আলফা ইসুরেন্স কোম্পানির হেড অফিস মতিঝিলে।
তাদের অফিস ছোট কিন্তু ব্যবসা ভালো। জাহাজের মালামাল ইন্সুরেন্স করাই এই কোম্পানির ব্যবসা। এই ধরনের ব্যবসায় বিশাল অফিস লাগে না। একটা টেলিপ্রিন্টার, আন্তর্জাতিক টেলিফোন লাইন, উপরের মহলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগই যথেষ্ট। অল্পকিছু কাজ জানা লোকই যথেষ্ট। কোম্পানির মালিক জোবায়েদ সাহেব। অবাঙালি। ১৯৫০ সনে বিহার থেকে মোহাজের হয়ে বাবামার সঙ্গে ঢাকা এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ বছর। সেই সময় তাঁদের পরিবারের সম্বল ছিল মায়ের আঠারো ভরি সোনার গয়না। মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে সেই বিত্ত ফুলে ফেঁপে একাকার হয়েছে। জোবায়েদ সাহেব আলফা ইসুরেন্সের একটা শাখা অফিস খুলেছেন করাচিতে। খুব সম্প্রতি লন্ডনেও একটা অফিস নেয়া হয়েছে। অফিস চালু হবার আগেই ঝামেলা লেগে গেল। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য রাখছেন। এমনিতেই তার মাথা ঠাণ্ডা। এখন তা আরো অনেক ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
অফিসের কাজকর্ম নেই বললেই হয়। টেলিপ্রিন্টারে খাট খাট বেশ কিছুদিন হল শোনা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক লাইন সব সময় ব্যস্ত। লাইন চাইলেই পাওয়া যায় না। গতকাল সারাদিন অপেক্ষা করে করাচীর লাইন পেলেন। তাও কথাবার্তা পরিষ্কার না। করাচী অফিসের নবী বখশ বলল, বাঙালি কুত্তাগুলোর খবর কি? কুত্তাগুলোর ল্যাজ সোজা হয়েছে?
জোবায়েদ সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে ব্যবসার কথা তুললেন। জানা গেল ব্যবসা মোটামুটি। খুব খারাপ না, আবার ভালোও না। নবী বখশ আবার বাঙালি প্রসঙ্গ তুলল, ইংরেজিতে যা বলল তার বঙ্গানুবাদ হচ্ছে— সব বাঙালি পুরুষগুলোর বিচি অপারেশন করে ফেলে দেয়া দরকার। বিচি ফেলে দিলেই এরা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বিচি গরম হওয়ায় এরকম করছে। গরম দেশে গরম বিচি ভালো না।
জোবায়েদ সাহেব চিন্তিত বোধ করছেন। পশ্চিমাদের মনোভাব এই হলে ঝামেলা মিটবে না। তারা বাঙালিদের যতটা তুচ্ছ করছে তত তুচ্ছ করার কিছুই নেই। বরং এরা জাতি হিসেবে ভয়ংকর। ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এই বাঙালিগুলোই শুরু করেছিল। যাদের রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না তারা যে পালিয়ে বাঁচল তা গান্ধিজীর জন্যে না। চরকা কাটা, দেশি লবণ খাওয়া এগুলো ফালতু ব্যাপার। ব্রিটিশ সিংহ চরকা ভয় পায় না। ব্রিটিশ সিংহ ভয় পেয়েছিল–ক্ষুদিরাম মার্কা ছেলেগুলোকে।
বাঙালিগুলো মহাঅলস, একটু ভালো-মন্দ খেতে পারলে মহাখুশি, গল্প করার সুযোগ পেলে খুশি, রাজনীতি নিয়ে দুএকটা কথা বলতে পারলে আনন্দে আত্মহারা, নিজের বউ নিয়ে বেড়াতে যাবার সময় আড়চোখে অন্যের স্ত্রীকে একটু দেখতে পারলে মহা আনন্দিত। তবে এদের রক্তের মধ্যে কিছু একটা আছে। বড় কোন গণ্ডগোল আছে। মাঝে মাঝে এরা ক্ষেপে যায়। কিছু বুঝতে চায় না, শুনতে চায় না। সাহস বলে এক বস্তু যে এদের চরিত্রে নেই সেই জিনিস কোথেকে চলে আসে।
জোবায়েদ বুঝতে পারছে সামনের দিন পাকিস্তানিদের জন্যে ভালো না। শুধু ভালো না বললে কম বলা হবে, সামনের দিনগুলো ভয়ংকর। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কেউ তা ধরতে পারছে না। এরা এখন মোটামুটি সুপ্ত। দেশ দখলে নিয়ে এসেছে। থানা পর্যায়ে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। চলে এসেছে মিলিশিয়া, রেঞ্জার পুলিশ। ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কমান্ডো গ্রুপের সুশিক্ষিত সৈন্য। আরো আসছে। জাহাজ আসছে।
সিগন্যাল কোরের কর্নেল এলাহীর সঙ্গে জোবায়েদ সাহেবের সুসম্পর্ক। কর্নেল এলাহীর এক শালাকে তিনি লন্ডন ব্রাঞ্চের অফিসের দায়িত্ব দিয়েছেন। এলাহী সাহেব মাঝে মাঝে জোবায়েদ সাহেবের অফিসে কফি খেতে আসেন। গল্প-গুজব করে বিদেয় হন। ব্যাপারটা জোবায়েদের পছন্দ না, কারণ শহরের মুক্তিবাহিনী নামক গেরিলারা তৎপর হচ্ছে। কর্নেল এলাহী এখানে আগমন তাদের চোখে পড়তে পারে। অফিসে বোমা মেরে দেয়া বিচিত্র কিছু না। অবশ্যি জোবায়েদ সাহেব জানেন- গেরিলা তৎপরতা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনার এখনো কোন কারণ ঘটে নি। অল্পবয়েসী কিছু ছেলে-পুলে এই কাজটা করছে। গেরিলা জীবনের রোমান্টিক অংশটাই তাদের আকৃষ্ট করছে। তবে এটাকে হেলাফেলা করাও ঠিক না। যুদ্ধে অতি তুচ্ছ ব্যাপারও অবেহলা করতে নেই। ঘোড়ার নালের জন্যে পেরেক ছিল না বলে রাজত্ব চলে গেল। গল্পের রূপক অংশটি অগ্রাহ্য করা ঠিক না।
জোবায়েদ সাহেব ঠিক নটার সময় অফিসে আসেন। তাঁর ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন। এক ঘণ্টা পর পর কফি খান। এক কাপ কফি, একটা সিগারেট। বেলা একটার মধ্যে পাঁচটা সিগারেট এবং পাঁচ কাপ কফি খাওয়া হয়। একটা বাজার পাঁচ মিনিট পর তিনি অফিস থেকে বের হন। বাড়ি চলে যান। বাকি সময়টা বাড়িতেই থাকেন। বাড়ি থেকে বের হন না। গত দুমাস ধরে এই তাঁর রুটিন। এক মাস আগে পরিবারের সবাইকে করাচি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার ধারণা এক সময় হঠাৎ করে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার চাপ সৃষ্টি হবে। বিমানের টিকিট পাওয়া যাবে না। তাঁর ধারণা সচরাচর ভুল হয় না। তিনি নিজে যাবার কথা ভাবতে পারছেন না। কারণ তাঁর সম্পদ চারদিকে ছড়ানো। সিলেটে চা বাগানে ত্ৰিশ পার্সেন্ট শেয়ার কেনা আছে। দিলখুশা এলাকায় কিনেছেন পাঁচ বিঘা জমি। এই জমি সোনার খনির মতো। বিশ বিঘা জমি নারায়ণগঞ্জে কেনা আছে। একটা ফ্যাক্টরি দেবার কথা ভাবছিলেন। দুটি বাড়িও ঢাকা শহরে তাঁর আছে। সেই তুলনায় করাচিতে কিছুই নেই। তিনি অতি বিচক্ষণ লোক হয়েও এই বড় ভুলটি করেছেন। সম্পদ এই অংশে তৈরি করে যাচ্ছেন।
দেশ যদি সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে কি হবে? ইন্ডিয়া দখল করে নেবে? সেই সম্ভাবনা কতটুকু? এখনো বুঝতে পারছেন না। ইন্ডিয়া কি এত বড় ভুল করবে? মনে হয় না। এই দেশের মানুষগুলোর ইন্ডিয়া প্রসঙ্গে কোন মোহ নেই। যারা ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের উপর দেশের মানুষ খানিকটা বিরক্ত বলেই মনে হয়।
বড় সাহেবের দরজার পর্দা ফাঁক করে মোবারক ঢুকল। হাসিমুখে বলল, কর্নেল সাব আয়া।
জোবায়েদ সাহেব বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির কারণ দুটি। এক, কর্নেল সাহেবের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চাচ্ছেন না। দুই, মোবারক এখন আর বাংলা বলছে না। মোবারক অবাঙালি কিন্তু কথা বলত বাংলায়। নিখুঁত ঢাকাইয়া বাংলায়। কিছুদিন হল সে আর বাংলা বলছে না। দাঁত বের করে যখন-তখন হাসছে। মনে হচ্ছে পুরো দেশটা সে তার চকচকে গোলাপি শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে বসে আছে। এখন নিশ্চিন্ত মনে জর্দা দিয়ে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা যায়।
জোবায়েদ সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদের কফি দাও।
মোবারক পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলল, কফি তুরন্ত আ যায়ে গি।
কর্নেল এলাহী শুধু খালি হাতে আসেন নি। একটা চকলেটের টিন নিয়ে এসেছেন। বিদেশি চকলেট, বেশ দামি জিনিস। তিনি কখনো খালি হাতে আসেন না। এর আগের বার এসেছিলেন আন্তর নিয়ে। তাদের ভেতর কথাবার্তা ইংরেজিতে হল।
এলাহী ঃ তোমার মুখ এমন গম্ভীর কেন? ব্যবসার হাল কি ভালো না?
জোবায়েদ ঃ না। ব্যবসা মন্দা।
এলাহী ঃ খুব সাময়িক ব্যাপার। কয়েকটা দিন যাক, দেখবে ব্যবসা হু হু করে বাড়বে।
জোবায়েদ ঃ কয়েকটা দিন মানে কত দিন?
এলাহী ঃ এই ধর তিন মাস।
জোবায়েদ ঃ তিন মাসে সব ঠিক হয়ে যাবে?
এলাহী ঃ ঠিক তো এখনই হয়ে গেছে। থানায় থানায় আমাদের লোক আছে। এখন হচ্ছে কম্বিং অপারেশন। প্রতিটি মানুষকে এক এক করে দেখা হচ্ছে।
জোবায়েদ ঃ কম্বিং অপারেশনের পর কি হবে?
এলাহী ঃ কি হবে তা কর্তা ব্যক্তিরা ঠিক করবেন। আমি অতি ক্ষুদ্র মৎস্য। তবে আমার যা অনুমান ওদের শায়েস্তা করার পর একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাওয়া হবে। এক ধরনের আই ওয়াশ আর কি। হা-হা-হা। তখন ওদের যা বলা হবে তাতেই তারা রাজি হবে। দুদু খাবে?— বললে ওরা বলবে, খাব। তোমাক খাবে?- বললেও ওরা বলবে, খাব।
জোবায়েদ ঃ তোমাদের অবস্থা তাহলে ভালো।
এলাহী ঃ ভালো মানে? একসেলেন্ট! Can no be better.
জোবায়েদ ঃ শুনছি। তোমরা মেয়েদের উপর অত্যাচার করছ- এটা কি ঠিক?
এলাহী ঃ কোথেকে শুনিছ? ইন্ডিয়া বেতার?
জোবায়েদ ঃ হ্যাঁ, বিবিসিও বলছে।
এলাহী ঃ তুমি কি আজকাল প্রপাগাণ্ডা। নিউজ শোনা ধরেছ? সবচে বড় ক্ষতি করছে এই সব প্রপাগাণ্ডা। নিউজ।
জোবায়েদ ঃ তাহলে তোমরা মেয়েদের উপর কোন অত্যাচার করছ না?
এলাহী ঃ কিছু কিছু হয়ত হচ্ছে। ওয়ার ফেয়ারে এগুলো হয়। আমরা তো হাড়ুড়ু খেলছি না। যুদ্ধ করছি। এরা আমাদের শত্রুপক্ষ। এই দেশের মেয়েরা তো আমার শ্যালিকা নয়। শ্যালিকাদের সঙ্গেও যেখানে ফষ্টি-নষ্টি করার সুযোগ আছে সেখানে এদের সঙ্গে কেন করা হবে না। তুমি আমাকে বল।
কফি চলে এসেছে। কর্নেল এলাহী কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির ভঙ্গি করল। জোবায়েদ সিগারেট ধরাল। এই সিগারেটটা বাড়তি। আজ একটার ভেতর ছয়টা সিগারেট খাওয়া হয়ে যাবে। কফিও এক কাপ বেশি খাওয়া হবে। জোবায়েদের বিরক্তি-ভাব বাড়ছে। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, কর্নেল এলাহী!
বলে ফেল।
তুমি নিজে কি কোন বাঙালি মেয়েকে রেপ করেছ? ঠিকঠাক জবাব দাও। তোমার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আগুন হাতে নিয়ে মিথ্যা বলাটা ঠিক হবে না।
মিথ্যা বলতে চাচ্ছি। এই ধারণা তোমার হল কেন? মিথ্যা বলার তো তেমন প্রয়োজন দেখছি না। মেয়েদের সঙ্গ পেয়েছি। এবং পাচ্ছি। তবে আমি বাড়ি থেকে মেয়ে ধরে এনে রোপ করি না। উপহার হিসেবে আমার কাছে পাঠানো হচ্ছে।
কারা পাঠাচ্ছে?
এই দেশের মানুষই পাঠাচ্ছে। হা-হা-হা। হিন্দু মেয়েদের সম্পর্কে আমার খানিকটা আগ্রহ ছিল। কামাসূত্রার দেশের কন্যা, না-জানি কি। মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এরা হচ্ছে মোস্ট অর্ডিনারী। আরেক কাপ কফি দিতে বল। তোমার এখানে দেখি অসাধারণ কফি তৈরি হয়।
জোবায়েদ আরেক দফা কফি দিতে বল। আজ সাত কাপ কফি খাওয়া হবে। সাত কাপ কপি, সাতটা সিগারেট। খুব খারাপ একটা দিনের শুরু হচ্ছে। খুব খারাপ দিন। কর্নেল এলাহী কতক্ষণ এখানে থাকবে বোঝা যাচ্ছে না। মানুষটাকে এই মুহূর্তে অসহ্য বোধ হচ্ছে।
কর্নেল এলাহী!
ইয়েস মাই ফ্রেন্ড।
তুমি কফি খেয়েই বিদেয় হবে। আমার অতি জরুরি কিছু কাজ আছে। তুমি না গেলে তা করতে পারছি না।
অফকোর্স বিদেয় হব। রাতে কি তুমি ফ্রি আছ?
কেন বল তো?
অফিসার্স মেসে ছোট্ট একটা পার্টি হবে। খুব এক্সকুসিভ।
পার্টিতে যেতে বলছ? হ্যাঁ। তোমার মন মরা ভাব কাটানো দরকার। পার্টিতে সেই চেষ্টা সাধ্যমতো করা হবে। সন্ধ্যায় বাসায় থাকবে। আমি নিজে এসে নিয়ে যাব। চমৎকার কফি।
অনিল বড় সাহেবের জন্যে অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছে। কর্নেল সাহেব বসে আছেন বলে যেতে পারছে না। কয়েকটি কারণে বড় সাহেবের সঙ্গে তার দেখা প্রয়োজন। হাতে টাকা-পয়সা নেই। কিছু যদি পাওয়া যায়। তাছাড়া বড় সাহেবকে সে পছন্দ করে। নিজেও জানে না। চাকরির ইন্টারভ্যু দিতে এসে সে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। প্রায় কুড়ি জনের মধ্যে তার বিদ্যাই সবচে কম।
ইন্টারভ্যু বোর্ডে জোবায়েদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সঙ্গে কি কোন প্ৰশংসাপত্ৰ আছে?
অনিল প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, একটা আছে কিন্তু আমি স্যার দিতে চাচ্ছি না।
কোন দিতে চাচ্ছেন না?
প্ৰশংসাপত্রটা আমার বাবার দেয়া। আমি কারো কাছ থেকে প্ৰশংসাপত্ৰ জোগাড় করতে পারি নি, কাজেই বাবাই একটা লিখে দিলেন।
কি করেন আপনার বাবা?
স্কুল শিক্ষক।
প্ৰশংসাপত্রটা দেখি।
অনিল খুবই অস্বস্তির সঙ্গে হাতে লেখা কাগজটা এগিয়ে দিল। তার ধারণা ছিল, প্ৰশংসাপত্রটা পড়ে তিনি হেসে ফেলবেন এবং বোর্ডের অন্য মেম্বারদের দেখাবেন। কারণ প্ৰশংসাপত্রে লেখা–
যাহার জন্যে প্ৰযোজ্য
একজন পিতাই তাহার পুত্রকে সঠিক চিনিতে পারেন। মা ভাল চিনিতে পারেন না, কারণ সন্তান নয় মাস গৰ্ভে ধারণ করিবার কারণে মায়ের চিন্তা ভালবাসায় আচ্ছান্ন হইয়া থাকে। ইহাই স্বাভাবিক। একজন পিতা সেই ক্ৰটি হইতে মুক্ত। আমি অনিল বাগচীর পিতা। সে যোগ্যতায় বলিতেছি- আমার পুত্রের ভেতর সততার মতো বড় একটি গুণ পূর্ণ মাত্রায় আছে। সে তেমন মেধাবী নহে। তাহার মেধা সাধারণ মানের। ঈশ্বর মানুষকে পরিপূরক গুণাবলি দিয়ে পাঠান। সেই কারণেই আমার পুত্রের মেধার অভাব পূরণ করিয়াছে তাহার সততা। অন্য কোন গুণ আমি আমার পুত্রের ভিতর লক্ষ্য করি নাই। যাহা লক্ষ্য করিয়াছি তাহাই বলিলাম।
বড় সাহেব প্ৰশংসাপত্ৰ ফিরিয়ে শুকনো গলায় বললেন, আচ্ছা। আপনি যেতে পারেন।
অনিল বাড়ি চলে এল। দশদিনের মাথায় রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি দিয়ে তাকে জানানো হল যে চাকরি দেয়া হয়েছে। তার পোস্টিং হবে লন্ডন ব্ৰাঞ্চে। তবে কাজ শেখার জন্যে তাকে এক বছর ঢাকা অফিসে থাকতে হবে।
অনিল মুখ শুকনো করে বলল, লন্ডনে আমি গিয়ে থাকব কি করে? অসম্ভব। আমি এই চাকরি করব না। মরে গেলেও না।
এই সংসারে না বলে সহজে পার পাওয়া যাবে যায় না। সুরেশ বাগচী স্কুল থেকে রিটায়ার করেছেন। সংসার অচল। অনিলকে ঢাকায় আসতে হল।
মোবারক এসে অনিলকে বলল, কর্নেল সাহেব চলা গিয়া।
অনিল উঠল। বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিনের আলো থাকতে থাকতে টাঙ্গাইল পৌঁছানো দরকার। রাস্তাঘাট কেমন কিছুই জানে না।
জোবায়েদ সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। অনিল বলল, স্যার আসব?
আস।
স্যার, আমি একটু দেশে যাব। ছুটি চাচ্ছি।
দেশে যাবার মতো রাস্তাঘাট কি এখন নিরাপদ?
নিরাপদ না হলেও যেতে হবে। আমার বাবাকে স্যার মিলিটারীরা মেরে ফেলেছে। বোনটা আছে। অন্য এক বাড়িতে।
বস।
অনিল বসল। জোবায়েদ সাহেব নিয়ম ভঙ্গ করে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমি শুনেছি। রাস্তাঘাট এখন মোটেই নিরাপদ না। আমি শুনেছি বাস থেকে যাত্রীদের নামানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যাদের কথাবার্তায় এরা সন্তুষ্ট হয় না তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
আমিও শুনেছি স্যার।
এই অবস্থায় রিস্ক নেয়া কি ঠিক? বেঁচে থাকাটা জরুরি। ইচ্ছে করে রিস্ক নেয়া বোকামি।
অনিল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন স্যার? ঢাকায় বসে থাকতেন?
বড় সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, না। আমি রওনা হয়ে যেতাম।
আমি তাহলে স্যার উঠি?
আগামীকাল গেলে কি তোমার চলে? তুমি যদি আগামীকাল যাও তাহলে মিলিটারীর কাছ থেকে আমি একটা পাশ জোগাড় করে দিতে পারি। কর্নেল এলাহী আমার বিশেষ বন্ধু।
মিলিটারীর কাছ থেকে কোন পাশ নেব না স্যার।
ঠিক আছে। তাহলে দেরি কর না, রওনা হয়ে যাও। মে গড বি উইথ ইউ। এক প্যাকেট চকলেট আমার কাছে আছে, এটা নিয়ে যাও।
অনিল হাত বাড়িয়ে চকলেটের টিন নিল।
তোমার নিশ্চয়ই কিছু টাকা পয়সা দরকার। ক্যাশিয়ারকে বলে দিচ্ছি, এক হাজার টাকা নিয়ে যাও। যদি আমরা দুজন বেঁচে থাকি আবার দেখা হবে।
যাই স্যার।
অনিল দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়াল। জোবায়েদ সাহেব বললেন, কিছু বলবে?
অনিল না সূচক মাথা নাড়ল। জোবায়েদ সাহেব লক্ষ্য করলেন ছেলেটি নিঃশব্দে কাঁদছে। কাঁদুক। কিছুক্ষণ কাঁদুক। তিনি আনিলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। সান্ত্বনার কিছু বলা দরকার। একটি বাক্যও মনে আসছে না। তিনি আরেকটি সিগারেট ধরালেন। আজ সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। তিনি একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। মাথা ধরেছে। প্ৰচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
মোবারক।
ইয়েস স্যার।
কফি।
কফি কামিং স্যার।
ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না।