য করলে কাজী বা মুফতির কাছে অভিযোগ জানাতে যেতে যেন ভয় না পায়।’ শূর সাম্রাজ্যের শেষের দিকে প্রশাসন যত সংকুচিত হচ্ছিল ততই সেখানে আফগানদের বদলে রাজস্ব প্রশাসনে বেশি করে হিন্দুদের নিয়োগ বাড়ছিল। ইসলাম শাহের উত্তরসূরি আদালির সময় পর্যন্ত হিন্দুদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছিল। দিল্লির একটি বাজারের ‘শুহনা’ হিসাবে কর্মজীবন শুরু করা হিন্দু সন্তান হেমুর এই সময়েই। উত্থান ঘটেছিল এবং তিনি উচ্চতর উজির পদ লাভ করেছিলেন। যদিও আফগানদের পিছনে ফেলে হিন্দুদের সামনের সারিতে উঠে আসার ঘটনা শূর সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের পর্বে দেখা দিয়েছিল তবুও এটা অস্বীকার করা যাবে না যে শের শাহের সময় থেকেই কৌলীন্য ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করেছিল এবং শাসকশ্রেণির সামাজিক ভিত্তিটা। অনেক বৃহত্তর পরিসর লাভ করেছিল। তবে এ ব্যাপারে আসল পরিবর্তনটা প্রত্যক্ষ করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল একটা মানুষের আগমনের জন্যে, তিনি হলেন আকব:ব।
১. ‘তারিখ-ই-শের শাহী’ গ্রন্থের রচয়িতা আব্বাস খান সারওয়ানি আকবরের সময়ে স্তর ভিত্তিক সমাজে নারীকে ঠিক কি চোখে দেখা উচিত হবে সে ব্যাপারে বলতে গিয়ে যে অসমর্থনযোগ্য যত পোষণ করেছিলেন তা ছিল ঠিক এইরকম- ‘বিচক্ষণ পুরুষ ঠিকই। বলে যে, কখনো নারীর প্রতি আস্থা রাখবে না ও ভুল করেও তোমার গোপন কথা তাদের বলবে না। সব বিষয়ে ওদের সঙ্গে আলোচনা করবে না এবং ধনসম্পদ ও রাজকোষ এদের নজর থেকে লুকিয়ে রাখবে সর্বদা, শুধু যেটা প্রকাশ করবে তা হল তোমার ক্ষমতা…এ তো সবাই জানে যে ঈর্ষা হল নারীর অন্যতম সহজাত এক গুণ। তারা জ্ঞানার্জনেরও অযোগ্য। নানান রকম ছলচাতুরীতে এদের জুড়ি মেলা ভার। তাই ওদের দ্বারা চালিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই।