০৪.
সন্তু একবার উঁকি মেরে তার বাবার ঘর দেখল। তার বাবা নানক চৌধুরী ইদানীং দাড়ি রাখছে। বড় পাগল লোক, কখন কী করে ঠিক নেই। এই হয়তো আধ হাত দাড়ি, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল হয়ে গেল। ফের একদিন গিয়ে দাড়ি কামিয়ে, মাথা ন্যাড়া করে চলে এল। তবুনানক চৌধুরীকে নিয়ে কেউ বড় একটা হাসাহাসি করে না। সবাই সমঝে চলে। একে মহা পণ্ডিত লোক, তার ওপর রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ব্ৰজ দত্ত নামে মারকুট্টা ছেলেকেও একবার লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল নানক চৌধুরী। কারণ ব্রজ দত্ত পাড়ার একটা পাগলা ল্যাংড়া লোককে ধরে মেরেছিল। সেই পাগলা আর ল্যাংড়া রমণী বোস নাকি বলে বেড়িয়েছিল যে ব্ৰজ দত্ত আর সাঙাতরা একরকম নেশা করে, তা মদের নয় কিন্তু মদের চেয়েও ঢের বেশি সাংঘাতিক।
সন্তু পরদা সরিয়ে উঁকি মেরে সাবধানে বাবাকে দেখে নেয়। ঘরটা অন্ধকার, কেবল টেবিল ল্যাম্পের ছোট্ট একটু আলো জ্বলছে, আর চৌধুরীর বড়সড় অন্ধকার ছায়ার শরীরটা ঝুঁকে আছে বইয়ের ওপর। পাড়ায় বোমা ফাটলেও নানক চৌধুরী এ সময়ে টের পায় না।
কালু আজ সন্তুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। কাল রাতে লাশ দেখে ফেরার পথে কালু বলেছিল, স্যু, খুনটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। কিন্তু ভয় খাই যদি শালা খুনেটা জানতে পারে যে আমি দেখেছি, তো আমাকেও ফুটিয়ে দেবে। তাই তোকে সব বলব, কাল সিংহীদের বাগানে রাত আটটায় থাকবি।
সন্তু বলল, কাল কেন? আজই বল না।
কালু মাথা নেড়ে বলে, আজ নয়। আমি আগে ভেবে-টেবে ঠিক করি, মাথাটা ঠান্ডা হোক। আজ মাথাটা গোলমাল লাগছে।
সন্তু বলল, কত টাকা পাবি বললি?
পাঁচশো। তাতে কদিন ফুর্তি করা যাবে। রিকশা টানতে টানতে গতর ব্যথা। পাঁচশো টাকা পেলে পালবাজারে সবজির দোকানও দিতে পারি।
সন্তু ব্ল্যাকমেল ব্যাপারটা বোঝে। সে তাই পরামর্শ দিল, পাঁচশো কেন? তুই এক হাজারও চাইতে পারিস।
দেবে না।
দেবে। খুনের কেন্স হলে আরও বেশি চাওয়া যায়।
দুর!- কালু ঠোঁট উলটে বলে, বেশি লোভ করলেই বিপদ। আজকাল আকছার খুন হয়। কজনকে ধরছে পুলিশ! আমাদের আশেপাশে অনেক খুনি ঘুরে বেড়াচ্ছে ভদ্রলোকের মতো। খুনের কেসকে লোকে ভয় পায় না।
সন্তু কাল রাতে ভাল ঘুমোয়নি। বলতে কী সেকাল থেকে একটু অন্য রকম বোধ প্রছে। খুন সেকখনও দেখেনি বটে, কিন্তু বইতে খুনের ঘটনা পড়ে আর সিনেমায় খুন দেখে সে ইদানীং খুনের প্রতি খুব একটা আকর্ষণ বোধ করে। তার ওপর যদি সেই খুনের ঘটনার গোপন তথ্যের সঙ্গে সে নিজেও জড়িয়ে পড়ে তবে তো কথাই নেই।
রাত আটটা বাজতে চলল। দেয়ালঘড়িতে এখন পৌনে আটটা। এ সময়ে বাড়ির বাইরে বেরোনো খুবই বিপজ্জনক। নানক চৌধুরী, তার বাবা, যাকে সে আড়ালে নানকু বলে উল্লেখ করে, সে যদি পায় তো একতরফা হাত চালাবে। নাক চৌধুরী ব্যায়ামবীর বা ওভাষাকে ভয় পায় না, তা ছেলের গায়ে হাত তুলতে তার আসবে কেন?
তবু যেতেই হবে। সেই ভয়ংকর গুপ্ত খবরটা কালু তাকে দিয়ে যাবে আজ।
সন্তু রবারসোলের জুতো পরে আর একটা দুই সেল টর্চবাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সিংহীদের বাড়ির বাগান ভাল জায়গা নয়। পোডড়াবাড়ির মতো পড়ে আছে। সেখানে প্রচুর সাপখোপের আচ্ছা।
মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আজ মাস্টারমশাইয়ের আসার দিন নয়। কাজেই সন্তু পড়ার ঘরের বাতিটা জ্বেলে একটা বই খুলে রেখে বেরিয়ে পড়ল। মা যদি আসে তো ভাববে ছেলে পড়তে পড়তে উঠে বাথরুমে বা ছাদে গেছে।
খুব তাড়াতাড়ি সন্তু রাস্তা পার হয়ে খানিক দূরে চলে আসে। সিংহীদের পাচিলটা কোথাও কোথাও ভাঙা। একটা ভাঙা জায়গা পেয়ে সন্তু অনায়াসে পাচিল টপকে বাগানে ঢুকে ঝোপঝাড় ভেঙে এগোয়। কালু এসে গেছে কি না দেখবার জন্য এধার-ওধার টর্চের আলো ফেলে। কোথাও কাউকে দেখা যায় না।
শিরিষ গাছের তলায় এসে সন্তু দাঁড়ায়। দুবার মুখে আঙুল পুরে সিটি বাজিয়ে অপেক্ষা করে।, কালু এখনও আসেনি। বরং খবর পেয়ে মশারা আসতে শুরু করে ঝাঁক বেঁধে। হাঁটু, হাত, ঘাড় সব চুলকোনিতে জ্বালা ধরে যায়। সন্তু দুচারটে চড়চাপড় মেরে বসে গা চুলকোয়। কালু এখনও আসছে না।
চার দিক ভয়ংকর নির্জন আর নিস্তব্ধ। ওই প্রকাও পুরনো আর ভাঙা বাড়িটায় সন্তু ওকে ফাঁসি দিয়েছিল। এই বাড়িতেই মরেছে সিংহবুড়ে। তার ওপর গতকাল দেখা লাশটার কথাও মনে পড়ে তার। ছেলেটার বয়স বেশি নয়, একটা বেশ ভাল জামা ছিল গায়ে, আর একটা ভাল প্যান্ট। ছেলেটার চুল লম্বা ছিল, বড় জুলপি আর গোঁফ ছিল। ওইরকম বড় চুল আর জুলপি রাখার সাধ সতুর খুব হয়। কিন্তু তার বাবা ননক চৌধুরী সন্তুকে মাসান্তে এক বার পপুলার সেলুন ঘুরিয়ে আনে। সেখানকার চেনা নাপিত মাথা স্ক্রু-কাট করে দেয়।
সন্তুর যে ভয় করছিল তা নয়। তবে একটু ছমছমে ভাব। কী যেন একটা হবে। ঠিক বুঝতে পারছে না স্যু, তবে মনে হচ্ছে অলকে কে যেন একটা দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি আস্তে করে দো-বোমার পলতেয় ধরিয়ে দিচ্ছে। এখন জোর শব্দে একটা ভয়কর বিস্ফোরণ হবে।
হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে শব্দ ওঠে। সতু শিউরে উঠল। অবিকল নীলমাধরের সেই সড়ালে কুকুরটা যেমন জঙ্গল ভেঙে ধেয়ে আসত ঠিক তেমন শব্দ। সন্তুর হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল। আকাশে মেঘ চেপে আছে। চার দিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সত্ কেবল প্যান্টের পকেট থেকে তার ছোট্ট দুরিটা বের করে হাতে ধরে রইল। যেদিক থেকে শব্দটা আসছে সেদিকে মুখ করে মাটিতে উবু হয়ে বসে অপেক্ষা করছিল সে। হাত-পা ঠান্ডা মেরে আসছে, বুক কাঁপছে, সু খুব ভয় সন্তু পায় না। পালানোর চিন্তাও সে করে না।
একটু বাদেই সে ছোট্ট কেরোসিনের ল্যাম্পের আলো দেখতে পায়। রিকশার বাতি হাতে কালু আসছে। কিন্তু আসছে ঠিক বলা যায় না। কালু বাতিটা হাতে করে ভয়ংকর টলতে টলতে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্পূর্ণ মাতাল।
সন্তু টর্চটা জেলে বলে, কালু, এদিকে।
কোন শালা রে-কালু চেঁচাল।
আমি সন্তু।
কোন সন্তু?-বলে খুব খারাপ একটা খিস্তি দিল কালু।
সন্তু এগিয়ে কালুর হাত ধরে বলে, আস্তে। চেঁচালে লোক জেনে যাবে।
কালু বাতিটা তুলে সন্তুর মুখের ওপর ফেলার চেষ্টা করে বলে, ওঃ, সন্তু!
হ্যাঁ।
আয়।
বলে কালু তার হাত ধরে টানতে টানতে পোড়া বাড়ির বারান্দায় গিয়ে ওঠে। তারপর সটান মেঝেতে পড়ে গিয়ে বলে, আজ বেদম খেয়েছি মাইরি! নেশায় চোখ ছিঁড়ে যাচ্ছে।
সন্তু পাশে বসে বলে, কী বলবি বলেছিলি?
কী বলব?–কালু ধমকে ওঠে।
বলেছিলি বলবি। সেই খুনের ব্যাপারটা।
কোন খুন? ফলির?
হ্যাঁ।
কালু হা হা করে হেসে বলে, আমি পাঁচশো টাকা পেয়ে গেছি সন্তু, আর বলা যাবে না।
কে দিল?
যে খুনি সে।
লোকটা কে?
কালু ঝড়াক করে উঠে বসে বলে, তোকে বলব কেন?
বলবি না?
না। পাঁচশো টাকা কি ইয়ারকি মারতে নিয়েছি?
সন্তু খুব হতাশ হয়ে বলল, তুই বলেছিলি বলবি।
কালু মাথা নেড়ে বলে, পাঁচশো নগদ টাকা পেয়ে আজ অ্যাতো মাল খেয়েছি। আরও অনেক আছে, পালবাজারে সবজির দোকান দেব, নয়তো লন্ড্রি খুলব। দেখাব?
বলে কালু তার জামার পকেট থেকে একতাড়া দশ টাকার নোট বের করে দেখায়। বলে, গোন তো, কত আছে। আমি বেহেড আছি এখন।
সন্তু গুনল। বাস্তবিক এখনও চারশো পঁচাশি টাকা আছে।
বলল, খুনি তোকে কিছু বলল না?
না! কী বলবে! বলল, কাউকে বলবি না, তা হলে তোকেও শেষ করে ফেলব।
পাঁচশো টাকা দিয়ে দিল?
কালু মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলে, দূর, পাঁচশো টাকা আর কী! এ রকম আরও কত ঝেঁকে নেব। সবে তো শুরু।
সন্ত উত্তেজিত হয়ে বলে, ব্ল্যাকমেল!
কালু চোখ ছোট করে বলে, আমি শালা ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার, আর তোমরা সব ভদ্রলোক, না?
ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার নয় রে। ব্ল্যাকমেল।
আমি ইংরিজি জানি না ভেবেছিস! রামগঙ্গা স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছিলাম ভুলে যাস না।
সন্তু এতক্ষণে হাসল। বলল, ব্ল্যাকমেল হল…
চুপ শালা। ফের কথা বলেছিস কি…।
বলে কালু লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।
সন্তু কালুর হঠাৎ রাগ কেন বুঝতে না পেরে এক পা পেছিয়ে তেজি ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে বলল, এর আগে খিস্তি করেছিস, কিছু বলিনি। ফের গরম খাবি তো মুশকিল হবে।
কালু তার বাতিটা তুলে সন্তুর মুখের ওপর ফেলার চেষ্টা করে বলল, আহা চাদু! গরম কে খাচ্ছে শুনি?
বলে ফের একটা নোংরা নর্দমার খিস্তি দেয়।
সন্তু হাত-পা নিশপিশ করে। হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে ছুরিটা টেনে বের করে আনে সে। বেশি বড় না হলেও, বোতাম টিপলে প্রায় পাঁচ ইঞ্চি একটা ধারালো ফলা বেরিয়ে আসে। সস্তুর এখনও পর্যন্ত এটা কোনও কাজে লাগেনি।
ফলাটা কেরোসিনের বাতিতেও লকলক করে উঠল।
সন্তু বলল, দেব শালা ভরে।
দিবি? কালু উঠে দাঁড়িয়ে পেটের ওপর থেকে জামাটা তুলে বলল, দে না।
বলে জিব ভেঙিয়ে দু হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অশ্রাব্য গালাগাল দিতে থাকে।
সস্তুর মাথাটা গোলমেলে লাগছিল। গতবার সে একটা গুন্ডা বেড়ালকে ফাঁসি দিয়েছিল। শরীরের ভিতরটা আনচান করে ওঠে। সে একটা ঝটকায় কালুকে মাটিতে ফেলে বুকের ওপর উঠে বসে। তারপর সম্পূর্ণ অজান্তে ছুরিটা তোলে খুব উঁচুতে। তারপর বিদ্যুবেগে হাতটা নেমে আসতে থাকে।
কালু কী কৌশল করল কে জানে! লহমায় সে শরীরের একটা মোচড় দিয়ে পাশ ফিরল। তারপর দুষ্টু ঘোড়া যেমন ঝাঁকি মেরে সওয়ারি ফেলে দেয় তেমনি সস্তুকে ঝেড়ে ফেলে দিল মেঝের ওপর। পাঁচ ইঞ্চি ফলাটা শানে লেগে ঠকাৎ করে পড়ে গেল।
কালু একটু দূরে গিয়ে ফের পড়ল। তারপর সব ভুলে ওয়াক তুলে বমি করল বারান্দা থেকে গলা বার করে।
বিস্মিত সন্তু বসে রইল হা করে! সর্বনাশ! আর-একটু হলেই সে কালুকে খুন করত! ভেবেই ভয়ংকর ভয় হয় সন্তুর।
কালু বমি করে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসল বারান্দার থামে হেলান দিয়ে। মাথা লটপট করছে। অনেকক্ষণ দম নিয়ে পরে বলল, ছুরি চমকেছিস শালা, তুই মরবি।
সন্তু আস্তে করে বলে, তুই খিস্তি দিলি কেন?
কালুর কেরোসিনের বাতিটা এখনও মেঝের ওপর জ্বলছে। সেই আলোতে দেখা গেল, কালু হাসছে। একটা হাই তুলে বলে, ও সব আমার মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে যায়। কিন্তু গাল দিলে কি গায়ে কারও ফোঁসকা পড়ে? আমাকেও তো কত লোক রোজ দুবেলা গাল দেয়। তা বলে গগনদার মতো খুন করতে হবে নাকি।
সন্তু বিদ্যুৎস্পর্শে চমকে উঠল। গগনদা!
তড়িৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তোকে টাকাটা কে দিয়েছে কালু?
বলব কেন?
আমি জানি। গগনদা।
দূর বে!
গগনদা খুন করেছে?
কালু মুখটা বেঁকিয়ে বলে, কোন শালা বলেছে?
তুই তো বললি।
কখন? না, আমি বলিনি।
সন্তু হেসে বলে, দাঁড়া, সবাইকে বলে দেব।
কী বলবি?
গগনদা তোকে টাকা দিয়েছে। গগনদা খুনি।
কালু প্রকাণ্ড একটা ঢেকুর তুলে বুকটা চেপে ধরে বলে, টাকা। হ্যাঁ, টাকা গগনদা দিয়েছে। তবে গগনদা খুন করেনি!
সন্তু হেসে টর্চটা নিয়ে পিছু ফিরল। ধীরেসুস্থে পাঁচিলটা ডিঙিয়ে এল সে।