০৪. ইমরান সাহেবের ঘুম

সকাল নটা।

ব্যারিস্টার সালেহ ইমরান সাহেবের ঘুম অনেক আগেই ভেঙেছে। তিনি শোবার ঘরের টিভির সামনে বসে আছেন। টিভিতে সিএনএন ধরা আছে। তবে শব্দ হচ্ছে না, শুধুই ছবি। মুনা ঘুমাচ্ছে। টিভির শব্দে তিনি স্ত্রীর ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছেন না। মুনা কাল অনেকরাত জেগে এইচবিওতে একটা ভূতের ছবি দেখেছে। আজ সে বেলা পর্যন্ত ঘুমুবে, এটাই স্বাভাবিক।

সালেহ ইমরান টিভির পর্দার দিকে তাকাচ্ছেন না। তাঁর হাতে কয়েকটা পত্রিকা। তাঁর নজর পত্রিকার হেডলাইনে। আজকের প্রধান খবর–কারগিল। সীমান্তে ভারত পাকিস্তান খণ্ডযুদ্ধ। এই খণ্ডযুদ্ধের একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। এই যুদ্ধ পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে দুটি দেশের যুদ্ধ।

আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। অন্যদিন খবরের কাগজ পড়ার মধ্যেও একটা তাড়াহুড়া থাকে। সেই তাড়াহুড়া আজ নেই। তিনি এককাপ চা এবং এককাপ কফি এর মধ্যে খেয়ে নিয়েছেন। যেদিন চা ভালো হয় সেদিন কফি ভালো হয় না। যেদিন কফি ভালো হয় সেদিন চা ভালো হয় না। আজ দুটিই ভালো হয়েছে। সালেহ ইমরানের আরেক কাপ কফি খেতে ইচ্ছা করছে। তিনি অপেক্ষা করছেন। মুনা ঘুম ভেঙেই কফি খাবে। ছুটির দিনে স্ত্রীর সঙ্গে কফি খাওয়া আনন্দের ব্যাপার। সেই আনন্দের জন্যে অপেক্ষা করা যায়।

মুনার ঘুম ভেঙেছে। সে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, হ্যালো! গুড মর্নিং।

সালেহ ইমরান স্ত্রীর দিকে একপলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন। মুনার গায়ে কোনো কাপড় নেই। মুনা গায়ে কাপড় রেখে ঘুমাতে পারে না। তার না কি হাঁসফাস লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে। স্ত্রীর এই অভ্যাসের সঙ্গে সালেহ, ইমরান দীর্ঘ পনের বছর ধরে পরিচিত, তারপরেও মুনার এই অবস্থায় অতি স্বাভাবিক হাসাহাসি তিনি নিতে পারেন না।

মুনা টিভির সামনে গেল। রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে এইচবিওতে দিতে দিতে বলল, অ্যাই, বেল টিপে কফি দিতে বলো।

সালেহ ইমরান বললেন, তুমি গায়ে কিছু একটা দাও, তারপর বলি।

মুনা বলল, তুমি ভুলে যাচ্ছ, দিনের প্রথম কফি আমি এভাবেই খাই।

সালেহ ইমরান বললেন, তাহলে গায়ে চাদর টেনে বিছানায় বসো। কেউ একজন ঘরে ঢুকে তোমাকে এই অবস্থায় দেখবে, এটা কি ভালো হবে?

আমাদের শোবার ঘরে আমরা না ডাকা পর্যন্ত কেউ ঢুকবে না। এটা তুমি ন ভালো করে জানো।

তারপরেও তো ভুল করে কেউ ঢুকে পড়তে পারে।

কেউ এরকম ভুল করলে দেখবে তাদের মেমসাহেব নগ্ন হয়ে স্যারের পাশে বসে আছে। এই দৃশ্য দেখলে পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে যাবে না। সোলার সিস্টেমে তেমন কোনো বিপর্যয় হবে না।

সালেহ ইমরান চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। নিজেই কিচেন থেকে দুই কাপ কফি নিয়ে ঢুকলেন। মুনা আগের অবস্থায় নেই। সে বড় বড় ফুলের গাউন জাতীয় পোশাক গায়ে দিয়েছে। বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে এসেছে। টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে নি। মুখে বিন্দু বিন্দু পানি। সালেহ ইমরান কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুনাকে খুবই সুন্দর লাগছে।

মুনা কফিতে চুমুক দিয়ে আগ্রহের সঙ্গে বলল, তুমি তো কাল ছবিটা অল্প খানিকক্ষণ দেখে ঘুমিয়ে পড়লে। পুরোটা দেখলে মজা পেতে।

সালেহ ইমরান বললেন, ভূতের ছবি দেখে কেউ মজা পায় না, ভয় পায়।

শেষপর্যন্ত ছবিটা কিন্তু ভূতের ছিল না। ভৌতিক যাবতীয় কর্মকাণ্ড বাচ্চা মেয়েটা করত।

কেন করত?

কারণ মেয়েটা মানসিক রোগী।

মুনা সালেহ ইমরানের কোল থেকে সবকটা খবরের কাগজ টেনে নিল। সে কাগজ পড়বে না। দ্রুত পাতা উল্টে ছবিগুলি দেখবে। ছবির ক্যাপশন পড়বে।

সালেহ ইমরান ঠিক করলেন স্ত্রীকে উপদেশমূলক কিছু কথা বলবেন। যেমন, আজ তিনি টিভিতে সিএনএন দেখছিলেন। মুনা তাকে কিছুই জিজ্ঞেস না করে চ্যানেল বদলে দিল। কোল থেকে খবরের কাগজ টেনে নিয়ে নিল।

মুনা বলল, ইন্ডিয়া পাকিস্তান যুদ্ধ হচ্ছে–পড়েছ খবরটা?

সালেহ ইমরান গম্ভীর গলায় বললেন, হুঁ!

এই যুদ্ধে আমরা কাদেরকে সাপোর্ট করব? ইন্ডিয়াকে না পাকিস্তানকে?

যুদ্ধকে আমরা সাপোর্ট করব কেন? যুদ্ধ কি সাপোর্ট করার মতো বিষয়?

মুনা বলল, তুমি গলা গম্ভীর করে কথা বলছ কেন? কোনো কারণে কি আমার উপর রেগে আছ?

না।

কেউ আমার উপর রাগ করলে কিংবা বিরক্ত হলে আমি সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারি।

কেউ যদি তোমার উপর খুশি হয় সেটা কি ধরতে পার?

মুনা বলল, অবশ্যই পারি। কফি নিয়ে ঘরে ঢুকে তুমি আমাকে দেখে খুশি হয়ে গেলে, সেটা সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি।

ক্ষিধে লেগেছে, চল নাশতা খেতে যাই।

মুনা বলল, আমি নাশতা খাব না। আমার চোখ থেকে ঘুম যায় নি। আমি আবার ঘুমাব। তুমি নাশতা খেয়ে নাও।

ঠিক আছে।

কাল রাতে তোমাকে যে একটা কথা বলেছিলাম সেটা মনে আছে?

কী কথা?

মতিন নামের লোকটাকে বিদায় করে দিতে। সে এক সপ্তাহ এই বাড়িতে আছে। এক সপ্তাহের বেতন দিয়ে তাকে বিদায় করে দিবে। কী কারণে তাকে বিদায় করবে সেটা রাতে একবার বলেছি। তোমার মনে না থাকলে আরেকবার বলতে পারি।

আরেকবার বলো।

মুনা বিছানায় উঠে গায়ের কাপড় খুলে চাদর দিয়ে নিজেকে ঢাকতে ঢাকতে বলল, মতিন নামের লোকটা ঘর থেকে বাইরে পা দেয় নি। ঘরের বাইরে পর্যন্ত আসে নি। কমলের ঘরে যায় নি। কমলের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করে নি। নিজের ঘরে বসে দিনরাত টিভি দেখেছে, গান শুনেছে, বই পড়েছে, সিগারেট খেয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে এই চাকরিটা নিয়েছে রিলাক্স করার জন্যে।

একটা ছোট্ট ঘরে সাতদিন বসে থাকার মধ্যে কি কোনো রিলাক্সেসান আছে?

একেকজন একেকভাবে রিলাক্স করে। মতিন নামের লোকটির রিলাক্সেসান এই রকম। তুমি আমাকে আরেককাপ কফি দিয়ে তারপর নাশতা খেতে যাও। ভালো কথা, আজ শুক্রবার, কমলের মুভি ডে। সন্ধ্যাবেলা তার সঙ্গে মুভি দেখতে হবে, ভুলে যেও না।

ভুলব না।

থ্যাংক ইউ, অ্যান্ড আই লাভ ইউ। শোন, তোমাকে কফি আনতে হবে না। আমি এখনই ঘুমিয়ে পড়ব।

মুনা চাঁদরের নিচে ঢুকে গেল।

 

সালেহ ইমরান লাইব্রেরি ঘরে বসে আছেন। তাঁর সামনে মতিন বসে আছে। তার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এই সাতদিনে লোকটা মনে হচ্ছে শেভ করে নি। তবে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে লোকটাকে খারাপ লাগছে না। সালেহ ইমরান পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, তোমাকে কেন ডেকেছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?

মতিন বলল, বুঝতে পারছি না।

সালেহ ইমরান সিগারেট ধরাবেন কি ধরাবেন না বুঝতে পারছেন না। এটা হবে তার দিনের প্রথম সিগারেট। তিনি সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করছেন। চেষ্টার অংশ হিসেবে দিনের প্রথম সিগারেট ধরানোর সময় প্রতিদিনই কিছু কিছু বাড়াতে হবে। তিনি যে রুটিনে চলছেন সেই রুটিনে আজকের প্রথম সিগারেট

একটায় ধরানোর কথা। এখন বাজছে বারোটা।

তিনি সিগারেট ধরালেন। মতিন নামের লোকটিকে স্যাক করা হবে। অস্বস্তিকর কাজ। যে-কোনো অস্বস্তিকর কর্মকাণ্ডে সিগারেটের ধোঁয়া একধরনের আব্রু তৈরি করে।

সালেহ ইমরান সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তোমাকে আমরা যে। পারপাসে রেখেছিলাম সেই পারপাস ফুলফিলড হচ্ছে না।

মতিন বলল, ও আচ্ছা।

সালেহ ইমরান বললেন, You are not the right person.

মতিন বলল, বুঝতে পারছি।

তোমার সময় নষ্ট হলো, আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট।

স্যার, কোনো অসুবিধা নেই। আমি কি এখনই চলে যাব?

ইউ টেক ইউর টাইম। তুমি সাতদিন ছিলে, তোমাকে আমি পুরো মাসের বেতন দিতে বলেছি।

স্যার থ্যাংক য়্যু। যেহেতু আমি এখন আর আপনার কর্মচারী না, আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি? আপনার সিগারেট খাওয়া দেখে লোভ লাগছে।

সালেহ ইমরান বললেন, অবশ্যই! তিনি তাঁর সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। লাইটার এগিয়ে দিলেন। সালেহ ইমরানকে দেখে মনে হচ্ছে। চাকরিচ্যুতি জাতীয় কঠিন কর্মকাণ্ড খুব সহজেই হয়ে যাওয়াতে তিনি আনন্দিত।

সালেহ ইমরান বললেন, চা দিতে বলি। চা খাও।

মতিন বলল, চা খাব না স্যার।

সালেহ ইমরান বললেন, আমি শুনেছি পুরো সাতদিন তুমি নিজের ঘরে বসেছিলে। আমার কাছে খুবই অদ্ভুত লেগেছে। কারণটা কী বলো তো।

মতিন বলল, কারণ এখন বলা অর্থহীন।

সালেহ ইমরান বললেন, অর্থহীন হলেও বললা। অবশ্যি তোমার যদি তেমন আপত্তি না থাকে।

মতিন বলল, আপত্তি আছে। কিন্তু আপনি শুনতে চাচ্ছেন, কাজেই শুনুন। আমি আপনার ছেলের সঙ্গে একধরনের গেম খেলার চেষ্টা করেছি। Autistic শিশুরা নিজেকে নিয়ে গুটিয়ে থাকতে পছন্দ করে। তারা কারো সঙ্গে মিশে না। নিজের ঘর থেকে বের হতে চায় না। আমি ঠিক এই কাজটি করেছি। আপনার ছেলে ব্যাপারটি লক্ষ করেছে। সে আমাকে তার মতোই একজন ভাবছে। আমি ডাকলেই সে আসবে, এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

তুমি তাকে ডাক নি কেন?

আমি নিজে তাকে ডেকে আনতে চাই নি। আমি চেয়েছিলাম সে নিজে এসে আমার কপাল ফাটিয়ে দেয়ার জন্যে লজ্জিত হবে এবং সরি বলবে।

সালেহ ইমরান দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার ধারণা তুমি ডাকলেই সে আসবে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে? এটা কী করে বুঝলে?

সে আমাকে একটা নোট পাঠিয়েছিল। নোটটা দেখতে চান? আমার সঙ্গেই আছে। নোটটা সে নিজেই দরজার নিচ দিয়ে দিয়েছে।

সালেহ ইমরান আগ্রহের সঙ্গে বললেন, দেখি!

মতিন মানিব্যাগ থেকে কাগজের টুকরাটা বের করল। সেখানে লেখা

yoser orrsy srroy orrys rroys ryrso ysror soyrr rryos ryors rsroy yorsr osrry osyrr sryor syon orsry osryr rrsoy royrs srryo soryr yorrs ysor sroyr rrosy ysrro oysro rysor rsoyr srory sryro yrsro ryosr rsory rosry rosyr oysrr yrors ryros rsyro rrsyo rorys oyrsr yrros oryrs rsyor yrosr oyrrs oryst isryo yrsor syror syrro orsyr oyrrs rorsy yrrso roysr

সালেহ ইমরান বললেন, এর মানে কী?

মতিন বলল, সে লিখেছে Sorry. সরি লিখতে যে অক্ষরগুলি লাগে এগুলিই সে নানানভাবে সাজিয়েছে। শুধু মূল শব্দটা লেখে নি। আবার এমনও হতে পারে যে, প্রতিবারই সে Sorry লিখেছে, কিন্তু Dyslexiaর কারণে মূল বানানটা তার মাথায় ঠিকমতো আসছে না। Autistic শিশুরা Dyslexiaতে ভুগে, এই তথ্য আপনি অবশ্যই জানেন। আপনিই আমাকে বইপত্র দিয়েছেন।

মতিন!

জি স্যার।

এসো চা খাই। চা খেতে খেতে আরো কিছু কথা বলি।

চা খাব না স্যার। আমি এখন চলে যাব। কে আমাকে টাকা দেবে বলে দিন।

সালেহ ইমরান আরেকটি সিগারেট ধরালেন। সিগারেট পরপর দুটি হয়ে গেছে। এটা খারাপ লক্ষণ। এখন সিগারেটের সংখ্যা দ্রুত বাড়বে। সালেহ ইমরান মতিনের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তোমার কর্মকাণ্ড শুরুতে বুঝতে পারি নি বলে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি এখানেই থাক।

মতিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমার ইচ্ছা করছে না।

চট করে না বলবে না। যে-কোনো সিদ্ধান্তই ভেবে-চিন্তে নিতে হয়।

অনেকেই ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় না।

ঠিক আছে, তুমি চলে যেতে চাচ্ছ চলে যাবে। আমার সঙ্গে এককাপ চা খেয়ে যেতে তো সমস্যা নেই। বোস। প্লিজ।

মতিন বসল! সালেহ ইমরান সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন।

 

নিশু তার বাবার জন্যে ক্র্যাচ কিনে এনেছে। অ্যালুমিনিয়ামের হালকা ক্র্যাচ। ঝকঝক করছে।

আজিজ আহমেদ বিরক্ত গলায় বললেন, এ-কী! ক্র্যাচ কী জন্যে?

নিশু বলল, ক্র্যাচের ব্যবহার তুমি জানো না বাবা? বগলের নিচে দিয়ে হাঁটবে। হাইট অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যবস্থাও আছে। এসো হাইট ঠিক করে দেই।

আমি ক্র্যাচ বগলে দিয়ে হাঁটব কী জন্যে?

তুমি ক্র্যাচ বগলে দিয়ে হাঁটবে, কারণ তুমি পা মচকে ফেলেছ। পা ফেলতে পারছ না।

পা তো ভাঙে নাই। সামান্য মচকেছে, একদিন রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

যখন ঠিক হয়ে যাবে তখন আর ক্র্যাচ ব্যবহার করবে না। ঠিক না হওয়া পর্যন্ত করবে। উঠে দাঁড়াও, আমি হাইট ঠিক করব।

আজিজ আহমেদ কঠিন গলায় বললেন, না।

নিশু বলল, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন বাবা?

সব বিষয়ে তুই জোর খাটাস, এটা আমার পছন্দ না।

মেয়ে তার বাবার উপর জোর খাটাতে পারবে না?

না।

বাবা কি মেয়ের উপর জোর খাটাতে পারবে?

মেয়ের জ্ঞানবুদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত পারবে।

নিশু শান্ত গলায় বলল, আমার জ্ঞানবুদ্ধি কি হয়েছে?

আজিজ আহমেদ বললেন, তোর জ্ঞানবুদ্ধি হয় নি। তারপরেও আমি কিন্তু তোর উপর জোর খাটাই না।

আমার জ্ঞানবুদ্ধি হয় নি?

না। এমএতে ফার্স্ট ক্লাস পেলেই জ্ঞানবুদ্ধি হয় না।

আমার জ্ঞানবুদ্ধি হয় নি এটা কেন বলছ?

ব্যাখ্যা করতে হবে?

অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে। উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করতে হবে। মনে কর পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে–নিশুর জ্ঞানবুদ্ধি নেই বিষয়টি উদাহরণসহ বিশেষভাবে ব্যাখ্যা কর!

শুনলাম তুই ইংল্যান্ডে যাবার আগে বিয়ে করবি। তারপর শুনলাম নিজেই পাত্র খোজায় বের হয়েছিস। একজন না করেছে, এখন অন্য দুইজনের সঙ্গে দেন-দরবার করছিস। তারপর শুনলাম দুইজনের একজন রাজি হয়েছে, এখন আবার তুই রাজি না। কারণ যে রাজি হয়েছে সে তোর সঙ্গে ইংল্যান্ডে যেতে চায়। এতে আবার তোর আপত্তি। আরো ব্যাখ্যা লাগবে?

না।

নিশু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বাবা, আমি বেরুচ্ছি। দুপুরের আগেই ফিরব। তুমি আবার রান্না করতে বসবে না। আমি দুপুরের খাবার নিয়ে আসব।

ক্র্যাচ জোড়া নিয়ে যা, আমার দেখতে ভালো লাগছে না।

নিয়ে যাচ্ছি।

মতিনের কোনো খবর পাওয়া গেছে? তার সঙ্গে আমার জরুরি আলাপ ছিল।

এক সপ্তাহ ধরে তার কোনো খোজ নেই। সে কোথায় গেছে জানি না। তার মেসে গিয়েছিলাম, সেখানে নেই। মোবাইলে অনেকবার টেলিফোন করেছি। রিং হয় কিন্তু ধরে না।

ও আচ্ছা।

এখন বলো, মতিনের জ্ঞান-বুদ্ধি কি ঠিক আছে? না-কি সেও জ্ঞান-বুদ্ধি শূন্য।

আজিজ আহমেদ জবাব দিলেন না।

নিশু চলে গেল। সঙ্গে ক্র্যাচ নিয়ে গেল না। আজিজ আহমেদ রাগী চোখে ক্র্যাচের দিকে তাকিয়ে সময় পার করতে লাগলেন। ডান পায়ে তিনি ভালোই ব্যথা পেয়েছেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সমস্যাটা হয়েছে। যে ধাপে পা ফেলতে চেয়েছেন সেই ধাপে না ফেলে তার পরের ধাপে ফেলেছেন। মস্তিষ্ক কো-অর্ডিনেটে সমস্যা করেছে। মস্তিষ্কের বয়স হয়েছে। সে ক্লান্ত। এ ধরনের ভুল সে আরো করবে। তিনি রাস্তা পার হচ্ছেন, দৈত্যের মতো ট্রাক আসছে। হন বাজাচ্ছে। মস্তিষ্ক তাকে সাবধান করতে ভুলে যাবে। লোকজন আহা আহা করে ছুটে আসবে। একজন ছুটবে ট্রাক ড্রাইভার এবং হেল্পারের পেছনে। ট্রাক ড্রাইভার ধরা পড়বে না, কিন্তু অল্পবয়স্ক হেল্পারটা ধরা পড়ে যাবে। তাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হবে। যারা তাকে মেরে ফেলবে তারা কিন্তু খুবই স্বাভাবিক মানুষ। অফিস শেষে বাসায় ফিরে মেয়েকে অঙ্ক শেখায়। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেইলি রোডে নাটক দেখতে যায়।

চাচাজি!

আজিজ আহমেদ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। এত চমকানোর মতো কিছু হয় নি। তার সামনে মতিন দাঁড়িয়ে আছে। মতিনের হাতে বাজারের ব্যাগ। ব্যাগভর্তি বাজার। দুই কেজি খাসির মাংস, খাসির কলিজা। বিশাল সাইজের একটা ইলিশ। তিনটা গলদা চিংড়ি।

মতিন বলল, চাচাজি, আপনি কি ধ্যান করছেন? কতক্ষণ ধরে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি দেখেও দেখছেন না। কী চিন্তা করছিলেন?

কিছু না।

আপনার পায়ে কী হয়েছে?

পায়ে কিছু হয় নাই। সামান্য মচকেছে।

ক্র্যাচ-ফাচ দেখতে পাচ্ছি।

নিশুর কাণ্ড। তুমি অবশ্যই আজ যাবার সময় ক্র্যাচ দুটি নিয়ে যাবে। It is an order.

মতিন বলল, চাচাজি, আপনি কি কোনো কারণে রেগে আছেন?

আমি রেগে আছি। যতবার ক্র্যাচ দুটি চোখে পড়ছে ততবারই রাগ বাড়ছে।

চাচাজি, আপনি মাথা থেকে ক্র্যাচের ব্যাপারটা দূর করে দিন। আমি যাবার সময় এই দুই বস্তু নিয়ে যাব। কিছুদিন ক্র্যাচ বগলে দিয়ে হাঁটব।

আজিজ আহমেদ ভুরু কুঁচকে বললেন, কেন?

পঙ্গু জীবন যাপন করে দেখি কেমন লাগে। মানুষদের সহানুভূতি নিয়ে জীবন যাপন। পঙ্গুদের প্রতি সমাজের সহানুভূতি আছে। চাচাজি, আপনি কি জানেন, পঙ্গুদের পৃথিবীর কোনো দেশেই ক্যাপিটেল পানিশমেন্ট দেয়ার বিধান নেই?

জানি না তো!

বাংলাদেশেও নেই।

তুমি এতদিন ছিলে কোথায়?

ডুব দিয়ে ছিলাম চাচাজি। এখন ভেসে উঠেছি।

আবার কবে ডুব দেবে?

জানি না। চাচাজি, চলুন রান্নাবান্নায় নেমে পড়ি। হঠাৎ কিছু টাকা পেয়ে গলাম, বাজার নিয়ে এসেছি। একটা ইলিশ মাছ এনেছি ফাটাফাটি। সে ইলিশ সাম্রাজ্যের রানী। খাঁটি পদ্মার ইলিশ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছাকাছি ধরা পড়েছে। ইলিশের নাক পর্যন্ত বোঁচা। মনে হয় ব্রিজের স্প্যানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে।

আজিজ আহমেদ বিরক্ত মুখে বললেন, আজ রান্নাবান্না হবে না। নিশু না করে দিয়েছে। সে না-কি খাবার নিয়ে আসবে। আমি নিশুকে রাগাতে চাচ্ছি না।

বাজার কি ফ্রিজে রেখে দেব?

ফ্রিজ নষ্ট।

আমি কি চলে যাব?

চলে যাও। ক্র্যাচ সঙ্গে নিয়ে যাও। বাজার যা এনেছ তাও নিয়ে যাও।

আপনার মেজাজ কি বেশি খারাপ?

হুঁ।

মেজাজ কখন ঠিক হবে কিছু বুঝতে পারছেন? ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মেজাজ ঠিক হলে বসতাম।

তুমি চলে যাও। বাজার যা এনেছ নিয়ে যাও।

আপনি রাগ করেছেন নিশুর উপর, সেই রাগ দেখাচ্ছেন আমাকে। এটা কি ঠিক হচ্ছে?

আজিজ আহমেদ জবাব দিলেন না।

সিগারেট খাবেন চাচাজি? একটা সিগারেট দেই। প্রচণ্ড রাগের সময় সিগারেট ধরালে রাগটা কমে। এটা পরীক্ষিত।

আজিজ আহমেদ টেবিলে রাখা খবরের কাগজ হাত বাড়িয়ে নিলেন। এই কাজটি করার জন্যে তাঁকে সামান্য ঝুঁকতে হলো। সেই সামান্য ঝুঁকিতেই পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা বোধ হলো। গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে আরাম হতো। মতিনকে বললেই সে গরম পানি করে দিবে। তার কাউকেই কিছু বলতে ইচ্ছা। করছে না। তার ইচ্ছা করছে বাড়িঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে।

 

মতিন ক্র্যাচে ভর দিয়ে ঢাকা শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। লোকজন তার দিকে তাকাচ্ছে, তবে মতিন যে-রকম ভেবেছিল সেরকম হচ্ছে না। কেউ তাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। গাঢ় সহানুভূতির তেমন কোনো দৃষ্টি তার প্রতি নেই। হাতে বাজারের ব্যাগটাও সমস্যা করছে। ক্র্যাচে হুকের মতো কিছু থাকলে ভালো হতো। সেই হুকে বাজারের থলি ঝুলানো যেত। যারা ক্র্যাচ নিয়ে ঘোরাফেরা করে তাদের মাথায় এই বুদ্ধিটা আসে না কেন!

এক পা দুলিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটার প্রক্রিয়া মতিন রপ্ত করে ফেলেছে। তার ভালো লাগছে। দুটি ক্র্যাচে ভর দিলে শরীর দোলনার মতো সামান্য দোলে–তখন ভালো লাগে। মতিন ঠিক করে ফেলল সে হেঁটে হেঁটেই বোনের বাসায় যাবে। সময় লাগবে? লাগুক। তার হাতে অফুরন্ত সময়।

দরজা খুলল তৌহিদা। মতিন বলল, মিস তৌ, বাজারের ব্যাগটা ধর তো।

তৌহিদা বাজারের ব্যাগ ধরল না। হতভম্ব গলায় বলল, আপনার পায়ে কী হয়েছে?

লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে।

লিগামেন্টটা কী?

নিজেও পরিষ্কার জানি না। ডাক্তাররা জানে।

সারতে কতদিন লাগবে?

মতিন হতাশ ভঙ্গি করে বলল, এই জীবনে সারবে বলে মনে হচ্ছে না। বাকি জীবন ক্র্যাচে ভর দিয়েই চলতে হবে। এখনো সময় আছে, ভেবে দেখ।

কী ভেবে দেখব?

পঙ্গু স্বামী নিয়ে সংসার করতে পারবে কি-না।

তৌহিদার কান্না পাচ্ছে। সে চেষ্টা করছে চোখের পানি আটকাতে। বেশিক্ষণ পারবে এরকম মনে হচ্ছে না। তার ইচ্ছা করছে এক্ষুনি ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাঁদে। মানুষটাকে দরজার কাছে ফেলে যেতেও ইচ্ছা করছে না। বেচারা হাঁটতে পারছে না, তার উচিত সাহায্য করা। সে যদি এখন বলে, আপনি আমার শরীরে ভর দিয়ে ঘরে ঢুকুন, তাহলে কি অন্যায় হবে?

অন্যায় হলে হবে। লোকে তাকে খারাপ ভাবলে ভাববে। সে কিচ্ছু কেয়ার করে না।

মতিন হঠাৎ বিস্মিত হয়ে লক্ষ করল, তৌহিদা অন্যদিকে ফিরে কাঁদছে। তার প্রধান চেষ্টা কান্না আটকানোর। সে তা পারছে না। কান্না থামানোর প্রক্রিয়ায় সমস্ত শরীর ফুলে ফুলে উঠছে।

মতিন বলল, কাঁদছ কেন? সমস্যা কী?

তৌহিদা ছুটে পালিয়ে গেল।

সালেহা ছোট ভাইয়ের অবস্থা দেখে মনে হলো খুশি হয়েছেন। তাঁর চোখে মখে আনন্দ আনন্দ ভাব। তিনি বললেন, তোর যে এই অবস্থা হবে আমি জানতাম। তোর দুলাভাইকে বলেছি। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখিস।

মতিন বলল, দুলাভাইকে কী বলেছ?

বলেছি যে তোর একটা বিপদ হবে।

বুঝলে কীভাবে? টেলিপ্যাথি?

স্বপ্নে দেখেছি। শেষরাতের স্বপ্ন। দেখলাম সাদা রঙের একটা সাপ আমার বাঁ পায়ে ছোবল দিয়েছে।

সাপ তোমার পায়ে ছোবল দিয়েছে, স্বপ্নের হিসাবে তোমার পায়ের লিগামেন্ট ছেড়ার কথা। আমারটা ছিঁড়ল কেন?

তৌহিদা এই কথায় খুব মজা পেল। একটু আগেই সে কেঁদে এসেছে। অশ্রুপাতের চিহ্ন এখন আর তার চেহারায় নেই।

সালেহা বললেন, নিজের উপর স্বপ্ন দেখলে অন্যের উপর ফলে। আমি যদি স্বপ্নে দেখি আমি মারা যাচ্ছি, তাহলে আমি ঠিকই বেঁচে থাকব। আমার নিকট আত্মীয়ের মধ্যে কেউ মারা যাবে।

মতিন বলল, আমার পায়ের লিগামেন্ট ফিগামেন্ট ছিঁড়ে একাকার, আর তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুশি। মুখভর্তি হাসি।

সালেহা বললেন, অবশ্যই আমি খুশি। এই অবস্থায় তোকে আমি ছাড়ব না। এখানে রেখে দেব। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেতে পারবি না।

সর্বনাশ! তোমার এই দুই রুমের বাড়িতে আমি ঘুমাব কোথায়?

তুই ঘুমাবি তৌহিদার ঘরে।

বিয়ের আগেই তার সঙ্গে ঘুমানো কি ঠিক হবে?

তৌহিদা এই কথায় এতই আনন্দ পেল যে, হাসির দমকে তার শরীর ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। সালেহা ভাইকে ধমক দিলেন ফাজলামি কথা আমার সঙ্গে বলবি না। আমি তোর দুলাভাই না। তুই তৌহিদার ঘরে ঘুমাবি, তৌহিদা থাকবে আমার সাথে। আর তোর দুলাভাই ড্রয়িংরুমের সোফায় ঘুমাবে। সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুমাতে পারে।

মতিন বলল, তাহলে তো সব সমস্যারই সমাধান। আমার ক্ষিধে লেগেছে। রান্নাবান্নার আয়োজন কর।

সালেহা বললেন, দুনিয়ার বাজার এনেছিস। রাঁধতে সময় লাগবে। আচ্ছা, তুই তিনটা গলদা চিংড়ি কোন হিসাবে কিনলি?

তোমাদের হিসাবে কিনেছি। দুলাভাইয়ের জন্যে একটা, তোমার জন্যে একটা, আর তৌ-এর জন্যে একটা। আমি গলদা চিংড়ি খাই না। হাই কলেস্টরেল।

তৌ ফৌ ডাকবি না। শুনতে জঘন্য লাগে। তৌহিদা, তুমি জোগাড়যন্ত্র করে দাও। আজ আমি রাঁধব।

মাতিন বলল, আপা, তুমি তো বাঁধতে পার না। সব নষ্ট করবে। তৌ রাঁধুক।

কথা বাড়াবি না। গোসলে যা। তোর গা দিয়ে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে।

মতিন বলল, মগভর্তি করে এককাপ চা দাও তো আপা। চা খেতে খেতে গোসল করব। শরীরের ভেতর ঢুকবে গরম চা, বাইরে ঠাণ্ডা পানি। ঠাণ্ডা গরমে মিলে সিরিয়াস রি-অ্যাকশন।

 

মতিন মগভর্তি চা নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে। রান্নাঘরে তৌহিদা এবং সালেহা। সালেহা সকালবেলাতেই দাঁতের ব্যথা এবং পেটের ব্যথায় কুঁ কুঁ করছিলেন। এখন মহানন্দে রান্নাবান্না করছেন। তৌহিদার সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করছেন। গল্পের বিষয়বস্তু একটাই–মতিন।

আমার ভাইটার কীরকম পাগলা স্বভাব দেখেছিস? চা খেতে খেতে গোসল করবে। বিয়ের পর কী যে যন্ত্রণায় তুই পড়বি! তোর কলিজা ভাজা ভাজা করে দেবে। ঠিক বলছি না?

হুঁ।

ছোটবেলায় সে কিন্তু খুব শান্ত ছিল। যতই তার বয়স হচ্ছে ততই সে দুষ্ট প্রকৃতির হচ্ছে। তবে যত দুষ্টই হোক তার অন্তর দিঘির পানির মতো।

পরিষ্কার পানি, না ময়লা পানি?

তুইও দেখি মতিনের মতো কথা বলা শুরু করেছিস। ময়লা পানি কী জন্যে হবে? দিঘির টলটলা পানি।

তৌহিদা সালেহার কথায় বাধা দিয়ে হঠাৎ নিচু গলায় বলল, আপা, আমাদের বিয়েটা কবে হবে? বলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।

সালেহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তৌহিদা মরমে মরে যাচ্ছে। এরকম একটা লজ্জার কথা সে কীভাবে বলে ফেলল? তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? মনে হয় মাথা খারাপই হচ্ছে। মাথা খারাপ মানুষ দিনেদুপুরে চোখের সামনে অদ্ভুত জিনিস দেখে। সেও দেখে। কয়েকদিন আগে সে তার নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিল। ঘুমাচ্ছিল না, জেগেই ছিল। হঠাৎ শুনল মতিনের গলা। মতিন বিছানার পাশ থেকে বলছে মিস তৌ, অসময়ে ঘুমাচ্ছ কেন? সে চমকে পেছনে ফিরে দেখে মতিন চেয়ারে বসে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। তৌহিদা ধড়মড় করে উঠে বসে দেখে কিছু নেই। তৌহিদার ধারণা, সে কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি পাগল হয়ে যাব। পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়াবে, কিংবা হাতে একটা লাঠি নিয়ে রিকশা কন্ট্রোল করবে। রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকবে।

সালেহা বললেন, তৌহিদা, কী চিন্তা কর?

তৌহিদা নিচু গলায় বলল, কিছু চিন্তা করি না।

সালেহা বললেন, তোমার বিয়ের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। যথাসময়ে বিয়ে দেব। বিয়েতে খরচপাতিও করব। তোমার তিনকুলে কেউ নাই বলেই হাতে সুতা বেঁধে বিয়ে হবে তা না। একসেট গয়নাও দিব। তবে একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত!

তোমাদের একটা সন্তান আমাকে দিয়ে দিবে। আমি পালব। সে আমাকে মা ডাকবে। তোমাকে না।

তৌহিদা গাঢ় স্বরে বলল, আপনি যা বলবেন তাই হবে।

 

মতিন নিজের গায়ে পানি ঢালার আগে ক্র্যাচ দুটা সাবান দিয়ে ধুয়ে নিল। একটা ক্রাচে দাগ পড়ে গিয়েছিল, অনেকক্ষণ চেষ্টা করল দাগ উঠানোর।

সামান্য কিছু সময় ক্র্যাচের সঙ্গে কাটানোর জন্যেই কি মতিনের ক্র্যাচ দুটির প্রতি এত মায়া জন্মেছে? মানুষের মায়া শুধু যে মানুষের এবং জীবজন্তুর দিকেই প্রবাহিত হয় তা-না, জড়বস্তুর দিকে প্রবাহিত হয়। মতিন ঠিক করে ফেলেছে

ক্র্যাচের আত্মকাহিনী নামের একটা লেখা লিখবে। স্যাটায়ার টাইপ লেখা–

আমি কে? কী আমার পরিচয়? আমি একটা ক্র্যাচ। মানুষের বগলে ঘামের দুর্গন্ধে আমার দিন কাটে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন–আমার এই দেহখানি তুলে ধর। তখন কি তার মনের কোথাও ক্র্যাচ নামক বস্তুটি ছিল? তিনি কাকে দেহখানি তুলে ধরার গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন–ক্র্যাচকে?

বাথরুমের দরজায় টুকটুক করে টোকা পড়ছে। মতিন বলল, কে?

আমি তৌহিদা।

কী চাও মিস তৌ?

আপনার কি আরো চা লাগবে?

তুমি চা নিয়ে এসেছ?

হুঁ।

ভেরি গুড। তুমি একজন পঙ্গু মানুষের দোয়া পেয়ে গেলে। তুমি বড়ই ভাগ্যবতী মেয়ে।

তৌহিদার চোখে আবারো পানি এসে যাচ্ছে। সে অবশ্যই ভাগ্যবতী। শুধু ভাগ্যবতী না, অসীম ভাগ্যবতী। অসীম ভাগ্যের কারণেই এমন একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে।

অনেকক্ষণ হলো তৌহিদা বাথরুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার উচিত সালেহা আপাকে রান্নায় সাহায্য করা। কিন্তু সে এখান থেকে নড়তে পারছে না।

এত পদ রান্না হয়েছে, মতিন কিছুই খেল না। তার না-কি ক্ষুধা মরে গেছে। সালেহা বিরক্ত হয়ে বললেন, ক্ষুধা কেন মরে যাবে? মতিন বলল, ক্ষুধা হচ্ছে। একটা প্রাণীর মতো। তার জন্ম আছে, মৃত্যুও আছে। ক্ষুধা শৈশব থেকে যখন যৌবনে আসে তখন তার বিয়ে হয়, বাচ্চাকাচ্চাও হয়। তখনই ক্ষুধা প্রচণ্ড হয়। এখন বুঝেছ?

সালেহা বললেন, না।

না বুঝলে কিছু করার নাই। আমি উঠলাম এবং চললাম।

মতিন ক্র্যাচ ফেলে হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তৌহিদা এবং সালেহা মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। যে মানুষটা ক্র্যাচে ভর না দিয়ে এক পা ফেলতে পারছিল না সে কেমন গটগট করে দরজা খুলে চলে গেল।

 

বিকাল পাঁচটা। আজিজ সাহেব ঠিক আগের জায়গাতেই বসে আছেন। কথা ছিল নিশু তার জন্যে খাবার নিয়ে আসবে। নিশু আসে নি। হয়তো ভুলে গেছে। আজিজ আহমেদের পায়ের ব্যথা বেড়েছে। পা ফুলে উঠেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *