ইব্ন কাসীর (র)-এর জীবনী
(ক) ব্যক্তি পরিচয়
তাঁর নাম ইসমাঈল ইব্ন উমর ইব্ন কাসীর ইব্ন দূ ইব্ন কাসীর ইব্ন দিরা আল-কুরায়শী। তাঁর খান্দানটি কুরায়শের বনী হাসালা শাখা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। সন্ত্রান্ত গোত্ররূপে এ গোত্রটির খ্যাতি রয়েছে। তাদের বংশ লতিকা সংরক্ষিত রয়েছে।
আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক আল মিযয়ী এ বংশ লতিকার কিছু অংশ সম্পর্কে অবগতি লাভ করেছেন- যদরুন তিনি আনন্দিত হন ও অনেকটা বিস্ময়বোধ করেন। এ জন্যে তিনি আমার বংশ তালিকায় ‘আল কুরায়শী’ উপাধি লেখা শুরু করেন।(৪০)
আমার নিকট এটি ইব্ন কাসীর (র)-এর বিশুদ্ধতম বংশ তালিকা। কারণ, ইব্ন কাসীর (র) তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে নিজে এটি উদ্ধৃত করেছেন। এজন্যে তার নাম ও বংশ পরিচয়ে যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। সে সম্পর্কে আমরা আলোকপাত করবো না।(৪১) কারণ যার সম্পর্কে এসব বিবৃতি তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীতে অন্য সব তথ্য একেবারে গুরুত্বহীন।
জন্ম : ৭০১ হিজরী সনে ইব্ন কাছীর (র) জন্মগ্রহণ করেন। যেমনটি ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে তিনি উল্লেখ করেছেন।(৪২) এ থেকে তার জন্ম তারিখ সম্পর্কে যে মতপার্থক্য ছিল তার নিরসন হল।(৪৩) তাঁর জন্মস্থান ছিল ‘বুসরা’*-এর অন্তর্গত ‘মিজাদাল’ নামক জনপদে। ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে তাঁর জন্মস্থান ‘মুজায়দিল’ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।(৪৪) যতদূর মনে হয়। ভুলক্রমেই এমনটি লিখিত হয়েছে।
তাঁর পিতা : তাঁর পিতা হলেন খতীব শিহাবউদ্দীন আবু হাফস উমর ইব্ন কাসীর। তিনি বসবাস করতেন বুসরা নগরীর পশ্চিমে অবস্থিত ‘শারকাব্বীন’ গ্রামে। রসরা ও শারকাবীনের দূরত্ব খুবই সামান্য। খতীব শিহাবউদ্দীন ৬৪০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতুল গোত্ৰ বনু উকবায় তিনি বিদ্যার্জনে ব্ৰতী হন। তিনি চমৎকার কবিতা লিখতেন। বুসরার আননাকা অঞ্চলের বিদ্যালয়সমূহে তিনি লেখাপড়া করেন। তারপর বুসরকার পূর্বদিকে অবস্থিত খিতাবা জনপদে চলে যান। তিনি শাফিঈ মাযহাব অবলম্বন করেন এবং ইমাম নওয়াবী ও ইমাম গাযারীর নিকট বিদ্যা শিক্ষা করেন। তিনি সেখানে প্রায় ১২ বছর অবস্থান করেন। এরপর ফিরে আসেন ‘মিজদাল’-এ। এখানে তার বিবাহ হয়। আবদুল ওহাঁহাব, আবদুল আর্যীয ও ইসমাঈল নামক তিন পুত্রের জনের পর তার কয়েকজন কন্যা সন্তান ও জন্মগ্রহণ করে। এছাড়া ইউনুস ও ইন্দ্রীস নামক দুই পুত্ৰও জন্মগ্রহণ করে। ইব্ন কাসীরের পিতার একটি প্রসিদ্ধ জীবনালেখ্য ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।(৪৫) ৭০৩ হিজরীতে মুজায়দিলে ইব্ন কাহীরের পিতার ইনতিকাল হয়। তখন ইসমাঈল-এর বয়স প্রায় তিন বছর।
(২) শৈশব ও যৌবন
ইব্ন কাসীর (র)-এর সহোদর আবদুল ওহহাব ৭০৭ হিজরীতে সপরিবারে দামেশকে চলে যান। তাঁর সম্পর্কে ইব্ন কাসীরের মন্তব্য, ‘তিনি আমাদের সহোদর এবং আমাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহবৎসল ছিলেন।’(৪৬) ইব্ন কাসীর (র) হিজরী ৮ম শতাব্দীতে মামলুক সুলতানদের শাসনামলে তার যৌবনকাল অতিবাহিত করেন। তাতারীদের আক্রমণ, একাধিক দুৰ্ভিক্ষ, হৃদয়-বিদারক দুৰ্যোগগুলো তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। তখন দুর্ভিক্ষে লক্ষ-লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে। তিনি ফিরিঙ্গীদের সাথে সংঘটিত ক্রুসেড যুদ্ধগুলোও দেখেছেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, শাসকদের পারস্পরিক দ্বন্দু-সংঘাত ইত্যাদি তাঁর সম্মুখেই সংঘটিত হয়। এতদসত্ত্বেও এ যুগে শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধনের প্রবল উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। আমীর-উমারাদের আগ্রহ এবং বিজ্ঞজন ও শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠানগুলোর জন্যে অকাতরে দান করার কারণে প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বহুসংখ্যক গ্রন্থ রচিত ও সংকলিত হয়।
মৃত্যু : ৭৭৪ হিজরী সনে ২৬শে শা’বান বৃহস্পতিবার তাঁর ইনতিকাল হয়। তাঁর জানাযায় বহুসংখ্যক লোকের সমাগম ঘটে। তাঁর ওসীয়ত অনুসারে তাঁর সর্বশেষ আবাসস্থল সূফীদের গোরস্থানে শায়খুল ইসলাম তকী উদ্দীন ইব্ন তাইমিয়্যা (র)-এর কাছে তাকে দাফন করা হয়। যা দামেশকের বাব আন-নাসর-এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত।
(৩) তাঁর শিক্ষকবৃন্দ
ইব্ন কাসীর (র) প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। দশ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি কুরআন মজীদ কণ্ঠস্থ করে নিয়েছিলেন। শায়খ নূরুদ্দীন আলী ইব্ন ইবনুহীজা কুরাকী শাওবাকী দিমাশকী শাফিঈ (মৃত্যু ৪ ৭৩০ হিঃ)-এর ওফাত উপলক্ষে ইব্ন কাছীর (র) লিখেছেন, ‘কুরআন হিফজ ও কিতাব অধ্যয়নে তিনি আমাদের সহপাঠী ছিলেন। আমি ৭১১ হিজরীতে কুরআন খতম করি।’(৪৭)
শত শত শায়াখের নিকট তিনি শিক্ষা গ্ৰহণ করেন। তবে তিনি যাদের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং যাদের তিনি অনুসরণ করেন তাদের সংখ্যা খুবই অল্প ছিল। এদের মধ্যে শায়খ তকী উদ্দীন ইব্ন তাইমিয়া সর্বােগ্রগণ্য। কারণ তার সাথে ইব্ন কাছীর (র)-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ইব্ন কাসীর তার অভিমত অনুসরণ করতেন এবং তালাকের মাসআলায় তার মতানুযায়ী ফতোয়া দিতেন। এ ব্যাপারে তিনি বিপদেও পড়েছিলেন এবং কষ্টও ভোগ করেছেন। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে ইব্ন কাসীর (র)-এর লিখিত তথ্য সূত্রে আমরা তা জানতে পারি। হিজরী ৮ম শতাব্দীর প্রথমার্ধের বড় বড় ঘটনার বর্ণনায় এ তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইতিহাস শাস্ত্রে তিনি সিরিয়ার ইতিহাসবিদ কাসিম ইব্ন মুহাম্মদ বিরযালী (মৃত্যু ৭৩৯ হিঃ) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কাসিম ইব্ন মুহাম্মদ (র)-এর ইতিহাস গ্রন্থ যা মূলত শায়খ শিহাবুদ্দীন আবু শামা মাকদেসী-এর ইতিহাস গ্রন্থের পরিশিষ্ট। ইব্ন কাসীরের ইতিহাস গ্রন্থে উপরোল্লেখিত গ্রন্থের সবিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
হাদীস শাস্ত্রে তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন শায়খ মিযয়ী ইউসুফ ইব্ন আবদুর রহমান জামালুদ্দীন (মৃত্যু ৭৪৪ হিঃ)। তিনি সে যুগে গোটা মিসরে স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ মুহাদিস ছিলেন। ‘তাহষীবুল কামাল’ গ্ৰন্থটি তাঁর রচিত। ইব্ন কাছীর (র) শায়খ ‘মিযয়ী’-এর অধিকাংশ গ্ৰন্থ তার কাছে অধ্যয়ন করেন। ইব্ন কাসীর (র) উক্ত শায়াখের এতই ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য অর্জন করেছিলেন যে, শায়াখের কন্যা যায়নাব’কে তিনি বিবাহ করেন। তিনি হাদীসশাস্ত্র ও রাবীদের জীবনী সম্পর্কে শায়খ মিযয়ী থেকে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন।(৪৮) তিনি অংক শাস্ত্রের শিক্ষা গ্ৰহণ করেন উস্তাদ ‘হাযৱী’ থেকে।(৪৯)
ইব্ন কাসীর (র)-এর আরো কতিপয় শিক্ষক
(১) জনাব ইজুদ্দীন আবু ইয়া’লা, হামযা ইব্ন মুআইয়িদুদ্দীন আবুল মা’আলী, আসা’আদ ইব্ন ইজ্জ্বদীন আবু গালিব মুযাফফর ইবনুল ওষীর আত তামীমী দামেশকী। ইবনুল কালানসী (মৃঃ ৭২৯ হিঃ)। ইনি মুহাদিস ছিলেন। নেতৃত্বের গুণাবলীও তাঁর মধ্যে ছিল। ৭১০ হিজরী সনে তিনি মন্ত্রীত্ব লাভ করেছিলেন।(৫০)
(২) ইবরাহীম ইব্ন আবদুর রহমান গাযারী। ইব্ন কাসীর (র) তার নিকট শাফিঈ মাযহাবের দীক্ষা গ্ৰহণ করেছেন এবং সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ তার কাছে অধ্যয়ন করেন।(৫১)
(৩) নাজমুদ্দীন ইবনুল আসকালানী (র)। ৯টি মজলিসে ইব্ন কাসীর (র) তার নিকট সহীহ মুসলিম অধ্যয়ন করেন।
(৪) শিহাবুদ্দীন আলহিজার ওরফে ইব্ন শাহনা। আশরাফিয়া দারুল হাদীসে তিনি হাদীসের প্রায় ৫০০টি পুস্তিকা অধ্যয়ন করেন। ৭৩০ হিজরীতে তাঁর ইনতিকাল হয়। তাঁর নাম ছিল আহমদ ইব্ন আবু তালিব।
(৫) কামালুদ্দীন ইব্ন কাষী শাহবাহ, তার নিকট ইব্ন হাজিব রচিত উসূল বিষয়ক গ্রন্থ মুখতাসার’ পাঠ করেন।
(৬) শায়খ নাজমুদ্দীন মূসা ইব্ন আলী ইব্ন মুহাম্মদ জীলী দামেশকী। ইনি বিদগ্ধ জ্ঞানীজন এবং লেখক ছিলেন। ইবনুল বাসীস নামে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। লিপি বিদ্যায় উস্তাদ এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞ বলে তিনি বিবেচিত হতেন। ৭১৬ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যু হয়।
(৭) শায়খ হাফিজ ও ইতিহাসবিদ শামসুদ্দীন যাহাবী মুহাম্মদ ইব্ন আহমদ কায়মায- তার নিকটও তিনি শিক্ষা লাভ করেন। ৭৪৮ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যু হয়।
(৮) নাজমুদ্দীন মূসা ইব্ন আলী ইব্ন মুহাম্মদ, তিনি একাধারে শায়খ এবং উচ্চমানের কবি ছিলেন। ৭১৬ হিজরীতে তিনি ইনতিকাল করেন।
(৯) কাসিম ইব্ন আসাকির, ইব্ন শীর্যায়ী, ইসহাক আসাদী মিসর থেকে তাকে অনুমতি দিয়েছেন আবু মূসা কুরাফী এবং আবুল ফাতাহ দাবূসী।
তাঁর জ্ঞান গরিমার স্বীকৃতি
এমন একজন মানুষ যিনি তার সমসাময়িক যুগের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ, হাদীসবিশারদ, তাফসীরকারগণ এবং অংক শাস্ত্রবিদগণের কাছে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন, এ ধরনের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষ খুব কমই দেখা যায়।
দাউদী তার প্রশংসা করেছেন এভাবে- ‘আমরা যাদেরকে পেয়েছি তাদের মধ্যে ইব্ন কাসীর (র) হাদীসের মূল পাঠ কণ্ঠস্থকারীদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন এবং হাদীসের উৎস, পরিচিতি, রিজাল পরিচিতি এবং শুদ্ধাশুদ্ধ বিচারে বিজ্ঞতম ব্যক্তি। তার সমকালীন বিদগ্ধজন ও তাঁর শায়খগণ তাঁর স্বীকৃতি দিতেন। ফিকাহ ও ইতিহাস শাস্ত্রের বহু কিছু তীর নখদর্পণে ছিল। তিনি যা শুনতেন তা খুব কমই ভুলতেন। তিনি গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী উত্তম ফিকাহাবিদ ছিলেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। আরবী ভাষার আলোচনায় তিনি সার্থকভাবে অংশ নিতেন। কবিতা রচনা করতেন। আমি বহুবারই তার কাছে গিয়েছি। কিন্তু কোন বার কিছু না শিখে এসেছি বলে আমার মনে পড়ে না।।(৫২)
ইব্ন কাসীর (র)-এর প্রশংসা বর্ণনায় হাফিজ যাহাবী (র) বলেন, : তিনি হাদীসসমূহের উৎস নির্ণয় করেছেন, সেগুলো যাচাই-বাছাই করেছেন, গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাফসীর গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং এসব ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা গ্ৰহণ করেছেন।(৫৩) ‘আল মুজামুল মুখতাস’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘তিনি ফতোয়াবিশারদ ইমাম, প্রাজ্ঞ ও প্ৰসিদ্ধ মুহাদিছ, বিজ্ঞ ফকীহ এবং হাদীসের বরাত সমৃদ্ধ তাফসীরে সিদ্ধহস্ত।’
আবুল মুহাসিন হুসাইনী (র) বলেছেন, ‘তিনি একই সাথে ফতোয়া দিয়েছেন, শিক্ষকতা করেছেন, তর্কযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, ফিকাহ, তাফসীর ও ব্যাকরণ শাস্ত্ৰে নতুন রচনাশৈলী উদ্ভাবন করেছেন এবং হাদীস বর্ণনাকারী ও হাদীসের সত্যাসত্য বিচারের ক্ষেত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।(৫৪)
আল্লামা সুয়ুতী (র) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, তার তাফসীর গ্রন্থটি অভূতপূর্ব, তার পদ্ধতিতে আর কোন তাফসীর গ্রন্থ সংকলিত হয়নি।(৫৫)
গবেষণামূলক বিষয়াদিতে যেমন, ইতিহাসবিদ, তাফসীরকার এবং হাদীস বিশারদরূপে তিনি সামাজিক জীবনে এবং চিন্তার জগতে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। আল্লামা যাহাবী (র)-এর পর তিনি উন্মুসসা’ওয়াত তানাকুরিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।(৫৬) তিনি ‘নুজায়বিয়ায়’ শিক্ষকতা করেন এবং ৭৪৮ হিজরী সনে ফাওকানী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন।
দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার ইতিহাস গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি সিরিয়ার নায়েবে সুলতানের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং সাইপ্রাসবাসীদের ভীতি প্রদর্শন ও শাস্তির ঘোষণা প্ৰদানসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।(৫৭) অন্যত্র তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি খলীফার সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং খলীফা তাকে বিনয়ী, বিচক্ষণ ও মিষ্টভাষী বলে প্ৰশংসা করেছিলেন।(৫৮)
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
অধঃপতনের যুগে রাজনৈতিক বিষয়াদিতে উলামা-মাশায়েখদের পরস্পর বিরোধী ভূমিকার কারণে দলীল-প্রমাণের প্রতি জনসাধারণের বীতশ্রদ্ধ ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। তাই ফতোয়া প্ৰাৰ্থ সংশ্লিষ্ট ফতোয়ার সাহায্যে সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা আন্দোলন সংগঠিত করবে। এমন আশংকায় তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতোয়া দানে বিরত থাকেন। যেমন কাষীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দানে তিনি বিরত থাকতেন। কারণ ফতোয়া দ্বারা প্ৰশাসনকে বিব্রত করা হয়।(৫৯)
অস্থিরতার এই যুগে রাজনৈতিক বিষয়ে নিজের রায় ঘোষণার ব্যাপারে তিনি যতটুকু রক্ষণশীল ছিলেন, অন্যদের সাথে মিলেমিশে কাজ করার ব্যাপারে তিনি ততটুকু উদার ও অকুণ্ঠ ছিলেন। হারারিয়্যা তরীকার সাথে সংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনকারী আবদুল্লাহ আল মুলাতী থেকে হাদীস বর্ণনা করাকে তিনি স্বভাবগতভাবে এবং শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অপছন্দ করতেন।(৬০)
খ. রচনাবলী
ইব্ন কাসীর (র) বিশেষত ইতিহাস, তাফসীর এবং হাদীস বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত ও পাণ্ডুলিপি আকারে বহু গ্ৰন্থ রয়েছে।
প্ৰকাশিত গ্ৰন্থরাজি
(১) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : এটির জন্যেই আমরা এই ভূমিকা লিখছি। এটি ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ। ১৪ খণ্ডে সমাপ্ত। শেষ দু’খণ্ড শেষ যুগের ফিতনা-ফাসাদ ও যুদ্ধবিগ্ৰহ বিষয়ক। ইব্ন কাসীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শায়খ শিহাবুদ্দীন আবু শামা মাকন্দেসীর ইতিহাস গ্রন্থের পরিশিষ্ট স্বরূপ আমাদের শায়খ হাফিজ ইলমুদ্দীন বিরযালী যে ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন। এটি তার পরিশিষ্ট। তার ইতিহাস গ্রন্থের পরিশিষ্ট স্বরূপ এযুগ পর্যন্ত ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ আমি এ গ্রন্থে সংযোজিত করেছি। তার ইতিহাস গ্ৰন্থ থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যগুলো চয়ন করার কাজ আমি শেষ করেছি ৭৫১ হিজরী সনে। হযরত আদম (আ:) থেকে আমাদের এ যুগ পর্যন্ত তিনি যা লিখেছেন তা এখানে এসে শেষ হয়েছে।(৬১)
কিন্তু ৭৩৮ হিজরীর পর থেকে ৭৫১ হিজরী পর্যন্ত সময়কালে বিরযালীর সংগৃহীত কোন তথ্য সম্পর্কে আমি অবগত হইনি।(৬২) ইব্ন কাসীর তার ইতিহাস গ্রন্থের অনুসরণ করে ৭৬৮ হিজরী সন পর্যন্ত পৌছান অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর ৬ বছর পূর্ব পর্যন্ত ইতিহাস বিবৃত হয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে, ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থটি শায়খ শিহাবুদ্দীন আবু শামা মাকদেসীর (মূঃ ৬৬৫ হিঃ) ইতিহাস গ্রন্থের পরিশিষ্টের পরিশিষ্ট।(৬৩)
সুতরাং এই কিতাবের বুনিয়াদ ও ভিত্তি হল শায়খ আবু শামা মাকদেসীর ইতিহাস গ্রন্থ, এটিতে রয়েছে ৬৬৫ হিজরী পর্যন্ত সময়কালের তথ্য। তার পরবর্তী অংশের ভিত্তি হল বিরযালীর ইতিহাস গ্রন্থ।৬৪ এটি হল ৭৩৮ হিজরী সন পর্যন্ত, অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর এক বছর পূর্ব পর্যন্ত। তারপর তথ্য সন্নিবেশিত করলেন ইব্ন কাসীর (র) ৭৬৮ হিজরী সন পর্যন্ত। অবশ্য ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থটি হুবহু আবু শামার গ্রন্থ নয়। কারণ, ইব্ন কাসীর (র) ছিলেন আবু শামা-এর ইতিহাস গ্ৰন্থ এবং বিরযালীর ইতিহাস গ্রন্থের পরিশোধন ও পরিমার্জনকারী। ইব্ন কাসীর (র) বলেন, তার ইতিহাস-গ্রন্থ থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যগুলো চয়ন করার কাজ শেষ করি ৭৫১ হিজরী সনের জুমাদাল উখরার ২০ তারিখ বুধবারে।(৬৫)
তিনি তাঁর এই গ্রন্থটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন :
(১) প্রথম অংশে রয়েছে আরশ-কুরসী, আসমান-যমীন ও এগুলোর মধ্যে যা আছে তা সৃষ্টির ইতিহাস এবং আসমান-যমীনের মধ্যবতী যা আছে সেগুলো সৃষ্টির ইতিহাস। অর্থাৎ ফেরেশতাকুল, জিন, শয়তান ইত্যাদির বর্ণনা। আরও রয়েছে। হযরত আদম (আ:)-এর সৃষ্টি, আম্বিয়া-ই কোরামের ঘটনাবলী, ইসরাঈলীদের বিবরণ এবং আইয়ামে জাহিলিয়াতের ঘটনাবলীসহ, হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর নবুওত লাভ পর্যন্ত কালের ঘটনাবলী।
(২) দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে নবী করীম (সা)-এর ওফাতের পর থেকে ৭৬৮ হিজরী পর্যন্ত।
(৩) তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে। ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য অশান্তি, বিপর্যয়, কিয়ামতের আলামতসমূহ, পুনরুত্থান, হাশর-নশর, কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ অবস্থা ও জান্নাতজাহান্নামের বিবরণ।
ইতিহাস গ্রন্থ সংকলনে তিনি তাঁর পূর্বে সংকলিত ইতিহাস গ্রন্থগুলোর তথা তারীখে তাবারী, তারীখে মাসউদ্দী ও তারীখে ইবনিল আহীর ইত্যাদি গ্রন্থের রীতি অনুসরণ করেছেন। ঘটনাবলী তিনি বছরওয়ারী বর্ণনা করেছেন। এগুলো বর্ণনায় তিনি বিভিন্ন শিরোনাম ব্যবহার করেছেন। প্রথমে তিনি বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী বৰ্ণনা করেছেন। তারপর ঐ বছর যারা ইনতিকাল করেছেন তাদের জীবনী আলোচনা করেছেন। কবিতার উদ্ধৃতি আছে প্রায় সব পৃষ্ঠাতেই। অনেক সময় তাঁর স্বরচিত কবিতা কিংবা প্রাসঙ্গিক কুরআনুল করীমের আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।
এই গ্রন্থটি বহুবার মুদ্রিত হয়েছে। আমার মনে হয় এর প্রাচীনতম মুদ্রণ হল ১৩৪৮ হিজরীর মুদ্রণটি। বাদশাহ আবদুল আর্যীয ইব্ন আবদুর রহমান আল সউদ এটি মুদ্রণ ও প্রকাশে আর্থিক সাহায্য প্ৰদান করেছিলেন। আসতানাতে অবস্থিত ওলীউদ্দীন লাইব্রেরীতে রক্ষিত কপি থেকে কুর্দিস্তান আল আলামিয়া প্রেসে এটি মুদ্রিত হয়েছিল।
দ্বিতীয়বার মুদ্রিত হয়েছিল কায়রোর আসসা’আদাহ ছাপাখানায় ১৩৫১ হিজরীতে। তারপর দুই খণ্ডে আলাদা-আলাদা ছাপা হয় মিসরে। অনুরূপভাবে শায়খ ইসমাঈল আনসারী কর্তৃক পরিমার্জিত রূপে রিয়াদে ছাপা হয় ১৩৮৮ হিজরী সনে, তবে এ সকল মুদ্রণে বিভিন্ন ক্রটি ছিল। এ জন্যে সকল ক্ৰটি-বিচূতি পরিশোধন করে বর্তমান মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ প্রসংগে আমরা উল্লেখ করতে পারি যে, শিহাবুদ্দীন ইব্ন হুযায়ী (ওফাত ৮১৬ হিঃ।) ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ৭৪১ হিজরী থেকে ৭৬৯ হিজরী সন পর্যন্ত সময়কালের ঐতিহাসিক তথ্যাদি সন্নিবেশিত করে। বার্লিনে তার একটি কপি রয়েছে।
আমরা এ বিষয়ে ঐতিহাসিক জুরজী যায়দানের একটি অভিমতের বিরোধিতা করি। তিনি বলেছেন যে, ‘বিরযালী’ রচিত ‘আল মুকতাফা লি তারীখে আবী শামাহ’ গ্রন্থটি ইব্ন আসাকির রচিত ‘ইখতিসারু তারিখ-ই-দামিশক’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট। জুরজী যায়দান উল্লেখ করেছেন যে, আররাওদাতাইন ফী আখবারে দাওলাতাইন আসসিলাহিয়্যাহ ওয়ান নুরিয়্যাহ’ গ্রন্থের সাথে আল মুকতাফা লি তারীখে আবী শামাহ’-এর সম্পর্ক রয়েছে তা সঠিক নয়।
যেহেতু ইব্ন আসাকীর-এর ইতিহাস গ্রন্থটি হল এ সিরিজের মূল ভিত্তি যা সর্বমহলে সুপরিচিত। ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’-ই যেহেতু এই ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত, তাই ইব্ন আসাকির সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার— যদিও এখানে তার আলোচনা খুব একটা প্ৰাসংগিক নয়।
তিনি, ইব্ন আসাকির, হাফিজ আবুল কাসেম আলী ইব্ন আবু মুহাম্মদ হাসান ইব্ন হিবাতুল্লাহ ওরফে ইব্ন আসাকির দিমাশকী। তার উপাধি ছিল সেকাতুদ্দীন। তিনি সিরিয়ার মুহাদিছ, শাফিঈ মাযহাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফকীহ। কোন কোন সফরে তিনি সামআনীর সফরসঙ্গী ছিলেন। দামেশকের নূরিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপক পদে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। তার রচিত ‘তারীখে দিমাশক’ গ্রন্থের জন্যে তিনি সমধিক খ্যাতি লাভ করেন। খতীব আবু বকরের ‘তারী খ-ই বাগদাদ’ গ্রন্থের রচনা-রীতি অনুসরণে ইবনে আসাকির ৮০ খণ্ডে সমাপ্ত এই গ্রন্থটি সংকলন করেছেন। তাতে তিনি ইসলামের প্রারম্ভিক যুগ থেকে তাঁর সমসাময়িক কাল পর্যন্ত দামেশকে বসবাসকারী এবং দামেশকে আগত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, রাবীগণ, মুহাদিসগণ, হাফিজগণ, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের জীবনী আলোচনা করেছেন। দামেশকের ‘মাজম আল ইলমী আল-আরবী’-এর অর্থানুকল্যে এ গ্রন্থের কতক অংশ প্রকাশিত হয়েছিল আর কতক অংশ প্রকাশিত হয়েছিল দামেশকের ‘রাওদাতু শশাম’ প্ৰকাশনালয়ের সহায়তায়।
এই গ্রন্থের কয়েকটি পরিশিষ্ট গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল : মূল রচয়িতা ইব্ন আসাকির (র)-এর পুত্র আলকাসিম রচিত পরিশিষ্ট।
সদরুদ্দীন বাকরী-এর রচিত পরিশিষ্ট।
উমর ইব্ন হাজিব রচিত পরিশিষ্ট।
আলোচ্য গ্রন্থের কয়েকটি সার-সংক্ষেপ গ্ৰন্থ রয়েছে, তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল :
ইখতিসারে আবী শামা, এটির পরিশিষ্ট লিখেছেন বিরযালী এবং পরবর্তী অংশ ইব্ন কাসীর (র)।
‘লিসানুল আরব’ গ্রন্থ প্রণেতা জামালউদ্দীন ইব্ন মানযুর রচিত সংক্ষিপ্তসার। ইসমাঈল আজলুষী আল-জারাহকৃত সংক্ষিপ্তসার।
ইখতিসার-ই শায়খ আবুল ফাতাহ আল খাতীব (ওফাত ১৩১৫ হিঃ)।
(১) ইব্ন কাসীর (র)-এর অন্যান্য রচনা
(২) তাফসীরুল কুরআনিল করীম (তাফসীরে ইব্ন কাসীর)
এটি প্রথমে ছাপা হয় বুলাকে, কানুজীর ‘ফাতহুল বয়ানের’ পার্শ্বটীকা রূপে এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১০ খণ্ডে। পুনরায় ছাপা হয় ১৩০০ হিজরীতে সাইয়িদ আবু তায়িত্ব সিদীক ইব্ন হাসান খান রচিত ‘মাজমাউল বিয়ান কী মাকাসিদিল কুরআন’ গ্রন্থের পার্শ্বটীকা স্বরূপ। ১৩৪৩ হিজরীতে এটি নাজদ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ইমাম সুলতান আবদুল আয়ীয ইব্ন আবদুর রহমান আল ফায়সাল-এর নির্দেশে মিসরের আল মানার ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়। এটির পার্শ্বটীকায় ছিল ইমাম বগভী (র) রচিত তাফসীর। পরে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘উমদাতুত তাফসীর আনিল হাফিজ ইব্ন কাছীর’ নামে ১৯৫৬ খৃস্টাব্দ/১৩৭৫ হিজরীতে পুনঃপ্রকাশিত হয়। এটি ৫টি খণ্ডে মুদ্রিত হয়। তাফসীর নং ১৬৮ ক্ৰমিক নম্বরে ৭ খণ্ডে সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখিত মাকতাবাতুল আযহারিয়্যায় রক্ষিত পাণ্ডুলিপি থেকে এটি মুদ্রিত হয়। ৮২৫ হিজরীতে ‘ মুহাম্মদ আলী সূফী এটির কপি করে দিয়েছিলেন। আমার জানা মতে এটি উৎকৃষ্টতম ছাপা।
ইব্ন কাসীর (র) কুরআন করীমের তাফসীর কুরআনের আয়াত দ্বারা, অতঃপর হাদীস দ্বারা এই নীতির অনুসরণ করেছেন। ইসরাঈলীদের মনগড়া বৰ্ণনাগুলোর তিনি সমালোচনা করেছেন। এগুলোর প্রতি তার কোন আস্থা ছিল না। তবে শরীয়ত যেগুলো সমর্থন করে, সেগুলো ব্যতিক্রম। তিনি তাফসীর গ্রন্থের সাথে ‘ফাযায়েলুল কুরআন’ও সংযুক্ত করে দিয়েছেন। যা ১৩৪৮ হিজরীতে স্বতন্ত্রভাবে মিসরে ছাপা হয়েছিল। অতঃপর তার তাফসীরের সাথে পুনরায় ছাপা হয়।
(৩) আল ইজতিহাদ কী তালাবিল জিহাদ
দারুল কুতুব আলুমিসূরিয়্যাতে এর একটি অশুদ্ধ কপি সংরক্ষিত আছে। ‘আলমাখতৃতাত ইন্সটিটিউটে’ এর ফটোকপি মজুদ আছে। এ কিতাবটি অতি সাধারণভাবে কোন প্রকারের পরিশোধন পরিমার্জন ব্যতীত প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ছিল বহু ভুল ও বিকৃতি। ১৩৪৭ হিজরী সনে ‘আবুল হাওল’ প্রেসে এটি মুদ্রিত হয়। তবে পরিশোধিত ও পরিমার্জিত প্রকাশনা হল ১৪০১ হিজরী মুতাবিক ১৯৮১ খৃস্টাব্দে বৈরুতে প্রকাশিত মুদ্রণটি। আবদুল্লাহ আবদুর রহীম উসায়লীন এই মুদ্রণের তত্ত্বাবধান করেন।
(ওফাত-৭৭৬ হিঃ) আগ্রহ পূরণার্থে ইব্ন কাসীর (র) এ গ্রন্থটি সংকলন করেছিলেন। এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত রয়েছে হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুসলিম ও ক্রুসেডারদের যুদ্ধ বিগ্রহের বর্ণনা। সেই যুগের বর্ণনা যে যুগে ইব্ন কাসীর (র) জীবন যাপন করেছিলেন। ইতিহাস শাস্ত্রে এটি একটি নির্ভরযোগ্য গ্ৰন্থরূপে বিবেচিত হয়। কারণ, সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী এই গ্রন্থে সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণিত হয়েছে। তিনি তাঁর এ গ্রন্থটি একটি ভূমিকা দ্বারা শুরু করেন। এতে তিনি জিহাদে উদ্বুদ্ধকারী কুরআনের আয়াতসমূহ এবং এরপর এ বিষয়ক হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছেন। মোট ১৩টি হাদীস তিনি এখানে সন্নিবেশিত করেছেন। তারপর ক্রুসেডার ও মুসলমানদের মধ্যকার যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর আলেকজান্দ্ৰিয়া সীমান্তে ফিরিঙ্গীদের আগ্রাসী আক্রমণ এবং মুসলমানদের প্রতিরোধের কথা বর্ণনা করেছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর যুগ থেকে শুরু করে খিলাফতে রাশেদা ও তার পরবর্তী যুগের সিরিয়ায় মুসলমানদের ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ’-এর জন্যে অবিরাম প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন। ফিরিঙ্গীদের বায়তুল মুকাদ্দাস দখল এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবী কর্তৃক তা পুনরুদ্ধারের ইতিহাস এবং গাযা, নাবলুস, আজলুন, কুর্ক, গাওর, শাওবাক ও সাফাদ অঞ্চল পুনরাধিকারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।
(৪) ইখতিসার-ই-উলুমিল হাদীস
এটি হাদীসের পরিভাষা বিষয়ক একটি পুস্তিকা। ‘আল-বাইছুল হাছীছ ইলা মারিফাতি উলুমিল হাদীস’ শিরোনামে আহমদ মুহাম্মদ শাকির এটির ব্যাখ্যাগ্ৰন্থ লিখেছেন। এটা হচ্ছে ইব্ন কাসীর (র) কৃত ইব্ন সালাহ-এর ‘মুকদিমা’ গ্রন্থটির সংক্ষিপ্ত সার। এ গ্রন্থের কয়েকটি মুদ্রণ হয়।
(ক) ১৩৫৩ হিজরী সনে শায়খ মুহাম্মদ আবদুর রাযযাক হামযার পরিশোধন সহকারে এর মক্কা সংস্করণ প্ৰকাশিত হয়।
(খ) ১৩৫৫ হিজরী সনে এর মিসরীয় সংস্করণ ছাপা হয়। আহমদ শাকির এটি সংশোধন
করেছেন।
(গ) কিছু অতিরিক্ত ব্যাখ্যা ও মন্তব্য সহকারে আহমদ শাকির ১৩৭০ হিজরী সনে এটা কায়রো থেকে পুনঃ প্ৰকাশ করেন।
(৫) শামাইলুর রাসূল ওয়া দালাইলু নুবুওয়াতিহী ওয়া ফন্যায়েলিহী ও খাসাইসিহী
এটি ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্ৰন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। ১৩৮৬ হিঃ/১৯৬৭ খ্ৰীঃ কায়রো থেকে প্রকাশিত এ গ্রন্থটি মুস্তাফা আবদুল ওয়াহিদ কর্তৃক পরিশোধিত ও পরিমার্জিত।
পরিশোধনে তিনি নিম্নে উল্লেখিত কপিগুলোর সাহায্য নিয়েছেন।
(ক) ওলীউদ্দীন কৃত ফটোকপি, এটি ইতিহাস গ্রন্থ ক্রমিক নং ১১১০ রূপে ‘দারুল কুতুব আল মিসরিয়্যা’ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।
(খ) মাকতাবা-ই-তায়মুরিয়্যা সংরক্ষিত ইতিহাস গ্রন্থ নং ২৪৪৩।
(গ) আলেপ্পোর মাকতাবা-ই-আহমদিয়া পাণ্ডুলিপি থেকে সংরক্ষিত কপি অনুসারে ১৩৫১
হিঃ সনে দারুস সাআ’দা প্ৰকাশনী থেকে প্ৰকাশিত কপি।
(৬) ইখতিসারু আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ
এটিও ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়’ থেকে সংকলিত গ্রন্থ। এতে ইব্ন কাসীর (র)-এর জাহেলী, যুগের আরব ইতিহাস এবং সীরাতুন্নবী-(সা) বিষয়ক আলোচনা স্থান পেয়েছে। ‘আল বিদায়া, ওয়ান নিহাম্বা’-এর ২য় খণ্ডের-শেয় থেকে ৫ম, খণ্ডের শেষ পর্যন্ত প্রায় তিন খণ্ডের আলোচনা এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। অর্থাৎ এই অংশটি ৪ ভাগে বিভক্ত। গ্রন্থটি বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। যেমন :
(ক) মিসরীয় মুদ্রণ : ১৩৫৮ হিঃ/১৯৫৭ খ্ৰীঃ আরিফ লাইব্রেরীতে রক্ষিত কপি অনুসারে ‘আল ফুসূল কী ইখতিসারে সীরাতে রাসূল (সা:)’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
(খ) বৈরুত ও দামেশকের ‘মুআসসাসাতু উলুমিল কুরআন ওয়া দারুল কলম’ প্রকাশনালয়ের প্রকাশনা। ১৩৯৯-১৪০০ হিজরীর মধ্যে ডঃ মুহাম্মদ ঈদ আল-খাতরাবী ও প্রফেসর মুহিউদ্দীন মন্তু এই সংস্করণটি সম্পাদনা করেন।
(৭) আহাদীসুত তাওহীদ ওয়ার রান্দু আলাশ শিরক
ব্রুকলম্যান তাঁর আরবী সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের (২/৮) পরিশিষ্টে এ তথ্য উল্লেখ করেছেন এবং তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ১২৯৭ হিজরী সনে এটি দিল্লীতে মুদ্রিত হয়েছে।
উপরোল্লেখিত গ্রন্থগুলোই হচ্ছে ইব্ন কাসীর (র) রচিত প্ৰকাশিত গ্রন্থ। তাঁর অপ্রকাশিত রচনাবলীর সংখ্যা অনেক। সেগুলোর মধ্যে প্ৰসিদ্ধগুলোর তালিকা নিম্নে দেয়া হচ্ছে :
(২) তাঁর অপ্রকাশিত রচনাবলী
(৮) জামিউল মাসানীদ
এ গ্রন্থটি ৮ খণ্ডে সমাপ্ত। শায়খ মুহাম্মদ আবদুর রাযযাক হামযা এটির নামকরণ করেছেন ‘আল-হাদসূ ওয়াস সুনান কী আহাদী।সিল মাসানীদ ওয়াস সুন্নান’। এটিতে তিনি ইমাম আহমদ আল-বাযযায-এর মুসনাদ, আবু ইয়া’লা-এর মুসনাদ, ইব্ন আবী শায়বার মুসনাদ এবং ৬টি প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। দারুল কুতুব আল-মিসরিয়্যাতে এর একটি কপি মওজুদ আছে যা সাত খণ্ডে বাঁধাইকৃত।
৭ম খণ্ডে আবু হুরায়রা (রা)-এর মুসনাদ-এর সিংহভাগ স্থান পেয়েছে।
(৯) তাবাকাতুশ শাফিঈয়্যা
দাউদী তাঁর গ্রন্থে (১ম খঃ পূঃ ১১০-১১১)-এর উল্লেখ করেছেন। কায়রোর আল মাখতৃতাত ইন্সটিটিউটে। ৭৮৯ ক্ৰমিক নম্বরে এ পুস্তকটির একটি ফটোকপি মওজুদ আছে যা ত্রুটিপূর্ণ। রাবাতের কাতানীর কপি থেকে এটি ফটো কপি করা হয়েছে। সেখানে শুস্তারবামিত এর অপর একটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে- যার ক্রমিক নং হচ্ছে ৩৩৯০।
(৩) ইব্ন কাসীর (র)-এর বিলুপ্ত রচনাবলী
ইব্ন কাসীর (র)-এর যে সকল রচনা আমরা পাইনি। কিন্তু তার গ্রন্থাদিতে কিংবা পূর্ববতী যুগের লেখকদের গ্রন্থে সেগুলোর নাম পাওয়া যায় তার কতকগুলোর কথা আমরা নিম্নে উল্লেখ করছি :
(১০) আত তাকমীল কী মা ‘রিফাতিস সিকাতি ওয়াদ দুআ‘ফা ওয়াল মাজহীল
হাদীসের বর্ণনাকারিগণ সংক্রান্ত ৫ খণ্ডে সমাপ্ত এ গ্রন্থটিতে তিনি তার শায়খ ‘মিযয়ী’-এর ‘তাহষীবুল কামাল’ এবং আল্লামা যাহাবী-এর ‘মীযানুল ইতিদাল’ গ্রন্থদ্বয় একত্র করেছেন। তিনি নিজে হাদীস বর্ণনাকারীদের যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত অতিরিক্ত কিছু তথ্যও এতে সংযোজন করেছেন।
নিম্নে বর্ণিত গ্ৰন্থসমূহে আলোচ্য গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছেঃ
(ক) হাজী খলীফা রচিত কাশফুযযুনুন, খঃ ১, পৃঃ ৪৭১
(খ) দাউদী রচিত তাবাকাতুল মুফাসসেরীন, খঃ ১, পৃঃ ১১০
(গ) আল্লামা সুযুতী রচিত যায়লু তাযকিরাতিল হুফফাজ, পৃঃ ৫৮।
(১১) আল কাওয়াকিবুদ দারায়ী ফীত তারিখ
এটি জীবন চরিত বিষয়ক গ্ৰন্থ। ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ থেকে এটি সংকলিত। হাজী খলীফা তাঁর ‘কাশফুজ জুনুন’ গ্রন্থে আলোচ্য গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের ১৫২১ পৃষ্ঠায় এর উল্লেখ করেছেন।
(১২) সীরাতুশ শায়খায়ন
এ গ্রন্থে তিনি হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফত প্ৰাপ্তি, তার মর্যাদা ও আচারআচরণের বিষয় উল্লেখ করেছেন। এরপর উল্লেখ করেছেন। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর জীবন, কর্ম ও অন্যান্য বিষয়। তাঁরা দু’জনে নবী করীম (সা) থেকে যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেগুলোও তিনি এ গ্রন্থে সংকলিত করেছেন। ফলে গ্রন্থটি হয়েছে তিনখণ্ড বিশিষ্ট।
নিম্নে বর্ণিত গ্রন্থগুলোতে আলোচ্য গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় :
(ক) আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া খঃ ৭, পৃঃ ১৮।
(খ) আল্লামা সুয়ুতী রচিত যায়লু তাযকিরাতিল হুফফাজ, পৃঃ ৩৬১
(১৩) আল ওয়াদিহুন নাফীফ ফী মানাকিবিল ঈমাম মুহাম্মদ ইব্ন ইদ্রীস
এ গ্রন্থটি ‘মানাকিিবশ শাফি, ঈ’ নামে প্রসিদ্ধ।
নিম্নে বর্ণিত গ্রন্থগুলোতে এর উল্লেখ রয়েছেঃ
(ক) হাজী খলীফা রচিত কাশফুজ জুনুন, খঃ ২, পৃঃ ১৮৪০।
(খ) আদ দাউদী রচিত ‘তাবাকাতুল মুফাসসিরীন’ খঃ ১, পৃঃ ১১১।
(১৪) কিতাবুল আহকাম
এটি একটি বিরাট গ্রন্থ। তিনি এটি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। হজ্জ অধ্যায় পর্যন্ত রচনা করেছিলেন। ‘আল-আহকামুস সুগরা কীল হাদীস’ নামেও এটির উল্লেখ পাওয়া পায়। হাজী খলীফা রচিত কাশফুজ জুনুন’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডে ৫৫০ পৃষ্ঠায় এ গ্রন্থটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
(১৫) আল আহকামুল কবীরা
নিম্নলিখিত গ্রন্থাদিতে এ গ্রন্থের আলোচনা রয়েছে : (ক) ইব্ন কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ৩, পৃঃ ২৫৩। (খ) আদ দাউদী তাবাকাতুল মুফাসসিরীন, খঃ ১, পৃঃ ১১০, ১১১।(১৬) তােখরীজু আহাদী।সি আদিল্লাতিৎ তানবীহ কী ফুরুইশ শাফি‘ঈয়্যা
নিম্নোক্ত গ্রন্থাদিতে এ গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় :
(ক) ইব্ন কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ২, পৃঃ ১২৫।
(খ) আল বাগদাদী, হিদায়াতুল আরেফীন, খঃ ১, পৃঃ ২১৫।
(১৭) ইখতিসারু কিতাবি আল মাদখাল। ইলা কিতাবিস সুনান লিল বায়হাকী
এর সারসংক্ষেপ। ইব্ন কাসীর (র) রচিত ‘ইখতিসার উলুমিল হাদীস’ গ্রন্থের ৪র্থ পৃষ্ঠায় উল্লেখ পাওয়া যায়।
(১৮) শারহু সহীহ আল-বুখারী
তিনি এটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। নিম্নে বর্ণিত গ্রন্থগুলোতে এর উল্লেখ পাওয়া যায় :
(ক) ইব্ন কাসীর (র) রচিত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’, খঃ ৩, পৃঃ ৩।
(খ) প্রাগুক্ত খঃ ১১, পৃঃ ৩৬।
(গ) হাজী খলীফা রচিত কাশফুজ জুনুন’ খঃ ১, পৃঃ ৫৫০।
(ঘ) আদ দাউদ্দী, তাবাকাতুল মুফাসসিরীন, খঃ ১, পৃঃ ১১০-১১১।
(১৯) আস-সিমাত
হাজী খলীফা রচিত কাশফুজ জুনুন গ্রন্থের ২য় খণ্ডে ১০০২ পৃষ্ঠায় এর উল্লেখ রয়েছে। উপরোল্লেখিত পরিশিষ্ট, ভাষ্য গ্ৰন্থ, সারসংক্ষেপ এবং সংকলনগুলোর পাশাপাশি ইব্ন কাসীর (র)-এর একটি কাব্য গ্রন্থেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। এটি সংকলন ও ব্যাখ্যা করা জরুরী। অদূর ভবিষ্যতে একাজ সম্পন্ন করার হিম্মত ও তাওফীক যেন আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দান করেন।
তাঁর কবিতার নমুনা :
تمر بنا الایام تتری و انما – نساق الی الاجال والعین تنظر
দিন যাচ্ছে অবিরাম আর আমরা আহা
নীত হচ্ছি মৃত্যুর দিকে চক্ষু দেখিছে তাহা।
فلا عاتد ذالك الشباب الذى مضى – ولا زاثل هذا المشيب المكدر
অতীত যৌবন আসবে না ফিরে কভু এ জীবনে
জরাজীর্ণ এই বাৰ্ধক্য যাবে না সরে কোনক্ষণে।
(৩) জ্ঞাতব্য
(১) তাঁর রচনাশৈলী : আল্লামা ইব্ন কাসীর (র) ও তাঁর রচনাবলী সম্পর্কে আলোচনার উপসংহারে তাঁর রচনাশৈলী সম্পর্কে কিছু কথা বলা জরুরী। ইব্ন কাসীর (র) ছন্দ ও বাক্যের সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতেন। তবে তিনি কতগুলো স্থানীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেগুলো ঐতিহাসিক তাবারী, মাসউদী ও ইবনুল আসীরের ভাষাগত উৎকর্ষের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। ইব্ন খালদুন তাঁর মুকাদ্দমা ও ইতিহাস গ্রন্থে যে পর্যায়ের ভাষাগত অলংকার ব্যবহার করেছেন ইব্ন কাসীর (র)-এর ব্যবহৃত ভাষা তার তুলনায় দুর্বল। আমরা এ কথা বলতে পারি যে, ইব্ন কাসীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থ রচনার প্রতি যত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, শব্দ ও ভাষার প্রতি তত গুরুত্ব দেননি। কারণ তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে ততটা পারদশী ছিলেন না। তার কবিতার ক্ষেত্রেও এ কথা প্ৰযোজ্য।
তার ভাষার মধ্যে আমরা প্রচুর ভুল-ভ্ৰান্তি লক্ষ্য করি। যেমন তিনি বলেছেন :
و و طنوا اراضی کشیر ة من صنع بلاد هم
অনুরূপভাবে তাঁর যুগের তুকী ও মামলুকদের ব্যবহৃত কতকগুলো শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। যথোচিত শব্দ চয়নেও কোন কোন ক্ষেত্রে তার ক্রটি পরিলক্ষিত হয়।
যেমন সালাহ উদ্দীনের ব্যাপারে তাঁর পুত্রদের শোক ও আহাজারীর বর্ণনায় তিনি লিখেছেন (তারা কৃত্রিমভাবে তাঁর জন্যে কাঁদছে।) যেন পিতা-পুত্রের মাঝে কোন আন্তরিক ও আত্মিক সম্পর্ক ছিল না, ফলে তারা কান্নার ভান করেছে।
(২) বৰ্ণনা পদ্ধতি : এতো ছিল ভাষাগত দিক। বর্ণনা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ইব্ন কাসীরের রচনা পাঠে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।
(ক) কুরআনুল দ্বারা কুরআনের তাফসীর করার পদ্ধতি বিষয়ের সাথে সংগতি রেখে তিনি কুরআন করীমের প্রচুর আয়াত সন্নিবেশিত করেছেন। অতঃপর আয়াতের সাথে সম্পর্কিত হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছেন।
(খ) তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে বিশ্বকোষ সুলভ বর্ণনা পদ্ধতি লক্ষণীয়। তিনি বর্ণনাকারীদের সূত্র ও ভাষ্যসমূহ দ্বারা তার ইতিহাস গ্ৰন্থকে সমৃদ্ধ করেছেন।
(৩) ইসরাঈলী বর্ণনাগুলো সম্পর্কে তিনি সন্দেহ পোষণ করতেন। তিনি বলেছেন, এটি এবং এটির ন্যায় অন্যান্য বর্ণনা আমার মতে মিথ্যাচারী ও ধর্মত্যাগী লোকদের স্বকপোলকল্পিত রচনা। এ সবের দ্বারা তারা তাদের দীনের ব্যাপারে জনসাধারণকে বিভ্ৰান্ত করে। অন্যত্র তিনি বলেছেন, এই তাফসীরে আমি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছি তা হল ইসরাঈলী বৰ্ণনা বর্জন। কারণ এগুলোর উল্লেখ করা শুধু সময়ের অপচয়। এগুলোতে রয়েছে তাদের মধ্যে প্রচলিত মিথ্যাচারের বর্ণনা।
(৪) একজন হাদীসবিশারদ ইমামের মতই তিনি রেওয়ায়েত বা বর্ণনা সূত্রসহ তথ্য উল্লেখে গুরুত্ব দিয়েছেন। ইজতিহাদ ও আপন অভিমত সংযোজনকে তিনি অপছন্দ করতেন।
(৫) সংশ্লিষ্ট গ্রন্থগুলোর একত্রীকরণ। কোন তথ্য কিংবা বর্ণনাতে রং চড়াতে গিয়ে তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন করতেন না। বরং প্রতিটি দলীল ও বর্ণনাকে তিনি হুবহু উদ্ধৃত করতেন।
(৬) অলংকরণ, বিন্যাস, সৌন্দর্য বিধান, ব্যাখ্যাকরণ ও হেতু বর্ণনা তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল না। বরং তাঁর প্রধান ও সার্বিক লক্ষ্য ছিল তথ্যসমূহ একত্র করা। ফলে কখনো কখনো তথ্য ও বর্ণনার পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হয়। আবার কখনো কোন তথ্যের প্রাসংগিক বিষয়াদি একাধিক স্থানে সন্নিবেশিত হয়েছে।
—————-
(৪০) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৩২।
(৪১) ইব্ন হাজর, আব্দদুরারুল কামিনা, খঃ ১, পৃঃ ২৯৯, ৩৭৭। দাউদ্দী, তাবাকাতুল মুফাসসিরীন, খঃ ১, পৃঃ ১১০।
যাহাবী : তাবাকাতুল হুফফাজ পৃঃ ৫৭, যিরকানী আল-আলাম, খঃ ১, পৃঃ ৩২০।
(৪২) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২২।
(৪৩) ইব্ন কাসীর, উমাদাতুত তাফসীর (আল মুকাদ্দামা) খঃ ১১, পৃঃ ২২। যারাকানী, আল ইলাম, খঃ ১; পূঃ ৩৭।
* বর্তমানে উযা হুরান নামে পরিচিত।
(৪৪) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ১৪, পূঃ ৩২।
(৪৫) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ১৪, পৃঃ ৩৩।
(৪৬) প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৮।
(৪৭) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃ. ১৫৬, ৩২৬।
(৪৮) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২০৩, ২০৪। ইব্ন হাজর, আব্দদুরারুল কামিনা,
(৪৯) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৫৬।
(৫০) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৫৩।
(৫১) প্রাগুক্ত, খঃ ১৪, পৃষ্ঠা ১৫২।
(৫২) দাউদ্দী, তাবাকাতুল মুফাসসিরীন, খঃ ১৪, পৃঃ ১১১।
(৫৩) যাহাবী, তাবাকাতুল হুফফাজ, খঃ ৪, পৃঃ ২৯।
(৫৪) আবুল মাহাসিন আল হুসায়নি, যায়লু তাযকিরাতুল হুফফাজ, পৃঃ ৫৮।
(৫৫) সুয়ুতী, যায়লু তাবাকাতিল হুফফাজ, পৃঃ ২২।
(৫৬) আলহাসানী, যায়লু তাযকিরাতিল হুফফাজ পৃঃ ৫৮। ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৮২,
প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭৫।
(৫৭) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৩২৯।
(৫৮) প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৭।
(৫৯) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২১৬।
(৬০) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২৭।
(৬১) প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৪।
(৬২) আমাদের সম্মুখে উপস্থিত গ্রন্থে আমরা এই বর্ণনাভঙ্গি লক্ষ্য করি :
(ক) ইব্ন আসাকিরের (মৃত্যু ৫৭১) দামেশকের ইতিহাস
(খ) আবু শামা (মৃত্যু : ৬৬৫) রচিত দামেশকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
() বিরযালী (মৃত্যু : ৭৩৯) রচিত দামেশকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের পরিশিষ্ট
(ঘ) ইব্ন কাসীর (মৃত্যু : ৭৭৪) রচিত, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া
(ঙ) শিহাবুদ্দীন ইব্ন হাজী (মৃঃ ৮১৬) রচিত, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-এর পরিশিষ্ট
আমার ধারণা, এটিই তাঁর পূর্বতন আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থ।
(৬৩) ইনি হলেন শিহাবুদ্দীন আবদুর রহমান ইব্ন ইসমাঈল ইব্ন ইবরাহীম ইব্ন উছমান ইব্ন আবু বকর ইব্ন আব্বাস, আবু মুহাম্মদ আল মাকদেসী। তিনি ছিলেন একাধারে ইমাম, আলিম, হাফিজ, মুহাদিস, ফকীহ ও ইতিহাসবিদ। তিনি আবু শামা নামে প্রসিদ্ধ। তিনি দারুল হাদীস আল আশরাফিয়্যা-এর শায়খ এবং রুকনিয়্যাহ মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। তাঁর রচিত গ্ৰন্থসমূহ হল বহু খণ্ডে সমাপ্ত ইখতিসার তারিখে দামিশাক বিরযালী (র) এ গ্রন্থেরই পরিশিষ্ট রচনা করেছেন], শারহুশ শাতিবিয়্যাহ, আররাদ্দু ইলাল আমীরিল আউয়াল, আল মাবিআছ, আল ইসরা, আররাওদাতায়ন কীদ দাউলাতায়ন আসসালাহিয়াহ ওয়ান নূরিয়্যাহ। ৫৯৯ হিজরীতে তাঁর জন্ম ‘আররাওদাতায়ন’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট রূপে তিনি আরও কিছু তথ্য সংযোজন করেছেন। তিনি হাদীস এবং ফিকাহ, অধ্যয়ন করেছেন ফখর ইব্ন আসাকির ও ইব্ন আবদুস সালাম (র) থেকে। তিনি মুজতাহিদের স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। কবিতাও রচনা করেছেন। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। ৬৬৫ হিজরী সনে তাঁর বাসগৃহে তাঁকে দাফন করা হয়।
(৬৪) বিরযালী হলেন, ইলমুদ্দীন আবু মুহাম্মদ আল কাসিম ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন বিরযালী। সিরিয়ার ইতিহাসবিদ। শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী। ৬৬৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ যে বছর শায়খ আবু শামা মাকন্দেসী ইনতিকাল করেন সে বছর বিরযালীর জন্ম হয়। ৭৩৯ হিজরীতে তিনি ইনতিকাল করেন। তখন তিনি ইহরাম বাধা অবস্থায় ছিলেন। অতঃপর তাকে গোসল দেওয়া হয় এবং কাফন পরানো হয়। এক হাজারেরও অধিক শায়খ ও আলিম তাঁর লাশ বহন করে নিয়ে যান। আন নূরিয়্যা মাদ্রাসায় তিনি শায়খুল হাদীস ছিলেন। তাঁর কিতাবগুলো ঐ প্রতিষ্ঠানের জন্যে তিনি ওয়াকফ করে দেন। (ইব্ন কাসীর আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৯৬-৯৭)
(৬৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৪, তাঁর সংকলন ‘আলমুকতাফা লি তারীখে আবীশামা’ এটিকে তিনি আবু শামা রচিত ইতিহাস গ্রন্থ আর রাওদাতায়ন’-এর সাথে সংযোজন করেছেন। জুরজী যায়দান তার তারীখে আদাবিল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে এরূপ উল্লেখ করেছেন। তাতে ৭২০ হিজরী পর্যন্ত কালের ঘটনাবলী তিনি বিবৃত করেছেন। ‘কৃপরিলীতে’ এর একটি কপি রয়েছে। কায়রোর আন্তর্জাতিক আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাণ্ডুলিপি বিভাগে এর একটি ফটো কপি রয়েছে। তাঁর শিষ্য তাকীউদ্দীন ইব্ন রাফি সালামী (মৃত্যু ৭৭৪ হিঃ) আল ওফিয়্যাতে’ এর একটি পরিশিষ্ট লিখেছেন। ‘দারুল কুতুব আলমিসরিয়্যাতে’ এর একটি কপি রয়েছে।
——————–
তথ্য সূত্র
আমরা শুধু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান তথ্য সূত্ৰসমূহ উল্লেখ করছি, যাতে বিস্তারিত জানার জন্যে ভাষ্যগ্রন্থসমূহের সাহায্য নেয়া যায় :
(১) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৪ খণ্ড, ৭ ভলিউমে। (২) ইব্ন কাসীর, উমদাতুত তাফসীর আনিল হাফিজ ইব্ন কাসীর সংক্ষেপায়ন ও সম্পাদনা— আহমদ মুহাম্মদ শাকির, দারুল মাআরিফ, মিসর। প্রথম প্রকাশ, ১৩৭৬ হি/১৯৫৬ খৃঃ।
(৩) ইব্ন কাসীর, আল-ইজতিহাদ ফী তালাবিল জিহাদ, সম্পাদনা, আবদুল্লাহ আবদুর রহীম উসায়লান, বৈরুত, ১৪০১ হিঃ/১৯৮১ খৃঃ।
(৪) ইব্ন কাসীর, ইখতিসার উলুমিল হাদীস, সম্পাদনা—আহমদ শাকির, ভূমিকা, আবদুর রাযযাক হামযা, কায়রো, ১৩৭০ হিঃ।
(৫) ইব্ন কাসীর, শামাইলুর রাসূলু ওয়া দালাইলু নুবুওয়াতিহী, ওয়া ফাযাইলিহী
ওয়া খাসাইসিহী, সম্পাদনা— মুস্তফা আবদুল ওয়াহিদ, ঈসা আল বাবী আল হালাবী এণ্ড কোম্পানী মুদ্রণালয়, কায়রো, ১৩৮৬হিঃ/১৯৬৭ খৃঃ।
(৬) ইব্ন কাসীর, ইখতিসারু আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, সম্পাদনা—মুহাম্মদ ঈদ আল খাতরাবী ও মুহিউদ্দীন মস্তুও, উলুমুল কুরআন ওয়া দারুল কলম ফাউন্ডেশন দামেশ্বক, বৈরুত, ১৩৯৯-১৪০০ হিঃ।
(৭) ইব্ন কাসীর, আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, সম্পাদনা-মুস্তাফা আবদুল ওয়াহিদ, দারুল মারিফাহলিত তাবাআ’ ওয়ান নাশর, বৈরুত, ১৩৯৯ হিঃ/১৯৭৯ খৃঃ।
(৮) ইব্ন কাসীর, তাফসীর ইব্ন কাসীর ওয়াল বাগাবী, মাতবা’আতুল মানার মুদ্রিত, মুহাম্মদ রশীদ রেযার উপস্থাপনা, মুদ্রণ নির্দেশ দিয়েছেন সুলতান আবদুল আষীয আল-সাউদ, নাজদ ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ইমাম, মিসর, ১৩৪৩ হিজরী।
(৯) খায়রুদ্দীন আযযিরিকলী, আল-আ’লাম, কামূস ও তারাজিম, দারুল ইলম লিল মালাঈন, বৈরুত রোড নং-৫, ১৯৮০ খৃস্টাব্দ।
(১০) জুরিজী যায়দান, তারাখু আদাবিল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ, উপস্থাপনা, শাওকী দায়ফ, দারুল হিলাল মুদ্রিত, কায়রো।
(১১) শামসুদ্দীন আযযাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফাজ, হায়দ্রাবাদে মুদ্রিত, ১৩৩৪ হিজরী।
(১২) ইব্ন হাজার আল আসকালানী, আব্দদুরারুল কামিন ফী আইয়ান আল মিআতিস সামিনা, হায়দ্রাবাদে মুদ্রিত, ১৩৪৮ হিজরী।
very good writing
মাশাআল্লাহ