আমাদের সংসারে কী–একটা পরিবর্তন এসেছে। সুর কেটে গেছে কোথাও। শীলু আমার সমস্ত চেতনা এমনভাবে আচ্ছান্ন করে রেখেছে যে, আমি ঠিক কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। মা ভীষণরকম নীরব হয়ে পড়েছেন। শঙ্কিতভাবে চলাফেরা করছেন। তাঁর হতাশ ভাবভঙ্গি, নিচু সুরে টেনে–টেনে কথা বলা সমস্তই বলে দেয় কিছু একটা হয়েছে। বাবা এসে প্রায়ই আমার ঘরে বসেন। নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় দু— একটি কথাবার্তা বলেন : কেমন পড়াশোনা চলছে? বাজারের জিনিসপত্রের যা দাম!
আমি তাঁর ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারি, তিনি কিছু একটা বলতে চান। এলোমেলো কথা বলতে-বলতে এটি সেটি নাড়তে থাকেন, তারপর হঠাৎ করে উঠে চলে যান। কী বলতে চান তা বুঝে উঠতে পারি না। বাবাকে আমরা বড়ো ভয় পাই, নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না। মাকে যখন জিজ্ঞেস করি, কি হয়েছে মা? মা অবাক হবার ভান করে বলেন, হবে। আবার কি রে খোকা?
মা মিথ্যা বলতে পারেন না, কিছু লুকোতে পারেন না। আমি জোর দিয়ে বলি, বল, কী হয়েছে?
মা মেঝের দিকে তাকিয়ে টানা সুরে কাঁপা গলায় বললেন, কোথায় কি হায়েছে?
অথচ প্রায়ই দেখছি বাবা আর মা ফিসফিস করে আলাপ করছেন। বিরক্তিতে বাবার ভ্রূ কুঁচকে উঠছে ঘন ঘন। অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে বসে থাকছেন। পরশু রাতে মা গুনগুন করে কাঁদছিলেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, কে যেন ইনিয়েবিনিয়ে গান গাইছে। রাবেয়া বলল, ও খোকা, ও ঘরে মা কাঁদছে রে।
রুনু বলল, সত্যি দাদা, মা কাঁদছে। আমি ভেবেছি–বুঝি বেড়াল।
রাবেয়া গলা উঁচু করে ডাকল, মা, ও মা, কাঁদছ কেন?
মা চুপ করে গেলেন। রাবেয়া আবার ডাকল, মা, ও মা!
মা ধারা— গলায় বললেন, কি?
তুমি কাঁদছিলে কেন?
আমি সমস্ত কিছু বুঝতে চাই। আমি সবাইকে ভালোবাসি। যে-সংসার বাবা গড়ে তুলেছেন, সেখানে আমার যা ভূমিকা, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি করতে চাই। যদি কোনো জটিলতা এসেই থাকে, তবে সে-জটিলতা থেকে আমি দূরে থাকতে চাই না। আমি চাই সবাই সুখী হোক। রুনুশীলুর মতো একটি ময়না এনে পুষুক, যেটি সময়ে-অসময়ে মানুষের মতো সুখের শিস দিয়ে উঠবে।
দুপুরবেলা ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ রাবেয়া আমায় ডেকে তুলল। উত্তেজনায় তার চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে।
ও খোকা, শুনছ, আমার বিয়ে।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তোকালাম? রাবেয়া খিলখিল করে হেসে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না? আল্লার কসম, সত্যি বিয়ে, আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
কখন বিয়ে?
আজ বিকেলে। এখন আমি গোসল করে সাজব! তুমি আবার সবাইকে বলে বেড়িও না খোকা, আমার বুঝি লজ্জা নেই?
মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বললেন, বরপক্ষের ওরা বিকেলে দেখতে আসবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পাগল মেয়েকে বিয়ে করবে কে?
মা বললেন, পাগল কোথায় রে, ঐ একটু যা আছে তা সেরে যাবে।
বরপক্ষের লোকজন জানে?
মা ভীত কণ্ঠে বললেন, আমি ঠিক বলতে পারি না তোর আরা বলেছে কি না। তুই আপত্তি করিস না খোকা।
কিন্তু হঠাৎ বিয়ের কী হল?
আমি জানি না। তোর আর। শাল ঠিক করেছেন। তোর আরাকে জিজ্ঞেস কর।
দেখতে আসবে পাঁচটায়, চারটার ভিতরেই সব তৈরি হয়ে গেল। মা ঘামতে ঘামতে খাবার তৈরি করলেন। বসবার ঘরে নতুন পর্দা লাগান হল; ট্রাঙ্কে তোলা টেবিল-ক্লথ বিছিয়ে দেয়া হল টেবিলে। মন্টু সাইকেলে করে দূর কোথাও থেকে ফুল এনে ফুলদানি সাজাল। রুনু রাবেয়ার একটি শাপলা রঙের শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। রাবেয়া ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, মা, রুনু যে বড়ো আমার শাড়ি পরেছে, ময়লা করে ফেলবে তো।
ময়লা হলে ইন্ত্রি করিয়ে দেব।
যদি ছিঁড়ে ফেলে?
কি ভ্যাজর ভ্যাজার করছিস।
হুঁ, আমি তো ভ্যাজর ভ্যাজর করছি। আমার যদি আজ বিয়ে না হত, দেখতে রুনুর চুল ছিঁড়ে ফেলতাম না!
রাবেয়া পরেছে বেশ দামী আসমানী রঙের শাড়ি। সাধারণ সাজগোজের বেশি। কিছু করে নি। এতে তাকে যে এত সুন্দরী লাগবে, কে ভেবেছে! বড়ো বড়ো ভাসা চোখ, বরফি-কাটা চিবুক, শিশুর মতো চাউনি। সব মিলিয়ে রূপকথার বইয়ে আকা বন্দী রাজকন্যার ছবি যেন।
মাস্টার কাকা একটা ফর্সা পাঞ্জাবি পরে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন, বরপক্ষীয়দের অভ্যর্থনার জন্য। পাঁচটায় তাদের আসার কথা, ছটা পর্যন্ত কেউ এল না। ঠিকানা নিয়ে মাস্টার কাক খুঁজতে গেলেন। জানা গেল কেউ আসবে না। একটি পাগল মেয়ে গছিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র তারা কী করে যেন জেনেছে।
লজ্জায় আমার চোখে পানি এসে পড়ল। কী দরকার ছিল এ সবের? না-ই হত বিয়ে। মা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, দরকার ছিল রে।
কী জন্যে?
আমার কেমন যেন সন্দেহ হয় খোকা!
কী সন্দেহ?
কাল তোর বাবা রাবেয়াকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে, তখন জানবি।
বাবা নামলেন রিকসা থেকে। রাবেয়া ধীরে-সুস্থে নামল। মুখ কালো করে বলল, মা, ডাক্তার আমাকে বেশি পরিশ্রম করতে নিষেধ করেছেন। এখন শুধু বিশ্রাম। তাই না বাবা?
বাবা মার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললেন, এখন কী করবে?
ব্যাপারটা আমি জানলাম। রুনু জানল। মন্টু ফুটবল খেলতে বাইরে গেছে, শুধু সে-ই জানল না। রাবেয়ার নির্বিকার ঘুরে বেড়ানর ফল ফলেছে। ডাক্তার তাকে পরিশ্রম করতে নিষেধ করেছেন। এখন রাবেয়ার প্রয়োজন শুধু বিশ্রাম।
রাবেয়ার মাথার ঠিক নেই। ছোটবেলা থেকেই সে ঘুরে বেড়ােত চারদিকে। সব বাড়িঘরই তার চেনা। চাচা খালু দাদা বলে ডাকে আশেপাশের মানুষদের। তাদের ভিতর থেকেই কেউ তাকে ডেকে নিয়েছে। এমন একটি মেয়েকে প্রলুব্ধ করতে কী লাগে? মোর রাত্রে ঘুম হয় না। তাঁর চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। রুনু আর শীলুদের বাসায় গান শুনতে যায় না। নাহার ভাবী বেড়াতে এসে বললেন, কি ব্যাপার, তোমরা কেউ দেখি আমাদের ওখানে যাও না, রাবেয়া পর্যন্ত না।
রুলু কথা বলে না। মা নিচু গলায় বলেন, রাবেয়ার অসুখ করেছে মা।
কি অসুখ, কই জানি না তো?
এমনি শরীর খারাপ।
বলতে গিয়ে মায়ের কথা বেধে যায়। অসহায়ের মতো তাকান।
ব্যাপারটার উৎস রাবেয়ার কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করলাম। আমি। সন্ধ্যায় যখন রুনু মাস্টার কাকার কাছে পড়তে যায়, ঘরে থাকি আমি আর রাবেয়া। তখনই আমি কথা শুরু করি :
রাবেয়া।
কি?
কোথায় কোথায় বেড়াতে যাস তুই?
কত জায়গায়। চেনা বাড়িতে।
খুব ভালো লাগে?
হুঁ।
কাকে কাকে ভালো লাগে?
সবাইকে!
ছেলেদের ভালো লাগে?
হুঁ।
নাম বল তাদের।
একটানা নাম হলে চলে সে। তাদের কাউকেই সন্দেহভাজন মনে হয় না। আমার। সবাই বাচ্চা বাচ্চা ছেলে। রাবেয়াকে বড়ো আপা ডাকে।
তারা তোকে আদর করে, রাবেয়া?
হুঁ।
কী করে আদর করে?
আমার সঙ্গে খেলে, আর—
আর কি?
গল্প করে।
কিসের গল্প?
ভূতের।
ইতস্তত করে বলি, তোকে কেউ চুমু খেয়েছে রাবেয়া?
যাহ! তাই বুঝি খায়?
মার কথাগুলি হয় আরো স্পষ্ট, আরো খোলামেলা। আমার লজ্জা করে। মা আদুরে গলায় বলেন, রাবেয়া, কে তোর শাড়ি খুলেছিল? বল তো নাম।
যাও মা, তুমি তো ভারি…
মা রেগে যান। হপাতে হাঁপাতে বলেন, তাহলে এমন হল কেন? বল তুই হারামজাদী?
রাবেয়া বলে না কিছু, মা ফুঁপিয়ে—ফুঁপিয়ে কাঁদেন। রাবেয়া বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। বলে, কাঁদা কেন, মা?
বল, কার সঙ্গে তুই শুয়েছিলি?
রাবেয়া চুপ করে থাকে। কথাই হয়তো বুঝতে পারে না। বাবা পাগলের মতো হয়ে উঠেছেন। মেজাজ হয়েছে খিটখিটে, অল্পতেই রেগে বাড়ি মাথায় তোলেন। রুনু স্কুল থেকে ফিরতে দেরি করেছে বলে মার খেল সেদিন। এক দিন দেখি বাবা গণক নিয়ে এসেছেন, পাড়ার সব যুবকদের নাম লিখে কী-সব মন্ত্র পড়ছে সে।
রাবেয়ার অসুখের প্রত্যক্ষ চিহ্ন ধরা পড়ল এক দিন ভোরে। চা খেয়েই ওয়াক ওয়াক করে বমি করল সে। যদিও তার শারীরিক অস্বাভাবিকতা নজরে আসার সময় এখনো হয় নি, তবু তার শরীরে আলগা শ্ৰী আসছিল। একটু চাপা গাল ভরাট হয়ে উঠছে, ভুরু মনে হচ্ছে আরো কালো, চোখ হয়েছে উজ্জ্বল, চলাফেরায় এসেছে এক স্বাভাবিক মন্থরতা। স্কুলের হেড-মাস্টারের বউ এক দিন বেড়াতে এসে বললেন, দেখ ও বউ, তোমার মেয়ে কেমন হাঁটছে–ঠিক যেন পোয়াতি।
কথাগুলি আমার বুকে ধক করে বিধেছে। কিছু একটা করতে হবে এবং খুব শিগগিরই। সবার জানিবার ও বুঝবার আগে। একটি করে দিন যাচ্ছে, অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সবাই। কিন্তু কী করা যায়? বাবা নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবেছেন। এক বার ইচ্ছে হয় তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। বাবাকে বড়ো ভয় করি আমরা।
সেদিন রাতে শুনলাম। বাবা চাপা কণ্ঠে বলছেন, বিষ খাইয়ে মেরে ফেল মেয়েকে। মা বললেন, ছিছি, বাপ হয়ে এই বললে? বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আমার মাথার ঠিক নেই শানু, তুমি কিছু মনে করো না। পাগল মেয়ে আমার! বাবার দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনলাম। অনেক রাত অবধি ঘুম হল না। আমার। একসময় রাবেয়া ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। কাতর গলায় বলল, খোকা।
কি? বাথরুমে যাবি?
উঁহু!
কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
বমি করবি?
না।
স্বপ্ন দেখেছিস?
হুঁ।
কী স্বপ্ন?
মনে নেই।
ঘুমিয়ে পড়, ভালো লাগবে।
আচ্ছা।
রাবেয়া শুয়ে পড়ল আবার। মুহুর্তেই উঠে বসে বলল, খোকা।
কি?
পলা এসেছে।
কে এসেছে?
পলা। দোর খুলে দেখ, বারান্দায় বসে আছে। আমি ডাক শুনলাম।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম দু জনেই। কোথায় কি? খা-খাঁ করছে চারদিক। রাবেয়া ডাকল, পলা, পলা।
মা বললেন, কে কথা বলে?
আমি রাবেয়া, মা।
বাবা ধমকে উঠলেন, যাও যাও, ঘুমুতে যাও! কী কর এত রাত্ৰে?
শব্দ শুনে মাস্টার কাকা বাইরে আসেন।
কী হয়েছে খোকা?
রাবেয়া বলে, পলাকে ডাকছিলাম কাকা।
যাও শুয়ে পড়, পলা কোথেকে আসবে এত রাত্তিরে?
শুতে শুতে রাবেয়া বলল, খোকা, পলাকে একটা চামড়ার বেল্ট কিনে দেবে? গলায় বেধে দেব।
আচ্ছা!
আর একটা লম্বা শিকল কিনে দেবে?
দেব!
আচ্ছা, আর একটা জিনিস দেবে?
কি জিনিস?
নাম মনে নেই আমার। দেবে তো?
আচ্ছা দেব।
কবে? কাল?
না, চাকরি হোক আগে।
বাবা বলে উঠলেন, কি ভ্যাজর ভ্যাজর করছিস তোরা? ঘুমো। সারা দিন খেটে এসে শুই, তাও যদি শান্তি পাওয়া যায়।