০৪. আৰ্যামি

আৰ্যামি

আমাদের আদিম আৰ্য প্রপিতামহেরা ধরা পৃষ্ঠের ঠিক কোন জায়গা থেকে যাত্রারম্ভ করে যে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছেন, সে প্রশ্নের একটি নিশ্চিত জবাব দেওয়া শক্ত। তাঁরা কি মধ্য-এশিয়ার পশ্চিম দিকটায় ভেড়া চরাতেন, না নরওয়ের উত্তর-মাথায় মাছ শিকার করতেন, এ তর্কের কোনও মীমাংসা হয়নি। ভাষাতত্ত্বের প্রমাণে যে যব তাঁরা সকলে মিলে নিঃসন্দেহই খেতেন, তা তাদের চাষ করে-পাওয়া, না ইউফ্রেটিসের তীরের বুনো যাব, সে বিষয়েও মহা মতভেদ রয়েছে। তারপর তাদের সবারই মাথার প্রস্থের একশো গুণকে দৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল যে কখনওই পাঁচাত্তরের বেশি হত না, একথা আর এখন কোনও পণ্ডিতই হলপ করে বলতে রাজি নন। বরং শোনা যাচ্ছে যে, যেমন আমাদের বাঙালি ব্ৰাহ্মণেরা সবাই এক আৰ্যবংশাবতংস হলেও তাদের চেহারায় এ-মিলটা ধরার জো নেই, কেননা কেউ কটা কেউ কৃষ্ণ, কারও মাথা গোল কারও চেপটা, তেমনি আদিম আৰ্যদের মধ্যেও চেহারার এই গরমিলের দিকেই প্রমাণের পাল্লাটা নাকি বেশি ভারী হয়ে দাড়াচ্ছে। এমনকী একদল কালাপাহাড়ি পণ্ডিত এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন যে, আৰ্য বলে কোনও একটা বিশিষ্ট জাত, অর্থাৎ একটা বিশিষ্ট জাত যাকে ওই এক নামে ডাকার কোনও বস্তুগত কারণ আছে, কোনওদিনই কোনওখানে ছিলনা। ওটা একটা ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের পণ্ডিতদের মানসিক সৃষ্টি, ‘ওয়ার্কিং হাইপথিসিস’।

যেমন গতিক দেখা যাচ্ছে, তাতে করে প্রাচীন ও আদিম আৰ্যজাতির অদূদ্ষ্টে কী আছে বলা কঠিন। আসছে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তাঁরা বিধাতার সৃষ্টি বলে কায়েম হয়েও বসতে পারেন, আবার মানুষের কল্পনা বলে বাস্তব পদার্থের লিস্টি থেকে তাঁদের নামও কাটা যেতে পারে। কিন্তু একটা বিষয়ে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। আর্যজাতির কপালে যা-ই ঘটুক, তাঁরা বস্তু হয়ে চেপেই বসুন, আর অবস্তু হয়ে উড়েই যান, ‘আৰ্যামি’ বস্তুটির তাতে বিশেষ কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। যাঁরা মনে করে, কারণ না থাকলেই আর তার কার্য থাকে না, তাঁরা না পড়েছে দর্শনশাস্ত্ৰ, না আছে তাদের লৌকিক জ্ঞান। ‘নিমিত্ত’ কারণ যে একটা কারণ, একথা আরিস্টটল থেকে অন্নভট্ট পর্যন্ত সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। এবং ও-কারণটি নিজে ধ্বংস হলেও তার কার্য ধ্বংস হয় না। যেমন নিজের বোনা কাপড়খানির পূর্বেই তাতি বেচারির জীবনান্ত ঘটতে কিছুই আটক নেই। আর পুথি ছেড়ে সংসারের দিকে চেয়ে দেখলেও এর ভুরি ভুরি প্রমাণ চোখে পড়বে। যুদ্ধ থেমে গেছে কিন্তু ‘পাবলিসিটি বোর্ড’ চলছে; জার্মানভীতি ঘুচে গেল অথচ ‘রিফর্ম স্কিম’ নিয়ে আমাদের তর্ক শেষ হয়নি; এমনকী বিলাতের কলের মজুরেরা যেমন যুদ্ধের মধ্যে দুবেলা পেটপুরে খেয়েছে, যুদ্ধের পরেও তেমনি চলুক বলে হাঙ্গাম উপস্থিত করেছে।

