০৪. আমার সালাম নিও

বাবা,

তুমি আমার সালাম নিও। দাদাজান আমাকে দিয়ে জোর করে চিঠি লেখাচ্ছেন। তোমার কাছে নাকি ঐ চিঠি হাতে হাতে পৌঁছানো হবে।

আমরা সুখানপুকুর ঠিকমত পোঁছেছি। পথে কোন অসুবিধা হয়নি। শুধু ঠাকরোকোনা স্টেশনে পায়ে গোবর লেগে গিয়েছিল। তার কি যে কড়া গন্ধ! এখনও যাচ্ছে না। আমি এ বাড়ির বুয়াকে গরম পানি করতে বলেছি। গরম পানিতে আজ সারাদিন পা ড়িবিয়ে রাখব।

এদিকে আমাদের খুব একটা খারাপ খবর আছে। ভয়ংকর খারাপ। দাদাজান বলছেন দশদিন থাকতে হবে। দশদিনের আগে তিনি আমাদের ছাড়বেন না। আপা হাল ছেড়ে দিয়েছে, আমি এখনও হাল ছাড়িনি। আমি খুব চেষ্টা করছি দাদাজানকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দুই-তিন দিন থেকে চলে আসতে। দাদাজান হয়ত বুঝতে চাইবেন না। কিছু কিছু মানুষ আছে–অন্যের সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে পারে না।

তবে জায়গাটা খুব সুন্দর। অবশ্য দশদিন ধরে দেখার মত সুন্দর না।

যদি দশদিন থাকতে হয় তাহলে আমি খুব বিপদে পড়ব। কারণ আমি মাত্র দুদিন পড়ার জন্য গল্পের বই নিয়ে এসেছি।

বাবা শোন, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমার যে বন্ধু আছে–মনীষা–তাকে টেলিফোন করে হ্যাপি বার্থডে দিতে হবে। তার জন্মদিন ১৭ তারিখ। তার টেলিফোন নাম্বার ৮১ ৩২ ১১।

চিঠি লেখার কাগজ শেষ হয়ে গেছে–চিঠি এখানেই শেষ করলাম। এবার তাহলে ৬০ + ২০

ইতি

নীতু

পুনশ্চ : বাবা, তোমার বাবাকে আমার মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। খুব বেশি পছন্দ হয়নি।

 

নীতু এক গামলা গরম পানিতে তার পা ডুবিয়ে রেখেছে। গোবরের গন্ধ দূর করার একটা চেষ্টা। তার হাতে গল্পের বই। সে খুব ধীরে ধীরে পড়ছে। তাড়াতাড়ি পড়লেই বই শেষ হয়ে যাবে। মস্তবড় ভুল হয়েছে–অনেকগুলি বই নিয়ে আসা উচিত ছিল।

শাহানা বোনের কাণ্ড দেখল। তাকে মনে মনে স্বীকার করতেই হল নীতু খুব গোছানো মেয়ে। এর মধ্যেই গরম পানি গামলা সব জোগাড়যন্ত্র করে ফেলেছে। বেশ শান্ত শান্ত ভঙ্গি করে গল্পের বই নিয়ে বসেছে। যেন সে এ বাড়ির একজন কর্ত্রী। শাহানা বলল, ঘুরতে যাবি না-কি রে?

নীতু নাসূচক মাথা নাড়ল। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাল না। শাহানা বলল, চল হেঁটে আসি–তুই তোর পায়ে আরও খানিকটা গোবর মাখার সুযোগ পেয়ে যাবি। স্টেশনের গোবরের মত বাসি গোবর না, টাটকা গোবর। এর মজাই অন্য রকম।

আপা, বিরক্ত করবে না। প্লীজ।

গ্রাম দেখে আসি চল্‌।

গ্রাম আমার দেখতে ভাল লাগে না। গ্রামের গল্প বই-এ পড়তে ভাল লাগে, দেখতে ভাল লাগে না।

বেশিক্ষণ পা পানিতে ড়িবিয়ে রাখবি না। সমস্যা হবে।

কি সমস্যা হবে?

মাছের মত তোর পায়ে আঁশ বেরিয়ে যেতে পারে। শেষে দেখা যাবে মৎস্যকন্যা হয়ে গেছিস।

তুমি সব সময় ঠাট্টা কর আপা। মাঝে মাঝে ঠাট্টা ভাল লাগে না…

তুই যাবি না তাহলে?

না।

শাহানা একাই বের হল। কেউ তাকে লক্ষ্য করল না।

শাহানার সবচে বড় ভয় ছিল কাদার ভয়। দেখা গেল ভয় অমূলক। কাদা তেমন নেই। হাঁটার জন্যে কাদাবিহীন শুকনো জায়গা যথেষ্ট আছে। সাবধানে হাঁটলেই হয়। অস্বস্তির ব্যাপার একটাই–মাঝে মাঝে শাড়ি খানিকটা টেনে তুলতে হচ্ছে।

হাঁটতে শাহানার অসম্ভব ভাল লাগছে–ছায়াঢাকা পথ কথাটা বই-টইয়ে পাওয়া যায়–এই প্রথম সে ছায়াঢাকা পথ দেখলকড় বড় ছাতিম গাছ সারা পথ জুড়ে এমনভাবে ছড়ানো যেন মাথার উপুর ছাতা ধরার জন্যেই এরা আছে। পথের একদিকে বেতবন। শাহানা চিনতে পারল বেত ফল দেখে থোকায় থোকায় ফলে আছে। কিছু বেতফল কি সে ছিঁড়ে নিয়ে নেবে? নীতু দেখলে মজা পেত।

পথে হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম সম্পর্কে শাহানার ধারণা কিছু কিছু পাল্টাচ্ছে। যেমন ঘুঘুপাখির ডাক। শাহানার ধারণা ছিল, ঘুঘুপাখি শুধু ভরদুপুরেই ডাকে। এখন দেখা যাচ্ছে তা না, এরা সারাক্ষণ ডাকে। পাখিরা মোটেই শান্ত এবং চুপচাপ ধরনের না–এরা বেশ ঝগড়াটে এবং সারাক্ষণ কিচির-মিচির করতে ভালবাসে।

শাহানা লক্ষ্য করল, বিভিন্ন বাড়ি থেকে মেয়েরা উঁকি-ঝুঁকি মেরে তাকে দেখছে। সে কোন পুরুষমানুষ না, মেয়েরা তাকে এমন আড়াল থেকে দেখছে কেন কে জানে। শাহানা তাকালেই এরা আবার দ্রুত সরে যাচ্ছে। পুরুষমানুষ তেমন চোখে পড়ছে না। সবাই বোধহয় কাজে চলে গেছে। শ্রাবণ মাসে হাওড় অঞ্চলের পুরুষদের তেমন কাজ থাকার কথা না–এরা গেছে কোথায়? ছোট ছোট ছেলেমেয়ে প্রচুর চোখে পড়ছে। এরা কেমন ভয়ে ভয়ে শাহানাকে দেখছে। তাকে এরা ভয় পাচ্ছে। কেন? একটা ঐ দশ বছরের মেয়ে ভয় জয় করে শাহানার পেছনে পেছনে আসতে শুরু করেছিল। পেছন থেকে তার মা তাকে ডেকে থামিয়ে দিল।

পথটা এখন তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। শাহানা দাঁড়িয়ে আছে। তিনপথের কোনটায় সে যাবে বুঝতে পারছে না। যদিও তিনটা পথই তার কাছে এক রকম। একটায় গেলেই হয়। সে নিরিবিলি কিছুক্ষণ হাঁটতে চায়–কাজেই এমন পথ তাকে বাছতে হবে যেখানে লোকজন কম চলাফেরা করে। সেটা বের করা তেমন কঠিন কিছু না, পথের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কোন পথে লোক চলাচল কম।

হারিয়ে যাবার ভয় নিশ্চয়ই নেই। এত ছোট জায়গায় কেউ হারায় না। আর যদি সে হারিয়ে যায় তাহলেও সমস্যা নেই। বললেই হবে–রাজবাড়িতে যাব। তাদের বাড়িটা হল রাজবাড়ি। সেই অর্থে রাজবাড়ির মেয়ে হয়ে সে হল রাজকন্যা। দি প্রিন্সেস।

রাজকন্যা একা একা হাঁটছে–প্রজারা সব দূর থেকে আগ্রহী ও কৌতূহলী হয়ে দেখছে। মজার ব্যাপার তো। তার বেশভূষা ঠিক রাজকন্যার মত না। শাড়ি আরও জমকালো হলে ভাল হত। সাদামাটা সুতির শাড়ি। গায়ে কোন গয়না নেই। রাজকন্যার থাকবে গা ভর্তি গয়না। জড়োয়া গয়না। আলো পড়ে পাথর চিকমিক করতে থাকবে।

শাহানা ভুল পথ বেছেছে। কিছুদূর গিয়েই পথ শেষ হয়ে গেল। ঘন জঙ্গল শুরু হল। জঙ্গলের ভেতর ঢোকার কোন প্রশ্ন ওঠে না।(শ্রাবণ মাসের জঙ্গল–মাটিতে হাঁটু-উঁচু ঘাস জমে আছে–নিশ্চয়ই সাপখোপ কিলবিল করছে। বাঁ পাশে উঁচু ঢিবির মত আছে। তার বাঁধের ওপাশে হাওড়। শাহানা কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ফিরে যাবে, না বাঁধের ছোট পাহাড়টায় উঠবে?

আচ্ছা, এই সমতল ভূমিতে হঠাৎ এরকম উঁচু একটা জায়গার মানে কি? ডেবে যাওয়া পুরোনো কোন মঠ-টঠ না তো? আর্কিওলজী বিভাগ কি জানে এই জায়গা সম্পর্কে? ঢিবির উপর উঠে দেখার মত কিছু কি আছে? না থাকারই কথা। তবু উঁচু জায়গা দেখলেই মানুষের উঠতে ইচ্ছে করে। শুধুমাত্র এই কারণেই শাহানা উঠা ঠিক করল। হিল পায়ে বাধে উঠা যাবে না। খালি পা হতে হবে। তার নীতুর মত শুচিবায়ু নেই, তবু পা থেকে জুতা খুলতে মন সায় দিচ্ছে না।

হঠাৎ পেছন থেকে তীক্ষ্ণ গলায় কে ডেকে উঠল–আপনে কে গো? আপনে কে?

হিল পায়েই শাহানা অনেকখানি উঠে পড়েছিল। সেইখানেই সে থামল। পেছন ফিরল। শ্যামলামত হালকা-পাতলা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। তার চোখে গভীর কৌতূহল। মেয়েটার হাতে বাঁশের খলুই। আশ্চর্য মিষ্টি চেহারা তো মেয়েটির! মেয়েটা আগের মতই তীক্ষ্ণ গলায় বলল–নামেন কইলাম। নামেন। তাড়াতাড়ি নামেন।

কেন?

সাপে ভর্তি। এইটার নাম–মা মনসার ভিটা। এক্ষণ নামেন।

তোমার নাম কি?

নাম পরে শুনবেন। আগে নামেন। প্রতি বছর এই জায়গায় সাপের কামড়ে গরুবাছুর মরে।

আমি তো গরুবাছুর না।

মানুষও মরে। গত বাইস্যা মাসে মরছে একজন।

এতদূর ওঠে সাপের ভয়ে নেমে যাওয়া ঠিক না–আরো খানিকটা উঠা যাক। ঝাঁঝালো রোদে সাপ বের হয় না। তাদের চোখ আলো সহ্য করতে পারে না। শাহানা তর তর করে উপরে উঠে গেল। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে তাকে দেখছে। ঢিবিটায় শেষ পর্যন্ত না উঠলে মেয়েটার হতভম্ব মূর্তি দেখা যেত না। বড় রকমের একটা মজা থেকে সে বঞ্চিত হত। শাহানা নেমে আসছে। নামাটা কঠিন মনে হচ্ছে হিল খুলতেও সাহস হচ্ছে না। সাপের কথা বলে মেয়েটা ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

হিল না খুলেই শাহানা নামল। শাহানা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটা বলল, আপনে কে?

সহজ সপ্রতিভ ভঙ্গি। গ্রামের মেয়েরা এমন আগবাড়িয়ে কথা কি বলে? বোধহয় না। দরজার আড়াল থেকে উঁকি-ঝুঁকি দিতেই তারা পছন্দ করে।

আমার নাম শাহানা। আমি ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বড় নানী। তুমি কে?

আমি কেউ না।

কেউ না মানে কি? তোমার তো একটা নাম আছে। না-কি নামও নেই?

আমার নাম কুসুম।

খলুইতে কি?

গোবর। গোবর টুকাইতে বাইর হইছি। এর মধ্যে আপনেরে দেখলাম। আফনের বেজায় সাহস–মনসার ভিটাতে কেউ উঠে না।

শীতের সময়ও উঠে না? তখন তো সাপ থাকে না।

জ্বি না, শীতের সময়ও না।

এই জায়গাটা এমন উঁচু কেন জান?

আল্লাহ তাকে উঁচা কইরা বানাইছে, এই জন্যে উঁচা।

শাহানা হেসে ফেলল। কুসুমও হাসছে। শাহানা বলল–গোবর দিয়ে কি করবে? সার বানাবে?

খড়ি করব।

এই বিশ্রি জিনিশটা হাতে মাখতে খারাপ লাগে না?

জ্বে না। খারাপ লাগবে ক্যান?

শাহানা হাসিমুখে বলল, আমার একটা ছোট বোন আছে–ওর নাম নীতু। নীতুর পায়ে গোবর লেগেছিল। সে পুরো একটা সাবান পায়ে ঘষে শেষ করেছে। এখন গরম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে।

কুসুম বলল, আফনেরা রাজবাড়ির মেয়ে, আফনেরার কথা আলাদা।

আমরা বুঝি রাজবাড়ির মেয়ে?

জ্বি।

রাজা থাকলে তবেই না রাজবাড়ি হয়। রাজা কোথায়?

রাজবাড়ি যার থাকে হেই রাজা।

মেয়েটা শুধু যে সপ্রতিভ তাই না–লজিক নিয়ে খেলতেও পছন্দ করছে। বেশ তো। শাহানা বলল, তোমাদের বাড়ি কোষ্টা? কুসুম উৎসাহের সঙ্গে কাল–ঐ যে দেখা যায়। যাইবেন আমরার বাড়িত?

হ্যাঁ যাব।

আফনেরে বুবু বললে আফনে কি রাগ হইবেন?

না, রাগ হব না।

কুসুম উজ্জ্বল চোখে তাকাল। খুশি খুশি গলায় বলল, বুবু আসেন।

শাহানার যাওয়া হল না। সে অবাক হয়ে দেখল, তার দাদাজান প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন। এভাবে আসতে তাঁর যে কষ্ট হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে। তাঁর ফর্সা মুখ লাল টকটক করছে। তিনি খুব ঘামছেন।

ইরতাজুদ্দিনের পেছনে পেছনে দুজন কামলাও আছে। একজনের হাতে ছাত ধরা। তারাও পাচ্ছে। ইরতাজুদ্দিন থমথমে গলায় বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড! তুই কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে এলি একা একা? আর কখনো যেন এরকম না হয়। কখনো না।

তিনি পথের উপরই বসে পড়েছেন। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন। শাহানার মনে হল, এই মানুষটার হার্টের কোন সমস্যা আছে। নয়ত ওভাবে পথের উপর বসে এত শব্দ করে শ্বাস নিতেন না। হার্ট বিশুদ্ধ রক্ত ঠিকমত সমস্ত শরীরে পৌঁছে দিতে পারছে না।

কুসুম পুখ থেকে নেমে পড়েছে। ভীত ভঙ্গিতে ইরতাজুদ্দিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরতাজুদ্দিন কড়া চোখে কুসুমের দিকে তাকালেন। কুসুম আরও সংকুচিত হয়ে পড়ল। তিনি নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। শাহানার দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন–আর কখনো এরকম করবি না। আয় আমার হাত ধর। চল যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *