আবু ইব্রাহীমের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলতে দেরি হয়ে গেলে সিদ্দিক হোসেন তাকে টাকা ধার দেয়, সেই টাকা দিয়ে সে দরখাস্ত করে। সিদ্দিক হোসেনেরও আন্তরিক ইচ্ছে ছিল এই যে, আবু ইব্রাহীম ঢাকায় একটু ঠাই করে নিক; কোনো কারণে হয়তো তাকে তার ভালো লেগেছিল; যদিও আমরা জানি যে, রূপনগরে আবু ইব্রাহীমের জায়গা কেনা হয় নাই বরং খুব শীঘ্রই তার লাশ ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের পথে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল। রূপনগরের প্লটের জন্য দরখাস্ত করার পর তারা দুজন একদিন মিরপুরের প্রান্তে রূপনগর হাউজিং এর জায়গা দেখে আসে, আবু ইব্রাহীম তার নূতন সেকশনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং এই সময়, তার ব্যস্ততা এবং শীতল আবরণের ভেতর দিয়ে একজন লোক ক্রমান্বয়ে তার দিকে অগ্রসর হয়ে আসে; এই লোকটির নাম আমরা খালেদ জামিল বলে জানতে পারি। মমতাও পরে এর সঙ্গে পরিচিত হয়। দুটো সাপ্লাই অর্ডারের শিপমেন্টের সময় সীমা বাড়ানোর জন্য পর পর দুদিন সে আবু ইব্রাহীমের কাছে আসে; লম্বা, সুন্দর চেহারা তার; কথা বলে অজস্র এবং কথা বলতে বলতে বাংলা থেকে ইংরেজিতে চলে যায়। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পরে সে একদিন আসে এবং বলে, চা খাওয়া যাক, স্যার। আবু ইব্রাহীম ভদ্রতা করে চা আনালে সে বলে, আপনার ওপর দিয়েই খেলাম। তখন আবু ইব্রাহীমকে তার কথা শুনে হাসতে হয় এবং বলতে হয় যে, এটা কোনো ব্যাপার নয়। খালেদ জামিল ফিস ফিস করে বলে, আমাদের ফার্ম থেকে স্যার কিছু স্যুভেনির দেওয়া হয় গিফট হিসেবে, নেক্সট টাইম আই উইল বি অনার্ড টু ইনকুড ইউ ইন দি লিস্ট।
আবু ইব্রাহীম হাসে বলে, ইটস নট নেসেসারি।
অফ কোর্স নট, বাট সার—খালেদ জামিল পুনরায় একটি সিগারেট ধরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, সে বলে আপনি স্যার সিগারেট খান না, ইটস স্যাড। আসলে আপনাকে বলতে অসুবিধা নেই, উই আর ফ্রেন্ডস। আই হ্যাভ সাম গুড ফেন্ডস লাইক ইউ, এন্ড আই হ্যাভ সাম ইম্পর্টেন্ট রিলেটিভস্ অলসো। আমাদের যা বিজনেস, আপনাকে বলতে অসুবিধা নাই, আপনিতো জানেন এটা কি বিজনেস। উই আর্ন ইট অ্যাট নো কস্ট, ইউ আর্ন কমিশন এবং এর একটি অংশ আমরা রাখি, এন্ড উই শেয়ার দি আদার পার্ট উইথ আওয়ার ফ্রেন্ডস।
খালেদ জামিলের কথায় আবু ইব্রাহীম আবার হাসে বলে, আমি জানি। একটা সিগারেট খান।
না, থ্যাঙ্কস; আমি সিগারেট খাই না।
আপনি ভালো আছেন; আজকে চলি; এই বলে সে উঠে যায় এবং যেদিন চীনে রেস্তোরায় বসে আবু ইব্রাহীম হেলেনের সঙ্গে ভেজিটেবল স্যুপ খায় তার পরদিন সে পুনরায় এসে উপস্থিত হয়।
একটা কাজে এলাম, স্যার।
কেমন কাজ?
ভালো, ক্লিন।
খালেদ জামিল তখন তাকে কাজের কথাটি বলে; সে বলে যে, টিসিবি পাঁচ হাজার টন এলুমিনিয়াম ইনগট আমদানি করতে চায়। এ জন্য বৈদেশিক ঋণসাহায্যে থেকে টিসিবির নূতন কিছু বরাদ্দ দরকার এবং এই বরাদ্দ এফআরজি গ্রান্ট থেকে হলে ভালো হয়। আবু ইব্রাহীম তখন সে বছরের পণ্য ঋণ-সাহায্য বরাদ্দের অবস্থার বিষয়টি খালেদ জামিলকে খুলে বলে, সে তাকে বলে যে, এফআরজি গ্রন্টের সব টাকা বরাদ্দ করা হয়ে গেছে। নূতন বরাদ্দ দেওয়ার মতো কোনো অবশিষ্ট নেই।
আমি জানি স্যার, খালেদ জামিল বলে, আপনি শুধু টিসিবির প্রস্তাবমতো এফআরজি গ্রান্ট থেকে অতিরিক্ত বরাদ্দের ব্যবস্থা করার জন্য বিদেশ সম্পদ দপ্তরকে লিখে দিলেই হবে।
কিন্তু টিসিবি তো আমাদেরকে লেখেনি।
চিঠি কালকেই পেয়ে যাবেন।
পরদিন সে টিসিবির চিঠি পায় এবং তার কিছুক্ষণ পর খালেদ জামিল আসে।
এটা স্যার একদম ক্লিন কেস।
কিন্তু বছরের প্রথম এলোকেশন নেওয়ার সময় তার কেন বলল না যে, তাদের এলুমিনিয়াম ইনগট দরকার?
তখন দরকার ছিল না, এখন তারা মনে করছে যে, তাদের ইনগট দরকার। চিঠিতে লিখেছে না সে কথা?
আবু ইব্রাহীম এবং তার মন্ত্রণালয়ের তেমন কিছু করার ছিল না, টিসিবির চাহিদার প্রেক্ষিতে তারা বৈদেশিক সম্পদ দপ্তরে প্রার্থিত অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য চিঠি লিখে দেয় এবং বৃহস্পতিবার দুপুরে খালেদ জামিল তার অফিসে আসে, বলে, কেমন আছেন ভাই?
না, তা নয়। এদিকেই আর একটা কাজ ছিল, ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।
তাই? কেমন আছেন আপনি?
জ্বি ভালো। আপনি ভালো?
আবু ইব্রাহীম হাসে এবং বলে, আপনার অন্যান্য ব্যবসাপাতি কেমন চলছে?
ব্যবসা তো ভাই চলে না, চালাতে হয়।
কেমন চালাচ্ছেন?
চেষ্টা করছি পারছি কই! দেশের যা অবস্থা!
কেন, দেশের কি হলো?
আপনি কি বলেন দেশের অবস্থা ভালো?
তা বলি না।
তাহলে?
আবু ইব্রাহীম তার দিকে তাকায়, সে বলে, এখানে কোনো নিয়ম নাই, শৃঙ্খলা নাই।
আবু ইব্রাহীম চুপ করে থাকে এই আশায় যে, এতে করে লোকটির কথা বলার প্রসঙ্গ শেষ হবে এবং সে প্রস্থান করবে; কিন্তু খালেদ জামিল ওঠে না, সে বলে, মার্শাল ল’ হয়ে যেতে পারে।
হবে নাকি? কাগজে দেখেন, না, জেনারেলরা অসন্তুষ্ট।
আবু ইব্রাহীম পুনরায় চুপ করে থাকে, তখন খালেদ জামিল বলে, চা খাওয়া যাক, আপনার পিয়নটাকে ডাকেন।
আবু ইব্রাহীমের বিরক্তি লাগে এবং বলা যায় যে, খালেদ জামিলের এই অতি অন্তরঙ্গতায় সে কিছুটা ক্ষুব্ধও হয়। কিন্তু সে তাকে আটকাতে পারে না, বেল বাজিয়ে পিয়ন ডাকে এবং পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে। তখন খালেদ জামিল বলে, আপনি মাইন্ড করবেন না, প্লিজ; আমার সকালে নাস্তা করা হয় নাই, কিছু নাস্তা আনাই।
আবু ইব্রাহীম ব্যাপারটি পরিষ্কাররূপে বুঝতে পারে, সে অসহায়ের মতো খালেদ জামিলের দিকে তাকায় এবং তারপর বলে যে, চা ছাড়া আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছে তার নেই।
খালেদ জামিল তখন আবু ইব্রাহীমের কথা মেনে নেয় এবং শুধু চা আনার জন্য পিয়নকে টাকা দেয়। খালেদ জামিলের এই আচরণে আমাদের হয়তো মনে হবে যে, সে আবু ইব্রাহীমের ইচ্ছের দৃঢ়তার সামনে পরাস্ত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে আমরা এমন সব ঘটনার কথা জানতে পারব, যখন আমাদের মনে হবে যে, এই সব প্রাথমিক দিনগুলোয় ডাঙায় উঠে আসায় অনভ্যস্ত এবং অনিচ্ছুক মাছের মতো সে আবু ইব্রাহীমকে খেলাচ্ছিল। চা খেতে খেতে আবু ইব্রাহীম বলে, ফান্ডের জন্য দৌড়াচ্ছেন, এই ইনগট সাপ্লাইয়ের অর্ডার কি আপনি পাবেন?
পেতে পারি।
কোন দেশ থেকে আসবে এগুলো?
আমার প্রিন্সিপাল সুইডেনের।
তার গুদাম পরিষ্কার করা দরকার?
হতে পারে, টিসিবিরও এই জিনিসগুলো দরকার।
সেদিন খালেদ জামিল চলে যাওয়ার পর আবু ইব্রাহীমের হাতে কিছু অলস মুহূর্ত জমা হয় এবং তখন তার হেলেনের কথা মনে পড়ে। কাল কামালের ঘরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে, সে বলে; তার এই স্বগতোক্তির ধরনে সে চমৎকৃত হয় এবং ভীরুতার আবরণ খসিয়ে নিজের কাছে এই প্রশ্ন করে যে, সে আসলে কি চায় এবং তার মনে হয় যে, সে এই প্রশ্নের উত্তর জানে না। সেদিন দুটোর পর সিদ্দিক হোসেনের গাড়িতে চেপে সে যখন ঘরে ফেরে তখন সে কিছুটা উন্মনা হয়ে থাকে, তারপর সেদিন সন্ধ্যায় তার বাসার ব্যালকোনিতে সে যখন এসে দাঁড়ায়, তার পুনরায় এই কথাটি মনে হয়, সে কি চায় হেলেনের কাছে এবং সে নিজেকে বলে, আমি জানি না। কিন্তু সন্ধ্যার এই নবীন অন্ধকারের ভেতর দাড়িয়ে আবু ইব্রাহীম দেখে যে, সে নিজেকে অব্যাহতি দিতে পারে না এবং তার সামনে পুনরায় এই প্রশ্নটি আসে যে, কালকে কামালের বাসায় একা হেলেনকে নিয়ে সে কি করতে চায়। তখন তার মনে হয় যে, সে আসলে তার পরিকল্পনার কথা জানে; ধোয়াটে অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে কোনো ধ্বনি উচ্চারণ না করে সে বলে, আমি তোমাকে নগ্ন করব। আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যে, হেলেনকে কামালের বাসায় আসতে বলার সময়ই থেকেই সে এ কথাটি জানত। কিন্তু এখন, সম্ভাব্য ঘটনা থেকে মাত্র একটি রাত্রির ব্যবধান দাঁড়িয়ে, সে যখন এই সত্যকে নিরাবরণ অবস্থায় নিজের সামনে স্থাপন করে, সে তখন দেখে যে, তার হৃদয় এক বেদনায় ভরে যায়; আবু ইব্রাহীম এই বেদনা নিয়ে সে রাতে ঘুমায়। সকালে উঠে সে টেলিভিশনের সামনে বসে এবং এই অবস্থায় যখন ঘড়ির কাঁটা সকাল দশটার ঘর পার হতে থাকে, যখন ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘরের দিকে অগ্রসরমান হয়, তখন টেলিভিশনের পর্দার ওপর চোখ রেখে কোনো ধ্বনি উচ্চারণ না করে হেলেনকে সে এই কথা বলতে থাকে, আজকে তুমি ফিরে যাও হেলেন, মানুষকে এভাবে কখনো ফিরে যেতে হয়, একা বিষণ্ণ এবং আনত হয়ে, আজকে তুমি ফিরে যাও। কিন্তু সেদিন টেলিভিশনের সামনে বসে আবু ইব্রাহীমের এই সত্যটা জানা ছিল না যে, জীবন আনন্দ এবং বেদনার সর্বদাই একটি খেলা মাত্র। কারণ পরদিন অফিসে গেলে কামাল তাকে ফোন করে এবং শুক্রবার সকালে তাকে অর্থহীনভাবে ঘরে অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য গালমন্দ করে। তখন কামালের কাছ থেকে সে যখন জানতে পারে যে, হেলেনও কামালের বাসায় যায় নাই, তখন প্রথমে তার হাসি পায়, তারপর সে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। আবু ইব্রাহীমের জীবন এ ভাবে উন্মোচিত হয়, তা আমরা অবলোকন করি এবং আমাদের সামনে ক্রমাগতভাবে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে যে, তার পতনের কোনো শেষ নেই। আবু ইব্রাহীম টেলিভিশনের সামনে বসে প্রত্যাখ্যান করার মতো করে হেলেনকে বলেছিল ফিরে যাওয়ার জন্য; কিন্তু হেলেন আসেইনি। এমনকি তিন-চার দিনের ভেতর সে জানতে পারে যে চীনে রেস্তোরায় বসে হেলেনকে কামালের বাসায় আসতে বলার সময় তার নিজের যেমন একটি পরিকল্পনা ছিল, এ প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার সময়ই হেলেন জানত যে, সে আসবে না। কারণ খুবই শীঘ্রই আবু ইব্রাহীম তার অফিসের ঠিকানায় হেলেনের একটি চিঠি পায়, সেই চিঠি থেকে সে জানতে পারে যে, শুক্রবারের দু’দিন আগে বুধবার রাতে হেলেনের ফ্লাইট নির্ধারিত ছিল এবং সেই ফ্লাইটে তারা দেশত্যাগ করে যায়। হেলেন তার চিঠিতে লেখে, আমি তোমাকে কখনো দুঃখ দিতে চাইনি ইব্রাহীম। আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে যে, তার কিছু করার নেই এবং এরপর কিছুদিন তাকে পুনরায় সেইসব গ্রিক চরিত্রের মতো মনে হয়, যারা নিয়তির দ্বারা পীড়িত হয় এবং সেই নিয়তিকে বহন করে চলে। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে হবে যে, অন্য এক নিয়তির মতো খালেদ জামিল আবু ইব্রাহীমের জীবনে প্রকাশিত হয় এবং বস্তুত তার মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে। সহসাই একদিন বিকেলে শান্তিনগর থেকে বাজার করে হেঁটে ঘরে ফেরার সময় খালেদ জামিলের সঙ্গে তার পুনরায় দেখা হয়। খালেদ জামিল তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে তার বিল্ডিং-এর সামনে এনে নামিয়ে দেয়। তখন আবু ইব্রাহীমকে ভদ্রতা করে বলতে হয়, এক কাপ চা খেয়ে যান এবং খালেদ জামিল নির্দ্বিধায় এই প্রস্তাবে সম্মত হয়। সে রাতে আবু ইব্রাহীম দিনপঞ্জিতে যা লেখে তা থেকে আমরা জানতে পারি যে, খালেদ জামিলের আচরণ তার কাছে প্রথমে কৌতুককর লেগেছিল। কিন্তু তারপর সে যখন তার অমলিন পরিশীলিত মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে কোনো অসম্পূর্ণতা অথবা অসঙ্গতি খুঁজে পায় না। তার অনাবিল ব্যক্তিত্বে কোনো বিচ্যুতি দেখে না। সেদিন খালেদ জামিলের সঙ্গে বাইরের ঘরে বসে নোনতা বিস্কুট এবং চা খাওয়ার সময় একটি লোক এসে হাজির হয়। দরজার বেল বাজলে আবু ইব্রাহীম দরজা খুলে দেয়, মুজিবুর রহমান মলিন চেহারা নিয়ে তার দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার হাতে মিষ্টির একটি প্যাকেট। আবু ইব্রাহীমের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে সে তোতলাতে থাকে। আবু ইব্রাহীম এটুকু শুধু বুঝতে পারে যে, সে মিষ্টির প্যাকেটটি তার বাচ্চাদের জন্য এনেছে। আবু ইব্রাহীমের কয়েকটি মুহূর্ত লাগে সিদ্ধান্ত নিতে, সে মুজিবুর রহমানকে ফিরিয়ে দেয়, তারপর ঘরে ফিরে এলে খালেদ জামিল বলে কি হয়েছে?
একটা লোক, চাকরি গেছে, চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মিনিস্ট্রিতে আপিল করেছে।
কি করেছিল?
গুদামের মালের হিসেব মিলেনি।
কি করবেন।
ব্যাপারটি পরীক্ষাধীন আছে।
খালেদ জামিল তখন বলে, এই সব কেস খুব সেনসেটিভ হয়; কারণ এসব কেসের সঙ্গে হিউম্যান এলিমেন্ট জড়িত।
তখন আবু ইব্রাহীম হঠাৎ বিরক্ত হয়, হয়তোবা তখন তার মনের ভেতর একটি অস্বস্তি ছিল, কারণ একটি বিষণ্ণ এবং বিতাড়িত ছায়ার মতো সে মুজিবুর রহমানকে কলোনির রাস্তা ধরে অপসৃত হতে দেখেছিল। সে বলে, আমি জানি না আপনি আমাকে কোনো লেসন দেওয়ার চেষ্টা করছেন কিনা!
আবু ইব্রাহীমের কথা শুনে খালেদ জামিল গম্ভীর হয়ে ওঠে এবং সিগারেট ধরায়, তারপর সে বলে, আপনি আমাকে বুঝতে পারেন নাই। আমি আপনাদের সঙ্গে সহজ এবং সাবলীল হতে চাচ্ছি মাত্র। আপনার মতো অনেক ইয়াং এবং ব্রাইট অফিসারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমি ব্যবসা করি; জীবনটা সঙ্গতকারণেই আমার জন্য কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। আপনার সঙ্গে আমার একটা দূরবর্তী সম্পর্ক হলেও আছে। ইটস লাইক এ গেম, আপনার বিবেচনানুযায়ী আপনি খেলবেন, সেটা অ্যাগরিড। তবে কখনো কখনো, যেমন ধরেন ড্রিঙ্কসের টেবিলে সকলে যখন হার্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছে তখন একজন সফট ড্রিঙ্ক নিয়ে বসলে যেমন হয়, তেমন এক ধরনের আন-এক্সপ্লেইনড় অসুবিধা হয়।
আবু ইব্রাহীম বলে, আমি দুঃখিত। তবে আমার ব্যাপারে আপনি এক ধরনের সদিচ্ছা দেখান, যার পিছনে অবশ্যই কিছু কারণ থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়।
ইয়েস, বিকজ উই ক্যান বি ফ্রেন্ডস। বাট উই ক্যান্ট বি ফ্রেন্ডস ইফ ইউ টেক এ ফানটা হোয়াইল আই টেক এ হুইস্কি। হোয়াই ক্যান্ট ইউ অলসো টেক ও ফানটা?
আবু ইব্রাহীমের কথা শুনে খালেদ জামিল হাসে। তারা বুঝতে পারে যে, এসব প্রসঙ্গে ঐক্য হওয়ার সম্ভাবনা নাই। খালেদ জামিল শুধু যাওয়ার সময় একবার বলে, লাইফ ইউ নট লাইক ড্রিঙ্কিং এ ফানটা, ইটস লাইক এ হার্ড ড্রিঙ্ক এবং আবু ইব্রাহীম আর কিছু না বলে তাকে চলে যেতে দেয়। ভেতরের ঘরে গিয়ে আবু ইব্রাহীম দেখে যে, মমতা বিছানার উপর বসে কাঁথার মতো একটি কাপড় সেলাই করে।
কি ব্যাপার?
কি?
খেতা সেলাই কইরতাছ? কি ব্যাপার?
ইয়ার্কি মাইরো না!
আবু ইব্রাহীম গম্ভীর হয়ে বলে, এইটা কি?
ড্রেসিং টেবিলের পর্দা।
এইটা আবার কোন স্টাইলের পর্দা হইলো!
যে স্টাইলের হয় সেই স্টাইলেরই।
আবু ইব্রাহীম তখন আবার হাসে এবং বলে, একটা কথা কই তোমাক।
মমতা আবু ইব্রাহীমের দিকে তাকায়।
বিন্দু আর শুভ বড় হওয়া যাইতাছে।
তাতে কি হইছে?
আমরা কিন্তু আর একটা বাচ্চা নিতে পারি।
বাজে কথা কয়ো না।
এত বড় শরীরটা তোমার আর কোন কাজে লাইগব?
মমতা আর কোনো কথা বলে না, আবু ইব্রাহীম বাইরের ঘরে এসে বসে, কাজলি আবু ইব্রাহীমকে এক কাপ চা বানিয়ে দেয়। তখন মমতা সেলাইয়ের কাপড়টি হাতে করে বাইরের ঘরে আসে।
হেলেনের কি খবর?
চইলা গেছে ওরা।
বাসায় দেখা কইরতে আইসলো না?
তোমাকে ভয় পায় হয়তো।
এর পর তারা দুজন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর মমতা বলে, আমাক কি তুমিও আসলে ভয় পাও?
এই কথা শুনে আবু ইব্রাহীম বড় করুণ এবং বিষণ্ণ চোখে মমতার দিকে তাকায় এবং দেখে যে, তার চোখের সামনে একটি নারী, একটি দিনের বিকাশের মতো আলো এবং ছায়ার বুননে ফুটে ওঠে। সে দেখে যে, মমতা তার দেহটা পিছন দিকে টান করে দিয়ে মাথা দেয়ালের সঙ্গে ঠেকিয়ে রেখেছে, তার মুখে কালো ছায়া, পানিতে ভরে এসেছে চোখ। আবু ইব্রাহীম সেদিন, সেই কটি মুহূর্ত বাক্যহীন হয়ে থাকে, তারপর মমতা চোখের পানি মুছে ফেললে, সে উঠে গিয়ে তার বহুল ব্যবহৃত ব্যালকোনিতে দাঁড়ায়। মমতার এই চোখের জল তাকে প্লাবিত করে রাখে, তখন একদিন খালেদ জামিল তার অফিসে এসে বলে, আপনাকে ফানটার দাওয়াত দিতে এলাম; সুইডেন থেকে আমার প্রিন্সিপাল এসেছে, তাই নেক্সট সানডেতে শেরাটনে একটা ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, অ্যান্ড ইউ আর কর্ডিয়ালি ইনভাইটেড টু দা ডিনার। আবু ইব্রাহীম ডিনার খেতে চায় না, খালেদ জামিল কয়েকদিন পর আবার আসে এবং বলে, আপনি গেলেন না। উই মিসড় ইউ ভেরি মাচ! আবু ইব্রাহীম একটু লাজুকভাবে হাসে, চা আনায় এবং বলে শুধু চা। তার কথায় হঠাৎ করে খালেদ জামিল উল্লসিত হয়ে ওঠে, বলে, ওনলি টি। সিমপ্লিসিটি ইজ গ্রেটনেস অ্যান্ড গ্রেটনেস ইজ সিমপ্লিসিটি, ইউ আর বোথ সিম্পল অ্যান্ড গ্রেট। এই কথা শুনে আবু ইব্রাহীম যখন হেসে ওঠে তখন খালেদ জামিল তাকে সেই হাসির ভেতর ডুবে যেতে দিয়ে অপেক্ষা করে। তারপর আবু ইব্রাহীম পুনরায় সুস্থির হলে সে কাজের কথাটি বলে, সিমেন্ট কেনার একটা প্রস্তাব আসছে আপনাদের অনুমোদনের জন্য।
সে জন্যই এত কথা বলেছেন?
না, তা নয়।
তখন খালেদ জামিল বলে যে, আবু ইব্রাহীমের কাছ থেকে সে কোনো অন্যায় সুযোগ কামনা করে না। সে তাকে কোনো অন্যায় কিছু করতেও বলবে না। সে শুধু সুবিবেচনা এবং সদিচ্ছা চায়। তারপর আবার দেখা হবে বলে সে চলে যায়। খালেদ জামিল চলে যাওয়ার পর সিদ্দিক হোসেন আবু ইব্রাহীমের রুমে আসে এবং তাকে সঙ্গে করে গৃহনির্মাণ পরিদপ্তরে যায়। সেখান থেকে তারপর তারা বাসায় ফেরে। সে রাতে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়; সকালে উঠে কলোনিতে লোকজন রেডিওতে মার্শাল ল’ প্রতিষ্ঠা এবং শহরে কাফু জারির খবর শোনে। দেশের বৃদ্ধ এবং কালো চেহারার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি অপসারিত হয়, সন্ধ্যায় সকলে টেলিভিশনে ইউনিফর্ম পরা সুদর্শন এবং অল্পবয়স্ক প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ভাষণ শোনে। দুদিন পর যখন দিনের বেলার কার্টু তুলে দেয়া হয় এবং অফিস আবার খোলে, আবু ইব্রাহীম অফিসে যায় এবং বেলা দেড়টার দিকে সেদিনকার ডাক তখন যখন আসে তার ভেতর সে সিমেন্ট কেনা সম্পর্কিত চিঠিটি পায়। তার কিছুক্ষণ পর সিদ্দিক হোসেন আসে এবং তারা বাড়ির দিকে রওনা হয়। তখন সিদ্দিক হোসেন তাকে বলে, জমির মালিকভো হয়া গেলা।
তাই? কে বলল?
আমি খোঁজ নিতে গেছিলাম, লটারিতে তোমার নাম উঠছে।
তোমার?
আমারও।
চমৎকার।
বাসায় ফিরে খাবার খেয়ে আবু ইব্রাহীম আবার বের হয় এবং সে সন্ধ্যের সময় ঘরে ফিরে দেখে যে, মমতা শুভকে সঙ্গে করে সিদ্দিক হোসেনের বাসায় বেড়াতে গেছে। পুরো সন্ধ্যেটা সে বিন্দুর সঙ্গে গল্প করে কাটায়, তারপরেও মমতা এবং শুভ ফেরে না দেখে, কাজলিকে ঘরে রেখে তারা দুজন বাইরে বের হয়। তখন তারা দেখতে পায় যে, কলোনির সামনের রাস্তা এবং মাঠের ওপর দিয়ে একটু একটু বাতাস বয়ে যায়।
সুন্দর না আব্বু, বাতাসটা?
হেঁ।
ঘরের মইদ্দ কেমন গরম!
হু! ইকটু ঘুরবি রাস্তা দিয়া?
হেঁ।
তারা এগিয়ে গিয়ে বড় রাস্তার উপর দাঁড়ায় এবং তখন আবু ইব্রাহীম বেড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়, বলে আইজ থাইক। আর একদিন ঘুরিস। এতে বিন্দুর মন খারাপ হয়ে যায়। সে ফুটপাথের কিনারায় একটি সেগুন গাছের ছায়ার অন্ধকারে গিয়ে বসে।
আমরা এইখানে তাইলে বইসা থাকি আব্ব?
আরে না, ফুটপাথের উপুর কি বইসা থাকা যায়?
বিন্দু বলে, কি ফাইন বাতাস আলু, বসি না এইখানে। আম্মুরা তো ফিরবনি এখান দিয়াই, এই কথা বলে, সে উঠে এসে আবু ইব্রাহীমের হাত ধরে টেনে সেগুন গাছের অন্ধকারের ভেতর নিয়ে যায়।
আম্মুরা যখন এইখান দিয়া যাইব তখন চুপ কইরা থাইকপা, কথা কইবা না।
কেন?
পিছন থেইকা ভয় দেখামু।
যুদি তর আম্মু চিখখুর দেয়?
যাহ্, শুভ চিখখুর দিব।
তর স্কুলের বন্ধুরা কেমন আছে সব?
ভালো আছে।
নাম কি জানি সব ওগোরে?
সোনিয়া, পিউ, ইফফাত। জানো আলু পিউরা না ইন্ডিয়া গেছিল বেড়াইতে। ওর আম্মু অনেক সুন্দর সুন্দর শাড়ি আইনছে।
তুই একটা শাড়ি নিবি?
হেঁ দিবা কিনা?
আচ্ছা ঠিক আছে দিমু। শাড়ি পরায়া তক শ্বশুরবাড়ি পাঠায়া দিমু।
যাহ্, উ!
যাহ্ উ, কি?
বিন্দু কিছু বলে না, তখন আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যে, তার কন্যাটি পৃথিবীর সব চাইতে মধুময়ী স্ত্রী হবে; একটি ঘর উদ্ভাসিত হবে, প্লাবিত হবে একটি পুরুষের জীবন এবং তখন একটি দমকা বাতাস বয়ে যায়, সে বাতাসে বিন্দু একটু শিউরে উঠলে আবু ইব্রাহীম তাকে হাত দিয়ে বেষ্টন করে কাছে টেনে আনে। বিন্দুর একটি হাত আবু ইব্রাহীমের হাতের ভেতর স্থাপিত থাকে। তার আঙুলের ভেতর বিন্দুর হাতের আঙুল খেলা করে এবং বিন্দুর চুলের ভেতর থেকে শুকিয়ে যাওয়া ঘামের গন্ধ পায়। এভাবে আরো অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তারা দূর থেকে মমতা আর শুভকে আসতে দেখে এবং আবছা অন্ধকারের ভেতর বসে থাকলেও শুভ তাদেরকে চিনে ফেলে। রাস্তার ধারে ফুটপাথের উপর মেয়েকে নিয়ে এভাবে বসে থাকায় মমতা আবু ইব্রাহীমকে ভৎসনা করে। বিন্দু মমতাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে; তখন মমতা এক মুহূর্তের জন্য বসে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে, বলে, না চলো কাজলি একা রইছে ঘরে। মমতার ইচ্ছের মুখে বিন্দু আর শুভ পরাস্ত হয় এবং আবু ইব্রাহীমও যখন ওদেরকে সাহায্য করে না, তখন তাদেরকে ফিরতেই হয়। বিন্দু আর শুভ আবু ইব্রাহীমের দুহাত আঁকড়ে ধরে থেকে হাঁটে, কিন্তু কলোনির ভেতরের রাস্তায় ঢুকে তারা তার হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড় দেয় এবং নিজেদের বিল্ডিং-এর কাছে গিয়ে তারা যখন ঘুরে দাঁড়ায় তখন এই দুই বালকবালিকা দেখে যে, কলোনির উঁচু দালানের ফাঁক দিয়ে এক ঝকঝকে চাদ ভেসে যায়।
ইস, দেখো আলু কি বড় চান।
আবু ইব্রাহীম দেখে এবং তার মনে হয় যে, দশ নম্বর বিল্ডিং-এর কার্নিশের উপর আলোর এই বলয়টি এখনই আছাড় খেয়ে পড়বে।
দেখো মমতা!
মমতা একবার দেখে মুখ ঘুরিয়ে রাখে।
দেখো, তোমার মুখের মতো চান!
ফাইজলামি মাইরো না।
চলো, একটুখানি বইসা থাকি এইখানে।
আবু ইব্রাহীমের প্রস্তাবে বিন্দু এবং শুভ আনন্দে হুটোপুটি খায়। কিন্তু মমতা প্রসন্ন হয় না। তারা তাদের বিল্ডিং-এর সামনে রাস্তার ধারে বসে, মমতা শিক্ষিকাদের মতো বুকে দু হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। আবু ইব্রাহীম দেখে যে, তাদের বাসার জানালায় কাজলি দাড়িয়ে আছে; সে বিন্দুকে তা দেখায়। বিন্দু হাত নেড়ে চিৎকার করে, কাজলি, এই কাজলি, ওই যে চান!
পাগল হয়া গেছে সব, মমতা বলে এবং তার কথার প্রতিধ্বনি করে আবু ইব্রাহীম বলে, কেমন পাগল করা জোছনা।
চলো, ওঠো সবাই।
কিন্তু মমতার কথা কেউ শোনে না, তখন সে তাদের রেখে চলে যায়। সে রাতে বিন্দু আর শুভ ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আবু ইব্রাহীম শুতে গেলে মমতা জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়, তখন জানালা গলে জোছনা এসে বিছানার উপর পড়ে এবং মমতা সেই আলোয় পিঠ রেখে আবু ইব্রাহীমের দিকে মুখ করে বসে।
আইজ এমন জোছনা যে গায়ে লাইগলে টের পাওয়া যায়, মমতা বলে, তারপর সে কাত হয়ে শোয়, মনে হয় যেন জোছনা জোয়ার তার পিঠের দিক থেকে শরীর ডিঙিয়ে বিছানার উপর দিয়ে গড়িয়ে আসে।
তুমি কি জায়গার জন্য টাকার কথা কিছু চিন্তা কইরছ?
দেখি কি করা যায়।
আব্বাকে লেইখা দেই?
দেখি আগে কি অবস্থা দাঁড়ায়।
তখন মমতা চুপ করে থাকে।
এই আলোয় তোমাকে কেমন লাইগতাছে জান?
মমতা তারপরেও চুপ করে থাকে।
মনে হইতাছে জড়ো করা এক থোকা শেফালি ফুল।
মমতা তার কথা বলে না, আবু ইব্রাহীম মমতার ভারী হয়ে আসা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনে। সে রাতে আবু ইব্রাহীম তারপরেও আরো কিছুক্ষণ জোছনা এবং মমতার নিঃশ্বাস ধ্বনির ভেতর জেগে থাকে। পরদিন বেলা এগারোটার সময় খালেদ জামিল তার অফিসে আসে এবং তারা হাসি বিনিময় এবং করমর্দন করার পর শীঘ্রই কাজের কথায় এসে পড়ে। খালেদ জামিল বলে যে, সিমেন্ট আমদানির এই প্রস্তাবে তার ফার্ম জুপিটার এন্টারপ্রাইজের দরপত্র গ্রহণের সুপারিশ করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। আবু ইব্রাহীম বলে যে, চিঠিটা সে দেখেছে, দরপত্রদাতাদের প্রস্তাবিত মূল্যের তুলনামূলক প্রতিবেদনও দেখেছে। সে বলে যে, জুপিটার এন্টারপ্রাইজের কোট করা দর সর্বনিম্ন নয়, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন; সর্বনিম্ন দরপত্রদাতার দরপত্র অপূর্ণাঙ্গতার কারণে বাতিল করা হয়েছে। কাজেই, সে বলে যে, বিষয়টি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। খালেদ জামিল তার কথা শুনে গম্ভীরভাবে মাথা ঝাকায় এবং বলে, আপনাকে আমি কোনো অন্যায় করতে বলব না। তবে যে দরপত্র বাতিল ধরা হয়েছে, সেটা সঙ্গতভাবেই করা হয়েছে।
আবু ইব্রাহীম তার চেহারাটা নির্লিপ্ত করে রেখে বলে, দেখা যাক। খালেদ জামিল তখন হাসে এবং বলে, একটু দেখবেন, আপনার সিমপ্যাথি চাই। তারপর সে উঠে। আবু ইব্রাহীমের সঙ্গে করমর্দন করে বেরিয়ে যায় এবং তারপর সেদিন বিকেলে সে পুনরায় আবু ইব্রাহীমের বাসায় আসে।
তদবির করতে এলেন?
খালেদ জামিল তার কথায় ব্ৰিত হয় না, মুখের হাসি ধরে রেখে বলে, তা নয়, আছেন কেমন?
আছি।
খালি ঘরে বসে থেকে দিন কাটে?
আর কি করব?
আমি আর আমার স্ত্রী খুব শীঘ্রই একটা আউটিং এর আয়োজন করছি; ভাবী আর বাচ্চাদেরসহ আপনি যদি এ কোম্পানি করেন তাহলে আমরা খুব খুশি হব।
দেখা যাবে।
খালেদ জামিল তখন আবু ইব্রাহীমের মুখের দিকে পরিপূর্ণভাবে তাকায় এবং বলে আপনি কি প্রপোজালটা একজামিন করেছেন?
দেখলাম।
খালেদ জামিল একটু হাসে।
ব্যবসটা কি আমরা পাব? আপনার কি মনে হয়?
এভাবে কথা বলা কি উচিত?
প্লিজ আপনি অফেন্স নেবেন না।
আবু ইব্রাহীম চুপ করে থাকে, কাজলি চা আর বিস্কুট দিয়ে যায়। চা খেতে খেতে খালেদ জামিল বলে, সত্যিকার অর্থে আমাদেরটাই লোয়েস্ট অফার।
আমার মনে হয় না, আবু ইব্রাহীম বলে। তার এই কথা শুনে খালেদ জামিল অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, আমরা কি একটা ডীল-এ আসতে পারি।
এবার আবু ইব্রাহীমকে খালেদ জামিলের মুখের ওপর, চোখের দিকে তাকাতে হয় এবং সে দেখে যে, খালিদ জামিলের চেহারায় কোনো কুঞ্চন নেই; সে চেহারা শান্ত এবং সব সময়ের মতো উজ্জ্বল। তখন খালেদ জামিল বলে, আমি তো ভাই আপনাকে আগেই বলেছি যে, আমরা ব্যবসা করি। উই আর্ন প্রফিট অর কমিশন, অ্যান্ড উই ডোন্ট মাইন্ড শেয়ারিং ইট উইথ ফ্রেন্ডস।
আবু ইব্রাহীম তখনো চুপ করে থাকে এবং খালেদ জামিল পুনরায় বলে, এর সঙ্গে দেশ কিংবা জাতির ক্ষয়ক্ষতির কোনো ব্যাপার নেই; আপনি যদি পারটিসিপেট করেন তাহলে ইউ অলসো গেট এ বেনেফিট, ইফ ইউ ডোন্ট, দেন দি শেয়ার অফ ইয়োর বেনিফিট গোজ টু সামবডিএলস। পুরো ব্যাপারটাই এই, অন্য কিছু নয়।
আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যেন সে কথা খুঁজে পায় না এবং খালেদ জামিল তার কথা বলে চলে, এই টেন্ডারটায় আমাদের অফারই ভ্যালিড অ্যান্ড লোয়েস্ট অফার। এটা গ্রহণ করার কথা বললে আপনি কোনো অন্যায় করবেন না; কেউ তা বলতে পারবে না।
তখন আবু ইব্রাহীম বলে, যে অফারটা লোয়েস্ট, সেটাকে শুধুমাত্র প্যাকিং স্পেসিফিকেশনের তারতম্যের কারণে ইনভ্যালিড ধরা হয়েছে।
কিন্তু ডিয়ার স্যার, অফার যদি নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী না হয়, তাহলে সেটা ইনভ্যালিডই হয়। তাছাড়া প্যাকিং খুবই ইম্পর্ট্যান্ট একটি বিষয়; প্যাকিং এর কারণে পুরো কনসাইনমেন্টের সিমেন্ট নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু এখনো তো প্যাকিং স্পেসিফিকেশন ঠিক করে দিতে বলা যায়।
তা যায়। কিন্তু ডিয়ার স্যার, তাহলে অন্যায় করা হয় আমাদের প্রতি। সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। টেন্ডারের প্রথম শর্তই হচ্ছে এই যে, অফার নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হতে হবে। আমি আমার ইচ্ছামতো স্পেসিফিকেশনের জিনিস সর্বনিম্ন দাম কোট করলেই সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, দ্যাট কুড ওনলি বি এ জোক। টেন্ডার কোটেশন ওপেন করার পর নেগোসিয়েশনও নিয়ম এবং এথিকস বিরোধী।
আবু ইব্রাহীম কিছু বলে না। তখন খালেদ জামিল পুনরায় নিচুস্বরে বলে, ক্যান উই কাম টু এ ডীল?
কি জিনিস সেটা?
খালেদ জামিল কয়েক মুহূর্তভাবে, তারপর বলে, আপনি আদারওয়াইজ নেবেন না তো?
আবু ইব্রাহীম নীরবে অপেক্ষা করে খালিদ জামিল বলে, উই ক্যান শেয়ার আওতায় প্রফিট। আবু ইব্রাহীম তখন স্নানভাবে হাসে, খালেদ জামিল তার মুখের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে বলে, আপনাকে কোনো অন্যায় করতে হবে না, যা ন্যায়সঙ্গত আপনি তাই করবেন; অ্যান্ড অ্যাবাউট দি প্রফিট শেয়ারিং-এটা আসলে আপনাদেরই টাকা; আমরা ইন্ডেটর, আমাদের কমিশনের ভেতর একটা অংশ ধরা থাকে এভাবে শেয়ার করার জন্য। এটা আপনাদেরই প্রাপ্য; নিলে নিলেন, না নিলে সেটা আমাদের পকেটেই থেকে যায়।
তাই?
খালেদ জামিল হাসে, বলে, হোয়াই নট? ইট্স ইয়োর মানি।
আবু ইব্রাহীম দেখতে পায় যে, সে এই লোকটির বাক্যজাল ভেদ করতে পারে না। দুর্বলতা এবং পতন তাকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করতে থাকে সেই দিনটি পর্যন্ত, যে দিনটি সহসাই আসে এবং যেদিন সে নিজের বিশ্বাসকে পুনরায় শনাক্ত করে। কিন্তু তার পূর্ব পর্যন্ত খালেদ জামিল অগ্রসর হতে থাকে এবং ইভেন্টারদের কমিশনের একটি অংশ তাদের প্রাপ্য একথা শোনার পর আবু ইব্রাহীম সেদিন তাকে বলে, আমি সব কিছু এখনো ভালোমতো দেখিনি।
আপনি দেখেন, আপনাকে তো দেখতেই হবে। কিন্তু আমি যা বললাম এর বাইরে আপনি কিছু পাবেন না। আপনি লোয়েস্ট অ্যান্ড ভ্যালিড অফার গ্রহণের প্রস্তাব করতে পারেন।
তাই?
আবু ইব্রাহীম হাসে, সে হাসিতে খালেদ জামিল যোগ দেয় এবং বলে এবং আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আই শ্যাল হাম্বলি অফার ইউ সামথিং।
কি জিনিস?
আই শ্যাল গিভ ইউ থারটি।
আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যে, তার কাঁধের পেছনে এবং চোয়ালের পাশের পেশিতে খিচুনি ধরে যাচ্ছে; সে তার চোখ কুঁচকে তাকায় এবং তা দেখে খালেদ জামিল বলে, আপনি অফেন্ড ফিল করবেন না, প্লিজ; ইটস ওনলি এ গিফট, আই শ্যাল গিভ ইউ থারটি থাউজেন্ড বাকস্। আবু ইব্রাহীম চুপ করে থাকে, শুকনো চোখে তাকায়। তখন খালেদ জামিল একটি সিগারেট ধরিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, ওকে দেন, সো উই আর ফ্রেন্ডস, অ্যান্ড এভরিথিং ইজ এগ্রিড।
আবু ইব্রাহীম তখন কিছুটা রূঢ়ভাবে বলে, আই অ্যাম নট সো সিওর, আমাকে পুরো জিনিসটা ভালো করে দেখতে হবে।
সে রাতে খালেদ জামিল চলে গেলে আবু ইব্রাহীম ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ টেলিভিশন দেখে তারপর শুয়ে পড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম আসে না, অবশেষে শেষ রাতের দিকে সে ঘুমায়। পরদিন অফিসে তার নানা ধরনের ব্যস্ততার ভেতর কাটে; খালেদ জামিল আর তার সঙ্গে দেখা করতে আসে না। তাতে সে স্বস্তিবোধ করে। কিন্তু অফিসে না এলেও সন্ধ্যের সময় খালেদ জামিল পুনরায় তার বাসায় আসে এবং বলে, আপনি কি আমার ওপর বিরক্ত হয়েছেন?
কেন?
না এমনি।
তখন সেই অত্যন্ত সঙ্কটজনক মুহূর্তগুলো আবু ইব্রাহীম চুপ করে থাকে এবং আমরা এরকমটি সঙ্গতভাবেই ভাবতে পারি যে, আবু ইব্রাহীম একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং এ কারণেই সে চুপ করে ছিল। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কি কারণ ছিল সেটা আমরা সঠিকভাবে জানি না, কোনো দিনই হয়তো জানব না, হয়তো খালেদ জামিলের যুক্তিতর্কের সামনে তার মনে হয়েছিল যে, কোনো কিছুতেই কিছু এসে যায় না, হয়তো বা তার মনে অন্য কিছু ছিল। তবে সব অবস্থা বিবেচনায় আমাদের এ রকম বিশ্বাস না করে উপায় নেই যে, আবু ইব্রাহীম সজ্ঞানে তার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং নির্ধারিত ঘটনাটি ঘটার জন্য অপেক্ষা করছিল; যদিও তার ভেতরে একই সঙ্গে ছিল অনভ্যস্ততার অস্বস্তি। তার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে সেদিন খালেদ জামিল একটি সিগারেট ধরায় এবং সে প্রত্যাখ্যান করবে জেনেও তাকে সাধে, তারপর এক গাল ধোয়া ছেড়ে সামনের দিকে তার পা ছড়িয়ে দেয়।
আপনি কি কেসটা প্রসেস করেছেন?
না, আজকে সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
আপনার কি মনে হয়?
আবু ইব্রাহীম গম্ভীরভাবে খালেদ জামিলের দিকে তাকায় তখন সে তার প্যান্টের পকেট থেকে একটি পেট মোটা চারকোণা ইনভেলপ বের করে টেবিলের উপর রাখে। আবু ইব্রাহীম যখন টেবিলের উপর রাখা ইনভেলপটির দিকে তাকায় তখন তার দৃষ্টিতে কি ছিল, বিষণতা অথবা হরষ, তা আমরা বলতে পারি না। তবে আমরা তার সমূহ পতন অবলোকন করতে থাকি; তার মুখের দিকে তাকিয়ে খালেদ জামিল বলে ওঠে, প্লিজ প্লিজ ইউ ডিজার্ভ ইট, এখানে পুরো ত্রিশ হাজার আছে। এরপরও অবশ্য আবু ইব্রাহীম তার চেহারাটাকে প্রসন্ন করে তোলে না, সে কেমন নিরস কণ্ঠে বলে, আমি তো বলেছি আমাকে ভালোমতো দেখতে হবে ব্যাপারটা। তখন মনে হয় যেন নিউটন যেমন পতনশীল বস্তু দেখে বলবিদ্যার একটি সূত্র আবিষ্কার করেছিল তেমনি পতনশীল আবু ইব্রাহীমের দিকে তাকিয়ে খালেদ জামিল মানুষের আচরণের একটি সূত্র অনুধাবন করে। সে বলে, আপনাকে কোনো অন্যায় করতে হবে না। তারপর সেদিন খালেদ জামিল যখন আবু ইব্রাহীমের বাসা থেকে বিদায় নেয়, সে প্রথমে কিছুক্ষণ নির্লিপ্তের মতো বসে থাকে, তারপর সে টাকার বান্ডিলটা বের করে ভেতরের ঘরে গিয়ে স্টিলের আলমারির ড্রয়ারের ভেতর প্যাকেটটি রেখে চাবি দিয়ে তালা লাগিয়ে দেয় এবং তারপর সে প্রতিদিনের মতো ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়ায় এবং মিন্টো রোডের ঝাঁকড়া গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে অফিসের নথি পরীক্ষা করে দেখতে থাকে; তার মনে পড়ে যে খালেদ জামিলের ফার্মের প্রস্তাবিত দর সর্বনিম্ন নয়, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং সর্বনিম্ন বাতিল দরপত্রের চাইতে এই দর টন প্রতি দু ডলার বেশি। তখন একটি পোকা উড়ে এসে তার মুখের ওপর পড়ে, সে হাত দিয়ে পোকাটিকে সরিয়ে দিয়ে হিসেব করে দেখে যে, দশ হাজার টনে এই পার্থক্য দাঁড়ায় বিশ হাজার ডলার এবং তার মনে হয় যে, এ অনেক টাকা। তখন বিন্দু আর শুভ এসে পড়তে বসে এবং আবু ইব্রাহীম ওদের কাছে বসে খবরের কাগজে পুনরায় চোখ বুলায়। কাগজের ভেতরের পাতায় সিনেমার বিজ্ঞাপনের ওপর চোখ রেখে তার মনে হয় যে, সর্বনিম্ন দরপত্রদাতাকে একটি সুযোগ দিলে এতগুলো টাকা বেঁচে যায়। তখন তার খালেদ জামিলের দিয়ে যাওয়া প্যাকেটটির কথা মনে পড়ে এবং সে পুনরায় নূতন করে সব ভাবতে থাকে। শুভকে অঙ্ক কষতে সাহায্য করতে করতে মমতা একবার তাকে জিজ্ঞেস করে যে, সে বাড়ি যাবে কিনা। আবু ইব্রাহীম ঠিকমতো তার কথার উত্তর দেয় না। সে ভেবে দেখতে থাকে ত্রিশ হাজার ক্যাশ টাকা থাকার পরও রূপনগরের প্লট কেনার টাকার জন্য তাকে দেশে যেতে হবে কিনা। কিন্তু তার মনে হয় যে, খালেদ জামিল এই ব্যবসাটি পেতে পারে না। তখন সে পুরো জিনিসটা আবার খতিয়ে দেখতে থাকে। এভাবে সে একটি ঘোরের ভেতর পড়ে যায়, বিন্দু আর শুভর পড়াশোনা শেষে খাওয়া-দাওয়া করে এবং খানিকটা টেলিভিশন দেখার পর সকলে যখন শুয়ে পড়ে, তখনো সে সিমেন্ট কেনার প্রস্তাব সম্পর্কিত ভাবনায় ব্যস্ত থাকে। পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমেই সে ফাইলটি নিয়ে বসে সবকিছু আবার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে এবং এক আনন্দময় উঘাটনের মতো সে একটি সমাধান খুঁজে পায়। তখন সে তার স্টেনোটাইপিস্টকে ডেকে ডিকটেশন দেয়, তারপর সকাল দশটার দিকে খালেদ জামিল তাকে ফোন করে।
কেমন আছেন ভাই?
এইতো, আপনি কেমন আছেন?
জ্বি ভালো, আবু ইব্রাহীম খালেদ জামিলের অসাময়িক এবং দরাজ কণ্ঠস্বর শোনে, আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি।
কেন?
এমনি। বাই দা বাই, ফাইলটা কি ধরেছেন?
হ্যাঁ, নোট টাইপ হচ্ছে।
সব কিছু ঠিক আছে?
হ্যাঁ।
জুপিটার এন্টারপ্রাইজ ইজ গেটিং দি বিজনেস?
হ্যাঁ তবে প্রাইস অ্যাডজাস্ট করতে হবে লোয়েস্ট প্রাইসের সঙ্গে।
এইতো স্যার মেরে দিলেন।
কোনো উপায় নাই।
একটু প্লিজ দেখেন, এটা পারা যাবে না, আমার প্রিন্সিপাল রাজি হবে না, হেভি লস হয়ে যাবে।
কোনো ওয়ে আউট দেখছি না।
তবু আর একবার বিবেচনা করেন, আপনি সরাসরি জুপিটার এন্টারপ্রাইজের অফার গ্রহণ করার প্রস্তাব দিতে পারেন।
না পারি না, ব্যবসটা লোয়েস্ট বিডারকেও দেওয়া যায়; প্যাকিং স্পেসিফিকেশনের যে হেরফের আছে সেটা একেবারে ইনসিগনিফিকেন্ট। প্যাকিং এর ব্যাপারটা এখনো নেগোসিয়েট করা যায় এবং এটা করলে বিশ হাজার ডলার কম লাগে। কাজেই ব্যবসাটা বরং আপনার জুপিটার এন্টারপ্রাইজ পাক, কিন্তু প্রাইসটা দু ডলার করে কমানো হলে জিনিসটা ঠিক হয়। আমার অবস্থাটা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন।
খালেদ জামিল বলে, আপনি তবু আর একবার দেখেন এবং তারপর সে টেলিফোন রেখে দেয়, আবু ইব্রাহীম বিষয়টি নিয়ে আর ভাবে না; সিমেন্ট কেনার ফাইলের নোট টাইপ হয়ে এলে সে সেটি রেখে একটি মিটিং এ যোগ দিতে যায় এবং মিটিং শেষে বাসায় ফেরে। সেদিন দুপুরে খেতে বসে মমতাকে সে ত্রিশ হাজার টাকার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানায় এবং মমতা এর উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলে, হাউজ বিল্ডিং অ্যাডভ্যান্স নিছি। সে আরো বলে যে, আরো হাজার দশেক টাকা যোগাড় করতে হবে এই উদ্দেশ্যে সে শীঘ্রই দেশের বাড়ি যেতে পারে। মমতার সঙ্গে তার জমির প্লট কেনার টাকা পয়সা এবং গ্রামের বাড়ি যাওয়ার বিষয়ে আর কোনো কথা হয় না। সেই দুপুরে আবু ইব্রাহীম মমতাকে দেশের বাড়ি যাওয়ার কথা বলার পর খানিকটা ঘুমায়। পরদিন তার অফিসে খালেদ জামিল আসে এবং দেখে যে, ফাইলটি তখনো আবু ইব্রাহীমের টেবিলের উপর পড়ে আছে। খালেদ জামিল প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হাসে এবং মলিন চেহারার আবু ইব্রাহীমের হাত ঝাঁকিয়ে উষ্ণ করে তোলে।
কেমন আছেন?
এত কিছুর পরও আবু ইব্রাহীমের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে না, সে তার চোখের কোণ একটু কুঁচকে রাখে, ঠোঁট হাসির মতো করে টিপে রাখে, নিজেকে ছেড়ে দিতে পারে না, আড়ষ্ট হয়ে বলে, জ্বি ভালো, আপনি ভালো আছেন?
জ্বি, ফাইলটা কি পুট আপ করেছেন?
না, এই তো ফাইল, পুট আপ করব।
যা বলেছিলেন তাই?
হ্যাঁ। তারপর নিচু এবং শুকনো স্বরে কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে সে বলল, বুঝতেই পারছেন, আমি চাকরি করি।
খালেদ জামিল তার এই কথা শুনে ভুল করে একটু হাসে এবং এভাবেই সে ভুল করতে থাকে, অথবা এভাবেই সে যেন এক পরিচয় থেকে অন্য এক পরিচয়ের ভেতর এসে দাঁড়ায় এবং দুর্ভাগ্যক্রমে আবু ইব্রাহীম তার বিসর্জিত চেতনার প্রান্ত থেকে তাকে শনাক্ত করে। খালেদ জামিলের মুখের এই হাসিটি তার খারাপ লাগে, তার মনে হয় কৈফিয়ত দেওয়া তার উচিত হয়নি। কিন্তু খালেদ জামিল আবু ইব্রাহীমকে বুঝতে পারে না। সে তার ডান হাত প্রসারিত করে টেবিলের উপর স্থাপন করে, তারপর আবু ইব্রাহীমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, চাকরিকে এত ভয় পান কেন?
আবু ইব্রাহীম এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে অসহায়ের মতো ঠোঁটে নীরব হাসি ধরে রাখে।
চাকরি আপনাদের কিছুই দেয় না। তবুও সব সময় ভয় পান।
আবু ইব্রাহীম তারপরেও চুপ করে থাকলেও খালেদ জামিল আরো উৎসাহিত হয়ে হয়ে বলে, ভয় না পেয়ে জীবনে রিস্ক নিতে হয়।
তাই!
চাকরি কারো যায় না; গেলে এদেশে কারো চাকরি থাকত না।
চাকরি আবার যায়ও, আবু ইব্রাহীম বলে।
আচ্ছা ঠিক আছে, যদিবা যায়-ই তাতে ক্ষতি কি? আমিতো চাকরি করিনি, তাতে আমার কি ক্ষতি হয়েছে?
সবাই তো ব্যবসা করতে পারে না।
তা অবশ্য পারে না। খালেদ জামিল তখন সিগারেট ধরিয়ে লম্বা করে টান দিয়ে বলে, আপনি কি কখনো ব্যবসা করার কথা ভেবেছেন।
ব্যবসা করার কথা প্রত্যেক চাকরিজীবীই ভাবে।
তা ঠিক। ব্যবসা সম্পর্ক আপনার কি মনে হয়?
কঠিন জিনিস।
কথা বলতে বলতে খালেদ জামিল সম্ভবত তার সাবধানতার অর্গল মুক্ত করেছিল, কারণ সে বলে, ইট ইজ ভেরি মাচ চ্যালেঞ্জিং, আমি এটা উপভোগ করি। ইটস এ শর্ট অফ এ গেম। আই ক্যান পারসু এনিবডি। আমি যে কোনো পরিস্থিতিতে কাজ করিয়ে আনতে পারি।
তাই!
আসলেই তাই। এভরিবডি ইজ ম্যানেজেবল অ্যান্ড এভরিবডি কুডবি পারচেজড্।
এভাবে খালেদ জামিল তার চূড়ান্ত বাক্যটিতে অত্যন্ত অসতর্কতা এবং অবহেলার সঙ্গে উচ্চারণ করে এবং এর ফলে আবু ইব্রাহীম তার অফিসের আলোবাতাসহীন ঘরের ভেতর বসে খালেদ জামিল এবং একই সঙ্গে নিজেকে এক পরিবর্তিত প্রেক্ষিতের ওপর ভিন্ন অবয়বে দণ্ডায়মান দেখতে পায়। খালেদ জামিল কয়েকটি মুহূর্তে নেয় বিষয়টি অনুধাবনে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে, আপনি প্লিজ মাইন্ড করবেন না। ইউ আর মাই ফ্রেন্ড। তখন তারা অনেকক্ষণ কোনো কথা না বলে বসে থাকে। তারপর খালেদ জামিল বলে, ফাইলটা কি আজকে ছেড়ে দেবেন?
হ্যাঁ।
খালেদ জামিলের আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয় না, সে হেসে করমর্দন করে চলে যায় তখন আবু ইব্রাহীম বসে থাকে, সে পুরো পরিস্থিতিটা বুঝতে পারে এবং খুবই বিচলিত হয়ে ওঠে। সে সিমেন্ট কেনার প্রস্তাবের ফাইল আলমারিতে তালা বদ্ধ করে রেখে সিদ্দিক হোসেনের অফিসে যায়। আবু ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর কোনো কারণ ছাড়াই সিদ্দিক সাহেবের একবার এই দিনটির কথা মনে পড়েছিল, তার মনে হয়েছিল যে, সতত বিষণ্ণ আবু ইব্রাহীমের মুখে নিদাঘ দিনের পুকুরের পানির মতো নিষ্কম্প একটি কিছু স্থির হয়ে আছে; হয়তো সেটা ছিল আরো খানিকটা বিষণ্ণতা, হতাশা অথবা কোনো এক স্পৃহা; কারণ সিদ্দিক হোসেনের মনে পড়ে যে, সে দিন আবু ইব্রাহীম প্রবল বিকারের মতো অথচ স্থির ও নিচু কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিল, আই অ্যাম এ বাস্টার্ড! আবু ইব্রাহীম সিদ্দিক হোসেনের অফিস থেকে বের হয়ে সেদিন দুপুরে বারোটার আগেই বাসায় ফিরে আসে এবং মাথা ধরছে বলে দুটো ডিসপ্রিন বড়ি খেয়ে শুয়ে থাকে। তার এই মাথা ধরা সারাদিন এবং সারারাত থাকে। পরদিন অফিসে যাওয়ার আগে সে পানিতে গুলে পুনরায় দুটো ডিসপ্রিন খায়। অফিসে গিয়ে সে সিমেন্টের ফাইল নিয়ে বসে এবং দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে। সে ফাইলের পূর্বে লেখা নোট ছিঁড়ে ফেলে স্টেনোকে ডেকে ডিকটেশন দেয়, তারপর নোট টাইপ করা হয়ে গেলে সাইন করে ফাইল ছেড়ে দেয়। তারপর নটার দিকে বের হয়ে সে সিদ্দিক হোসেনের ওখানে গিয়ে চা খায় এবং গল্প করে। বারোটার সময় নিজের অফিস কামরায় ফিরে সে দেখতে পায় যে, খালেদ জামিল এসে বসে রয়েছে এবং তার মনে হয় যে, সে জানত, এই লোকটি এসে বসে থাকবে। খালেদ জামিল তাকে দেখে এক গাল হেসে বলে, কোথায় গিয়েছিলেন?
আবু ইব্রাহীম বলে, এই।
ফাইলটা ছেড়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ।
খালেদ জামিল তখন পুনরায় গলি ভরে হাসে এবং বলে ঠিক আছে। তারপর সে চকচকে কালো ব্রিফকেসটা টেনে নিয়ে গাত্রোত্থানের জন্য তৈরি হয়। তখন আবু ইব্রাহীম তার মুখের দিকে একবার নির্লিপ্তভাবে তাকায় এবং তার এই দৃষ্টির সামনে খালেদ জামিল পুনরায় তার অলৌকিক হাসির পেখম মেলে ধরে। আবু ইব্রাহীম চোখ নামিয়ে নিয়ে নিচুস্বরে বলে, আসলে পুরো প্রস্তাবটা এবং কাগজপত্রগুলো আমি আবার পড়ে দেখলাম।
আবু ইব্রাহীমের কথা শুনে খালেদ জামিলের কোনো ভাবান্তর হয় না; সে একইভাবে আবু ইব্রাহীমের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন আবু ইব্রাহীম পুনরায় চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, লোয়েস্ট বিডারকে স্পেসিফিকেশন ঠিক করার জন্য অফার দেওয়া উচিত এবং সে সেটা করতে রাজি হলে এই টেন্ডার তারই পাওয়া উচিত। সে রাজি না হলেই কেবল দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে নিগোশিয়েট করা যেতে পারে প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য।
এরপরও আবু ইব্রাহীম খালেদ জামিলের চেহারায় কোনো অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার ছায়া দেখে না; সে শুধু বলে, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
এটাই ন্যায়সঙ্গত, আবু ইব্রাহীম বলে। তার কথা শুনে খালেদ জামিলের চেহারায় ক্রমে বিভ্রান্তির ভাব ফুটে উঠতে থাকে এবং সে বলে, তাই?
আমার তাই মনে হয়।
তাহলে কি লিখলেন ফাইলে?
এটাই লিখেছি।
আর ইউ সিউর? ইয়েস।
তখন আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যে, খালেদ জামিলের চেহারায় সে যা দেখছে তা শুধুই হাতাশা এবং খালেদ জামিল এক বিস্ময়কর ক্লান্তস্বরে তাকে বলে, কেন এটা করলেন?
এটাই ন্যায্য।
খালেদ জামিল কিছুক্ষণ বিচলিত হয়ে চুপ করে থাকে, তারপর বলে, আর ইউ গিভিং দি মানি ব্যাক?
কিসের মানি?
খালেদ জামিল মনে হয় যেন আবু ইব্রাহীমের আর একটু বুঝতে পারে না, সে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায়। আমরা যখন এই বিষয়টি জানি তখন আমাদের কাছেও তার এই আচরণ বোধের অগম্য বলে মনে হয়। তবে আমরা অনুমান করতে পারি যে, এখানেও আবু ইব্রাহীমের হয়তো একটি হিসেব ছিল। কিসের টাকা, এই প্রশ্নটি করে সে খালেদ জামিলের মুখের উপর তার দৃষ্টি স্থাপন করে রাখে এবং দেখতে পায় যে, খালেদ জামিলের ঠোঁটের দুকোণ চেপে আসে। কিন্তু এই নাটকের এই দৃশ্যের রচনাটি ভালোমতো উপভোগ করতে পারার আগেই সে প্রবল বিস্ময় এবং উৎকণ্ঠার সঙ্গে দেখে যে, খালেদ জামিল ঝাকি দিয়ে নিজেকে বিহ্বলতা থেকে মুক্ত করে এবং বলে, ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে দেখা হবে; তারপর সে চলে যায়। আবু ইব্রাহীমের তখন অনেক কিছু ভাবার ছিল এবং প্রথমে যে কথাটি সে ভাবে তা হচ্ছে এই যে, খালেদ জামিল পুলিশের কাছে যাবে না, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্তও করবে না। কিন্তু যে কথাটি সে ভেবে বের করতে পারে না তা হচ্ছে এই যে, খালেদ জামিল আসলে কি করবে এখন? এই অবস্থায় পরদিন খালেদ জামিল তাকে ফোন করে।
আমি খালেদ বলছি।
জ্বি।
ফাইলটা কি নেমেছে?
না।
নাউ টেল মি অ্যাবাউট দি মানি ইউ হ্যাভ টেকেন।
কিসের মানি?
আপনি জানেন না?
আপনি বলেন।
লিসেন জেন্টেলম্যান ইউ আর প্লেয়িং উইথ ফায়ার।
আমি ব্যস্ত আছি, রাখব।
খালেদ জামিল চুপ করে থাকে, আবু ইব্রাহীম টেলিফোন রেখে দেয়। পরদিন আবু ইব্রাহীম দুদিন ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি যায় এবং তার শ্বশুরকে চল্লিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করে দিতে বলে আসে। পরবর্তী সোমবারে অফিসে গিয়ে সে দেখে যে, সিমেন্টের ফাইল নেমে এসেছে এবং সে দেখে যে, সে যেভাবে বলেছিল, সেভাবেই প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়েছে। আবু ইব্রাহীম এই সিদ্ধান্তের কথা বাণিজ্যে সংস্থাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয় এবং এর একটু পরে সে খালেদ জামিলের টেলিফোন পায়। আপনি আমার সঙ্গে বেঈমানি করেছেন।
আপনি বাজে কথা বলবেন না।
এ জন্য আপনাকে ভুগতে হবে।
ভয় দেখাবেন না।
ওকে, আই ওয়ান্ট মাই মানি ব্যাক।
কিসের মানি আপনার?
আপনি আমাকে চেনেন না ইব্রাহীম সাহেব, প্লিজ ডোন্ট পুল মাই লেগ।
সরি, রাখি।
আবু ইব্রাহীম টেলিফোন রেখে দেয় এবং একটি ফাইলের ওপর কাজ শুরু করে; তখন কিছুক্ষণ পর খালেদ জামিল তার ঘরে এসে ঢোকে। তাকে দেখে আবু ইব্রাহীমের হৃৎপিণ্ডটি ছটফট করে ওঠে, কিন্তু সে সুস্থিরভাব ধরে রাখে এবং দেখে খালেদ জামিলের মুখটি একখণ্ড কৃষ্ণবর্ণ মেঘের মতো থমকে আছে। খালেদ জামিল আবু ইব্রাহীমকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে যে, সে কেন এই খেলা খেলছে এবং তার হতাশা ও ক্ষোভ বেড়ে যায় যখন আবু ইব্রাহীম উত্তর দেয় যে, সে তার কথা বুঝতে পারছে না। তখন খালেদ জামিল নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ঠিক আছে। আমিও বুঝতে পারি নাই, আই অ্যাডমিট। নাউ আই ওয়ান্ট মাই মানি ব্যাক।
টাকাটা কিসের?
খালেদ জামিলের মেঘাচ্ছন্ন মুখটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ক্রমাগতভাবে জ্বলে ওঠে, সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে এবং চেয়ার পিছন দিকে ঝাকি দিয়ে ঠেলে, উঠে চলে যায়। পরদিন খালেদ জামিল, লোকজনে অফিস ভরে ওঠার আগে, খুব সকালে আবু ইব্রাহীমের অফিস রুমে এসে ঢোকে এবং কোনো কথা না বলে তার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে। তখন আবু ইব্রাহীমের এক ধরনের ভয় হয়, কিন্তু চুপ করে অপেক্ষা করা ছাড়া তার কিছু করার থাকে না।
আমি আপনার আসল কথাটা জানতে চাই!
কোন বিষয়ে?
আবু ইব্রাহীমের এই আতঙ্ক হতে থাকে যে, তার কথা শুনে খালেদ জামিল হয়তো এইবার ভেঙে খানখান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু খালেদ জামিল এরপরও নিজেকে ধরে রাখে, তার চোখের পাতা কাপে এবং এই কম্পন আটকাতে গেলে তার চোখের কোণ কুঁচকে আসে, সে নিচু স্বরে বলে, অ্যাবাউট দি মানি ইউ টুক ফ্রম মি।
আমি আপনার কাছ থেকে কোনো টাকা নিইনি, যা বলার প্রোপারলি বলবেন।
খালেদ জামিল টেবিলের উপর পেতে রাখা তার হাতের মুঠ বন্ধ করে আবার খোলে, সে বলে, ওকে, ওকে, অ্যাবাউট দি মানি আই গেভ ইউ।
কিন্তু খালেদ জামিলের কথায় এরপরেও আবু ইব্রাহীম সন্তুষ্ট হয় না, মনে হয় যেন সে খালেদ জামিলকে একটি পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়, তাই যেন সে বলে, কিসের টাকা? আপনি আমাকে কেন টাকা দিতে যাবেন?
খালেদ জামিলের চোখ কুঁচকে থাকে; সে বলে, আপনি আমার টাকা ফেরত দিতে চান না?
কি বলেন আপনি, কিসের টাকা আপনার?
খালেদ জামিল তখন পুনরায় তার ঠোঁট কামড়ে ধরে এবং ক্ষিপ্তের মতো বলে, আই গেভ ইট অ্যাজি ব্রাইব, আপনি ঘুষ নিয়েছেন আমার কাছ থেকে, কিন্তু কাজ করেন নাই।
আবু ইব্রাহীম খালেদ জামিলের মুখের দিকে তাকায় এবং যখন তার চেহারায় ক্ষিপ্ততার সঙ্গে হতাশা এসে মিশে যেতে থাকে তখন সে বলে, সো ইউ গিভ ব্রাইব, আপনি তাহলে ঘুষ দেন!
খালেদ জামিল চুপ করে থাকে, তারপর বলে, ইউ আর জাস্ট প্লেয়িং এ ইউজলেস গেইম।
হোয়াই নট।
আপনি আমার টাকা দেবেন না?
আবু ইব্রাহীম তখন তার মুখ নিচু করে, মাথা ঝাকায়, বলে, হ্যাঁ দেব।
খালেদ জামিল বিস্ময় অথবা অন্য কোনো কারণে বাকরহিত হয়ে অপেক্ষা করে, কিন্তু আবু ইব্রাহীম আর কিছু না বললে সে বলে, আমি কি আপনার বাসায় আসব?
না।
তা হলে?
আমি এনে আপনাকে দিয়ে দেব।
কবে?
কালকে।
আমি কি এখানে আসব?
না আপনি এখানে আসবেন না। কাল দশটার সময় আপনি জিপিওর সামনে অপেক্ষা করবেন, আমি আসব।
আবু ইব্রাহীম এইসব বাড়াবাড়ি কেন করেছিল তা খালেদ জামিল বুঝতে পারে নাই এবং মনে হয় আমরাও হয়তো আবু ইব্রাহীমকে বুঝতে পারব না। বস্তুত তাকে বুঝে ওঠার আগেই, আর চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ে সে তার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পড়ে। সে দিনটি ছিল মঙ্গলবার, সকালে অফিসে যাওয়ার সময় আবু ইব্রাহীম ত্রিশ হাজার টাকার প্যাকেটটি বের করে তার ফোলিও ব্যাগের ভেতর পুরে নেয়, মমতাকে বলে যে, টাকাটা একজন লোককে দিতে হবে এবং মমতা কোনো কথা বলতে পারার আগেই সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তারপর তার ঘড়িতে যখন দশটা বাজে সে টাকার প্যাকেটটা পকেটে পুজে নিয়ে জিপিওর সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু খালেদ জামিলকে সে দেখে না। সে যখন অপেক্ষা করতে থাকে তখন কিছুক্ষণ পর হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে দুজন যুবক তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় এবং ফিসফিস করে বলে, যা আছে দিয়া দেন। আবু ইব্রাহীম শুধু এক মুহূর্তের জন্য চমকানোর সুযোগ পায়, তারপর তিনটি ক্রিয়া প্রায় এই সময়ের ভেতর ঘটে যায়। একজন যুবক আবু ইব্রাহীমের বাহু আকর্ষণ করে তার ফুলে থাকা প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলে, ইব্রাহীম বলে ওঠে, আরে এবং ঠিক তখনই দ্বিতীয় যুবকটি তার ডান হাতটি ওঠায়; আবু ইব্রাহীম শুধু সূর্যের আলোয় একটি রূপালি ঝিলিক দেখে এবং সে আর কোনো শব্দ বা ধ্বনি উচ্চারণ করার আগেই যুবকটি চাকুর ফলা তার বাম বুকে হৃৎপিণ্ডের ভেতর প্রোথিত করে দেয়। আবু ইব্রাহীম কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব নির্বাপিত হয়, যুবক দুটি তার পতনশীল দেহটি ধরে রাস্তার উপর শুইয়ে দিয়ে, আশপাশের লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড়াতে দৌড়াতে বায়তুল মোকাররমের দিকে চলে যায়।