চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আলু পৌঁছিল
ছোট লাইনের রেলপথ ব্রিটিশ রাজ্যের সদর স্টেশন ছাড়িয়া প্রায় ত্রিশ মাইল পার্বত্য চড়াই ঘুরিতে ঘুরিতে উঠিয়া যেখানে শেষ হইয়াছে, সেইখান হইতে ঝিন্ রাজ্যের আরম্ভ। এই ছোট লাইনের ছোট ঘোট গাড়িগুলি পাহাড়ী পথে কখনো হাঁপাইতে হাঁপাইতে, কখনো বাঁশীর আর্তস্বরে চিৎকার করিতে করিতে বহির্জগতের যাত্ৰীগুলিকে ঝিন্দের তোরণদ্বার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া যায়। এই ত্রিশ মাইলের মধ্যে কেবল আর একটি স্টেশন আছে —সেটি ঝড়োয়া স্টেশন। ঝিঝড়োয়ার গিরিসঙ্কটে প্রবেশের উহা দ্বিতীয় দ্বার। এই দুই স্টেশনে নামিয়া যাত্রীদের হাঁটা পথ ধরিতে হয়। ঝিন্ঝড়োয়া রাজ্যের মধ্যে এখনো রেল প্রবেশ করে নাই।
উত্তুঙ্গ পাহাড়ের কোলের কাছে ছোট সুদৃশ্য ঝি স্টেশনটি নিতান্তই খেলাঘরের স্টেশন বলিয়া মনে হয়। কারণ এইখান হইতে অভ্রভেদী পর্বতের শ্রেণী শৃঙ্গের পর শৃঙ্গ তুলিয়া আকাশের একটা দিক একেবারে আড়াল করিয়া দিয়াছে। উহারই অভ্যন্তরে, মালার ভিতর নারিকেলের শস্যের ন্যায় ঝিন্ঝড়োয়া রাজ্য লুকাইয়া আছে। স্টেশনের সম্মুখ হইতে একটা অনতিপ্রশস্ত পথ পাহাড়ের উপর উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে। মাড়োয়ারীর পাগড়ির মত সরু পথ পর্বতের বিরাট মস্তক বেষ্টন করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া উর্ধ্বে উঠিয়াছে। সে পথে ঘোড়া কিম্বা মানুষ-টানা রিকশা চলিতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো প্রকার যানবাহনের চলাচল অসম্ভব।
স্টেশনের সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র টেলিগ্রাফ অফিস, সেখান হইতে টেলিগ্রাফ তারের একটা প্রান্ত পাহাড়ের ভিতর দিয়া ঝিন্দের দিকে গিয়াছে। স্টেশনের কাছে দুইটি দোকান, একটি সরাইখানা শহর বাজার কিছুই নাই। দিনে রাত্রে দুইবার ট্রেন আসে, সেই সময় যা-কিছু যাত্রীর ভিড়। অন্য সময় স্থানটি নিঝুমভাবে নিশ্চিন্ত মনে ঝিমাইতে থাকে।
দ্বিপ্রহরের কিছু পরে ঝিন্ স্টেশনের স্টেশনমাস্টার প্ল্যাটফর্মের উপর রৌদ্রে চারপাই বিছাইয়া নিদ্রাসুখ উপভোগ করিতেছিলেন, দূর হইতে ট্রেনের বাঁশীর শব্দে তাঁহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। তিনি তখন ধীরে-সুস্থে গাত্রোখান করিয়া কুলি ডাকিয়া সিগন্যাল ফেলিবার হুকুম দিলেন; আর একজন কুলিকে চারপাইখানা সরাইয়া ফেলিতে বলিলেন। তারপর চোখে চশমা ও মাথায় টুপি আঁটিয়া গম্ভীরভাবে কঙ্করাকীর্ণ প্ল্যাটফর্মের উপর পদচারণ করিতে লাগিলেন।
লোহালক্কড়ের ঝন ঝন ঝড় ঝড় শব্দে, ইঞ্জিনের পরিশ্রান্ত ফোঁস ফোঁস আওয়াজ এবং বাঁশীর গগনভেদী চিৎকারে শব্দজগতে বিষম হুলস্থূল বাধাইয়া ট্রেন আসিয়া পড়িল। গাড়ি থামিলেই গুটিকয়েক আরোহী মন্থরভাবে মোটঘাট লইয়া গাড়ি হইতে অবতরণ করিল। অধিকাংশই মোসাফির, তাহার মধ্যে দুএকজন ভদ্রলোকশ্রেণীভুক্ত–দেখিলে মনে হয় ঝিন্দে বেড়াইতে আসিয়াছে। সম্প্রতি রাজ-অভিষেক উপলক্ষে আবার একটা কিছু কাণ্ড ঘটিতে পারে, এই আশায় সংবাদপত্রের একজন রিপোটারও সংবাদ সংগ্রহ করিবার জন্য এই ট্রেনে আসিয়াছে।
স্টেশনমাস্টার মহাশয় অবিচলিত গাম্ভীর্যের সহিত যাত্রীদের টিকিট গ্রহণ করিলেন, তারপর প্ল্যাটফর্মের ফটক বন্ধ করিয়া নিজের ঘরে আসিয়া বসিলেন। স্টেশনমাস্টারের নাম স্বরূপদাস; লোকটির বয়স হইয়াছে; গত বিশ বৎসর তিনি এই ঝিন্দের সিংহদ্বারে প্রহরীর কাজ করিতেছেন। বাহিরের লোক যে কেবল তাঁহার কৃপায় ঝিন্দে প্রবেশ-লাভ করিতে পারে একথা সর্বদা তাঁহার মনে। জাগরূক থাকে। তাই নিজের পদমর্যাদা স্মরণ করিয়া আগন্তুক যাত্রীদের সম্মুখে তিনি অত্যন্ত গম্ভীর হইয়া থাকেন। স্পর্ধারত কোনো যাত্রী কখনো কিছু জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি সগর্ব বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া উত্তর না দিয়াই অবজ্ঞাভরে আবার নিজের কাজে মনঃসংযোগ করেন।
ঘরে বসিয়া স্বরূপদাস দৈনিক হিসাব প্রায় শেষ করিয়াছেন এমন সময় দ্বারের নিকট হইতে শব্দ আসিল—স্টেশনমাস্টার, এখনি আমার দুটো ভালো ঘোড়া চাই।
ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে ভীষণ ভ্রূকুটি করিয়া মুখ তুলিতেই স্টেশনমাস্টার একেবারে কাঠ হইয়া গেলেন। দেখিলেন দ্বারের উপর দাঁড়াইয়া—সদার ধনঞ্জয় ক্ষেত্রী। প্রকাণ্ড পাগড়ি তাঁহার সুকৃষ্ণ মুখের উপর ছায়া ফেলিয়াছে বটে, কিন্তু কানের রুবি দুইটা খরগোসের চোখের মত জ্বলিতেছে। স্বরূপদাস দাঁড়াইয়া উঠিয়া ফৌজী প্রথায় সেলাম করিল। মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না।
ধনঞ্জয় ঈষৎ রুক্ষস্বরে বলিলেন–শুনতে পাচ্ছ? এখনি দুটো ভাল ঘোড়া আমার চাই। ঝিন্দে যেতে হবে।
যো হুকুম! বলিয়া আর একবার সেলাম করিয়া প্রায় দৌড়িতে দৌড়িতে স্বরূপদাস বাহির হইয়া গেল।
মিনিট দশেক পরে ফিরিয়া আসিয়া সে খবর দিল যে, সৌভাগ্যবশত দুইটা ঘোড়া পাওয়া গিয়াছে— জিন্ চড়াইয়া মোসাফিরখানার ফটকের কাছে প্রস্তুত রাখা হইয়াছে, এখন সর্দার মর্জি করিলেই হয়।
সর্দার একখানা দশটাকার নোট তাহার সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া বলিলেন–গোলমাল করো না। তোমার ঘরে গিয়ে দোর বন্ধ কর। উঁকি মেরো না বুঝলে? যাও।
নোটখানা কুড়াইয়া লইয়া স্বরূপদাস সবিনয়ে নিজের ঘরে ঢুকিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। সর্দার ধনঞ্জয় এখন একবার প্ল্যাটফর্মের চারিদিকে তাকাইয়া দেখিলেন— কেহ কোথাও নাই। কুলি দুইটা চলিয়া গিয়াছে পরদিন সকালের আগে ট্রেন ছাড়িবে না, কাজেই তাহাদের ছুটি। আগত ট্রেনের গার্ড, ড্রাইভার, ফায়ারম্যানেরা বোধ করি ক্লান্তি বিনোদনের জন্য সরাইখানায় ঢুকিয়াছে। পরিত্যক্ত গাড়িখানা নিষ্প্রাণভাবে লাইনের উপর পড়িয়া আছে। সর্দার ধনঞ্জয় একখানা প্রথম শ্রেণীর গাড়ির সম্মুখে গিয়া ডাকিলেন—বেরিয়ে আসুন রাস্তা সাফ।
একজন সাহেববেশধারী লোক গাড়ি হইতে নামিলেন। মাথায় ফেল্টের টুপি মুখের উধ্বাংশ প্রায় ঢাকিয়া দিয়াছে, ওভারকোটের উল্টানো কলারের আড়ালে মুখের অধোভোগ ঢাকা। এই দুয়ের মধ্য হইতে কেবল নাকের ডগাটুকু জাগিয়া আছে।
দুইজনে নীরবে স্টেশনের ফটক পর্যন্ত গেলেন। তারপর ধনঞ্জয় বলিলেন–একটু দাঁড়ান–আমি আসছি!
ফিরিয়া স্টেশনমাস্টারের ঘর পর্যন্ত আসিয়া ধনঞ্জয় দ্বার ঠেলিয়া দেখিলেন বন্ধ। জিজ্ঞাসা করলেন—মাস্টার ঘরে আছ?
ভিতর হইতে শব্দ হইল— হুজুর!
উঁকি মারোনি তো?
জী নহি।
আবার হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, যদি কিছু বুঝে থাকো কারুর কাছে উচ্চারণ করো না। উচ্চারণ করলে গদানা নিয়ে মুস্কিলে পড়বে। বুঝেছ?
ভীতকণ্ঠে জবাব আসিল–হুজুর।
মৃদু হাসিয়া ধনঞ্জয় ফিরিয়া গেলেন। সরাইখানার সম্মুখে দুইজনে দুই ঘোড়ায় চড়িয়া পার্বত্য পথ ধরিয়া উঠিতে আরম্ভ করিলেন। কিছুক্ষণ নীরবে চলিবার পর ধনঞ্জয় সঙ্গীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন—এতদূর পর্যন্ত তো নিরাপদে আসা গেছে মাঝে আঠারো মাইল বাকী—আজ রাত্রে যদি আপনাকে রাজমহলের মধ্যে পুরতে পারি— তারপরে ব্যস। স্টেশনমাস্টারকে খুব ধমক দিয়েছি সে যদি বা কিছু সন্দেহ করে থাকে– ভয়ে প্রকাশ করবে না।
ধনঞ্জয় যদি সঞ্জয়ের মত দূরদর্শী হইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন, তাঁহারা পর্বতের আড়ালে অন্তর্হিত হইলে পর স্টেশনমাস্টার আস্তে আস্তে ঘর হইতে বাহির হইল। তারপর সাবধানে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সহসা দৌড়িতে আরম্ভ করিল। টেলিগ্রাফ অফিসে পৌঁছিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল–বৃজলাল, জলদি, জলদি, একটা ফর্ম দাও তো। জরুরী তার পাঠাতে হবে।
বৃজলাল একহাতে কল নাড়িতে নাড়িতে অন্য হাতে একটা ফর্ম দিল। মাস্টার কিছুক্ষণ ভাবিয়া তাহাতে লিখিল–
আলু পৌঁছিয়াছে, সঙ্গে একটি অন্য মাল আছে চেনা গেল না। ঘোড়ার পিঠে ঝিল্ রওনা হইল।
এই লিখিয়া নিজের নাম সহি করিয়া টেলিগ্রামটি রাজধানীর এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পুরুষোত্তমদাসের নামে পাঠাইয়া দিল।
তারপর নিজের গুদানার কথা ভাবিতে ভাবিতে ঘরে ফিরিয়া আসিল।