আরবি, রোমান, বাংলা!
দীর্ঘ পরাধীনতার পর নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রটি কীভাবে গড়ে তোলা যায়, রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর কীভাবে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব, সে ব্যাপারে শিক্ষিত সমাজ আত্মনিয়োগ না করে, একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত ভাষাকে কীভাবে বিকৃত ও তছনছ করা যায়, তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন একশ্রেণির উচ্চশিক্ষিত কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। যে সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নিরক্ষর, যাদের দুই বেলা দু-মুঠো অন্নের সংস্থান করাই কঠিন, সেই সমাজে একটি নিতান্ত অনাবশ্যক ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। তারা নিজেরা ছিলেন বিভ্রান্ত মানুষ, জনগণকেও বিভ্রান্ত করতে থাকেন।
যে ভাষার কবি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান, সে ভাষাভাষীর কোনো রকম হীনম্মন্যতা থাকার কথা নয়। সে ভাষার ভাব প্রকাশের ক্ষমতা অপার এবং তা যে লিপিতেই লেখা হোক, তা বৈজ্ঞানিক। বাংলার আগে যেসব ভাষার কবি-সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, সেগুলো হলো ফরাসি, জার্মান, নরওয়েজিয়ান, স্প্যানিশ, পোলিশ, ইতালিয়ান, ইংরেজি, সুইডিশ ও ডাচ। এসব ভাষার কাতারে স্থান পায় বাংলা। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও যে ভাষায় একজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র ও নজরুল ইসলাম আছেন, সে ভাষার মানুষের তো অহংকারের সীমা থাকার কথা নয়। সে ভাষার সংস্কার করা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই।
আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তন অথবা রোমান অক্ষরে বাংলা লেখার চিন্তা কারও মাথায় আসাটাই স্রেফ দুর্বুদ্ধি। ব্যক্তিবিশেষের দুর্বুদ্ধি হলেও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যখন প্রস্তাবের পেছনে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থাকে বা বিশেষ মতলব কাজ করে, তখন তা অতি নিন্দনীয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই নিন্দনীয় কাজটিই করেছেন একশ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিক এবং তাঁদের তাঁবেদার লেখক ও শিক্ষাবিদ।
পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হলেও তার একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক সত্তা ছিল-পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চল বা কেন্দ্র থেকে তা হাজার মাইল দূরে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান বা সীমান্ত প্রদেশ পাশাপাশি ও অবিচ্ছেদ্য। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশও মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান ছিল এমন এক স্বতন্ত্র ভূখণ্ড, যার অধিবাসীদের ৯৯ ভাগ বাংলা ভাষায় কথা বলে। যে বাংলা ভাষার রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। বাংলা সাহিত্য পৃথিবীর উন্নত সাহিত্যগুলোর একটি। বাংলা ভাষা বাঙালির গর্বের ধন। সে ভাষা নিয়ে ছেলেখেলা চলে না।
আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে একদিকে ছিল ধর্মীয় আবেগ (বরং বলা ভালো অর্থহীন ভাবাবেগ), অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতির খোঁড়া যুক্তি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৫ মাসের মধ্যে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচিতে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪৮। সম্মেলন উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। তিনি একজন বাঙালি। তিনি পাকিস্তানের শিক্ষাকে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন এবং বাংলা। ভাষায় আরবি হরফ প্রচলনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন, তার দ্বারা আঞ্চলিক ভাষাগুলির সংরক্ষণের কাজ সাধিত হবে। তা ছাড়া আরবি বর্ণমালা পাকিস্তানের। বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষাগত সামঞ্জস্য বিধানেও সহায়তা করবে।
[বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৬৯, পৃ. ২৪৬]
শুধু একেবারে কথার কথানয়,মিশনারি উদ্দীপনানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীশিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামীকরণ এবং বাংলা ভাষাকে আরবীকরণে অব্যাহত চেষ্টা চালাতে থাকেন। এবং তাঁকে সমর্থন করার মতো শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক বাংলার মাটিতে যথেষ্টই ছিলেন। দুই মাস পরে, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯, যখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন চলছে, তখন পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান শিক্ষা-উপদেষ্টা বোর্ডের দ্বিতীয় অধিবেশন। সেখানেও ফজলুর রহমান জাতীয় সংহতির যুক্তিতে আরবি হরফের পক্ষে ওকালতি করেন। দৈনিক আজাদে তাঁর ভাষণের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তাতে তিনি বলেন, সহজে এবং দ্রুত যে হরফের মারফত ভাষা পড়া যায় সেই ভাষাই সবচাইতে ভালো। তিনি বলেন, কোন হরফটা ভালো তা। ঠিক করার পূর্বে একবার বিভিন্ন প্রদেশের হরফের বিচার প্রয়োজন। সিন্ধুর ভাষা হচ্ছে সিন্ধি, কিন্তু তার হরফ আরবি। পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষা উর্দু হলেও তার হরফ “নাস্তালিক”। সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ভাষা পশতু হলেও হরফ বহুলাংশে আরবি। তার মতে,বাংলায় বহু সংযুক্ত অক্ষর এবং এর স্বরবর্ণের নানা চিহ্ন থাকায়। তা টাইপরাইটিং বা শর্টহ্যান্ডে ব্যবহার করা যায় না। আরবি হরফই সহজ। দ্রুত লিখন ও পঠনের পক্ষে সুবিধাজনক বলে আরবিকেই পাকিস্তানি ভাষার (বাংলাসহ) হরফ করা উচিত। আরবি হরফ প্রবর্তিত হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নিরক্ষরতা দূর করার পথ সহজ হবে।
আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে অকাট্য যুক্তিদানকারী মন্ত্রী মহোদয়কে যদি ওই সম্মেলনের কোনো শ্রোতা অনুরোধ করতেন যে আপনার বক্তৃতাটি আপনি আরবি অক্ষরে আমাদের লিখে দেন, তাহলে তিনি তা পারতেন কি? যা হোক, শুধু বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপও নেন। ১৯৫০ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় পূর্ব বাংলার কয়েকটি জেলায় ১০টি কেন্দ্র খুলে সেখানে আরবি হরফে লেখা বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। সরকারি সূত্র জানায়, প্রত্যেক শিক্ষাকেন্দ্রে। ২৫ থেকে ৩৫ জন ছাত্র ৬ মাসের জন্য শিক্ষাগ্রহণ করতে আরম্ভ করেন। এই পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৯ সালে ৩৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করে এবং ১৯৫০-এ তা বাড়িয়ে করা হয় ৬৭ হাজার ৭৬৪ টাকা। নতুন রাষ্ট্রে যেখানে অতি জরুরি ব্যাপারে অর্থের ছিল অভাব, সেখানে আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য এই অর্থের অপচয় ছিল অপরাধের শামিল। শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি হরফে বাংলা ভাষার বইও ছাপা হয়েছিল। আরবি হরফে বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল।
[দ্রষ্টব্য : পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, পৃ. ২৫৭-৫৮]
আরবি প্রচলনের এই জোরজবরদস্তিমূলক চেষ্টার প্রতিবাদ করেছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “উর্দু হরফের সাহায্যে বাংলা শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে অর্থ অপব্যয়ের কী মানে থাকতে পারে? আশ্চর্যের কথা,এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গ সরকারের কোনো সম্পর্ক নাই। এই অর্বাচীন ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এক লক্ষ টাকা ব্যয় করবেন। আমার আশঙ্কা হয় এটা বন্ধ না করা হলে সরকারি টাকার অপব্যয় করা হবে।
[ একই সূত্র, পৃ. ২৫৭-৫৮]
সরকারকে সমর্থন দেওয়ার মতো মানুষও ছিলেন পূর্ব বাংলায় অনেক। ১৯৪৯ সালের ২ এপ্রিল, চট্টগ্রামে ‘কেন্দ্রীয় সাহিত্য পরিষদ বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের বিষয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। আবুল ফজলের সভাপতিত্বে সেই অনুষ্ঠানে আজাদ সম্পাদক মুজিবর রহমান খাঁ বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক বিরাট ভৌগোলিক ব্যবধান রহিয়াছে, … আমাদের পরস্পরের নিকটতম হওয়ার জন্য প্রয়োজন ঐক্য, মিলন, সংহতি এবং তমদ্দুনিক যোগাযোগ। ইহার জন্যই আরবী বর্ণমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
[আজাদ, ৮ এপ্রিল ১৯৪৯]
নৈতিক বল থাকলে সরকারি চাকরি করেও স্বাধীন মতামত দেওয়া সম্ভব। সেই বিভ্রান্তির সময় সরকারি কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান The Language Problem of Today শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ভাষাতত্ত্ব তার বিষয় নয়, তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি তাঁর ওই পুস্তিকায়, যা প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ১৯৪৯-এ, বলেছিলেন, আরবি ও রোমান অক্ষরের চেয়ে বাংলা শ্রেষ্ঠ।
ফেরদাউস খানের এই মতামত সরকারি নেতা ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের দৃষ্টিতে পড়ে। সরকারের বাইরের আরবিপন্থীদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার মধ্যে একজন বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আবুল কাসেম। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং শিক্ষাসচিব এফ এ করিম ফেরদাউস খানের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর ভাষায়,’জনাব এফ এ করিম তার দফতরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি কিছুটা রুষ্ট স্বরে বললেন, “আপনি দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করছেন। পাকিস্তান সরকার বাঙলা ভাষার জন্য আরবি হরফ চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন আর আপনার পুস্তকটি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল ব্যবহার করছে।” আমি জবাব দিলাম, হরফ সমস্যার উপর যে তাত্ত্বিক গবেষণা আমি চালিয়েছিলাম বইটিতে তা-ই লিপিবদ্ধ করেছি। কোনো রকম রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তাতে নেই। আমাকে বিদায় দেওয়ার আগে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী, যিনি বাঙলাভাষী তিনি নিজেও আরবী হরফ গ্রহণের সুপারিশ করে যাচ্ছেন। আপনার সাবধান থাকা উচিত। আমার ভয় হচ্ছিল, কারণ তিনি আমার জবাবদিহি দাবি করবেন। তিনি তেমন কিছুই করলেন না বরং Farsight ছদ্মনামে The Script Question শীর্ষক একটি পুস্তিকা রচনা করে আমার যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করলেন।
[মোহাম্মদ ফেরদাউস খান, জীবনের ঘাটে ঘাটে, ২০০১, পৃ. ৮৬-৮৭]
এর কিছুদিন পর ১৭ অক্টোবর ১৯৪৯, শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান চট্টগ্রাম সফরের সময় সার্কিট হাউসে ফেরদাউস খানকে দেখা করতে বলেন। তিনি লিখেছেন, আমি বুঝেছিলাম তিনি কী বলতে চান। আলাপের শুরুতেই তিনি বললেন, “হরফ সম্পর্কিত আপনার লেখাটা আমি পড়েছি, তবে আমি আপনার সাথে একমত নই।” আরবী হরফের পক্ষে তিনি তার যুক্তি পেশ করলেন, আমি আমার মন্তব্য তুলে ধরলাম, রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত আমাদের আলোচনা চলছিল তবে কোনো সময়ই তিনি উম্মা প্রকাশ করেননি। বিদায়ের সময় আমাকে বললেন, “দেখা যাচ্ছে এ বিষয়ে আমরা একমত হতে পারছি না, তবে আপনাকে একটা। অনুরোধ জানাব কীভাবে আরবী হরফ বাঙলার জন্য গ্রহণ করা যায়, সে সম্পর্কে আমাকে লিখে জানাবেন।” আমি জবাব দিয়েছিলাম তা জানাব,তবে শর্ত থাকবে যে এই ব্যাপারে আমার নাম যেন জড়ানো না হয়। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাকে লিখে জানিয়ে দিলাম আর সেটি পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েকটি শিক্ষা কমিটিতে সদস্য করে নিয়েছিলেন।
[একই সূত্র, পৃ. ৮৭]
নৈতিক মনোবল ও সৎ-সাহস থাকলে কাউকে খুব বেশি সাহসী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সেদিন প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদেরা যে সাহসের অথবা দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে পারেননি, একজন তরুণ প্রভাষক তা দিয়েছেন। সেদিন যদি আরবিপন্থীদের প্রতিহত করা না যেত, তাহলে আজ আমাকে এই রচনাটাও লিখতে হতো আরবি হরফে অথবা উর্দুতে।
আরবি হরফপন্থীরা কখনো আশা ছেড়ে দেননি। এমনকি বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের পরেও তাঁদের অপতৎপরতা অব্যাহত থাকে। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে আসেন মালিক ফিরোজ খান নূন। তিনি ছিলেন পাঞ্জাবের অধিবাসী এবং মানুষ হিসেবেও অপেক্ষাকৃত সজ্জন ছিলেন, তবে বাঙালি জাতি সম্পর্কে তাঁর বিশেষ ধারণা ছিল না। তাঁর পত্নী ভিকারুন নিসা নূন বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। ফিরোজ খান নূনও আশা পোষণ করতেন যে আরবি অক্ষরে বাংলা লিখলে ভালোই হয়। কিন্তু বাংলায় গভর্নর থাকা অবস্থায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়বেন এই ভয়ে বিশেষ কিছু বলেননি। বরং পরিস্থিতি আঁচ করে ঢাকায় বলেন, একটি জাতির উপর কোনো ভাষাই চাপাইয়া দেওয়া যায় না।… জোর করিয়া আরবী হরফ প্রবর্তন ভ্রমাত্মক হইবে।’
[ সংবাদ, ১৩ চৈত্র ১৩৫৯]
তাঁর স্বদেশে ফিরে গিয়েই তিনি সুর পাল্টান। লাহোরে গিয়ে তিনি যা বলেন, তা ছিল আর এক চাল। বাঙালীরা যদি আরবী হরফে বাংলা লিখিতে রাজী থাকেন, তাহা হইলে বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইলেও তাহার আপত্তি থাকিবে না।
[আজাদ, ১৬ চৈত্র ১৩৫৯]
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষার শতকরা ৯০টি শব্দই ফারসি, উর্দু ও আরবি, এমনকি পাঞ্জাবি ভাষা হতে উদ্ভূত।’
তার এই প্রবল পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল বাঙালি পণ্ডিতদের থেকে। তা কেউ না করলেও বাংলা ভাষার একজন তরুণ শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রতিবাদ করেন তাঁর এক নিবন্ধে। তিনি বলেন, আমরা জনাব নূন ও তার পেটোয়াদের চ্যালেঞ্জ করছি যে, কোনো মুসলমান ও বিদ্বান বাংলা লেখকের রচনা থেকে অন্তত দশ ভাগ আরবী, ফারসী শব্দ বার করে দিতে। [সাপ্তাহিক যুগের দাবী, ১১ এপ্রিল ১৯৫৩]। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রভাষক। তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘নূন সাহেবের এই অপচেষ্টার সহায়ক হচ্ছে কতকগুলি বিশ্বাসঘাতক ও এঁটো পাতাভোজী মীরজাফর ও মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধর্মান্ধ অথচ কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে একাত্তরে পাকিস্তানি আলবদর বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করতে হয়।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর জন্য দুঃখ লাগে