কিন্তু প্রকৃত গোড়ার কথা এই যে, ‘আৰ্যামি’র সঙ্গে ‘আর্যের’ আসলে কোনও কাৰ্যকারণ সম্বন্ধ নেই। আর্যজাতি পৃথিবীতে যতই প্রাচীন হন না কেন, ‘আৰ্যামি’ জিনিসটি যে মনুষ্য সমাজে তার চেয়ে ঢের বেশি প্রাচীন, তাতে বিন্দুমাত্ৰ সন্দেহ করা চলে না। বুৎপত্তি দিয়ে বস্তুনির্ণয়ের চেষ্টা করে শুধু এক বৈয়াকরণ; এবং ও-জাতটি যে কাণ্ডজ্ঞানহীন একথা সর্ববাদিসম্মত। ‘আৰ্যামি’ হল মানুষের সেই মনোবৃত্তির প্রকাশ ও বিকাশ, বিলাতি পণ্ডিতদের মতে যাতে ইত্যর প্রাণী থেকে মানুষ তফাত, অর্থাৎ তার ‘সেলফ কনশাসনেস’; আর দেশিতত্ত্বজ্ঞদের মতে যার সম্পূর্ণ বিনাশ, অথবা যা একই কথা–চরম বিকাশই হচ্ছে পরামুক্তির পথ, অর্থাৎ অহংজ্ঞান। সমাজতত্ত্ববেত্তারা বলেন, মানুষ যে পরের মধ্যে নিজের সাদৃশ্য দেখে, তাতেই সে অপরের সঙ্গে সমাজ বেঁধে ঘর করতে পারে। এই সাদৃশ্যবোধ হল সমাজবন্ধনের একটা পোক্ত শিকল। কিন্তু সবাই জানে ভিন্ন জিনিসের মধ্যে সাদৃশ্যজ্ঞানটা সাধারণ বুদ্ধির কথা। সূক্ষ্মবুদ্ধির কাজ হচ্ছে একইরকম জিনিসের মধ্যে থেকে তফাত বের করা। সুতরাং মানুষ যখন সূক্ষ্মবুদ্ধির জোরেই করে খাচ্ছে, তখন তার বুদ্ধির স্বাভাবিক বেঁধাকটা হল পরের সঙ্গে নিজের সাদৃশ্য নিয়ে খুশি না থেকে, এই মিলের মধ্যে অমিল কোন কোন জায়গায় তাই খুঁজে বের করার দিকে। আর এ খোঁজে কাকেও ব্যর্থ হতে হয় না। কেননা একে তো লাইবনিজ প্রমাণই করে গেছেন যে, সংসারে দুটি বস্তুর ঠিক একরকম হবার কোনও জো-ই নেই; আর লাইবনিজ ছিলেন একজন দিগগজ গণিতজ্ঞ লোক। তারপর সবাই নিজেকে জানে সাক্ষাৎভাবে, অন্য সকলকে পরোক্ষে। আমার বুদ্ধি আমার কাছে স্বপ্ৰকাশ, অন্যের বুদ্ধি আছে কি নেই, সেটা অনুমানের কথা। কাজেই আমি যে অন্য সকলের চেয়েই ভিন্নরকমের, এবং মোটের উপর এ-রকমটি আর হয় না, এ জ্ঞান যেমন ব্যাপক তেমনি গভীর। নিজের সম্বন্ধে এই মর্মগত বোধটা লোকে যখন প্ৰকাশ করে ফেলে, তখন তার নাম হয় ‘অহংকার’, দ্বিতীয় ভাগ থেকে বেদান্তগ্ৰন্থ পর্যন্ত সবাই যার একটানা নিন্দা করেন। আর এ ভাবটি যখন একটা দলকে ধরে প্রকাশ হয়, তখন সেই বস্তুটিই হল ‘আর্যামি’। কেবল দলের প্রকারভেদে নামের রকমভেদ ঘটে, যেমন আভিজাত্য, ব্ৰাহ্মণত্ব, পেট্রিয়টিজম, অ্যাংলো-স্যাকসনত্ব ইত্যাদি। এবং ভাট, চারণ, কবি, ঐতিহাসিক সকলে মিলে মানুষের সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এর জায়গান গেয়ে আসছে।

সংসারে এমন সব সরলবুদ্ধির লোকও আছে যাঁরা প্রশ্ন করে বসে ব্যক্তির পক্ষে যেটা দোষের, সমাজ বা জাতি, অর্থাৎ ব্যক্তিসমষ্টির পক্ষে সেইটিরই বর্ধিত সংস্করণ বা ‘এনলার্জড এডিশন’ কোন প্ৰশংসার?—-অবশ্য এর সোজা উত্তর এই যে, ব্যক্তি আর জাতি এক নয়, কেননা যদি তা হত, তা হলে ও-দুয়ের নাম এক না হয়ে, ভিন্ন ভিন্ন হবে কেন! উক্তরূপ প্ৰশ্নকর্তাদের পাণ্ডিত্যের উপর বিশেষ শ্রদ্ধা নেই; না হলে জার্মন, অ-জার্মন সবরকম পণ্ডিতের প্রাচীন নুতন নানা মত তুলে এ-ও দেখানো যেত যে, জাতি বা ‘স্টেট’ জিনিসটা মোটেই ব্যক্তির সমষ্টি নয়। কেননা ও-নিজেই একটা স্বতন্ত্র ব্যক্তি, যার একটা নিজস্ব গুণ, ইচ্ছা, অনুভূতি আছে, যা জাতি বা স্টেটের লোকদের গুণ, ইচ্ছা ও অনুভূতি থেকে স্বতন্ত্র, মোটেই তার সমষ্টি নয়। অর্থাৎ দেশের সব লোক দরিদ্র হলেও দেশটা ধনী হতে কোনও আটক নেই। আর এ-কথা যে ঠিক, ভারতবর্ষের প্রত্যেক লোককেই তা স্বীকার করতে হবে। এইসব সূক্ষ্মী অথচ প্ৰকাণ্ড তত্ত্ব যাদের বুদ্ধির অগম্য তাদের জন্য একটা সহজ ছোট উত্তর দেওয়া যাচ্ছে। কারু নিজের সম্বন্ধে অহংকার প্রকাশ করাটা যে, সমাজে নিন্দার কথা, তার কারণ ওই এক অহং-এর খোঁচা আর সকল অহং-এর গায়ে লেগে তাদের ব্যথিত করে তোলে। কিন্তু একটা গোটা দলকে ধরে যখন এটি প্রকাশ হয়, তখন দোষটা আর থাকে না। এবং এতে দলের সকলেরই সহানুভূতি পাওয়া যায়। অবশ্য একদলের অহংবোধটা অন্য আর একদলের গায়ে লাগেই লাগে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। কেননা আমাদের যা কিছু রীতি, নীতি, বিধি, নিষেধ, সে সবই হল ছোট হোক বড় হোক কোনও একটা দলের লোকদের পরস্পরের প্রতি ব্যবহারকে লক্ষ্য করে। একদলের সঙ্গে আর একদলের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রিত করা এ-সব কোনও কিছুরই লক্ষ্য নয়! সেইজন্য লোকের সঙ্গে কথায় ও কাজে যে লোকের ভদ্রতার সীমা নেই, সেই লোকই একটা সমস্ত জাতির সম্বন্ধে কথায় বা ব্যবহারে কোনওরকম ভদ্রত রক্ষার প্রয়োজন বোধ করে না। যে লোক জীবনে কাকেও কোনওদিন কড়া কথা বলেনি, সেও দল বেঁধে একটা গোটা দেশকে পোষণে ও শোষণে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না।

আধুনিক ইউরোপীয় রাজ্যগুলির মধ্যে ‘ইন্টারন্যাশানাল ল’ বলে যে আপসি ব্যবহারনীতির চলতি আছে, সকলেই জানে যে, তার গোড়ার কথা হচ্ছে সমাজে বা রাষ্ট্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারের যে-সব নিয়মকানুন গড়ে উঠেছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যবহারে সেইগুলিকে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। ডাচ পণ্ডিত হুগো গ্রোসিয়াসকে এই আন্তর্জাতিক ধর্মশাস্ত্রের প্রবর্তক বলা চলে। এ সম্বন্ধে যিনি কিছুমাত্র আলোচনা করেছেন তিনিই জানেন যে, রোমান ব্যবহারশাস্ত্ৰে লোক-ব্যবহারের যে নিয়মগুলি সর্বসাধারণ, সুতরাং স্বাভাবিক বলে গণ্য হয়েছিল, গ্রোসিয়াস সেইগুলিকেই তাঁর মৈত্রীবিগ্ৰহ সংহিতার ভিত্তি করেছিলেন। ব্যক্তির নীতিকে সমষ্টির রীতি করে তোলার এই চেষ্টা কতদূর সফল হয়েছে, ১৯১৪ সালে তার একটা পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে, এবং ১৯১৮ সালেই তার শেষ হয়েছে এমন মনে করবার কোনও সংগত কারণ নেই।

একটা অবাস্তর কথা দিয়ে ‘আৰ্যামির এই উৎপত্তি পর্বের অধ্যায় শেষ করা যাক। ইংরেজ-দার্শনিক হবস গ্রোসিয়াসেরই সমসাময়িক লোক ছিলেন। তিনি কল্পনা করেছিলেন যে, আদিতে মনুষ্য-সমাজ রাষ্ট্রবদ্ধ ছিল না। এবং কাজেই পরস্পরের প্রতি ব্যবহারের কোনও বঁধাের্বাধি নিয়মও চলতি ছিল না। সে ছিল একটা নিত্য বিগ্ৰহ বিবাদের যুগ, যখন প্রত্যেকেই ছিল প্ৰত্যেকের শত্ৰু, এবং সবারই হাত তখন সবারই বিরুদ্ধে তোলা থাকত। এই ভয়ানক দুরবস্থাটা মোচন করবার জন্যই সবাই মিলে একটা ‘স্টেট’ গড়ে তার হাতে আত্মসমৰ্পণ করেছে, এবং ‘স্টেট’ পরস্পরের প্রতি ব্যবহারের আইন-কানুন বেঁধে দিয়ে বৈষম্যের জায়গায় শান্তি এনেছে। বহু পণ্ডিত প্ৰমাণ করেছেন এবং এখনও করছেন যে, হবসের এই কল্পনাটা একেবারে অনৈতিহাসিক। মানুষ কোনওদিনই সমাজ ছাড়া ছিল না, এবং কোনও রাষ্ট্র-গড়ার মজলিসের প্রসিডিং, কি পাথরে কি তামায়, এ পর্যন্ত কোনও পুরাতত্ত্ববিদই আবিষ্কার করতে পারেননি। কিন্তু একটা সন্দেহ মনে না এসে যায় না। মানুষের আদিম অবস্থার এই যে কল্পনাটা সেটা হবস নিয়েছিলেন তাঁর সমসাময়িক ইউরোপীয় রাজ্যগুলির পরস্পরের সম্বন্ধ থেকে। অর্থাৎ গ্রোসিয়াস চেয়েছিলেন, লোক-ব্যবহারের নীতি নিয়ে এই সম্বন্ধকে নিয়ন্ত্রিত করতে, আর হবস কল্পনা করেছিলেন, এই নীতি নিয়ম প্রচলনের পূর্বে লোকের সঙ্গে লোকের সম্বন্ধ ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্বন্ধেরই মতো।  পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে গ্রোসিয়াসের বিখ্যাত পুথির ছাব্বিশ বছর পরে হবসের ‘লিভিয়াথন’ প্ৰকাশিত হয়।

 

আৰ্যামির জন্ম রহস্যটা একবার প্রকাশ হলে তার জীবন-চরিত্যের হেরফেরগুলো বুঝতে আর কষ্ট হয় না।

বড় হোক, ছোট হোক একটা দলের নাম দিয়ে নাকি এ জিনিসটিকে চালাতে হয়, তাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে অল্প-বিস্তর মোটারকম বাহ্যিক লক্ষণের উপরেই দাড় করানো ছাড়া উপায় থাকে না। গায়ের চামড়ার রং, মাথার খুলির মাপ, সাগরবিশেষের পশ্চিম পারে কি পর্বতবিশেষের উত্তর ধারে নিবাস স্থান, খাবার জিনিসে নাইট্রোজেনের প্রাচুর্য কি স্নেহ-পদার্থের আধিক্য, পূর্বপুরুষ ঘোড়ায় চড়ে বর্শা চালাতেন কি মাটিতে দাঁড়িয়ে তির ছুড়তেন, এইরকম যাহোক কিছু একটার উপরেই একটা প্ৰকাণ্ড অভিমানের ইমারত গড়ে তুলতে হয়। অবশ্য এই চর্মাস্থি-বিদ্যা, ভৌগোলিক-তথ্য, ভক্ষ্যাভক্ষ্য-বিচার এর প্রত্যেকটিরই ‘ইনুয়েন্ডো’ বা ইঙ্গিত হচ্ছে মানসিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির এক একটি লম্বা ফর্দ। এ-সব লক্ষণের সঙ্গে এ-সব গুণের কোনওরকম অন্যথা সিদ্ধিশূন্য’ বা নিত্যসম্বন্ধ আছে কি না সে সন্দেহে আৰ্যামির অভিমানকে কখনও সংকুচিত হতে হয় না। কেননা লক্ষণগুলি হল বাহ্যিক অর্থাৎ প্রত্যক্ষ, আর গুণগুলি হল নিগূঢ় অর্থাৎ আনুমানিক। প্রত্যক্ষ নিয়ে তর্ক চলে না, আর তর্কের ভূমিই হল অনুমান। এবং তর্ক জিনিসটার সুবিধা এই যে, এ ব্যাপারে পরাজয় নির্ভর করে বিপক্ষের শক্তির উপর নয়, নিজের ইচ্ছার উপরে। নিজে স্বীকার না। করলে তর্কে হার হয়েছে, এ অবশ্য কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। কেননা সেইটিই হবে আবার একটা তর্কের বিষয়।

ব্যক্তির অহংকারের চেয়ে সমষ্টির অহংকারের একটা শ্রেষ্ঠত্ব এই যে, এক এক যা নিয়ে কোনওরকমেই অহংকার করা চলে না, দল বেঁধে তাকেই একটা দুৰ্জয় অহংকারের কারণ করে তোলা যায়। এক যুগের ফরাসিরা সে যুগের ইংরেজদের বুদ্ধিসুদ্ধিতে বিশেষ মুগ্ধ না হয়ে, তাদের নাম দিয়েছিল ‘জনবুল’। আজ ইংল্যান্ডের খবরের কাগজ লেখকেরা এই নামটাকেই একটা উৎকট জাতীয়-অভিমান প্রকাশের রাস্ত করে তুলেছে। এ-জাতির বুদ্ধি যে একটু মোটা বলে বোধ হয়, তার কারণ এ-বুদ্ধি হালকা নয়, গুরুতর রকমের ভারী; এতে যে বেশি ঢেউ খেলে না, এর অতলস্পর্শ গভীরতাই হল তার কারণ: এ জাত যে চট করে একটা ‘থিয়োরি’ কি ‘আইডিয়েল’ নিয়ে মেতে ওঠে না তার কারণ এদের স্থির ‘প্র্যাকটিক্যাল’ বুদ্ধি; ফরাসির মতো এদের সাম্য ও স্বাধীনতা এক দিনে কুড়িয়ে পাওয়া নয়, কারণ নজিরের পর নজির ধরে ক্রমশ এর আয়তন বৃদ্ধি হচ্ছে, সেইজন্য গতিটা একটু মন্থর। কিন্তু আমার সন্দেহ হয় যে, ‘জনবুলত্বের’ এত গুণব্যাখ্যান সত্ত্বেও কোনও ইংরেজ এটা স্বীকার করতে রাজি হবে কি না, তার নিজের বুদ্ধিটা আপাতদৃষ্টিতেও একটু মোটা, যতই গুরুত্ব এবং গভীরতা সে দৃষ্টিবিভ্রমের কারণ হোক না কেন। অর্থাৎ ‘জনবুলত্বের’ উপর জাতীয়-অভিমান অনায়াসে দাড় করানো যায়, কিন্তু কোনও ব্যক্তির পক্ষে ওটাকে নিয়ে অহংকার দেখানো একটু শক্ত। বোধহয় ঠিক এই কারণেই আমাদের জাতীয়-চরিত্রের দুর্বলতাগুলিকে লজ্জা দিয়ে বিদায় করবার জন্য প্রবন্ধে, গানে, বক্তৃতায় যে-সব চেষ্টা হয়েছে, তাতে তেমন আশানুরূপ ফল দেখা যায় নাই। কেননা লজ্জা জিনিসটা মানুষে পায় কোনও কারণে দল থেকে তফাত হয়ে পড়তে হলে। সুতরাং সবাই মিলে দল বেঁধে লজ্জা পাওয়াটা বড় একটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। বরং জাতীয়-জীবনের অবস্থা দেখে সবাই মিলে যে লজ্জা পাওয়ার চেষ্টা করছি এই ব্যাপারটিকেই একটা অহংকারের কারণ করে তোলা কিছুই কঠিন নয়।

 

‘আৰ্যামি’ যত রকমের আছে, বলা বাহুল্য, তার মধ্যে সেরা হচ্ছে জন্মগত ‘আৰ্যামি’। এর কারণও খুব স্পষ্ট। জন্মকে ভিত করে ‘আর্যামিীর অহংকার দাড় করানো যেমন সহজ, এর শ্ৰেষ্ঠত্বের স্পর্ধাটাও হয় তেমনি গগনস্পশী। জন্মের উপর যে জীবের গুণাগুণ নির্ভর করে তা ঘোড়ার বংশে যখন ঘোড়া আর গোরুর বংশে গোরুই জন্মাচ্ছে তখন অস্বীকার করবার জো নেই। আর ভেদটা কেবল পৃথক-জাতীয় ভেদ নয়, স্বজাতীয় ভেদও বটে। সে কথা নবীন লেখক হাউস্টন চেম্বারলেইন ও প্রাচীন ঋষি বশিষ্ঠ(১) দুজনেই তেজি ঘোড়ার উচু বংশের দৃষ্টান্তে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং জন্মের উপর শ্রেষ্ঠতার দাবিকে ভিত্তিহীন বলে সরাসরি অগ্রাহ্য করা চলে না, এবং এ দাবি উপস্থিত করতেও এক জন্মানো ছাড়া আর কিছুই অপরিহার্য নয়। কোনও বিশেষ বংশের সঙ্গে বিশেষ গুণের যোগাযোগ আছে কি না। সে তর্ক তোলা যায় বটে, কিন্তু এর মীমাংসার কোনও সম্ভাবনা না থাকাতে কারও কোনও ভয়ের কারণ নেই। বর্তমান বংশধরদের মধ্যে গুণটানা থাকলেই যে সে গুণ বংশে নেই এটা একেবারেই প্ৰমাণ হয় না। কেননা বর্তমানে হয়তো। ওটা ‘লেটেন্ট’ ভাবে রয়েছে, ভবিষ্যবংশীয়দের মধ্যে ঠিক ফুটে বেরোবে! ‘অ্যাটেভিজম’ যে একটা প্ৰত্যক্ষ ব্যাপার তার ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত তো ডারউইনের পুথিতেই রয়েছে! ‘জার্‌ম প্ল্যাস্‌ম্‌ জিনিসটি যে অমর, সে তথ্য বাইস-ম্যানই প্ৰমাণ করে গেছেন।

আর এই সহজ দাবিটির বহরই বা কী বিরাট। এ যে শ্রেষ্ঠত্ব, এ মিশে রয়েছে একেবারে রক্তের সঙ্গে, তৈজস-নাড়ির অণুতে অণুতে। যার সঙ্গে সে রক্তের সম্পর্ক নেই, সে সারা জীবন তপস্যাতেও এর কাছে ঘেঁষতে পারবে না। অথচ এই দুর্লভ মহত্ত্ব যাঁরা পেয়েছে তাঁরা পেয়েছে একবারে বিনা আয়াসে; মিতাক্ষরা বংশের ছেলের মতো কেবলমাত্র জন্মের জোরে ও জন্মের সঙ্গে। একে লাভ করতেও যেমন আয়াস নেই, বজায় রাখতেও তেমনি কষ্ট নেই। কেননা এ শ্ৰেষ্ঠত্বকে ঝেড়েও ফেলা যায় না, এর নষ্ট হবারও ভয় নেই। সহজ কথায় জন্মগত আৰ্যামিটি হচ্ছে দল বেঁধে প্রতিভা ও আরও কিছু উপরির দাবি। কেননা প্রতিভারও উত্তরাধিকার নেই।

এ-কথা বোধহয় আর না বললেও চলে যে, মিত্তির বংশের গৌরব ও নয়নজোড়ের বাবুয়ানা থেকে আরম্ভ করে কুলীনত্ব, ব্ৰাহ্মণত্ব, দ্বিজত্ব, শ্বেতচর্মত্ব এবং অবশেষে আৰ্যত্ব পর্যন্ত সবই হল জন্মগত আৰ্যামিরই প্রকারভেদ। এর প্রতিটিই একটা-না-একটা আস্ত দলের পক্ষে অসাধারণত্বের দাবি। অবশ্য কোনও দল ছোট, কোনওটি মাঝারি, কোনওটি অতি প্রকাণ্ড। কিন্তু সর্বত্রই দলের লোকদের পরস্পর সম্বন্ধ হচ্ছে সপিণ্ড সম্বন্ধ, হয় বস্তুগত্যা, নয় কল্পিত। তবে এ সপিণ্ডত্বের সাত পুরুষে নিবৃত্তি হয় না। দরকার হলে একে ব্ৰহ্মার মুখ পর্যন্ত, কি আদি আর্যভূমির আদিম আৰ্য-দম্পতি পর্যন্ত অনায়াসে টেনে নেওয়া চলে। এবং যাঁরা খবর রাখেন, তাঁরা বোধহয় এর একটাকে আর একটার চেয়ে বড় বেশি অপ্রামাণ্য বলতে সাহসী হবেন না।

 

জন্মগত আৰ্যামি এ পর্যন্ত যত রকমের দল ধরে প্রকাশ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দল হল আৰ্যত্বের দল। আৰ্যামি ও আর্যত্ব দুটি যে এক জিনিস নয়, দ্বিতীয়টি প্রথমটিরই প্রকারবিশেষ মাত্র, এতক্ষণের আলোচনায় এই কথাটি নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে; সুতরাং এর পুনরালোচনা নিম্প্রয়োজন। কিন্তু এই ‘আৰ্যামি’ বিশেষের দু-একটি বিশেষত্বের আলোচনা না করলেই নয়। কেননা আৰ্যামির এই বিরাট প্রকাশটিকে একবার ধারণা করতে পারলেই আৰ্যামির স্বরূপ বুঝতে আর কিছু বাকি থাকবে না।

এই আর্যামির ছোটখাটো দাবিটি কতকটা এইরকমের— পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির পর থেকে যতসব জাতির আবির্ভাব হয়েছে, আর্যজাতি যে তাদের মধ্যে কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ তা নয়, তার শ্রেষ্ঠত্ব একবারে অতুলনীয়। আৰ্যেন্তর কোনও জাতির সঙ্গে শরীরে কি মনে তার কোনও তুলনাই চলে না। আদিকাল থেকে একাল পর্যন্ত মানব-সভ্যতার যা কিছু সৃষ্টি তা সবই হয়েছে আৰ্যজাতির কোনও-না-কোনও শাখার হাত দিয়ে। অন্য সব জাতির সামান্য যা দান, তা সফল ও সার্থক হয়েছে, কেবল আৰ্য-মহারাজ তা গ্ৰহণ করে নিজস্ব করেছেন বলে। এ জাতির যা আচার, ব্যবহার, ধর্ম, সমাজ তাই হল সদাচার, সধর্ম, শিষ্ট সমাজ, আর এর বাইরে সবই অনাৰ্য’ ও ‘বারবারিকা’। সুতরাং পৃথিবীর আধিপত্যে আর্যজাতির যে দাবি সে খাঁটি ন্যায়ের দাবি। গ্রিক-আৰ্য আরিস্টটল বলেছেন যে হঠাৎ যদি পৃথিবীতে একদল লোকের আবির্ভাব হয়, যাঁরা কেবল শরীরের আয়তনে ও গড়নে দেবতাদের মতো আর সব মানুষের চেয়ে তফাত ও শ্রেষ্ঠ তবে সবাই নির্বিবাদে স্বীকার করবে যে, আর সমস্ত লোকের উপর তাদের আধিপত্যের ধর্ম ও ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে। এবং যদি কেবল সামান্য দেহের সম্বন্ধেই এ কথা ঠিক হয়, তবে মনে যাঁরা অসাধারণ সাধারণ লোকের উপর তাদের আধিপত্যের অধিকারটা কত বেশি! এই কথাটাই খুব অল্পের মধ্যে প্রকাশ করে তিনি বলেছেন যে, ‘এক জাতির লোক স্বভাবতই স্বাধীন, আর এক জাতির লোকের স্বভাবই দাসত্ব।’ এই হচ্ছে সার সত্য। কেননা স্বাধীনতা জিনিসটা মনুষ্যত্বের সামান্য ধর্ম নয় যে সব মানুষেরই তাতে কোনও অধিকার আছে; কারণ এ তো খুব স্পষ্ট যে, সে অধিকার নির্ভর করে স্বাধীনতার মূল্যোপলব্ধির ক্ষমতার উপর, যার ভিত্তি হল দেহের ও মনের শক্তি। এ কথা খুব নিৰ্ভয়েই বলা চলে যে, অনেক জাতির লোক রয়েছে স্বাধীনতার কল্পনাও যাদের অজ্ঞাত। সেইজন্য দাসত্ব কি প্ৰভুত্ব দুই অবস্থাই তাদের সমান। যতটুকু উন্নতি তাদের সম্ভব, অবস্থাভেদে তার কোনও প্রভেদ ঘটে না। ইহুদি, চিনা, সেমিটিক ও অর্ধসেমিটিক জাতিগুলি এর দৃষ্টান্ত।

উপরের বর্ণনায় আৰ্যজাতির আধিপত্য-দাবির অংশটা, অর্থাৎ এ ন্যায়ের প্রতিজ্ঞাটি, প্ৰসিদ্ধ লেখক হাউস্টন চেম্বারলেইনের ‘উনবিংশ শতাব্দীর ভিত্তি’ নামক অপূর্ব গ্রন্থ থেকে অনুবাদ করে দিয়েছি। চেম্বারলেইন জাতিতে ইংরেজ, শিক্ষায় জার্মান; এবং তাঁর পুথি রচনা করেছেন জার্মানভাষায়। যাঁরা চেম্বারলেইন-এর মতামতের খুব সদয় সমালোচক নন তাঁরাও স্বীকার করেছেন যে, তার হাতের কলম হল সোনার কাঠি। বস্তুত সে কলম যে সলীল ও স্বচ্ছন্দ গতিতে প্রাচীন ও আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার বিচিত্র ইতিহাসের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে, তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। তাঁর গ্রন্থের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠা থেকে যে রসজ্ঞতা ও সূক্ষ্ম-বিশ্লেষণ, শ্ৰদ্ধা ও ঘূণা, অনুরাগ ও বিদ্বেষের তীব্র আলো ঠিকরে পড়ছে তাতে অল্প-বিস্তর চোখ না। ঝলসে যায় না। কিন্তু আর্যজাতির পক্ষে এই যে সর্বাধিপত্যের দাবি, যা র্তার পুথিতে গোঁড়া থেকে শেষ পর্যন্ত, বারবার উপস্থিত করা হয়েছে, এর কদৰ্যতা ও ভীষণতা চেম্বারলেইন-এর কলমের কালিতেও একটুকুও ঢাকা পড়েনি।

কেননা এর পাণ্ডিত্যের পোশাক আর যুক্তির মুখোশ খুলে ফেললে যা বেরিয়ে পড়ে, সে হচ্ছে আদিম নগ্ন বর্বরতা, যা নিজের দলের বাইরে কাকেও শত্ৰু ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারে না। এবং হয় মৃত্যু নয় দাসত্ব এ ছাড়া সে শত্রুতার আর কোনও অবসানও কল্পনা করতে পারে না। হয়তো মানুষের ইতিহাসে এমন এক দিন ছিল যখন সমস্ত জাতি মানুষের দল, কি আর্য কি অনাৰ্য, এই মনোভাব নিয়েই প্ৰতিবেশী অন্য সব দলের সঙ্গে কারবার করত। এবং এও সম্ভব যে এই নির্মম বিরোধের উষ্ণ রক্তের স্পর্শেই মানুষের সভ্যতার প্রথম উন্মেষ ঘটেছে, তার সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যবহারে প্রাণ ও গতিসঞ্চার হয়েছে। কিন্তু মানুষের এই যে আদিম ভয় ও বিদ্বেষ, লোভ ও নিষ্ঠুরতা, এ হল প্রকৃতির অদম্য ও অন্ধ শক্তিরই রূপান্তর। এ তর্ক করে না, যুক্তি দেয় না, ন্যায়ের দোহাই পাড়ে না, সুন্দরবনের বাঘের মতো শিকার দেখলেই তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে। দামোদরের বন্যার ধবংসলীলার মতো ধর্মশাস্ত্রের প্রমাণে এরও কোনও বিচার চলে না। কিন্তু যখনই তর্ক করে, যুক্তি দিয়ে, ন্যায়-ধর্মের ইন্দ্ৰজাল সৃষ্টি করে জাতির উপর জাতির আধিপত্যকে, দলের সঙ্গে দলের শত্ৰুতাকে খাড়া রাখতে হয় তখনই বুঝতে হবে যে, সে জাতি প্রকৃতির গোড়ার ধাপ ছাড়িয়ে উঠেছে। কারণ সে জাতির কাছে নিঃসন্দেহ প্ৰমাণ হয়েছে যে জাতির সঙ্গে জাতির, দলের সঙ্গে দলের এক শত্রুতার সম্বন্ধ ছাড়া অন্য সম্বন্ধ সম্ভব, এবং সেই সম্বন্ধই নিত্য ও ঘনিষ্ঠ। এ ধাপে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ধর্মকেই ধর্মের বিচারে আশ্রয় করলে ধর্মও এখন তাকে বিচার করবে। প্রস্তাবনা ও প্রথম অঙ্ককে সমস্ত নাটকের ভিতর দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টানতে চেষ্টা করলে কাব্যের সৌন্দৰ্য তাতে কেবল আঘাতই পাবে।

মানুষের সভ্যতায় আর্যজাতির দান অনেক, হয়তো অপূর্ব ও অতুলনীয়। কিন্তু মানুষের উপর তার আর্যামির আঘাতও কম প্রচণ্ড নয়। আৰ্য-রোম অনাৰ্য-কার্থেজকে একবারে ধুলা না করে তৃপ্ত হয় নাই, অর্থাৎ অন্য একটা সভ্যতাকে একবারে ধ্বংস না করে নিজের সভ্যতাকে বজায় রাখবার কোনও পথ সে খুঁজে পায়নি। যে হিন্দু আৰ্য ওষধি ও বনস্পতিতে বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন উপলব্ধি করেছে, ‘দসু্য’ ও ‘রাক্ষসের প্রাণের উপর সেও কোনও মায়া দেখায়নি। আধুনিক ইউরোপীয় আৰ্য দুটি মহাদেশ থেকে সেখানকার অনাৰ্য অধিবাসীদের একেবারে মুছে ফেলেছে, এবং আর একটা মহাদেশ থেকেও মুছে ফেলবার চেষ্টায় আছে। এ চেষ্টার সমর্থনে যুক্তির অবশ্য অভাব নেই। এই উচ্ছেদ ও ধ্বংস না হলে যে আধুনিক আৰ্য-সভ্যতার যে গৌরব, তারও বিকাশই হতে পারত না। এই গরীয়সী সভ্যতাকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়াই হল ধর্ম। এবং যাদের রক্তের মধ্যে এই সভ্যতা রয়েছে তাদের সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া এর অন্য কোনও উপায় নেই। তাতে যদি অন্য সব জাতিকে পৃথিবী ছেড়ে গিয়েও এর জায়গা করে দিতে হয় মানবজাতির পক্ষে সেও মঙ্গল। লক্ষ্মণের কাছে অগস্ত্য-ঋষির পরিচয় দিতে রামচন্দ্র তীকে ‘পুণ্যকৰ্মা’ বলে উল্লেখ করেছেন, কেননা তার ত্ৰাসে দক্ষিণ দিকে ‘রাক্ষসেরা পা বাড়াতে সাহস না করায় সে দিকটা ‘লোকদের’ বাসের উপযুক্ত হয়েছে। এবং এ যুক্তির উত্তর দেওয়াও কঠিন। কেননা যা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে যা ঘটেনি। তাকে ওজনে তোলা চলে না। বর্তমান আৰ্য-সভ্যতা না গড়ে উঠলে আৰ্য অনাৰ্য মিশাল সভ্যতা কীরকমের হত, কি তেমন কোনও সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারত কি না। এ তর্ক এখন তোলা একবারেই নিস্ফল, কারণ এর কোনওরকম মীমাংসার সুদূর সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের উপর আধিপত্য ও উচ্ছেদের দাবিটাও যে কত অচল, মানুষের সভ্যতার গোটা ইতিহাসটাই তার প্রমাণ। এ দাবির গোড়ার কল্পনা হল এই যে, যে জাতি একবার বড় হয়ে উঠেছে সে চিরকালই বড় থাকবে, এবং আর কেউ বড় হয়ে উঠতে পারবে না। অথচ যেসব জাতির পর জাতি এতকাল ধরে মানুষের সভ্যতাকে কখনও ধীরে কখনও দ্রুত গড়ে তুলেছে তাদের কেউ কারও বংশধর নয়। আজই কি হঠাৎ মানুষের সভ্যতায় এই ধ্বংস ও সৃষ্টি লীলা থেমে গেল!! অথচ চিরকালই তো যে মাথায় উঠেছে সেই মনে করেছে সে একেবারে অচ্যুত। এবং পূর্ব পূর্ব শ্রেষ্ঠ জাতির পতন হলেও তার যে কেন সেটা ঘটবে না। তার কারণ খুঁজে বের করতে কারও কখনও কষ্ট হয়নি। প্রতিদিন জীব যম-মন্দিরে যাচ্ছে দেখেও অমরত্বের কল্পনা আশ্চর্য সন্দেহ নেই, কিন্তু আরও বেশি আশ্চর্য এই কল্পনা যে, যাঁরা বেঁচে আছে তাঁরা যে কেবল অমর হবে তা নয়, আর নতুন কারও জন্মও হবে না।

 

আৰ্যত্বের ‘আর্যামি’ এতক্ষণ যা বর্ণনা করেছি। সে হল তার একটা মাত্র দিক। কেননা ব্ৰহ্মের যেমন দুইরূপ, এ আর্যামিরও তেমনি দুই মূর্তি; সগুণ ও নিৰ্গুণ, ক্রিয়াশীল ও নিস্ক্রিয়। বলা বাহুল্য যে, বর্তমানে এর প্রথমটির বিকাশ হয়েছে ইউরোপের আর্য-সমাজে, দ্বিতীয়টির পূৰ্ণ-প্রকাশ আর্যভূমি ভারতবর্ষে। পশ্চিম শাখাটি দাবি করছে সর্বজ্ঞত্ব ও সৰ্বেশ্বরত্ব; তার ক্রিয়ার দাপটে আর সকলের হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া একরকম রুদ্ধ। আর পুবের শাখাটি ‘নিষ্কলং নিস্ক্রিয়ং শান্তং’, ‘অপ্ৰাণ’ ও ‘আমন’। সকলেই জানে যে সগুণত্বের সিঁড়ি দিয়েই নির্তৃণত্বে পৌছিতে হয়। ভারতীয় আর্যেরাও অবশ্য তাই করেছেন। ক্রিয়াশীলত্বের সিঁড়ি দিয়ে নিস্ক্রিয়ত্বের ছাদে এসে পৌছেছেন। এটা যে পরমার্থের অবস্থা তাতে সন্দেহ নেই, কেননা ‘একরূপে অবস্থিত যে অৰ্থ’ তাই হল পরমার্থ। যাঁরা এ অবস্থা থেকে ভারতের আৰ্য-সমাজকে আবার সচল অবস্থায় নিতে চান তাঁরা ইভলিউশনের’’ গতিবিধির কোনও খবরই রাখেন না।

যাহোক, আৰ্যামির এই সগুণ ও নিৰ্গুণ প্রকাশের মধ্যে একটি আন্তরিক মিল রয়েছে, কেননা এ দুই হলেও মূলে এক। সে মিলটি হচ্ছে যে, দুয়ের পথই বিবেকানন্দ যাকে বলেছেন ছুৎমাৰ্গ, বাইরের স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে নিজের শুচিত রক্ষা করা। তবে পশ্চিমের ওদের পথ হল আর সবাইকে তাড়ানো, আমাদের কৌশল হল সবার কাছ থেকে পালান। শেষ পর্যন্ত কোনটায় বেশি ফল হয় বলা কঠিন।

মানুষে মানুষে চরিত্র ও মনের শক্তির যে তফাত, জাতির সঙ্গে জাতির সে তফাতের চেষ্টার কোনও অর্থ আছে কি না, এবং থাকলে সেটা ঠিক কোথায় সে তর্ক না-হয় নাই তোলা গেল। মেনে নেওয়া যাক, এ তফাত আছে। কিন্তু প্ৰভেদমাত্রই উচু নিচুর সম্বন্ধ নয়, এবং বর্তমান পৰ্যন্ত কাজের পরিমাণও একটা জাতির শক্তিসামর্থ্যের শেষ প্রমাণ নয়। কেননা মানুষের ইতিহাস কিছু শেষ হয়ে যায়নি যে, এখনই লাইন টেনে হিসাব নিকাশ আরম্ভ করা যেতে পারে। আজ যাঁরা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ও প্রবল, তাঁরা ট্যাসিটাসের জার্মনেরই বংশধর। তখন দাড়ি টেনেছিলেন বলে ট্যাসিটাসের ঠিকে যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে এখন দাড়ি টেনে স্টুয়ার্ট চেম্বারলেইন-এর ঠিকই বা শুদ্ধ হবার সম্ভাবনা কোথায়! আর শ্রেষ্ঠত্ব, তার অর্থ যাই হোক, যদি প্রভুত্বের নিয়োগপত্র হয়, তবে তার শেষ কোথায়? আৰ্যত্ব এমনকী ইউরোপীয় আৰ্যত্বের সীমায় এসেই বা তার গতিরোধ হবে কেন? শ্রেষ্ঠের মধ্যেও শ্রেষ্ঠতমের দাবি কেনই বা না চলবে! কেননা, ‘আৰ্যামি’ ভেদেরই মন্ত্র, মৈত্রীর বন্ধন নয়। শোনা যাচ্ছে যে বর্তমান যুদ্ধ আরম্ভ হবার পরেই ফ্রান্সের নৃতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা প্রমাণ করেছেন যে, প্রশিয়ানরা মোটেই আৰ্য-জাতির লোক নয়, তাঁরা ইউরোপের প্রস্তর যুগের অধিবাসীদের একবারে অবিমিশ্র বংশধর। এবং সে যুগের যে-সব মাথার খুলি পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে বর্তমান কালের যে মাথার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক মিল, সে হচ্ছে প্ৰিন্স বিসমার্কের মাথা।

মানুষের সভ্যতা যাঁরা গড়ে তুলেছেন, তাঁরা সবাই অসাধারণ মানুষ। কিন্তু কোনও বিশেষ বংশ, কুল বা জাতি থেকে তাঁরা আসেননি। এবং নিজের বংশ, কুল বা জাতির সঙ্গে তাদের যে মিল তার চেয়ে অনেক বেশি মিল পরস্পরের সঙ্গে। শুদ্ধোদন যখন শাক্যকুলের সিদ্ধার্থের ভিক্ষুবেশ দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন তখন ভগবান বুদ্ধ তাকে বলেছিলেন যে, এই তাঁর কুলধৰ্ম; তাঁর বংশ রাজবংশ নয়, বুদ্ধেরা তার পূর্বপুরুষ। প্রকৃতির এই যে ইঙ্গিত, এই হল মানুষের মিলনের সত্য পথের ইঙ্গিত। বংশ, কুল, জাতি কিছুই অসত্য নয়, কিন্তু সে সত্য হল ব্যাবহারিক। এরা কাজ চালাবার উপায়, কিন্তু মৈত্রীর সম্বন্ধ কাজের সম্বন্ধ নয়। এই কাজ চালাবার দলকে ধরে মানুষের মধ্যে মৈত্রীস্থাপনের চেষ্টা পণ্ডশ্রম। কেমন দলের সঙ্গে দলের সম্বন্ধ সব সময়েই থাকবে কাজের সম্বন্ধ, সে ‘অ্যালায়েন্সই হোক, আঁতাতই হোক, আর লিগ অব নেশনই হোক। তাতে শান্তি আসতে পারে। কিন্তু মৈত্রী আসবে না। কেননা মৈত্রীর জন্য চাই মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, দলের সঙ্গে দলের আদান-প্ৰদান নয়। এবং সে কেবল তখনই সম্ভব, যখন বংশ, জাতি, রাষ্ট্রের প্রাচীর মানুষের চেয়েও উচু হয়ে উঠে দৃষ্টিকে বাধা না দেয়; যখন নামরূপের মায়া যা এক, তাকে বহু করে দেখানোর কাজ থেকে নিবৃত্ত হয়।

——————–
(১) ‘কুলোপদেশেন হয়োহপি পূজ্য
স্তস্মাৎ কুলীনাং স্ক্রিয়মুদ্বহন্তি ॥’ (বশিষ্ঠ-সংহিতা)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *