০৪. আদিম শ্রেণীহীন সমাজ

আদিম শ্রেণীহীন সমাজ

আদিম শ্রেণীহীন সমাজ ছেড়ে মানুষ এল শ্রেণীসমাজের আওতায়। কী করে, কোন প্ৰাখিব প্রভাবের ফলে অতীতের মানুষ ইতিহাসের এই পথটুকু অতিক্রম করল? হাতিয়ারের উন্নতি; এই উন্নতিই মানুষকে দেখাল। প্ৰকৃতির কাছে মুক দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পথ, আবার এই উন্নতির কৃপাতেই একদল মানুষ ক্ৰমে ক্ৰমে বাকি সকলকে দাসত্ব-শৃঙ্খলে বাধতে পারল। সমাজের এই পরিবর্তন কীভাবে সংস্কৃতির স্তরে প্রতিফলিত হয়েছে, তার কথা মনে রাখতে হবে। আদিম শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীসমাজ। আর তারই প্ৰতিচ্ছবি : ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম।

ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, ধর্ম ইন্দ্ৰজালের উন্নত আর সংস্কৃত সংস্করণমাত্র। বুর্জোয়া পণ্ডিত-মহলে এই ভ্ৰান্ত ধারণা ঘুরে ফিরে অনেকবার দেখা দিয়েছে। অনেকেই চেষ্টা করেছেন ইন্দ্ৰজালের মধ্যেই ধর্মের উৎস খুঁজতে, অনেকে চেয়েছেন ধর্মকে ইন্দ্ৰজালেরই সভ্য সংস্করণ বলে প্রচার করতে। যেন আদিম মানুষের অন্বেষণ-বৃত্তি প্রথমটায় অতি স্থূল আর প্রাকৃত তত্ত্ববোধে আশ্রয় পেয়েছিল, তারই নাম ইন্দ্ৰজাল; ক্ৰমে সেই তত্ত্ববোধ উন্নত আর সংস্কৃত হতে হতে ধর্মের রূপ নিল। অর্থাৎ এই বিচার অনুসারে ইন্দ্ৰজাল আর ধর্ম-র মধ্যে গুণগত তফাত–জাতের তফাত–যেন নেই। তফাত যেটুকু, সেটুকু নেহাতই স্কুলের সঙ্গে সুন্মের তফাত।

অথচ, জাতের তফাতটাই দুয়ের মধ্যে আসল তফাত। ভুয়োদর্শনের সুস্থ প্রভাবের ফলে স্তর জেমস ফ্রেজারের বুর্জোয়া দৃষ্টিও এই বিষয়কে উপেক্ষা করতে পারেনি। তিনিও মানছেন যে, ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে ধর্মের শুধু উদ্দেশ্য ভেদই নয়, উপায়-ভেদও বর্তমান। ইন্দ্ৰজালের উদ্দেশ্য হলো প্ৰকৃতিকে বশ করা; প্ৰকৃতিকে জয় কৱা; ধর্মের উদ্দেশ্য হলো দেবতাকে সন্তুষ্ট করে তার কাছে কৃপা ভিক্ষা করা। জয় করা আর ভিক্ষা চাওয়া–উদ্দেশ্যের দিক থেকে গুণগত প্ৰভেদ বই কী। তা ছাড়া, উপায়ের দিক থেকেও তফাতটা অত্যন্ত গভীর ও গুরুতর : প্ৰকৃতিকে বশ করতে গিয়ে ইন্দ্ৰজাল আবিষ্কার করতে চায় প্ৰাকৃতিক নিয়ম-কানুনকে–প্ৰকৃতির রাজ্যে কাৰ্য-কারণ সম্বন্ধকে। তাই, যত অস্পষ্ট আর যত অব্যক্ত ভাবেই হোক না কেন, ইন্দ্ৰজালের পেছনে নিশ্চয়ই এই বিশ্বাসই নিহিত যে, প্ৰকৃতির দাসত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো প্ৰকৃতির অমোঘ নিয়মকে চিনতে পারা। ইন্দ্ৰজালের যা প্ৰাপ্য, তার চেয়ে বেশি। উজ্জ্বাস করবার প্রয়োজন নেই-প্রকৃতির দাসত্ব থেকে মুক্তির আসল পথ যে প্ৰকৃতির নিয়মকেই চিনতে শেখা, এই বোধ ইন্দ্ৰজালের পেছনে অব্যক্ত ও অচেতন। কল্পনার কুত্মটিকায় আবিল, তবু এই বোধের অস্তিত্বটুকুকে উড়িয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। অপর দিকে ধর্মের পেছনে উপায় হিসেবে কোন বোধের উপর নির্ভরতা? প্রার্থনা দিয়ে করুণার উদ্রেক, স্তবস্তুতির খোশামোদ দিয়ে মন গলানো, আহুতির ঘুষ দিয়ে হাত করা। মানুষের প্রথম ধর্ম চেতনা-সব দেশের বেলাতেই মোটামুটি একই রকম-প্ৰকৃতির অধিষ্ঠাতা আর অধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীর সন্ধান করেছে ৷ প্ৰকৃতির রাজ্যে নিয়মের সন্ধান নয়, কেননা এইসব দেবদেবীর মধ্যে আর যাই থাক, নিয়মের শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। খেয়ালী বড়লোকদের মতো এই সব দেবদেবীর দল; অসীম তাদের শক্তি; তবু ভিক্ষে চাইলে তারা ভিক্ষে দিতেও পারে, খোেশামোদ শুনলে খুশি হয়, ঘুষ পেলে সিদ্ধি দেয়।

এবং ফ্রেজার ঠিকই বলেছেন যে, আসলে বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের যে বিরোধ, মােটামুটি সেই বিরোধই ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে ধর্মের, কেননা अभि रेखांबांनी आधूनिक दिखांप्नब्ररे आनि-भूक्ष। ज्ञ् ऊारेनब्र,-नानांन দেশে নানানভাবে ইন্দ্ৰজাল আর ধর্মের মেশামেশি। সত্ত্বেও,-ফ্রেজার স্পষ্টই অনুভব করেছেন যে, ইন্দ্ৰজাল-কে ধর্মের চেয়ে প্রাচীন বলে স্বীকার করতেই হবে। “যদিও বহু যুগে বহু দেশে দেখতে পাওয়া যায়, ইন্দ্ৰজাল আর ধর্ম মিশে রয়েছে, তবুও কয়েকটি কারণের দরুন মনে করা উচিত যে, এই মেশামিশি আদিম নয়।”

কিন্তু এই সব কারণগুলির স্বরূপ কী? ফ্রেজারের মতে প্ৰধানত দুরকম। প্রথমত, ইন্দ্ৰজাল এবং ধর্মের মূল ধারণাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ইন্দ্রজালের ভিত্তি হলো ধারণার অনুষঙ্গ (association of ideas), এবং ধর্মের ভিত্তি হলো প্ৰকৃতির অধিষ্ঠাতা-অধিষ্ঠাত্রী চৈতন্য-এবং-ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন দেবদেবীর কথা। এ কথা তো স্পষ্টই যে, ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন শক্তির ধারণা নিছক ধারণার অনুষঙ্গের চেয়ে অনেক জটিল এবং অনেক উন্নত। দ্বিতীয়ত,–এবং এইটেই হলো ফ্রেজারের বৈজ্ঞানিক মহত্ত্ব যে, পদে পদে তিনি পরিদর্শনের উপর নির্ভর করতে চান–পৃথিবীর বুকে আজও যে সব জাতি সভ্যতার নিম্নতম স্তরে পড়ে আছে, তাদের মধ্যে ধর্ম দেখা দেয়নি, আছে শুধু ইন্দ্ৰজাল। ফ্রেজার বলছেন, অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের কথা। আশ্চৰ্য দেশ এই অষ্ট্রেলিয়া,–এর আকার অপেক্ষাকৃত ছোট, এর মধ্যে জলের অভাব এবং মরুদেশের প্রাচুৰ্য, এবং অন্যান্য মহাদেশের সঙ্গে এর যোগাযোগ না থাকার দরুণ আজও এই দেশ যেন “অতীত জিনিসের জাদুঘর” হয়ে রয়েছে। অন্যান্য দেশে যে-সব গাছগাছড়া আর পশুপাখি আজ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, সেইসব গাছগাছড়া আর পশুপাখি আজও এখানে টিকে আছে, এবং সেই সঙ্গে টিকে আছে আদিম মানবসমাজের নিদর্শনও। আর সে সমাজে ধর্মের চিহ্ন নেই, আছে ইন্দ্ৰজালের। মোটামুটি বলা যায়, ফ্রেজার বলছেন, অষ্ট্রেলিয়ার সব আদিম অধিবাসীই ইন্দ্ৰজাল-বিদ বা মায়াবী, কিন্তু পুরোহিত একজনও নয়। সভ্যতার এই নিম্নতম নিদর্শনে যদি দেখা যায় শুধু ইন্দ্রজাল, অপেক্ষাকৃত উন্নততর স্তরে ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে ধর্মের মেশা মিশি-প্ৰাচীন ভারত, মিশর প্রভৃতি থেকে শুরু করে আধুনিক য়ুরোপের অপেক্ষাকৃত পিছনে-পড়ে-থাকা সমাজ পৰ্যন্ত-এবং সভ্যতার উচ্চতর স্তরে যদি দেখা যায় শুধু ধর্ম, তাহলে বুঝতে হবে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ইন্দ্ৰজালকে পেছনে ফেলে ক্রমশ এগিয়েছে ধর্মের দিকে।

ফ্রেজারের বৈজ্ঞানিক নিষ্ঠা অসামান্য, এবং এক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তও–ধর্ম এবং ইন্দ্ৰজালে জাতের তফাত, এবং এই দুয়ের মধ্যে ইন্দ্ৰজাল প্ৰাচীনতরঅবশ্যই স্বীকাৰ্য। এবং ইন্দ্ৰজালের প্রাচীনতার পক্ষে উপরোক্ত যে দুটি প্রমাণ তিনি দিয়েছেন, তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রমাণের গুরুত্ব নিশ্চয়ই মানতে হবে। কিন্তু তার দুর্বলতা ও দৃষ্টির সংকীর্ণতা ধরা পড়ে উপরোক্ত প্ৰথম প্ৰমাণের মধ্যে। ইন্দ্ৰজাল প্ৰকৃতির অন্তর্নিহিত অমোঘ আইনকানুনকে আবিষ্কার করে প্রকৃতিকে জয় করতে চায়, ইন্দ্ৰজাল আধুনিক বিজ্ঞানেরই আদি পুরুষ-তবুও ইন্দ্রজালের তুলনায় ফ্রেজার ধর্মকে মহত্তর ও উন্নততর মানব-সংস্কৃতি মনে করতে বাধ্য হয়েছেন ৷ এক এই উন্নত লক্ষণ থেকেই প্ৰমাণ, ফ্রেজার মনে করেছেন, যে, ধর্ম উন্নততর মানব-সমাজের সংস্কৃতি। এখানেই ফ্রেজারের বুর্জোয়া দৃষ্টি তাঁর বৈজ্ঞানিক চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছে।

বুর্জেয়া দৃষ্টিকোণের সংকীর্ণতা। সেই সংকীর্ণতা সাম্য-জীবনের স্বরূপএবং তারই প্ৰতিচ্ছবি যে সংস্কৃতিতে, সেই সংস্কৃতির স্বরূপকেও-বোঝাবার পথে পরিপন্থী। তাই, ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম, সংস্কৃতির ইতিহাসে এই পথটুকুকে বুঝতে হলে সামাজিক পরিপ্রেক্ষাকে মনে রাখা একান্তভাবে দরকার, মনে রাখা দরকার মানুষের পক্ষে আদিম শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এসে পড়বার কথা।

আদিম অবিভক্ত সমাজের পটভূমি ছাড়া ইন্দ্ৰজালকে বোঝবার উপায় নেই। কেননা, যত অস্পষ্টভাবেই হোক, যত অচেতনভাবেই হোক, ইন্দ্ৰজালের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানেরই পূর্বাভাস। প্রকৃত বিজ্ঞানের দুটো প্ৰধান দিক ৷ এক হলো প্রয়োগের উপর ঝোক – উৎসাহটা প্ৰকৃতিকে জয় করবার, প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্ৰাম করবার। আর দ্বিতীয় দিক হলো প্ৰকৃতিকে জয় করবার জন্যে প্ৰকৃতির অমোঘ নিয়মকে আবিষ্কার করবার চেষ্টা। অর্থাৎ প্ৰকৃত বিজ্ঞানের মূলে এ চেতনা বর্তমান যে, প্ৰকৃতির নিয়মকে চিনতে শেখার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত মুক্তি। এই প্রয়োগনির্ভরতা এবং মুক্তির স্বরূপস্বীকারকে বিজ্ঞানের দুটো প্রধান দিক বলে মানতেই হবে, কেননা এর থেকে বিচুত হলে বিজ্ঞানকে লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হতে দেখা যায়। যেমনটা হয়েছে আজকের যুগে : সামাজিক অর্থে প্রয়োগভ্ৰষ্ট ও মুক্তি সম্বন্ধে ভ্ৰান্তবিশ্বাস-বিলাসী তথাকথিত বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের যে সংকট গত কয়েক বছর থেকে অত্যন্ত প্ৰকট হয়ে পড়েছে, তাকে ধামাচাপা দেবার উপায়ও আজ যেন নিঃশেষ।

মানুষের সেই আদিম সমাজে, সভ্যতার ওই সুদূর ও নিম্নতর স্তরে, মানুষের সংস্কৃতি কেমন করে এই সুস্থ চেতনার ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল? সমস্যা সন্দেহ নেই। এবং বুর্জোয়ার চুলচেরা বিচারেও এ সমস্যা সমাধানের কোনো মূলসূত্র পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, বুর্জোয়ার দৃষ্টিভঙ্গিই সংকীর্ণ, যে সংকীর্ণতা এই সমস্যা সমাধানের পরিপন্থী। বুর্জোয়ার দৃষ্টি ব্যক্তির ও ব্যষ্টির দৃষ্টি। এই দৃষ্টিতে আদিম সমাজকে বুঝতে পারাই সম্ভব নয়, কেননা সে সমাজ শ্রেণীহীন সমাজ, যেখানে জীবন সমবায়ের জীবন। সে সমাজের অন্তনিহিত স্বজনী উৎসকে বুর্জোয়ার দৃষ্টি আবিষ্কার করবে। কেমন করে? আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক সংখ্যাগণিতের সম্পর্ক নয়, অঙ্গর সঙ্গে অঙ্গীয় সম্পর্ক। তাই সমগ্র সমাজের কল্যাণ ছাড়া ব্যক্তিবিশেষের মাথায় কল্যাণ সম্বন্ধে আর কোনো কল্পনা আসা কঠিন। মুক্তির রূপ ব্যক্তি-বিশেষের কোনোরকম স্বার্থসিদ্ধি নয়। সমাজের শাসন তখন শ্রেণী-বিশেষের স্বার্থে অনুপ্ৰাণিত হয়নি, তাই মানুষের কাছে সমাজখৃঙ্খলা শৃঙ্খল-এর রূপ নেয়নি ৷ শৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলবার কথা তাই ওঠেই না। বরং এই শৃঙ্খলাকে স্বীকার করা, একে মেনে নেওয়া-তার মধ্যেই মানুষের মুক্তির একমাত্র সম্ভাবনা। একের স্বার্থ আর দশের স্বাৰ্থ পৃথক নয়, দশের সিদ্ধির সঙ্গে একের সিদ্ধির ঘনিষ্ঠ মেশামিশি। সমাজ-শৃঙ্খলা যখন শ্রেণীস্বার্থে রক্ষিত হয়ে শৃঙ্খলের রূপ নেয়, শুধু তখনই মানুষের পক্ষে এই শৃঙ্খলাকে ভাঙবার অন্ধ তাগিদ ওঠে। আদিম প্ৰাগবিভক্ত সমাজে এই তাগিদ ওঠবার কথা নয়। ওঠেওনি। তাই, তার সংস্কৃতির পিছনেও মুক্তি বলতে শৃঙ্খলাকে চিনতে শেখাই বুঝিয়েছে, যদিও অস্পষ্ট, যদিও অচেতনভাবেই।

আদিম প্ৰাগবিভক্ত সমাজের সংস্কৃতিতে প্রয়োগের তাগিদই বা অগ্ৰণী কেন? এর উত্তর জাদুঘরে গিয়ে সে-যুগের ভোঁতা হাতিয়ারগুলোর উপর চোখ বোলালেই বোঝা যায়। ওইরকম স্থূল হাতিয়ার হাতে সবাই মিলে পৃথিবীর সঙ্গে প্ৰাণপণ-সংগ্ৰাম করলে পরই কোনোমতে সবাইকার পক্ষে বাঁচতে পারা সম্ভব। তাই সংগ্রাম যতটুকু, ততটুকু প্ৰকৃতির সঙ্গেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্ৰাম নয়।

মানুষের উৎপাদন-শক্তি তখনো উদ্ধৃত্ত বলে কিছু সৃষ্টি করতে শেখেনি। বলেই একজনের শ্রমের উপর নির্ভর করে আর একজনের পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। মেহনতের দায় প্ৰত্যেকের উপরই, মেহনত ছাড়া জীবনের অর্থ নেই। প্ৰকৃতিকে জয় করবার তাগিদটাই আদিম মানুষের কাছে আদি ও অকৃত্রিম তাগিদ; নাচ আর ইন্দ্ৰজালের মধ্যে এই তাগিদের প্রকাশ। শ্ৰীমতী হ্যারিসন দেখাচ্ছেন, আদিম মানুষের সমাজে মানুষের বয়েস বাড়ার আর এক নাম হলো নাচের সংখ্যা বাড়া, নাচে যোগ দিতে না পারাটা চরম লজ্জার লক্ষণ, বার্ধক্যের দরুন নাচে যোগ দিতে না পারলে মানুষ আপন কপালে করাঘাত করে; জীবনধারণের আর কোনো অর্থ খুঁজে পায় না।

প্ৰকৃত বিজ্ঞানের এই মূল ভিত্তিতে–প্ৰয়োগ-প্ৰাধান্য আর মুক্তির স্বরূপবোধে–সুদূর অতীতের অসভ্য মানুষ অচেতনভাবে আশ্রয় পেয়েছিল তার সমাজ-সংগঠনের দরুন। তারপর শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ইতিহাসে মানুষ যখন ডাক শুনেছে শোষণের পালা শেষ করে দেবার, তখন আবার বিকশিত হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সঙ্গে বস্তুবাদের উপর ঝোঁকও। যেমনটা দেখতে পাওয়া যায় য়ুরোপে, মধ্যযুগ শেষ হয়ে নতুন যুগ শুরু হবার সময়। ইংলেণ্ডে বেকন-হবস, ফরাসী দেশের বস্তুবাদীর দল। কিন্তু ইতিহাসের অগ্রগতির মধ্যে দিয়ে দেখা গেল অতি মারাত্মক ধাঙ্গাবাজি লুকোনো ছিল সে-ডাকের পিছনে; এ-ডাক শোষণের পালা শেষ করবার আহবান নয়, একজাতীয় শোষণের বদলে আর একজাতীয় শোষণকে কায়েম করবার ডাক। আর, এই কথা সমাজের মধ্যে যতই প্রকট হতে লাগল, ততই ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো বিজ্ঞানের সংকট। হাজার রকম কলাকৌশলের উন্নতি সত্ত্বেও, লক্ষ রকম চোখ-ধাধানো আবিষ্কারের কান-ফাটানো খবর রটিয়েও, আজ বিজ্ঞানের এই সংকট সম্বন্ধে খবরটুকুকে চাপা দেবার কোনো উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। বিজ্ঞানের মধ্যে জায়গা জুড়ে বসতে চাইছে ভাববাদ। নিছক গবেষণারোয় সংকীর্ণ গণ্ডিটুকুর মধ্যে যতটুকু প্ৰয়োগ, তার উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে চাইল বিজ্ঞান, সামাজিক মেহনতের বিরাট পটভূমি আর বিজ্ঞানের পটভূমি হয়ে থাকতে পারল না।

সোভিয়েট বিপ্লবের মধ্যে শোনা গেল শোষণের পালা শেষ করবার ডাক। কিন্তু এ ডাক একজাতীয় শোষণ শেষ করে নতুন জাতের শোষণ পেশ করবার অভিসন্ধি নয়। সামাজিক মেহনতের হারানো পটভূমি ফিরে পাওয়া গেল বিজ্ঞানে, ঘোষিত হলো নিঃসংকোচ বস্তুবাদের জয়। তার ভিত্তিতে প্ৰয়োগ, সমষ্টির চেতনা আর মুক্তির স্বরূপ উপলব্ধি। আর তারই প্রেরণায় দিকে দিকে আজ মিলিত মহামানবের অগ্ৰগতি আগামী নিঃশ্ৰেণীক সমাজের দিকে-এই সমাজে বিজ্ঞান হবে সংকটমুক্ত, সমবেত মানবজীবনের উৎস থেকে প্রেরণা সঞ্চয় করে বিজ্ঞান আবার প্রতিষ্ঠিত হবে সুস্থ বস্তুবাদী ভিত্তির উপর।

তবু, আগামী কালের বিজ্ঞান অতীতের ইন্দ্ৰজালের স্তরে নিশ্চয়ই ফিরে যাওয়া নয়। তার সহজ কারণ, আগামী কালের নিঃশ্রেণীক সমাজ অতীতের অবিভক্ত শ্রেণীহীন সমাজের পুনরুক্তিমাত্র নয়। সমবায়ের দিক থেকে, মিলেমিশে একসঙ্গে থাকার দিক থেকে, মিল থাকলেও এ দুইয়ের ঐশ্বর্যে একেবারে আকাশপাতাল তফাত। অতীতের অবিভক্ত সমাজের কাহিনী নিতান্তই দারিদ্র্যের কাহিনী; মানুষ তখন স্থূল হাতিয়ার হাতে প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে প্ৰবৃত্ত, তার বাস্তব সাফল্য নেহাতই সংকীর্ণ–তাই দৈন্যের আর অভাবের অন্ত নেই। ওই অক্তাবের প্রতিষেধক হিসেবে মানুষ খুঁজেছে ইচ্ছাপুরাণ-বাস্তব বিজয়ের ফাকিটুকু কল্পনার বিজয় দিয়ে ভরাট করবার চেষ্টা। বজের ডাক-কে আয়ত্ত করে বজের শক্তিকে আয়ত্ত করার কথা। ইন্দ্ৰজালের এইটেই হলো আসল দৈন্য–এই ইচ্ছাপূরণ। দীন সমাজের প্রতিচ্ছবিইন্দ্ৰজালের মধ্যেও অনেকখানি দৈন্য না থেকে উপায় কী? এই দৈন্তের দরুনই, এই ইচ্ছাপূরণের চাপেই, ইন্দ্ৰজালের বস্তুবাদী ভিত্তিটুকু নেহাত অস্পষ্ট এবং অচেতন। আগামী নিঃশ্ৰেণীক সমাজের বাণী হলো প্রাচুর্যের বাণী-তাই দৈন্তের চাপ নেই তার তত্ত্বজিজ্ঞাসায়, আগামী কালের বিজ্ঞানে। সে বিজ্ঞান সুস্থ আর সংস্কারমুক্ত। তার বস্তুবাদী ভিত্তি স্পষ্ট ও সচেতন।

ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম। কেমনভাবে, ঠিক কোন প্রভাবের ফলে মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসে এই পরিবর্তন এল? এই পরিবর্তনকে বোঝবার কোনো উপায় নেই। বুর্জোয়ার দৃষ্টি দিয়ে। কেননা বুর্জোয়ার দৃষ্টিকোণ অনিবাৰ্যভাবেই ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিকোণ, অথচ সংস্কৃতির স্তরে এই পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবিমাত্র; তাই সামাজিক পরিবর্তনটুকুই ঐখানে একমাত্র মূলসূত্র।

সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতি। ইন্দ্ৰজালের মৃত্যু এবং ধর্মের জন্ম-এই দুয়ের মূলসূত্রই পাওয়া যাবে এই সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতির মধ্যে। একের সঙ্গে দশের সম্বন্ধ আর অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ নয়, একের আর দশের জীবন-সমস্যা নয় অদ্বৈত। একের অনুপ্রেরণা আর দশের অনুপ্রেরণা হলো বিভিন্ন, বিচ্ছিন্ন হলো একের সিদ্ধি আর দশের সিদ্ধি। আদিম সাম্যাবস্থাই ছিল অতীত ইন্দ্ৰজালের মূল উৎস। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্ৰাম নয়, মানুষের সঙ্গে সংগ্ৰাম শুধু প্ৰকৃতির। এক অখণ্ড সমগ্রতার মধ্যে মানুষের জীবন, তার সংস্কৃতিটুকুও এই জীবন থেকে বিচ্যুত নয়। তাই সংস্কৃতিটুকুও সংগ্রামেরই অঙ্গ। ইন্দ্ৰজাল তাই প্রয়োগপ্ৰধান। আবার, সমাজ-জীবনে অখণ্ড সমগ্রতা বলেই মুক্তির যে অচেতন আদর্শ ইন্দ্ৰজালের অন্তরালে, তা শৃঙ্খলাকে ভাঙবার আদর্শ নয়,-শৃঙ্খলাকে স্বীকার করার মধ্যেই মুক্তি। তাই সংস্কৃতি হিসেবে ইন্দ্ৰজালের যে-দুটো প্ৰধান বৈশিষ্ট্য, তার মূলে রয়েছে সামাজিক অখণ্ডতার চেতনা। এই আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতির মধ্যেই ইন্দ্ৰজালের মৃত্যুরহস্য।

শুধু ইন্দ্ৰজালের মৃত্যুরহস্যই নয়, ধর্মের জন্মরহস্যও। আদিম সাম্যাবস্থাবিচ্যুতির বিভিন্ন দিকগুলির স্বতন্ত্র উল্লেখ করা যাক, দেখা যাবে প্রত্যেকটি দিকই কীভাবে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ধর্মের জন্মকে সম্ভব করেছে। প্রথমত, প্রয়োগের প্রাধান্য আর টিকল না। প্ৰকৃতির সঙ্গে সমবেত মানুষের সংগ্রামের বদলে দেখা দিল মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্ৰাম। একদল মানুষের ঘাড়ে পড়ল উৎপাদনের সমস্ত দায়। কিন্তু তারা সমাজের সদরমহলে নয়, অন্দরমহলে। তাই সমাজের সদরমহল থেকে বাদ পড়ল মেহনতের কথা। শ্রমের কথা বাদ দিয়ে প্ৰকৃতির ব্যাখ্যা খোঁজবার চেষ্টা। প্ৰকৃতির নানান বিভাগের অধিষ্ঠাতা-অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে দেখা দিল হরেক রকম দেবদেবীর কল্পনা। সভ্যতার সদর মহলে মানুষের মন ঝুঁকল ধর্মের দিকে। কিন্তু কোন মানুষের? মানুষ তো আর আগেকার মতো শুধু এক রকমের নয়, দু-রকমের। শাসক আর শাসিত, শোষক আর শোষিত। শুধু শাসকের, শুধু শোষকের মাথা খাটাবার ঢালাও অবসর। মাথা খাটিয়ে পাওয়া দেবদেবীর উপাখ্যান। আর তাই, শাসক-শ্রেণীর চেতনায় জন্ম বলেই, এই সব প্রথম দেব-দেবীগুলি শাসকশ্রেণীর প্রতিকৃতিমাত্ৰ।

প্রথমত, এইসব দেব-দেবীগুলি সকলেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জীব। এই ব্যক্তিত্ব-চেতনা আদিম সাম্যাবস্থায় ছিল না, থাকবার কথা নয়। কেননা একের চেতনা তখন দশের চেতনার সঙ্গে মিশে এক অখণ্ড সমগ্রতার রূপে বিরাজ করছে। কিন্তু, শ্রেণীবিভাগের পর, শাসকের ব্যক্তিত্ব বাকি সকলোয় উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তাই এই ব্যক্তিত্ব প্ৰতিফলিত হয়েছে তার কল্পনা দিয়ে গড়া দেব-দেবীগুলির মধ্যেও।

দ্বিতীয়ত, শাসক-শ্রেণীর মানুষের খামখেয়ালী বৃত্তি এই সব দেব-দেবীগুলির মধ্যে অল্পবিস্তর প্রতিফলিত। শাসকের মতোই অসীম শক্তি এই দেবতাদের; তবু তাদের কাছে ভিক্ষে চাইলে ভিক্ষে মিলতে পারে, স্তবস্তুতির খোশামোদে তাদের মন গলাবার সম্ভাবনা, নৈবেদ্যর ঘুষ পেলে তারা সিদ্ধি দিতেও পারে। খোশামোদ-প্রিয় আর লোভী। এই সব প্ৰথম দেব-দেবীর দল-এর মধ্যেই পাওয়া ষাবে পৃথিবীর প্রথম শাসক-শ্রেণীর প্রতিচ্ছবি।

তবু প্ৰকৃতির অধিষ্ঠাতা আর অধিষ্ঠাত্রী হিসাবে কল্পিত হলো কেন? কেননা অপেক্ষাকৃত উন্নত হাতিয়ারের কৃপাতে মানুষের উৎপাদনশক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি। হলেও তখনও মূল সমস্যা প্ৰকৃতিকে নিয়েই-প্ৰাকৃতিক শক্তির সামনে মানুষ প্ৰায় তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎ হয়েই রয়েছে। প্রকৃতিকে নিয়ে যে সমস্যা, আদিম সাম্যাবস্থায় মানুষ তার সমাধান করতে চেয়েছিল প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্ৰাম করে, এই শক্তিগুলিকে জয় করে। কিন্তু সংগ্রামের কথা আর শ্রেণীসমাজে প্রাধান্য পেল না, কেননা তখন কর্ম হয়েছে অপ্রধান, প্ৰাধান্য পেয়েছে জ্ঞান। তাই প্ৰাকৃতিক শক্তি নিয়ে যে সমস্যা, শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের সভ্য মানুষ সে সমস্যার সমাধান করতে চাইল অন্যভাবে। এই শক্তিগুলিকে বাস্তবিক জয় করার চেষ্টা না করে নিজের মনকে, চেতনাকে এমনভাবে বদল করা, যাতে প্ৰাকৃতিক শক্তিগুলি আর শক্রদ্ধাপে দেখা না দেয়। অৰ্থাৎ, নিজের কল্পনাকে আর আবেগকে এমনভাবে পরিবর্তন করে নেওয়া, যাতে অন্তত এইটুকু সাত্মনা জুটবে যে, প্ৰাকৃতিক শক্তিগুলির সঙ্গে মানবমনেরই আত্মীয়তা-এইভাবে বিরোধী শক্তিগুলিকে মিত্র কল্পনা করে মানুষ বুঝি এদের হাত থেকে নিস্তার পাবে। তাই, এই সব আদিম দেব-দেবীর দল-মূলে প্ৰাকৃতিক শক্তি সম্বন্ধে কল্পনা হলেও-শোষক শ্রেণীর চেতনারই ছাচে ঢালা তাদের রূপ। এর মধ্যে প্ৰাকৃতিক শক্তির কাল্পনিক প্ৰতিবিম্ব তো আছেই; কিন্তু শুধু সেইটুকুই নয়, শোষক শ্রেণীর নিজেদের রূপ অনুসারে রূপান্তরিত।

ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে ধর্ম। এই ধর্ম শোষকের চিন্তা আর কল্পনা দিয়ে গড়া। তাই এর সঙ্গে শোষক-শ্রেণীর স্বার্থের কথাটাও জড়িত রয়েছে। ধর্মের দরুন শোষক-শ্রেণীর স্বাৰ্থসিদ্ধিটা কী রকম? শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শোষিত জনগণকে শাসনে রাখার জন্যে আধ্যাত্মিক অন্ত্রের উপযোগিতা অসামান্য। স্বৰ্গ-নরক, পাপ-পুণ্য, ইহলোকের অন্নের বদলে পরলোকে পরমামের আশ্বাস, এমনি কতই কী। ধর্ম শিখিয়েছে, সংগ্রামের বদলে প্রার্থনার উপযোগিতা; শাসকের কাছ থেকে যদি কিছু পেতেই হয়, তা নেহাতই ভিক্ষার দান, চাটুকারিতার বখশিশ, ঘুষের ফল। ধর্মকে তাই জনগণকে আয়ত্তে রাখবার আফিম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ আফিমের ঘোর জনগণের মনকে নেহাতই নিরাপদ, নেহাতই নিরুপদ্রব করে রাখবে।

 

শ্ৰেণীবিভক্ত সমাজ। ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে ধর্ম। শাসক-শ্রেণীর একটি অস্ত্ৰ এই ধর্ম। প্ৰাকৃতিক শক্তির কাল্পনিক প্ৰতিচ্ছবি-শাসক-শ্রেণীর ছাচে ঢালা প্ৰতিচ্ছবি-এই ধর্মের প্রাণবস্তু হলেও বাস্তব হাতিয়ার হিসেবে শাসক-শ্রেণীর কাছে এর মূল্য বড় কম নয়। অবশ্য শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের যে রকম ইতিহাস আছে, সেইরকমই ইতিহাস আছে ধর্মেরও। শ্ৰেণীসমাজের কাঠামোর মধ্যে যুগে যুগে উৎপাদনশক্তির রূপ বদলে যাবার ফলে এতদিন পর্যন্ত শোষণের রূপ, সমাজ-ব্যবস্থার রূপ নানানভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। তাই পরিবর্তিত হয়েছে শোষণের জন্যে অনিবাৰ্যভাবে উপযোগী এই আফিমের রূপও।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আফিমকে জনগণ আমনভাবে মেনেই বা নিল কেন? শাসক-শ্রেণীর স্বার্থে প্রণোদিত, শাসক-শ্রেণীর কল্পনাপ্ৰসুত এই ধর্মকে শোষিত জনগণ স্বীকার করতে গেল কেন? ইতিহাসের সেই সুদূর অতীতকে খুঁড়তে পারলে হয়তো দেখা যাবে যে, যতটা সহজে ধর্মকে মেনে নেবার ব্যাপারটা সাধারণত প্রচার করা হয়, আসলে ঘটনাটি অত সহজ সত্যিই ছিল না। অনেক জায়গায় জনগণ অনেকভাবে এই ধর্ম-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিল, বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল। তার কিছু কিছু স্বাক্ষর আজও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি। তবু, মোটের উপর এ কথায় কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই ধর্ম-বিশ্বাসকে জনগণ শেষ পৰ্যন্ত স্বীকারই করে নিয়েছে। কেমন করে তা সম্ভব হলো? উত্তরে মনে রাখতে হবে আদিম সাম্যাবস্থাবিচ্যুতির পটভূমি। এই বিচ্যুতির ফলে আদিম সমবেত জীবনে যে নিশ্চয়তা, তারও বিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী। একের ভাগ্য যখন দশের ভাগ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধে যুক্ত, তখন সুনিশ্চিত সাহসে মানুষ বুক বাঁধতে পারে; অনিশ্চয়তার কথা তেমন ওঠে না। কিন্তু মানুষ যখন একা, প্ৰকৃতির বিরাট শক্তির সামনে সে তুচ্ছ আর অকিঞ্চিৎ। এখানে বাস্তব তুচ্ছতা অকিঞ্চন তার কথা বলছি না, তুচ্ছতা-বোধ আর অকিঞ্চনাত-বোধের কথা বলছি। আদিম সাম্যাবস্থায় মানুষের উৎপাদনশক্তি অনেক অনুন্নত ছিল; তাই বাস্তবভাবে দেখতে গেলে প্ৰকৃতির বিরাট শক্তির সামনে মানুষ অনেক বেশি তুচ্ছ, অনেক বেশি অসহায়। তবু, অসহায়বোধ তখন তেমন প্ৰকট হয়ে পড়েনি, যে-রকম প্ৰকট হয়ে পড়ল অপেক্ষাকৃত উন্নত উৎপাদন-প্ৰণালীর সমাজে-শ্রেণী-সমাজে। কেননা, শ্রেণী-সমাজের আগে, এই সাম্যাবস্থায়, একের জীবন যখন দশের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধে যুক্ত, তখন দশের প্রেরণা একের প্রেরণার মধ্যে সঞ্জীবিত। আর সমবায় জীবন থেকে সঞ্জাত এই প্রেরণা বাস্তব অসহায়তা সত্ত্বেও মানুষের মনকে পঙ্গু হতে দেয়নি, মানুষের অসহায়-বোধ প্রকট হতে পারেনি। দশের প্রেরণা একের প্রেরণাকে সঞ্জীবিত করেছে, আর তাই মানুষ দশের সঙ্গে মিলে কোমর বেঁধে লেগেছে অসাধ্য সাধনের কাজে, প্ৰকৃতিকে জয় করবার কাজে ৷ প্ৰকৃতির বিরাট শক্তির সামনে ভীত মানুষ হাটু গেড়ে করুণ প্রার্থনার ভঙ্গি গ্ৰহণ করেনি-মিনতি জানাতে চায়নি। সেই শক্তির কাছে, চায়নি তার করুণার উদ্রেক করতে। দল বেঁধে এক সঙ্গে এই শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করছে মানুষ, এমন-কী বাস্তব বিজয়ের প্রকাণ্ড অসম্পূর্ণতাটা কাল্পনিক বিজয় দিয়ে পূরণ করে নিতে চেয়েছে। কিন্তু কেঁদে পড়েনি, ভিক্ষে চায়নি। কেঁদে পড়া, ভিক্ষা চাওয়া, অসহায়ের মতো করুণা প্রার্থনা করা-সমবেত জীবনের পরিপূর্ণতার মধ্যে এসবের স্থান নেই।

শ্ৰেণী-সমাজের আওতায় জনগণের মধ্যে এই যে অসহায়-বোধ, একে যেন ইন্ধন জোগাল নতুন এক ধরনের দুৰ্যোগ, নতুন এক ধরনের অনিশ্চয়তা। আগে ছিল শুধু প্ৰাকৃতিক দুৰ্যোগ, শ্রেণী-সমাজে তার উপর জুটল সামাজিক দুৰ্যোগও। বৃষ্টি না হলে ফসল ফলবে না, মানুষের পেট ভরবে না; দল বেঁধে বৃষ্টির নাচ নেচে, কল্পনায় বৃষ্টি পেয়ে দল বেঁধে দ্বিগুণ উৎসাহে ফসলের সন্ধান করা-এই হচ্ছে ইন্দ্ৰজাল। কিন্তু বৃষ্টি পড়ল, ফসল ফলল, তবু মানুষের পেট ভরল না-এ হলো এক নতুন ধরনের অনিশ্চয়তা। অনাবৃষ্টির অনিশ্চয়তার উপর আর এক রকমের অনিশ্চয়তা যোগ করে দেওয়া। মানুষের মনের অসহায়বোধকে দ্বিগুণ করে তোলা। সমবেত জীবন থেকে কোনো প্রেরণারই সঞ্চয় নেই। ভিক্ষাপাত্রই বুঝি একমাত্র সম্বল, শাসকের কৃপা জাগাতে পারা ছাড়া কোনো পথই চোখে পড়ে না। মানুষের মন ধর্মের দিকে ঝুঁকবে বই-কী।

তারপর, সেই প্ৰথম সভ্য সমাজের পর থেকে আজ পর্যন্ত শ্রেণী:সমাজ। উৎপাদন-প্ৰণালীর হাজার উন্নতি সত্ত্বেও এই সামাজিক অনিশ্চয়তার হাত থেকে মানুষ মুক্তি পায়নি। তাই ধর্মের হাত থেকেও নয়। অসহায় মানুষ জীবনে বিধ্বস্ত হয়ে করুণা ভিক্ষা করেছে উচ্চতর শক্তির কাছে। সমবেত জীবন ফিরে না। আসা পৰ্যন্ত এই অসহায়তা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। তাই, ধর্মের হাত থেকেও নয়। সমাজের গভীরে ধর্মের এই বীজ লুপ্ত থাকার দরুন। এতদিনকার খাপছাড়া সব রকম নাস্তিক্যবাদ বিফলে গিয়েছে। সমবেত জীবন ফিরে পাবার আগে পৰ্যন্ত ধর্মের হাত থেকে মানুষের প্রকৃত মুক্তি নেই; অর্থাৎ এক কথায় গণ-বিপ্লব। এই বিপ্লব সোভিয়েট দেশে সাম্য-জীবনের আগমনী শুনিয়েছে। তাই, ধর্মের হাত থেকেও নিষ্কৃতির পথ দেখিয়েছে মানুষকে। তবু অতীত ইন্দ্ৰজালের স্তরে ফিরে যাওয়া নয়। অনেক অনেক উন্নত উৎপাদন-প্ৰণালী এসেছে মানুষের কবলে। তাই প্ৰকৃতিকে আসল জয় করবার অভাবটা কল্পনায় জয় করা দিয়ে পূরণ করে নেবার চেষ্টা নয়-ইন্দ্ৰজাল নয়। বিজ্ঞান। সংস্কারমুক্ত সুস্থ বিজ্ঞান। ইন্দ্ৰজালের মূল ভঙ্গি যেন অনেক অনেক উঁচু স্তরে উন্নীত।

ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম। শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীসমাজ। এই পটভূমিকে মনে রাখতেই হবে। বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিক-কলাকৌশলের দিক থেকে যত আশ্চৰ্য প্ৰতিভার অধিকারীই তিনি হোন না কেন-এই পটভূমির কথা মনে রাখেন না। তাই ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে ধর্মে পৌঁছোনোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেষ পৰ্যন্ত কয়েকটি কাল্পনিক কথার উপর তাকে নির্ভর করতে হয়।

স্যার জেমস্‌ ফ্রেজারের কথাই আবার উল্লেখ করছি। ধর্মের জন্মের মূলে মানুষের মনে যে এক অভূতপূর্ব অসহায় ভাব জেগেছিল, সে-কথা তিনি অনুভব করতে পারেন : “আমাদের সেই আদিম দার্শনিকট তার প্ৰাচীন বিশ্বাসের লিঙ্গর থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর, সংশয় এবং অনিশ্চয়তার দুৰ্যোগময় সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে তার নিজের উপর আর নিজের শক্তির উপর পুরোনো সুখের আস্থা নির্মমভাবে ঝাকুনি খাবার পর, নিশ্চয়ই করুণভাবে হতভম্ব ও বিচলিত হয়ে পড়েছিল; শেব পর্যন্ত সে শান্তি পেল ঝোড়ো সমুদ্রে পাড়ি শেষ করে এক শান্ত স্বৰ্গে পৌছে, বিশ্বাস আর কর্মের এক নতুন শৃঙ্খলা খুঁজে পেয়ে, যে শৃঙ্খলা অমন ঝঙ্কাটময় সংশয়ের একটা সমাধান তাকে দিতে পারুল, দিতে পারল প্ৰকৃতির উপর যে আধিপত্যকে সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ত্যাগ করেছে, তারই একটা বিনিময়, বিনিময়টা যতই ঠুনকো হোক না কেন।” কিন্তু প্রশ্ন ওঠে; সহস্ৰ বছর ইন্দ্ৰজাল অভ্যাসের পর হঠাৎ এক সময়ে স্তর ফ্রেজারের ‘আদিম দার্শনিকটর’ মনে এই অসহায় ভাবে জাগল কেন, হঠাৎ বা কেন সে “প্ৰকৃতির উপর আধিপত্য” “ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিত্যাগ” করল? অর্থাৎ, ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে মানুষ কেন এল ধর্মের আওতায়? এ প্ৰশ্নকে ফ্রেজার অগ্রাহ করেননি। কিন্তু তার দৃষ্টি বুর্জোয়ার দৃষ্টি, সংস্কৃতির সমস্ত ইতিকথাই সে-দৃষ্টিতে ব্যক্তি-বিশেষের অবদান। তাই তিনি উক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলছেন, প্রাচীনকালের “ধূৰ্ততর বুদ্ধিমানেরা” হঠাৎ যেন আবিষ্কার করল ইন্দ্ৰজালের বন্ধ্যাত্বি; বৃষ্টির নাচ নাচলে সত্যিই বৃষ্টি হবার কথা নয়। আর তাই এত অশান্তি, শেষ পৰ্যন্ত ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে ধর্মের দিকে অগ্ৰগতি? সংস্কৃতিকে শুধু ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি বলে ধরে নিলে এই রকম অর্থহীন। “হঠাৎ” দিয়ে বিজ্ঞানের অনেক ফাঁক পূরণ করতে হয়!

তবু প্রশ্ন ওঠে, সহস্ৰ বছর ধরে এমন-কী একজনও বেরুল না, যে ধরতে পারল ইন্দ্ৰজালের বন্ধ্যাত্বি? অতি বছর ধরে, অমন একটানাভাবে ইন্দ্ৰজাল টিকল কেমন করে? এ প্রশ্ন ফ্রেজার নিজেই তুলেছেন আর জবাবে বলেছেন : অনেক সময় ইন্দ্ৰজাল অনুষ্ঠানের পর বাস্তবিকই হয়তে হঠাৎ বাঞ্ছিত ফল ফলত। বৃষ্টি তো এমনিতেই মাঝে মাঝে হয়; হঠাৎ হয়তো ইন্দ্ৰজাল অনুষ্ঠানের পর–কিন্তু ইন্দ্ৰজাল অনুষ্ঠানের দরুন নয়, প্ৰাকৃতিক নিয়মেরই দারুন–আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরল। আর তাই মানুষের মনে বদ্ধমূল হলো ইন্দ্ৰজালে বিশ্বাস।

সমাজের পটভূমি তুচ্ছ করে শুধু খাপছাড়া আপতনের উপর নির্ভর করতে যাওয়া। অথচ, স্পষ্টই দেখা যায়, শুধু এই ক্ষীণ আর আপতিক অনুষঙ্গের সূত্র দিয়ে সহস্ৰ বছর ধরে মানুষের পক্ষে ইন্দ্ৰজালে বিশ্বাসের সঙ্গে বাধা থাকবার প্ৰসঙ্গ প্ৰায় হাস্যকর। হাজার বছর ধরে মাত্র কয়েকটি আচমকা ঘটনায় মোহিত হয়ে এবং লক্ষ লক্ষ বিরুদ্ধ দৃষ্টান্তকে অগ্ৰাহ করে মানুষের মনে টিকে রইল ইন্দ্ৰজালে বিশ্বাস! অথচ, সামাজিক পটভূমিটুকু মনে রাখলে এখানে কোনোরকম রহস্য থাকে না। হাজার বছর ধরে মানুষের মন ইন্দ্ৰজালে আস্থাবান ছিল, কেননা হাজার বছর ধরে ইন্দ্ৰজাল সত্যিই প্ৰকৃতিকে জয় করবার পথে তাকে সাহায্য করেছে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের মানুষ, শ্রেণীসমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে ইন্দ্ৰজালের এই বাস্তব অর্থক্রিয়াকারিত্ব বুঝবে কেমন করে? ইন্দ্ৰজালকে আজ শুধু বন্ধ্যা ভ্ৰাস্তির ভূপ বলে মনে হয়, কেননা ইন্দ্ৰজালকে আমরা আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষায় দেখতে চাই। আজকের দিনে কেউ যদি শিকার-নৃত্য করে, তাহলে তার শিকার সমাধা হবার বাস্তব সম্ভাবনা বাড়বে না। কিন্তু আদিম মানুষের বেলায় তো তা নয়। কেননা, তার জীবন সমবায়ের জীবন-একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। ইন্দ্ৰজালের অনুষ্ঠান কোন মানুষের একার অনুষ্ঠান নয়, সমগ্ৰ সমাজের অনুষ্ঠান। তাই এই অনুষ্ঠান থেকে ষে প্রেরণা উদ্দীপ্ত, তা সমগ্ৰ গোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চারিত। বৃষ্টির নাচ। নাচতে নাচতে সমগ্ৰ গোষ্ঠীর সামনে দুলে উঠল বৃষ্টির ছবি-চোখের সামনে সেই ছবির প্রেরণা। ফসল জুটছে, ফসল জুটবেই, জুটবেই, জুটবেই-এই প্রেরণায় সঞ্জীবিত হয়ে পুরো দল যখন ফসলের সন্ধানে বেরুল, তখন তার বাস্তব সাফল্য অনেক বেশি সম্ভবপর।

তাই যতদিন আদিম অবিভক্ত সমাজ, ততদিন পৰ্যন্ত ইন্দ্ৰজাল বন্ধ্যা নয়, মিথ্যা নয়, মূখীতা নয়। তার বাস্তব মূল্যও অনেকখানি, অনেকখানি তার অবদান বাস্তব সাফল্যের পথে। তারপর সেই আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতিএই বিচ্যুতির মধ্যেই ইন্দ্ৰজালের মৃত্যু : অবিভক্ত সমাজে ইন্দ্ৰজাল যে বাস্তব সাফল্যের সহায় ছিল, বিভক্ত সমাজে আর তা রইল না। মানুষের জীবনে দেখা দিল অনিশ্চিত আর অসহায় ভাব। তাকে অবলম্বন করেই জন্ম হল ধর্মের।

ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম : কোনো কল্পিত আদিম দার্শনিকের আকস্মিক আবিষ্কার নয়, সামাজিক পরিবর্তনেরই প্ৰতিচ্ছবি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *